পুরুষোত্তম বিবর্জিতা তিনযুগের তিন নারীর আত্মকথা
২০ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৪২
আমিই শূর্পনখা, দেবী সপ্তশ্রুঙ্গি
পৃথিবীর কিছু রণ-রক্ত-মৃত্যুর কাহিনী থেকে যায়। কোন অন্ত্যজ নারীর বীরদর্প কাহিনী কখনও থাকে না। আমি শূর্পনখা, রাবন ভগিনী। মহর্ষি বিশ্বশ্রবা ও কৈকসীকণ্যা। আমি মিনাক্ষী। আমি দীক্ষা। লঙ্কার আলো জ্বলে আমার রূপের প্রদীপে। আমার লাবণ্যে ম্লান হয় চাঁদ। ম্লান হয় প্রকৃতি। হরিণীর চঞ্চলতায় দণ্ডক বনে আমার অবাধ বিচরণ। অসামান্য যৌবন প্রেম খুঁজে ফেরে। শত শত পুরুষ হৃদয়ের তীব্র আগ্রহ। আমার মন ওঠে না। রাক্ষসকুলের কেউ নয়। আমি চাই দূর্বাদলশ্যামকান্তি পুরুষ। শরীরে অতল সমুদ্রের ঢেউ। শরীরের শিখরে সন্ধিতে নারীত্বের ডাক। আমার পুরুষ সঙ্গী চাই। সে যে কেউ নয়। অসাধারন কেউ।
সেদিন সন্ধ্যে নেমেছে। গভীর অরণ্যে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে আমি ফিরছি রাজপ্রাসাদে। সারদিনের ক্লান্তি জড়ানো সমস্ত অঙ্গে। কোনো এক বাঁকে এসে দেখি আলো। এ কোন আলো? এত আলো! কে তুমি? সূর্যকিরণ ম্লান হয় বুঝি! কে তুমি কন্দর্পকান্তি? নজরে নজর থামে। আমি বিদ্যুৎজিহ্ব। কালকেয় রাজ্যের যুবরাজ। এরই প্রতীক্ষা ছিল কি আমার? আমি বিবশ হয়ে যাচ্ছি। হে, রাজকুমার, আমি স্বাধীনচেতা নারী, আমি মিনাক্ষী, রাবণ ভগিনী। আমি নারী থেকে দাসী হতে চাই। গ্রহন করে ধন্য করো। দ্বিধা নেই রাজকুমারের। চিবুক তুলে সে বলল, কথা দিলাম। কিন্তু তোমার ভ্রাতা রাবণ কি আমাকে গ্রহণ করবেন? সে দায় আমার। রাজী আমি তাকে করাবই।
কিন্তু কুপিত হলেন ভ্রাতা। রাবণ উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, অসম্ভব, দানবকুলে আমি বোনকে দেব না। তুমি তাকে ভুলে যাও। তীব্রস্বরে বলে উঠি আমি মিনাক্ষী, বহুদিন পরে যাকে পেয়েছি জীবনে তাকে ছাড়া আমার দয়িত কেউ নেই। প্রচন্ড ক্রুদ্ধ রাবণ তার রক্তবর্ণ মুখমন্ডল নিয়ে আমার দিকে এগোতেই এগিয়ে এলেন রানি মন্দোদরী। এ কোন কথা রাজাধিরাজ? নারীর কি অধিকার নেই আপন ভাগ্য স্থির করবার? ভগিনী তোমার। রাজ্য, কূল, বংশ থেকে প্রাণপ্রিয়। মর্যাদা কোথায় পাবে সে, যদি তুমি তা না দাও তাকে পিতৃসম ভাই হয়ে? শান্ত হলেন ভ্রাতা। তবে তাই হোক। দিকে দিকে বার্তা রটি গেল। বিচিত্র বর্ণে সেজে ওঠে লঙ্কা, আনন্দ, জয়ঢাক, নৃত্য। কৌতুক কোলাহলে নারীরা উদ্বেল। শুধু আনন্দ কত আনন্দ- শূর্পণখার বিয়ে। স্ব্বামীর সাথে সুখের জীবন।
একদিন ভ্রাতা রাবণ সপ্তমতল, তথা রসাতল জয়ের কালে এলেন আমার রাজপ্রাসাদে। আমার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্ব ও ভ্রাতা রাবণ আলাপচারিতায় রত। আমি অন্তরালে। হঠাৎ শুনি কোলাহল। ভ্রাতা রাবণ হত্যা করেছেন আমার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্বকে। বীরশ্রেষ্ঠ রাবণের সম্মুখে সকলেই অবনত। শুনি, বিদ্যুৎজিহ্ব নাকি রাবণের ওপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। তাতেই রাবণের অসির আঘাতে আমি বিধবা হলাম। আমার গর্ভে বিদ্যুৎজিহ্ব-র সন্তান। ত্রিলোকবিজয়ী রাবণও সে দিন শব্দ শূন্যতা ভেঙে আহ্বান করলেন চল লঙ্কা, এ লঙ্কাপুরী পুনরায় গৃহ হোক তোমার। অসম্ভব। ফিরিয়ে দিলাম ভ্রাতাকে। শুধু চাইলাম দণ্ডক বনে অবাধ বিচরণের ছাড়পত্র। লঙ্কার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দক্ষিণ ভারতের বনাঞ্চলে বাস-স্থাপন করলাম আমি। আমার সাহচর্যের জন্যে ভ্রাতা রাবণ পাঠালেন আমার দুই বৈমাত্রেয় ভাই খর ও দূষণকে। তারপর…
তারপর আমার গর্বিতা মা হয়ে নতুন প্রকাশ। আমার সন্তান জন্ম নিল – জম্বু। আহ্লাদ, যত্ন। জম্বুর বড় হয়ে ওঠা। তখন কিশোর। ও দিকে মাতুল রাবণ ব্যস্ত নিজ রাজ্য বিস্তারে। যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ। এদিকে আমার ছেলেটি জপ ধ্যান করে বেড়ায়। ওইটুকু বয়সে? হ্যাঁ। তাও আবার অদ্ভূত ভাবে। গাছে ঝুলে। ও দিকে রামচন্দ্র পিতৃসত্য রক্ষায় সীতা আর লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসে। কুটিরের প্রয়োজনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে গাছে কোপ মারতেই ঝুপ করে ওপর থেকে পড়ল আমার ছেলে। ধ্যান জপ যাই করুক, ক্ষতি করুক বা নাই করুক, সে রাক্ষস। বাঁচার জন্য অনুনয় করল আমার সন্তান জম্বু। সে দিন নিরস্ত্রকে হত্যা করেছিল লক্ষ্মণ। সর্বনাশে আমার কান্না অরণ্য ছাড়িয়ে মিশেছিল আকাশে। কিন্তু কখনও জানতে পারি নি কে আমাকে এ ভাবে অসহায় করল। তারপরে একাকী অরণ্য জীবন। দীর্ঘ সময় একাকী বিচরণ। নিঃসঙ্গ। বনে বনে ঘুরে ফিরি। প্রতি দিনের মতো সে দিনও এসেছি বনে। মন বলে ওঠে আমার যেন কী হারিয়ে গেছে। কবে, কী, কোথায়? আমি জানি না। তাই নিত্য নিত্য বনে বনে খুঁজে বেড়াই। কাকেই বা জিজ্ঞেস করব? কেই বা জানে? কী পেলে আমার ব্যথা যাবে? হঠাৎ…
হঠাৎ দেখি সে পদচিহ্ন। এ কার পদচিহ্ন? পদ্ম, আরও কী কী যেন আঁকা আছে? এ তো পুরুষের? কে এ পুরুষপ্রধান! আমি একবার অন্তত তাকে দেখে নারী জীবন সার্থক করতে চাই। আমার খুব ইচ্ছে করছে এই চরণ পদ্মের রজঃ মাখি। আমার মাথায়, গালে, বুকে। আঃ! কেউ দেখে না ফেলে। আমি যাই এই পদচিহ্ন ধরে যদি সে মনোহরের সন্ধান পাই। এই বার প্রেমরসে মজিল মীনাক্ষী! দিন দুই পরে দেখি গোদাবরীতে স্নানরত এ কোন দূর্বাদলশ্যাম? গভীর আড়াল থেকে আগ্রহভরে দেখি। এ তো রঘুবীর। রাম। রামের গ্রীবা, ওষ্ঠ, দন্ত! আহা চক্রবাক সদৃশ তার নিতম্ব। নিশ্চিত। শুধুই কল্পনা। রামচন্দ্র যে অবতার। নগ্নতাকে আবৃত করে তাই সূর্যরশ্মি। বলয় তৈরি করে ঘিরে রাখে। তবু কল্পনা। কামাতুর আমি। স্বীকারে লজ্জা নেই। দীর্ঘ নিস্তরঙ্গ জীবনে নতুন শিহরণ! স্নানশেষে দুজন মুখোমুখি। তুমি কে? আমি রঘুবীর রাম, মানব মাত্র, তুমি? আমি মিনাক্ষী, রাবণ ভগিনী। আমি বিমোহিত শশী। তারপর…
তারপর অন্তর পাগল হল, রামচন্দ্রের পাদপদ্মে জীবন উৎসর্গ করতে মন চায়। তার পর সাক্ষাতে ও অসাক্ষাতে কত কথা। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে। একদিন অধৈর্যে বলে ফেলি তাকে আমি কি তোমাকে কিছুতেই পেতে পারি না প্রিয়? আমায় বিবাহ কর রাম। আমি কিছুতেই ত্যাগ করতে পারছি না তোমায়। কৌতুকে বলেন রাম, তুমি তো দেখেছ সীতাকে, সীতার মতো জায়া থাকতে কেন মীনাক্ষী সুন্দরী আমি তাকে বঞ্চিত করি। বরং লক্ষ্মণ অবিবাহিত, সুন্দরও বটে। লক্ষ্মণকে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে পারো।” কৌতুক? হায় রে! প্রেমের বুঝিবা এমনই কৌতুক! আমিও সরল মনে লক্ষ্মণের কাছে যাই, লক্ষ্মণ তুমি আমায় বিবাহ কর। তোমার দাদার আদেশে আমি তোমায় প্রস্তাব দিচ্ছি। আমি তো খুব ভালবাসি তোমার দাদাকে। তাই তার আদেশই মানছি। চল আমরা গিরি কাননে বিবাহ করি। এবার কৌতুকে লক্ষ্মণ। কৌতুকের দরাদরি হাঁকাহাঁকি, পাল্লায় চড়েছে শূর্পণখা। ভালবাসার অপরাধে নারীর সৌন্দর্য ওজন দাঁড়িতে বিকোচ্ছে। তখনও, এখনও। একই ভাবে, অন্য ভাবে। উপহাসে, অপমানে জর্জরিত। আর যে পারা যায় না। আমার রাক্ষস সত্ত্বা জেগে ওঠে ধীরে ধীরে। রূপ খসে যায়। আমি তখন ভয়ঙ্করী শূর্পণখা। লক্ষ্মণের হাতের অসি ছুটে এল আমার নাকে কানে।
কী বা করেছে পুরুষ কালে কালে, যুগে যুগে নারীদের অপমান উপহার দেওয়া ছাড়া। কি বলেছিলে লক্ষ্মণ? বিরূপিতা শূর্পনখা রাক্ষসী কামরূপিনী দূর হ ঘৃণ্য রাক্ষসী! আজ তোকে এমন শান্তি দেব!…। শাস্তি তুমি দিয়েছিলে। আমিও তেমনি। প্রতিজ্ঞা করেছি এর শোধ নেব আমি। চরম প্রতিশোধ। নিয়েছি। স্বামীহন্তারক রাবণ নিহত হয়েছেন। রঘুবীর রাম তুমিও হারালে সীতাকে। কিন্তু রঘুবীর, আমার জন্যে সার্থক হয়েছিল তোমার অকালবোধন। অঙ্গদ এসেছিল। বেশ্যার মাটি চাই প্রতিমা নির্মাণে। অঙ্গদের সাথে রতিক্রিয়ায় আমি বেশ্যা হলাম। সেই মাটি দিয়ে তোমার দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণ। আপত্তি কর নি। অথচ প্রজাদের চাপে অবলীলাক্রমে সীতাকে করেছ ত্যাগ। বাল্মীকির আশ্রমে তখন সীতা। সত্যি বলেছি তাকে সেইখানে গিয়ে। সীতাকে। রামরাজ্যে নাকি কেউ অসুখি নয়, সবাই সুবিচার পায়! তবে রাজনন্দিনী আজ ত্যাজিত, কেন? অন্য নারী সঙ্গ যদি পাপ হয় তবে নিজ পত্নী পরিত্যাগ কি সেই পাপবোধের সীমারেখা লঙ্ঘন করে না, তাও অন্যের অনুরোধে? সীতা শান্ত হতে বলে। আমার হাতে একটি ফুল দিয়ে বলে, ‘মানুষ আরও বেশি চায়। কেন আশা কর, তুমি যাকে চরম ভালবাসো, সেও তোমায় চরম ভালবাসবে? যে তোমায় কুরূপ করেছে তার জন্য ঠিক কতটা শাস্তি যোগ্য মনে কর? মৃত্যু? মৃত্যু তো শাস্তিই হতে পারে না, সে তো পরম শান্তির। তুমি তোমার ভালবাসা সযত্নে লালন কর তোমাতে। তবেই, যারা তোমায় আঘাত করেছে তারা কিছুতেই শান্তি পেতে পারে না।’ তারপরে সীতার পাতাল প্রবেশ। তুমিই তো বলেছিলে রাম, নারীরা মর্ত্যে পূজিতা হবে না? আমি আজ সপ্তশ্রুঙ্গি দেবী। মর্ত্যে পূজিতা। আর তুমি স্মরিত হও সীতার নামের পরে। সীতা-রাম। হায় রাম, তুমি কাপুরুষ। পুরুষোত্তম নও। যদিও নারীকে অপমান করতে আমার নাম উচ্চারিত হয়। সে অপমান নারীর নয়। পুরুষের। তাই আমি দেবী সপ্তশ্রুঙ্গি। আর তুমি? আজ প্রতীক মাত্র।
আমি রাধা, প্রেমের সমনাম
আমি রাই। রাধা। পুরাণ, বেদ, উপনিষদ, প্রাক্-ইতিহাস তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রেমের আদিরমণী। আমাকে অনেকেই বলেন পরকীয়ার প্রতীক। আচ্ছা কোন মেয়েকে যদি এমন পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় যে এমনিতে সুপুরুষ, কিন্তু ব্যবহারে বরফের মতো শীতল। তাদের শরীরের পাতা ঝরে না, সেই ঝরা পাতায় এসে পড়ে না সকালবেলার রঙিন আলো, সেই আলো লেগে জেগে ওঠে না নতুন পাতার গান। সে পুরুষ স্বামী হলে কোন মেয়ের উত্তাল সমুদ্রে নেবে আসবে না অজাগর শীতলতা! সে মেনে নেবে স্বামীর নপুংসকতা? দেহতরী বাইবে না তো অন্য কোনো ঘাটে?
তবু তো আমি সেই স্বামীকে নিয়েই কপালের দোহাই দিয়ে বেঁচে ছিলাম। অথচ আমাকেই পাঠানো হল দুধ-দই-ক্ষীরের বিকিকিনির হাটে। সেই হাটে বাঁকে বাঁকে চলে নানা মাপের কলস। কলসের মুখ শ্বেত-আবরণে ঢাকা। আমাদের চিত্র-বিচিত্র বস্ত্রে পড়ে সকালবেলার আলো। তারপরে বিকিকিনি শেষে বনের পায়ে-চলা। আইয়ানের সঙ্গে এমনিতে বড় একটা দেখা হয় না আমার। দিনের বেলা আইয়ান নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া তার স্বভাব, নইলে আমার শরীরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সে বড় শক্ত কাজ। যে বরফ গলতে পারে না, গলতে চায় না, সে আগুনকে খুব ভয় পায়। তবু কখনও কখনও তো বরফেরও সাধ হয় জল হয়ে আগুনকে নেভানোর। কিন্তু সাধ্যে কুলোয় না।
কিন্তু সব গোলমাল করে দিল বাঁশিওয়ালা কালো ছেলেটা। কথা নেই বার্তা নেই এক একটা রূপময় তুলনার সঙ্গে সে বাঁশিতে ফুঁ দেয়! সেদিন নিয়মিত মাঝি আসে নি। হয়তো শরীর ভাল নেই। নদীতে নৌকো বাঁধা। ছেলেটি এসে জানাল সে পার করে দেবে। সবাই উঠতেই ছেড়ে দিল নৌকো আমায় ফেলে। চিৎকার করে বলল, ফিরে এসেই আমায় নিয়ে যাবে। আমি উচাটন মনে বিশ্বাস করলাম ছেলেটিকে। ছেলেটি ফিরে এল। নৌকোয় শুধু আমি ও সে। কৃষ্ণ কানহাইয়া। কিছুটা যেতেই উলটে গেল নৌকোটা। উলটে গেল না উলটে দিল বোঝার মত মনের অবস্থা আমার ছিল না। আমি প্রাণ বাঁচাতে ছেলেটির বক্ষলগ্না হলাম। আমার শরীর অবশ হয়ে গেল। সে জলে আগুন জ্বালালো সেই রসিক বাঁশিওয়ালা। জলের মধ্যে যে এমন করে কেউ কাউকে বাজিয়ে তুলতে পারে, বিশ্বাস করুন আমি ভাবতেও পারি নি। আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম যে মনের মতো শরীরেরও কিছু নিজস্ব দাবি থাকে। সে অর্গল সেদিন খুলে দিল কৃষ্ণ। এরপর থেকে দিন নেই রাত নেই, আমি বেজেই চললাম। সে খেলার কত ছল, কত ছলনা।
ক্রমেই প্রেম জমে উঠল আমার দিক থেকে। সেও মেতে উঠল শুধু আমায় নিয়ে নয়। আমার সহচরীদের সাথেও। আমরা তাকে মেনে নিয়েছিলাম পুরুষোত্তম হিসেবে। এ তো পুরুষ নয় এ যে পরমপুরুষ। ত্বমাদিদেব পুরুষপুরাণ ত্বমস্য বিশ্বস্য পরমনিদান..। প্রেমে উন্মত্ত প্রায় সকলেই। তবে মিলনতৃপ্তি প্রকাশ করায় কুন্ঠা ছিল। তবে এমনভাবে রাঙিয়ে দেওয়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমার প্রেম ছিল একমুখী। আমি কৃষ্ণপ্রেমেই মগ্ন ছিলাম চিরজীবন। কিন্তু সে? গোপিনীদের ভরা-দুধের কলসি তিনি গুলতি মেরে ফাটিয়ে দেয়। কাঁচুলি-চোলি-ঘাগরা ভিজিয়ে দুধ নামে ধারায় ধারায়। গোপ-বালিকাদের ঠোঁটে, গালে, খোলা নাভিতে দুধের রেখা ঝরে। যেন মিলনকালে রতিস্নান! গোপিনীরা নদীপারে জামা-কাপড় রেখে যমুনায় নাইতে নামলে কানাই গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখে। মেয়েদের ঘাগরা-চোলি-গয়না পুঁটুলি পাকিয়ে কদম গাছের মগডালে বেঁধে রাখে। তারা ভেজা আদুল গায়ে জল ছেড়ে উঠে না আসা অবধি কালাচাঁদ পোশাক ফেরত দেয় না। নগ্ন নারী-শরীর তারিয়ে তারিয়ে দেখে নয়নসুখ করে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে? বিনি রতি পাইলে তোকে না এড়িবে কাহ্ন।’
এহেন কৃষ্ণের ডাক এল কর্তব্যের। গোচারণ-বংশীবাদন তার জন্যে নয়। সে বুঝতে পারল, রাধার চেয়েও তার ক্ষত্রিয় ধর্মকর্ম অনেক বেশি মূল্যবান। ভোজবংশীয় রাজা কংস তখন চাইছেন যেততেনপ্রকারে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানকে খতম করে, পথের কাঁটাকে উপড়ে ফেলতে। কংসের নির্দেশে মথুরা থেকে রথ সাজিয়ে বৃন্দাবনে এলেন অক্রুর। ওই রথে কৃষ্ণকে নিয়ে যাবেন মথুরায়। তার আগেই কংসের আমন্ত্রণ পৌঁছে গিয়েছে কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তো মনে মনে এই দিনটির জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কৃষ্ণ উদগ্রীব হলে কী হবে, বেঁকে বসল তার সহচর-সহচরীরা। কৃষ্ণ যে বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যাবে, এ খবর চাউর হতে সময় লাগেনি। দাবানলের থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুধু গোপ-গোপিনীরাই নয়, গোটা বৃন্দাবনই যেন বিষণ্ণতার মেঘে ঢেকে গেল। কংসের সেই রথ ঘিরে বসে থাকে গোপ-গোপিনীরা। প্রত্যেকে বিনিদ্র রজনী। যদি, কৃষ্ণ চলে যায়, তাই বিনিদ্র রজনী। কৃষ্ণের পথ আগলাতে শুধু রাতের ঘুম নয়, খাওয়াও ভুলেছে সবাই। একদিন সবার চোখের আড়ালে আমার রেপাল্লি গ্রামে এলেন কৃষ্ণ। বৃন্দাবন ছেড়ে যাওয়ার কথা আমায় জানাল। আমি নীরব। কারও মুখে কোনও কথা নেই। বুকের ভিতরে তোলপাড় হলেও আমি কিছু বললাম না। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট হলেও সে আমার ঈশ্বর। ততটাই শান্ত কৃষ্ণ, মাঝসমুদ্রের মতো ধীর, স্থির। ঢেউ ভাঙার আবেগের লেশ বিন্দুমাত্র নেই। কৃষ্ণ সেখান থেকে চলে আসার আগে, শুধু বললাম, তোমাকে কেউ কোনও দিন আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। তুমি সশরীরে আমার সামনে না-থাকলেও, হৃদয়ে থাকবে আষ্টেপৃষ্টে। তুমিই তো আমার আত্মা গো!
মথুরার পথে, কংসের রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা দিল কৃষ্ণ। বলরাম তার সঙ্গী। এর মধ্যে যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। কেটে গিয়েছে কতগুলো বছর। অত্যাচারী কংস কৃষ্ণের হাতে শেষ হয়েছে, তা-ও অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। শান্তি ফিরেছে মথুরায়। একদিন আমার মনে হল আমার কথা কি তার এতটুকু মনে পড়ে? বসিয়া বিরলে থাকয় একলে না-শুনে কাহার কথা…। অষ্টপ্রহর কৃষ্ণনামই আমার অবলম্বন। একদিন স্বামী, সংসার সব বিসর্জন দিয়ে, সবার অলক্ষ্যে চুপিসারে শ্বশুরঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বৃন্দাবন ছেড়ে দ্বারকা। কতগুলো দিন তাকে হাঁটতে হয়েছে। কতটা পথ। দিনের পর দিন পথ ভেঙে ক্লান্ত। খাওয়া নেই। রাতে ঘুম নেই। উদভ্রান্ত সে পথহাঁটা। শরীর দুর্বল হয়েছে। হারিয়েছে জৌলুস। হাঁটতে হাঁটতে একদিন আমি দেখলাম দ্বারকার রাজপ্রাসাদ। আমার দুর্বল মুখে হাসি ফুটল। অন্য প্রজাদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে ঢোকার অনুমতি মিলল। দেখতে পেলাম প্রাণের মানুষটিকে। খুশিতে মন ভরে উঠল।
যাতে কাছ থেকে চোখের দেখা দেখতে পাই, কৃষ্ণের অনুমতি নিয়েই রাজপ্রসাদে দাসীর কাজ নিলাম। রাজপ্রসাদের আর কেউ আমার ও কৃষ্ণের এই সম্পর্কের কথা জানত না। রাজপ্রাসাদে দূর থেকে রোজ কৃষ্ণকে দেখতাম। একটা সময় এল, কৃষ্ণের কাছ থেকে এই দূরত্ব, বিচ্ছেদ মানতে পারছিলাম না। অতীতের সঙ্গে কৃষ্ণকে মেলাতে পারছিলাম না। বুঝলাম এই শারীরিক নৈকট্য আত্মিক নৈকট্য নয়। ফলে কৃষ্ণকে না-জানিয়েই আচমকা একদিন প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। মনে তীব্র অভিমান। শরীর ভেঙেছে। অকালবার্ধক্য গ্রাস করছে। কোথায় যাব জানি না। শুধু হাঁটছি। শুধু বুঝতে পারলাম আয়ূ শেষ হয়ে আসছে। কখন জ্ঞান হারালাম জানি না। দেখি সামনে কৃষ্ণ। বললে, তুমি কি চাও? কিচ্ছু না। তবু তিনি অনুনয়ের কন্ঠে বললে, তুমি তো কোনও দিন কিচ্ছু চাওনি আমার কাছে। আজ কিছু চাও। যে বাঁশি আমায় ব্যাকুল করত বৃন্দাবনে, সেই বাঁশিই শুনতে চাইলাম। শেষবারের মতো। সুর তুলল কৃষ্ণ। যে সুর আগে কোনও দিন বাজায় নি। সেই বাঁশি শুনতে শুনতেই নিথর হয়ে এল আমার দেহ। কৃষ্ণ বাঁশিখানি ভেঙে ছুড়ে ফেলে দিল জঙ্গলে। আর বাঁশি বাজাবে না কখনও। মুহূর্ত গেল না, পলক পড়ল না, সে চলে গেল আবার দ্বারকায়, তার প্রাসাদে।
আমাদের এই প্রেম কাহিনি, সর্বাধিক চর্চিত। তাই একে আর অহেতুক স্বকীয়া-পরকীয়া ভেবে কী হবে? প্রেম মানে যেন আজও বৈষ্ণব কবিতা: তোমার আমার একই হিয়া ভাল সে জানয়ে আমি/ হিয়ার হৈতে বাহির হৈয়া কী রূপে আছিলা তুমি। কিন্তু পুরুষোত্তম কৃষ্ণ? আমি জানতাম কৃষ্ণ যুদ্ধ করেননি, কিন্তু আগাগোড়াই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমার মৃত্যুর পরে কৃষ্ণ দিন সাতেকও বেঁচে ছিলেন না। একটি গাছের তলায় তিনি যখন বসে ছিলেন পা ছড়িয়ে, তখন হরিণের কান ভেবে ভুল করে এক ব্যাধ তীর মারে তার পায়ে। সেই তীরের আঘাতে কৃষ্ণ প্রাণ ত্যাগ করেন। সেই মৃত্যুমুহূর্তে কৃষ্ণ তখন কী ভাবছিলেন? আমার কথা? না যুদ্ধ পরবর্তী ভারত কথা? জানি না, কিন্তু আমার কোন ক্ষোভ নেই। হয়ত আমার জীবন বাহ্যিক আঙ্গিকে পরিপূর্ণ নয়, কিন্তু আমার প্রেম অমরত্ব পেয়েছে। তাই আমার নাম উচ্চারিত হয় কৃষ্ণের আগে। রাধাকৃষ্ণ। তাই উপেক্ষিতা হলেও আমি অমর। প্রেমের বিশ্বে।
যশোধরার বুদ্ধবিচার
আমি শাক্যবংশীয় যুবরাজ সিদ্ধার্থজায়া যশোধরা। আমার ও সিদ্ধার্থর জন্ম একই দিনে। আমার শ্বশ্রূ শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোদনের রাজত্বর রাজধানী ছিল কপিলাবাস্তু নগর। রাজা শুদ্ধোদনের স্ত্রী মহামায়া। দীর্ঘদিন সন্তানহীন রাণী মহামায়া এক আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে স্বপ্ন দেখলেন সন্তানলাভের। রাজ-জ্যোতিষী জানালেন, এক মহাপুরুষ শাক্যবংশে জন্ম নেবেন। স্বাভাবিক নিয়মে পিতৃগৃহে যাওয়ার সময় লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষের নিচে বৈশাখী পূর্ণিমার মায়াবী আলোয় রাণি মহামায়া জন্ম দিলেন সিদ্ধার্থের। নবজাত রাজকুমার ও রাজমাতা ফিরে এলেন কপিলাবস্তু নগরে। মহাজ্ঞানী ত্রিকালজ্ঞ ঋষি অসিত শিশু সিদ্ধার্থকে নিরীক্ষণ করে বললেন, “এই শিশু কোনও সাধারণ মানব শিশু নয়। ইনি পৃথিবীর মানুষকে মুক্তিপথের সন্ধান দেবেন। সিদ্ধপুরুষ। তাই এই পুত্রের নাম রাখা হোক সিদ্ধার্থ। ”দৈবজ্ঞরা এসে ভাগ্যগণনা করে বললেন, “গৃহস্থাশ্রমে থাকলে এই পুত্র হবে হবেন এক মহাশক্তিশালী নৃপতি, কিন্তু সন্ন্যাসাশ্রমে গেলে ইনি হবেন যতিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ। “ জন্মের সাতদিনের মাথায় মৃত্যু হল সিদ্ধার্থের মাতা মহামায়াদেবীর। শিশুর লালন পালনের ভার নিলেন তার মাসী তথা শুদ্ধোদনের অন্যতমা পত্নী গৌতমী। তাই শিশুর আরেক নাম রাখা হল গৌতম।
আমার পিতৃবাস কপিলাবস্তুর পাশের রোহিনী নদীর ওপারে দেবদহ নগরে। আমরা কোলিত। বহু যুগ ধরে শাক্য ও কোলিতদের শত্রুতা। আমাদের রাজা সুপ্রবুদ্ধ। তার ভ্রাতা দণ্ডপাণি শাক্য, আমার পিতা। ডাকনাম গোপা। আমার মুখশ্রী নাকি অপরূপ তাই আমার আর একটি নাম বিম্বা। রাজকুমার সিদ্ধার্থকে আমি প্রথম দেখি আমার আট বছর বয়সে। সে সময়ে শাক্য ও কোলিত রাজপুত্রদের মধ্যে এওকটি রাজহাঁস সংক্রান্ত বিবাদের বিচারে ডাক পেতে সিদ্ধার্থ আমাদের প্রাসাদে হাজির হন। তার পরনে সুদৃঢ় বক্ষ বন্ধনীর উপর সাদা উত্তরীয়। গলায় মুক্তার মালা। কপালে ও বুকে অঙ্কিত চিত্রবিচিত্র সুগন্ধী চন্দন। কানে সোনার কর্ণকুণ্ডল। নিম্নার্ধে সরু সোনার পাড় বসানো কাশীর বস্ত্র। কোমর বন্ধনে উজ্জ্বল সোনার বন্ধনী। সবে কোমল গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে তার সুকুমার মুখে। সোনার মতো উজ্জ্বল, দীর্ঘ আর সুঠাম তার শরীর। চোখদুটি উজ্জ্বল আর অপূর্ব সুন্দর। যেন এক অপরূপ মায়া দিয়ে গড়া তার দুটি চোখ। আমি মুগ্ধ হলাম। শুনেছিলাম তার মা মায়াদেবী নাকি এমনই তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা ও অপরূপ সুন্দর ছিলেন। বিচারের পর বিচারক রায় দিলেন সিদ্ধার্থের পক্ষে। শাক্য কুমারগণ একত্রে উল্লাসে ফেটে পড়ল। অথচ সিদ্ধার্থের মুখে আনন্দের চিহ্নই নেই।
এরপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ আট বছর কেটে গেল। কুমার সিদ্ধার্থের বয়স এখন প্রায় ষোলো। এখন যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তবে রাজকুমার অন্যান্য রাজপুত্রদের মতো আমোদপ্রিয় নন, সাজসজ্জা ও পশু শিকার তিনি অপছন্দ করেন। শুদ্ধোদনের মনে সারাক্ষণ কুমারকে নিয়ে একধরণের আশংকা। একজন বয়স্ক ও প্রাজ্ঞ মন্ত্রী রাজা শুদ্ধোদনকে একদিন বললেন, “মহারাজ! কুমার কি বিবাহ করতে চান না? বিবাহ করতে চাইলে তার মনোমত পাত্রীর সঙ্গে তার বিবাহ দিন। অল্প বয়সে সংসারে একবার প্রবেশ করলে কুমার আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে চাইবেন না। “ সিদ্ধার্থকে বিবাহের কথা জিজ্ঞাসা করাতে সবাইকে অবাক করে কুমার বলে উঠলেন, “আমার বিবাহে কোনও আপত্তি নেই। ” এ কথা শুনে মহারাজ শুদ্ধোদন বললেন,
‘ব্রাহ্মণীং ক্ষত্রিয়াং কন্যাং বৈশ্যাং শূদ্রীং তথৈবচ। / যস্যা এতে গুণাঃ সন্তি তাং কন্যাং মে প্রবেদয়।। / ন কূলেন না গোত্রেণ কুমারো মম বিস্মিতঃ। / গুণে সত্যে চ ধর্মে চ তত্রাস্য রমতে মনঃ।’
অর্থাৎ এমন কন্যার অন্বেষণ করুন যিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র যে কোনও কূল বা গোত্রের হলেও তাতে কুমারের কোনও আপত্তি নেই। তবে তিনি যেন সদা সত্য ও ধর্মে অবিচল থাকেন। ব্রাহ্মণগণ দেবদহে এলেন। আমাকে তারা নির্বাচন করে ফিরে গেলেম। কিন্তু আমাকে বা আমার পরিবারকে কিছুই জানালেন না। মহারাজ শুদ্ধোদন এরপর এক সন্ধ্যায় রাজবাড়ির উদ্যানে এক বিশাল সভার আয়োজন করলেন। সিদ্ধার্থর স্বয়ংবর সভা। এই সভার আমন্ত্রণ এল আমার পরিবারেও। আমি আমার পিতার সাথে গেলাম সেই কাননে। অনেক কন্যার ভিড়। দেখলাম সিদ্ধার্থ নিজে তাদের হাতে উপহারগুলি তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! রাজপুত্র উপহার দেওয়ার সময় তো কোনও মেয়ের দিকেই চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না! তাহলে তিনি কী করে পত্নী নির্বাচন করবেন? নাকি রাজপুত্র শেষ পর্যন্ত বিবাহই করবেন না? আমার বড় কৌতূহল হল। ভাবতে ভাবতেই একসময় সিদ্ধার্থর সামনে চলে এলাম। দেখলাম উপহারের থালাটি একেবারে শূন্য, আর একটিও উপহার সেখানে অবশিষ্ট নেই। তাহলে কি দেবেন আমাকে? সিদ্ধার্থ আমার দিকে তাকালেন। হঠাৎ তার গলার অমূল্য মুক্তোর মালাটি খুলে আমাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “তবে এই নাও তোমার উপহার রাজকুমারী!” সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে একসঙ্গে অনেক শাঁখ বেজে উঠল। দাসী সহচরীরা উলুধ্বনি দিতে লাগল। এমনটাই আগে থেকে ঠিক ছিল। যাকে রাজপুত্র মনোনয়ন করবেন, তার গলাতেই নিজের মালাটি দান করবেন।
সিদ্ধার্থ আমাকে মনোনয়ন করলেও, আমার পিতা দণ্ডপাণিশাক্য বললেন, কুল প্রথা অনুযায়ী তাদের কন্যার পাণিপ্রার্থীকে অশ্বচালনা, ধনুর্বাণ, অসিচালনা প্রভৃতিতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। এইসব বিদ্যায় দক্ষ জনকেই আমি আমার কন্যা দান করব। এ-কথায় মহারাজ শুদ্ধোদন বিরক্ত হলেও সিদ্ধার্থ কিন্তু দণ্ডপাণি শাক্যের কথায় বিরক্ত হলেন না। নির্দিষ্ট দিনে একখানি রথে চড়ে ময়দানে এসে পৌঁছালেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ। তার উর্ধ্বাঙ্গে আজ কেবল একটি স্বচ্ছ ও শ্বেত উত্তরীয়। তার উন্মুক্ত বক্ষস্থল চন্দন চর্চিত। গলায় মুক্তার মালা। কোমরবন্ধনীতেও মুক্তার আভরণ। নিম্নাঙ্গে ঘন নীল রঙের অধোবাস। তার উজ্বল স্বর্ণাভ গৌরবর্ণ সকালের রোদে যেন ঝলমল করছে। তার সুকুমার সুগঠিত শরীর এবং সরল ও পবিত্র মুখটি দেখে আমি মনে মনে তারই জয় প্রার্থনা করলাম। দেবদত্তসহ আনেক রাজকুমার আমার পাণিপ্রার্থণায় নেমেছিলেন যুদ্ধে। সেই যুদ্ধ বর্ণনার বিস্তারে যাওয়ার দরকার নেই। সর্ববিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন সিদ্ধার্থ।
এরপর শুভদিনে সিদ্ধার্থ ও আমার বিবাহ হয়ে গেল। কপিলাবস্তুর মানুষ ও দেবদহের মানুষ একত্রে আনন্দে মেতে উঠল। বিয়ের দিনে কত যে ফুল এল, কত যে ঝাড়বাতি জ্বলল, কত রকম যে খাবার রান্না হলো তার ইয়ত্তা নেই। কত নট ও নটী এলো। শত শত নর্তকী ও সঙ্গীত শিল্পীর দল এসে তাদের শিল্পের পরিচয় দিতে কপিলাবস্তুতে ভিড় জমালেন। সিদ্ধার্থ দিন কয়েক নগরভ্রমণে গিয়ে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু বিষয়গুলো তাকে কাতর করে তুলল। তার মনে হলো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। সংসারের মায়া ত্যাগ করে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হলেই এই বিষয়ের উত্তরপ্রাপ্তি সম্ভব। তিনিও দুঃখমুক্তির সন্ধানে গৃহত্যাগ করবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। পিতার নিকট গিয়ে তিনি তার সংকল্পের কথা জানালেন। পুত্রের কথা শুনে রাজা প্রাণাধিক পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি শাক্যরাজ্যের রাজপুত্র, তোমার কর্তব্য রাজধর্ম পালন। সংসারধর্মপালন। উত্তরাধিকারী অরস্তুত রাখা, জারগ্রস্তত না হয়ে চিরযৌবনপ্রাপ্তি। ব্যাধিহীন জীবন, অমর হয়ে চাওয়া তো সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা। এ-শর্ত প্রত্যাহার কর পুত্র। তখন সিদ্ধার্থ বললেন, মৃত্যুও যে-কোনও সময় আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। আমি গৃহত্যাগ করার সংকল্প করেছি।
এর মধ্যে আমার কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তানজন্ম নিল। পুত্রের জন্মের খবর পেয়ে গৌতম নিজের অজান্তে বলে উঠলেন, ‘রাহু জন্মেছে, বন্ধন উৎপন্ন হয়েছে।’ দূতমুখে এ কথা জানতে পেরে রাজা শুদ্ধোদন পৌত্রের নাম রাখলেন রাহুল। কিন্তু গৌতম সিদ্ধান্ত নিলেন, এ-বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন, আজই গৃহত্যাগ করতে হবে। আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত, জ্যোৎস্নায় আলোকিত নগরী। কুমার শেষবারের মতো আমার ঘরে গেলেন। দেখলেন শিশুপুত্র রাহুল আমার কোলে ঘুমোচ্ছে। স্নেহ, মায়া, প্রেম কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারল না। একে কি নিষ্ঠুরতা বলে না? একে কি প্রেমহীনতা বলে না? একে কি কাপুরুষতা বলে না? সত্যকে এড়িয়ে তস্করের মত পালিয়ে যাওয়া…। এ কোন বোধপ্রাপ্তির পথ?
রাজপুত্র রাজসুখ ত্যাগ করে হলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। সমাজ-সংসার থেকে দূরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, শুরু হল তার সুদীর্ঘ তপস্যা। অতি কঠোর সাধনার ফলে তার শরীর ক্রমে ক্ষয়ে গেল। তার অঙ্গসঞ্চালনের ক্ষমতা কমে গিয়ে তিনি মরণাপন্ন হলে তার উপলব্ধি হয় যে, অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়। নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করে একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় তিনি ধ্যানে বসেন। নিকটবর্তী গ্রামের কোনো এক শ্রেষ্ঠী কিম্বা গোপকন্যা সুজাতা তাকে বনদেবতা মনে করে এক পাত্র পরমান্ন নিবেদন করেন। সেই পরমান্ন বা পায়স আহার করে তিনি দেহে-মনে তৃপ্তি ও বল অনুভব করেন। আবার বসলেন তপস্যায়। “ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং/ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু। /অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্প দুর্লভাং/নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে”।। উনপঞ্চাশ দিন ধরে ধ্যান করার পর তিনি বোধি প্রাপ্ত হন। এই সময় তিনি মানব জীবনে দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, যা চতুরার্য সত্য নামে খ্যাত হয়। নিজে যা প্র্য়োগ করেন নি জীবনে তার প্রচার তিনি শুরু করলেন। রাজধর্ম বিচ্যুত, প্রজাপালন থেকে পলায়নোত্তর জীবনে, স্ত্রী-সন্তানকে অনন্ত অন্ধকারে নিক্ষেপ করে তিনি অহিংসার বাণী প্রচারে মত্ত হলেন।
দীর্ঘ ৭ বছর পর কপিলাবস্তুতে ফিরে এলেন বুদ্ধ। রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি পুত্র রাহুলকে ডেকে বললাম –ওই তোমার পিতা, তাকে ডেকে আন। রাহুল নিজের পরিচয় দিয়ে গৌতম বুদ্ধ কে ঘরে আস্তে অনুরোধ করল। গৌতম বুদ্ধ সে আহ্বান অগ্রাহ্য করলেন। পুত্রকে অস্বীকার করলেন। এরপর সকলের কাতর অনুরোধে উনি বাড়িতে প্রবেশ করলেন কিন্তু কোথাও দাঁড়ালেন না। রাজবাড়ি থেকে শেষবারের মতো বের হওয়ার সময় আমি চাইলাম তাকে আটকাতে। তিনি যাই করুন এই প্রাসাদে থেকে করুন। এই প্রাসাদকে বানিয়ে তুলুন তার সংঘ। গৌতম বুদ্ধের সামনে আমি আমার দীর্ঘ চুল বিছিয়ে অপেক্ষা করলাম। গৌতম বুদ্ধ বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে আমার চুল মাড়িয়ে রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি কতটা ভালবাসা নিয়ে আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছি দীর্ঘদিন তার মূল্য দিলেন গৌতম বুদ্ধ। আমার ভালবাসা পায়ে মাড়িয়ে সারা জীবনের জন্য নিজ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন। যে নিজের স্ত্রীর ভালবাসার মূল্য দিতে জানেন না, তিনি কি করে মানুষকে ভালবাসার কাহিনি শোনান? এটা দ্বিচারিতা নয়?
শুদ্ধোদনের মৃত্যুর পরে রাজা হলেন মহানাম। তিনি আমার শ্মশ্রুমাতা গৌতমী, গৌতমীকন্যা রূপানন্দা, আমাকে ও পুত্র রাহুলকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন। কারণ তিনি ভীত ছিলেন যদি ভবিষ্যতে রাহুল রাজা হয়। নিরুপায় শ্মশ্রুমাতা গৌতমী পায়ে হেঁটে আমাদের সবাইকে নিয়ে বৈশালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আমরা বৈশালীর কুক্কুটারামে এসে উপস্থিত হলাম এবং বুদ্ধের কাছে আশ্রয়ভিক্ষা করলাম। কিন্তু কি বললেন বুদ্ধ? প্রথমে প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে যে সংঘে মহিলাদের স্থান নেই। কিন্তু পরে সকলের পীড়াপীড়িতে রাজী হয়ে আক্ষেপোক্তি করে বলেন যে, হে আনন্দ, যদি আমাদের ধর্মে নারীকে সন্ন্যাস দেওয়া অনুমোদন না করা হতো তাহলে এই ধর্ম এক হাজার বছর স্থায়ী হতো। কিন্তু যেহেতু এখন সংঘে নারীদেরও প্রবেশ ঘটলো, সেই কারণে এই ধর্ম মাত্র পাঁচশো বছর স্থায়ী হবে! প্রেম ও করুণার সাগর বুদ্ধদেবের এই উক্তি নারীদের প্রতি তার মননের পরিচয় দেয়। আমার বুদ্ধের বা সিদ্ধার্থের প্রতি কোন উস্মা বা অভিযোগ নেই। কিন্তু তিনি ভগবান নন। তিনি ঈশ্বর নন। নিঃস্বার্থ পুরুষোত্তম নন। তিনি নিছকই একজন মানুষ। আর পাঁচজনের মত। আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখায় নীতির উল্টোপথের যাত্রী। নারীজাতিকে তীব্র অবহেলা করে কি কখনও কেউ পুরুষোত্তম হতে পেরেছে?
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত গোস্বামী ঈদসংখ্যা ২০২৩ গল্প পুরুষোত্তম বিবর্জিতা তিনযুগের তিন নারীর আত্মকথা সাহিত্য