তাপসী দাসের ‘আমার যে জীবন’
২০ এপ্রিল ২০২৩ ১১:০২
আমার গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, কিভাবে শুরু করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা! এমনকি কি দিয়ে শুরু করব সেটাও জানিনা। তবু ছেলেবেলা দিয়েই শুরু করা যাক…।
আমার ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে আমি আর আমার ভাই। ভাইকে পাহারা দেওয়াই ছিল আমার একমাত্র ডিউটি। এদিকে আমার ভাই বয়সে আমার থেকে দুবছর দুমাসের বড় হওয়া সত্ত্বেও আমরা একই ক্লাসে পড়তাম! এর পেছনে অবশ্য একটা গল্প আছে। সেটা হলো আমার ভাই বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে একটু পিছিয়ে। একটু বললে ভুল হবে সে অনেকটাই পিছিয়ে। আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মত তার অত বোধ বুদ্ধি ছিলনা। এমনকি ঠিকঠাক করে কারও সাথে কথাও বলতে পারত না! তার কিছু কর্মকাণ্ডের নমুনা দিই। আমরা তখন ক্লাস থ্রি/ফোর এ পড়ি। সময়টা কালবৈশাখীর, হঠাৎ প্রচন্ড জোরে বাতাস ছাড়লো, চারপাশ ধুলোয় ভরে গেল, আমি আর আমার ভাই ছুটে ঘরে ঢুকেই একটা পলিথিন নিয়ে মা কিছু বলার আগেই একে অন্যের হাত ধরে সেকি দৌড়! এই ঝড়ের মাঝে দৌড়াতে দৌড়াতে সোজা চলে গেলাম সরকারি ডিসির বাংলো বাড়ির আম বাগানে। ঢুকে দেখি ততক্ষণে আমাদের আগেই অনেকে চলে এসছে আম কুড়াতে। তারপর হুমড়ি খেয়ে আমি আর আমার ভাই নেমে গেলাম আম কুড়াতে!
একসময় ঝড় শান্ত হলো, আমাদের আম কুড়ানোও শেষ হলো, সবাই হাত ভর্তি আম নিয়ে ফিরে যাচ্ছি যার যার গন্তব্যে, এদিকে আম কুড়ানোর নেশায় ভুলে গিয়েছিলাম কে কোথায় আছি, কে কোনও দিকে ছুটছি। হাত ভর্তি আম নিয়ে আমি আমার ভাইকে খুঁজছিলাম আর আশায় ছিলাম সে কতগুলো আম কুড়ালো সেটা দেখব কিন্তু যখন তাকে দেখলাম কিছুটা অবাক হলাম, সে শূন্য হাতে এক কর্নারে ভেজা কাকের মত দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?সে খুব সাধারণ ভাবে উত্তর দিলো, ঝরের সময় একটা ছেলে আম কুড়াচ্ছিলো সেই ছেলেটা আমার ভাইকে ডেকে বলেছিল ছেলেটার আমগুলো যেনো আমার ভাই দাঁড়িয়ে পাহাড়া দেয়। আমার ভাইও সেই ছেলের কথামতো দাঁড়িয়ে আম পাহাড়া দিয়েছে। তাই জন্য সে নিজে কোনও আম কুড়াতে পারেনি!! আশা করি আমার ভাইয়ের বুদ্ধিমত্তার ঠিক কোথায় সমস্যা সেটা অল্প হলেও ধরতে পেরেছেন! ঠিক এই ধরনের আরও নানাবিধ সমস্যা তার ছিল।
যাই হোক এবার মূল কথায় আসি, আমার ভাইয়ের এই সমস্যার কারনে আমার বাবা ঠিক করেছিলেন যদি আমাকে আর আমার ভাইকে একই ক্লাসে ভর্তি করে দেওয়া যায় তাহলে আমি ওকে আর ও আমাকে দেখে রাখতে পারবে। বাবার ভাবনার শুরুটা যদিও সুন্দর হয়েছিল কিন্তু শেষটা নয়,,,
এবার আমার পরিবারের বাকি সদস্যদের একটা ছোট বর্ণনা দেই। আমি আমাদের পাঁচ সদস্যদের পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ এবং অবহেলিত সন্তান। আমার বড় আমার দুই দাদা। আমার মায়ের দিকের পরিবারটা যতটা সাদামাটা ততটাই অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ অন্যদিকে বাবার দিকের পরিবারকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য খুব একটা হয়নি তবে যেটুকু হয়েছে সেটুকু পর্যাপ্তই বলা চলে।
এখন ব্যাখ্যা করি নিজেকে কেন অবহেলিত সন্তান মনে হয়! প্রথমত বড় হবার পর মায়ের আলমিরায় একটা ছবির এলবামে আমার বড় দাদার ছোটবেলার ছবি খুজে পেয়ে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমার বা আমার মেঝ দাদার ছবি নাই কেন?উত্তরে মা বলেছিলেন প্রথম সন্তান আদরের হয়, শখের হয় তাই তার ছবি আছে কিন্তু পরের সন্তানের বেলায় সেই শখটা আর থাকেনা তাই আমাদের বাকি দুজনের ছবি সেই পুরাতন এলবামে ছিল না! সেদিন মায়ের উত্তর শুনে কেন জানি না মনে হয়েছিল ওহ আচ্ছা তাহলে আমি তো তিন নাম্বার খুবই অবহেলার পাত্রী!
গত এক বছর আগে বাবার কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা ছিল এমন, আমার ঠাকুর দিদির খুব আদরের সন্তান ছিল আমার বাবা, আর আমার ঠাকুরদিদি ছিল আমার বাবার দুনিয়া। ঠাকুরদি মারা যাওয়ার পর বাবা আশ্রমে গিয়ে মহারাজ এর কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন মা তো চলে গেছেন! এখন আমি মা ডাকবো কাকে? মহারাজ বাবাকে বলেছিলেন তোর মা আবার তোর ঘরে আসবে … তারপরের বছর আমার জন্ম হয়েছিললো! এবং আমার বাবা আমাকে মা ডাকেন।
এই ঘটনা শুনার পর যে কোনও সন্তানের সেই অবহেলিত হবার কষ্ট নিমিষেই মুছে যাবার কথা এবং আমারো মুছে গিয়েছিল।
আবারও ছেলেবেলায় ফিরে যাই … আমার ছেলেবেলা পুরুটা জুড়ে আছে আমার ভাই। আমরা পিঠাপিঠি তো ছিলাম সেই সাথে ছিলাম ভাল বন্ধু। বাবা একই ক্লাসে আমাদের ভর্তি করেছিলেন সে আমাকে দেখে রাখবে বলে যদিও ছেলেবেলায় তাকে বিভিন্ন আপদ বিপদ থেকে রক্ষা করাই ছিল আমার কাজ। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারত না, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত না, তার হয়ে যতটুকু সম্ভব আমিই বুঝিয়ে বলতাম।
ও যখন বুঝতে পারলো ও গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা বা বুঝাতে পারেনা তখন সে মনে মনে অন্য কিছু করার কথা ভাবছিল।
সেই অন্য যে কিছু সেটা বলছি…
আমরা তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে টিচার আমাদের মা কে দেখা করতে বললেন! মা যথারীতি পরদিন স্কুলে গেলেন এবং জানতে পারলেন সে ক্লাসে নকল করেছে! টিচারের বক্তব্য ছিল এমন; যে ছেলে মুখে কিছু বলতে পারেনা সেই ছেলে এত নিখুঁত করে একটা প্রশ্নের উত্তর কিভাবে লিখলো!
ঘটনার গভীরে গিয়ে জানতে পারলাম আমার ভাইয়ের অপরাধ সে খাতায় যে উত্তর লিখেছিল সেখানে দাঁড়ি-কমা পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল দেখে তার টিচারের সন্দেহ হয় এবং ওকে ক্লাসে সেই প্রশ্নের উত্তর মুখে বলতে বলা হয়। সে ক্লাসের সবার সামনে দাঁড়িয়ে এক লাইনও বলতে পারেনি। আর তাতেই শিক্ষক ধরে নিয়েছেন সে ওই উত্তর বই দেখে হুবহু খাতায় কপি করেছে। তাই তার উত্তরপত্র বাতিল করা হয়েছিল। সেদিন স্কুলে দাঁড়িয়ে সে কোনওরকম কথা বলেনি প্রতিবাদও করেনি। এদিকে বাসায় আসার পর তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন শুধু শুধু নকল করতে গিয়েছিলি! উত্তরে সে বলেছিল আমি নকল করে লিখিনি, উত্তর আমার জানা বলেই লিখেছি। সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললে আমার কথা জড়িয়ে যায় তোমরা তো জানো! হ্যাঁ আমরা জানি, তারপরেও ভাইয়ের কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য বললাম তাহলে এখন সেই উত্তরটা লিখে দে আমার সামনে। সে লিখে দিলো। বলে রাখা ভাল তার হাতের লিখা দেখলে মনে হতো টাইপ রাইটারে কেউ টাইপ করেছে, তার মাঝে কোথাও যতিটাও মিস যায়না! এমন নির্ভুল লিখা দেখলে যে কোনও টিচারের সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমরা একই সাথে ক্লাস নাইন অবধি পড়াশোনা করতে পেরেছিলাম। ওর সবকিছুতে ফাইট করতে হতো। সহজে কথা বলতে চাইতো না বলে টিচাররা নানা কারনে ওকে ভুল বুঝতো। একটু হাবাগোবা টাইপ ছিল বলে ক্লাসের কেউ মিশতোও না তার সাথে, কোনও বন্ধুও ছিলনা। ক্লাসের এক কোনে একা একা সে তার মত করে থাকত। সেবার নবম শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো আমি খুব ভালভাবে পাশ করলাম কিন্তু মন ভেঙে গেল যখন শুনলাম সে সব সাবজেক্ট এ ভাল করেছে কিন্তু হিসাব বিজ্ঞানে ফেইল করে বসলো! আমার প্রচন্ড মন খারাপ হলো। এদিকে ওকে মা প্রচন্ড বকাঝকা করে। কারন বার্ষিক পরীক্ষায় ফেইল মানে আরও এক বছর একই ক্লাসে তাকে থাকতে হবে। মা কিছুদিন ক্লাসটিচার এর কাছে দৌড়াদৌড়ি করল, কোনওভাবে বলে কয়ে ক্লাস টেনে প্রমোট করা যায় কিনা সেজন্য কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা! ফেইল মানে ফেইল এটা কোনও ভাবেই ঠিক করা যাবেনা! এদিকে বাবার ব্যবসার অবস্থা তখন খুব টানটান যাচ্ছিল! চাকুরিজীবীদের জীবন এক গতিতে চলে ব্যবসায়ীদের আরেক গতিতে। বিয়ের পর চাকরিজীবীদের জীবন সম্পর্কে অবহিত হয়েছি আর বিয়ের আগে বাবাকে দেখেছি। এই ভাল এই মন্দ! কিছুদিন ছন্দপতন হতো তো কিছুদিন উত্থান হতো আবার কিছুদিন খুব স্বাভাবিক যেত। আমাদের সেই সময়টা যাচ্ছিল খুব ভয়াবহ। এমন সময় সন্তানের একই ক্লাসে আরও এক বছর থাকতে হবে সেটা ভাববার থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবতেই বরং বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ হচ্ছিল! হলোও তাই, বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফেইল করেছো যেহেতু সেহেতু আর পড়াশোনা করার কোনও দরকার নাই! ঘরে বসে থাক।
আমার ভাইয়ের পড়াশোনা সেখানেই সমাপ্ত। যদিও মা সবকিছুর বিপক্ষে গিয়ে বলেছিলেন কোনও সমস্যা নাই ছেলে আরও এক বছর নবম শ্রেনীতে থাকবে তাতে কোনও সমস্যা নাই! মা চেয়েছিলেন ভাইকে নবম শ্রেনীতে আবারও ভর্তি করতে কিন্তু সেখানে বাধ সাধে আমার ভাই। এমনিতেই সে সবার থেকে নানা কারনে পিছিয়ে থাকত বলে হীনমন্যতায় ভুগতো সেখানে সে একই ক্লাসে দুই বছর থাকলে নতুন সহপাঠীরা যে তাকে নিয়ে ক্লাসে ঠাট্টা মশকরা করবে, তার দিকে আঙুল তুলে নানা কথা বলবে সেটা সে ঠিকই বুঝেছিল। এবং এই জন্য সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে তার পড়াশোনা সেখানেই সমাপ্ত করবে।
সবকিছু কেমন এলমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম, একসাথে স্কুলে আর টিউশন ক্লাসে যাওয়ার ভাই বন্ধু হঠাৎ করে আমাকে মাঝপথে একা করে দিয়েছিল। এর মাঝে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি সেদিন আমার ভাই হিসাব বিজ্ঞানে ফেল করেনি। তাকে ফেল করানো হয়েছিল। আমার ভাই বলেছিল তার সকল অংক ঠিক ছিল সে ফেল করতে পারেনা। সে তার খাতা দেখতে চেয়েছিল কিন্তু ক্লাসটিচার তার খাতা দেখার অনুমতি দেয় নাই। পরে জানতে পেরেছিলাম যেই সাবজেক্ট এ সে ফেল করেছিল সেই টিচার ওনার কাছে ওকে প্রাইভেট পড়তে বলেছিল। সেও বাসায় প্রাইভেট পড়ার কথা জানিয়েছিল কিন্তু বাবার ব্যবসায় তখন মন্দা যাচ্ছিল বিধায় সেই টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তে দিবে দিবে বলেও দেয়নি বলে টিচারের একটা রাখ তার উপর ছিল বাকিটা আমরা ধারনা করে নিয়েছিলাম। ছেলের ফেইল এর খবর পেয়ে আমার মা ক্লাসটিচার এর কাছে দৌড়াদৌড়ি করেছিল ছেলেকে দশম শ্রেণীতে তুলে দেওয়ার জন্যে নয় ছেলের হিসাব বিজ্ঞান খাতাটা দেখার অনুমতি পাবার জন্য। ভাই আমার মা কে বলেই যাচ্ছিল টিচারের কোথাও ভুল হয়েছে আমাকে খাতা দেখাতে বলো … কিন্তু আমরা খাতা দেখার অনুমতি পাইনি।
কিছুদিন পর থেকে আমি পড়াশোনা শুরু করেছিলাম ঠিকই অন্যদিকে আমার ভাই আগে খেলাধুলা করতে বাইরে যেত কিন্তু এই ঘটনার পর সে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। নিজেকে চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি করে দেয়। বাইরে পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ভেবে সে বাইরে যেত না, কারও সামনে যেত না বাসায় কেউ এলে নিজেকে গুটিয়ে রাখত। আমাদের সাথে কোথাও বেড়াতে যেত না একেবারে গৃহবন্দি করে নিল নিজেকে। জন্ম থেকে সমস্যা নিয়ে জন্মানো ছেলেটা আরও সমস্যায় জর্জরিত হয়ে গেল।
তার কথাবার্তা চালচলন এ পরিবর্তন আসতে শুরু করল, খিটখিটে হয়ে গেল, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন কোনওকিছুতেই সে ছিলনা; তার সমস্ত দুনিয়া জুড়ে একজনই ছিল- সে হলেন মা। সে তার যাবতীয় আবদার অযুহাত না বলা সবকিছু মায়ের সাথেই শেয়ার করে দুনিয়ার আর কারও সাথে ওর কোনওরকম সামাজিক সম্পর্ক নাই!
২০০৮ এর অক্টোবরে আমার বিয়ে হয়, বিয়েটা মন্দিরে হয়, খুব সাদামাটা বিয়ে। সেই বিয়েতে আত্মীয় স্বজন বলতে কেউই ছিলনা। বরযাত্রী আপ্যায়ন করার মত অবস্থানে বাবা ছিলনা বলেই এমন বিয়ের আয়োজন।
সাতশ টাকার একিটা টিস্যু শাড়ি সাথে পুরাতন পহেলা বৈশাখ এর লাল ব্লাউস আর বেমানান কিছু চুড়ি হাতে সেজেছিলাম বিয়ের সাজ। শাশুড়ী মা ছেলের বউকে প্রথম দর্শন করে খুব মর্মাহত হলেন, হবারই কথা প্রথমত একমাত্র ছেলের বউ, তার উপরে কোনওরকম অনুষ্ঠান ছাড়া বিবাহ! তার উপর আবার কন্যার বাড়ি থেকে কন্যাকে কিছুই দেওয়া হলোনা! লস! কন্যা আবার অধ্যয়নরত ছাত্রী, বিয়ের পর পড়াশোনার দ্বায়িত্ব এসে পড়বে ছেলের ঘাড়ে! লসের উপর আরও লস! বিয়েরদিন শাশুড়ী মা একমাত্র ছেলের বউ এর জন্য একটা সনাতন সোনার গলার নেকলেস আর কানের দুল নিয়ে এসছিলেন। এবং সযত্নে সেগুলো আমাকে পরিয়ে আমার শাশুড়ী মা আমাকে বরণ করেছিলেন! আহা! সেই মূহুর্ত টা আমার জীবনে অন্যতম স্বরণীয় মূহুর্ত ছিল! যদিও সেই গহনা আমি আমার গোটা জীবনে সেই একদিনই পরার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাও কয়েক ঘন্টার জন্য, পরবর্তীতে সেগুলো আর কোনওদিন হাতে নিয়ে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি।
বিয়ের পরের সময়টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। বিয়ের পর আমি একজন বন্ধু পেয়েছিলাম। এই মানুষটার কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি, চিনেছি।
এদিকে আমার শাশুড়ী মা অনেক বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমতি মহিলা ছিলেন। ওনি আমাকে ওনার কাছে ডেকে নিয়ে প্রায়শই খুব আফসোস করতেন! ওনার ছেলে এমন মেয়ে বিয়ে করার আফসোস! ওনার তিন ছেলেমেয়ে মাস্টার্স পাশ করে তবেই বিয়ে করেছেন চাইলে ওনার ছেলের জন্য অন্য ওনি অনেক ভাল মেয়ে জোগাড় করতে পারতেন! কিন্তু ছেলে ভুল করে ফেলেছেন বলে সেই আফসোস করতেন! কথার ফাকে ফাকে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমি কি ভুল কিছু বলেছি ছোটমনি?
আমি বলতাম, না মা আপনি ভুল কিছু বলেন নাই
তারপর আমার সম্মতি পেয়ে মা আবার বলতে শুরু করতেন, এক বড়লোক পরিবারের মাস্টার্স পাশ মেয়ের বাবা তো নাছোড়বান্দা ছিলেন … কিন্তু ছেলে ভুল করে বসলো! এই ভুলের ফলাফল কি পেলো? আইট্টাকলা! একটা আইট্টাকলা জুটলো কপালে!
মায়ের কথা শুনে মনে মনে খুব হাসি পেতো! যদিও হাসি পাওয়ার মত কথা কিনা জানিনা কিন্তু ওনার শব্দচয়ন শুনে না হেসে পারতাম না!
মায়ের আফসোস পর্ব এখানেই শেষ হতো না, তিনি আমার মায়ের সাথেও একই গল্প বলতেন! আমার মা কে তিনি বলতেন বুঝলেন দিদি, আমার মেয়েদের নখের যোগ্যতাও আপনার মেয়ের নাই! না আছে বাপের টাকা না আছে শিক্ষা! সবই আমার ছেলের কপাল! নিজের কপালে নিজে লাত্থি মেরেছে! আমার মা আমার শাশুড়ী মায়ের সাথে সহমত পোষণ করতেন! মেয়ের মাকে ছেলের মায়ের সব কথায় সহমত পোষণ করাটা হয়ত সামাজিক নিয়মে পড়ে! আমার শাশুড়ী মায়ের আফসোস পর্ব শেষ হলে আমি পার্থর কাছে এসে মুচকি হেসে বলতাম তুমি আমাকে শুধু শুধুই বিয়ে করতে গেলে! আমার মত আইট্টাকলা বিয়ে না করে একটা মাস্টার্স পাশ চাকুরিজীবী মেয়ে বিয়ে করতে পারতে!
আমার কথা শুনে সে কি বুঝতো কে জানে, আমাকে তার সামনে বসিয়ে একটা ছোট গল্প শুনাতো, গল্পটা ছিল এমন, সে যখন প্রথম ঢাকায় আমাদের বাসায় এসে আমাকে দেখেছিল তখন প্রথম দেখাতেই সে মনে মনে ভেবেছিল জীবনে যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে এই মেয়েকেই বিয়ে করব! এবং ঘটনা এখানেই শেষ না, সে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে মন্দিরে মানত করেছিল যেন এই মেয়েটাকে সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়! এবং সে পেয়েছে। তার প্রার্থনা উপরওয়ালা কবুল করেছিলেন। তার সুখ যদি কারও কাছে আইট্টাকলা মনে হয় তাতে তার কিছু যায় আসেনা!
তার এই ছোটগল্প আমার মনের সকল কষ্ট মুছে দিতো! মনে হতো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েদের একজন।
আমার শাশুড়ীর আমার প্রতি খারাপ লাগাটা আরও তীব্র হলো যখন ওনার ছেলে বিদেশের উচ্চতর ডিগ্রি (PHD) কমপ্লিট না করে স্ত্রীর টানে চিরতরে বাংলাদেশ চলে এল! আমার শাশুড়ী মায়ের ধারনা আমি কান্নাকাটি করে আমার সোয়ামীকে বাংলাদেশ চলে আসতে বাধ্য করেছিলাম! যদিও সে বিদেশ থেকে চিরতরে চলে আসার জন্য কান্নাকাটি আমি করিনি কিন্তু সে চিরতরে চলে আসাতে আমি কিন্তু সত্যিই অনেক খুশি হয়েছিলাম! আসলে সেই উচ্চতর ডিগ্রির ভ্যালু সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা তখনও ছিল না।
আমার শাশুড়ী এখন আমাদের মাঝে নেই। মায়ের বিভিন্ন স্মৃতি আমার কারনে অকারণে মনে পড়ে। সেবার আমার বিয়ের পর পরার মত আমার কোনও শাড়ি ছিলনা, এদিকে পার্থর বন্ধুরা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে ঘুরাঘুরি করতে নিয়ে যাবে আমাকে। পার্থ ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল মা আমরা বাইরে যাব তাপসীর কোনও শাড়ি নাই তোমার একটা শাড়ি ওকে দাও; ও পরুক। আমার শাশুড়ী ওর কথায় প্রচন্ড পরিমানে মর্মাহত হলেন! একে তো আমি নতুন বউ আমাকে কিছু বলতে পারছেন না তার উপর ওনার কাছে শাড়ি মানে হলো ওনার ছেলে আর ছেলের বউ থেকেও বেশি মূল্যবান। আমার শাশুড়ী বিভিন্ন ভাবে ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন নতুন বউ জামাকাপড় পড়ে গেলেই হয় শুধু শুধু শাড়ী কেন! পার্থ বলল ওর ভাল কোনও জামাকাপড় নাই, তোমার সবুজ শাড়িটা দাও ওটা আমার খুব পছন্দের! সবুজ শাড়ির কথা শুনে শাশুড়ী ভাবলেন এতক্ষন তো শাড়ী চেয়েছে এখন তো একেবারে শাড়ীর কালার ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে! তার থেকে বরং কোনও একটা শাড়ি দিয়ে ঝামেলা এখানেই শেষ করা ভাল! তারপর আমার শাশুড়ী ওনার আলমিরা খুলে মোটামুটি ১৫/২০ মিনিট ঘাটাঘাটি করে যে শাড়িটা বের করেছিলেন এর থেকে দূর্বল শাড়ি হয়ত ওনার আলমিরায় আর ছিল না! এদিকে শাড়ি দেখে পার্থ বার বার বলে যাচ্ছিল এই শাড়ি সেই শাড়ি নয় যেটা সে চাইছে! এদিকে আমার শাশুড়ী কোনও ভাবেই মনে করতে পারছিলেন না ছেলে কোনও সবুজ শাড়ীর কথা বলছে! অবশেষে আমি বললাম মায়ের দেওয়া শাড়িটা অনেক সুন্দর আমি সেটাই পরবো, পরবর্তীতে শাশুড়ীর দেওয়া শাড়ি পরে ঘুরে এসে শাশুড়ী মায়ের শাড়ি রিটার্ন করতে গিয়ে বুঝেছিলাম একজনের শাড়ি আরেকজন এর পড়া উচিত না। জামাই দিতে না পারলে কি আরেকজনের শখের শাড়ি নিয়ে পড়তে হবে! যাইহোক মায়ের সেদিনের শাড়ি প্রেম আর কথাগুলো মনে পড়লে এখনও মনে মনে হাসি আবার কাদিও।
এদিকে মায়ের সেই সবুজ শাড়ি কিন্তু আমি দেখেছিলাম। বিয়ের প্রায় ৫/৬ বছর পর মা একবার ওনার আলমিরা গুছানোর সময় একটা বটল গ্রীন শাড়ি হাতে নিয়ে আমাকে ডেকে দেখাচ্ছিলেন, শাড়িটার পাড় আর আচলে খুব সুন্দর সোনালী গোটা পাতির ঘন কাজ করা! শাড়িটা যে কেউ দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসবে। মা শাড়িটা দেখাতে দেখাতে বলছিলেন শাড়িটা নাকি পার্থর খুব প্রিয়। তখন বুঝেছিলাম বিয়ের পর এই শাড়িটার কথাই সেদিন পার্থ বলছিল আর আমার শাশুড়ী এই শাড়িটার কথাই অস্বীকার করে যাচ্ছিলেন! এত সুন্দর শাড়ি আমার থাকলে আমিও অবশ্য কাউকে পড়তে দিতাম না! মা সেদিন ঠিকই করেছিলেন!
আমাদের বিয়ে হয় ২০০৮ সালে হলেও আমরা সংসার শুরু করি ২০১২ সালে। মাঝের চারটা বছর আমরা প্রচুর টানাপোড়েন এর ভেতর দিয়ে যাই। চট্টগ্রামে তখন আমার শশুরবাড়ি বলতে ওর বড় বোনের বাসা, আর ঢাকায় আমার বাবার বাসা। মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের বিয়ের পর বাবার বাড়ি থাকা মানে কেমন একটা অস্বস্তি! কোনও কিছু প্রয়োজন হলে মা বাবাকে বলতে কেমন একটা সংকোচ হয়, এদিকে সোয়ামী তখনও বেকার। তারপর অনেক চড়াই-উতরাই শেষ করে বুকে অসীম সাহস সঞ্চয় করে দুজনে মিলে ঠিক করলাম আমরা একটা ছোট্ট বাসা নিবো যত বাধাই আসুক একসাথে থাকবো। তারপর আমরা ৬ হাজার টাকায় দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসায় উঠেছিলাম, শুরু করেছিলাম আমাদের টোনাটুনির সংসার। সেই সংসারে এক এক করে আরিয়ান আর গলু এল, মাঝখানে অনেকটা বছর কেটে গেল। সব ঠিকঠাক ছিল, একদিন হঠাৎ একটা দু:সংবাদ পেলাম। মা অসুস্থ। সেই অসুখ যেনতেন অসুখ ছিল না! দীর্ঘ ৫ বছর এই অসুখের সাথে তিনি লড়াই করে বেচেছিলেন। মায়ের সাথে আমি একই ছাদের নিচে ৯বছর ছিলাম! এই নয় বছরে আমি ওনাকে বুঝাতে ব্যার্থ ছিলাম আমি ওনাকে কতটা ভালবাসি! কেন জানিনা ওনি সবসময় আমাকে ওনার প্রতিপক্ষ ভাবতেন!
মা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে একদিনের জন্যেও ভালবেসেছিলেন কিনা জানি না!
কোভিডের সময়টায় মায়ের চিকিৎসা খুব একটা ভালভাবে হয়নি, হাসপাতালে টেস্ট এর জন্য কেউ ধরে দেখতে চাইতো না! বাধ্য হয়ে বাসাতেই মায়ের চিকিৎসা চলতে থাকে… এদিকে সেই সময়টায় বিড়াল নিয়ে ভিডিও করে আমি টুকটাক আমার ফেসবুক প্রোফাইলের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করি। ভিডিওগুলোতে আমি আমার বিড়ালদের দেখাতাম আর পেছনে আমি কথা বলতাম। মানুষ তাদের পাশাপাশি আমার কথাবার্তা খুব পছন্দ করতে শুরু করে। আমাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে, ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগল! আমাকে দেখা যাচ্ছেনা অথচ আমার কথাবার্তা সবাইকে আনন্দ দিচ্ছে। এভাবে করোনাকালীন লকডাউন এর সময়ে অনলাইনে গল্প আড্ডা করে করে দিনগুলো ভালই কাটছিল! দেখতে দেখতে আমার সেই ছোট্ট পেজটাও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল! আমার এসব পোষা প্রাণীর ব্যাপারটায় আমার শাশুড়ী মা সবসময় নিরবতা পালন করতেন। কখনও আমাকে এই নিয়ে কোনওধরনের বাধা দেননি, হয়ত মাও এদের খুব পছন্দ করতেন! তবে সেকথা কোনওদিন মুখে বলেননি! অবশ্য মা তখন আমার সাথে এমনিও কথা বলতেন না। মা চলে যাওয়ার আগের দীর্ঘ ৯ মাস ওনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন। নভেম্বরের এক বিকেলে মায়ের শরীর খারাপ হয়, মা আমাকে ডাকেন না, পার্থকে ডাকেন, পার্থ মায়ের কাছে যায়, মায়ের পাশে আমাকে ডেকে বসায়, বসিয়ে তরিঘড়ি করে নিচে যায় হাসপাতালে নেওয়ার গাড়ি ডাকতে। আমি মায়ের পাশে চুপচাপ বসেছিলাম। কেউ কোনও কথা বলছিলাম না, মা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলেন, বুঝতে পারলাম মা আর নেই। কোনও কিছু বুঝে উঠার আগেই মা আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন! পার্থ গাড়ি নিয়ে এল কিন্তু মা কে পেলো না। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বসেছিলাম … জীবনে প্রথম এবং শেষ বারের মত মায়ের হাত আমি সেদিন ধরেছিলাম। মা চলে যাওয়ার পর কতটা শূন্য অনুভূত হয়েছিল সে আমি কাউকে কোনোদিন বুঝাতে পারব না।
কেবলই মনে হচ্ছিল একদিনের জন্যেও আমি ওনার ভালবাসা পাইনি, আমি ছিলাম ওনার একটা হতাশার যায়গা!
এমনকি মা চলে যাওয়ার পরেও আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ওনি আমাকে কতোটা অপছন্দ করতেন! ওনি আমার কাছে চিরকাল আমার দীর্ঘশ্বাস হয়ে রয়ে যাবেন! মায়ের কথা মনে হলেই হিন্দি সিনেমা তারে জামিন পার এর সেই মা গানের একটা লাইন মনে পড়ে যায়, ক্যায়া ইতনা বুড়ি হু ম্যায় মা…!
সবকিছুর পরেও যখন পার্থকে দেখি মনে মনে খুব শান্তি পাই, মায়ের সবচেয়ে প্রিয় আর আদরের এই ধন আমার কাছে তিনি রেখে গেছেন! আমাকে ভরসা না করলে কি রেখে যেতে পারতেন! মা হয়ত আমাকে মনে মনে অনেক ভালবাসতেন কিন্তু কোনওদিন সেটা বুঝতে দেন নি বা আমি বুঝিনি।
মা চলে গেছেন আজকে প্রায় আড়াই বছর! এর মাঝে জীবনে কত পরিবর্তন চলে এল। মায়ের সেই অযোগ্য আইট্টাকলা বউকে এখন কত হাজার হাজার মানুষ ভালবাসে, কত সম্মান করে, মা কে খুব বলতে ইচ্ছে করে মা আপনার আইট্টাকলা বউমা তার ছোট্ট জীবনে সবই পেয়েছে শুধু আপনার ভালবাসা ছাড়া! মা আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তির নাম আপনার ভালবাসা। আপনি আমার কাছে একটা দীর্ঘশ্বাস!
এদিকে আমার সেই ভাই কিন্তু আমার বা আমার দাদা বিয়েতে উপস্থিত ছিল না, এমনকি আমার দুই বাচ্চা হবার পর সে হাসপাতালেও যায়নি বোনের বাচ্চাদের দেখতে। সামাজিকতা বলে যে একটা শব্দ আছে সেটার কোনও অর্থ তার কাছে নাই। সে ওসবের ধার ধারেনা। কোনও কাজেও সে অংশগ্রহণ করেনি, বাসার বাইরেও খুব প্রয়োজন না হলে যায়না। তার জীবন সকালের নাশতা, দুপুরের ভাত আর রাতের খাবারেই সীমাবদ্ধ। বছর তিনেক আগে আমার মায়ের কেন যেন মনে হলো ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলে পরিবর্তন আসতে পারে! আমাকে জানানোর পর আমি সম্মতি দিই না, কারন আমার ভাইয়ের জীবনে সাধ আহ্লাদ না থাকতেই পারে কিন্তু যে মেয়েটা বিয়ে করে আসবে তার জীবনের সাধ আহ্লাদ নষ্ট করার অধিকার তো আমাদের নাই! কিন্তু আমার মায়ের ব্যাখ্যা ছিল অন্যরকম, মা ভাবছিলেন ছেলেকে বিয়ে দিলে বউ এলে ছেলের দ্বায়িত্ব জ্ঞান হবে। তখন কাজ কর্মে মনোনিবেশ করবে ছেলের মাঝে পরিবর্তন আসবে। তাছাড়া মা বাবা যতদিন আছে ছেলেকে দেখছে কিন্তু যেদিন মা বাবা থাকবে না সেদিন তাদের সন্তান কে দেখার জন্য তো একজনকে প্রয়োজন। তারপর বিয়ের কথা যখন ভাইকে বলা হলো উত্তরে সে নিরব ছিল দেখে মা ধরেই নিয়েছিল ছেলের সম্মতি আছে। তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিন যায়গায় কারও হাত নেই, কপালে যা আছে তা হবেই। তারপর খুব জোড়েসোরে মেয়ে খোজা হচ্ছিল, মেয়েকে গরীব হতে হবে। কারন বড়লোক এমন ছেলেকে মেয়ে দিতে যাবে কেন!
খুঁজতে খঁজতে পেয়েও গেল, মেয়ের বয়স সবে ১৬। মেয়ের পরিবারের বিয়ে দিতে কোনও আপত্তী নাই, থাকবেও বা কেন, ৭ সদস্যের পরিবারে এই মেয়ে তৃতীয়। তার পরে আরও দুই বোন আছে। এদিকে বড় বোন ক্যান্সার আক্রান্ত। একটা ছেলের আশায় আশায় তার ঘরে এখন ৫ কন্যা। তবু ভগবান এই পরিবারে একটা ছেলে সন্তান দিয়ে মুখ তুলে তাকান নি। মেয়ে দেখতে গিয়ে সেদিনই আশীর্বাদ হয়ে গেল বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল! দেখতে দেখতে বিয়েও হয়ে গেল, আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দ করেছিলাম আমি এই বিয়েতে! বিয়ের পর কিছুদিনের ভেতর ভাইয়ের বউও বুঝে গেল তার কেমন ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। তার জন্য মেয়েটার অবশ্য কোনও আফসোস নাই, সে তার বাবার বোঝ হালকা করতে পেরেছে ভেবেই খুশি। সহজ সরল ছোট্ট একটা মেয়ে। আমার বৌদি। আমি তার যায়গায় নিজেকে কল্পনা করি, আমার খারাপ লাগে। আমার মা যেই চিন্তাধারা থেকে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন সেটা আদতে বিফলে গেল। আমার ভাইয়ের অবস্তার কোনও পরিবর্তন এল না। ছেলে আগে একা একা ঘরে থাকত এখন স্ত্রী কে নিয়ে ঘরে থাকে কোথাও যায়না, এমনকি বিয়ের পর সে শশুর বাড়িও যায়নি কোনওদিন। এদিকে এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে বেচারি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। মা ভাবলেন বাচ্চা কাচ্চা এলে ছেলের মাঝে পরিবর্তন আসবে কিন্তু না তাও পরিবর্তন এলনা! এবার মায়ের কপালে চিন্তার ছাপ পড়তে শুরু করল এতকাল তো ছেলে একা ছিল এখন তো সেই পাল্লা আরও ভারী হলো!
এদিকে মায়ের চিন্তা আমাকেও নাড়া দিলো, মনে মনে ঠিক করে নিলাম অনাগত বাচ্চার দ্বায়িত্ব আমি নিবো। নিজের দ্বায়িত্ববোধ এর যায়গা থেকে সেই অনাগত বাচ্চার সকল দ্বায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে নিলাম। তার মা বাবা হয়ত হয়ে উঠতে পারব না কিন্তু তার সকল দ্বায়িত্ব তো নিতেই পারি! তারপরের বছর ঠিক আমার জন্মদিনের দিন আমার ভাইয়ের ঘরে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। তাদের দুইজনের সংসার তিনজনের হয়ে গেল! সেই কন্যার নমকরন করলাম লাবন্য।
লাবণ্যকে এখন আমি আমার কাছে নিয়ে এসছি সাথে ওর মা কেও। ও এখনও কথা বলতে শেখেনি, ওদের মা মেয়েকে আমি সেই সবকিছুই দেওয়ার চেষ্টা আমি করি যা যা তারা প্রাপ্য। যদিও অনেক কিছুই আমার পক্ষে দেওয়া হয়তো সম্ভব না।
মা কে ছাড়া আমাদের সংসার সেই সাথে আমার তিন সন্তান অরন্য, অনন্য আর লাবন্যকে নিয়ে আমাদের জীবন জীবনের নিয়মেই কেটে যাচ্ছে… আমার বিশ্বাস লাবণ্য একদিন অনেক বড় হবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমার যে জীবন ঈদসংখ্যা ২০২৩ জীবনস্মৃতি তাপসী দাস প্রবন্ধ সাহিত্য