পুরনো পাপ
২১ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৪৩
১.
সত্যি, নারকীয় ঘটনা বটে! একে একে পাচ-পাঁচটি লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। নাহ, ঠিক পাঁচটা নয়, তিনটে লাশ, আর দুজন তখনও বেঁচে। তার একজন অবশ্য হাসপাতালে নিতে নিতেই পরপারে পাড়ি জমালো, আরেকজনের তখনও শ্বাস পড়ছে, কিন্তু কতক্ষণ টিকবে বলা কঠিন।
বলছি সিলেটের কথা। ডিটেকটিভ অলোকেশ রয় ঘটনাচক্রে তখন সিলেটেই অবস্থান করছেন। সঙ্গে তার দুই সহযোগী আর্কিটেক্ট উর্বী বোস এবং রিপোর্টার আসিফ ইমরুল ওরফে ইমু।
এটা খুন নাকি অপঘাত, তা জানবার আগে চলুন ভিকটিমদের সঙ্গে খানিক আলাপ-পরিচয় সেরে আসি। এমন পৈশাচিক ঘটনা তো আর নিত্য নিত্য ঘটে না। রীতিমতো রোমহর্ষক কেস। এমন ঘটনার কথা শুনলে শুধু মাথার চুল নয়, চোখের পাতাও দাঁড়িয়ে যায়।
গেল হপ্তায় লন্ডনপ্রবাসী ব্যবসায়ী আবু আলম দেশে ফিরলো। সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। আবু আলম সেখানে রেস্তোরাঁর ব্যবসা করে। বলতে নেই, খানাদানার বিজনেস সে বেশ জমিয়ে ফেলেছে। লন্ডন শহরের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হোয়াইট চ্যাপেল ও ব্রিক লেনে তার তিনখানা রেস্তোরাঁ আছে। ছেলেপুলে নিয়ে সে নিজেই সেসব দেখাশোনা করত। বলা বাহুল্য, আবু আলমের ছেলেরা সোমত্ত এখন। দুজনের বয়স বাইশের উপরে। বড় ছেলে খিজিরের জন্ম বাংলাদেশে, আর ছোটটা, যার নাম নাজির, সে বিলেতেই জন্মেছে।
আবু আলমের সন্তানদের মধ্যে মেয়ে ময়না সবার ছোটো। বয়স আঠারো। দেখতে শুনতে মন্দ নয়, তবে পড়াশুনোটা তার ধাতে নেই। পড়ালেখা করতে ময়নার ভাল লাগে না। অন্যদের দেখাদেখি ওখানে কিছুদিন চেষ্টা সে করেছিল অবশ্য, কিন্তু হয়নি। অগত্যা আবু আলম তার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিল। সেই উদ্দেশ্যেই মূলত তার দেশে আসা। ভেবেছিল, দেখেশুনে ভাল কোনও ছেলে পেলে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে। বিয়ের পর মেয়ের স্বামীকে লন্ডন নিয়ে গিয়ে রেস্তোরাঁর কাজে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু বিধি বাম! সেসব কিছু তো হলই না, উল্টো দীর্ঘদিন পর দেশে এসে বেঘোরে প্রাণটা হারালো আবু আলম! একা নয়, সপরিবার।
ওহ, আরও দুটো তথ্য এখানে দিয়ে রাখা ভাল। আবু আলমের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি, তার স্ত্রীর নাম রোজিনা। স্বামীর সঙ্গে তার বয়সের ফারাক বেশ। অন্তত পনেরো বছর। ভূমিকা অনেক হল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। কী করে এমন অঘটন ঘটলো, তা জানতেই জনতা বেশি আগ্রহী।
সিলেট নগরীর মধুবন এলাকায় আবু আলমের সুপরিসর বাড়ি ছিল একখানা। ছিল বলছি এইজন্যে যে, আবু আলম আর বেঁচে নেই। সে এখন ওই দূর আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেছে। ভিনদেশি তারা! সে এখন আমাদের সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
লন্ডন থেকে ফিরে মধুবনের এই বাড়িতেই এসে উঠেছিল আবু আলম। সপরিবার। কটা দিন একসঙ্গে কাটাবে বলে আবু আলম তার ভাই-ভাতিজার পরিবার, আর তার শ্বশুরপক্ষকেও ডেকে নিয়েছিল। দোতলা বাড়িতে অনেকগুলো রুম খালি পড়ে আছে। আবু আলমের ডাকে সাড়া দিয়ে যে যার পছন্দমতো রুম বেছে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকছিল সবাই। বাড়ির চারপাশে অনেকটা জায়গা, গাড়ি বারান্দা, টানা লন, আছে বাগানও। বেশ রুচিশীল ও আরামদায়ক বাড়ি বলতে হবে। টাকা থাকলেই সবার ভাল থাকা হয় না। রুচি ও ভাগ্য লাগে।
গেল রাতে বাইরে থেকে খাবার এসেছিল। আবু আলম নিজে যদিও একজন নামজাদা শেফ, কিন্তু দেশে ফিরে আর নিজের হাতে রান্না করতে মন চায়নি। তাই একেকদিন একেকজন রান্না করত। তাছাড়া সিলেটি রেস্তোরাঁ থেকেও খাবার আসত। কাল রাতেও এসেছিল। আর তাই খেয়েই!
মানেটা এই পুলিশ অনুমান করছে, খাদ্যে বিষক্রিয়া থেকেই মরেছে আবু আলম। প্রায় সপরিবারে। বন্ধুর দাওয়াতে সপারিষদ সিলেট এসেছিলেন গোয়েন্দা অলোকেশ রয়। কোতোয়ালি থানার ওসির সঙ্গে তার পূর্বপরিচয় ছিল। অলোকেশ এই শহরেই আছেন জেনে ইন্সপেক্টর জানে আলম অলোকের উপস্থিতি প্রার্থনা করেছেন। কেসটা আগাগোড়া জটিল, তাই তিনি এসে যদি একটু মাথা গলান তাহলে বেশ হয়। কে না জানে, টু ইজ বেটার দ্যান ওয়ান!
কিন্তু প্রবলেম যেটা হয়েছে অলোকেশ আসলে ঘটনার স্পট বা অকুস্থল দেখবার ফুসরত পাননি। তার আগেই আবু আলমসহ উজির-নাজির (থুক্কু উজির নয়, খিজির হবে) সকলের লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেষ্টা-চরিত্র করে যদি বাঁচানো যায় সেই ভরসায়।
ডিউটি-ডক্টর চেষ্টার কিছু ত্রুটি করেননি, কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না। লন্ডনপ্রবাসী আবু আলম রাতেই মারা গেল। সঙ্গে তার স্ত্রী রোজিনা, মেয়ে ময়না আর ছোটো ছেলে নাজিরও আর বাঁচলো না। তাদের লাশ হিমঘরে রাখা আছে। জীবনের উত্তাপ হারিয়ে ওরা এখন খুব ঠান্ডা। অ্যাজ কোল্ড অ্যাজ আইস-কিউব। তখনও বেঁচে ছিল শুধু একজন আবু আলমের বড় ছেলে খিজির, যে কিনা বাংলাদেশে জন্মেছিল।
কী ভাবছেন, ভাই জানে আলম? অপমৃত্যু, নাকি? কেজো গলায় বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।
সাথে সাথে কিছু বললেন না ইন্সপেক্টর জানে আলম। তিনি ভাবছেন। তার কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ।
বিষক্রিয়া, তাই তো? খাবারে! আগবাড়িয়ে বললেন অলোকেশ। কেননা, তিনি ইতোমধ্যে এটুকু তথ্য জানতে পেরেছেন। উপস্থিত আবু আলমের নিকটাত্মীয়দের কানাঘুষোয় যতটা জানা যায়। বাইরের খাবার খেয়েই নাকি তারা সব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর ভাবনার খোয়াই ভেঙে সচকিত হন ইন্সপেক্টর জানে আলম। শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠে বললেন, তাইতো শুনেছি, ডিটেকটিভ। খাবারে বিষক্রিয়া।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন? রিপোর্ট কী বলছে? টু-দ্য পয়েন্ট প্রশ্ন করলেন অলোকেশ রয়। উর্বী ও ইমরুল পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে। ইমরুল ওর নোটবুক বের করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি নোট করবার প্রস্তুতি নেয়।
নাথিং স্পেশাল। ময়নাতদন্ত রিপোর্টেও ওই আমরা যা ভাবছি তাই লেখা আছে।
কী?
বিষক্রিয়া! মাথা নেড়ে বললেন ইন্সপেক্টর জানে আলম।
ওহ্! তাহলে তো মিটেই গেল। ইটস জাস্ট অ্যা মিসহ্যাপ। আচমকা বিপদ যাকে বলে। বিপদ তো আর কাউকে বলেকয়ে আসে না। আচমকা এসে যায়। বয়ান বিশদ করলেন অলোকেশ রয়। অনেকটা নিরাসক্ত ভাবে ও কণ্ঠে।
উর্বী কিছুটা নিরাশ হয়। তার মানে এই কেসে মাথা ঘামানোর কিচ্ছু নেই! স্রেফ অপঘাত! ইমরুল মাথা চুলকায়। সে বুঝতে পারে না, এই বাড়িতে আবু আলমের পরিবার ছাড়াও আরও অনেকে ছিল। মোট চারটে পরিবার। বাকিদের কারও কিছু হল না, শুধু আবু আলম!
ইন্সপেক্টর জানে আলম আবারও নৈশব্দ্য ভাঙলেন। কষা গলায় বললেন, কেসটা বোধ হয় ততসহজ নয় যেমনটা ভাবছেন ডিটেকটিভ। বাইরে থেকে আনা একই খাবার, খেলও সবাই। অথচ মারা গেল কেবল আবু আলমের পরিবার! ভাই-ভাতিজা, কাজের বুয়া, মালি বা শ্বশুরপক্ষের কেউ মারা গেল না। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক নয়!
জানে আলমের কথার মর্মার্থ বুঝতে অলোকের মোটেও অসুবিধা হয় না। তিনি শুধু হুঁসূচক শব্দ করে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে যান। যেতে যেতে বললেন, জাস্ট ওয়েট, আমি একটু ডিউটি ডক্টরের সঙ্গে কথা বলে আসছি। উর্বী, তোমরাও থাকো।
আবু আলমের পরিবারের চারজন ডেড। বেঁচে আছে শুধু তার বড় ছেলে খিজির। তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। তার অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। শ্বাসটুকু পড়ছে, এই যা!
ডক্টর?
বলুন।
পেশেন্টের অবস্থা কেমন?
ভাল নয়, মানে স্টেবল নয় একদম। মাথা নাড়লেন ডক্টর।
অর্থাৎ আবু আলমের ছেলে খিজির শঙ্কামুক্ত নয় বলছেন?
একেবারেই নয়। যে বিষের আক্রমণ হয়েছে তা বেশ খতরনাক। কয়েকবার ওয়াশ-আউট করেও তাকে স্টেবল করা যায়নি।
কী রকম বিষ? যদ্দূর জানি, খাবারে বিষক্রিয়া হয় ব্যাক্টেরিয়াল টক্সিনের কারণে। মামুলি আক্রমণ শরীর সামলে নেয়, তবে আক্রমণ বেশি হলে সেক্ষেত্রে রোগী মারাও যেতে পারে। বিষটা আসলে কী একটু বলবেন প্লিজ? ফের জানতে চান অলোকেশ।
জানি না স্যার। টক্সিকলোজিস্ট এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন। এড়িয়ে গেলেন ডক্টর। তিনি বয়সে তরুণ হলেও বেশ বুদ্ধি রাখেন বোঝা যায়। এসব থানা-পুলিশ জেরাফেরা কীভাবে সামাল দিতে হয় ভালই জানেন তিনি।
যেটুকু জানার জানলেন অলোকেশ। শুধু বুঝতে পারছেন না, কী এমন খতরনাক বিষ, যা কিনা স্রেফ ফুড পয়জনিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হল, আর তার ফলস্বরূপ চার-চারটা মানুষ এক রাতে টেঁসে গেল! নাকি বাইরে থেকে বিষ প্রবেশ করেছে শরীরে! খাবারের মাধ্যমে!
ভাবছেন অলোকেশ। এমন তীব্র বিষক্রিয়ার খবর খুব একটা শোনা যায় না। মদটদ গিলে বা রেক্টিফায়েড স্পিরিট পান করে অনেক সময় নিচুতলার মানুষ মারা পড়ে। তাই বলে দীর্ঘদিন বাদে দেশে বেড়াতে এসে বিলেতফেরত নামি রসুইঅলা আবু আলম পরিবারসমেত মারা যাবেন কেন!
কেসটা স্রেফ অ্যাকসিডেন্ট, নাকি বুঝেশুনে কেউ! ভাবনাটা আপাতত মুলতুবি রাখেন তিনি। একই পরিবারের চারজন মানুষ ডেড, আরও একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ভাবা যায়!
২.
লাশের সুরতহাল প্রস্তুত। আবু আলম বা মৃত কারও শরীরে কোনওরকম আঘাতের চিহ্ন নেই, না কোনও চাকা চাকা দাগ, অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনেরও কোনও নাম-নিশানা নেই। পিএম রিপোর্ট বলছে বিষের কারণে মৃত্যু। ডিটেকটিভ অলোকেশ আপাতত কিছু বলছেন না। তবে তার মনে প্রশ্ন আছে। আবু আলম ও তার পরিবারের মৃত্যুর কারণ ফুড পয়জনিং নাকি বিষাক্ত কিছুর অনুপ্রবেশের ফল, সেটা তাকে জানতে হবে। আর তার জন্য চাই ভিকটিমরা রাতে যে খাবার খেয়েছে তার কেমিক্যাল পরীক্ষা বা ল্যাবটেস্ট।
ব্যাপারটা তিনি ইন্সপেক্টর জানে আলমের সঙ্গে শেয়ার করলেন। বললেন যে, সেই খাবারের কেমিক্যাল টেস্ট মাস্ট। ওটা কিন্তু করাতেই হবে।
হয়ে যাবে। মাথা নাড়লেন জানে আলম।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা মধুবনের উদ্দেশ্যে রওনা হন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। আবু আলমের বাংলোটাইপ বাড়ি। সাজানো গোছানো, বেশ সুন্দর দেখতে। কেস যেমনই হোক, জেরাটা বাদ দেওয়া চলবে না। গোয়েন্দাগিরির দুটো জিনিস বেশ ভালই রপ্ত করেছেন অলোকেশ। একজিজ্ঞাসা। চোখের এবং মুখের। অর্থাৎ চোখ দিয়ে দেখতে হবে, আর যতটা পারা যায় জেরা করতে হবে।
দুই নম্বর তরিকা হল ইনটুইশন বা ধী-শক্তির প্রয়োগ। সবসময় মগজ গলিয়ে কাজ হয় না, তখন চাই তৃতীয় নয়ন বা সিথ সেন্সের সঠিক ব্যবহার। বাড়িতে ঢোকার মুখে বাগানের মালি মোজা মিঞার সঙ্গে দেখা। তার বয়স খুব বেশি নয়, আবু আলমের ছেলে উজির-নাজিরের মতোই হবে। কুড়ি বা বাইশ। সে বাগানে আগাছা পরিষ্কার করছিল। তার চোখেমুখে মৌনীভাব বিরাজমান।
মোজা মিঞা বাইরের লোক। এখনই তাকে জেরা করবার যুক্তি নেই।
প্রথমেই আবু আলমের শ্বশুরকে পাকড়াও করলেন অলোকেশ। নোট নেবার জন্য ইমরুল প্রস্তুত। উর্বী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। এই কেসে সে যেন ঠিক তাল পাচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে এতে মশলা আছে, আবার মনে হচ্ছে নেই।
বলুন শ্বশুরমশাই, কেসটা কী করে ঘটলো?
কোনও কেস? বাচ্চাদের মতো টালুক টুলুক চোখে তাকায় বুড়ো লোকটা।
ওই যে, আপনার মেয়ে-জামাই মারা গেল? নাতি-নাতনি! আপনারা তো কেউ মরেননি!
তাতে বেজায় হকচকিয়ে যান আবু আলমের শ্বশুর লোকমান। রেগেও গেলেন বুঝি। খেঁকুরে গলায় বললেন, কেন, আমরা মারলেও খুব ভাল হত বুঝি! চার মরণে খুশি হননি, আরও চাই?
লজ্জা পেলেন অলোকেশ। নিজেকে শুধরে নিয়ে বললেন, না মানে আমি ঘটনার আগাপাশতলা একটু জানতে চাই।
কেন, আপনি জানবেন কেন! কে আপনি? আপনি কে? রীতিমত খেপচুরিয়াস লোকমান সাহেব।
মেজাজ হারান না অলোকেশ। মুচকি হেসে বললেন, আমি পুলিশ নই, তবে পুলিশের লোক। আই মিন, ইন্সপেক্টর জানে আলম আমার বেশ কাছের মানুষ। কাজেরও। আমরা মিলেমিশে কাজ করি, বুঝলেন!
একটু থেমে আবার বললেন, নিন, বলুন এবার। একই খাবার খেলেন আপনারা। মেয়ে-জামাই মরল, কিন্তু শ্বশুর লোকমান দিব্যি বেঁচে আছে! ব্যাপারটা অবাক করার মতোন না?
জানি না সংক্ষেপে বললেন লোকমান। মানে তার রাগ তখনও পড়েনি। পড়ার কথাও নয়। উর্বী অলোকের দিকে শাসানির চোখে তাকায়। যেন বলতে চায়, এই বুঝি জেরা করবার কোনও তরিকা হল!
খাবার কোত্থেকে এল? জানেন কিছু?
জানি। জানবো না কেন? আমিই খাবারের অর্ডার করেছিলাম। লোকমান বললেন।
কোনও হোটেল? কে দিয়ে গেছে খাবার? ফের জানতে চান অলোকেশ।
জিন্দাবাজারের অমৃতব্যঞ্জন হোটেল। ওখানকারই কোনও ছেলে-ছোকরা খাবার দিয়ে গেছিল। নাম মনে নেই। তবে তার চেহারা দেখলে চিনতে পারব। কষা গলায় বললেন হতভাগ্য আবু আলমের শ্বশুর।
পাশেই দাঁড়িয়েছিল আবু আলমের ভাতিজা রুহুল। রুহুল ক্লাস টেনের ছাত্র। এখনও সেভাবে গোঁফদাড়ি ওঠেনি। আবার মাকুন্দাও হতে পারে। দেখে তার বয়স বোঝা যায় না।
রুহুল!
যে আজ্ঞে।
কেসটা ঠিক কী ছিল? লোকমান সাহেব যা বলছেন তা ঠিক? অলোকেশ জানতে চান। তাতে গনগনে চোখে তার দিকে তাকান আবু আলমের শ্বশুর লোকমান। পুলিশের পাশর্^চর লোকটা তাকে মিথ্যাবাদী ঠাওরালো!
মাথা নাড়লো মাকুন্দা রুহুল। অর্থাৎ লোকমান সাহেব ঠিকই বলেছেন। কেসটা এমনই ঘটেছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তোমরা সকলে একই খবাার খেলে, অথচ আবু আলম ও তার পরিবার মরল, তোমরা সবাই বেঁচে গেলে। বিশ্বাস করা কঠিন বৈকি! স্বগতোক্তির মতো করে বললেন অলোকেশ। নাকি আবু আলম আগেই বাইরে থেকে কিছু খেয়ে এসেছিল! যার অনিবার্য ফল মৃত্যু! কিন্তু তাই বলে সবাই মিলে মরবে! ছেলে-বুড়ো রেয়াত করবে না! উহুঁ, কেসটা কেমন যেন জটিল হয়ে উঠেছে!
উর্বী ও ইমরুলের সঙ্গে পরামর্শ করলেন অলোকেশ। এখন কী করা উচিত বলে মনে করো তোমরা?
উর্বী চিন্তিত। অদ্ভুত চোখ করে তাকায় ইমরুল। সে বলপেনের পশ্চাতে দাঁত ঘষে। বদঅভ্যেস একটা!
চলো, আমরা বরং জিন্দাবাজার যাই। হোটেল অমৃতব্যঞ্জন। আহা, এই জিন্দাবাজারের খাবার খেয়েই বেচারা লন্ডনপ্রবাসী আবু আলম মুর্দাঘরে জায়গা নিল! আপসোস কি বাত!
বেরিয়ে যান অলোকেশ। যাবেন যে, যাবেন কীসে? এখানে তো তার বন্ধুর গাড়ি নেই বা উর্বীর সেই পিংকরঙ মোপেডও নেই। অগত্যা মনুষ্যচালিত ত্রিচক্রযান রিকশাই ভরসা। মাত্র কয়েক মাইল দূরত্বে জিন্দাবাজার, ভাড়া হাঁকছে আশি! ব্যাটা পাগল না পেটখারাপ!
উর্বী বলল, নাও ওঠো। এখানকার রিকশাভাড়া এমনই। সবাই ভাবে তারা লন্ডনে বসে দেদারসে পাউন্ড কামাচ্ছে। সিলেটে সবকিছুই কস্টলি।
তাই বলে আশি! ইটস টু মাচ! এদেশে সব্বাই দুর্নীতিবাজ। যে যেভাবে পারছে লোকের গাঁট কাটছে। রাগে গজগজ করেন অলোকেশ। কুড়ি টাকার ভাড়া আশি! বললেই হল! টাকা যেন গাছে ধরে!
অমৃতব্যঞ্জনে গিয়ে দেখেন ইন্সপেক্টর জানে আলম অলরেডি সেখানে হাজির। তবে তার উদ্দেশ্য অন্য। তিনি এসেছেন খেতে, আর অলোকেশ জেরা করবেন।
কই, সেই ছেলেটা কই? কে গিয়েছিল আবু আলমের মধুবনে খাবার পৌঁছে দিতে!
ক্যাশবাক্সের পেছনে বসা আধবুড়ো ম্যানেজার কিছু মনে করতে পারছে না। তাতে বেশ বিরক্ত হন অলোকেশ। আজ যেন খানিকটা অধৈর্য তিনি। সত্যি বলতে, আবু আলমের খচুরে শ্বশুরটা তার মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
কে গিয়েছিল?
জানি না সাব। মনে করতে পারছি না।
আপনি ম্যানেজার, নাকি ড্যামেজার! আশ্চর্য! একদিন আগের ঘটনা মনে রাখতে পারেন না! বেশ শব্দ করেই বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।
ম্যানেজার চুপ।
আপনি জানেন, আপনার হোটেলের খাবার খেয়ে চার-চারটা মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে! ছেলেটাকে ডাকুন, নইলে! ইশারায় ভোজনরত ইন্সপেক্টর জানে আলমকে দেখালেন তিনি।
অবশেষে একজন এল। নেহাতই ছেলেমানুষ। দাঁত কেলিয়ে বুক ঠুকে সে বলল, জি সাব, আমি টোকন। আমিই গেছিলাম লোকমান স্যারের বাসায় খাবার নিয়া। কী সুন্দর সাজাইন্যা বাড়ি! কত্ত জায়গা-জমিন! খুব ভাল বাড়ি স্যার। আইজ আবারও খাওন লাগবো নাকি? মক্কা বিরিয়ানি?
যা বোঝার বুঝে গেছেন অলোকেশ। এই ছেলে বড় কোনও অভিনেতা নয়। সে ভনিতা জানে না। টোকনের পক্ষে আর যাই হোক, কৌশল মানুষ মারা সম্ভব না। রণেভঙ্গ দিলেন তিনি। বললেন, চলো উর্বী, আপাতত ডেরায় ফিরে যাই। বিকেলে আবার বেরোবো।
যাবার আগে তিনি অমৃতব্যঞ্জন হোটেলের কেবলাকান্ত ম্যানেজার ফয়জুলের মুঠোফোন নম্বর চেয়ে নেন। পরে কখনও কাজে আসতে পারে।
৩.
কয়েকটা ব্যাপার মাথায় নিয়ে ঘুরছেন অলোকেশ।
প্রশ্ন এক আবু আলম ও তার পরিবার সত্যিই কি কারও ষড়যন্ত্রের শিকার? হতেই পারে। নইলে তার পরিবারের সবাই কেন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবে? ব্যাক্টেরিয়াল টক্সিন কি এতটাই শক্তিশালী?
প্রশ্ন দুই আবু আলম ও তার ছেলেদের অনুপস্থিতিতে কে সবচে বেশি লাভবান হবে? কীভাবে? ভাই-ভাতিজা? নাকি শ্বশুর! ভাতিজা রুহুলের সঙ্গে কথা হল। তার বাপ আফসারের সঙ্গে হয়নি। ধরা যাক, আবু আলম কাউকে তার সহায়-সম্পত্তি লিখে দিয়ে যায়নি। সেক্ষেত্রে লন্ডনের রেস্তোরাঁ কে পাবে সে-কথা না হয় তোলা থাক। মধুবনের এই সুন্দর সুরম্য বাড়িটার মালিকানা পাবে কে? রুহুল ও তার বাপ আফসার নিশ্চয়ই। মধুবন কম টাকার সম্পত্তি নয়। অন্তত পঞ্চাশ কোটি। বেশিও হতে পারে।
প্রশ্ন তিন রুহুলের বাপ আফসার যদি আবু আলমকে সপরিবার খুনই করবে, সেক্ষেত্রে নিজবাড়ি মধুবনে কেন? অন্য কোথাও বা অন্য কোনওভাবেও করতে পারত। যেভাবে ওরা মরেছে, তাতে আফসারের উপরে দোষ কিন্তু আসবেই। কারণ পাশের ঘরে আফসার তার ছেলে রুহুল ও স্ত্রীসমেত মজুত ছিল।
আচ্ছা, পুরো কেসটা আবার নিছক দুর্ঘটনা নয় তো! অলোক হয়তো মিছেই ভেবে ভেবে মাথা গরম করছেন! এমন ধারণা উর্বীরও যে হয়নি তা নয়। মানুষ কি ফুড পয়জনিংয়ে মারা যায় না!
কিন্তু!
কীসের কিন্তু, অলোক? উর্বীর প্রশ্ন।
আমার ইনটুইশন বলছে এখানে কেচ্ছা বা কাহিনী আছে। এটা স্রেফ দুর্ঘটনা নয়। ডাল মে কুছ কালা হ্যয়।
উর্বী চুপ মেরে যায়। অলোকের ইনটুইশনের উপরে কোনও কথা চলে না। হিজ নেভার প্রুভড রঙ! এ ব্যাপারে তিনি এডগার অ্যালান পোর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বসে আছেন। পো ভাবতেন, কখনও কখনও ঐশ্বরিক কোনও ইশারা বা ইঙ্গিত এসে পুরো কেসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে যায়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কফির তেষ্টা পেলো অলোকের। উর্বী চাফি খাবে, সবসময় যেমন খায়। চা প্লাস কফি। ইমরুলের চা-কফি দুটোই চলে। তবে সে সিলেটে এসে আর কফি খেতে চায় না। চা-ই হোক। চায়ের শহর সিলেট।
উর্বী চা-কফির এন্তেজাম করতে যাবে, সহসাই ইন্সপেক্টর জানে আলমের ফোন। আসুন না, জলদি আসুন, ডিটেকটিভ। জরুরি কথা আছে। সেই সঙ্গে জম্পেশ কফিও খাবেন। আমি জানি আপনি কফিকোহলিক।
জরুরি ডাক। উপেক্ষা করা সমীচীন হবে না ভেবে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সপারিষদ। কোতোয়ালি থানায় গিয়ে শোনেন, আর কেউ নয়, আবু আলমের শ্বশুর লোকমান সাহেব নাকি মামলা করেছেন। অপমৃত্যু নয়, খুনের মামলা!
তাই নাকি! খুন! বলেন কি, জানে আলম? বিস্মিত অলোকেশ। লোকমান সাহেব কী করে নিশ্চিত হল যে এটা খুনের কেস?
আমি ভাই জানতাম এমনই কিছু হবে। চার-চারটা মৃত্যু। কম নয়! জানে আলম মাথা নেড়ে বললেন।
উর্বী মৃদু হেসে বলল, জানে আলম জানবে না, তাই কি হয়!
ওর কথায় শ্লেষ মাখানো ছিল, ইন্সপেক্টর সাহেব তা ধরতে পারলেন না। দিলখোলা মাথা ভারী মানুষ কি না। অত প্যাঁচঘোচের ধার ধারেন না তিনি।
তা বিবাদী কাকে করেছে? আই মিন খুনি কে? এনি সাসপেক্টস?
নাথিং মানে কেউ না। লোকমান সাহেব ধারণা করছেন এই ঘটনার পেছনে কারও অদৃশ্য হাত আছে। কিন্তু তাকে তিনি চেনেন না বা জানেন না। পুলিশের কাজ তাকে খুঁজে বের করা। করতে হবে। তিনি তার জামাই-মেয়ে ও নাতি-নাতনির হত্যার বিচার চান।
না পারলে বা না ধরলে? ঈষৎ হালকাচালে কথাটা বললেন অলোকেশ রয়।
খুনি ধরতে না পারলে তিনি নাকি ব্রিটিশ হাইকমিশারের কাছে গিয়ে নালিশ করবেন। তার মেয়ে-জামাই ও নাতিরা ব্রিটিশ সিটিজেন। মেরুন রঙের পাসপোর্টধারী বিশিষ্টজন। হাইকমিশন নিশ্চয়ই কিছু করবে। প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন তারা।
হো হো করে একচোট হাসলেন অলোকেশ। দুদিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন! বাংলাদেশের এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই। কে কী বলল, হাঁচি বা কাশি দিল, সেসব শুনে চলার দিন শেষ। আমরা এখন নিজের পায়ে চলি, নিজের খাবার খাই। আমরা কারও কাছে হাত পাতি না। গর্বের পদ্মাসেতুই তার প্রমাণ।
ইন্সপেক্টর জানে আলম কিন্তু সত্যিই চাপবোধ করছেন। বললেন, আপনি তো ভাই বসন্তের কোকিল। মনের আনন্দে অনুসন্ধান করেন। না করলেও কিছু ক্ষতি নেই। মন না বসলে উড়ে পালাবেন। কিন্তু আমি! আমার কী হবে?
কী! আমি পালাই? পালিয়ে যাব! কভি নেহি। আমার অভিধানে ব্যর্থতা বলে কোনও শব্দ নেই, ইন্সপেক্টর। এই কেসে হাত যখন লাগিয়েছি, আবু আলম ও তার পরিবার সত্যি সত্যি খুন হয়ে থাকলে খুনিকে আমি ধরবোই। ইট্স অ্যা প্রমিস!
অলেকের কথায় আশ্বস্ত হন ইন্সপেক্টর। বললেন, অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনি সঙ্গে আছেন জেনে খুশি হলাম। বলুন এখন কী করা যায়!
তেমন কিছুই না। শুধু জানতে হবে খাবারে বিষক্রিয়া কী করে হল? ওটা নিছক ব্যাক্টেরিয়াজনিত বিষ (ফুড পয়জনিং), নাকি বাইরে থেকে ভয়ংকর কিছু ভিকটিমদের শরীরে ঢুকেছিল তা নিশ্চিত হওয়া দরকার।
ওহ্ ইয়েস। আপনার সাজেশন কী, ডিটেকটিভ?
দুটো কাজ করতে হবে। যে খাবার খেয়ে ওরা মারা গেল তার কেমিক্যাল টেস্ট করতে হবে। আর ডেডবডির ভিসেরা রিপোর্ট চাই। স্পেশালি কিডনি। তাহলে আরও নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
ওকে বস, হয়ে যাবে। সোৎসাহে বললেন ইন্সপেক্টর জানে আলম। অলোকের আশ্বাস পেয়ে তিনি বেশ উজ্জীবিত বোধ করছেন। সেই আনন্দে তিনি শখ করে তাদেরকে আরেক রাউন্ড স্পেশাল মালই চা এনে খাওয়ালেন। খাঁটি মোষের দুধের চা। খুব সুস্বাদু, পেটরোগাদের পক্ষে খেয়ে হজম করা কঠিন।
ইমরুল, খাবে? নাকি ওয়াক ওভার? মজা করল উর্বী। আমার অবশ্য খেতে আপত্তি নেই। যা সুন্দর ফ্লেভার! সো অ্যাপিটাইজিং!
লাজুক হাসে ইমরুল। তা সে হাসুক আর যাই করুক, উর্বী জানে সে পেটরোগা। বলল, খাচ্ছো খাও। তবে সামলে। দেখো, যেখানে সেখানে আবার তোমার পেট ছেড়ে না দেয়। দেশে কিন্তু পাবলিক টয়লেটের খুব অভাব।
৩
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো রিপোর্টই পাওয়া গেল। আবু আলমের বড় ছেলে খিজির তখনও মরেনি। তবে তার অবস্থা খুব একটা ভাল না। আটচল্লিশ ঘণ্টায় খুব একটা উন্নতি হয়নি। ডাক্তাররা তাকে শঙ্কামুক্ত তো বলছেনই না, বরং খিজিরকে নিয়ে বেশ শঙ্কিত বোঝা যায়। রীতিমতো সংকটাপন্ন।
রিপোর্ট যা বলছে তাতে অলোকেশের অনুমান খুব একটা ভুল ছিল না। মামুলি ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে এতগুলো সোমত্ত মানুষ এতসহজে মরতে পারে না। বালবাচ্চা হলেও না হয় কথা ছিল। তারা কেউ এতটাও বয়স্ক নয় যে খাবারে বিষক্রিয়ায় ধুপধাপ মরে যাবে। চিকিৎসাও পেয়েছিল সময়মতো। তাও বাঁচেনি।
ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্টে বিষের নাম ও নেচার উল্লেখ রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে যে, এলিয়েন গোছের বিষ ওটা, অর্থাৎ বাইরে থেকেই সেটা ভিকটিমদের শরীরে ঢুকেছে বা ঢোকানো হয়েছে।
কী বিষ? নাকি কেমিক্যাল?
ইথিলিন গ্লাইকোল! বড্ড বিটকেল নাম! মুখ বিকৃত করে উর্বী। ইমরুল কেমিক্যালের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে দুবার বিষম খেল। ওর আলজিভে ঘা লাগল, এবং সে বারংবার জিভ দিয়ে আলজিভের গায়ে আদর করতে লাগল।
ইথিলিন গ্লাইকোল! হোয়াট ইজ দিস? কীসে থাকে? কোনও ফরম্যাটে? কী দিয়েই বা তৈরি? এমন বেশকিছু প্রশ্ন নিজের মনে আওড়াচ্ছেন অলোকেশ রয়। এই জীবনে তিনি অনেক কেসের মুখোমুখি হয়েছেন, সমাধানও করেছেন। কিন্তু এমন বিটকেল কেস আর একটাও পাননি। কেস তো নয়, যেন রহস্যের ঠিলা!
জানি না। নিপাট ভদ্রলোকের মতো স্বীকার করে নেন এই কেসের আইও ইন্সপেক্টর জানে আলম।
খুক খুক করে বারদুই কেশে অলোকেশ বললেন, বুঝেছি। শিগগিরই কোনও বিষ-বিশারদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ইম্মিডিয়েটলি।
কফি! কফি চাই। মনে মনে নিজেই নিজেকে হাঁক শোনান তিনি। কফি না খেলে তার মগজ খোলে না। কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস খেতেন পাইপ, সত্যজিতের ফেলুদা চারমিনার টানতেন, ব্যোমকেশ বক্সী সিগ্রেট, আর আমাদের অলোকেশ খান কফি। কফি হাতে ডান জুলপি টানাটানি করার মানেই বিষম বিপদে আছেন তিনি, কেস নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। কেসের জটিলতা গভীরতা যেমন, গুরুগাম্ভীর্যও তেমনই।
উর্বী মনে মনে বেশ খুশি। ইমরুলও। যাক, কেসটা শেষমেশ একটা ভিন্নদিকে মোড় নিল। একেবারে জোলো কেস নয় এটা। ভেতরে মশলা আছে। ভিনদেশ থেকে এসে চার-চারটা লোক অপঘাতে মরলো, অথচ কাউকে সাসপেক্ট করা গেল না এটা হতে পারে? পারে না। কখনওই না।
কফিসহযোগে ইন্সপেক্টর জানে আলমের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসলেন অলোকেশ। সঙ্গে আছেন এসআই লক্ষ্মণ ও উর্বী-ইমরুল। দুটো পয়েন্ট নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি।
কী পয়েন্ট? ব্ল্যাঙ্ক লুক দিলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম।
খুনের মোটিভ এবং সাসপেক্টস! প্রত্যয়ী সুরে বললেন অলোকেশ।
এটাকে খুনই বলছেন ডিটেকটিভ! একটু যেন দ্বিধান্বিত জানে আলম সাহেব। খাবারে বিষক্রিয়া! দুর্ঘটনাও তো হতে পারে।
না, পারে না। স্পষ্ট জানিয়ে দেন অলোকেশ। তিনি আরও যোগ করলেন, দেখুন ভাই জানে আলম, আমি জানি এসব ব্যাপারে আপনার বেশ ভালই জানাশোনা। আপনার অভিজ্ঞতাও কিছু কম নয়। তাই আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ফুড পয়জনিং আর জেনেশুনে কারও শরীরে বিষ ঢোকানো এককথা নয়।
বিষ! জেনেশুনে! আবারও বিস্ময় প্রকাশ করলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম। তাতে একটু বিরক্তই হন অলোকেশ। রাত জেগে সাত কা- রামায়ণ শুনে সীতাকে তিনি কার বাপ সাজাচ্ছেন! মানে হয়!
হ্যাঁ, বিষ। আর বিষটা ঢুকেছে খাবারের মাধ্যমে। কৌশলে। সেই কারণেই হয়তো কেসটা লুকস লাইক ফুড পয়জনিং, আদতে যা নয়। এটা একটা কোল্ড-হেডেড মার্ডার, ইন্সপেক্টর। নিজের অভিমত ব্যক্ত করলেন তিনি।
বুঝলাম এটা খুন। তাহলে এবার বলুন তো ডিটেকটিভ, একই খাবার সকলে খেলো, অথচ মারা গেল শুধু আবু আলমের পরিবার। কেন?
ইয়েস। দ্যাটস দ্য পয়েন্ট। আমিও সেটাই ভাবছি। তাহলে কি যারা মারা যায়নি তাদের কেউ এই কেসের সঙ্গে জড়িত! ইচ্ছে করে কেবল আবু আলমের পরিবারকেই সে টার্গেট করেছিল!
উর্বী মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সেও ঠিক এই লাইনে ভাবছে। কিন্তু কাজটা তাহলে খুব কাঁচা কাজ হয়েছে বলতে হবে। খুনি কি এতটাই বোকা যে নিজেই নিজেকে ধরিয়ে দেবে? কিন্তু তাতে সমস্যা আরও বাড়ে ছাড়া ছাড়ে না। সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়।
কেমন করে শুনি? উর্বীর দিকে প্রশ্নবোধক চোখ তুলে তাকান অলোকেশ। ইমরুল নোট নেয়। সে সবার কথা টুক টুক করে টোকে। ওর বিবেচনায় যা গুরুত্বপূর্ণ তাতে আন্ডার লাইন টানে।
দেখো অলোক, খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছে মোট পাঁচজন, মারা গেছে চারজন, মুমূর্ষু একজন। অথচ সেই এই খাবার খেয়েছে আরও অন্তত পাঁচজন। তাদের কেউ তো অসুস্থ হয়নি! যেমন আবু আলমের শ্বশুর-শাশুড়ি, তার ভাই-ভাতিজা ও কাজের লোক রহমত আলী।
হুঁ। কেসের প্যাঁচটা তো ঠিক সেখানেই। স্বীকার করে নেন অলোকেশ।
এবার তাহলে বলুন এই কেসের প্রাইম সাসপেক্ট কে? ইন্সপেক্টর জানে আলম অমনি অলোকেশের অনুমানের ফ্যালাসি ধরে বসলেন। বললেন, আবু আলমের শ্বশুরপক্ষ ও ভাই-ভাতিজা সবাই মিলে নিশ্চয়ই খুনটা করেনি। তাদের মোটিভ কী! শ্বশুর লোকমান কেন তার নিজের মেয়ে রোজিনাকে খুন করবে! হোয়াই? প্রায় ঘাঁউয়ের মতো শব্দ করে উঠলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম।
নাহ্, শ্বশুর কাজটা করেনি সম্ভবত। আনমনে বললেন অলোকেশ। তাহলে আর কে বাকি থাকে? আবু আলমের ভাই আফসার ও তার ছেলে রুহুল। শোনা যায়, ইদানীং তাদের বেশ টানাটানি চলছিল। আর্থিক টানাপোড়েন। আর কে না জানে, অভাবে স্বভাব নষ্ট! কিন্তু তাই বলে খুন! নিজের ভাই-ভাবি ও ভাতিজাদের!
টাকার অভাব হলেই লোকে যদি খুন করত তাহলে সারা দেশে আর একটাও মানুষ বেঁচে থাকত না। টাকার অভাব কার না আছে বলুন! আর অভাব! সে কি আর কখনও মেটে নাকি! মানুষ যত পায় তার চাহিদাও যেন ততই বাড়ে। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে অভাববোধ। আর উল্টোপথে একই হারে কমতে থাকে সুখ। বস্তুত, গরিবের চেয়ে ধনীরাই বরং বেশি অসুখী।
নাহ, ফিলজফি কপচানোর সময় এটা নয়। তাই কেসে মন দেন অলোকেশ রয়। জানে আলমের কানে কানে বললেন, আপনি দয়া করে আবু আলমের ভাই আফসার ও তার ছেলে রুহুলের উপর নজর রাখুন। কড়া নজরদারি চাই। আমি কিন্তু তাদের নাম সাসপেক্ট লিস্টের উপরের দিকেই রাখছি। কারণ আবু আলম ও তার ছেলেরা মারা গেলে তার সকল সম্পত্তি বাপ-বেটাই পাবে। ইন ফ্যাক্ট, তারা দুজন এই ঘটনার সবচে বড় বেনিফিশিয়ারি।
সায় দেন জানে আলম। ওয়ারিশন বিবেচনায় আফসার ও তার পরিবারই সুবিধাভোগীএই পয়েন্টে অলোকের সঙ্গে একমত হন ইন্সপেক্টর। তক্ষুনি তিনি ওই দুজনের পেছনে চর লাগিয়ে দেন। তাদের সারাক্ষণের মুভমেন্ট নজরদারির আওতায় আনলেন।
৪.
জানে আলমের সঙ্গে মোলাকাত শেষে ডেরায় ফিরলেন অলোকেশ ও তারসহযোগীরা।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে সেলফোনের বাটন টিপছেন তিনি। কাকে যেন ফোন করবেন। ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর ধারায় ঝরছে একেবারে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসময়ের বৃষ্টি উপভোগ করে উর্বী। কাছেই দুটো ভাতশালিক সেই বৃষ্টিতে স্নানশুদ্ধি করছে। আলতো ঠোঁটে গা ঘষছে। আবার অসময়ের বৃষ্টিতে কাকস্নান করছে কেউ কেউ। ওরা এলাকার লোক। এসব বৃষ্টিটিষ্টি তারা থোরাই কেয়ার করে!
হ্যালো, ডক্টর সোহেল?
জি বলছি।
আমি অলোকেশ বলছি। আপনার বন্ধু। হেহে গোছের হাসলেন তিনি।
ওহ্ হো! বলুন ডিটেকটিভ কেমন আছেন? কোথায় আপনি? মেলাদিন কোনও খোঁজখবর নেই! ফোনের ওপার থেকে বিশিষ্ট ফরেনসিক স্পেশালিস্ট সোহেল মাহমুদ উত্তর দেন।
খোঁজখবর নেই তো কী হয়েছে! খাসখবর আছে। মজা করলেন অলোকেশ। তারপর বললেন, ভাই একটু দেখে বলুন তো ইথিলিন গ্লাইকোল ঠিক কোনও জাতের কেমিক্যাল! এই বস্তু কারও পেটে গেলে কেমন বিষক্রিয়া হতে পারে!
জাস্ট অ্যা মিনিট। হোল্ড অন প্লিজ। একটুখানি সময় চেনে নেন ডক্টর সোহেল। বলতে গেলে প্রায় সবজান্তা শমসের এই ডাক্তার। তার সামনে টেবিলে সবসময় বইয়ের স্তূপ থাকে। ফরেনসিক সায়েন্সের নানান বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য। বিষবিজ্ঞানেও তার বেশ দখল রয়েছে। মিনিট দুয়েক পরেই ফোনে ফিরলেন তিনি। বললেন, দেখুন মিস্টার ডিটেকটিভ, ইথিলিন গ্লাইকোল কোনও সাধারণ জিনিস নয়। আপনি বলুন তো, এই বস্তু পেলেন কোথায়?
কোথায় পেলাম সেকথা পরে হবে ডক্টর। আপনি এর নেচার সম্পর্কে বলুন। স্বাদণ্ডগন্ধ কেমন? খাওয়া চলে? এই জিনিস পেটে গেলে কি কেউ অসুস্থ হতে পারে? পটাপট পটল তুলতে পারে? একে একে পাঁচজন!
পারবে না কেন! আলবাত পারে। তবে সচরাচর এই জিনিস কারও পেটে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এটা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হয় না। যদি না কেউ ইচ্ছে করে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে! কথা অসমাপ্ত রাখেন সোহেল মাহমুদ।
এগজাক্টলি ডক্টর। চাইলে কেউ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে এই জিনিস পেটে চালান করতে পারে, তাই তো!সহমত পোষণ করেন অলোকেশ। তিনি আরও জানতে চান, ইথিলিন গ্লাইকোল আমাদের ঘর-গেরস্থালির কাজে লাগে কিনা?
খুক খুক করে কাশলেন ডক্টর সোহেল। গলায় জমে থাকা শ্লেষ্মা সাফ করেন। বললেন, গেরস্থালির কাজে! সরাসরি নয়। তবে জুতোর কালির সঙ্গে মিশিয়ে ইথিলিন ব্যবহৃত হয়। তাতে জুতোর গায়ে কালিটা বেশ স্থায়ী হয়, চকচকেও দেখায়।
ওহ্, আই সি। আর কিছু, ডক্টর?
তাতে একটু হাসলেন সোহেল। চোক চোক করে। বললেন, আরও একটা সুবিধা কী জানেন ইথিলিন গ্লাইকোল গন্ধহীন কেমিক্যাল। রঙও খুব একটা পরিদৃশ্যমান নয়। ফলে খুবসহজেই এটা খাবারে মেশানো যেতে পারে। এই জিনিস কাজও করে খুব দ্রুত। মানবদেহে প্রবেশের পর প্রথমে এটা সিএনএস বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত হানে। তারপর হার্ট, এবং ফাইনালি কিডনিদুটো অকেজো করে দেয়। ফলে ভিকটিমের মৃত্যু অবধারিত হয়ে পড়ে।
ফোন ছেড়ে দেন অলোকেশ। তারা যা জানার মোটামুটি জেনে নিয়েছেন। এবার হিসাব মেলানোর পালা।
চলো উর্বী, বেরোই। ঝটপট মন ঠিক করেন অলোকেশ। ইমরুল, তুমি তৈরি তো?
কোথায় যাবে আবার? এই বৃষ্টিতে! পরে গেলে হয় না? ডিসেন্ট দেয় উর্বী। ঠিক ডিসেন্ট নয়, মন খচখচানি।
না, হয় না। আমাদের জীবনে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জানো তো কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়! অ্যা স্টিচ ইন-টাইম, সেভস নাইন।
আমি ইংরেজি জানি অলোকেশ। তুমি ওটা ট্রান্সলেট না করলেও পারতে! বাঙালির এই এক বদঅভ্যেস, জানো তো! বাগাড়ম্বর, জ্ঞান জাহির, গুরুচণ্ডালি, বাহুল্যদোষ, আরও কতো কী! মওকা পেয়ে একহাত নেয় উর্বী। তবে সে তৈরিও হয়। সে জানে, অলোকেশের কাজে বাধা দেওয়া অন্যায়। রীতিমতো অপরাধ। বৃষ্টি তাতে কী! অল্প কিছু লোক বৃষ্টি অনুভব করে, উপভোগ করতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ শুধুই ভেজে। ওরা সিক্ত হয়, ঋদ্ধ নয়।
আবু আলমের বাংলোবাড়ি মধুবনের উদ্দেশ্যে ছুটলেন অলোকেশ। যেতে যেতে বৃৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে। খানিক বাদে থেমেও গেছে। বাড়ির চৌহদ্দির মুখে বাগান-মালি মোজা মিঞার সঙ্গে আবার দেখা। সে কাজ ফেলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। এক বুড়ো। থুত্থুরে বুড়ো যাকে বলে। বেশ বয়স। সত্তরের উপরে হবে নিশ্চয়ই।
ব্যাটা কামচোর! উর্বী মনে মনে বলল। অলস-অকম্মাদের সে একদম দেখতে পারে না। জীবন একটা গাড়ির মতো। ফেলে রাখতে নেই। গাড়ির কাজই গড়ানো, গ্যারেজে বসে পচে মরা নয়। জীবনও তাই। জীবনে গতি না থাকলে সে জীবন বৃথা। ইটচাপা ঘাসের মতোই শুষ্ক ও বর্ণহীন।
বুড়োর সঙ্গে আলাপ জুড়লেন অলোকেশ। ইচ্ছে করেই। তিনি আলতাফ আলী। আলুটিলায় থাকেন। মোজা মিঞা তার কেউ নয়, তবে আবু আলমের বংশধর তিনি। দূর সম্পর্কের দাদু হন।
কেমন দাদু?
লতায় পাতায়। বললেন আলতাফ।
আবু আলম মারা গেল। প্রায় সপরিবার। পুলিশ বলছে খুন। কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
তাতে খটখটে হাসেন আলতাফ। তারপর বললেন, কী আর বলি বাপু আবু কিছু ভালা মানুষ না। বৈদেশ গিয়া সে ভোল পাল্টাইছে। মেলা টেকার মালিক হইছে হুনছি। কিন্তু তাতেই কি কারও চরিত্র বদলায়!
সে কি! আবু আলমের চরিত্রদোষ আছিল? অলোকের প্রশ্ন। বা কৌতূহল।
ক্যান বাপু! টেকা হইলে চরিত্র নষ্ট হবে না! তাই তো হয়। দ্যাশে কোনও টেকাঅলা লোকটা আছে কও দেহি, যার চরিত্তির ভালা! উল্টো প্রশ্ন ছোড়েন আবু আলমের দূর সম্পর্কের দাদু আলতাফ আলী।
মুচকি হাসে উর্বী। মনে মনে ভাবে, কথা কিছু ভুল বলেনি দাদু। টাকার গরম সহ্য করা কঠিন। টাকা বেশি হলে কোনও না কোনওভাবে তা দুর্গন্ধ ছড়াবেই। সহি রাস্তায় কত টাকা খরচ করা যায় বলুন!
খুলে বলুন দাদু। এই নিন সিগ্রেট। পকেট থেকে একশলাকা বেনসন এন্ড হেজেজ বের করে দেন অলোকেশ। তিনি নিজে ধূম্রপান করেন না, তবে সঙ্গে রাখেন। নেশারুদের কাছে টাকার চেয়ে বরং এসবের দাম বেশি।
বেজায় খুশি হন দাদু। খটখটে হাসেন তিনি। বললেন, কী আর বলব বাপু, আসো, ইদিকে আসো। কেচ্ছা কিছু বলি। তিনি অমনি আবু আলমের ঠিকুজি কোষ্ঠি মেলে ধরে বসলেন। আবুর ক্যারেক্টার নাকি গোড়া থেকেই খারাপ। তার অত্যাচারে আবুর বাপ আক্কু মিঞা অকালে প্রয়াত হন। প্রায় সপ্তায় সে নাকি একেকটা নতুন নারী ধরে নিয়ে আসত। না না, বিয়েটিয়ে নয়, স্রেফ সম্ভোগ। এই কইরে কত মাইয়ার প্যাট ছাড়ান কাটান লাগছে!
তারপর? তারপর কী হল দাদু? তাড়া দেয় উর্বী। সে বেশ মজা পেয়েছে। এ দেখি কেঁচো খুঁড়তে গোখরো বেরিয়ে আসছে!
পরে আর কি! মেলা ঝক্কিঝামেলা কৈরে শ্যাষে বিলাত পাড়ি দেয় আবু আলম। বাপের টেকা ছিল, গেছে। কিন্তু তার স্বভাব কি আর মরছে! জানি না বাপু। আমি এখন যাই। বেলা অইছে।
বেনসনের সুখ টান শেষ হতেই কেটে পড়ল বুড়ো। নেশা হজম, বোল খতম! বড্ড স্বার্থপর প্রাণী এই মানুষ! এবার মোজা মিঞাকে একটু ঘাঁটালেন অলোক। বললেন, তোমার মালিক আবু আলমের চরিত্র নাকি ঠিক ছিল না? বড্ড নারীঘেঁষা ছিল আবু! তুমি কী বলো?
মোজা মিঞা চুপ। সে কিছু বলছে না।
কী হল! কিছু বলো। তাড়া দেন অলোকেশ। মোজাকে তিনি বেশ নিরীক্ষণ করে দেখছেন। বড্ড চেনা চেনা লাগছে যেন! নাকি তার পরিচিত কারও সঙ্গে মোজার চেহারার বেশ মিল রয়েছে! ওর একটা অদ্ভুত ক্যারেক্টারও তার চোখে পড়ল। ওর বাঁ হাতের আঙুল ছটা। কালেভদ্রে এমন দেখা যায়!
এবারেও মোজা কিছু বলল না। বোধ হয় ঠিক করেছে খুনোখুনির বিষয়ে সে মুখ খুলবে না। কুলুপ এটে থাকবে। যাক গে যাক, মামুলি মালিকে দেবার মতো অফুরন্ত সময় তার হাতে নেই। তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। জলদি।
চৌহদ্দি পেরিয়ে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছলেন অলোকেশ ও তার টিম। কাজের লোক রহমতের সঙ্গে দেখা। সেদিন তাকে জেরা করা হয়নি, আজ যখন সামনেই পাওয়া গেল, ফেলে রাখা কাজটুকু সেরে ফেলা যাক।
রহমত?
জি সাব!
কেসটা সেদিন কী ঘটেছিল একটু বলবে!
কোনও কেস সাব?
হোটেল অমৃতব্যঞ্জন, খানাপিনা, আবু আলম ও তার পরিবারের মৃত্যু! তুমি কী জানো বলো। ঘাবড়িও না, আমরা পুলিশের লোক নই।
রহমত চুপ।
সব শালা নৈশব্দ্যের উপাসক হয়ে গেল নাকি! বিরক্ত অলোকেশ। উর্বী তাকে সামলায়। বলল, ডোন্ট ওয়রি। গেস, উই আর ইন দ্য রাইট ট্র্যাক। বিষের হদিস যখন পেয়েছ, খুনিরও পাবে। ও পালাতে পারবে না।
আরেকটু সাপোর্ট দিতেই মুখ খুলল রহমত। বলল, সাব, সেদিন হোটেলের একটা ছেলে খাবার আনলো। অনেক লোকের খাবার। অনেকগুলো হাঁড়ি-গামলা।
তাই নাকি? বাহ্! বেশ তো। উৎসাহ দেন অলোকেশ। বাবাজী কথা বলতে শুরু করেছে!
জি সাব। ভ্যান গাড়ি থেকে হোটেলের ছেলেটা হাঁড়ি নামায়, আর আমরা হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকি।
আমরা! তুমি ছাড়া আর কে কে ছিল? পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে প্রশ্নবাণ ছোড়েন অলোকেশ।
না মানে, আমি, বাগানের মালি মোজা আর কাজের বুয়া জরিনা। তিনজন মিল্যা খাবার তুলছিলাম।
ও তাই বলো।
আচ্ছা, সেই জরিনারে কই পাবো বলো তো? আছে নাকি কাছেপিঠে?
জরিনা! তারে দিয়া কী করবেন সাব? সে তো ভাল মানুষ। সরল সিধা মেয়েলোক! রহমত বলল। যেন সে তার চরিত্রের চৌকিদারি নিয়ে বসেছে। জরিনার নাম বলার সময় ওর দুচোখে কীসের যেন দীপ্তি দেখা গেল! প্রেম নাকি! প্রণয়!
তাও একটু ডাকো না। দেখি সে কী বলে! জোর করলেন তিনি। কিন্তু জরিনাকে তখন পাওয়া গেল না। সে নাকি গ্রামে গেছে। তার ভাই অসুস্থ। সে ছুটিতে আছে।
আর কাউকে জেরা করতে মন চাইলো না অলোকের। করে লাভও নেই মনে হয়। তাই ফিরে এলেন অলোকেশ। মধুবন বাংলো থেকে বাগানের পথ ধরলেন তিনি।
তারপর, মোজা মিঞা? কেমন চলছে দিনকাল?
কেমুন আর! আবু আলম সাব মারা গেল! পোলারাও গেল! আমার এই বাগান সাফ করনের কামডা কি আর থাকবো! মনমরা মোজা মিঞা।
হুঁ। তাই তো! তাহলে কী করবে এখন? কিছু তো একটা করে খেতে হবে, তাই না!
কী আর! পুরানা পেশায় ফিরা যামু!
পুরোনো পেশা! কী সেটা? কামাই কেমন?
কাম আর কী! মানুষের পায়ে হাত, সাফ-সুতরো, লাথি-ঝাঁটা, ঘষামাজা, এই আর কি! দুকথা বলে আর দাঁড়ায় না মোজা মিঞা। সে সোজা বাগানের অন্য পথে হাঁটা ধরে। ওরা বুঝতে পারে, বেচারা মোজার মনটা সত্যি ভাল নেই। সে অস্তিত্বসংকটে ধুঁকছে। কারণ সে জানে, অচিরেই সে বেকার হয়ে পড়বে।
৫.
নতুন কী কী তথ্য পাওয়া গেল?
আবু আলমের চরিত্রদোষ। তার এলমেলো কাজের কারণেই বাপের অকাল মৃত্যু হয়।
রহমতের সঙ্গে জরিনার সম্ভাব্য প্রেমের সম্পর্ক। তারা দুজন এই গাছের কাঁঠাল বলেই অনুমান। আচ্ছা, রহমত আর জরিনা দুজন মিলে কি কাজটা করতে পারে! কিন্তু মোটিভ? কী কারণে করবে! টাকার লোভে! এই খুনোখুনির মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও আজেবাজে কাজ ওরা করতে পারে! আবু আলমের বংশ সাফ হলে রহমত বা জরিনার কী সুবিধা?
বাগানের মালি মোজা মিঞার পুরোনো পেশায় ফিরে যাবার পরিকল্পনা। কারণ তার এই বাগান সাফের কাজটা সম্ভবত আর থাকছে না। মালিক নেই তো মালি কী করে থাকে! মধু না থাকলে মধুবন কি আর চলে নাকি!
আরেকটা তথ্য জানা খুব জরুরি। ভাবতে ভাবতেই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন দুঁদে ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। কী সেই তথ্য?
সেদিন রাতে আবু আলমের ঘরে কে খাবার পৌঁছে দিয়েছিল? রহমত, মোজা মিঞা নাকি জরিনা! এদের প্রত্যেকেরই আবু আলমের খাবারে ইথিলিন গ্লাইকোল মেশানোর সুযোগ ছিল। অমৃতব্যঞ্জন হোটেলের পাঠানো ভ্যান থেকে রুমঅব্দি খাবারের হাঁড়ি পৌঁছানোর সময়টুকু একেবারে কম নয়। কেউ চাইলে সবার অলক্ষ্যে ত্রস্ত হাতে খাবারে ইথিলিন গ্লাইকোল মেশাতে পারে।
সাথে সাথে জিন্দাবাজারের অমৃতব্যঞ্জনে ফোন করলেন অলোকেশ। তিনি জানেন এবং মানেন, দরকারি কাজ কখনও ফেলে রাখতে নেই। ঝোঁক বুঝে কোপ মারতে হয়। অমৃতব্যঞ্জনের ম্যানেজার ফয়জুলকে বললেন, জলদি ছেলেটাকে একবার পাঠান তো। সেই ছেলে হোটেল বয় টোকন। নিন, আমার ঠিকানাটা লিখুন। তাকে এক্ষুনি পাঠান, নইলে কিন্তু পুলিশ গিয়ে সবকটাকে তুলে আনবে। কোমরে দড়ি বেঁধে।
টোকন এল। মিনিট কুড়ির মধ্যেই এল সে। পুলিশের ভয় কার না আছে বলুন! আইনের হাত খুব লম্বা। আইন না মানলে আছে পীড়ন ও পানিশমেন্টের আশঙ্কা। যদিও এই আইন আবার সবখানে ঠিকঠাক কাজে আসে না। কখনও কখনও আইন লুলা-ল্যাংড়া হয়ে যায়! চোখে দেখতে পায় না। পুরোপুরি আন্ধা না হলেও আইন গ্লুকোমার পেশেন্ট বনে যায়।
কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। টোকন ঠিক সেই টাইপ ছেলে। সে হোটেল বয় বটে, অথচ তার চেহারায় জীবনের অপূর্ব হাতছানি। খুব উচ্ছ্বসিত দেখায় তাকে। সারাক্ষণ, সবসময়।
কেসটা বুঝিয়ে বললেন অলোকেশ। সেদিন রাতে অনেকের জন্যই খাবার নিয়ে গেছিল টোকন। অন্তত তিনখানা রুমে সে খাবার দিয়েছিল। টোকন নিজে থেকে বলল যে সে মধুবনের ভেতরে ঢোকেনি। যদিও খুব শখ ছিল, কিন্তু তার পায়ে নোংরা-ময়লা লেগেছিল, তাই সাহস হয়নি উপরে ওঠার।
তুমি খুব ভাল করে ভেবে বলো তো টোকন, আবু আলমের ঘরের জন্য কে খাবার নিয়ে গিয়েছিল? উপরে? রহমত, জরিনা নাকি মোজা মিঞা? নাকি এর বাইরেও আরও কেউ ছিল?
মাথা চুলকায় টোকন। সে একটু সময় নেয়। আসলে সে ঠিক মনে করতে পারে না। কারণ তখন রাত, তাও আবার আলো-আঁধারি ছিল। বড়লোকের বাড়ি তো, তাই পুরো আলোকিত ঘরবাড়ি বড্ড বেমানান। একটু অবছামতো থাকলে ভাল, ঠিক তাদের মনের আনাচে কানাচে যেমন রহস্যময় পুঁতি-অন্ধকার লুকিয়ে থাকে!
কী হল, বলো! বলো টোকন। মনে করো বলো। ওর মাথায় হাত রাখে উর্বী। স্নেহমাখা হাত। এমন ¯িœগ্ধ চেহারার ছেলে খুব একটা দেখা যায় না।
টোকন কিছু বলছে না দেখে নিজের কাছে তাকে টেনে নেন অলোকেশ। বললেন, তুমি ঠিক ওই মুহূর্তের উপর জোর দাও। ঘটনার দিন রাতের বেলা, যখন তুমি মধুবনের জন্য খাবার নিয়ে গেলে। ভাবো টোকন, মনস্থির করো। কনসেন্ট্রেট। ইটস ভেরি ইমপোর্ট্যান্ট!
অবশেষে মুখ খুলল অমৃতব্যঞ্জনের মিষ্টিমতো হোটেল বয় টোকন। একটা নাম বলল। ছোট্ট করে। আর কেউ জানলো না, শুধু ডিটেকটিভ অলোকেশ শুনলেন। কথাটা শোনার জন্য উর্বী ও ইমরুল উটের মতো কান বাড়িয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু তারা আদতে কিছু শুনতে পায়নি। অলোকেশও কিছু বলতে চাননি।
বকশিস দিয়ে টোকনকে বিদায় করলেন অলোকেশ। তারপর হাসপাতালে ছুটলেন, যেখানে তখনও আবু আলমের বড় ছেলে খিজির মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
হাসপাতাল? আবার? বিস্ময় প্রকাশ করে উর্বী। টোকন তোমাকে কার নাম বলল আমাকে বলবে না অলোক? অনুযোগের সুরে যোগ করল উর্বী।
মুচকি হাসেন অলোকেশ। অনেকটা যেন এড়িয়ে গেলেন।
ডক্টর, পেশেন্ট কেমন আছে? আবু আলমের ছেলে খিজির? কেবিনের বাইরে ডিউটি ডক্টরের কাছে জানতে চাইলেন অলোকেশ।
তাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়লেন ডক্টর। নাথিং নিউ। সে যেমন ছিল তেমনই আছে। তবে কন্ডিশন খারাপ হয়নি এটুকু অন্তত বলতে পারি।
তার মানে আপনারা এখনও আশাবাদী, তাই না? হয়তো সে বেঁচে উঠবে!
তা তো অবশ্যই। আশা না থাকলে মানুষ কি আর বাঁচে! যে স্বেচ্ছায় মরতে চায় তাকে কে বাঁচাবে বলুন! দার্শনিকের সুরে বললেন ডক্টর।
তাতে সায় দেন অলোকেশ। হুঁ শব্দ করে সামনে এগিয়ে যান। আচ্ছা, আমি কি খিজিরকে একবার দেখতে পারি? জাস্ট ফর অ্যা সেক! অনুনয়ের সুরে বললেন তিনি।
দেখবেন? দেখে কী হবে বলুন! ওর তো চেতনা নেই। চোখেও দীপ্তি নেই।
তাও! জোরাজুরি করছেন অলোকেশ, যা তার স্বভাবের সঙ্গে ঠিক যায় না। উর্বী অন্তত এই অলোককে চেনে না।
অবশেষে রাজি হন ডক্টর। কিছুক্ষণের জন্য শুধু ডিটেকটিভ অলোকেশ ভেতরে যান। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। খিজিরকে তিনি বেশ ভাল করে পরখ করে দেখলেন। ভাবছেন, এই চেহারা তো তার অচেনা নয়! কে এই খিজির!
অনতিদূর থেকে উর্বী খেয়াল করে, অলোকের চোখের তারায় হাসির ভাব ফুটে উঠলো যেন। তার মানে অন্ধকার টানেলের আগায় তিনি আলোর ফুটকি দেখতে পাচ্ছেন। দ্য কেস ইজ গেটিং সাম ওয়ে-আউট!
ডেরায় ফিরলেন অলোকেশ। তখন প্রায় সন্ধ্যা উতরে গেছে। ইংরেজি ভাষায় সিমলেস বলে একটা কথা আছে। যার কয়েকটা মানে আছে। অনেকটা এরকমউঈদ নো গ্যাপ, জোড়াতালিবিহীন, নিখুঁত কিংবা এ কথান হিসেবে বোনা কাপড়।
কেসটার এখনও যাকে বলে সেই সিমলেস সমাধান পাননি অলোকেশ। প্রায় জুড়ে এসেছে বটে, কিন্তু! কিছু একটা কিন্তু এখনও রয়ে গেল। খিজিরের চেহারা, টোকনের বক্তব্য, পারিপাশির্^ক এভিডেন্স সব যেন একজনের দিকেই ইশারা করছে। কিন্তু কেন! ভিনদেশি আবু আলমকে সপরিবারে ধ্বংস করে তার কী লাভ? মোটিভ কী!
নাহ্, হিসাব যেন মিলছেই না কিছুতেই। তাছাড়া খুনের উয়েপন সেই ইথিলিন গ্লাইকোল এর হদিস এখনও বেশ দুরস্ত। খুনি কীভাবে তা জোগাড় করল? এটা তো কোনও মামুলি কেমিক্যাল নয়!
উর্বী বা ইমরুলের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করবেন? উহুঁ, কেসের এই পর্যায়ে এসে কারও সঙ্গে আলাপচারিতা তার পছন্দ নয়। তিনি মগজ ঘামাবেন। একান্তে, একেবারে নিজের মতো করে। এটাই গোয়েন্দা অলোকের দন্তুর বা রীতি।
চেয়ারে কোমর খাড়া করে বসে ভাবছেন তিনি। থুতনিতে ঘন ঘন হাত বোলান, নির্মমভাবে নিজের জুলপি মোচড়ান। উর্বী বুঝতে পারে অলোক এখন ভাবনার গভীর আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ডিমে তা-দেওয়া ঘুঘুর মতো একান্তে ভাবছে।
সেইসময় নিতান্তই বেরসিকের মতো ইমরুল বলল, সিলেটের ওয়েদার একেবারে যাচ্ছেতাই। দেখো উর্বী, আমার জুতোর কী দশা হয়েছে! ময়লা-মাটি লেগে একশা। কী করি এখন!
কী আর করবে! ব্রুজ ইওর শুজ। জুতোয় কালি লাগাও। ঘষো। মাজো। এই নাও শু-শাইনার। পায়ে হাত দাও। চটুল সুরে উর্বী বলল।
ব্যস, তাতেই অমনি লাফিয়ে উঠলেন গোয়েন্দা অলোকেশ। একলাফে তিনি একেবারে চেয়ারের উপরে উঠে দাঁড়ালেন।
কী বললে উর্বী? ইমরুল এখন কী করবে? শু-শাইনার লাগাবে? ঘষা-মাজা করবে! পায়ে হাত দেবে? চেঁচালেন অলোকেশ।
তা নয়তো কী! নিজের কাজ নিজে করাই তো ভাল! বোকার মতো বলল উর্বী। এখনও সে বুঝতে পারেনি এই কয়েকটি কথার মাঝে কী অপার রহস্য লুকিয়ে আছে।
মুঠোফোনে পটাপট কারও নম্বর টিপলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। আঙুলের ত্রস্ত ছোঁয়ায়।
কে, ইন্সপেক্টর জানে আলম বলছেন?
নয়তো কে আবার! ফোনটা তো আমারই। ফোনের ওপার থেকে লঘু সুরে বললেন কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর জানে আলম।
কেস খতম! জলদি আসুন ভাই জানে আলম। আমার কথা শুনলে আপনি জানে পানি পাবেন, আই প্রমিস। সহাস্যে বললেন অলোকেশ।
খুনি কে তা ধরে ফেলেছেন? কে সে? কোথায় আসব? পৌনঃপুনিক প্রশ্ন করেন জানে আলম সাহেব। আসলে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না এতসহজে অলোক খুনিকে ফিগার-আউট করবেন।
আপাতত মধুবনে আসুন। ভিকটিমের বাড়ি। আবু আলমের বাড়ি বলছি না, কারণ সে তো আর বেঁচে নেই। তবে তার ছেলে খিজির সম্ভবত বেঁচে উঠবে। তারও কারণ আছে। আসুন, সব শুনবেন। সঙ্গে করে অবশ্যই ফোর্স নিয়ে আসবেন। বলেই অমনি ফোন কেটে দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।
চলো উর্বী, বেরোই। ইমরুল, জুতো চকচক পরে হবে, চল যাই মধুবন। রাইট নাউ।
৬.
মধুবন পৌঁছে অলোকের পরামর্শে ছোটোখাটো একটা গোলমিটিং ডাকলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম। সেখানে আবু আলমের শ্বশুরপক্ষ ছাড়াও ভাতিজা রুহুল ও তার বাপ আফসার উপস্থিত। হাজির হয়েছে বাহির মহলের কর্মচারীরাও। শুধু নেই কাজের মেয়ে জরিনা। আরও একজন আছে, আবু আলমের সেই দূর সম্পর্কে দাদু আলতাফ, যিনি কিনা ফেলুদার সেই সিধু জ্যাঠার মতো মেলা তত্ত্বকথা জানেন, পুরাণ বোঝেন এবং বোঝান।
শুরুতেই বেশ বড়সড় একটা বোম ফাটালেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। সবাই উপস্থিত হয়েছে কিনা দেখে নিয়ে তারপর বললেন, আবু আলমের বড় ছেলে খিজির কিন্তু ভাল আছে। তার শারীরিক অবস্থার মোটেও অবনতি হয়নি। ডাক্তার যা বললেন, সম্ভবত সে বেঁচে যাবে। কারণ খুনিও তা চাইছিল। খুনি তার কাছের লোক।
এই কথাটুকু বলে তিনি সকলের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছেন। কিন্তু একজন বাদে বাকি সবাই মোটামুটি স্থির। তারা চায় খিজির বেঁচে ফিরুক, তবে সভাকক্ষের একজনকে খুব সুস্থির, খুশি ও উজ্জীবিত দেখালো।
কে সে?
বাগানের মালি মোজা মিঞা।
কিন্তু কেন?
প্রশ্ন তো সেখানেই ভায়া! সময় নেন অলোকেশ। এবং বলেন, আবু আলমের ছেলে দুজন বলে আমরা জানি। কিন্তু আদতে দুজন নয়, তিনজন। খিজিরও তার বড় ছেলে নয়, সে মেজ। এক ছেলে মারা গেছে, কিন্তু দুজন এখনও বেঁচে আছে।
অলোকের কথা শুনে উপস্থিত সবাই নড়েচড়ে বসলো। শুধু একজন অনড়, সুস্থির ও চুপচাপ। মোজা মিঞা।
ইন্সপেক্টর জানে আলমসহসাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। কী বলছেন একটু খোলসা করে বলুন, মিস্টার ডিটেকটিভ!
বলছি, দাঁড়ান। দেখুন তো এই ছেলের সঙ্গে উপস্থিত কারও মিল পান কিনা? মুঠোফোনের গ্যালারি খুলে তিনি অসুস্থ খিজিরের ছবি দেখালেন। কী, মিল খুঁজে পেলেন ইন্সপেক্টর?
জানে আলম চুপ।
দেখুন, দেখুন, ভাল করে দেখুন। শুধু গায়ের রঙ দেখবেন না, ফেস-কাটিং দেখুন। হাতের আঙুলেও নজর দিন। গুরুত্বপূর্ণ ক্লু দেন অলোকেশ।
অমনি কেসটা ধরে ফেললেন জানে আলম সাহেব। আরে তাই তো! খিজিরের চেহারার সঙ্গে বাগানের মালি মোজা মিঞার তো ভারী মিল। ওই যে আঙুল! দুজনেরই বাঁ হাতে একটা করে আঙুল বেশি রয়েছে। পাঁচটার বদলে ছটা।
অলোক আর মিছে রহস্য বাড়ান না। বললেন, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, মোজা মিঞা খিজিরের নিজের ভাই, আবু আলমের সন্তান। কী মোজা, ঠিক বলিনি?
মোজা চুপ। সে মুখে কুলুপ এটেছে।
এই তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ায় সবচে বেশি বিস্মিত হয় আবু আলমের শ্বশুর লোকমান। সেও জানতো না, তার জামাইটির চরিত্র কেমন ফুলের মতো পবিত্র।
কফি এল। এসআই লক্ষ্মণের তদারকিতে রহমত বানিয়ে নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়ে এবার আসল কথায় এলেন অলোকেশ।
কী কথা?
ওই যে খুনের মোটিভ!
দেখুন ইন্সপেক্টর, মানুষ কিন্তু সবসময় লোভের বশবর্তী হয়ে খুনখারাবি করে না। প্রতিহিংসা, পুরোনো রাগ, বা ঘৃণা চরিতার্থ করতেও খুন করে বসে। এখানেও তাই করেছে খুনি।
বেশ বুঝলাম। কিন্তু সেই খুনিটা কে? অধৈর্য হয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম।
ওয়েট, সবুর করুন ভায়া। সবুরে মেওয়া ফলে। এখনে ফলবে দুর্ধর্ষ খুনির পরিচয়। কফিতে আলতো চুমুক দেন তিনি। বললেন, একটু ভাবুন, খিজির আর মোজা মিঞা প্রায় সমবয়সী। তারা দুজন একই মায়ের সন্তান। কিন্তু সেই মা-টা কে! কী তার পরিচয়! সে এখন কোথায়? দাদু, আপনি কিছু বলবেন?
খটখটে হাসলেন দাদু। বললেন, কই আবার! তাকে তো ওই শালা আবু আলমই লোক লাগিয়ে গুম করিয়েছিল। সেই খবর আর কেউ না জানলেও মোজা কিন্তু জানতো। আবু কি আর সাধে দেশ ছেড়েছে! পাপ! ওই পাপ ঢাকতেই সে লন্ডনে গেছিল।
হুঁ। বুঝলাম। দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন ইন্সপেক্টর আলম। তারপর?
তারপর আর কী! মোজা মিঞা তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগ পেলেই তার মায়ের হন্তারককে সে নিকাশ করবে। আবু আলম তার অনেক দিনের টার্গেট। কবে সে দেশে ফিরবে, সেই অপেক্ষার প্রহর গুনেছে মোজা মিঞা।
কফি খান জানে আলম। শর্ট চুমুকে, চুক চুক করে। কাব্য-দিব্যর বিলাই টুকটুকের মতো।
কিন্তু মোজাকে আপনি চিনলেন কী করে? স্রেফ খিজিরের সঙ্গে তার চেহারার মিল আছে, তাতেই!
নট অ্যাট অল, ইন্সপেক্টর। এতসহজে কি মানুষ চেনা যায়! প্রথম ক্লু খাবারে ইথিলিন গ্লাইকোলের উপস্থিতি। পরে জানা গেল রহমত, জরিনা আর মোজা এই তিনজন সেদিন খাবার নিয়ে মধুবনে ঢুকেছিল। আরও একজনের অবশ্য খাবারে ইথিলিন মেশানোর সুযোগ ছিল। সে হোটেল বয় টোকন। কিন্তু আবু আলমকে মেরে তার লাভ? মোটিভ কী! নাথিং।
টোকনকে বাদ দিলে বাকি রইলো রহমত, জরিনা আর মোজা মিঞা। টোকনই পরে জানালো যে আবু আলমের ঘরে সেদিন খাবার নিয়ে শুধু মোজা মিঞা ঢুকেছে। টোকন মিথ্যা বলেনি ধরে নিয়ে মোজাকে আমি পরখ করতে থাকি। নজরে রাখি। তার সামনে বারবার আবু আলমের কথা বলি। মোজা সব শোনে কিন্তু কিছু বলে না। ছেলেটা বেশ চতুর ও বুদ্ধিমান।
একদিন সে হঠাৎ বলে বসলো, টাকা থাকলেই মানুষ মানুষ হয় না। কথাটা আমার মগজে গেঁথে রইলো। একটু তলিয়ে ভাবতেই বুঝলাম মামুলি মালির মুখে এসব কথা একদম মানায় না। মানায়, বলুন আপনি! তারপর যখন খিজিরের সঙ্গে ফেস-কাটিং ও বাহ্যিক চেহারা ছাড়াও মোজার ছয় আঙুলের মিল পেলাম, আর ঠিক তার পরের দিন দাদু জানালো যে আবু আলমের চরম চরিত্রদোষ ছিল, তখন ঘটনা কিছুটা বুঝতে পারি। আন্দাজ করি যে, আবু আলমের খুনের সঙ্গে মোজার কিছু একটা কানেকশন্স থাকতেই পারে।
তারপর? তারপর কী হল? উদগ্র আগ্রহের সঙ্গে জানতে চান ইন্সপেক্টর জানে আলম। ভেতরে ভেতরে তিনি ফুঁসছেন। ঘামছেন। কৌতূহল ও উত্তেজনায়।
খুক খুক করেন অলোকেশ। এই কাশি অর্থপূর্ণ, উর্বী জানে। গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের সঙ্গে কাশিটা বেশ যায়। চায়ের সঙ্গে যেমন টা, কফির সঙ্গে টফি, সেইরকম।
বলুন ডিটেকটিভ, তারপর কী হল? কীভাবে এগোলে আপনি?
হুঁ, বলছি। ওয়েট। বুঝতেই পারছেন ইন্সপেক্টর, কেসের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না আমি। কিছুটা ইনটুইশন, আর কিছুটা প্রমাণ-সাপেক্ষ তথ্য ও উপস্থিত সাক্ষীদের বয়ানের উপর নির্ভর করেই সামনে এগোই। তবে আর যাই বলুন, মোজা মিঞার আচরণ আমার কাছে বরাবরই সন্দেহজনক মনে হয়েছে। আমাকে দেখলেই সে যেন কেমন মিইয়ে যেত। জড়সড় হয়ে থাকত। ওর এই ¯িœকি মুভমেন্ট আমাকে আরও বেশি সন্দিগ্ধ করে তোলে। আমি ওর উপর নজরদারি বাড়িয়ে দিই।
তারপর?
তারপর! আমি হাসপাতালে খবর নিয়ে জানতে পারি, রহমত, জরিনা এবং মোজা মিঞার মধ্যে কেবল শেষোক্ত ব্যক্তিটিই হাসপাতালে গিয়ে বারবার খিজিরের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর করছিল। কেন জানেন? খিজির আর মোজা মিঞা একই মায়ের সন্তান। ওরা সহোদর ভাই। আপাত চোখে খিজির আবু আলমের ছেলে হলেও তার বৈধ স্ত্রী রোজিনা কিন্তু খিজিরের মা নয়। খিজিরের মা সেই ভদ্রমহিলা যে কিনা মোজাকেও জন্ম দিয়েছে, আর পথের কাঁটা দূর করতে আবু আলম যাকে লোক লাগিয়ে গুম করিয়েছিল।
আঃ! পুরো সভাকক্ষে একরকম বিস্ময়সূচক শব্দ শোনা গেল। অর্থাৎ এই গূঢ় তথ্যাদি সম্পর্কে উপস্থিত কারও জানা ছিল না, ধারণাও নয়।
বুঝলাম ডিটেকটিভ। এবার বলুন, শেষঅব্দি আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে চার খুনের পেছনে মোজারই মগজ কাজ করেছে?
শুধু মগজ নয় ইন্সপেক্টর, পুরো কাজটাই করেছে মোজা। কী করে বুঝলাম! সেও এক রহস্য বটে। কিংবা বলতে পারেন স্বপ্নে পাওয়া দৈববটি। চোক চোক করে একচোট হাসলেন অলোকেশ। অর্থপূর্ণ হাসি। অলোকেশের এইসব আচরণ উর্বীর বেশ চেনা। প্রতিটা কেসের শেষাংশে এসব দৃশ্যই মোটামুটি মঞ্চস্থ হয়।
সে কেমন শুনি?
হুঁ। এক্ষেত্রে পুরো ক্রেডিট গোজ টু মাই টিমমেটস উর্বী এন্ড ইমরুল। কী করে, শুনবেন! বৃষ্টিতে ভিজে ইমরুলের জুতো নষ্ট হল। এই জুতো পরে সে বাইরে যেতে লজ্জা পাচ্ছিল। উর্বী তখন বলল, এই নাও শু-শাইনার, নিজের পায়ে হাত দাও, ঘষো, মাজো। জুতো ঠিক করে নাও।
তো! তাতে কী হল? বুঝতে পারেন না ইন্সপেক্টর জানে আলম। তিনি আরও আকর্ষণীয় কিছু শুনে চাচ্ছিলেন।
হাসলেন অলোকেশ। বুঝলেন না? তাহলে আপনি মোজা মিঞার নিজের কথা শুনুন। কেমন আছো জানতে চাইলে কথাপ্রসঙ্গে সে বলল, তার মন খারাপ। কারণ সে অনুমান করছে তার চাকরিটা আর থাকবে না। কেননা, মালিক না থাকলে মালিরও আর কাজ থাকে না। বললাম, তাহলে কী করবে শুনি? চাকরি গেলে করবে কী?
মোজার উত্তর সেই পুরনো পেশা। কাম আর কী! মানুষের পায়ে হাত, সাফ-সুতরো, লাথি-ঝাঁটা, ঘষামাজা, এই আর কি!
তখনও ভেটকি মাছের মতো ভোঁতা মুখ করে আছেন জানে আলম। তাতে বরং বিরক্তই হন অলোকেশ। তেতো গলায় বললেন, বুঝলেন না! লোকজনের পায়ে হাত, সাফ-সুতরো, ঘষামাজা এসবের মানে কী! মুচিগিরি ভাই, জুতো সাফাই। মোজা মিঞা আসলে মুচিগিরি করত। ওটাই তার আসল পেশা। মধুবনে সে কাজ নিয়েছিল স্রেফ আবু আলমকে মারবার জন্য। জাস্ট অ্যা ক্যামাফ্লাজ।
করত না হয়! তাতেই বা কী? মুচিগিরি করা কি কোনও অপরাধ? ইজ ইট অ্যা ক্রাইম, মিস্টার ডিটেকটিভ? ফের প্রশ্ন করেন ইন্সপেক্টর আলম।
উর্বী ও ইমরুল ভদ্রলোকের আইকিউ সম্পর্কে ব্যাপক সন্দিহান। এখনও যে কেন তিনি কেসটা বুঝছেন না! হোয়াটস রঙ উঈদ হিম?
আরে ভায়া, আপনার মনে নেই আবু আলমের খাবারে যে বিষাক্ত কেমিক্যাল পাওয়া গেছে তার নাম ইথিলিন গ্লাইকোল, যা কিনা জুতোর কালিতে পাওয়া যায়। বুঝলেন এবার?
ওহ্-হো-হো-ফো-ফো-ফো! এইবার বুঝেছি। বেটা তো বহুত চালাক! ধুরন্ধর! ধর শালারে! জানে আলমের নির্দেশ পেয়েই আমনি এসআই লক্ষ্মণ ও দুজন কনস্টেবল মিলে মোজা মিঞার দিকে তেড়ে যায়। মোজা মিঞা চাইলে আরও কিছুক্ষণ বাদানুবাদ করতে পারত, কিন্তু তা সে করেনি। কারণ সে হয়তো বুঝতে পারছে যে সে ধরা খেয়ে গেছে। তক্কো করেও মোজা মিঞা অবশ্য পার পেত না। কারণ ডিটেকটিভ অলোবেশ এরই মধ্যে কেসের পাকাপোক্ত প্রমাণ হিসেবে আবু আলমের ঘরের হাঁড়িকুড়ি ও দরজার গায়ে মোজা মিঞার আঙুলের ছাপ শনাক্ত করেছেন। সিআইডির ফরেনসিক টিম এলেই সেই ছাপ তুলতে পারবে। মোজা চালাক বটে, তবে খাবারে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর সময় হাতে গ্লাভস পরে নেয়নি।
লক্ষ্ণণের ধাওয়া খেয়ে পালাতে যায় মোজা মিঞা। কিন্তু তার বরাত খারাপ। সে পালাতে তো পারলোই না, উল্টো ডোর-ক্লোজারের জোরদার স্প্রিংয়ের ধাক্কা খেয়ে চিৎপটাং হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ভাবখানা এমন যেন সে স্বেচ্ছায় সমারসল্ট দিয়ে উল্টে পড়েছে।
ধর! ধর! ধর! ধর! ও যেন পালাতে না পারে। চেঁচিয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর জানে আলম। তার কাণ্ড দেখে উর্বী আর হাসি সংবরণ করতে পারে না। মাছ ধরলেন গোয়েন্দা অলোকেশ, আর খালুই পাতছেন ইন্সপেক্টর জানে আলম! হে হে হে!
সারাবাংলা/এসবিডিই
অরুণ কুমার বিশ্বাস অরুণ কুমার বিশ্বাসের বড়গল্প 'পুরনো পাপ' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ পুরনো পাপ বড়গল্প সাহিত্য