Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পহেলা বৈশাখে বাঙালির যত আয়োজন

তপন বাগচী
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১৮

ঢাকায় পহেলা বৈশাখে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, সেটি ইউনেস্কোর বিচারে বিশ্ব-ঐতিহ্যের মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালি হিসেবে আমরা গৌরব বোধ করি। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে মানুষ ছুটে আসে। পয়লা বৈশাখ তাই কেবল একটি তারিখ মাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। এই দিন উপলক্ষে সরকার বাংলাদেশের চাকরিজীবীদের জন্য ঈদণ্ডপূজার বোনাসের মতো ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করেছে। এটিও বড় আনন্দের কথা।

বিজ্ঞাপন

বহির্বিশ্বের সঙ্গতিরক্ষায় রাষ্ট্রচালিত হয় খ্রিষ্টাব্দের হিসেবে। আমাদের শিক্ষা, অফিস-আদালত, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা চলে একই হিসেবে। তাই নাগরিক সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে খ্রিষ্টীয় সন বা খ্রিষ্টাব্দ। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের জাতিসত্তায় আছে বঙ্গাব্দ। বাংলা সন কিংবা বঙ্গাব্দ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলা সনকে উদযাপন করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা।

বিজ্ঞাপন

নগরসংস্কৃতিতে পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ কেবল একদিনের উৎসব-আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনও অনস্বীকার্য। বিশ্বের সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে।

বর্ষগণনার ভিত্তিই ছিল ফসল তোলা বা খাজনা দেওয়া। অর্থাৎ কৃষিসংস্কৃতির প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে নববর্ষের সঙ্গে। আর কৃষিই মানুষের আদি সংস্কৃতি। কৃষি নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মকর্ম, শিক্ষা, বাণিজ্য প্রভৃতি। আমাদের কথা বলা বা ভাষা, সামাজিক রীতিনিতি, শিষ্টাচার সবকিছু মিলেই সংস্কৃতি। সকল সংস্কৃতির মূলে রয়েছে কৃষি। এ কথা মনে রাখলেই পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে।

বৈশাখের সঙ্গে হালখাতা তো রয়েছে। হালখাতা মানে পুরনো খাতা বদল করে নতুন খাতা খোলা। খাতা এখানে প্রতীকী অর্থে। খাতা মানে হিসেব। পুরনো পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নতুন হিসাব খোলার অনুষ্ঠান। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের একটা বিরাট তাৎপর্য আছে। চলমান সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। কিন্তু বছর শেষে বিক্রেতার বাড়িতে বা দোকানে গিয়ে পাওনা পরিশোধ করা এবং আপ্যায়িত হওয়ার ঘটনার মধ্যে ‘বাণিজ্য’ তথা ‘অর্থনীতি’ লুকিয়ে থাকলেও এর মধ্যে দিয়ে মানুষের যে মিলন ঘটে, পারস্পরিক সম্পর্কের যে বিকাশ ঘটে, তা মানুষের সামাজিক জীবনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। বৈশাখী মেলা যে শুধু উৎসবের-আনন্দের নয়, বাণিজ্যের সঙ্গেও এর গভীর যোগ রয়েছে, এ কথা যে কোনও সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে।

বর্ষবরণ উৎসবই একমাত্র পর্ব, যেখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই। বাঙালি একসঙ্গে সমান গুরুত্বে পালন করতে পারে একমাত্র পয়লা বৈশাখকেই। তাই সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ অনুষ্ঠান হিসেবে এর প্রয়োজন চলমান সমাজে বড় বেশি প্রয়োজন। আজকে যে করপোরেট প্রতিষ্ঠাগুলো পহেলা বৈশাখকে উদযাপনের জন্য খরচ করছে, তা আমাদের সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য নয়, তাদের বাণিজ্যপণ্য প্রসারের জন্য। আজকে তারা ব্যান্ডসংগীতকে উৎসাহ দিচ্ছে, কনসার্ট নামে ভিন্ন ধারার সংগীতকে প্রাধান্য দিচ্ছে, আমাদের যুবসমাজবে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে চালিক করার এক গভীর চক্রান্ত বলে মনে করি। তারা লোকসংগীত ও লোককারুপণ্যকে উৎসাহিতকরণে অর্থ সহায়তা দিলে বুঝতে পারব যে, তারা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে লালন করতে চায়। আশা করি, তাদের সুবুদ্ধির উন্মেষ ঘটবে।

পয়লা বৈশাখ মনে করিয়ে দেয় যে, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমি জাতিসত্তায় আমি বাঙালি, নাগরিকতার বিচারে আমি বাংলাদেশি—এই প্রশ্নের মীমাংসাও পাওয়া যায় পয়লা বৈশাখের কাছে। আমরা তাই পয়লা বৈশাখকে আত্মানুসন্ধানের বড় উৎসব বিবেচনা করতে পারি।

বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের যোগ বড় বিস্ময়কর। এটা তো ইলিশের মৌসুম নয়। এই সময়ে ইলিশ ধরা পড়লে তো আমাদের মৎস সম্পদের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। বৈশাখে শঙ্খ বাজে জয়ধ্বনিতে। বৈশাখের ফলের মৌসুম। তাই বৈশাখের আগমনকে চিহ্নিত করা যায় এভাবে—

‘আসে বৈশাখ, বাজে ওই শাঁখ
বাজে ঢাকঢোল, বাঁশি যে
ফলে ও ফসলে ভরে ওঠে, তাই
গ্রীষ্মকে ভালবাসি যে।
বৈশাখ নয় স্রোতের সারথী
ইলিশের মৌসুম
পান্তার সাথে ইলিশ ভোজনে
তবু পড়েছিল ধুম।
তাতে ক্ষতি হয় প্রকৃতির ধন
বোঝে এই দেশবাসী যে!’

কয়েক বছর ধরে বৈশাখে ইলিশ ধরা নিবৃত্ত করার সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করায় ইলিশ ধরা কমে গেছে। এতে মাছের বাড়তি উৎপাদনের ফল ভোগ করছে দেশের জনগণ—

‘সবুরেই মেওয়া ফলে জানি আর
ধৈর্যে বাড়বে ধন
এই সাদা কথা বুঝে গেছে আজ
সচেতন জনগণ
অসময়ে আর ধরে না ইলিশ
ধন্য মৎস্য-চাষী যে!

বৈশাখে নয় পান্তা-ইলিশ
বৈশাখ আনে ফল
রোদে পুড়ে আর ঝড়ে তাণ্ডবে
বাড়ায় মনের বল
মেলা-উৎসবে গানে-পার্বণে
কান্না ভুলানো হাসি যে।’

বাংলা নববর্ষ দুই দেশে উযাপিত হয় দুই দিন। বাংলাদেশে একদিন আগে। এর মধ্যে জাতপাতের ব্যাপার নেই। আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কিছু জটিল হিসাব। পহেলা বৈশাখ যেন একদিনের উদযাপন করতে পারি আগামীতে, সেই প্রত্যাশা রইলো।

‘নতুন বছরে নতুন স্বপ্নে
পথচলা শুরু হয়
শেকড়ের টানে খুঁজে পাই আজ
কোটি বাঙালির জয়,

হাতে হাত রাখি, মনে মনে মিলে
হাসি-তরঙ্গে ভাসি যে!’

লেখক: উপ-পরিচালক (গবেষণা), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

তপন বাগচী পহেলা বৈশাখে বাঙালির যত আয়োজন প্রবন্ধ বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর