হেমন্তের অন্তিম খেলা
২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৩২
মূল: রয় ডগলাস ব্র্যাডবেরি, অনুবাদ: হিল্লোল দত্ত
(রয় ডগলাস ব্র্যাডবেরি (২২ আগস্ট, ১৯২০- ৫ জুন, ২০১২) ব্র্যাডবেরি একজন মার্কিন ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, চিত্রনাট্যকার, এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের একজন পরামর্শক। তিনি ইলিনয়ে জন্ম নেন, টুসনে পড়াশুনো শুরু করেন, শেষ করেন লস এঞ্জেলসে। একক কৃতিত্বে তিনি বিংশ শতকের কল্পবিজ্ঞানের গল্প মূলধারার সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কল্পবিজ্ঞানের পাশাপাশি তিনি রহস্যরোমাঞ্চ, ভয়, জাদুবাস্তবতার গল্পও লিখেছেন অনেক। উপন্যাস ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ এবং গল্পসংকলন ‘দ্য মার্শ্যান ক্রনিকল’ -এর জন্যে তিনি বিখ্যাত। ‘দ্য অক্টোবর গেম’ তার এক পরিবারের তিনটি চরিত্রের গল্প যা শেষ হয় হেমন্তে।)
বন্দুকটা আবার নামিয়ে রাখে সে টেবিলের ড্রয়ারে আর ঠেলে বেঁধে দেয় ড্রয়ারটা।
না, এই ভাবে না। লুইজি এভাবে কষ্ট পেলে চলবে না। সে মরে যাবে আর সব শেষ হয়ে যাবে আর সে কষ্ট পাবে না। তার কষ্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ-স্থায়িত্ব। কল্পনার মাঝ দিয়ে স্থায়িত্ব। কিভাবে যন্ত্রণাটা দীর্ঘায়িত করা যায়? প্রথমত, কিভাবে যন্ত্রণাটা দেওয়া যায়? ঠিক হ্যায়।
শোয়ার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটা বেশ যত্ন করে তার কাফলিঙ্কগুলো জোড়া দেয়। তার এই উষ্ণ দোতলা ঘরের বাইরে নিচের রাস্তায় বাচ্চাদের ছটফটে দৌড় শোনা পর্যন্ত দীর্ঘক্ষণ সে স্থির থাকে, অনেক ছাই-রঙের ইঁদুরের মতো ওই বাচ্চাগুলো, অনেক পাতার মতো বাচ্চাগুলো।
বাচ্চাদের আওয়াজেই বোঝা যায় ক্যালেন্ডারের দিন-তারিখ। ওদের চিৎকার শুনেই বোঝা যায় সন্ধ্যেটা কোন ঋতুর। বোঝা যাচ্ছে বছরের শেষের দিককার সময় এটা। অক্টোবর। অক্টোবরের শেষ দিন, সাথে আছে সাদা কঙ্কালের মুখোশ আর কাটা কুমড়ো আর গলে-পড়া মোমবাতির গন্ধ।
না। বেশ কিছু দিন ধরে কিছুই ঠিক ছিল না। অক্টোবরেও কোনো কাজ হয়নি। যদি কিছু হয়, হয়েছে আরও খারাপ। কালো বো-টাই ঠিক করে নিল সে। যদি বসন্ত হতো, সে আয়নায় তার প্রতিবিম্বের সামনে ধীরে, নিঃশব্দে, আবেগশূন্যভাবে মাথা ঝোঁকালো, তবে হয়তো একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আজ রাতে সারা দুনিয়া পুড়ে ছারেখারে যাবে। নেই বসন্তের কোনো সবুজ, নেই কোনো সতেজতা, নেই কোনো প্রতিজ্ঞাই।
হলে দৌড়ের মৃদু শব্দ। “ওই যে মারিয়ন,” নিজেকে বলে সে। “ছোট্ট সোনা আমার। তার চুপচাপ আটটা বছর। একটুও শব্দ নেই। শুধু ওর ঝকঝকে ধূসর চোখ আর ওর অবাক-হওয়া ছোট্ট মুখ।” তার মেয়ে সারা সন্ধ্যে ধরে ঘরে-বাইরে করেছে, নানান মুখোশ পরে দেখেছে, তাকে জিজ্ঞেস করেছে কোনটা বেশি ভয়-লাগানো, খুব বেশি ভয়ঙ্কর। দুজনেই শেষে একমত হয়েছে কঙ্কালের মুখোশটার ব্যাপারে। ওটা ‘যা দারুণ!’ মানুষকে একেবারে ‘ভয়ের চোটে দাঁতকপাটি লাগিয়ে দেবে!’
আবারও আয়নায় তাকিয়ে নিজের চিন্তা আর পরিকল্পনার গহিন দৃষ্টিতে ডুবে যায় সে। অক্টোবর তার পছন্দের ছিল না কখনওই। সেই দিন থেকেই যখন প্রথম সে তার ঠাকুমার বাড়ির সামনে শুয়েছিল হেমন্তের ঝরাপাতার ওপরে আর শুনেছিল বাতাসের শনশনি আর দেখেছিল খালি গাছগুলো। কান্না চলে এসেছিল তার, কোনো কারণ ছাড়াই। আর সেই মন-খারাপের একটুখানি প্রতি বছর ফিরে আসে তার কাছে। সবসময় চলে যায় বসন্তের সাথে।
কিন্তু, আজ রাতটা যে আলাদা। হেমন্ত যেন থাকতে এসেছে লাখো বছর।
কোনো বসন্ত বুঝি আর আসবে না।
সারা সন্ধ্যে ধরে সে কাঁদছে। তার মুখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, একটা রেখাও না। সবই লুকানো আছে কোথাও, কিন্তু থামেনি।
হইহুল্লোড়ে ঠাসা ঘরটা ভরে উঠেছে ক্যান্ডির ঘন সিরাপের মতো গন্ধে। লুইজি আপেলগুলোকে পরিয়েছে ক্যারামেলের নতুন পোশাক, বিশাল বাটিতে টাটকা মেশানো ফলের রস, প্রতি দরজায় তারে-আটকানো আপেল, ফাঁপা, ফুটোওয়ালা কুমড়োগুলো প্রত্যেকটা ঠান্ডা জানালা থেকে তেকোনা চোখে তাকানো। একটা অপেক্ষমাণ জলের টব লিভিং রুমের মাঝ বরাবর, অপেক্ষা করছে, কাছেই এক ঠোঙা আপেল, ডোবানোর জন্যে। যা দরকার এখন তা একটু ছোঁয়া, বাচ্চাদের যোগ দেওয়া, আপেলগুলো জলে চোবানো আর ভাসানো আরম্ভ করা, তারে আটকানো আপেলগুলো ভিড়ে ভরা দরজায় দোলানো, ক্যান্ডিগুলোর উবে যাওয়া, হলটা ভয়ে বা আনন্দে প্রতিধ্বনিত হওয়া, সবসময় যেমনটা হয়।
এখন, ঘরটা প্রস্তুতির জন্যে চুপচাপ। এবং তার চাইতে একটু বেশি।
লুইজি আজ ছিল বাড়ির প্রতিটা ঘরে শুধু সে যে ঘরে আছে সেটা ছাড়া। এটা তার নিজের দেখানোর একটা সূক্ষ্ম কায়দা, দেখো, মিক, দেখো আমি কী যে ব্যস্ত! এতোটা ব্যস্ত যে যখন তুমি একটা ঘরে ঢোকো যেখানে আমি আছি তখন সবসময়ই অন্য একটা ঘরে আমার কোনো না কোনো কাজ পড়েই যায়! দেখো কিভাবে প্রায় ধাক্কা বাঁচিয়ে চলি!
কিছুক্ষণ ধরে এই ছোট্ট খেলাটা তার সাথে সে খেলে চলে, বাজে একটা ছেলেমানুষি খেলা। যখন লুইজি থাকে রান্নাঘরে তখন সে সেখানে যায়, বলে, “এক গ্লাস জল খাবো।” এক মুহূর্ত পরে, সে দাঁড়িয়ে, জল খাচ্ছে, আর ও যেন স্ফটিকের ডাইনির মতো দেখছে ক্যারামেল ফুটছে স্টোভের ওপর একটা প্রাগৈতিহাসিক মাটির পাত্রে, বলে ওঠে, “ওহ, জানালার কুমড়োগুলোতে আলো জ্বালানোই তো হলো না!” আর ছুটে যায় লিভিং রুমে কুমড়োগুলোকে আলো দিয়ে হাসিমুখ করে তুলতে। সেও আসে পেছন পেছন, হাসে, “পাইপটা লাগছে যে।” “ও রে, সাইডার!”, চেঁচিয়ে ওঠে সে, দৌড়ে যায় খাবার ঘরে। “সাইডারটা আমি দেখছি,” সে বলে। কিন্তু সে যখন পেছন পেছন আসে তখন সে ঢুকে গেছে স্নানঘরে আর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।
স্নানঘরের বাইরে সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, হাসে অদ্ভুতভাবে আর অর্থহীনভাবে, তার মুখের ভেতর পাইপটা ঠান্ডা, আর তারপর, খেলাটায় ক্লান্ত হয়ে, কিন্তু একগুঁয়ে, সে দাঁড়ায় আরও মিনিট পাঁচ। একটা শব্দও নেই ওর ভেতর থেকে। আর পাছে সে কোনোভাবে জেনে খুশি হয় সে বাইরে আছে, বিরক্ত সে, হঠাৎ লাফ দিয়ে ছিটকে আসে আর ওঠে যায় ওপরতলায়, শিস দেয় ফুর্তিতে।
সিঁড়ির ঠিক ওপরে সে অপেক্ষা করে। শেষে শোনে স্নানঘরের দরজাটার খিল খুলে যায় আর সে বেরিয়ে আসে আর নিচতলাটা আবার প্রাণ ফিরে পায়, যেমন পায় জঙ্গলের জীবনযাত্রা, কোনো একটা আতঙ্ক চলে যাওয়ার পর আর হরিণেরা ফিরে যায় বসন্তে।
এখন, তার বোটাই ঠিক-করা আর কালো কোটটা পরা শেষ হলে পরে নিচের হলে সরুগলার চেঁচামেচি শোনা যায়। মারিয়ন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, জামাটায় পুরো একটা কঙ্কালের মতো লাগছে ওকে।
“আমায় কেমন লাগছে, বাপি?”
“ফাটাফাটি!”
ছদ্মবেশের নিচ থেকে সোনালি চুল চোখে পড়ে। খুলির কোটর থেকে দুটো ছোট্ট নীল চোখ হাসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মারিয়ন আর লুইজি, তার পৌরুষ, তার অন্ধকারের শক্তির দুটো নীরব ঘোষণা। লুইজি কী তুক করল যে একটা কালো লোকের সব কালো উবে যায় আর ঘন বাদামি চোখ আর কালো কালো চুল ধুয়ে আর ধুয়ে আর ধুয়ে যায় আর পেটের বাচ্চাটা জন্ম নেয়, মারিয়ন, সোনালি, নীল-চোখ, লাল-গাল? কখনও কখনও তার সন্দেহ হয় লুইজি বাচ্চাটার জন্ম দিয়েছে একটা পুরোপুরি অযৌন অনুভব থেকে, ঘেন্নাভরা মন আর কোষের একটা পবিত্র গর্ভধারণ ওটা। তার প্রতি কঠিন মনোভাব থেকে সে তার নিজের আদলে একটা বাচ্চা তৈরি করেছে, শুধু তাই না, কোনোভাবে ডাক্তারকে দিয়ে বলিয়েছে, “সরি, মি. ওয়াইল্ডার, আপনার স্ত্রী আর কখনও মা হতে পারবে না। এটাই শেষ বাচ্চা।”
“আর আমি একটা ছেলে চাই,” আট বছর আগে মিক বলেছিল।
সে এখন মারিয়নকে তার কঙ্কালের মুখোশসহ জড়িয়ে ধরতে প্রায় ঝুঁকে পড়ে। তার ভেতরে মেয়েটার জন্যে একটা ব্যাখ্যার অতীত করুণা জন্ম নেয়, কারণ বাবার ভালোবাসা কখনও পায়নি সে, পেয়েছে শুধু প্রেমহীন মায়ের দম-আটকানো, চোখে-চোখে রাখা ভালোবাসা। কিন্তু সবচাইতে করুণা করে সে নিজেকে, সে তো সবচে বাজেভাবে জন্ম নেয়নি, তার মেয়েটাকে মেয়ে বলে ভালোবাসেনি, তা সে কালো না-ই হলো, ছেলেও না-ই হলো, না-ই হলো তার নিজের মতো। কোথাও যেন কী হারিয়ে ফেলেছে সে। বাকি সব ঠিকঠাক হলে সে হয়তো বাচ্চাটাকে ভালোবাসলেও বাসতে পারতো। কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে যে লুইজি মা হতেই চায়নি। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার চিন্তায় সে ভয়েই মরে যেতো। সে-ই বাচ্চাটা তার ওপর চাপিয়ে দেয়, আর সে রাত থেকে, প্রসববেদনার দিনটা পর্যন্ত, লুইজি বাড়ির অন্যদিকটাতেই রাত কাটাতো।
জোর-করে চাপানো বাচ্চাটা নিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করতো তার। এমন স্বামীকে ঘেন্না করা লুইজির জন্যে খুব সোজা যে ছেলের জন্যে সাংঘাতিক ব্যস্ত হয়ে নিজের একমাত্র স্ত্রীকে আরেকটু হলেই কবরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো।
কিন্তু, বেঁচে যায় লুইজি। এবং বিজয় তারই! যেদিন সে তাকে দেখতে যায় হাসপাতালে, তার চোখ একদম ঠান্ডা। আমি বেঁচে গেছি, জানিয়েছে তারা। আর মেয়েটা আমার হয়েছে সাদা! দেখো একবার! আর যখন সে ছোঁয়ার জন্যে হাত বাড়ায়, মা-টা তার সদ্য গোলাপি মেয়ে বাচ্চার সাথে ষড় করে সরে যায়, সরে যায় কালো বাধ্যকারী খুনীর কাছ থেকে। সবটাই কী চমৎকার পরিহাস। তার স্বার্থপরতার ফলাফল।
কিন্তু আবারও এসেছে অক্টোবর। এরকম এসেছে আরও আরও অক্টোবর আর যখন সে দীর্ঘ শীতের কথা ভেবেছে ভয়ে সে কুঁকড়ে উঠেছে বছরের পর বছর কারণ তার মনে পড়েছে একটা ঘরে তাকে পিষ্ট হতে হবে অন্তহীন মাসের পর মাস ধরে, বাইরে পাগলের মতো বরফ ঝরছে, আর ভেতরে সে আটকে পড়েছে এক রমণী আর এক শিশুর সাথে, যারা কেউ তাকে ভালোবাসে না, বাসবে না শেষ মাসগুলো অব্দি। গত আট বছর ধরে সে ছোটখাট বিরতি পেয়ে এসেছে। বসন্ত আর শীতে সে বেরিয়ে এসেছে, হেঁটেছে, গেছে চড়াইভাতিতে, সবগুলোই আসলে ছিল এক ঘৃণিত মানুষের আশাহীন সমস্যার আশাহীন সমাধান।
কিন্তু, শীতে, হাইকিং আর পিকনিক আর পালিয়ে-বেড়ানোগুলো ঝরে পড়ে পাতার সাথে সাথে। গাছের মতোই জীবন হয়ে পড়ে রিক্ত, ফলশূন্য, রস মাটিতে শুকানো। ঠিক আছে, তুমি লোকেদের আসতে আমন্ত্রণ জানাও, কিন্তু শীতে বরফঝড় আর এইসব যন্ত্রণায় মানুষদের কি পাওয়া যায়? একবার তার মাথা খুলেছিল, টাকা জমিয়েছিল ফ্লোরিডায় যাওয়ার জন্যে। দক্ষিণে গিয়েছিল তারা। খোলা প্রান্তরে হেঁটেছিল সে।
কিন্তু এখন, আসছে অষ্টম শীত, সে জানে সবকিছুর শেষ আসতে চলেছে। এরপর আর যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তার ভেতরে একটা এসিড আটকে ছিল যেটা এই ক’টা বছরে আস্তে আস্তে তার কোষগুলো খেয়েছে আর খেয়েছে আর আজ রাতে, তার ভেতরের বুনো বারুদে ওটা পৌঁছুবে আর শেষ হয়ে যাবে সবকিছুই!
