Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মনি হায়দারের উপন্যাস ‘কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা’


২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৫৫

[প্রথম পর্ব]

হ্যাঁ বলুন!

খোন্দকার মোশতাক হতভম্ব চোখে তাকিয়ে দেখছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। জিহ্বা আড়ষ্ট। শরীরে শক্তি নেই। মি. খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গের আইনুল হক, মিলিয়া রহমান আর জয়নাল হোসেনের অবস্থা একই রকম। মুখ আছে, জিহবা আছে, দাঁতও আছে কিন্তু মুখের মধ্যে শব্দ ফুটছে না।

টেবিলের ওপাশ থেকে রিভলভিং চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে চাংচু আবারও প্রশ্ন করছে, হ্যাঁ বলুন। কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?

ঢোক গিলে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে জবাব দেয় মি. খোন্দকার মোশতাক, আমরা আমপুরা থেকে এসেছি।

টেবিলের ওপাশ থেকে হো হো হাসে মি. চাংচু। লেজের উপর ডান পা দিয়ে একটু চুলকিয়ে বলে, এটা তো আমপুরা থানা। আপনাদের নির্দিষ্ট করে বলা দরকার, আমপুরার কোনো জায়গা থেকে এসেছেন?

মিলিয়া রহমান বড় বড় চোখে বলে, দরজিপাড়া থেকে এসেছি।

মাথা দোলায় মি. চাংচু― বুঝতে পেরেছি। তো বলুন কি করতে পারি আপনাদের জন্য?

সমস্যা হচ্ছে আমাদের বস, মানে আমপুরার ওয়ার্ড কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায় বলে পাঠিয়েছেন এই থানায় এলে ওসি খবির মিয়াকে পাওয়া যাবে। খবির মিয়ার সঙ্গে তিনি কথা বলে আমাদের পাঠিয়েছেন।

বুঝতে পেরেছি, আপনাদের ওয়ার্ড কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায় আমার সঙ্গেই কথা বলেছিলেন টেলিফোনে এই তো আধাঘণ্টা আগে। তিনিও বলেছিলেন আপনারা আসবেন। তো বসুন, ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বলে আমপুরা থানার ওসি মি. চাংচু।

ভয়ে ভয়ে বসে তিনজন ওসির সামনের টেবিলের চেয়ারে। চেয়ারের উপর কাঠের নেম প্লেটে লেখা, মি. চাংচু, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আমপুরা থানা। অথচ কমিশনার কথা বলল ওসি খবির মিয়ার সঙ্গে। ঘটনাটা কি? মি. খোন্দকার মোশতাক ভয়ানক চালাক আর ঘাগু লোক! সেই লোকও ভয় কাঁপছে। থানার ওসি একটা কুত্তা!

বিজ্ঞাপন

শুনুন মি. খোন্দকার মোশতাক, আপনি ঠিকই ধরেছেন―আমি মি. চাংচু। থানার ওসি কুকুর, সরকারি নাম মি. খবির মিয়া। আপনি বা আপনারা যা বলতে এসেছেন, নির্ভয়ে বলুন।

একটা কুকুর থানার ওসি! কি বলার আছে? কোনো দেশে বাস করছি? ওদিকে বসের বাড়িটাও কুকুরদের দখলে। থানায় এলাম কুকুরদের বিরুদ্ধে মামলা করতে, আর এসে দেখি থানার ওসিও কুত্তা। ও ব্যাটা সরি, কুকুরটাকে কি আর বলব? বললে তো কুকুরদের বিরুদ্ধেই বলতে হয়। কিন্তু বৃটিশ শাসনের সময়ে নীলকর হারামজাদাদের অসহ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে, বিচার করত সাদা চামড়ার বেনিয়া হারামজাদা বিচারকরা। সুতরাং অত্যাচারিত হয়েও সর্বস্বান্ত হয়েও মামলার রায় যেত নীলকরদের পক্ষে! মরার উপর খাড়ার ঘা আর কী! দুনিয়ায় শোষণের ইতিহাস একই। নাকি কোনোও ভুল জায়গায় এসে পড়লাম!

কি বলবেন না? তাড়া দেয় ওসি মি. চাংচু। আমার একটা জরুরি বৈঠক আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. হালাকুর সঙ্গে। যা বলার দ্রুত বলুন। আর হ্যাঁ, চা খাবেন আপনারা?

চা? জিহ্বা আড়ষ্ট মিলিয়া রহমানের। এক কাপ চা আর আগে এক গ্লাস পানি পেলে ভালোই হতো। ঘাড় নাড়িয়ে বলে, চায়ের সঙ্গে এক গ্লাস পানি―
সঙ্গে সঙ্গে যোগ দেয় জয়নাল হোসেন, আমিও!

পানি আর চা? আমপুরা থানার ওসি মি. চাংচু বা মি. খবির মিয়া হালকাভাবে জানতে চায়।

ঘাড় নাড়ায় জয়নাল হোসেন, জি!

মি. চাং চু কলিং বেল টেপে উঁচু হয়ে সামনের বাম পা দিয়ে। সঙ্গে পেছনের দরজা খুলে যায়। শাড়ি পরিহিত একটা কুকুর এসে দাঁড়ায়, স্যার!

সামনের তিনজনকে দেখিয়ে আদেশ করে, ওনাদের চা আর পানি দাও।

ওকে স্যার। শাড়ি পরিহিত কুকুরটা ভেতরে চলে যায়। কিন্তু মি. খোন্দকার মোশতাকের হার্টবিট আরও বেড়ে যায়। সঙ্গে তেষ্টাও। শাড়ি পরা কুকুরটাকে দেখার পর মি. খোন্দকার মোশতাকের পিলে চমকে একেবারে নীচে নেমে গেছে। আরে শালা, কুত্তায় পরে শাড়ি! বাঙালি রমনীদের শাড়ির আর ইজ্জত রইলো না। আচ্ছা, আমি বা আমরা এখন কোথায়? ঠাডা শহরের আমপুরায় তো? আমরা কি ঠিক জায়গায় এসেছি?

বিজ্ঞাপন

নিন, আপনাদের চা এবং পানি― ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে মি. খোন্দকার মোশতাক। শাড়ি পরিহিত কুকুরটা লম্বা হয়ে নিচের দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে দাঁতের সঙ্গে শাড়ির আঁচল বেঁধে সামনের পা দুটাকে হাতের মতো ব্যবহার করে ট্রে নিয়ে এসেছে। ট্রের উপর তিন কাপ ধূমায়িত চা আর তিনটা পানির গ্লাস। একের পর এক পানির গ্লাস আর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে চলে যাচ্ছে।

মিলিয়া রহমান পানির গ্লাস মুখে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটকু পানি পান করে গ্লাসটা শব্দ করে রাখে টেবিলের উপর। শব্দের কারণে তাকায় মি. চাংচু। ওরাও তাকায়, জিহবা বের করে হাসে মি. চাং চু। হাসির সঙ্গে মুখ গহব্বের বিকট দাঁতগুলো বের হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে শিউরে ওঠে মি. খোন্দকার মোশতাক, মিলিয়া রহমান আর জয়নাল হোসেন। হাসি থামিয়ে মি. চাংচু বলে, আপনারা চা খাচ্ছেন না কেনো?

সঙ্গে সঙ্গে তিনজনই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়, অদ্ভুত মিষ্টি চা। তাকায় পরস্পরের দিকে। বুঝে উঠতে পারছে না, চা খাচ্ছে না মজার মিষ্টি খাচ্ছে।
চা ভালো লাগছে না? মি. চাংচু জিজ্ঞেস করে।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় মিলিয়া রহমান, না না, চা ভীষণ ভালো লাগছে। কিন্তু..

কিন্তু আমপুরা থানার ওসি মি. চাংচু পাল্টা প্রশ্ন করে, কিন্তু কি?

আমরা বসে আছি, একটা নালিশ করতে এসেছিলাম। খুবই জরুরী…

হ্যাঁ বলুন, তাড়া দেয় মি. চাংচু। আর মি. দিগ্বিজয় রায় তো ফোন করেছিলেন আমাকে। আমি বললাম, আমাকে বলুন সরাসরি। তিনি বললেন, না আমার লোক আপনার অফিসে গিয়ে সরাসরি জানাবে। তো বলুন, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হালাকুর সঙ্গে বৈঠক আছে তিনটায়।

নড়েচড়ে বসে মি. খোন্দকার মোশতাক, আমাদের সম্মানিত ওয়ার্ড কমিশনার মি. দ্বিগ্বিজয়ের বাড়ি দখল করতে চায়―

ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমপুরা থানার ওসি মি. চাংচু, আমার এলাকায় দখলবাজি? গরগর করে গলার ভেতরে ক্রোধের কাঠ-ফাটায়, বলুন তো ওর নাম কি? কোনো গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করছে?

দড়িবাজ মি. খোন্দকার মোশতাক থেমে যায়। কি বলবে? বলবে আপনার মতো একদল কুকুর এসে মি. দিগ্বিজয় রায়ের বিশাল বাড়ি দখল করার চেষ্টা করছে। আর কি অবাক ঘটনা, কুকুরগুলো বেশ তাগড়া― অনেকটা আপনার মতো।

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা গল্প-উপন্যাস মনি হায়দার সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর