রুমা মোদকের গল্প ‘কিছু নেই’
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১০:০৮
আমার প্রেমিকদের বউয়ের নাম কোনো না কোনোভাবে রুমা। রুম্মান, রুমানা। কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ব্যাপারটা আবিষ্কার করে আমি যতোটা বিস্মিত হয়েছি তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি নিজেকে আবিষ্কার করে। তখন আমার কোনো প্রেমিক নেই। সদ্যই রুদ্রকে ‘তোমার সাথে আমার পোষাবে না’ জানিয়ে আবার একলা হয়ে গিয়েছি। হতে পারে মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার স্বাভাবিক ঋজুতাও আমার নেই তাই হয়তোবা একলা থাকাই আমার গন্তব্য।
তোদের মতো সকালে ছেলে কী খাবে, ইচ্ছে না করলেও জামাইয়ের পছন্দে ঘেমে নেয়ে রাতদুপুরে ইলিশপোলাও রান্নার ঝক্কি, ডাকা মাত্র উনুনের কাছ থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে তৃপ্ত করে আসার ঝামেলা ইত্যাদি আমার নেই। এ জাতীয় নানাবিধ সান্ত্বনা বাক্য যদিও আমি বন্ধুদের আড্ডায় দেই, আদতে প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে বাসার তালা খুলে অন্ধকার ঘরে ঢুকতে আমার ভালো লাগে না। অন্ধকারে ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিলে আমার কোনো তাড়া থাকে না আলো জ্বালানোর, উনুনে রান্না চাপানোর।
কতোদিন ঘরভর্তি খাঁ খাঁ শূন্যতায় দুটো বিস্কিট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে রাত পার করে দিয়েছি। এমন নয় যে কারও জন্য পছন্দের মেন্যু রান্না করে তার আনন্দের জন্য অপেক্ষা করার আনন্দের সাথে আমার পরিচয় আছে। তবু একা ঘরে এদিক সেদিক হাঁটতে হাঁটতে, ক্লজেটের শাড়ি উলটে পালটে পরের দিনের জন্য ম্যাচিং ব্লাউজের আলিঙ্গনে রাখতে রাখতে আমার মনে হয়, জীবনে তাড়া থাকার প্রয়োজন আছে। অনিশ্চিত অতর্কিত তাড়া। নইলে জীবন লবণ ছাড়া তরকারির মতো পানসে। এই যে আমি যখন ইচ্ছা বের হই, যখন ইচ্ছা ফিরি, ইচ্ছা হলে রাঁধি, ইচ্ছা না হলে রাঁধি না, কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার চাপ নেই এর মাঝে যে ক্লান্তি তা অফিসের কাজের চেয়ে তা ঢের ঢের বেশি। আমি অবশ্য ফুরফুরে মেজাজে নির্ভার শান্তির আঁচল উড়িয়ে হা হা হো হো করে হাসতে হাসতে বান্ধবীদের একদম এসব বুঝতে দেই না। আমার অন্দরে একদমই এদের প্রবেশাধিকার নেই।
আমি বরং ওদের সুখের ভাণ করা চেহারার গভীরে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসে অসুখের শোঁ শোঁ শুনতে পাই। যতোই মুখে বলুক, আলহামদুলিল্লাহ আমার উনি না এতো ঠান্ডা মেজাজের মানুষ! এই শোন না, আমার উনি রোলস রয়েস কিনেছেন মাশাল্লাহ, আর বলিস না বাচ্চারা বায়না ধরেছে আগামী মাসে থাইল্যান্ড যাবো ইনশাআল্লাহ- ইত্যাদির মাঝে গোপন করা নিজেদের নিজস্বতা বিলিয়ে দেওয়া তাদের পরজীবী জীবনের বিষাদ আমি ঠিক দেখতে পাই। ঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না আমার নিঃসঙ্গতা, নাকি এদের পরজীবীতা কোনটায় বিষাদের ভারটা বেশি!
আমার ঘর-সংসার, প্রেমিক নেই বলে সাবেকদের খুঁজে বেড়াবার মতো ইচ্ছে বা রুচি বা সময় কোনোটাই আমার নেই, ছিলোও না কোনোকালে। চরম দুর্বল মূহুর্তেও ভেঙে গুড়িয়ে না পড়ার মতো কোথায় একটা লৌহইস্পাতদৃঢ় হাড় আমাকে সোজা করে রাখে। আমি নত হয়ে সুখ কিংবা স্বস্তি কিনে নিতে পারি না বরং অসুখী কিংবা অস্বস্তি আমাকে জিতে যাওয়ার আরাম দেয়। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতানো জালে যতোই নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাই, পারি না। কীভাবে কীভাবে যেনো আরিফ আর নাহিদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে যায়। ঘুরেফিরে একই প্যানপ্যানানি। কী যে অসুখী জীবন ওদের। অভিন্ন সমস্যা এদের। সংসারে, দাম্পত্যে। প্রায় একই অভিযোগ অনুযোগ দুজনের। প্রায় এক। কিন্তু এই সমস্যার অভিন্নতা আমার মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত সন্দেহ তো তৈরি করেই না, কখনো কোনো অবিশ্বাসও তৈরি করে না।
আরিফ প্রায়ই লিখে, একবার দেখা হতে পারে রুমা? আমি ওর দেখা করার আকুলতায় নিজের ভেতরে গোপন সুখ অনুভব করি, প্রকাশ্যে ওকে বাজিয়ে দেখি, বউ কই? আর বলো না, লাইফটা হেল করে ছেড়ে দিয়েছে। এভাবেই শুরু করে আরিফ। বিয়ের পর থেকে কোনোদিন আমাকে বোঝার চেষ্টা করেনি সে। কোনো দায়িত্ব নেই তার ঘর-সংসার ছেলেমেয়ের প্রতি। ওর উচ্চাকিাঙ্খার মূল্য দিতে গিয়ে আমি পথে বসে গেছি। সারাদিন অফিস অফিস! এতো ক্যারিয়ারিস্ট মেয়েদের বিয়ে শাদি করতে নেই বুঝলে। আমি খুব খারাপ আছি রুমা। তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গেলে, তুমি কেনো আমার হলে না? আরিফের অসহায় স্বরের কাছে আমি সত্যি অপরাধী হতে থাকি। আরিফ আরও আফসোস যোগ করে তার কথায়, তুমি পাশে থাকলে জীবনটা অন্যরকম হতো…। কেনো ছেড়ে গেলে! আমি অতীতে হাতড়াতে থাকি। কেনো আরিফকে ছেড়ে এসেছিলাম! মনে করার চেষ্টা করি।
স্ত্রীকে নিয়ে একপাক্ষিক এতোগুলো অভিযোগ চুপ করে শোনা আমার নৈতিকতার সাথে যায় না। অন্য কোনো পুরুষ হলে একটা শব্দ মাটিতে পড়তে দিতাম না। খপ করে ধরতাম তীব্র প্রতিবাদে। কিন্তু আরিফের সব অভিযোগ চুপ করে শোনার বেলায় আমি প্রথাগত নারী হয়ে যাই। আমি বিশ্বাস করতে থাকি আরিফ সত্যি ভালো নেই আমাকে ছাড়া। আমি পাশে থাকলে আরিফের জীবনটা অন্যরকম হতো। আচ্ছা আরিফকে কেনো ছেড়ে এসেছিলাম! এবোর্ট করানোর সময় আরিফ বিল ভাউচার নিয়ে কাউন্টারে ওয়েট করছিল, আমি কখন আল্ট্রাসাউন্ড এর রুম থেকে বের হয়ে পে করবো। হ্যাঁ আমি জানতাম, আরিফকে বাবা মা ভাইবোনসহ পুরো সংসারকে টানতে হয়। জানতাম বলে একত্রে কাটানোর সবটুকু সময়ের ব্যয় আমি নির্দ্বিধায় বহন করতাম। আমার সংসার টানতে হতো না। যা বেতন পাই সবটুকুই নিজের। কিন্তু তাই বলে এইসময়ও আরিফ ঠান্ডা মাথায় হিসাব করবে, দায়িত্ব অস্বীকারের মতো স্বার্থপরতা দেখাবে এটা আমি ভাবতেই পারি না! বিয়ে আমরা করাতামই। হঠাৎ এ দুর্ঘটনায় অপ্রস্তুত আমাদের এবোর্ট করার সিদ্ধান্তটা দুজনেরই নেওয়া, দুজনের ভালোর জন্য! নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগেনি সিদ্ধান্তটা নিতে। এই ভালো না লাগার দায়টাতো দুজনেরই। এ সময় আরিফ কী করে টাকাখরচের বেলায় মাথা এতো ঠান্ডা রাখতে পারে!
আরিফের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো কর্মজীবনের প্রথম দিকে। একই অফিস একই ডেস্ক। একই বয়সের তরুণ কর্মী দুজন। সম্পর্ক গড়ে উঠাটাই স্বাভাবিক ছিলো না উঠা অস্বাভাবিক। চলুন আপনাকে নামিয়ে দেই বলে বাইকের পেছনে আমাকে বসিয়ে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিত আরিফ। ভদ্রতাবশত বাসায় ডেকেছি কয়েকদিন। না আসার ভদ্রতা দেখিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছে আরিফ। মাসকয়েক। বাইকে বসার উষ্ণতার স্রোত একদিন বাসা পর্যন্ত চলে আসে অনিবার্যভাবে। প্রয়োজনের গা জড়াজড়ি অনিবার্য হয়ে উঠে আরও প্রয়োজনে। শরীরে শরীরে আমাদের ভাব বিনিময় হয়, বিনিময় হয় প্রতিশ্রুতি। আমরা একসময় তার নাম দেই ভালোবাসা।
ট্রেনটি যখন স্টেশনে থামে তখন বাইরে ভোরকে ডেকে আনা অন্ধকার। ছেঁড়া কাপড়ের মতো সেই অন্ধকারের ভাঁজে ভাঁজে আলো। আমি জানতাম ট্রেন ভোরে স্টেশনে থামবে। কিন্তু এই ভোর যে এমন কাকপক্ষী না জাগা ভোর আমি বুঝিনি। আমার একলা চলা জীবনে নানা কিসিমের অন্ধকার। আসল অন্ধকার আমার কাছে কোনো অন্ধকারই নয়। লোকাল ব্রাঞ্চ থেকে কেউ এসেছে কিনা নিশ্চিত না হয়েই আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। সুনসান স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়। খুব কাছে পিঠেই গারো পাহাড়। সর্পিল গতিতে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আমার ডাকঘরের অমলের কথা মনে পড়ে। মনে হয় স্বপ্নের মতো গারো পাহাড়ের গা চিড়ে চলে যাবে অজানায় যেখানে রাজা থাকে। দুই পাহাড়ের মাঝ বরাবর জাগবে নববধূর কপালের টিপের মতো লাল সূর্য।
ট্রেন চলে গেলে হঠাৎ আমার চোখ পড়ে একরাশ ধোঁয়ার দিকে। কুয়াশার বুক চিরে রহস্যের মতো ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে পিলারের টিমটিমে আলো বরাবর। আমি এগিয়ে যাই সেদিকে। টিনের ভেতরে কাঠ কয়লার গনগনে আগুনে জ্বাল হচ্ছে হলুদ রঙে ঘনীভূত হয়ে আসা দুধ। এক কাপ চায়ের কথা বলে পাশে রাখা বেঞ্চে বসি। তখনই মেয়েটা এসে পাশে দাঁড়ায়। রুমা আপা? মাংকি টুপিতে কান ঢাকা। কয়েক পরত শীতের কাপড়ে শরীরস্বাস্থ্য, লিঙ্গ বুঝা দায়। কথা না বললে আমিও বুঝতাম কিনা সন্দেহ।
অচেনা পরিবেশে নিজের নাম শুনে স্পষ্টই বুঝলাম অফিসেরই প্রতিনিধি। আমি হাত বাড়িয়ে পাশে বসালাম। জি আমি রুমা। মেয়েটি নিজের পরিচয় দিলো, রুম্মান। রুম্মান হাবিবা। স্থানীয় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। আরে বাহ, আমাদের দুজনের নামেতো বেশ মিল। যেখানেই যাই সাধারণত পুরুষসহকর্মীরাই এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানে নারী তা ও আবার অঘটন ঘটার মতো রহস্যময় ভোরে। আমি খানিকটা বিস্মিতই হই। কিন্তু তা অপ্রকাশ্য রেখেই সহযাত্রী হই মেয়েটির। ডরমেটরির রুমে আমাকে পৌঁছে দিয়ে সকাল দশটা নাগাদ দেখা হবে বলে চলে যায় মেয়েটি।
