Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভায়লা সালিনার স্মৃতিকথা ‘বটবৃক্ষের ছায়া’

ভায়লা সালিনা
১১ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪৪

আমি আর আব্বু দুজনেই খুব আবেগপ্রবন। কিন্তু আব্বুকে দেখলে তা বুঝার উপায় নেই।
আমি ছোটবেলায় আব্বুর কাছে বসে যখন অ আ ক খ শিখতাম আব্বু তখন নিজের লেখা ছন্দ দিয়ে পড়াতেন।
‘বলো মা, ক-তে কলা; আরও হয় কমলা।’
আমি মন দিয়ে শিখতাম। আমার শিক্ষক, আমার শেখার প্রেরণা আমার আব্বু। আর আব্বুর থেকেই আমার এই লেখালেখির হাতেখড়ি। কবিতা লেখায় ছন্দ তাল কোথায় কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে আব্বুর থেকেই শেখা। আব্বু বলতেন, ‘ছন্দ কবিতার জন্য, কবিতা ছন্দের জন্য নয়, এটা কিন্তু ঠিক। ছন্দ গুনে গুনে কবিতা লিখলে শুদ্ধ কবিতা হয়, কিন্তু আবার কখনো কখনো সাবলিলতা হারিয়ে যায়। লেখার সময় একটা তাল তৈরী হয়, এটাই ছন্দ। এটাকে বিশ্লেষণ করেই আমরা নানান রকম ছন্দের কাঠামো তৈরী করেছি।’ এসব শিখতে শিখতে একসময় স্কুলের বুলেটিন বোর্ড, স্কুল-কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা লোখালেখি শুরু করি। যা মনে আসত লিখে ফেলতাম। আমেরিকায় আসার আগে আব্বু বার বার মনে করিয়ে দেন মনে করে কবিতার ডায়েরিটা নিয়ে এসো। আমি ডায়েরি সাথে আনি। আব্বু কতদিন আমার থেকে ডায়েরিটা চেয়ে নিয়ে কবিতা পড়ে বলেন এগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা করো। হাজারটা বই বের না করে একটা বই মনের মত ভালো বই বের করো। যা পড়ে মানুষ মনের খোরাক মেটাবে। দুঃখে কাঁদবে, সুখে হাসবে এমন বই লিখে ফেলো।

বিজ্ঞাপন

প্রথম যখন সংকলনের বই ইত্যাদি প্রকাশন থেকে বের হলো তখন আব্বুর হাতে এক কপি তুলে দিতেই, আব্বু ভীষণ আনন্দে কেঁদে ফেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন জীবনে আমি যা না করতে পেরেছি, তুমি তা করে দেখিয়েছ। সেদিন রাতে আম্মা ডেকে এনে বলেন, দেখ তোর আব্বু কি করে! আব্বুর রুমে এসে দেখি আব্বু আমার বই বুকে রেখে ঘুমিয়ে আছেন। আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। জীবনের সবচে বড় পাওয়াটাও পূর্ণ হয় আমার। ঠিক যেমন আব্বু একদিন আমার আশা পূর্ণ করেন। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। নতুন ক্লাস শুরু হবার সাথে সাথে আব্বু প্রথমেই বললেন, আমার একটা স্বপ্ন আমার ছেলেরা পূরণ করতে পারেনি; আমি জানি তুমি পারবে। আব্বু স্বপ্নটা কখনও মুখ ফুটে বলার আগেই আমি বুঝে নেই। ‘বেশিরভাগ বাবা-মায়ের সব স্বপ্ন ছেলেদের কাছে; আমার স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে।’ প্রায়ই এ কথা বলতেন আব্বু। এ কথা শুনে শুনেই আমার বেড়ে উঠা। আমি দিনরাত পরিশ্রম করে লেখাপড়া করি। কাউকে বলি না কেন করি। শুধু একদিন রাতে আম্মাকে বলি, আম্মা যেদিন আমি অনেক লেখাপড়া করে বড় হবো সেদিন একটা গাড়ি কিনব। আব্বু পাশে বসে শুনেন আমার কথা। কিছু বলেন না। আম্মা বলেন, তাহলে ভালো করে পড়ে মানুষ হও। আমি তাই করি সকাল সন্ধ্যা। আমি না বুঝতে দিতে চাইলেও আব্বু বোঝেন আমার পরিশ্রম আব্বুর স্বপ্ন পূরণের জন্য। পরীক্ষা দিলাম, এরপর রেজাল্টের পালা। এর মধ্যে আব্বু আম্মা আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখাতে নিয়ে যাবেন। আম্মা বললেন বাসার ভাঙা গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না। অফিসের গাড়ি নিয়ে নাও। আব্বু বললেন, দেখি কাল অফিসে গিয়ে কথা বলি। সেদিন সারাদিন আব্বুর ঘরে ফেরার নাম নেই। আম্মাকে দেখলাম কতক্ষন পর পর আব্বুর সাথে কথা বলেন। দুপুরে একজন এসে আম্মাকে বলে পুরনো গাড়িটা নিয়ে গেলেন। আম্মা খুব অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন। আবার বকুল খালাম্মাকে (আমাদের যিনি ছোট থেকে দেখাশুনা করতেন) দিয়ে পোলাও মাংস রান্না করাচ্ছেন। আব্বু না আসা পর্যন্ত আমি খাবো না। আম্মা আব্বুকে কল করে বললেন, মেয়ে কিন্তু খায়নি সারাদিন। আব্বু আসতে আসতে সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আব্বু এসেই হৈহৈরৈরৈ শুরু। এসেই আগে বসে পড়লেন খেতে আমাদের তিনজন ও আম্মাকে সাথে নিয়ে। খাবার টেবিলেই বললেন কাল ১২ টায় আমরা বেড়িয়ে পড়ব কুষ্টিয়া লালন শাহ মাজার ঘুরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ঘুরে এরপর ঢাকায় ফিরব। কাল সকালে অফিসের জীপ আসবে।

বিজ্ঞাপন

আমরা তিন ভাইবোন আনন্দে নেচে উঠলাম। সারারাত আনন্দে ঘুম হয়নি। সকালে সবার আগে আমি রেডি হয়ে বারান্দায় বসে আছি অফিসের জীপের অপেক্ষায়। ঠিক সকাল দশটায় অফিসের জীপের বদলে একটা ভক্সওয়াগন এলো বাসার সামনে। আশেপাশের সবাই গাড়িটা দেখতে ভিড় জমাতেই আমি গাড়ির ড্রাইভারকে বলি কাকু আমাদের বাসার সামনে গাড়ি রাখবেন না আমার আব্বুর অফিসের জীপ আসবে। কাকু বলেন, মা এটা তো তোমার গাড়ি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ দৌড়ে যাই আব্বুর কাছে। আব্বু মিটিমিট করে হাসেন আর আমি বলি আব্বু আমাদের নতুন গাড়ি? আব্বু আমাকে কোলে নিয়ে সোজা নীচে নেমে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে বলেন, কবে তুই বড় হবি গাড়ি কিনবি কি কিনবি না সে আশায় বসে না থেকে এখনই স্বপ্ন পূরণ কর। আমি তো আব্বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে থাকি। আব্বু বলেন, আরে থাম থাম পাগল। আমার দু’ভাই দৌড়ে নীচে এসে গাড়ি দেখে বলে আমি ড্রাইভার আমি ড্রাইভার। মেঝো ভাই গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বলে স্যার, ম্যাডাম আপনারা পেছনে বসেন। আমার আব্বু বিশ্বজয় করা হাসি হাসছেন। আমরা রওনা দেয়ার পর আম্মা ভাই ও আমাকে বলেন, তোমাদের আব্বু তোমাদের সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন; এখন তোমরাও আমাদের ইচ্ছে পূরণ করো। আব্বু আম্মাকে বলেন আমার মেয়ের যা যা স্বপ্ন আমি আমার কাছে থাকাকালীনই পূরণ করে যাব। কে জানে যদি মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ না করতে পারে। আমি তখন ম্যাডাম ম্যাডাম ভাব নিয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখি। হয়ত ভাবছিলাম কতবড় আকাশ; অথচ স্বপ্নগুলো তারচেও বিশাল।

ঘুরাফেরা শেষে যখন বাসায় ফিরে আসি পথেই আম্মা শুরু করেন, তিন ভাইবোন ঘরে ফিরেই পড়তে বসে যাবা না হয় আজকে দেখবা কি করি। আব্বু বিরক্ত হয়ে বলেন কি শুরু করলে এখনও তো ছুটিই শেষ হলো না। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে আব্বু আমাদের সবাইকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে, হাতে একটা বই নিয়ে পড়ছেন। একপাশে আমরা তিন ভাইবোন; অন্যপাশে আম্মা। ছুটির দিনগুলোতে আব্বুর মন ফুরফুরে থাকে। সচরাচর যেসব আহ্লাদ আম্মার সাথে করা হয়, আব্বুর সাথে ঐ একই রকমভাবে আহ্লাদ করি। আমার আব্বুর মুখে দেখা যেত প্রশ্রয়ের হাসি। আমি সুযোগ বুঝে আব্বুকে বলি আজকে তো অনেক টায়ার্ড আজকে আর পড়ব না। সাথে সাথে বড় ভাইয়েরাও একই আবদার করে বসে। আব্বু আম্মাকে বলে দেন, থাক আজ আজ আর পড়তে দিতে হবে না। আম্মা মেজাজ গরম করে রুম থেকে বেরিয়ে যান।

পরদিন সকালে আব্বুর সাথে স্কুলে যাবার পর বুলেটিন বোর্ডে বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে আব্বু এগিয়ে যান। মুখ গম্ভীর করে আমাকে বলেন চলো বাসায় চলো আজকে আর ক্লাস করতে হবে না। বাসায় ঢুকার সময় ড্রাইভারকে কি বলে পাঠিয়ে দেন কোথাও। আব্বু নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে ঘরে ফেরেন। ঘরে ঢুকেই আমাকে বলেন যাও কাপড় চোপড় খুলে হাতমুখ ধুয়ে আমার কাছে আসো। হাতমুখ ধুয়ে বের হয় আম্মার রুমে যেতেই দেখি আম্মা মিটমিট করে হাসছেন, আর ডাইনিং টেবিল ভর্তি মিষ্টি। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখেন বুকে কনগ্রেচুলেশনস বলে। কি শান্তি সেই জড়িয়ে ধরাতে। যেন অনন্তকাল এভাবে স্বনির্ভরতায় আব্বুর বুকে মাথা পেতে রাখা যায়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

বটবৃক্ষের ছায়া বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ ভায়লা সালিনা সাহিত্য স্মৃতিকথা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর