Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোনম সাহার গল্প ‘খেলাঘর’


২০ এপ্রিল ২০২৩ ১০:৩৫

খেলাটা ছিল খুব সহজ। ওরা প্রায় বিকেলেই ফুলটোকা নামের এই খেলাটা খেলতো। ওরা মানে একদলে রনি, রিংকু, রিপন, পর্ণা আর সীমা, অন্য দলে তন্ময়, তূর্য, পুলক, রিমঝিম আর টুপুর। টুপুররা পাঁচ ভাই-বোন। বড়দের কঠিন খেলাগুলো টুপুর ঠিক পারতনা। তাই মা যেদিন বলত, ছোটবোনকে খেলায় নাও তন্ময়; সেদিন বড় ভাইয়া টুপুরকে কোলে নিয়ে খেলার জায়গায় গিয়ে বলত, আজ আমরা টুপুরের সাথে ফুলটোকা খেলব। মেজভাই তূর্য একটু আপত্তি করত, ওর প্রিয় খেলা ছিলো ডাংগুলি বা রুমালচুরি জাতীয় কিছু; আর পুলকের পছন্দ ছিলো কুমির ডাঙ্গা। রিমঝিম এসে তখন সবাইকে রাজি করিয়ে টুপুরকে নিয়ে শুরু হতো, সেদিনের মতো ফুলটোকা খেলা।

বিজ্ঞাপন

দুইদলে ভাগ হয়ে যেত ওরা। দলের সবাইকে দেওয়া হতো একেকটা ফুল, ফল বা পাখির নাম। এই যেমন টুপুরের নাম হতো গোলাপ, পুলকের নাম হত পদ্ম। আবার যেদিন পাখির নামে খেলা হতো সীমার নাম হতো দোয়েল আর পর্নার নাম হতো টিয়া। এক দলের ক্যাপ্টেন অন্যদলের কোনো এক খেলোয়াড়ের চোখ পেছন থেকে ঢেকে নিজের দলের খেলোয়াড়কে ডাকত- আয় রে আমায় গোলাপ। গোলাপ নাম পাওয়া সেই খেলোয়াড় পা টিপে টিপে চোখ ঢেকে রাখা অন্য দলের খেলোয়াড়ের কপালে টোকা দিয়ে ফিরে যেত নিজের জায়গায়। তারপর সেই চোখ ঢেকে রাখা খেলোয়াড়কে চোখ মেলতে দেওয়া হতো আর তাকে বলতে হতো, গোলাপ নাম নিয়ে কপালে টোকা দিয়ে গেছে যে, সে আসলে কে?

বিজ্ঞাপন

সেই কোন ছোটবেলার ফুলটোকা খেলার স্মৃতি আজকাল প্রায় রোজ রাতেই কেন যে টুপুরের স্বপ্নে আসে! ইনসমনিয়া আছে টুপুরের। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু সেই ওষুধও আজকাল কাজ করে না, শুধু কেমন যেন আচ্ছন্ন করে রাখে। রোজ রাত দুইটা বা তিনটার দিকে ঘুমাতে যায় টুপুর। খানিকক্ষণ তন্দ্রা আর তারপর ঘুম নামলেই এই স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়া। ঘুম ভাঙলেই মোবাইলে সময়টা দেখে নেয় টুপুর। রোজ ঠিক একই সময়ে ঘুম ভাঙে, রাত চারটা।

একবার ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম আসে না টুপুরের। তবু কিছুক্ষণ চেষ্টা করে চোখ বুজে এপাশ ওপাশ করে ঘুমটা আনার। আধাঘন্টার মত চেষ্টায় রোজই সে ব্যর্থ হয়। তারপর বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে নেমে আসে বিছানা থেকে। আলো জ্বালায় সব ঘরের। রান্নাঘরে গিয়ে খুব যত্ন করে এককাপ চা বানায়। চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে ভোরের অপেক্ষায়। ভোর এলেই ঘুম আসে। চায়ের ক্যাফেইনের কী সাধ্য টুপুরের চোখের সে ঘুম আটকানোর! ভোরের সেই গাঢ় নিদ্রা ভাঙে সকাল নয়টায়। ঠিক নয়টাতেই, এর আগেও না, পরেও না।

সকাল সাড়ে নয়টায় শরীফা আসে। ঝড়ের গতিতে ঘর মুছে দেয়, কাপড় ধুয়ে দেয়, বাথরুম মেজে দেয়, পরিস্কার ঝকঝকে করে দেয় বারান্দা, দেওয়াল, সিলিং। শরীফার কাজের সময়টাতে টুপুর টমিকে খাবার দিয়ে এসে তাদের দুজনের নাস্তা বানায়। তার আর শরীফার নাস্তা। সরল ধরনের নাস্তা। বেশিরভাগ দিনই ব্রেড টোস্ট, ডিম আর চা, কখনও মেয়োনেজ দেওয়া স্যান্ডুইচ, আর এসবের সাথে একটু মিষ্টি বা কোন একটা ফল, কলা নয়তো আপেল। বাথরুম মাজতে যাবার আগে শরীফা নাস্তা খেতে বসে। শরীফা বসে একটা মোড়া নিয়ে, টুপুর ডাইনিং এর চেয়ারে। টুপুর অনেকদিন ভেবেছে, শরীফাকে কী তার টেবিলে ডাকা উচিত? কিন্ত ভাবনা পর্যন্তই, কখনও বলা হয়নি। শরীফা নাস্তা খায়, টুপুর মনোযোগ দিয়ে তা দেখে। গার্লিক ব্রেড টোস্ট টা শরীফা চায়ে ডুবিয়ে খায়। শরীফার জন্য টুপুর আলাদা করে কনডেন্সড মিল্ক কিনে আনে, তারপরেও শরীফার চায়ে চিনি দিতে হয় তিন চামচ। গরম চা পিরিচে ঢেলে চুমুক দিয়ে খায় শরীফা, আর অমলেটটা খায় সব শেষে তারিয়ে তারিয়ে। প্রতিদিন একই মতামত দেয় সে।
চা খুব ফাইন হইছে আপা! ফাস্ট ক্লাস! দোকানে কিনলে বিশ টাকা নিতো!
টুপুর হাসে। হাসতে হাসতে তার দুধ চিনিবিহীন আর্ল গ্রের কাপে চুমুক দেয়।
শরীফা জিজ্ঞেস করে, আইজকাও বাইরে যাইবেন না?
টুপুর না-বোধক মাথা নাড়ে।
বাজার লাগবো?
টুপুর না-বোধক মাথা নাড়ে আবারও।

শরীফা হতাশ হয়ে চলে যায় বাথরুম মাজতে। সাবানের গুড়ো ছিটিয়ে বেসিন মাজে ঘষে ঘষে। ফ্লোর পরিস্কার করতে করতে টুপুরের কথা ভাবে। দিনের পর দিন আপা ঘর থেকে বের হয় না। কথাবার্তাও বলে না। টুপুরের আসলে কী হয়েছে? বড় ভাবী যে বলে ছোট আপার মাথা খারাপ, সেটা কী আসলে সত্যি? মাথা খারাপ লোক কী রোজ নাস্তা বানিয়ে খাওয়ায় বাড়ির কাজের লোককে? না কি মাথা খারাপ বলেই খাওয়ায়, সুস্থ হলে করত না এ কাজ! শরীফা ঠিক হিসাব মিলাতে পারে না। হিসাব মেলাতে না পারার রাগে শরীফা লম্বা হাতলের ব্রাশ দিয়ে জোরে জোরে কমোড মাজে।

শরীফা কাজ সেরে চলে যাবার পর টুপুরের অখন্ড সময়। আগে যখন স্কুলের চাকরিটা ছিল তখন এ সময়ে টুপুর ব্যস্ত হয়ে তৈরি হতো। বাড়ি থেকে কাছেই স্কুল, ডে শিফটে পড়াতো টুপুর। অভিভাবক কমিটির এক নেতার সাথে খুব বাজে ঝামেলা হয়ে গেল ছাত্রী ভর্তির অনিয়ম নিয়ে, পরে সেই কাজটাই ছেড়ে দিতে হলো। এ বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে সেই স্কুলের ডে শিফটের এসেম্বলিতে গাওয়া জাতীয় সংগীত শুনতে পাওয়া যায়। অভ্যাস মত গলাও মেলায় টুপুর। সে জানে দুপুরবেলা তার গলায় জাতীয় সংগীত তিনতলার বারান্দা থেকে বড় ভাবীও শুনতে পায়। বড় ভাবী এই খবর সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে দেয় বাকি সবাইকে। খবর যায় আমেরিকায় বড় আপা রিমঝিমের কাছে। জার্মানিতে ছোট ভাই পুলকের কাছে। সবাই মিলে ভিডিও কনফারেন্স করে সপ্তাহে একদিন। টুপুরের স্বেচ্ছা নির্বাসিত দিনরাত্রির প্রতি পলের হিসেব মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হয় যে তাদের বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ের আসলে মাথা খারাপ হয়ে গেছে!

কিন্ত টুপুর জানে যে ওর মাথা ঠিকই আছে। ওর একটা স্কুলে পড়াবার চাকুরি ছিল। অনিয়মের সাথে আপোষ করতে চায়নি বলে সে ওটা ছেড়ে দিয়েছে। এটা মাথা খারাপের কিছু নয়, ঠিক কবে থেকে অন্যায়ের সাথে আপোষ করাটাকে মানসিক সুস্থতার চিহ্ন বলে মেনে নেওয়া হয়েছে তা টুপুর জানে না। টুপুরের বয়স ৩২। ও এখনও বিয়ে করেনি, এতেও অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। মনের মতো জীবনসঙ্গী না পেলে শুধু বিয়ের করার জন্যই করতে হবে, এমন চিন্তায় টুপুরের আস্থা নেই। টুপুর পাড়ার কুকুরদের রোজ খাবার দিতে বের হয়। বড় দুই হাড়িতে কেজি চারেক চাল-ডাল-মাংস মিলিয়ে হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করে ফ্যানের বাতাসের নীচে সেই খাবার ঠান্ডা করে টুপুর রাতের বেলা বালতিতে করে খাবার নিয়ে বের হয়। পাড়ার সব কুকুর বেড়াল লেজ নাড়তে নাড়তে টুপুরের পেছনে পেছনে যাচ্ছে আর টুপুর বিভিন্ন জায়গায় কাগজ পেতে ওদেরকে খেতে দিচ্ছে, উত্তর পাবে না জেনেও ওদের সাথে আহ্লাদ করে কথা বলছে; এই দৃশ্য এ পাড়ার লোকেদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। হয়তো অনেকেই ওকে পাগল ভাবে, কিন্তু টুপুর অন্যের ভুল ভাবনার তোয়াক্কা করে না। রাত বারোটার পরে টুপুর ছাদে হাঁটতে যায়। আকাশ পরিস্কার থাকলে জার্মানি থেকে ছোট ভাইয়ার পাঠানো টেলিস্কোপে চোখ রেখে দূরের নক্ষত্রদের দেখে। টুপুর রোজ একই স্বপ্ন দেখে রাত চারটায় ঘুম ভেঙে বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে গুনগুন করে গান গায়, ভোর হলে টুপুর ছাদে গিয়ে আঁচল পেতে শিউলি কুড়ায়…। এগুলো কি মাথা খারাপের লক্ষণ? টুপুরের নিজের তা মনে হয় না।

খিলগাঁওতে টুপুরদের পাঁচতলা বাড়ি। নীচতলার দুইটা ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। তিনতলার দুই ফ্ল্যাটে থাকে বড় আর মেজ ভাই। চার আর পাঁচতলার দুই ফ্ল্যাটেও ভাড়াটে থাকে। দোতলার পুরোটা ছিল টুপুরদের ঘর। তন্ময় আর তূর্যের বিয়ে হয়ে যাবার পর তারা তিনতলার দুই ফ্ল্যাটে আলাদা সংসার পাততে চলে গেল। রিমঝিম বিয়ের পর থেকেই আমেরিকায় থাকে। ছোট ভাই পুলক জার্মানি গেছে, এক পোলিশ মেয়ে বিয়ে করেছে, দেশে ফেরেনি আর কখনও। এরপর থেকে টুপুরকে নিয়ে তার মা বাবা থাকতেন শুধু সেই দোতলার ২৪০০ বর্গফুট জুড়ে গড়া সংসারে। প্রথমে মা, তারপর বাবা, দুজনেই ছয় মাসের ব্যবধানে মারা যাবার পর টুপুর একাই থাকে সেখানে, গত চার বছর ধরে। একা একা বাবা মায়ের ফেলে যাওয়া ঘর-দোর-সংসার আগলে রাখলে কিংবা সে ঘরে নিজের মতো থাকলেই কি একজন সুশ্রী, শিক্ষিতা, মৃদুভাষী, হাসিখুশি, হাই পাওয়ারের চশমা পরা ৩২ বছরের মেয়েকে মাথা খারাপ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগা যায়? টুপুর জানে না তা।

দুপুরবেলা সারা ঘর জুড়ে টুপুর হাঁটে। সিনেমা দেখে, বই পড়ে, টমির পাশে গিয়ে বসে, পাড়ার কুকুরদের কেউ কেউ টুপুরের খোঁজে গেটের সামনে এলে কেক বিস্কিট বা বাসি ভাত দিয়ে আসে। যেদিন যেদিন ইচ্ছে করে নিজের জন্য সামান্য একটু রাঁধে সে। একটু ইনস্ট্যান্ট নুডলস নয়তো একটা ফ্রোজেন কাবাব আর ফ্রোজেন পরোটা ভেজে নেওয়া। একা থাকার এই মজা। চাইলেই পড়ন্ত বেলায় হালিম রেঁধে লেবুর রস আর ভাজা পেঁয়াজ ছিটিয়ে গরম গরম লুচির সাথে এক বড় বাটি ভর্তি করে নিয়ে হুমহাম শব্দ তুলে খেয়ে নেওয়া যায়। আবার ইচ্ছে না হলে শুধু বিস্কিট, কলা আর আপেল খেয়েও পার করে দেওয়া যায় ক্ষিধে।

বিকেলে ছাদে বা বাগানে বাচ্চাদের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে আনমনে হাঁটে সে। টমিও হাঁটে টুপুরের পেছন পেছন লেজ নেড়ে নেড়ে। টুপুর একটু একটু করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আহ্লাদে গলায় ওম তোলা শব্দ করে টমি। সন্ধ্যা হলে কোনও কোনও দিন খুব রান্না করতে ইচ্ছে করে। কখনও মোরগ পোলাও, কখনও চিংড়ি মালাইকারি বা সর্ষে পাবদা, কোনদিন ঘি ছড়ানো সবজি খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা আর রান্না করে টেবিল সাজায় সে। টমির জন্য গাজর আর আলু দিয়ে চিকেন স্টু রাঁধে। টমিকে খাবার দিয়ে এসে নিজের খাবার নিয়ে বসে টিভির সামনে। একঘেয়ে কাহিনী আর বিরক্তিকর অভিনয়ের কোন সিরিয়াল দেখতে দেখতে গিলে নেয় খাবারটুকু। কোনও কোনও দিন রান্না ভীষণ ভালো হয়, সবাইকে ডেকে আহ্লাদ করে খাওয়াতে ইচ্ছে করে। আবার কোনওদিন হয় অতি জঘন্য। অবশ্য রান্নার স্বাদ কেমন হলো তা নিয়ে টুপুর বা টমি, কারওই তেমন মাথা ব্যাথা নেই!

যেদিন রান্না করতে ইচ্ছে করে না, সেদিন টমির জোটে পেট ফুড। টুপুরের নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। না খেয়ে থাকলেও হয়, অথবা বড় ভাবীর বাসায় গিয়ে কই মাছের দোপেঁয়াজা খেয়ে ইচ্ছে করছে বলে আহ্লাদী করে ভাবীকে রাগিয়ে দেওয়া যায়। অথবা মেজ ভাবীকে ইন্টারকমে বলা যায়, এক বাটি তরকারি দাও তো! ডাল থাকলে তা-ও দিও! সালাদ কেটে দিও কুচিকুচি করে। তুমি তরকারি পাঠালে আমি ভাত চড়াবো। আচ্ছা আজ কী তোমাদের লইট্যা শুটকি রান্না হয়েছে? মেজ ভাবী চমকে যায়। টুপুর কী করে জেনে গেল তা ভেবে ভয় পায়। অথচ, মাথার ব্যামো থাকা মানুষকে অকারণ ভয় পাবার শর্ত না থাকলে মেজ ভাবী বুঝতে পারত বিকেল বেলা বাচ্চাদের খেলার সময় টুপুর বাগানে বা ছাদেই থাকে। কার বাড়িতে কী রান্না হয়েছে তা জেনে নেওয়া কী আর এমন কঠিন?

রাত বারোটার দিকে টুপুর ছাদে যায়। পাঁচতলার ভাড়াটেদের ছেলেও ঐ সময় ছাদে যায় হাঁটতে। প্রতিবারই টুপুর ভাবে একবার কথা বলবে কী না! অথবা জিজ্ঞেস করবে, রাত চারটায় গিটারের টুংটাং কি আপনার ঘর থেকে আসে? জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাবার আগেই টুপুরকে দেখে ছেলেটা দ্রুত নেমে যায় ছাদ থেকে। নাম জানতে ইচ্ছে করে ছেলেটার। টুপুরের বয়সীই তো! ভয় পায় কেন টুপুরকে!

টুপুর ছাদে হেঁটে বেড়ায়। আকাশ পরিস্কার থাকলে তারা দেখে। ছোটবেলায় বাবা টুপুর আর পুলককে তারা চিনতে শিখিয়েছিল। ধ্রুবতারা দিয়ে আলাপ শুরু তারপর সপ্তর্ষিমন্ডল, তারপর একে একে স্পষ্ট হলো কালপুরুষ, রোহিনী, অনুরাধা, চিত্রা, বিশাখা, উত্তরফাল্গুনী। নিভুনিভু তারাদের দেখে দেখে আর অনেক অনেক সায়েন্স ফিকশন বই পড়ে পড়ে পুলক আর টুপুর দুজনেই ঠিক করেছিল তারা একদিন মহাকাশে যাবে। ফিজিক্স পড়তে চেয়েছিল দুজনেই। কিন্ত ক্লাস নাইনে যেতেই বাবা বলে দিলো মেয়েদের সায়েন্স পড়ার দরকার নেই, শুধু পুলক সায়েন্স পড়বে। মহাকাশে যাওয়া আর হলো না টুপুরের। তারাদের নিভে যাওয়ার রহস্যটা ঠিকঠাক জানা হলো না।

মেয়েদের কী কী করতে নেই তা বাবা খুব ভাল জানতেন। কত ভাল ছাত্রী ছিলো রিমঝিম! বাবা তার বিয়ে দিয়ে দিলেন ঊনিশ বছর বয়সে, মেয়েদের বেশি বয়সে বিয়ে দিতে নেই বলে। সেই থেকে উপন্যাস পড়ে কেঁদে ভাসানো রিমঝিম কেমনতরো হয়ে গেল! অমুকের মেয়ের বিয়েতে কত ভরি গয়না দিল, অমুকের ছেলেটা কোন এক ডিভোর্সি বিদেশী মেয়ে বিয়ে করেছে, রণবীর কাপুর না রণবীর সিং বেশি হ্যান্ডসাম; দীপিকা না ক্যাটরিনা কে বেশি সুন্দর; এই জাতীয় আলাপ ছাড়া রিমঝিম এখন আর আরাম পায় না। মেট্রিকে স্টার মার্ক নিয়ে পাস করা ঊনিশ বছরের মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেই কী তারা এমন হয়ে যায়!

বেঁচে থাকতে টুপুর কখনও প্রশ্ন করেনি বাবাকে। বাড়ি ভাড়া কেন টুপুরের একাউন্টে জমা হতে শুরু করলো বাবা বেঁচে থাকতেই, সে প্রশ্ন বাবাকে করেনি টুপুর। বড় ভাইয়া কেন মায়ের গায়ে হাত তুলেছিল, মেজ ভাই কেন মায়ের গয়না চুরি করে নিয়ে গেল, ছোট ভাইয়া কেন বাবার সাথে কথা বলতনা, অনেক রাতে কেবল টুপুরের ফোন থেকে মায়ের সাথে কথা বলত, আপা কোন অভিমানে বাবা মারা যাবার পরেও দেশে আসেনি, তা নিয়েও টুপুর প্রশ্ন করেনি। বাবা যেদিন পুরো বাড়িটা টুপুরের নামে লিখে দিলেন সেদিনও কোন প্রশ্ন করেনি। বড় ভাইয়েরা প্রশ্ন করেছিল প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে। বাবা কান দেননি সেই প্রশ্নে। সবার ফিসফিস ছিলো- টুপুর কী জাদুটোনা জানে? সে তার উত্তরও দেয়নি। ছাদে এসে চুপ করে বসে ছিল বাবার মৃত্যুর দিন। নীচে বাবার মৃতদেহের পাশেই চলছিল উকিল চাচার সাথে ভাইয়াদের ঝগড়া। শুধু টমি একঘেয়ে সুরে কেঁদে ভাসিয়েছে, অস্থির হয়ে ঘর বার করেছে,খায়নি সাতদিন। টমিটা কুকুর বলে এখনও বোকাই রয়ে গেছে।

ছাদ থেকে চারপাশে তাকালেই শুধু বড় বড় উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি। তার মাঝখানে টুপুরদের বাড়িটা ছোট মনে হয়। টুপুর জানে, বাড়িটা ওর নামে থাকাতে ভাইয়েরা এই বাড়ি ডেভেলপারকে দিতে পারছেনা। টুপুর জানে, ওর মাথা খারাপ, এটা প্রমাণ হয়ে গেলে এই বাড়ি টুপুর থেকে নিয়ে নেওয়া যাবে। টুপুর জানে, ওর সামান্যতম অস্বাভাবিক আচরণে বড় ভাবী কেন খুশি হয়ে যায়! মেজ ভাবী কেন ভয় পায়! বাড়ির সীমানা দেওয়াল লাগোয়া কাঠগোলাপ গাছটা তিন তলা সমান বড়। তিনটা গাছ ঝাঁপিয়ে শিউলি ফোটে ভোরের দিকে, ঝরে পরে টুপটাপ। বাতাসে ঘ্রাণ ছড়ানো সেই শিউলি আর কাঠগোলাপেরা জানে টুপুরের বাবা এই গাছদের বাঁচাতে বাড়িটা লিখে দিয়েছে টুপুরের নামে।

টমিকে একবার দেখে এসে ঘরে ফিরে আসে টুপুর। পশ্চিম কোণের আমগাছওয়ালা বাড়িটা ভাঙছে এবার। পুরোনো টানা বারান্দার দোতলা বাড়ি ভেঙে নয়তলা এপার্টমেন্ট হবে। ট্রাকে করে ইট-বালু-সিমেন্ট আসে রাতের বেলায়। নৈশব্দকে ছেদ করে দেয় সেই প্রকান্ড শব্দ! তবু সারা পাড়া কেমন ঘুমায়, কেউ ঊঠে এসে বলে না- এবার থামো!

শুধু টুপুরেরই শব্দ সহ্য হয়না। জানালা বন্ধ করে সেই একঘেয়ে গগনবিদারী শব্দ ঠেকাতে চায় টুপুর। বড় আপার ঘরে গিয়ে কিশোর উপন্যাসে ভরা আলমিরা খুলে বইগুলো ছুঁয়ে দেখে। মেলা থেকে কেনা মাটির পুতুলটার গায়ের ধুলো মুছে দেয়। ছোট ভাইয়ার ঘরে গিয়ে গিটারগুলো মুছে রাখে রোজ। পা টিপে টিপে টুপুর বাবা-মায়ের ঘরে যায়। মায়ের খাট, আয়না আর ড্রেসিং টেবিলটা মুছে সময় নিয়ে। বাবার জায়নামাজটা রাখে জায়গা মত। পানির গ্লাসে পানি রাখে। বাবা মায়ের মশারি গুঁজে দেয় বিছানার চারপাশে। বাতি নিভিয়ে দেয়। ড্রয়িংরুমের কুশনগুলো গুছিয়ে রাখে। ডাইনিং টেবিল মুছে বোতলে পানি ভরে ফ্রিজে রাখে। বারান্দার কাপড় তুলে এনে বাতিগুলো নেভায়। বাথরুমের দরজাগুলো আটকে আসে। নিজের বিছানাটা গুছায় পরিপাটি করে। মুখ ধুয়ে চুলে বিনুনি বেঁধে আসে তাদের ছেলেবেলার খেলাঘরে।

বড় পুতুল, ছোট পুতুল, বিড়াল পুতুল, কুকুর পুতুল, পান্ডা পুতুল, হাতি পুতুল, মাছ পুতুল দিয়ে সাজানো সেই খেলাঘর। রেলগাড়িটা সাজানো। ফিশিং গেমটা সাজানো। পেইংগুইনটা সাজানো। বিল্ডিং ব্লকস, ট্রাইসাইকেল, ক্যারম বোর্ড, দাবার সৈন্য, লুডোর ছক্কা। টুপুর ফ্লোরে রাখা বড় লাল কালোয় মেশানো মনিপুরী নকশার শতরঞ্জিটাতে বসে। নিজের হাতে নিজের চোখ বুজে দিয়ে প্রাণপনে ডাকে, আয়রে আমার গোলাপ! আয়রে আমার দোয়েল! আয়রে আমার বুলবুলি! আয়রে আমার শিউলী! কপালে একটা ফুলটোকার অপেক্ষায় ঘন্টা-মিনিট- সেকেন্ড কেটে যায় টুপুরের।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদসংখ্যা ২০২৩ খেলাঘর গল্প সাহিত্য সোনম সাহা সোনম সাহার গল্প ‘খেলাঘর’

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর