আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের দার্শনিক ও সামাজিক ভিত্তি
১৪ মার্চ ২০২৩ ১২:১৩
দ্য লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের ভাষ্য মতে, ১৯০৫ সাল ছিল ল্যাটিন ভাষায় “অ্যানাস মিরাবিলিস” অর্থাৎ অলৌকিক বছর, যে বছরে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি শেষ করেন এবং বিজ্ঞানের ওপর চারটা গবেষণাপত্র লেখেন যার থেকে জন্ম নেয় পদার্থবিজ্ঞানের কালজয়ী কিছু আবিষ্কার। আজ বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানীর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে থাকছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের দার্শনিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর আলোচনা।
মাত্র ২৬ বছর বয়সে “Annalen der Physik” নামে এক জার্নালে ঐ গবেষণাপত্রগুলো যখন প্রকাশিত হয় তখন আইনস্টাইন ছিলেন সামান্য এক পেটেন্ট অফিসের কেরানী। চারটি গবেষণাপত্রের প্রথমটি ছিল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের ওপর, যার ফলাফল হিসেবে হাল আমলে আমরা পেয়েছি সৌরশক্তির ব্যবহার; দ্বিতীয়টা ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত, যা থেকে আমরা বুঝি জলের ওপর যে ধুলার মত এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র ডাস্ট এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, সেটি অতি সূক্ষ্ম চলমান আণবিক কণিকার তৈরি, যার ফলশ্রুতিতে ঐ ডাস্টগুলো সামনে-পেছনে দোল খায়।
আইনস্টাইনের তৃতীয় গবেষণাপত্রটি ছিল সবচেয়ে কালজয়ী সৃষ্টি যা থেকে জন্ম নিয়েছে থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এর শিরোনাম ছিল “On the Electrodynamics of Moving Bodies” যেটা দেখিয়েছে কীভাবে বিভিন্ন গতিতে চলমান দর্শকের কাছে বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর আর সময়ের প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে পড়ে। আলোর বেগে চলমান বস্তুর সাথে কম গতিশীল বস্তুর এসব রাশিগুলোর পরিমাপে কীভাবে পার্থক্য সৃষ্টি হয়, কতটুকুইবা পার্থক্য হয়। সকল অবস্থায় আলোর গতি ধ্রুবক, এটিও আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ফলাফল।
এর দুটি প্রধান উপপাদ্য ছিল,
১) সমবেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলী অভিন্ন।
২) শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সমস্ত পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে একই এবং তা আলোর উৎস ও পর্যবেক্ষকের গতির সাথে নিরপেক্ষ।
আইনস্টাইনের এই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের ১০ বছর পর স্থান, কাল নিয়ে নিউটনের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে নতুন এক বিশ্ব-জাগতিক ধারণার জন্ম হয় যা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব নামে পরিচিত। এখানে স্থান-কালের পরমত্ম শেষ হয়ে শুরু হয় এক নতুন বাস্তবতা। সাথে সাথে ইউক্লিডের জ্যামিতি বিদায় নিয়ে তৈরি হয় নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি। স্থান-কালের ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা থেকে স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক এক নতুন বিশ্বে পৌঁছায় মানুষ। কাল হয়ে পড়ে স্থানের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। এ যেন সেই কবিতার মত, “যে কাল পেছনে ছিল, যে কাল সম্মুখে ফিরে আসে”।
চতুর্থপত্রটি ছিল বস্তুর জড়তা ও শক্তির সম্পর্ক বিষয়ক যা থেকে তিনি বস্তুর ভর আর শক্তি সংক্রান্ত কালজয়ী সমীকরণ “E = mc2” আবিস্কার করেন। তিনি দেখান শক্তি হল ভরের সাথে আলোর বেগের বর্গের সমানুপাতিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, আইনস্টাইনের নতুন দার্শনিক পদার্থবিজ্ঞানের সামাজিক বাস্তবতা কী ছিল? বিশ শতকের শুরুতে পদার্থবিজ্ঞান আর দর্শনে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হল যার দরুণ এই নতুন দার্শনিক পদার্থবিজ্ঞান জন্ম নিলো?