অফিসে ঢোকার মুখেই দেখা হয় রুম্মানের সাথে। রাতের চেহারার সাথে মিলাতে পারিনা। বড় টিপ, লিপস্টিক, ম্যাচিং শাড়ি ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং চাদর। আমার জন্যই অপেক্ষারত সে। ফিল্ড ভিজিটে যাওয়ার আগে ফাইল ওয়ার্কগুলো দেখে যাওয়া নিয়ম। মাসওয়ারি রিপোর্টগুলো এগিয়ে দেয় রুম্মান। আমি দেখতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাসে চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন শতকরা সাতাশ পার্সেন্ট নারী যা কিনা আগস্ট মাসের চেয়ে চার পার্সেন্ট কম। আমি কারণগুলো যাচাই করি। রুম্মান অক্টোবর মাসের রিপোর্ট গুছায়, আপা কফি দিতে বলি। হুম মন্দ হয় না জানিয়ে আমি আবার ফাইলে মনোযোগ ফিরিয়ে নেই।
আমাদের কাজগুলো মূলত একটু প্রত্যন্তে। নারীদের রোগ বালাই নিয়ে কথা বার্তা। বিশেষত যে নারীরা মেয়েলি রোগে ভোগে কিন্তু মুখ ফুটে বলে না পর্যন্ত। তাদের সরাসরি ডাক্তারের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়া। কাজটা শুরু হয়েছিলো বিদেশি অর্থায়নে। বিদেশিরা তখন আমাদের নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলো। পরে মধ্যমআয়ের দেশ হয়ে উঠলে দ্রুতই তাদের সব দুশ্চিন্তার অবসান হয় আর আরও দ্রুত তারা সব অর্থায়ন বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। এখন স্ব অর্থায়নেই কাজ হচ্ছে।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে রুম্মানই প্রথমে প্রসঙ্গ উঠায়। আপনি আরিফকে চিনতেন? কোনো আরিফ আমি চমকে তাকাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ। রুম্মান হঠাৎ আরিফের কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো? আমার কৌতুহল বাড়তে না দিয়ে রুম্মান জানায় আমি ওর লাইফ পার্টনার। ফেসবুক আইডি খুলে বেশ হাসিখুশি ছবি দেখায় দুজনের। রাতে ওর বাসায় দাওয়াতের আহবান করে আমাকে। আমি যাবো কী যাবো না ভেবে দ্বিধা দ্বন্দ্বে রুম্মান হঠাৎ আমাকে আরিফের ফোন ধরিয়ে দেয়। আমার না করা হয়ে উঠে না। আর করবোই বা কেনো। আমি আরিফের প্রেমিকা ছিলাম। এখন যতোই ও ভালো না থাকার গল্প বলুক, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আসার কথা বলার মতো অবিবেচক মেয়েতো আর আমি নই। বলিওনি কোনোদিন। আরিফ যখন ওর দুঃখের কথা বলে আমি বন্ধুর মতোই ওকে সান্ত্বনা দেই। কি আর করা আরিফ, মানিয়ে নাও। সন্তানদের দিকে তাকিয়ে। আরিফও খুব একটা আপত্তি করেনা। মেনে তো নিতেই হবে। বলে হাঁফ ছাড়ে।
বেশ জমে আমাদের আড্ডা। রাতে আরিফের বাসায়। আরিফের সাথে এতোদিনের কথায় কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, আরিফের স্ত্রী কী করে। আশ্চর্য। আরিফ রুম্মানের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলে, তাইতো তুমি জিজ্ঞেস না করলে আমি বলবো কেনো। রুম্মান আমার চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলে, আজ আপনাকে নিয়ে না এলে কী যে হতো! অনেক অপেক্ষা করে ছিলো আপনি আসবেন।
আমি দুজনের সংসার দেখি। বাচ্চাগুলো ডিভাইসে খেলায় মগ্ন। রুম্মান পোলাওয়ের ডিস রাখে টেবিলে। ঘি ফোঁড়নের খিদে লাগা গন্ধ রাতটাতে মেহমান আপ্যায়নের আনুষ্ঠানিকতা যোগ করে। আরিফ মাংসের বাটিতে চামচ দিতে দিতে রুম্মানকে তাড়া দেয়, যাও তো তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো একসাথে খাই। রুম্মান অভ্যাসের মতো বাকি কাজ আরিফকে দিয়ে ভেতর ঘরের দিকে হারিয়ে যায়।
একটার পর একটা বাটি ওভেনে দিতে দিতে আরিফ রুম্মানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। কী যে ভালো মেয়ে রুম্মান। দারুন রান্নার হাত। কী যে কর্মঠ। ঘরসংসার চাকরি সব একহাতে সামলায়। আমি তো সারা সপ্তাহ ঢাকাতেই থাকি। একটুও ভাবতে হয়না সংসার নিয়ে।
আমার মনে হতে থাকে এ আরিফ নয় অন্য কেউ। কিংবা আমার ম্যাসেঞ্জারে যে কথা বলেছে সে আরিফ নয় অন্য কেউ। নিজের বিশ্বাসকে করুণা হয়। অস্বীকার করতে পারি না, আরিফ অসুখে আছে জেনে নিজেকে বেশ প্রয়োজনীয় মনে হতো জগত সংসারে। অস্বীকার করি না এই সুখেও নিজের অনেক অসুখ আমি ভুলে থাকতে পারতাম।
এক রাতে সব সৌধ ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়লে আমি ডরমিটরিতে ফিরে ব্লক করে দেই আরিফকে।
ফিল্ড ভিজিটে যাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলিয়ে দেয় রুম্মান। শ’খানেক মহিলা জমায়েত হয়েছে ভোর থেকে। দ্রুত পৌঁছাতে হবে আমাদের। ডাক্তারও চলে আসবেন সময়মতো। এলাকাটা খুব নাজুক। অতিরিক্ত লবণ পানিতে। লবনাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নানা মেয়েলি রোগে আক্রান্ত মেয়েয়া। ডাক্তার বলেছিলেন আগামী বছরদশেকের মধ্যে এই এলাকায় স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব মহামারী আকার ধারণ করবে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বারকয়েক ঘুরে তাড়া দেন, আপনি উপর মহলে কথাটা তুলবেন। এ ব্যাপারে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেও ভেতরে ঠিকই জানি উপরমহলের কতোশতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কাছে এই প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের জীবনের কী আর গুরুত্ব! তবু ডাক্তার রুমানার উদ্বিগ্নতা আমার ভালো লাগে। কেউতো ভেতর থেকে এখনও মানুষ। এতো দরদ নিয়ে অন্যের কথা ভাবে।
ডা. রুমানার সাথে এই প্রত্যন্তে পরিচয় হবে আমি কল্পনাও করিনি। নাহিদের স্ত্রীর নাম রুমানা এটাও জানা ছিলো না আমার। দুজনের নানা কেজো অকেজো আলাপের মাঝে হঠাৎ ঢুকে পড়ল নাহিদ। এ নিয়ে নাহিদের থিসিস ইন্টারন্যাশনাল জার্নালগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়েছে। কোন নাহিদ? ডিএমসির নাহিদ! ব্যাচ? আমি নিশ্চিত হই নাহিদই বটে। বয়সন্ধিকালের প্রেমিক আমার। যে প্রেম নানা দেনা পাওনা, ভুলভাল বুঝাবুঝি, আজন্ম সংস্কার কাটিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত কি উচিত না ইত্যাদি টানাপোড়েনে আমাদের যৌবন পেরিয়ে যেতে থাকে। নাহিদের পরিবার কিংবা আমার পরিবার কেউ ভাবতেই পারেনি আমাদের বাল্যপ্রেম ঘরসংসারে গড়াবে না। আমার বাড়িতে নাহিদের জামাই আদর ছিলো, ওর বাড়িতেও ওর আম্মা ঠাট্টাচ্ছলে অধিকার বুঝিয়ে দিতেন, এই মাইয়া নিজের সংসারের সব বুইঝ্যা ল।
