হাসান মাহবুবের গল্প ‘প্রেতশব্দ’
১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৯
১.
গোধূলির ধূসর রং যখন বিলীন হয়ে সন্ধ্যের আঁধারকে আহবান জানালো নগরকে গ্রাস করেনিতে, রেণু তখন হেঁটে যাচ্ছিল একটা সরু গলি ধরে। সাদামাটা দেখতে মেয়ে রেণু, কাজ করে একটা সওদাগরী অফিসে। অফিস শেষে সরাসরি বাস না ধরে সে অনেকখানি পথ হাঁটে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে বলে বাসে করে মতিঝিল থেকে শাহবাগ যেতে প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে যায়। এই পথটা হেঁটে গেলে লাগে মাত্র পঞ্চাশ মিনিট। এতে সময় যেমন বাঁচে, শারীরিক পরিশ্রমও হয়।
রেণুকে অফিসে তাকে থাকতে হয় প্রায় নয় ঘন্টা। প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকে সে। গৎবাঁধা কাজগুলো করতে বিশেষ কোন দক্ষতা প্রয়োজন হয় না। এই কারণেই সে গত পাঁচ বছর ধরে এখানে রয়ে গেছে। সাদামাটা রেণুর জীবনে তেমন কোন উচ্চাশা নেই। এই সওদাগরী কোম্পানির ডেস্কে সপ্তাহে ছয়দিন নয় ঘন্টা করে বসে কর্মচারীদের বেতন, উপস্থিতি আর আচার-আচরণের তদারকি করে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে তার একদমই কোনও আপত্তি নেই।
ছোটবেলা থেকেই সে সাধারণ মেধার বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। একগাদা ছেলেপুলে জন্ম দেওয়া বাপ-মা তাকে নিয়ে বাড়তি কোন উচ্ছ্বাস বা উচ্চাশা প্রকাশ করেনি কখনও। সে রঙ তুলি দিয়ে গ্রাম আঁকেনি, হারমোনিয়ামে সুর তোলেনি, পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগও পায়নি। আশাহীন এবং আক্ষেপহীন জীবন তাকে খুব বেশি পরীক্ষায় ফেলেনি। সাধারণ ফলাফল করে পরীক্ষায় উৎরিয়ে সে একটা চাকুরিও পেয়ে গেছে, নির্ঝঞ্ঝাট। মেধায় খুব সাধারণ হলেও তার নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার কমতি নেই। এছাড়া সে কর্তৃপক্ষের কাছে ইনক্রিমেন্ট আর প্রমোশন নিয়ে তদবির করে না বলে ভাল কর্মচারীদের তালিকায় তার নাম আছে।
ঊর্ধ্বতনদের কাছে ভাল হিসেবে তারা পরিচিতি থাকলেও সাধারণ কর্মচারীদের অনেকেই তাকে সমীহমিশ্রিত ঘৃণার চোখে দেখে। কারণ, তাকে তৈরি করতে হয় স্যালারি রিপোর্ট। প্রতিমাসেই বেশ কিছু কর্মচারীর বেতন কাটতে হয় তাকে। তাদের অফিসে উপস্থিতির নিয়ম-কানুন বেশ কড়া। একমাসে একজন কর্মচারী সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত দেরি করতে পারে। এর বেশি দেরি হলে সর্বোচ্চ তিনদিনের জন্যে উপস্থিতি সমন্বয়ের আবেদন করা যায়। প্রতি মাসে এ রকম শয়ে শয়ে উপস্থিতি সমন্বয়ের আবেদন আসে। এগুলো মঞ্জুর করা না করার এখতিয়ার একান্তই রেণুর। বেশিরভাগ আবেদনের বিষয়বস্তু একই। ট্রাফিক জ্যামের কারণে আসতে বিলম্ব হয়েছে, অথবা নিজের বা পরিবারের কারও শরীর খারাপ ছিল। দুইশটা এরকম আবেদন এলে রেণু মঞ্জুর করে বড় জোর আশিটা। কোনটা রাখবে, কোনটা ফেলে দেবে, এসব সে নির্বাচন করে সতর্কতার সাথে। এমনভাবে, যেন কারও প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ না হয়।
পাঁচ বছরের চাকুরির অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে প্রশাসনিক কঠোরতাকে কাজের যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। তাই সে দিনদিন কঠোর হওয়া শিখছে। এই কর্মকঠোরতার সুবাদে তাকে সমীহ অথবা ঘৃণা করা কর্মচারীদের চোখে সে ভাল হতে পারত আন্তরিক ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু বরাবরই তার কথাবার্তা কাঠ-কাঠ, যান্ত্রিক। ফলে তার ডেস্কটা অফিসের প্রেম, আনন্দ আর কূটকচাল থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে যায়।
আজ তার অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়েছে। হোক গে। তার বাসায় ফেরার তাড়া নেই। সে হাঁটে মাঝারি গতিতে। হাঁটতে হাঁটতে নানান কথা ভাবে। ইনক্রিমেন্টের সময় চলে এসেছে। এজন্যে তাকে অফিসে বাড়তি কাজ করতে হচ্ছে। গত এক বছর কে কেমন কাজ করেছে, কার আচার ব্যবহার কেমন ছিল, কে নতুন নতুন বিষয় শিখেছে, নানা বিচার্য বিষয় অবলম্বনে তাকে তৈরি করতে হচ্ছে বিশাল একটি প্রতিবেদন। কার কত বেতন বাড়ছে, কার পদোন্নতি ঘটছে, এসব তথ্য জানতে পারাটাই তার জব স্যাটিসফেকশন। অফিসে সারাক্ষণ করছে কর্মচারীরা কার কতটা বেতন বাড়তে পারে। এই অসহনীয় কৌতূহল থেকে মুক্ত থাকতে পারাটা সে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল মনে করে। তার তৈরি রিপোর্টে অনেকের চাকুরি নড়বড়ে হয়ে যাবে। নামমাত্র ইনক্রিমেন্ট হবে এবং ছয় মাসের মধ্যে টার্মিনেশন লেটার পাবে।
এসব বিষয় নিয়ে যারা শঙ্কিত থাকে, তারা মূলত সেলস আর মার্কেটিংয়ের লোক। তাদের কাজের টার্গেট দেওয়া থাকে, টার্গেট পূরণ না হলেই বিপদ। প্রশাসনিক কাজে এসব ঝামেলা নেই। তবে আর বছর পাঁচেক চাকুরি করলে তাকে বাধ্যতামূলক প্রমোশন দিয়ে ওপরের পদে উঠিয়ে দিলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। সে জানে কেবল কিছু বাঁধা অংক আর সফটওয়্যারে বসানোর সূত্র আর ডাটা। এর চেয়ে বড় পদে উঠে গেলে তাকে চৌকশ মানুষদের সামলাতে হবে, বসতে হবে নীতিনির্ধারণী মিটিংয়ে, নিতে হবে বড় বড় সিদ্ধান্ত। আর তখনই তার মেধার অক্ষমতা প্রকট হয়ে উঠবে। তাই সে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করে তার যেন পদোন্নতি না হয়। সে যেন বাকি জীবনটা এইসব গৎবাঁধা হিসাব-নিকাশ করেই কাটিয়ে দিতে পারে। আপাতত সে এসব চিন্তায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করতে চায় না। আপাতত তার চাকুরিটা নিরাপদ এবং শক্ত অবস্থানে আছে এতেই সে খুশি। ফুরফুরে মেজাজে সে হেঁটে চলে। রাস্তার বিকল হয়ে যাওয়া বাতি আর নির্জনতা তাকে নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় না। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে হাঁটে।
২.
পেছনে একটা শব্দ হচ্ছে মচমচ করে। সস্তার স্যান্ডেলে করে হাঁটার সময় এরকম শব্দ হয়। শব্দটা হচ্ছে একলয়ে, যান্ত্রিক গতিতে। এ রকম অনেক শব্দ মিশে থাকে রাজধানীর রাজপথে। রেণু গা করল না। চলার গতি বাড়ালো না, পেছন ফিরে তাকালও না। আর মিনিটবিশেক হাঁটলে সে পৌঁছে যাবে বাসস্ট্যান্ডে। মেয়েমানুষ হলেও বাসে ওঠার ব্যাপারে সে পুরুষদের চেয়ে কমজোর না। ঠেলে, গুঁতিয়ে দিব্যি উঠে যায়। ‘লেডিজ সিট নাই’ বলে তাকে দমিয়ে রাখা যায় না। এইসব নাগরিক চিন্তার মধ্যেও মচমচ শব্দটা অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। পেছন ফিরে তাকাল সে। একটা কমবয়সী ছেলে, উদভ্রান্ত দেখতে, হেঁটে আসছে। মচমচ শব্দের উৎস সেই। তার থেকে বিশ গজ দূরে আছে সে। ঘাড় গোঁজ করে দ্রুতপায়ে হেঁটে আসছে সে। দেখতে কিছুটা ভীতিরই সঞ্চার করে।
হঠাৎ করে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কিছু অপরাধের কথা মনে পড়ে যায়। নির্জন রাস্তায় কিছু পথচারী না কি এভাবেই আক্রান্ত হয়েছে। তাদেরকে স্প্রে করা হয়েছে নতুন ড্রাগ স্কোপোলোমিন যা না কি ডেভিলস ব্রেথ নামেও পরিচিত। ভয়াবহ এই ড্রাগ। এর সামান্য সংস্পর্শে এলেই মানুষ বোধশক্তিহীন হয়ে যায়। তখন তাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করিয়ে নেওয়া যায়। ছেলেটার চোখমুখের অবস্থা ভাল না। প্রায় ছুটে আসছে সে। সাদামাটা দেখতে শক্তপোক্ত মেয়ে রেণু নগরের নানারকম বিরুদ্ধতার সাথে পরিচিত হলেও এবারের মতো বিপদের অনুভূতি কখনও হয় নি। রেণু ছুটতে শুরু করল।
৩.
রেণুর পেছনে যে ছেলেটি ছুটছিল, তার নাম আরিফ। ঢাকা শহরে এসেছে মাস তিনেক হলো। ঢাকা শহরে যারা আসে তারা সবাই ভাড়া খাটা মানুষ। এই শহর কারও নিজের না। আরিফও এই শহরকে নিজের করে ভাবতে পারেনি কখনও। বাসা একটা ঠিক করা ছিল বটে, কিন্তু সেই বাসাটা বাস উপযোগী নয়। জানালা একটা আছে, সেটা সামনের বাসার দেওয়ালের হুমকিতে নতজানু। আলো বাতাস না এলেও মশা আর অন্যান্য পতঙ্গ ঠিকই আসে। পানি থাকে না ঠিকমতো। ভাড়া দিতে দুই দিন দেরি হলেই কেয়ারটেকারের কটুকাটব্যে অস্থির হয়ে যেতে হয়। এই মাসের সাতদিন হয়ে গেল, সে এখনও বাসা ভাড়া যোগাড় করতে পারে নি। আজ গিয়েছিল দূরসম্পর্কের এক মামার কাছে কিছু টাকা ধার চাইতে। সেই ভদ্রলোক তার প্রজ্ঞা দিয়ে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে এই ছেলে তার কাছে বারবার আসবে টাকা ধার করতে।
প্রথমবারেই টাকা ধার দিয়ে দিলে, সে পুনরায় টাকা ধার নিতে আসার আগেই তার কাছে ধার পরিশোধের জন্যে তাগাদা দিয়ে তটস্থ করে রাখা যাবে। এতে সে অযাচিত ঝামেলা থেকে বাঁচবে। টাকাটা পকেটে নিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছিল তার মেসবাড়ির উদ্দেশ্যে। এই সময় সে খেয়াল করে মচমচ শব্দ করে অনেকক্ষণ ধরে কেউ তার পেছন পেছন আসছে। সদা উদ্বিগ্নতায় ভোগা ভীরু তরুণটি নিশ্চিত হয়ে যায়, তার মামার বাসা থেকেই দুস্কৃতিকারী একটা দল তাকে অনুসরণ করছে। এই নির্জন রাস্তায়, যেখানে অন্ধ ল্যাম্পপোস্টদের বোবা বিলাপে আশকারা পেয়ে যায় মাস্তান আর ম্যানেকুইন প্রশাসন, সেখানে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে পেছন ফিরে তাকানো যাবে না, থামা যাবে না। তাকে দৌড়ুতে হবে। সে ছুটতে শুরু করে।
৪.
আরিফের পেছনে হাঁটছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, মেজবাহ আহমেদ। ঢাকা শহর তার কাছে সমস্যা জর্জরিত এবং বিপদসঙ্কুল নয়। টাকাপয়সা এবং ক্ষমতা থাকলে ঢাকা এক বেহেশত! তিনি অফিসে যান, বাসায় ফেরেন এসি গাড়িতে করে। জ্যামের সময়টায় আত্মউন্নয়নমূলক বই পড়েন। বাসায় গিয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া তার সন্তানদের সাথে টিকটক ভিডিও করেন। যেটা ভাল লাগে, বাজার থেকে সেটাই কিনে আনেন। তার পাতে সবসময় পছন্দের খাবারটাই থাকে। তার স্ত্রী এই বয়সেও শরীরটা ধরে রেখেছেন চমৎকার। তাই অন্য সুন্দরী নারীদের দেখলে মনে বিক্ষিপ্ত ভাবনা উদয় হলেও স্ত্রীর প্রতি অরূচি আসে নি এখনও। তো আজ তার গাড়ি নষ্ট থাকায় তিনি ঠিক করলেন হেঁটেই বাসায় ফিরবেন। খুব বেশি দূরে নয় তার বাসা। হেঁটে গেলে এক ঘন্টা লাগবে। হাঁটার তেমন অভ্যেস না থাকায় পনেরো মিনিট হেঁটেই তার হাঁফ ধরে গেল। তিনি কিছুক্ষণ উবু হয়ে বসে বিশ্রাম নিলেন। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলেন।
সেই সময় মচমচ করে একটা শব্দ হতে লাগল পেছন থেকে। কেউ একজন তাকে অনুসরণ করছে। কয়েকবার গতি পরিবর্তন করে দেখলেন সমানুপাতে মচমচ শব্দটা পরিবর্তিত হচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেলেন। এমন একটা অবয়ব, যাকে যে কোনওকিছুই ভাবা যায়। তার মনে হলো এটা সেই সাংবাদিক, যে গত কিছুদিন ধরে তার পেছন পেছন ঘুরছে। এই বজ্জাত লোকটা বেশ কিছু দুর্নীতির সাথে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে চায়। তাকে হাতে-নাতে ধরতে বেশ কয়েকবার ফাঁদও পেতেছে। বারেবারেই সে তড়িৎ তৎপরতার মাধ্যমে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। নচ্ছার সাংবাদিকটা বোধ হয় এবার বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তাকে খসিয়ে ফেলতে হবে। মেজবাহ আহমেদ ছুট লাগালেন।
রেণুকে দেখে ভয় পেয়ে আগে আগে যিনি দৌড়াচ্ছেন তিনি মধ্য চল্লিশের গেরস্থ ভদ্রলোক সোবহান সাহেব। নিয়ম করে সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি রোগগুলো তার শরীরে বসত বেঁধেছে। প্রেসার, কোলেস্টরেল, সুগার সবই হাই। তিনি শরীর ঠিক রাখার জন্যে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। বেশ হাঁটছিলেন, তখন তাড়া করল সাদামাটা দেখতে শক্তপোক্ত নারী রেণু। ঢাকার রাস্তাঘাটে ইদানিং এমন নারী অপরাধীদের বিস্তার হচ্ছে। তারা কাছে এসে গায়ে গা লাগিয়ে হ্যারাজমেন্টের অভিযোগ তুলে টাকা আদায় করে নেবে। সোবহান সাহেব ঝামেলা থেকে বাঁচতে ছুটতে লাগলেন।
৫.
রেণু দৌড়াচ্ছে। ভীত। রেণুকে দেখে ভয় পেয়ে কেউ দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে আরিফ। তার পেছনে মেজবাহ রহমান। তার পেছনে আছে কেউ। তারও পেছনে আছে কেউ। তারা সবাই কারও না কারও ভয়ে ভীত।
দৌড়াতে দৌড়াতে তারা পেরিয়ে যায় মৎস ভবন। রমনার উঁচু বৃক্ষগুলো তাদের ছায়ায় ঢেকে দেয়। তারা সবাই পেছনে ফিরে তাকায়। অন্ধকার আর ছায়ায় মনুষ্যমূর্তিগুলোকে দেখে মনে হয় প্রেতের মিছিল নেমেছে রাস্তায়। তারা ছোটার গতি বাড়িয়ে দেয়।
নির্জন রাস্তার একাকী মানুষেরা একে অপরকে ভয় পেয়ে ছুটছে ভীড়ের মধ্যে মিশে যাবার অপেক্ষায়। ঐ তো দেখা যায় শাহবাগের ফুলের দোকানগুলো। ওখানে মানুষ মিশে আছে নগরের বিষ বুকে নিয়ে। এই বিষেই তাদের নির্বাণ।
ফুলের দোকানের কাছে এসে জমা হতে লাগল প্রেতমূর্তিরা। ঘামে ভেজা শরীর থেকে ছায়াটা সরিয়ে ফেলে পরিণত হলো ক্লান্ত নাগরিকে। তাদের জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত মেলার আগেই নিস্তরঙ্গ ফুলের দোকানটায় জমে উঠল জটলা। ওভারব্রিজের কাছ থেকে দৌড়ে আসতে লাগল একটা ছেলে। তার পেছনে শ’খানেক মানুষ। ছেলেটার বিরুদ্ধে পকেট মারার অভিযোগ। জনগণ আহবান জানাচ্ছে ছেলেটাকে ধরে প্রহার করার। ফুলের দোকানে আশ্রয় নেওয়া প্রেতদল উদ্বিগ্নতা কাটিয়ে চনমনিয়ে উঠল। হতাশ বেকার তরুণ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, মধ্য চল্লিশের গেরস্থ এবং আরও যারা ছিল পেছনে তাড়া করা ছায়ামূর্তির ভয়ে ন্যুব্জ হয়ে, তারা ভীড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে গণপিটুনিতে শামিল হলো। তাদেরকে জোরগলায় উৎসাহ প্রদান করতে লাগল সাদামাটা দেখতে মেয়ে রেণু। কিছুক্ষণ গণপিটুনি দেখার পর তার বাস এসে গেলে সে তড়িঘড়ি করে পড়ে থাকা গোলাপ ফুল পিষে বাসে উঠে গেল।
সোবহান সাহেব প্রহার শেষে সিগারেট ধরানোর জন্যে ম্যাচ খুঁজলে তার যোগান দিলেন মেজবাহ সাহেব। আর তাদের কাছ থেকে হতাশ বেকার যুবক আরিফ জানতে চাইলো প্রহার করতে গিয়ে তাদের বয়স্ক শরীরের গিরায় টান পড়েছে কি না। তারা একে অপরকে আশ্বস্ত করল যে সবাই ঠিক আছে। তাদের ভয়হীন হৃদয়ে খেলা করতে লাগল ভ্রাতৃত্বের সুন্দর অনুভূতি।
তাদের দিকে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে আছে প্রহারে প্রায় মৃত ছেলেটা। চোখ ভরে দেখছে করাল মেট্রোর সৌন্দর্য। আর কিছুক্ষণ, এরপরেই চোখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে! সে বুঝতে পারছে। টেনে হিঁচড়ে নিজেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে গিয়ে খেয়াল করল তার পেছনে শত পায়ের প্রেতশব্দ।
সারাবাংলা/এসবিডিই
গল্প-উপন্যাস বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ সাহিত্য হাসান মাহবুব হাসান মাহবুবের গল্প ‘প্রেতশব্দ’