রণজিৎ সরকারের গল্প ‘সৎ সন্তান প্রয়োজন’
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১১:০৮
১.
বাসার রহমান। পেশায় স্কুল শিক্ষক। তিনি শিক্ষাদান শেষ করে ওষুধের দোকানে এসে বসেন। আমার দোকানটা ভূইয়াগাঁতী বাজারে। স্কুল থেকে একটু দূরেই ওষুধের দোকান। বাসার মহোদয় কিন্তু প্রতিদিন ওষুধ কিনতে আসেন না। তিনি আসেন পত্রিকা পড়তে, আমার সঙ্গে দেশের রাজনীতির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মতাদর্শ এক। তাই তার সঙ্গে অনেক কিছু মিলে যায়। কথা বলতে স্বস্তিবোধ করি। কথায় আছে না মিলে থাকলে তেঁতুল পাতায় খাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে মিলটা যেন ঠিক তেঁতুল পাতায় খাওয়ার মতোই।
বাসার মহোদয় সৎ মানুষ। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সৎ মানুষের মধ্যে তিনিই প্রথম স্থানটা দখল করে আছেন। সে জন্য তার সঙ্গ পেতে ভালো লাগে আমার। সৎ সঙ্গ স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ। আমরা সবাই স্বর্গ বাস করার প্রত্যাশা করি। কিন্তু সে প্রত্যাশাপূরণ করার জন্য কর্ম করি না।
বাসার মহোদয়কে দুটো কারণে শ্রদ্ধা করি। এক তিনি শিক্ষক মানুষ, দুই সৎ মানুষ। তিনি কখনো অন্যায় করেন না। অন্যায় সহ্য করতে পারেন না। মানুষের উপকার করতে ভালোবাসেন। কাউকে উপকার করতে না পারলেও ক্ষতি করেন না কখনো।
২.
কয়েক দিন হলো বাসার মহোদয় আমার দোকানে আসেন না। মোবাইল ফোনে কল করলে রিসিভ করেন না। ঘটনা কী। কি হলো তার। অসুস্থ হলে আমাকে তার প্রয়োজন পড়ত। আমাকে কল করতেন। তার বাড়িতে যেতে বলতেন। কিন্তু কোন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নিশ্চিত তিনি অসুস্থ হননি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার বউ বাড়ি থেকে চলে গেছেন। তাও আবার পরপুরুষের সঙ্গে। এ যুগ-যামনায় বউ চলে যাওয়ার মতো এমন ঘটনা শুনে অবাক হওয়ার কথা না। অনেকের বউ তো চলে গেছে ও যাচ্ছেও। কিন্তু আমি সত্যি অবাক হলাম বাসার মহোদয়ের মতো মানুষের বউ চলে যাওয়ার কথা শুনে। এমন ভালো মানুষকে রেখে কোন চালাক স্ত্রী চলে যাবে না। বউ চলে নিশ্চয় কোন একটা রহস্য আছে। ভাবির চলে যাওয়ার খবর শুনে আমি সত্যি সত্যি আহত হলাম।
ঘটনা কী ঘটেছে? আমার জানার আগ্রহ খুব বেড়ে গেল। বাসারের সাথে কথা বলতে হবে। আসল ঘটনা উদ্ধার করার জন্য। বাসারের সংসারে কোন অভাব নেই। নেই শুধু তাদের সন্তান। ভাবি, তো অনেক ভদ্র ঘরের মেয়ে। তিনি কেন বাসার ভাইয়ের মতো সৎ মানুষকে রেখে অন্যের হাত ধরে চলে গেলেন। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। চলে যাওয়ার নিশ্চয় কোন এক রহস্য আছে। রহস্যটা আমাকে বের করতেই হবে। বাসার ভাইকে আমার সাথে একান্ত কিছু কথা শুনতেই হবে। কিন্তু বউ চলে যাওয়া পর থেকে লজ্জায় তিনি স্কুল আর বাসা ছাড়া কোথায় যাচ্ছেন না।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসারের বাসায় যাব। একান্তভাবে তার কিছু কথা শুনব।
৩.
