চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় এক চক্কর
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৫২
মেলায় ঢুকতেই ছেলের চোখ ছানাবড়া। বহু মানুষ, বাহারী খেলনা। কী নেই! ছেলে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। হাতে হারমোনিয়ামের মতো ঝুনঝুনি তুলে দিতেই নয় মাসের ছেলের হাসিতে বাবা হিসাবে আমার হৃদয়েও মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে থাকা ছোট দুই খালাতো ভাইও নানা খেলনা পেয়ে বেজায় খুশি। আর আমার সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে রাতে গরম লাল জিলাপি খাওয়ার স্বাদও ছিলো মুখে লেগে থাকার মতো। একইসঙ্গে বন্ধু ও ছোটভাইদের নিয়ে মেলায় এক চক্কর দিয়ে মনে হলো গ্রামীণ মেলা এখনও তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে। বলছিলাম ময়মসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রামের চৈত্র সংক্রান্তির মেলার কথা।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ শুক্রবার এই মেলা বসে। মূলত একদিনের মেলা হলেও রেশ থাকে তিনদিন। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত চলতে থাকে মেলার নানা উৎসব, আয়োজন। মেলায় অংশ নিতে গ্রামের প্রত্যেকে যেমন শহর থেকে ছুটে আসেন, তেমনি নাওইর- আত্মীয়স্বজনের পদচারণায়ও মুখর হয়ে উঠে গ্রামের সতেজ সবুজ মাঠ। ঘরে ঘরে চলে নানা আয়োজন, বাহারী রান্না।
মাইজবাড়ীর এই মেলাটি আযির ঢালীর মেলা হিসাবে পরিচিত। তবে লোকমুখে মাইজবাড়ি মেলা হিসাবেই অধিক সমাদৃত। মূলত গফরগাঁও উপজেলায় এই মেলার বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে গফরগাঁও উপজেলার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় মেলা। যদিও মুখীর মেলা নামে অন্য একটি মেলাও রয়েছে, যা মূলত মাজারকেন্দ্রিক।
মেলায় মাটির তৈজসপত্র ও খেলনার পসরা বসে। প্রায় হারিয়ে যাওয়া টেপা পুতুলও দেখা যায় মেলাটিতে। প্রতিবছরের মতো এবারও দেখা গেলো টেপা পুতুলের পসরা। ছোট ছেলেমেয়েদের খেলনা হিসাবে ব্যবহৃত ছোট হাড়িপাতিল, চুলা, কলসি, শিল-পাটাসহ নানা খেলনা দেখা গেলো এবারের মেলাতেও। কথা বলে জানা গেছে, এরসবগুলোই হাতে তৈরি। অর্থাৎ নানা যন্ত্রের ছোয়ায় এখন মাটির তৈজসপত্র তৈরি হলেও এখনও গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছোঁয়া রয়েছে। বাচ্চা ছেলে মেয়েদের কাছেও কদর রয়েছে এসব খেলনার। ঘরে ব্যবহার্য বিভিন্ন অসবাবপত্রের দেখা গেছে মেলায়, যা মাটির তৈরি।
আযির ঢালীর মেলায় চোখে পড়েছে বাহারী হাতপাখা। কোনটি তালপাতা আবার কোনটি খেজুরপাতা দিয়ে তৈরি। আবার কাপড়ের ওপর সুতার নকশা করে তৈরি হাতপাখাও দেখা গেছে। দেখা মিলেছে ঘুড়িরও। মেলায় ছিলো নাগরদোলাও। নাগরদোলায় উঠে শিশুরা ভীষণ উল্লসিত। রাতে আমরা কয়েক ছোটভাই মিলে এবার নাগরদোলায় উঠেছিলাম, যেন ফিরে গেছি সেই শৈশবে। এটিই মেলার প্রভাব! চুড়ি, কানের দুল, নাকফুল, চুলের কাঁকড়াসহ নারীদের নিত্যব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসপত্র দেখা গেছে মেলাতে। মূলত গ্রামীণ নারী ও ছোট ছোট মেয়েরা মেলার এসব গহনার প্রতি বেশ আগ্রহী। পুরো মেলাজুড়ে দোকানগুলোতে সব বয়েসী নারীদের ভিড় প্রতিবারের মতো এবারও দেখেছি।
একসময় বাবা অথবা বড় চাচার হাত ধরে মেলায় যেতাম। তখনকার মেলা ছিল আরও বেশি জমজমাট। মেলা উপলক্ষ্যে সব আত্মীয়স্বজন চলে আসতেন। তবে আগের সেই জমজমাট ভাব আর নেই। তবে এখনও আত্মীয়স্বজনরা আসেন। বেশিরভাগক্ষেত্রেই আসে ছোট শিশুরা। এবারে মেলা রোজায় হওয়ায় জমজমাট ভাব অন্যবারের চেয়ে কিছুটা কম।
তবে একটা বিশেষ কারণে এবারের মেলা আমার জীবনে একেবারেই অন্যরকম। প্রথমবার ছেলেকে কোলে নিয়ে মেলায় গিয়েছি এবার। মেলার সময়ে পারিবারিক কাজে গ্রামে ছিলাম, তাই মেলায় যাওয়ার এই সুযোগ মিলেছে। ছেলের বয়স এখন নয় মাস। তাই ছেলের জীবনে নিজ গ্রামের মেলা এবারই প্রথম। যদিও ছেলের কিছু বোঝার সময় হয়নি, তবুও কয়েকদিন ধরেই মা ও আমার সহধর্মিনী বলছিল- ছেলে নাকি মেলার কথা শুনলেই নাকি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। দাদার কাঁধে চড়ে মেলায় যেতে চায়। তাই ছেলেকে মেলায় নিয়ে যাওয়া আনন্দ মিস করতে চাইনি।
মেলায় যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল ছেলে হতবাক। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখছিল চারদিকের শত শত মানুষ। দেখছিল নানা খেলনা ও মানুষের ছোটাছুটি। দোকানে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন খেলনা হাতে পেয়ে তা নিয়েই খেলতে শুরু করে আমাদের রাইয়ান। মেতে উঠে আনন্দ আর হাসিতে। বিভিন্ন দোকানের সামনে নানা খেলনা দেখে সে বেজায় খুশি। সঙ্গে ছিল খালাতো দুই ছোটভাই। তারাও মেলায় অংশ নিয়ে বেশ আনন্দে মাতোয়ারা। মোবাইল, হারমোনিয়াম, বাঁশি, গাড়ি, ঝুনঝুনি ও বেলুনসহ নানা খেলনা কেনা হলো আমাদের ছেলের জন্যে। শেষে বাজার থেকে ইফতার সামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফেরা।
ইফতার শেষ করে রাতে আবার মেলায় আসলে বন্ধুরা মিলে গরম গরম জিলাপি খাওয়ায় মেতে উঠি। রাতে বাড়ি ফেরার সময় অল্প করে জিলাপিও নিয়েছে। রোজায় মেলা হওয়ায় এবার জিলাপি ও মুড়ি-মুরকির দোকানগুলোতে ভিড় কিছুটা কম। বন্ধু ও ছোটভাইরা মিলে বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখেছি। এবার মেলায় বড় আকারের লটারির ব্যবস্থাও ছিল, সেখানেও মেতে উঠেছিলো এলাকার সব বয়সী মানুষ।
সারাবাংলা/এসবিডিই
এমদাদুল হক তুহিন চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় এক চক্কর বেড়ানো বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ সাহিত্য