আমি যখন নিজ পরিবার আর নাহিদকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম, যতোটা অবাক হয়েছিলো পরিবার, ততোটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল নাহিদ। কাঁচা বয়সের প্রেম। ও লাল জামা বললে আমি লাল জামা, অমুকের সাথে কথা বলা নিষেধ তো নিষেধ, তমুকের ফোন ধরতে পারবে না তো ধরি না। হুঁশ হলে যখন নিজের বিলীন হওয়া টের পাই তখন আমিও না তো না। নাহিদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো প্রেম হারিয়ে কতোটা আর আমার দৃঢ়তার বিস্ময়ে কতোটা আমি বুঝতে পারিনি। তবে সহপাঠী রাকিবের সাথে এক রিক্সায় দেখে যেদিন নাহিদ আমাকে টেনে হিঁচড়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিলো সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নাহিদের সাথে আর নয়। খুব ভেঙে পড়েছিল নাহিদ। নাহিদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে ছিলো যে নাহিদের আম্মা আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে নাহিদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিলেন। নাহিদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো আমার দিকে। যে তাকানোতে করুণ আর্তি ছিলো। রুমা তুমি আমার হয়ে যাও আর তার চেয়েও বেশি আকুতি ছিলো এমন, রুমা তুমি আগের মতো হয়ে যাও। নাহিদ জানতো না টিউব থেকে পেস্ট বেরিয়ে গেলে আর টিউবে ঢুকানো যায় না।
আমাকে মুঠোয় পুরে রাখার দমবন্ধ কষ্ট আমি বুঝে গেছি। নাহিদের আকুতি পাত্তা না দিয়ে চলে আসায় সেদিন নাহিদ যে অবাক হয়েছিল, সামনে হিমালয় পাহাড় ধ্বসে গেলেও বোধহয় হতনা সে। একটু খারাপ যে আমার লাগেনি তা নয়। দিন শেষে অজস্র একসাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে আমি কেঁদেছি। আহা নাহিদ, যদি আমার ভালোবাসার অভাবে এলোমেলো হয়ে যায় তার জীবন!
খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জনের বাসাটা বেশ ছিমছাম। দুধারে ফুলের বাগান আর মাঝখানে রাস্তা। বিশাল ছড়ানো বারান্দা। সেখানে আয়েসী দোলনার মৃদু দোলা বুঝিয়ে দেয় এই বাড়ির ভেতর সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য মিলেমিশে বাস করে। রুমানা ভেতরে গিয়ে নাহিদকে পাঠায়। নাহিদের চোখে তেমন উচ্ছ্বাস নেই যেমন আশা করেছিলাম। এতোদিন পর দেখা, নাহিদ খুব স্বাভাবিক স্বরে বলে রুমানার মুখে রুমা নাম শুনে একবার মনে হয়েছিল হয়তো তুমিই হতে পারো। অনেক দূরের অনাকাঙ্খিত মানুষের মতো কেমন আছো জিজ্ঞেস করে আর কথা আগাতে পারে না নাহিদ। রুমানাকে ডেকে গল্প করতে বসিয়ে বাচ্চাকে পড়া দেখানোর অজুহাতে উঠে যায় নাহিদ।
ডরমেটরিতে ফিরে আমি নাহিদকে ইরেজ করতে চাই। কিন্তু কোথায় আছে নাহিদ? ফেইসবুকে নেই, হোয়াটসঅ্যাপে নেই। কোথায় ইরেজ করবো? যেখানে থাকার কথা, হৃদয়ে। সেখান থেকে নাহিদ মুছে সাফ করে দিয়েছে কোনো সন্দেহ নাই। বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম বুঝি আমি কোথাও আছি।
সারাবাংলা/এসবিডিই
গল্প-উপন্যাস বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ রুমা মোদক রুমা মোদকের গল্প ‘কিছু নেই’ সাহিত্য