শুক্রবার। দুপুর বেলা। দোকান বন্ধ করলাম। মোটরসাইকেল নিয়ে বাসার মহোদয়ের ইচলাদিগর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একটু পর তার বাড়িতে পৌঁছালাম। মোটরসাইকেল রেখে গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখতে পেলাম তার বৃদ্ধা মাকে। বাসারের মা আমাকে চেনেন। কারণ মাঝে মাঝে তাকে চিকিৎসা করতে আসতে হয়। সালাম দিয়ে বললাম, চাচি, আপনার শরীর কেমন?
চাচি আমার দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চিনতে পারলেন না। তারপর পাশে রাখা চশমাটা চোখে পরে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার রোহান। আমি বুঝতেই পারিনি বাবা। চশমাটা চোখে ছিল না, তাই তোমাকে চিনতে পাচ্ছিলাম না। দেরি হলো চিনতে, কিছু মনে করো না বাবা।
না না আমি কিছু মনে করিনি চাচি। এবার বলেন আপনার শরীর কেমন।
আমার শরীর ভালো। কিন্তু মন ভালো না রে বাবা।
আমি বুঝতে পারলাম। বউ মা চলে যাওয়ার কারণে তার মন খারাপ। এ প্রসঙ্গে তার সাথে কথা বলব না আর। অন্য প্রসঙ্গে বললাম, চাচি, বাসার ভাই কোথায়?
চাচি ডান হাত রুমের দিকে লম্বা করে বললেন, রুমে।
আমি রুমে দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজা খোলা। রুমে ঢুকতেই দেখি গভীর মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখছেন।
বললাম, বাসার ভাই।
আমার কথা শোনা মাত্র তাকালেন। বাসার বললেন, রোহান হঠাৎ আপনি, স্বপ্ন দেখছি না তো।
হ্যাঁ, আমি।
আমার বাসায় কি মনে করে। আমরা তো সবাই সুস্থ আছি।
আপনার পাশের গ্রামে রোগী দেখতে এসেছিলাম। আপনার বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। মনে হলো আপনার আম্মাকে দেখে যাই। তাই চলে এলাম। আর আপনি তো কয়েক দিন হলো দোকানে যাচ্ছেন না।’
শরীরের অসুখ হলে আপনার দোকানে বাধ্য হয়ে অনেকেই যায়। আমি তো যেতাম। আমার মনে সুখ নাই। মনে এখন অশান্তি। অশান্তির জন্য যাওয়া হচ্ছে না। বাসায় এসেছেন, ভালো করেছেন। এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। বসুন।
আচ্ছা। আমি বসছি।
পাশের চেয়ারের বসলাম। তারপর বললাম, আপনার মনে অশান্তি, আপনার মায়ের মন খারাপ। কি হয়েছে বলেন তো?
একটা ঘটনা ঘটেছে, সে জন্য মন খারাপ।
ঘটনাটা কি, আমাকে বলা যাবে।
আপনাকে ঘটনাটা বলা হয়নি। জানেন কি না জানি না। যে জন্য আমি আপনার দোকানে যাচ্ছি না। আসলে আপনার ভাবি আমাকে রেখে সজীব নামের একটা ছেলের সাথে চলে গেছে।
বলেন কি!
আমি বুঝতে পারলাম প্রসঙ্গ যেহেতু চলে এসেছে। এখন কথাটা বলা উচিত। তাই বললাম, ভাবি, কেন চলে গেছেন। নিশ্চয় কোন কারণ আছে?
দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বাসার বললেন, কারণ তো একটাই।
কী কারণ?
