ঢাকার প্রথম স্টুডিও ও ফ্রিৎজ ক্যাপ
২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৪৩
বঙ্গদেশে ক্যামেরা এসে পৌঁছালো ১৮৪০ সনে। সে তো কলকাতায়। পূর্ববঙ্গে ফটোগ্রাফি চর্চা ঠিক কবে থেকে শুরু হল তার সঠিক দিনক্ষণ বলা মুশকিল। ১৮৮৮ সনে ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র এক নম্বর সদস্য হন। ১৮৯০ সালে মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন ‘এইচ এল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি ফটো স্টুডিও খোলেন। ঢাকায় সম্ভবত নবাবরাই প্রথম ফটোগ্রাফিচর্চা শুরু করেন এবং নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই স্থাপিত হয় ঢাকার প্রথম ফটো স্টুডিও।
‘ঢাক থেকে ঢাকা’ গ্রন্থের লেখক সৈয়দ মাহমুদুল হাসানসহ কয়েকজন গবেষকের অনুমান, ১৮৬৪ সনে পুরান ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালের কাছে ভগীরথ সাহার বাড়িতে গোপীনাথ দত্ত প্রথম ফটো স্টুডিও খুলেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, সেটি আসলে ফটো স্টুডিও ছিল না। সে সময় ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, এটি ছিল ‘কাষ্ঠের ফ্রেম ও মৃত্তিকা নির্মিত নানাবিধ সামগ্রী’র দোকান। গবেষক অনুপম হায়াৎ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা’র ‘চারু ও কারু কলা’ অংশে বলেছেন, ১৯১০ সনে ঢাকার নবাবপুর রোডে ‘আর. সি. দাস অ্যান্ড সন্স’ চালু হয় এবং এটিই ‘ঢাকার প্রথম আলোকচিত্র স্টুডিও’। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার ‘ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে এই তথ্যকে নাকোচ করে দিয়েছেন। কারণ তার আগেই ফ্রিৎজ ক্যাপ নামের এক জার্মান আলোকচিত্রী ঢাকায় ফটো স্টুডিও করেন। গবেষক ওয়াকার এ খানের মতে ১৯০৩ অথবা ১৯০৪ সনে ক্যাপ ঢাকায় স্টুডিও ব্যবসা খুলে বসেন (A photographer named Fritz Kapp, দ্য ডেইলি স্টার, ৭ জুন, ২০২১)।
অনুপম হায়াৎ আরও বলেছেন, ১৯২০ সনে ‘ক্যাপফিজ’ নামে ঢাকায় একটি স্টুডিও গড়ে ওঠে। মুনতাসীর মামুন এই তথ্যটিকেও সঠিক মনে করেননি। গবেষক সিদ্ধার্থ ঘোষের উদ্ধারকৃত তথ্যের সঙ্গেও তা মেলে না। জনাব ঘোষ তার ‘ছবি তোলা : বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চা’ গ্রন্থে ‘পি. এম. বাকচির ইন্ডিয়া ডাইরেক্টরি’ অবলম্বনে ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সনে সক্রিয় থাকা ফটো স্টুডিওর যে তালিকা দিয়েছেন তাতে ঢাকার ‘ক্যাপফিজ’ নামে একটি স্টুডিওর নাম রয়েছে। জনাব মামুনের অনুমান, ফ্রিৎজ ক্যাপ তার ঢাকার স্টুডিওটি কারো কাছে বিক্রি করে দেয়ার পর তার নাম হয় ‘ক্যাপফিজ’। ঢাকাবিষয়ক লেখক তারেক আজিজ তার ‘সেকালের ছবিওয়ালা’ গ্রন্থে বলেছেন, শুরু থেকেই ক্যাপের ঢাকা স্টুডিওর নাম ছিল ‘ক্যাপফ্রিৎজ ফটোস’। কিন্তু