নিচে পাগলের মতো দরজার বেল বাজে। হলে দেখতে যায় লুইজি। একটাও শব্দ না করে মারিয়ন নিচে দৌড়ে যায় প্রথম অভ্যাগতদের সম্ভাষণ জানাতে। তারপর চিৎকার আর খুশির হুল্লোড়।
সে সিঁড়ির ওপরে ওঠে হেঁটে।
লুইজি নিচে, উপহার নিচ্ছে। দীর্ঘাঙ্গী আর ক্ষীণাঙ্গী সে আর এতোটাই ব্লন্ড যে প্রায় সাদাটে, হাসছে নতুন বাচ্চাদের সাথে।
থমকায় সে। কী এসব? এই বছরগুলো? বেঁচে থাকার এতো একঘেয়েমি? কোথায় ভুল হলো? শুধু বাচ্চাটার জন্ম নিয়েই নয় নিশ্চয়। কিন্তু তাদের সব উত্তেজনার একটা প্রতীক ছিল ওটা, ভাবে সে। তার ঈর্ষা আর তার ব্যবসায় ভরাডুবি আর যতসব বস্তাপচা জিনিস। কেন সে মুখ ফিরিয়ে নিল না, স্যুটকেসটা ভরাট করে নিল না আর চলে গেল না? না। লুইজি তাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে ততটা না দিয়ে সে যাবে না। খুব সোজা ব্যাপারটা। ডিভোর্স মোটেও আঘাত দেবে না ওকে। ওটা হবে স্রেফ ভোঁতা সিদ্ধান্তহীনতার একটা অন্ত। যদি সে জানতো ডিভোর্স লুইজিকে খুশি করবে তাহলে গোটা জীবন আক্রোশের বশেই সে ওর সাথে থেকে যেতো। না, ওকে আঘাত করতেই হবে তার। ভাবো কোনো উপায়, ধরো মারিয়নকে তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া গেল, আইনসঙ্গতভাবে। হ্যাঁ, এটাই ঠিক হবে। এটাই ওকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দেবে। মারিয়নকে সরিয়ে নিতে হবে।
“এই যে নিচে কারা!” সে নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে, উজ্জ্বলমুখে।
লুইজি মুখ তোলেও না।
“হাই, মি. ওয়াইল্ডার!”
সে যখন নামছে বাচ্চারা চেঁচায়, হাত ছোঁড়ে।
দশটার দিকে বন্ধ হলো ডোরবেল বাজা, আপেলগুলো দরজায়-বাঁধা তার থেকে টেনে খেয়ে ফেলা হলো, জলে আপেল চুবিয়ে চুবিয়ে গোলাপি বাচ্চা গালগুলো এখন ভেজা, ন্যাপকিনগুলো ক্যারামেল আর ফলের রসে নোংরা, আর, সে, গৃহকর্তা, খুশিমাখা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব নেয়। লুইজির হাত থেকে সে একরকম কেড়েই নেয় পার্টিটা। বিশটা বাচ্চার সাথে আর তাদের বারোজন মা-বাবার সাথে যারা ওদের সাথে এসেছে আর তার বানানো স্পেশাল স্পাইকড সাইডার খেয়ে বেজায় আনন্দে আছে তাদের সাথে কথা বলার জন্যে সে সারা ঘরজুড়ে ছোটাছুটি করে। হল্লাভরা হাসির দমকের মাঝ দিয়ে সে তদারকি করে গাধার ল্যাজ পিন দিয়ে আটকাও, বোতল ঘোরাও, মিউজিক্যাল চেয়ার আর এমনিই সব। তারপর, শুধু তেকোনা-চোখো কুমড়োর আলোতে, ঘরের সব আলো নেভানো, সে গলা চড়ায়, “শ্ শ্ শ্! আমার পেছন পেছন এসো!”, পা টিপে টিপে নেমে আসে সেলারে।
মা-বাবারা, মুখোশের দঙ্গলের বাইরে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে, কাজের স্বামীটির প্রশংসা করে, বলে ভাগ্যবতী স্ত্রীটির কথা। কী দারুণভাবে সে মিশে গেল বাচ্চাদের সাথে, তারা বলাবলি করে।
হৈ হৈ করতে করতে বাচ্চারা ভিড় জমায় স্বামীটির পেছনে।
“দ্য সেলার!” সে চেঁচায়। “ডাইনির আস্তানা!”
আরও হৈ-হল্লা। ভয়ে কাঁপার ভান করে সে। “ঢুকবে যারা আর তো তারা বের হতে কেউ পারবে না রে!”
মা-বাবারা নিঃশব্দে হাসে।
মিকের টেবিলের কাপড় কেটে বানানো স্লাইড বেয়ে বাচ্চারা একে একে পিছলে নেমে আসে অন্ধকার সেলারে। সে হিসহিস করে আর ভৌতিক আওয়াজ করে। অসাধারণ হাসি আর চিৎকারে ভরে ওঠে কুমড়ো-আলোকিত ঘর। সবাই একসাথে কথা বলে ওঠে। মারিয়ন বাদে সবাই। পুরো পার্টিটা জুড়ে খুব কম কথা আর শব্দ করেছে সে; সব তার ভেতরেই থাকে, সব উত্তেজনা আর আনন্দ। খুদে শয়তান একটা, সে ভাবে। অন্য সাপেদের মতো বন্ধ মুখ আর জ্বলজ্বলে চোখে সে নিজের পার্টিটা দেখে যায়, তার সামনে যেটা চলছে।
এবার, মাবাবারা। অনীহ হাসির সাথে তারা পিছলে নেমে আসে ওই ছোট্ট উৎরাইটা, চেঁচায় প্রচুর, আর ছোট্ট মারিয়ন পাশে দাঁড়িয়ে, সবসময় সব কিছুই সে দেখবে, শেষজন হয়ে। লুইজি স্বামীর সাহায্য ছাড়াই নেমে আসে নিচে। সে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, কিন্তু ও ঝোঁকার আগেই সে নেমে আসে নিচে।
ওপরের ঘরটা খালি আর মোমের আলোয় চুপচাপ।
মারিয়ন স্লাইডটার পাশেই দাঁড়ানো। “চলো আমরাও যাই,” সে বলে, আর তুলে নেয় তাকে।
সেলারে একটা বিরাট বৃত্ত করে সবাই বসে। চুল্লির দূর কোনা থেকে গরম এসে লাগে। প্রতিটা দেওয়ালে লম্বা সারি করে চেয়ারগুলো বসানো, বিশটা হুল্লোড়ে বাচ্চাকাচ্চা, প্রতিজন পর তাদের বারো জন মৃদুভাষী মা-বাবার একজন, লুইজি দূরতম কোনায়। মিক এই কোনায়, সিঁড়ির কাছে। সে উঁকি দেয় কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। সবাই চেয়ার হাতড়ে হাতড়ে বসে, যে-যেমন-পারে এই অন্ধকারে। এখন থেকে পুরো ব্যাপারটা চলবে অন্ধকারে, সে-ই হবে শ্রীমান কথাকার। একটা বাচ্চা সরে গেল ছোট পায়ে, সোঁদা সিমেন্টের একটা গন্ধ, আর বাইরে অক্টোবরের তারার নিচে-বওয়া বাতাসের শব্দ।
“এবার!” অন্ধকার সেলারে চেঁচিয়ে উঠলো স্বামীটি। “চুপ!”
সবাই ঠিকঠাক হয়ে বসেছে।
ঘরটা কালোয় কালো। নেই কোনো আলো, নেই কোনো ঔজ্জ্বল্য, কোনো চোখের চকমকানিও চোখে পড়ে না।
বাসনের মৃদু আঁচড়ের শব্দ, একটা ধাতব ঠুনঠুন।
“মারা গেছে ডাইনিটা,” কথা বলে ওঠে স্বামীটি।
“ইইইইইইইইইই,” বাচ্চারা বলে।
“ডাইনিটা মরে গেছে, মেরে ফেলা হয়েছে তাকে, আর এই যে ছুরিটা যেটা দিয়ে তাকে মারা হয়েছে।”
সে হাতবদল করে ছুরিটা। হাত থেকে হাতে সেটা ঘুরতে থাকে, বৃত্তের ওপরে আর নিচে, হাসি আর ছোট্ট অদ্ভুত চিৎকার আর বড়দের কিছু মন্তব্যের সাথে।
“ডাইনিটা মারা গেল, আর এই যে তার মাথাটা,” ফিসফিস করে স্বামীটা, আর সবচে কাছেরজনের হাতে তুলে দেয় জিনিসটা।
“ওঃ, আমি জানি খেলাটা,” চেঁচিয়ে ওঠে একটা বাচ্চা, খুশি খুশি গলায়, অন্ধকারে। “ফ্রিজ থেকে কিছু বুড়ো মুরগির নাড়িভুঁড়ি নিয়ে সবাইকে দেয় আর বলে, ‘এগুলো ডাইনিটার নাড়িভুঁড়ি!’ তারপর একটা মাটির মাথা নেবে আর বলবে ওটা মাথা, আর একটা স্যুপ-বোনকে বলবে হাত। আর একটা মার্বেল নেবে আর বলবে, ‘এগুলো ওর চোখ!’ আর কিছু ভুট্টাদানা নেবে আর বলবে, ‘এগুলো হচ্ছে দাঁত!’ তারপর একটা প্লাম-পুডিঙের প্যাকেট নেবে আর ওইটা দিয়ে বলবে, ‘এটা ওর পাকস্থলী!’ আমি জানি এটা কিভাবে খেলে!”
“চুপ চুপ, তুই সবকিছু নষ্ট করে দিবি,” একটা মেয়ে বলে।
“মারতে আসছিল ডাইনিটা, এই যে তার হাতটা,” মিক বলে।
“ইইইইইই!”
বৃত্তের ভেতরে একটার পর একটা জিনিস হাতবদল হতে থাকে, গরম আলুর মতো। কোনো বাচ্চা চেঁচিয়ে ওঠে, ধরে না ওগুলো। কেউ চেয়ার থেকে দৌড়ে সেলারের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় যতক্ষণ না ওই ভয়ঙ্কর জিনিসটা পেরিয়ে যায়।
“ওফ্, এগুলো মুরগির নাড়িভুঁড়ি,” ধমকে ওঠে একটা ছেলে। “ফিরে আসো, হেলেন!”
হাত থেকে হাতে, ছোট ছোট চিৎকারের পর চিৎকারের সাথে সাথে জিনিসগুলো সারি ধরে ধরে যেতে থাকে, থাকে, একটার পর আরেকটা।
“কেটে ফেলেছি ডাইনিটা, এই যে তার কলিজাটা,” স্বামীটা বলে।
ছয় কি সাতটা জিনিস পেরিয়ে যায় মুহূর্তে হাসিভরা, কাঁপুনিভরা আঁধারের মাঝ দিয়ে।
লুইজি কথা বলে ওঠে। “মারিয়ন, ভয় পেও না সোনা; এটা শুধু একটা খেলা।”
মারিয়ন কথা বলে না।
“ও ঠিক আছে,” স্বামীটা বলে। “ও মোটেও ভয় পায়নি।”
এগিয়ে চলে হাতবদল, চিৎকার, উল্লাস।
ঘরের চারপাশে হেমন্তের বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। আর সে, স্বামীটা, মিশকালো সেলারের একমাথায় দাঁড়িয়ে, কথা বলে চলে, জিনিসগুলো তুলে দেয় একটার পর একটা।
“মারিয়ন?” আবার শুধায় লুইজি, সেলারের দূরতম কোনা থেকে।
সবাই কথা বলছে।
“মারিয়ন?” লুইজি ডাকে।
সবাই চুপ হয়ে যায়।
“মারিয়ন, কথা বলো, তুমি কি ভয় পেয়েছো?”
মারিয়ন জবাব দেয় না।
স্বামী সেখানেই দাঁড়ানো, সেলারের সিঁড়ির গোড়ায়।
লুইজি ডাকে, “মারিয়ন, তুমি কি ওখানে আছো?”
উত্তর নেই। ঘরটায় একদম কোনো শব্দ নেই।
“মারিয়ন কোথায়?” ডাকে লুইজি।
“ও তো এখানেই ছিল,” একটা ছেলে বলে।
“বোধহয় উপরে উঠে গেছে।”
“মারিয়ন!”
কোনো উত্তর নেই। সব নিস্তব্ধ।
লুইজি চিৎকার করতে থাকে, “মারিয়ন, মারিয়ন!”
“বাতিগুলো জ্বালাও,” বড়দের মধ্যে কেউ বলে।
জিনিসগুলোর হাতবদল বন্ধ হয়ে যায়। ডাইনির শরীরের টুকরোগুলো নিয়ে বাচ্চারা আর বড়রা বসে থাকে।
“না।” দম আটকে যায় লুইজির। অন্ধকারে পাগলের মতো তার চেয়ারটা নড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। “না। আলো জ্বেলো না, আলো জ্বেলো না, ওঃ গড, গড, গড, আলোগুলো জ্বেলো না, প্লিজ, প্লিজ আলো জ্বেলো না, জ্বেলো না!” লুইজি এখন চিলচিৎকার করছে। পুরো সেলার ভরে উঠেছে তার আর্তনাদে।
কেউ নড়ে না।
সবাই বসে থাকে অন্ধকার সেলারে, এই হেমন্তের খেলার মাঝখানে হঠাৎ জমে আটকে গেছে তারা; বাইরে বইছে হাওয়া, শব্দ তুলছে বাড়িটায়, কুমড়ো আর আপেলের গন্ধের সাথে তাদের হাতের জিনিসগুলোর গন্ধ মিলেমিশে ঘরটা যখন ভরে তুলেছে হঠাৎ একটা ছেলে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসি!” আর সে আশা নিয়ে দৌড়ে ওঠে ওপরে আর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে, চারবার পাক দেয় বাড়ির চারদিকে, ডাকে, “মারিয়ন, মারিয়ন, মারিয়ন!” আর আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে অপেক্ষমাণ, শ্বাস-ফেলা সেলারে আর অন্ধকারে বলে, “ওকে খুঁজে পেলাম না।”
তারপর. . . কোনো এক ইডিয়ট বাতিটা জ্বেলে দেয়।
[রে ব্র্যাডবেরির ‘দ্য অক্টোবর গেম’ (১৯৪৮) অবলম্বনে]
সারাবাংলা/এসবিডিই
অনুবাদ গল্প ঈদসংখ্যা ২০২৩ গল্প-উপন্যাস সাহিত্য হিল্লোল দত্ত হেমন্তের অন্তিম খেলা