সন্তান।
আপনাদের তো কোন সন্তান নেই। সন্তান নিয়ে ঝগড়া বিবাদ হওয়ার কথা না।
আপনি তো বেশ ভালো করেই জানেন রোহান। আপনার ওষুধের দোকান থেকে আমি মাঝে মাঝে কত কিছু নিয়েছি। শুধু সন্তান নেব না বলে। সন্তান নেওয়া না নেওয়ার কারণে ফারিসার সাথে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতো।
হ্যাঁ, তা তো জানি। তবে বিয়ে করে সন্তান দেরিতে নেওয়া ঠিক না।
তা তো বেশ ভালো করেই জানি।
আমার দুই বন্ধুর বিয়ে করে সন্তান দেরিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পাঁচ বছর পার হয়েছে, এখন আর তাদের সন্তান হচ্ছে না। তারা বিপদে পড়েছে। কত কিছু করছে কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তাই জানেন তাদের ভাগ্যে সন্তান আছে কি না।
কিন্তু এ জনমে এ যুগে আমার যে সন্তানের বাবা হওয়ার ইচ্ছা নেই রোহান।
বাসারের কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে সমুদ্রের ভেতর পড়লাম। বলে কি! আমি বললাম, আপনি সন্তানের বাবা হতে চান না কেন?
সন্তানের অপকর্ম দ্বারা আজকাল বাবা মায়েরা কত অপমানিত হচ্ছেন। কেউ বাবা মাকে খুন করছে। সন্ত্রসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। ধর্ষণ করছে। মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে। ছিনতাই করছে। জঙ্গি হচ্ছে। কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। নেশাগ্রস্থ হয়ে বিপথে যাচ্ছে। আমি চাই না আমার সন্তান এদের মতো হোক। তাই নানা কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি সন্তানের বাবা হব না। এটাই ছিল আমার শেষ সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনার ভাবি, সন্তান নেওয়ার জন্য পাগল ছিল। সন্তানের মা হওয়ার জন্য ফারিসা অন্যের সাথে চলে গেছে। যাক তাতে আমার কোন শোক দুঃখ নেই। কারণ আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। সে তার ইচ্ছাপূরণ করার জন্য অন্য পুরুষের সাথে চলে গেছে যাক, সে তো নারী।
প্রতিটি নারী তো চায় তার কোলজুড়ে সন্তান আসুক। ভাবি তো একজন নারী। তার মাতৃত্বের চাওয়া থেকে কেন বঞ্চিত হবেন। আপনি না মানুষ গড়ার কারিগর। আপনার সন্তানকে নিজে হাতে কাদামাটির মতো গড়ে তুলতেন। তাহলেই তো সে আপনার মতো ভালো মানুষ হতে পারত।
এ যুগের এই পরিবেশে তা কখনো সম্ভব না। আর আমি মানুষ গড়ার কারিগরের কথা বলছেন, সে জন্য তো আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিজ সন্তানের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমার মোবাইল ফোন একটা কল এলো। কলটা করেছেন এক রোগীর ছেলে। কলটা রিসিভ করে বললাম, কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসছি। এই বলে ফোনটা রেখে দিয়ে বললাম, বাসার ভাই, কাশেমের মাকে দেখতে যেতে হবে। আমি এখন যাই। আপনি বিকেলে দোকানে এসেন। আপনার সাথে আরও অনেক কথা আছে।
ঠিক আছে। এভাবে তো আর বেশি দিন থাকা যাবে না। বিকালে আমি আপনার দোকানে যাব। জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য আমি নিজে ইনজেকশন নিব।
কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি দোকানে আসেন। তখন বিস্তারিত বলব।
ওকে।
আর হে বাসার ভাই, আপনি ভাবির কথা একটু ভাবেন, দেখেন ঘরের লক্ষ্মীকে ঘরে নিয়ে আসা যায় কি না।
আপনার রোগীর অবস্থা হয়তো সিরিয়াস। আপনি এখন যান। দোকানে এসে কথা বলব।
ঠিক আছে।
মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলাম। ভাবতে লাগলাম, বাসার মহোদয়ের কথাগুলো। কিন্তু কিছুতেই তার সন্তানহীন থাকা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না আমি।
সারাবাংলা/এসবিডিই
গল্প-উপন্যাস বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ রণজিৎ সরকার রণজিৎ সরকারের গল্প ‘সৎ সন্তান প্রয়োজন’ সাহিত্য