একটি কথা স্মরণ করতে হবে, নতুন এই পদার্থবিজ্ঞান দর্শনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, তাই এটাকে বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের দর্শন বললে খুব একটা বেমানান হবে না। তবে আগেই মনে করিয়ে দেই, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের অতি দুর্বোধ্য বিষয়ের একটি যা আইনস্টাইন নিজেই স্বীকার করেছেন।
আইনস্টাইনের একজন বায়োগ্রাফার মি গরডোও গ্যাব্রেন্ডাইন লিখেছেন, ‘একবার এক আমেরিকান সাংবাদিক এই মহান পদার্থবিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার, একটা লাইনে আপনি আপনার আপেক্ষিক তত্ত্ব বলুন তো?” আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, আপেক্ষিক তত্ত্বের ছোট্ট একটা সংজ্ঞা দিতে গেলে অন্তত তিনদিন লাগবে। তিনি এটাও বলেছিলেন, গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পোক্ত ধারণা না থাকলে আপেক্ষিক তত্ত্ব বোঝা একেবারে অসম্ভব।’
আসলে অধিকাংশ মানুষের কাছে আপেক্ষিক তত্ত্ব ভীষণ রহস্যময়। আইনস্টাইনের পাঠকের অবস্থা অনেকটা বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের মতো। মার্ক টোয়েন নাকি একবার গণিতের একটা বই হাতে নিয়ে আদ্যোপান্ত পড়ে বলেছিলেন, আমি এই বইটার আগামাথা একটা শব্দও বুঝিনি। আসলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের নেটওয়ার্কের ভেতর যেসব বিষয় আছে আপেক্ষিক তত্ত্ব তার সাথে বেশি একটা খাপ খায় না। এক যুগ আগে, আমি আমার এক সহকর্মীর সাথে টাইম ডাইলেশন (T= T0/ √1- v2/C2) নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আইনস্টাইনের টুইন প্যারাডক্স নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে তিনি আমাকে নির্ঘাত পাগল সাব্যস্ত করলেন। বিষয়টা মোটেও অস্বাভাবিক না, কারণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ভীষণ সম্প্রত্যয়গত ব্যাপার। যেটি মেনে নিতে বহু এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট অনেক টালবাহানা করেছে।
মনে রাখা দরকার আইনস্টাইন সম্পর্কে বড্ড বিশ্রী ধরণের মিথ্যা আর গল্পগুজব সাজিয়ে অনেক বায়োগ্রাফারই বই লিখেছেন। এটা তার জীবদ্দশায়ই ঘটেছে। ১৯৪৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ম্যাক্স ব্রড নামে এক লেখককে তিনি লিখেছিলেন, “বাজারে তার সম্পর্কে গল্প বানিয়ে কল্পকাহিনী সাজিয়ে এত বাজে সব লেখা বানানো হয়েছে যে সেগুলোর প্রতি যদি নজর দেই তাহলে সেসব ফালতু বিষয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কবরে যেতে হবে।”
এর কারণ হিসেবে অনুমান করা যায় আইনস্টাইনের তত্ত্বগুলো এত দুর্বোধ্য আর আকর্ষণীয় ছিল যে, আপামর জনতা সেসব নিয়ে গল্প গোগ্রাসে গিলত। সত্যমিথ্যা পাকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়ে উঠেছিল এজন্য যে তিনি বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা নিউটনের পবিত্র মসনদে সরাসরি ঢিল ছুঁড়েছিলেন। যেমন, ওয়াল্টার আইজাকটন “আইনস্টাইন: হিজ লাইফ এন্ড ইউনিভার্স” বইয়ে লিখেছেন আইনস্টাইন নাকি তার সার্বিয়ান এক বন্ধুর কাছে একসময় বলেছিলেন, তার সমস্ত গাণিতিক সমস্যাগুলো তার স্ত্রী মিলেভা ম্যারিক্স সমাধান করে দিতেন। খুব সঙ্গত কারণেই তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়েও অনেক নিম্নমানের গল্প বানানো হয়েছে, গাণিতিক দুর্বোধ্যতা আর আপাত অসম্ভব্যতার জন্য অনেকে এই সুযোগ নিয়েছেন।
তবে এদিক থেকে বলা যায়, খুব নাম করা দার্শনিক ও যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদী ফিলিপ ফ্রাঙ্ক “আইনস্টাইন: হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস” নামে ১৯৪৭ সালে জার্মান ভাষায় একটি বই লিখেছিলেন যেটি অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ আর সুখপাঠ্য। তাছাড়া মরিজ শ্লিক নামে আরেকজন জার্মান দার্শনিক (যিনি পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে এক ছাত্রের গুলিতে নিহত হন) অতি উঁচু মানের একটা বই লিখেছিলেন “স্পেস টাইম ইন কনটেম্পোরারি ফিজিক্স” নামে। আপেক্ষিক তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে এর থেকে চমৎকার বই আর হয় না।
এসব বই থেকে আপেক্ষিক তত্ত্বের একটি দার্শনিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মরিজ শ্লিক পুরোমাত্রায় পদার্থবিজ্ঞানী হলেও দর্শন জগতে ছিলেন সমধিক পরিচিত। তিনি আইনস্টাইনের সাথে জড়িয়ে ছিলেন নানা কাজে বিশেষ করে আপেক্ষিক তত্ত্বের দার্শনিক অবস্থান পরিষ্কার করতে তিনি ভীষণ পরিশ্রম করেন। স্থান-কাল বিষয়ের সাথে মানুষের মনস্ত্বাত্বিক গাঁটছড়া নিয়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি দেখান যেহেতু এ দুটো সরাসরি মানুষের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিষয় তাই অভিজ্ঞতাপূর্ব পরম বা চরম ধারণার কোন জায়গা নেই। আদতে জগতটা “চেতনার রঙ্গে রঙিন”।
১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উলমের স্বাবিয়ান শহরের ব্যাভারিয়ার এক সাদামাটা পরিবারে আইনস্টাইনের জন্ম। তাঁর মা-বাবার জ্ঞাতির কেউই তেমন কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলেননা। তার জন্মের পরপরই তাঁর বাবা-মা মিউনিখে চলে যান। মিউনিখ ছিল সে সময়ের জার্মানির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আইনস্টাইনের বাবা হারমেন আইনস্টাইন ছিলেন ছোট্ট এক ইলেক্ট্রোক্যামিকাল ফ্যাক্টরির মালিক। অসফল একজন ব্যবসায়ী হলেও তার জীবন ছিল আনন্দে ভরপুর। মিউনিখে এমন এক সামাজিক পরিবেশে তিনি বড় হন যেখানে সেনাবাহিনীর লোকেরা নিয়মিত প্যারেড করত, এর থেকে তার মনের ওপর দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। একদিকে মানুষের তৈরি আইন-কানুনের ওপর বিতৃষ্ণা; অন্যদিকে প্রকৃতির গভীরে যে বিরাট নিয়মের জগত আছে তার প্রতি শ্রদ্ধা। ধর্মীয় আচরণ তাকে টানতে পারেনি বরং মনে হয়েছে এসব বাধ্যবাধকতা মানুষকে তার স্বাধীনতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জুরিখ পলিটেকনিক থেকে পাশ করার পর তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, যার ফলে চাকরি নেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। সেখানে বসেই তিনি ইতিহাস রচনা করেন পদার্থবিজ্ঞানের।
আইনস্টাইন নিঃসঙ্গ জীবন পছন্দ করতেন। নাজি অত্যাচার এবং বর্ণ বৈষম্যের অভিজ্ঞতা ছিল তার কাছে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট ফিলিপ লেনার্ড যিনি কিছুতেই আপেক্ষিক তত্ত্বকে মেনে নিতে পারেননি। তার চিন্তা-ভাবনা ছিল সিমেটিক ও সোশ্যালিস্ট চিন্তার ঘোরতর বিরোধী। ঠিক সেই সময় জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রথেনিউ খুন হন। রথেনিউ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছিল। রথেনিউয়ের মৃত্যুর পর জাতীয় শোক দিবস পালন করার জন্য বলা হলে লেনার্ড অস্বীকৃতি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সোশ্যালিস্ট তাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। এই ঘটনাটা আইনস্টাইনের থিওরি বিরোধিতা করার সম্পর্ক আছে। লেনার্ডের আপেক্ষিক তত্ত্ব বিরোধিতা করার প্রধান কারণ হল আপেক্ষিক তত্ত্ব মানুষের কাণ্ডজ্ঞান বিরোধী। লেনার্ড হিটলারের লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি কারসাজি। বলশেভিক পদার্থবিজ্ঞান ঐ দেশে ঢোকানোর একটা অপচেষ্টা। ১৯৩৩ সালে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকার সময় হিটলারের কারণে জার্মান ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি জার্মান নাগরিকত্ব ছেড়ে আমেরিকা আসেন এবং পরবর্তীতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন ও ১৯৪০ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪৯ সালে আইনস্টাইন তার “Autobiographical Notes” এ লিখেছেন দুজন ভীষণ নামকরা দার্শনিক ডেভিড হিউম আর আর্নেস্ট মাখের দর্শন তার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের চিন্তার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বড় কৃতজ্ঞচিত্তে এ দুজন দার্শনিকের অবদান স্বীকার করেন। আইনস্টাইন যখন স্কুলের ছাত্র তখন এ দুজনের অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তা তাকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছিল। হিউম আর মাখ ছিলেন পুরদস্তুর অভিজ্ঞতাবাদী যারা নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো জ্ঞান আছে সেটা গ্রহণ করতেন না। অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন ধারণা হতে পারে না, এটাই ছিল তাদের সাফ কথা।
মাখ ১৮৯৫ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাক্টিভ সায়েন্সের অধ্যাপক নিযুক্ত হলে তিনি অভিজ্ঞতাভিত্তিক দর্শনকে বেগবান করার কাজে নিমগ্ন থাকেন। ১৯২০ সালের দিকে “ভিয়েনা সার্কেল” নামে যে দার্শনিক বলয় গড়ে ওঠে তার তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন মাখ। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে একটা মারাত্মক স্ট্রোক হলে ঐ পদে আসেন পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ বোল্টজম্যান। নামকরা এই অধ্যাপক সেসময় স্থান, কাল, সংবেদন ইত্যাদি নিয়ে তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের তুলোধুনা করেন। বিশেষ করে অ্যাপ্রাওরি দর্শন ছিল তার কাছে অবাস্তব বিষয়। অ্যাপ্রাওরি মানে যা আমরা অভিজ্ঞতা ছাড়াই জানি। সেক্ষেত্রে সর্বকালের সেরা দার্শনিকদের অন্যতম জার্মানের ইমানুয়েল কান্ট তার কাছে হয়ে পড়েন অচ্ছুৎ।
উল্লেখ্য, নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের সাথে কান্টশিয়ান দর্শনের আবার বেশ দোস্তি। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে যে, নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানে স্থান-কাল পরম। কোনো স্থানকে ব্যাখ্যা করতে হলে অন্যকিছুর সহযোগিতা ছাড়াই করা সম্ভব। কালের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অর্থাৎ স্থান-কাল পুরোপুরি অভিজ্ঞতাপূর্ব বাস্তবতা। তাছাড়া নিউটনের স্থানের সাথে কালের গাঁটছড়া ছিল না কোনোভাবেই। যেমন, দূরের কোন একটা নক্ষত্র যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে নিউটনের পদার্থবিজ্ঞান বলছে, আমরা সেটা সাথে সাথেই জানতে পারবো। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, না, ঐ নক্ষত্র থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে যতো সময় লাগে ততক্ষণ পর আমরা ওর মৃত্যুর খবর টের পাবো। এ কারণে আগে যেমন স্থান-কাল ছিল দুটো ভিন্ন বাস্তবতা এখন সেটা আইনস্টাইনের কাছে সেটা হয়ে গেল স্থান-কাল। স্থানের তিন মাত্রা আর কালের এক, দুটো মিলে তাই নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দাঁড়ালো চারমাত্রিক মহাবিশ্ব। স্থান-কালকে বলে দিল, “আমি তোমারি সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে।” এই সুর ধ্বনিত হয়ে চলেছে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত, যেন “বিশ্ব বীণার তারে, বিশ্বজন মহিছে”।
হিউম আর মাখের দর্শনের ভেতর দিয়ে নিউটনিয়ন ব্যাখ্যা মূল্য হারালো। তাদের ধারণার সাথে শতভাগ মিল না হলেও আইনস্টাইন স্বীকার করেছেন তাদের অবদানের কথা। মরিজ শ্লিকের কাছে ১৯১৫ সালে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “Your exposition is also quite right that positivism suggested rel. theory, without requiring it. Also, you have correctly seen that this line of thought was of great influence on my efforts and indeed E. Mach and still much more Hume, whose treatise on understanding I studied with eagerness and admiration shortly before finding relativity theory.”
এটি স্বীকার করতেই হবে যে, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের অভিজ্ঞতাজাত। ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০৫ সাল অবধি ৭ বছর নিরন্তর পরিশ্রম শেষে আইনস্টাইন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি আরও লেখেন, ৭ বছর ক্রমাগত ব্যর্থতা শেষে নিরন্তর পরিশ্রমের পর স্থান-কাল সংক্রান্ত এক নতুন ধারণায় পৌঁছলাম যে, এ দুটো রাশি অভিজ্ঞতার বাইরে দাঁড়াতে পারে না। যুগপৎ তার (simultaneity) ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করলে অবশেষে তার কাছে ধরা দিলো বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব। নিউটনের গতির সূত্র, কম গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে ভীষণ কার্যকর, কিছুতেই নড়চড় হবার না, কিন্তু গণ্ডগোল হয় যখন আলোর গতিতে চলমান কোনোকিছু নিয়ে আমরা ভাবি। আইনস্টাইন দেখালেন, এসময় নিউটনের সূত্রের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর আর সময়ের ধারণা একেবারে পাল্টে যায়। যেমন ধরুন, একটা “L” দৈর্ঘে্যর বস্তুকে আপনি পাঠালেন আলোর গতিতে। তাহলে এর দৈর্ঘ্য সংকুচিত হবে। কতটুকু হবে সেটি হিসেব কষে বললেন, “L= L0 √1- v2/C2” (এখানে L হচ্ছে দৈর্ঘ্য, V হচ্ছে বেগ আর C হচ্ছে আলোর বেগ)। এটির নাম দিলেন লেন্থ কন্টাকশান। ঠিক এভাবে সময়ের ধারণাও পাল্টে যাবে। আলোর গতিতে ভ্রমণরত একজনের সাথে স্থির কাঠামোর ওপর চলমান কোন মানুষের সময় হবে আকাশ পাতাল হেরফের। দুই যমজ ভাইয়ের একজন আলোর যানে ঘুরে আসলে হয়ত দেখবে তার সহোদরের চুলদাড়ি পেকে বুড়ো হয়ে গেছে। এই তাত্ত্বিক ধারণার নাম দিয়েছেন আইনস্টাইন টাইম ডাইলেশান, “T= T0/ √1- v2/C2”। ঠিক এমনভাবে ভরের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে খুব তারতম্য “M= m0 / 1- v2/C2”।
১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রমাণ হয় হাতেনাতে। স্থান-কালের বক্রতার কারণে আলোকরশ্মি যে বেঁকে যায় এই ভবিষ্যৎবাণী খেটে যায় পুরোপুরি। সেই থেকে পদার্থবিজ্ঞানে তার অবস্থান দাঁড়ায় হিমালয়ের সমান। লিউস ফিউয়ার তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হলো আত্মগত ভাববাদ। আত্মগত ভাববাদ হচ্ছে আমাদের চেতনা বা মনের ওপর বস্তু জগতের অবস্থান। অনেক সোভিয়েত বিজ্ঞানী এর প্রেক্ষিতে আপেক্ষিক তত্ত্বকে বস্তুবাদবিরোধী দর্শন হিসেবে বাতিল করে দেন।
তবে ফিলিপ ফ্রাংক বলেন, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সাথে আপেক্ষিক তত্ত্বের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়। এর যে শব্দার্থিক ব্যাখ্যা সেটি প্রত্যক্ষবাদের মূল স্পিরিটের সাথে সংগতিপূর্ণ। ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে আমরা যেভাবে অর্থপূর্ণ আর অর্থহীনতা যাচাই করি সম্ভবত আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের চিন্তার এরকম যুক্তিপূর্ণ ও ধারণাগত বিশ্লেষণ। এটা ভাববাদ হোক আর বস্তুবাদ হোক, তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে মানুষের চিন্তা জগতে এটি একটি রেভ্যুলেশন এবং বিজ্ঞানের জগতে একটা অন্যতম প্যারাডাইম শিফটিং।
১৯২১ সালে আইনস্টাইনের নোবেল প্রাপ্তির শতবছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। এই একশ বছরে বিজ্ঞান এগিয়েছে অভাবনীয় গতিতে, নতুন নতুন আবিষ্কারে মানুষ হয়ত আজ অনেক সত্য আবিষ্কারের কাছাকাছি। এর হাত ধরে একদিন এগিয়ে যাবে এই বিশ্বজগৎকে জানার আরও নতুন নতুন উপায়, অবগুণ্ঠিত রহস্য হয়ত আরও বেশি মানুষের চিন্তার দোরগোড়ায় পৌঁছাবে। সেদিনও আইনস্টাইন থাকবে আমাদের অতি আপন, বিজ্ঞান-দর্শন ভাবনার এক অম্লান সঙ্গী।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে প্রবন্ধ সাহিত্য সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার