দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন
২০ এপ্রিল ২০২৩ ২০:১৩
‘দিন হতে দিন আসে যে কঠিন, করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।’― মনীষী শাহ আবদুল করিম এখানে সমাজদ্রষ্টা, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সমাজের গভীর গভীরতর অসুখটি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। অসুখটি দেখার সক্ষমতা অর্জনের জন্য তাকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করে সমাজবিজ্ঞানী হওয়া লাগেনি, জল থৈথৈ হাওরের মাঝখানে বসে তার প্রজ্ঞা দিয়ে ধরতে পেরেছিলেন এই অসুখকে। উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন― সমাজ অচিরেই পথ হারাবে। তাই তার বিলাপ― ‘করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।’
এ কারণেই তাকে আমি বলি বাংলার মহান ‘লোকবুদ্ধিজীবী’। তার মতো বুদ্ধিজীবীরা হাওর-বাওড়েই থাকেন, অরণ্য-জঙ্গলেই থাকেন, পাহাড়-পর্বতে আর নিভৃত গ্রামেই থাকেন। সমাজের পালস বোঝার জন্য তাদের লাঁকা, দেরিদা, ফুকো, গ্রামসি পড়ার দরকার হয় না। এবং তারা চিরকাল উপেক্ষার শিকার হন। বড় বড় পুঁথিপুস্তক পড়া বুদ্ধিজীবীরা তাদের উপেক্ষা করেন, স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করেন।
তাদের মতো বুদ্ধিজীবদেরই দেওয়া দরকার ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রি। কিন্তু দেয়নি, দেবেও না। কেন? কারণ যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালান, তাদের মনোজগতে উপনিবেশ। তারা ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে এ দেশের জ্ঞানকে বিচার করেন। তারা ইউরোপীয় সমাজতত্ত্ব দিয়ে এ দেশের সমাজকে বিচার করেন। তারা যাদের পিএইচডি ডিগ্রি দেন, সেসব ডিগ্রি সমাজের কোনো কাজে লাগুক না লাগুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই। একটা বিষয় ঠিক করে দেবেন, ওই বিষয়ের ওপর মারিং-কাটিং করে কয়েকশ পৃষ্ঠা লিখলেই হলো। নিজে লিখতে না পারলে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেই হলো। নীলক্ষেত থেকে সেটা বাঁধাই করে জমা দিলেই হলো। ব্যস, পিএইচডি ডিগ্রি মিলে গেল। নামের আগে ‘ড.’ বসে গেল। ভালো একটা চাকরিও মিলে গেল। চাকরি আগে হওয়া থাকলে একটা প্রমোশনও পাওয়া গেল।
কণ্ঠশিল্পী মমতাজ ভারতের কোনো এক অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি ‘অর্জন’ করেছেন। এমন অখ্যাত অজ্ঞাত প্রতিষ্ঠান থেকে এই ডিগ্রি নেওয়া তার ঠিক হয়নি, স্বীকার করি। কিন্তু তাকে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি দিতে পারত। জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও দিতে পারত। কেন দেয়নি? এই জন্য যে― এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কাছে মমতাজ কেউ না, তার কোনো অস্তিত্বই নেই, তার কোনো অবদানই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে মমতাজের অবদান কোথায়? তার অবদানটা বোঝার জন্য সর্বপ্রথম যে কাজটা করতে হবে, তা হচ্ছে ইউরোপের জ্ঞানতত্ত্ব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত এই মাটিকে, এই সমাজের পালসকে বোঝা; যেমন বুঝেছিলেন লালন সাঁই, যেমন বুঝেছিলেন শাহ আবদুল করিম। তবেই বোঝা যাবে মমতাজের অবদান। নয়তো অসম্ভব।
আচ্ছা, গান দিয়ে কি সমাজ পরির্তন হয়? সংগীত দিয়ে কি মানুষের মনন গঠিত হয়? মানুষ তো গান গায় মনের সুখে, দুঃখে। গানের কী এমন শক্তি? এই প্রশ্ন মনে উদয় হলে মহামতি লালন সাঁইর গানগুলো ভালো করে শুনে দেখা যেতে পারে। উকিল মুন্সি, জালাল খাঁ, বিজয় সরকার, শাহ আবদুল করিম প্রমুখদের গানগুলো ভালো করে শোনা যেতে পারে। তারা শুধু প্রেম-বিরহের গানই রচেননি, গাননি; তারা তাদের গানের মধ্য দিয়ে একটা দর্শন প্রচার করেছেন। মানুষের মননকে বদলানোর দর্শন। তারা প্রচার করেছেন এক মানবতাবাদী দর্শন। খেয়াল করে দেখবেন, ইউরোপে মানবতাবাদ আসার বহু আগে এসেছে আমাদের এখানে, এই লোকবুদ্ধিজীবীদের হাত ধরে। সেই কত শতক আগে এই মাটির কবি চণ্ডীদাস গেয়ে উঠলেন― ‘সাবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।’ শ্রীচৈতন্য প্রচার করতে লাগলেন মানবতার বাণী। এই মাটির সন্তান হরিচাঁদ ঠাকুর প্রচলিত শাস্ত্রীয় ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেলন এক মানবিক ধর্ম― মতুয়া। পূর্ব-পশ্চিমের কোনো দর্শন না পড়া আরজ আলী মাতুব্বর গোটা সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন।
গানের মধ্য দিয়ে লোকবুদ্ধিজীবীরা কীভাবে মহৎ দর্শন প্রচার করেন, কীভাবে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেন, কীভাবে বঞ্চনার কথা বলেন, কীভাবে অধিকার-সচেতনতার কথা বলেন, কীভাবে দুর্নীতি-অন্যায় করতে ক্ষমতাবানদের নিরুৎসাহিত করেন― এসব বিষয় দেখার জন্য একটি গান পড়া যেতে পারে। গানটি ছত্তার পাগলার। নেত্রকোনার অখ্যাত লোকশিল্পী ছত্তার পাগলা। কোথাও তার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া কঠিন। তাকে নিয়ে ভালো একটি গবেষণা-প্রবন্ধ লেখা হয়নি আজও। কিন্তু তার গানটি একবার পড়ে দেখুন―
‘কাঙাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে
গুনা অইবো তোর
আমি লালচাপুরের ছত্তার পাগল
বাড়ি নউল্যার চর,
কাঙাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে
গুনা অইবো তোর।
ছত্তার গেছিন মাডি কাটত
ধেনু গাঙের চর
দেইখ্যা আইছে গম দিতাছে
চেয়ারম্যান আর মেম্বর।
ভাইরে, হাজার হাজার মাডি চুরি
দেইখ্যা দাঁতে কড়মড়
গায়ে উঠল জ্বর
কাঙাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে
গুনা অইবো তোর।
রেডিওতে হুনছি আমি
টেলিশনে দেখছি আমি
কেউ না আপন মোর
কাঙাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে
গুনা অইবো তোর।’
কবি শাহেদ কায়েসকে প্রায়ই বলি, চলেন শাহেদ ভাই, আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ি। সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। কালচারাল ইউনিভার্সিটি। সরকারের কাছে অনুমোদন চাইব। অনুমোদন না দিলে ফান্ড রেইজ করব। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই দেখা যাবে লালন সাঁইয়ের বিশাল একটি ভাস্কর্য। হলগুলোর নাম হবে লালন, হাছন, রাধারমণ, আরজ আলী মাতুব্বর, বিজয় সরকার, উকিল মুন্সি, জালাল খাঁ, ছত্তার পাগলার নামে। সুদূর গ্রাম থেকে আসা ছত্তার পাগলার মতো কোনো এক কবিয়াল, কোনো এক গায়েন, কোনো এক বয়াতি সেখানে মাঝেমধ্যে ক্লাস নেবেন। ক্লাস নেবেন সাইদুর রহমান বয়াতি, শিল্পী মমতাজ, কুদ্দুস বয়াতি, কাঙ্গালিনী সুফিয়া, রীতা দেওয়ান প্রমুখ।
এরা কেন? এদের কেন ক্লাস নিতে দেওয়া হবে? এরা সংস্কৃতির কী বোঝে? তারা কী বোঝে, তা বোঝার জন্য এই বাংলাকে বোঝা দরকার, এই বঙ্গীয় সমাজের পালসকে বোঝা দরকার, এই সমাজের গভীর গভীরতর ক্ষতটাকে বোঝা দরকার। আমরা তো এই শহরে বসে বড় বড় উপন্যাস লিখি, অনেক অনেক কবিতার বই লিখি, গানও লিখি বিস্তর। নাকটও মঞ্চস্থ করে যাচ্ছি অনেক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা গণমানুষের কাছে কতটা পৌঁছাচ্ছে? বলবেন, পৌঁছাতে হবে কেন? আমরা শিল্পের জন্য শিল্প করি। মানুষ এই শিল্পকে খুঁজে নেবে। খুঁজে নেওয়া তার দায়। শিল্প সবার জন্য নয়।
এই যে আমাদের উন্নাসিকতা, এই যে শিল্পকে চাঙ্গের ওপর তুলে রাখা― এর ফলাফল কী হয়েছে জানেন? গোটা সমাজটা চলে গেছে কুপমণ্ডুকদের দখলে। কুপমণ্ডুক কারা, তা সবাই জানেন, সবাই তাদের চেনেন।
অপরপক্ষে, ওপরে যাদের নামোল্লেখ করা হলো― সেসব কবিয়াল, গায়েন, বয়াতি― তারা শিল্পকে চাঙ্গে তুলে রাখেননি, পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরে তুলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখেননি। শিল্পকে তারা গণমানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। যেমন বিলিয়ে দিয়েছিলেন লালন, বিজয়, করিম প্রমুখ। লালনের গুরুত্ব কোথায়? কিংবা তার পরবর্তী ‘লোকবুদ্ধিজীবীদের’ অবদান কোথায়? এইখানে যে, তারা হচ্ছেন এই দেশের মানুষের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়। গানের মধ্য দিয়ে খুব সফটলি তারা মানুষের বদ্ধ বুদ্ধিকে আঘাত করেন। সেই আঘাতে মানুষের বুদ্ধির বদ্ধ কক্ষটির দুয়ার খুলে যায়। সেই দুয়ার দিয়ে বুদ্ধি বেরিয়ে আসে। হাঁটতে শুরু করে মুক্তির পানে। বিশাল বিশাল বই পড়া নগরের বুদ্ধিজীবীরা সমাজের ক্ষতের ওপরে প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব লোকবুদ্ধিজীবীরা সেই ক্ষতের মূলে চিকিৎসা করেন, রোগটাকে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা করেন। এ কারণে এ দেশের সমাজটা এখনো পর্যন্ত উগ্রতার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়নি।
আমাদের কল্পিত সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির বিষয়ও হবে এই বাংলার বৃহত্তর সমাজ, এই সমাজের সংস্কৃতি। ছাত্ররা ছত্তার পাগলাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গবেষণা করবে। তাদের চিন্তা-চেতনাকে তুলে আনবে। রেখে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমাদের কল্পিত সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি পাবেন তারা, যারা গণমানুষের মধ্যে থেকে গণমানুষের মনন পরিবর্তনে কাজ করছেন। যেমন― ধরুন মো. জসিম উদ্দিন। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। নিজেকে তিনি ‘অশিক্ষিত’ দাবি করেন। পেশায় তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি। থাকেন গ্রামে, কুষ্টিয়ার খোকসায়। তিনি নিজেকে ভিখারিও দাবি করেন। কীসের ভিখেরি? টাকা নয়, বইয়ের ভিখারি। নিজের আয় থেকে বই কেনেন এবং বই ভিক্ষাও করেন। সেসব বই দিয়ে তিনি একটি লাইব্রেরি পরিচালনা করেন― খোকসা কমিউনিটি লাইব্রেরি। ফেসবুকে তিনি আমার বন্ধু। আমি তার জ্ঞানতৎপরতা দেখি। মানুষের বুদ্ধির মুক্তি ঘটানোর জন্য তার আকুতি দেখি। দেখি আর শ্রদ্ধায় নত হই।
মানুষের বুদ্ধির মুক্তি ঘটনানোর জন্য জসিম কিংবা তার মতো গ্রামে বসে আরও যারা কাজ করছেন, কেন তারা রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হবেন না? কেন তারা পুরস্কৃত হবেন না? কেন তারা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করবেন না? বাংলাদেশের সমাজ আজ যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এই তলানিতে থেকে সমাজকে উদ্ধার করার জন্য পশ্চিমের জ্ঞান দিয়ে হবে না। লাঁকা, দেরিদা, ফুকো, গ্রামসি দিয়ে হবে না। তাদের জ্ঞানের ধারক-বাহকদের দিয়ে, যারা বলেন― ‘ইংরেজি শিক্ষার শিক্ষকদের চেয়ে মাদরাসার শিক্ষকরা মেধাবী’― তাদের দিয়েও হবে না। হবে জসিমদের মতো মানুষদের দিয়েই। তারাই বর্তমানের আলোকবর্তিকা। তারাই জ্বালিয়ে রেখেছেন জ্ঞানের প্রদীপ। যে কাজটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হওয়ার কথা, সেই কাজটি তারা করছেন। আর হবে সেসব লোকবুদ্ধিজীবীদের প্রচারিত গানের দ্বারা, গানের মধ্য দিয়ে তাদের প্রচারিত দর্শনের দ্বারা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ দিন হতে দিন আসে যে কঠিন নিবন্ধ সাহিত্য স্বকৃত নোমান