বর্তমান লেখক বিহারের হাথুয়া রাজ পরিবারের একটি অ্যালবামের মলাটে ‘ফ্রিৎজ ক্যাপ ঢাকা’ লেখা মনোগ্রাম খুঁজে পেয়েছেন। ফ্রিৎজ ক্যাপ অ্যালবামের ছবিগুলো তুলেছিলনে কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে। সুতরাং ক্যাপ নিজে কখনো ‘ক্যাপফিজ’ বা ‘ক্যাপফ্রিৎজ’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। এই বিষয়ে আমরা ইতিহাসবিদ জনাব মামুনের অনুমানকে সঠিক বলে ধরে নিতে পারি। তবে ক্যাপের ঢাকা স্টুডিও আর ক্যাপের থাকেনি তার সতত্য মেলে খাজা মওদুদের দিনলিপি থেকে। মওদুদ ১৯১৫ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, তিনি পাটুয়াটুলী গিয়ে দেখতে পান, ফ্রিৎজ ক্যাপের বিভিন্ন সামগ্রী নিলামে বিক্রি হচ্ছে। (নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি – অনুপম হায়াৎ)।
বিভিন্ন দেশে ‘ক্যাপ’ (Kapp) পদবির নাগরিক রয়েছেন। যেমন, ১৮৯০ সনে জন্ম নেয়া বিখ্যাত ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী এডমন্ড জাভিয়ের ক্যাপ। তার জন্ম লন্ডনে হলেও তার বাবা ছিলেন জার্মান ইহুদি। ইসরায়েলভিত্তিক ‘মিউজিয়াম অব দ্য জিউস পিপল’ বলছে, ‘ক্যাপ’ পদবিটির মূল একাধিক এবং একই নামের একাধিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। জার্মান শব্দ kappe (টুপি) থেকে শব্দটির উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু ইহুদি নাম হলে তা আসতে পারে Jacob শব্দের শেষাংশ থেকে। তাই ফ্রিৎজ ক্যাপের জার্মান ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রশ্ন হল, তিনি কলকাতায় কোথা থেকে এসেছিলেন? জনাব আজিজ বলেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সনে ‘শত্রুদেশের নাগরিক’ ফ্রিৎজ ক্যাপকে ইংরেজ সরকার নাগরিকত্ব দেয়। ক্যাপকে তখন জার্মান হিসেবেই নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি জাতিতে জার্মান হলেও জোর দিয়ে বলা যায় না তিনি জার্মানি থেকেই এসেছিলেন।
বর্তমান লেখক যুক্তরাজ্যের ব্রাউন ইউনির্ভার্সিটি লাইব্রেরির অনলাইন আর্কাইভে ফ্রিৎজ ক্যাপের তোলা আরও একটি ছবির সন্ধান পেয়েছেন। ছবিটি ১৮৯০ সনে তোলা। দুজন ব্রিটিশ সৈনিক এবং একজন নাবিকের গ্রুপ ফটো। ছবিটি তার কলকাতার ২৯ চৌরঙ্গীর স্টুডিওতে তোলা। ছবির পেছনে যে মাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তাতে লেখা, মাউন্ট বোর্ডটি অস্ট্রিয়ায় তৈরি। এর আগে ক্যাপের স্টুডিওর যেসব মাউন্ট বোর্ড পাওয়া গেছে তার কোনো মাউন্ট বোর্ডে ‘মাউন্ট মেইড ইন অস্ট্রিয়া’ কথাটির উল্লেখ ছিল না। ২৯ চৌরঙ্গীরই অন্য মাউন্ট বোর্ডগুলোতে কথাটি নেই। তার কি জার্মান ভাষাভাষী দেশ অস্ট্রিয়ায় যাতায়াত ছিল নাকি তিনি ভারতে থাকা কোনো অস্ট্রিয়ান স্টুডিও ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এই মাউন্ট আনিয়েছিলেন?
যা হোক। এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষে ফ্রিৎজ ক্যাপের চারটি স্টুডিওর কথা জানা গেছে। ওয়াকার এ খানের মতে, ক্যাপ ১৮৮০’র দশকে কলকাতায় পাড়ি জমান। প্রথমে কলকাতার ২৯ চৌরঙ্গী রোডে স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেন। জন ফল্কনারের ‘A Biographical Dictionary of 19th Century Photographers in South and South-East Asia’-এর তথ্য অনুযায়ী স্টুডিওটি ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। ক্যাপ কলকাতার হুমায়ুন প্যালেসে আরও একটি স্টুডি খোলেন, যা চলেছে ১৮৯৬ থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত (জন ফল্কনার)। কিন্তু তারেক আজিজ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় ১৮৯৮ সনের ৯ ফেব্রুয়ারি ছাপা হওয়া একটি খবরের বরাত দিয়ে জানাচ্ছেন, ক্যাপ প্রথমটি বিক্রি করে ৩ নং হুমায়ুন প্যালেসে নতুনটি শুরু করেন। তার মতে, ১৮৯৬ সনের আগেই ক্যাপ দার্জিলিংয়ে স্টুডিও স্থাপন করেন। যদিও ফল্কনার বলছেন, দার্জিলিংয়ে স্টুডিওটি স্থাপিত হয় ১৮৯৬ সনে। যা কমপক্ষে ১৮৯৮ সন পর্যন্ত চালু ছিল। দার্জিলিং পর্বের কিছু ছবি পাওয়া যায় বিখ্যাত নিলাম প্রতিষ্ঠান ‘সোদিবি’স’-এর ওয়েবসাইটে। এই ছবিগুলো ১৮৮০ দশকে তোলা। সুতরাং সম্ভবত তারেক আজিজ সঠিক। ক্যাপ সর্বশেষ ফটো স্টুডিওটি স্থাপন করেছিলেন ঢাকার ওয়াইজঘাট এলাকায়। সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘থ্যাকার স্পিঙ্কর’-এর ডাইরেক্টরি’ অবলম্বনে ১৯১০ সনে কলকাতায় সক্রিয় থাকা ফটোস্টুডিও’র যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে ‘এফ. কাপ অ্যান্ড কোং’ নামে একটি স্টুডিওর নাম রয়েছে। যদিও ঠিকানা ১১৫ আমহার্স্ট স্ট্রিট এবং প্রোপ্রাইটার হিসেবে পি. বোস, এম. এ-এর নাম রয়েছে। তারেক আজিজ জানিয়েছেন, পি. বোস ছিলেন এস. বোসের ছোট ভাই। এস. বোসের কাছেই ২৯ চৌরঙ্গীর স্টুডিও গুডউইলসহ বিক্রি করেছিলেন ক্যাপ।
‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র শুরু থেকে এর সঙ্গে ফ্রিৎজ ক্যাপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষক ঘোষ বলেছেন, ১৮৮৯ সনে কলকাতার ২৯ চৌরঙ্গীতে ছিল ফ্রিৎজ ক্যাপের স্টুডিও ‘মেসার্স কাপ অ্যান্ড কোম্পানি’। ফ্রিৎজ ক্যাপ তার প্রতিষ্ঠানের দুটি কক্ষ বিনা ভাড়ায় ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’কে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সনের ১৫ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দ্য ফটোগ্রাফিক নিউজ’ ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ আয়োজিত প্রদর্শনীর খবর প্রকাশ করে। সে খবর থেকে জানা যায়, ‘নাভাল ভলেন্টিয়ার্স’ ছবির জন্য ‘মেসার্স কাপ অ্যান্ড কোম্পানি’কে ‘অনরেবল মেনশন’ করা হয়। ১৮৯৮ সনের ২৭ জানুয়ারি ‘দ্য ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ’ পত্রিকায় খবর বের হয়, ২৬ জানুয়ারি ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র দশম বার্ষিক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। ভারতের ভাইসরয় দ্বিতীয় লর্ড এলগিন এবং তার সহধর্মিনী এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন এবং আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন। অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ আমির আলীও উপস্থিত ছিলেন। জন এইচ. গিয়ার সেদিন বর্ষসেরা আলোকচিত্র পুরস্কার হিসেবে ভাইসরয় মেডেল অর্জন করেন। পোরট্রেট ফটোগ্রাফি বিভাগে ব্রোঞ্জ মেডেল পায় ‘এফ. কাপ অ্যান্ড কোম্পানি’। এই খবর থেকে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। ক্যাপের সঙ্গে পোরট্রেটে ব্রোঞ্জ মেডেল জয় করেছিলেন আধুনিক আর্ট ফটোগ্রাফির অন্যতম পথিকৃৎ মার্কিন আলোকচিত্রী আলফ্রিড স্টাইগ্লিট্জ। স্টাইগ্লিট্জ ছিলেন ‘ক্যামেরা ওয়ার্ক’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ‘ফটোগ্রাফি’ ১৮৯৩ সনের ৯ মার্চ জানায়, সোসাইটি আয়োজিত প্রদর্শনীর ‘পোরট্রেট অ্যান্ড গ্রুপস’ বিভাগে ‘মেসার্স কাপ অ্যান্ড কোম্পানি’ ব্রোঞ্জ মেডেল পায়। লন্ডনের আরেক সাময়িকী ‘ব্রিটিশ জার্নাল অব ফটোগ্রাফি’র ১৯০১ সনের ১ মার্চ সংখ্যা থেকে জানা যায়, ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র প্রদর্শনীতে ‘এফ. ক্যাপ অ্যান্ড কোম্পানি’ ‘অর্ডার্ড টু দ্য ট্রান্সভাল’ শিরোনামের ছবির জন্য এবং ফ্রিৎজ ক্যাপ নিজে ‘ইন দ্য রেইন্স’ শিরোনামের ছবির জন্য ব্রোঞ্জ মেডেল অর্জন করেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র ১৮৮৮, ১৮৮৯, ১৮৯০, ১৮৯৩, ১৮৯৪, ১৮৯৫, ১৮৯৬, ১৮৯৭, ১৮৯৮, ১৮৯৯, ১৯০১, ১৯০৩, ১৯০৪, ১৯০৭, ১৯১২, ১৯১৩, ১৯১৯, ১৯২০, ১৯২২, ১৯২৩ ও ১৯২৪-এর ‘নির্বাচিত সদস্য’দের যে তালিকা উদ্ধার করেছেন তার একটিতেও ফ্রিৎজ ক্যাপের নাম নেই। আমাদের ধারণা, এই তালিকাগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়। সোসাইটির সঙ্গে ক্যাপের নিবিড় সম্পর্ক ছিল কিন্তু তিনি সোসাইটির সাধারণ সদস্যও ছিলেন না, তা মানা কঠিন। যা হোক, ফ্রিৎজ ক্যাপ ‘ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা’র পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন।
ওয়াকার এ খানের মতে, ১৯০৩ সন নাগাদ ক্যাপ লোকসানের কারণে তার আগের সবগুলো স্টুডিও বন্ধ করে দেন। সম্ভবত ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র মাধ্যমেই ফ্রিৎজ ক্যাপের সঙ্গে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হয় এবং তার উৎসাহে ক্যাপ ১৯০৩ অথবা ১৯০৪ সনের দিকে ঢাকার ৮ ওয়াইজঘাটে স্টুডিও স্থাপন করেন। তবে তার আগেই ১৯০১ সনে আহসানউল্লাহ মারা যান। তারপর নবাব হন খাজা সলিমুল্লাহ। নতুন নবাবও ফ্রিৎজ ক্যাপকে পৃষ্ঠপোষকতা করা অব্যাহত রাখেন। ঢাকায় এসে ক্যাপ স্টুডিও ব্যবসার পাশাপাশি নবাবদের পারিবারিক আলোকচিত্রী হিসেবেও পুরোদমে কাজ শুরু করেন দেন।
ফ্রিৎজ ক্যাপ যে সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। নারীন্দার ঢাকা খ্রিস্টান কবরস্থানের রেজিস্টার সূত্রে জনাব খান জানিয়েছেন, ১৯০৭ সনে ক্যাপের আড়াই বছর বয়সী কন্যা ক্রিস্টিনা উইলহেলমিনার মৃত্যু হয় এবং তাকে এই কবরস্থানেই দাফন করা হয়। ১৯১৪ সনের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত ক্যাপ ঢাকায় ছিলেন। তারপর ফ্রিৎজ ক্যাপের কি হল? জনাব খান বলছেন, ক্যাপ ‘কোনো চিহ্ন না রেখে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যান’। তিনি কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, এক. মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর শত্রুদেশের লোক হওয়ায় ফ্রিৎজ ক্যাপ কি সপরিবারে ঢাকা কারাগারে আটক ছিলেন? দুই. গৃহবন্দী ছিলেন? নাকি ভারতের অন্য কোথাও তাদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল? জনাব মামুনের অনুমান, ফ্রিৎজ ক্যাপ ১৯১০ সনে অথবা তার আগে মারা যান কিংবা ব্যবসা বন্ধ করে দেশে ফিরে যান। আমরা জেনেছি, ১৯১৫ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপের স্টুডিওর সরঞ্জাম নিলামে বিক্রি হয়েছে। সুতরাং ১৯১০ সনে বা তারও আগে ক্যাপ মারা গেছেন কিংবা দেশে ফিরে গেছেন বলে মনে হয় না। জনাব খান অবশ্য মনে করেন, পুরো মহাযুদ্ধের সময়ে ক্যাপ ভারতেই ছিলেন। তিনি ক্যাপ সম্পর্কে শেষ যে তথ্যটি দিতে পেরেছেন তা হল, ১৯১৬ সনে আব্দুল কাদের নামের একজন দর্জি ব্যবসায়ী কাপড় সেলাইয়ের মজুরি বাবদ বকেয়া পাওনা আদায়ে ফ্রিৎজ ক্যাপের বিরুদ্ধে ১৯১৬ সনে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। ‘The Indian Law Reports’-এর ৪৩তম খণ্ডে এই তথ্যের সত্যতা মেলে। তারপর কি হয়েছিল? এতোদিন এই প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না। ২০২২ সনে প্রকাশিত ‘সেকালের ছবিওয়ালা’ বইয়ে তারেক আজিজ সে বিষয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য উত্থাপন করেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯১৫ সনে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর ক্যাপ ঢাকা শহরে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন। সেই দর্জির মামলায় ক্যাপ দার্জিলিংয়ে গ্রেফতার হন। যুদ্ধের পুরো সময় তিনি দার্জিলিংয়ের কারাগারে বন্দী থাকেন। এ সময় তার ঢাকা স্টুডিওর সরঞ্জাম জব্দ করা হয় (পরে নিলামে ওঠে)। ক্যাপের শেষজীবন কাটে কলকাতায়। ব্রিটিশ সরকারের নাগরিকীকরণ সনদপত্রের সূত্রে জনাব আজিজ জানিয়েছেন, ১৯২০ সনে ক্যাপকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। অনুমান করি, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ক্যাপের ওঠাবসা থাকায় কারামুক্তি ও নাগরিকত্ব পাওয়া তার জন্য খুব কঠিন ছিল না। জনাব আজিজ ‘India Deaths and Burials 1789-1948’ থেকে জানতে পেরেছেন, ১৯২৪ সনে ‘ক্রনিক নেফ্রাইটিস’-এ ভুগে ফ্রেডরিক ফ্রিৎজ ক্যাপ মৃত্যুবরণ করেন। এই গবেষক কলকাতাভিত্তিক ইতিহাস গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইমার্সিভ ট্রেইল’-এর প্রধান তথাগত নিয়োগীর বরাতে আরও জানিয়েছেন, ক্যাপকে পার্ক স্ট্রিটের মিশন সিমেট্রিতে দাফন করা হয়েছিল। তবে এখন সেই সমাধিস্থলের কোনো চিহ্ন নেই।
দুই বাংলায় বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ফ্রিৎজ ক্যাপ এবং তার ক্যামেরা। তুলেছেন অসংখ্য মানুষ ও স্থাপনার ছবি। ১৮৯৭ সনে তিনি আসাম ভূমিকম্প-পরবর্তী অবস্থার অনেক ছবি তোলেন। ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনীর বহু ছবি ক্যাপের তোলা। কলকাতার স্টুডিওতে তো তুলেছেনই, মাঠেঘাটেও কম তোলেননি। ১৯০৩ সনে প্রকাশিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব লামসডেন’স হর্স’ গ্রন্থের বেশকিছু ছবি ফ্রিৎজ ক্যাপের। ক্যাপ ১৯০০ সনের কলকাতা বন্যার ছবিও তুলেছিলেন। ব্রিটিশ সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য স্ফেয়ার’- এর ১৯০০ সনের ৩ নভেম্বর সংখ্যায় বড় করে ছাপা হওয়া এমন কমপক্ষে দুটি ছবির সন্ধান পেয়েছেন বর্তমান লেখক। শিশুসাহিত্যিক এবং বাংলায় মুদ্রণশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে ফ্রিৎজ ক্যাপের যোগাযোগ ছিল কিনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রসেস ক্যামেরায় হাফটোন ব্লক তৈরির ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর চিরনমস্য। এ বিষয়ে লন্ডনের ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’ (১৮৯৫-১৯৮২) পত্রিকায় ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সনের মধ্যে তার ইংরেজিতে লেখা মোট নয়টি গবেষণাপত্র ছাপা হয়। তার দুটিতে ব্যবহৃত হয়েছে ফ্রিৎজ ক্যাপের তোলা দুটি ছবি। ছবিগুলোর ব্লক তৈরি করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর নিজে। ওয়াকার এ খান জানিয়েছেন, ১৮৯২ সন থেকে ক্যাপের ঢাকায় আসা-যাওয়া শুরু। গবেষক শামীম আমিনুর রহমান তার ‘ঢাকার প্রথম আকাশচারী ভানতাসেল’ বইয়ে জানিয়েছেন, ১৮৯২ সনে নবাব আহসানউল্লাহর উদ্যোগে মার্কিন নারী আকাশচারী জিনেট ভ্যান তাসেল যখন গ্যাস বেলুনে করে ঢাকার আকাশে ওড়েন (উড়তে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান) তখন সে ঘটনার ছবি তুলতে ঢাকায় এসেছিলেন ক্যাপ। ১৯০৭, ১৯০৯ ও ১৯১১ সনে তিনি রাঙামাটিও ভ্রমণ করেন। ১৯০৪ সনে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকা সফর করেন। এই সফরকে কেন্দ্র ও উপলক্ষ করে তোলা ছবিগুলোকে একসঙ্গে ‘কার্জন কালেকশন’ বলা হয়। ফ্রিৎজ ক্যাপও তখন ঢাকায়। এই অ্যালবামের এক গুচ্ছ ছবি তার তোলা। ‘কার্জন কালেকশন’ নাম হলেও ক্যাপ প্রধানত ঢাকা শহরের মোগল ও ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন স্থাপনা ও স্থানের ছবি তুলেছিলেন। তবে তখন তিনি যেহেতু নবাবদের ঘরের মানুষ তাই তার সেই ছবিগুলোতে নবাবদের প্রভাব স্পষ্ট। বেশিরভাগ ছবিই নবাবদের করা স্থাপনার। তারপরও ঢাকা শহরের ইতিহাস পাঠে এই ছবিগুলোর কোনো বিকল্প নেই। ছবিগুলো ব্রিটিশ লাইব্রেরির অনলাইন আর্কাইভে পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯১২ সালের ২৭ মে গঠিত হয় নাথান কমিশন। এই কমিশনের ১৪ জন সদস্যের একটি গ্রুপ ছবি পাওয়া যায়। অনেকের দাবি, ১৯১২ সনের এই ছবিটিও ক্যাপের তোলা।
আমাদের কাছে ফ্রিৎজ ক্যাপ এখনো পুরোপুরি ধরা দেননি। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলা এখনো বাকি। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন তাও আমরা জানি না, কারণ তার কোনো প্রতিকৃতিও আমাদের হাতে নেই। তার তোলা গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ক্যাপ এবং তার কর্ম নিয়ে আরও গবেষণা জরুরি, এক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা কাজে আসতে পারে। অন্তত ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের ইতিহাসকে জানতে আমাদের ফ্রিৎজ ক্যাপ পাঠ করতেই হবে।
লেখক : দৃশ্যগল্পকার, সাংবাদিক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঢাকার প্রথম স্টুডিও ও ফ্রিৎজ ক্যাপ প্রবন্ধ সাহিত্য সুদীপ্ত সালাম