কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়
২১ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৫৫
একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রান্নাঘরের বাসনকোসন ভিম দিয়ে মাজার পর ট্যাপের নিচে ধরলে যেমন চকচক করে, সেরকম চকচক করছে চারপাশ। সোনাপুর রেল স্টেশনটা দক্ষিনমুখী। সকাল বিকাল মিলিয়ে তিনটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় এখানে। দক্ষিনমুখী হওয়াতে স্টেশনে বসলেই গায়ে হাওয়া খেলে যায়। স্টেশনের ডানদিকের কোণায় মতিন মিয়ার চায়ের দোকান। তবে শুধু চা-ই নয়, টোস্ট বিস্কুট, ড্রাই কেক, পান ও সিগারেট পাওয়া যায়। বিকেলে পাওয়া যায় পিঁয়াজু। পিঁয়াজু এখানে ভাজা হয় না, ভাজা মতিন মিয়ার বাড়িতে। রেললাইন পার হলেই যে বাড়িটা দেখা যায় সেটাই মতিন মিয়ার বাড়ি। কেউ পিঁয়াজু কিনতে আসলে হাঁক দিয়ে বলে, ‘লও, মিয়া, আমার বউ নিজের হাতে বানাইছে। ওই যে ভাজতাছে এখনো।’ যে দিকে নির্দেশ করে মতিন মিয়ার চোখ ও হাত, সেদিকে আসলে কিছুই দেখা যায় না। একটা বাড়ি, বাড়ির সামনে ঝুলন্ত তার আর তারের ওপর একটা লুঙ্গি ও শাড়ি শুকাতে দেওয়া ছাড়া।
স্টেশনে ঢুকেই মতিন মিয়ার দোকান থেকে দশ টাকার পিঁয়াজু কিনলো গৌরব। বৃষ্টির পরে পিঁয়াজু খেতে ভালো লাগে। খেতে কেমন হবে কে জানে! মুড়ি হলেও চলত। আশপাশে মুড়ি মাখানো কেউ বিক্রি করছে না। সিগারেট খাওয়া যায়। কিন্তু সিগারেট গৌরবের অভ্যাস নেই। শুধু কারও খাওয়া দেখলে খেতে ইচ্ছা করে এই যা। এখন ইচ্ছে করছে বেঞ্চিতে বসা ভদ্রলোককে দেখে। কি আরামসে সিগারেট টানছে। দেখে মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র সুখ এই সিগারেট টানায়।
বেঞ্চির আরেক প্রান্তে গিয়ে বসল গৌরব। পিঁয়াজু মুখে দিলো। একবার ঘুরে তাকালো ভদ্রলোক। গৌরবকে দেখে নিয়ে আবার মনোযোগী হলো সিগারেটের ধোয়া ছাড়ায়। এমন অজপাড়াগাঁয়ের স্টেশনে এমন কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক পাওয়া কঠিন। অনেকটা গ্রামের ছোট নদীতে হঠাৎ করে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ আটকে যাওয়ার মতো ঘটনা।
গৌরব আড়চোখে পাশের ভদ্রলোককে খেয়াল করল। বয়স তার মতোই। তবে দেখায় আরও কম। গৌরবের না কামানো গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিন্তু ভদ্রলোকের তা নেই। ক্লিন সেভ। চুল পাকতে শুরু করেছে গৌরবের। ক’দিন আগে মেহেদী দিয়েছে। এখন লাল দেখাছে। নদীর গতিপথ আটকে বাঁধ দিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপারটা। হতে চেয়েছে সাদা, হয়ে গেছে লাল। পাশের ভদ্রলোকের চুল কালো। গৌরব নিশ্চিত ‘কলপ’ দেওয়া।
পিঁয়াজু শেষ হয়ে এলে, হাতের ঠোঙাটা পাশের বিনে ফেলে গৌরব। এই অজপাড়াগায়ের স্টেশনেও একটা মলিন বিন আছে এটা ভাবতেই ভালো লাগে গৌরবে। আসার সময় মতিন মিয়ার দোকান থেকে সিগারেট আনে। বেনসন লাইট। কিন্তু ধরায় না। ইচ্ছা করেই। যাতে পাশে বসা ভদ্রলোকের কাছ থেকে আগুন চাওয়ার একটু সুযোগ পাওয়া যায়।
আবার বেঞ্চিতে এসে বসে গৌরব। ততক্ষনে পাশের ভদ্রলোকের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে। আগুন চাইলো গৌরব।
হাতের সিগারেটের শেষ অংশটা এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। সেটা দিয়ে কায়দা করে সিগারেট ধরালো গৌরব।
তারপর আগ বাড়িয়ে নিজের নামটা বলল। আমি গৌরব। গৌরব রহমান।
এ অবস্থায় বলে দিতে হয় না এবার তোমার বলো বাছা! ভদ্রলোকমাত্রই জানেন।
আমি শরীফ। শরীফ রায়হান। বলেন ভদ্রলোক।
এখানে?
আমার স্ত্রী আর সন্তান আসবে। ওদের নিতে এসেছি। ট্রেন নাকি ৩০ মিনিট লেট।
ওহ। আমার কোনো কাজ নেই। ভাবলাম বসে যাই। লোকাল?
না, মেইল ট্রেন।
হেসে ওঠে গৌরব। আমি আপনার কথা জিজ্ঞেস করছি। এই এলাকাতেই বাড়ি?
এবার হেসে ফেলে শরীফ রায়হানও। নাহ, আমি বদলি হয়ে এসেছি।
ওহ। আস্তে করে বলে দম নেয় গৌরব। আশা করে ভদ্রলোক হয়তো পাল্টা কোনো প্রশ্ন করবে। করে না। শরীফ রায়হানের কোনো আগ্রহ নেই। গৌরবই সরব হয়। আমি একটা গল্প বলতে চাই আপনাকে?
জি? উৎসুক চোখ নিয়ে তাকায় শরীফ রায়হান।
জি, একটা গল্প। শুনবেন? ত্রিশ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
কেমন গল্প?
আমার নিজের গল্প। একদম ব্যক্তিগত। শোনেন।
আচ্ছা বলুন। নড়ে চড়ে বসে শরীফ রায়হান।
সিগারেট ধরান আরেকটা। বেশি থাকলে আমাকে দিয়েন একটা।
শরীফ রায়হান পকেট থেকে দুটি সিগারেট বের করেন। একটা বাড়িয়ে দেন গৌরবের দিকে। লাইটার বের করে ধরিয়েও দেন।
শাঁ করে কয়েকটা পাখি উড়ে যায়। যেন পাখিদের ঘরে ফেরার তাড়া।
গল্প শুরু করে গৌরব। আমি তখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করেছি। বড় চাকরি না। ছোটখাটো। একটা দেশীয় কোম্পানির এসআর মানে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় আমার চাকরি। সেখানে একা থাকি। আর দোকানে দোকানে মালের অর্ডার নেই। রাতে সেই অর্ডার হেড অফিসে পাঠিয়ে দিই।
বাহ। ভালো চাকরি।
হুম। আসলেই ভালো ছিল ওই সময়টা। চাকরির চেয়ে সময়টা ভালো। তারপর কি হলো শুনুন।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দেয় গৌরব। তারপর আবার বলা শুরু করে।
একদিন বিকেলে একটা মার্কেটে ঢুকে কাজ সেরে বের হচ্ছিলাম। মোবাইলে টাকা নেই। আশপাশে তাকিয়ে একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকানে গেলাম। বেশ ভিড়। আমার আগে দুজন তরুনী। তার আগে একটা ছেলে। ছেলেটার নম্বর লেখা শেষ হওয়ার পর তরুনী নম্বর বললেন। শেষ করে টাকা দিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। এক মুহুর্ত দেরি না করে একা বের হয়ে গেলেন। বুঝলাম দুজন আলাদা। আমি সরে এসে বের হওয়ার জায়গা করে দিলাম। কিন্তু কি বুঝে যেন আমি বের হয়ে গেলাম। হুট করে মনে হলো আমার মোবাইল নম্বর আমি ভুলে গেছি। ফ্লেক্সিলোডওয়ালার কাছে আমি কিছুই বলতে পারব না। আমিও বের হয়ে আসি দোকান থেকে। আমি খেয়াল করি, আমার মাথা জুড়ে সম্ভবত এটা মন জুড়ে হবে- শুধু ওই মেয়েটা। যে মেয়েটা ঘোর লাগা এক সন্ধ্যার মতো করে আমার দিকে তাকিয়েছিল। মফস্বলে এমন স্মার্ট মেয়ে দেখা পাওয়া কঠিন। আমি অন্তত দেখিনি। এ কারণেই কিনা আমার চোখ আটকে গেল। মেয়েটির পিছু নিলাম। জানি কাজটা খুব খারাপ হচ্ছে। তবুও, পিছু নিলাম। মেয়েটির পেছনের অবয়ব তখন আমার চোখের সামনে। কবিরা যে দীঘল কালো চুল দেখে কবিতা লেখে কিংবা পাড়ার তরুণেরা যে চুল দেখে হুট করে প্রেমে পড়ে যায়, যে চুল নেশাগ্রস্থ করে দেয় সেরকম চুল মেয়েটার। হেঁটে গিয়ে রিকশায় উঠলো সে। আমি রিকশা অবধি গেলে দ্বিতীয়বার মুখটা দেখার সুযোগ হলো। কি মায়াবী। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছা করে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে যে ধরনের মুখ, ঠিক সেরকম একটা মুখ তার। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা যেন বাড়তি সৌন্দর্য তৈরি করেছে। মেয়েটি উঠে বসার পর রিকশা চলে যায়। আমি তাকিয়েই থাকি। আরেকটা রিকশা নিয়ে পিছু নেব কিনা ভাবছি। ততক্ষনে চোখের আড়ালে চলে গেছে মেয়েটির রিকশা।
গল্প বলতে বলতে একটু থামে গৌরব। তাকায় শরীফ রায়হানের দিকে। জানতে চায়, বাকিটুকু শুনতে চায় কিনা। শরীফ রায়হানের কথায় শোনার আগ্রহ আছে এটা বোঝা যায়। জি বলুন। ভালো লাগছে।
আবার শুরু করে গৌরব।
তারপর আমি ফিরে আসি সেই ফ্লেক্সিলোডের দোকানে। মোবাইলে পঞ্চাশটা টাকা ভরাই। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে মেয়েটার নম্বর চাই দোকানদারের কাছে। দেওয়ার কোনো কারণ নাই। খাতির জমাই। পরেরদিন আবার যাই দোকানে। এবার বন্ধু বানাই তাকে। অবশেষে দেয় ছেলেটা। আমারই বয়সী তো। সম্ভবত বোঝে আমার মনের অবস্থা।
বাহ, এবার তো তাহলে আর টেনশন নাই? গৌরব থেমে যাওয়ার পর বলে শরীফ রায়হান।
আসলেই টেনশন ছিল না সেদিন। নম্বর পেয়ে সেদিন রাতে ভয়ে ভয়ে মেসেজ দিলাম একটা। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরতি মেসেজ। এভাবে দুদিন চললো মেসেজ আদানপ্রদান। তৃতীয় দিন সাহস করে কল। কি কন্ঠ। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চলতে থাকল আমাদের কথাবার্তা। জানলাম সে ওখানে তার চাচার বাসায় বেড়াতে এসেছিল। কয়েকদিন পর চলে গেছে। কিন্তু আমাদের কথা চলে যায় নাই। চলতে থাকে।
কথা বলতে বলতে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া হয়ে যায়। তারপর প্রেম। একটা লাজুক হাসি হেসে বলে গৌরব।
তাই তো হওয়ার কথা। বলে নিঃশ্বাস ছাড়ে শরীফ রায়হান। এরপর নিশ্চয় দেখা করা এবং বিয়ে।
উহু। একটু উল্টাতে হবে। বিয়ে এবং দেখা করা।
মানে?
মানে, দেখা করতে চাই দুজনই। কিন্তু কি করে জানি দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই আমাদের দেখা হবে বাসরঘরে। তার আগে নয়।
আমি রাজি হয়ে যাই। বাবা-মাকে জানাই। সে-ও জানায়। দুজনই যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক এবং আমাদের বাবা-মাও তুলনামূলক আধুনিক তাই অমত করেন না। প্রেমের বছরখানেকের মাথায় একটা বৃষ্টিমূখর সন্ধ্যায় আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।
সত্যি সত্যি আমাদের দেখা হয় বাসরঘরে। তখন নিশ্চয় আপনার অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছিল? জানতে চায় শরীফ রায়হান।
আমার হৈমন্তী গল্পের সেই নায়কের মতো অবস্থা হয়েছিল। কি যেন নাম?
অপু?
হু, আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম টাইপ অনুভূতি।
আচ্ছা। দারুন। তারপর তো সুখে শান্তিতে বসবাস করা শুরু করলেন। এই গল্পটা এমন কি আহামরি বলেন। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলেন শরীফ রায়হান।
এখনো শেষ হই নাই শরীফ ভাই। শেষ করি?
হুমম করেন বলে দ্বিতীয়বার আগ্রহ নিয়ে তাকায় শরীফ রায়হান।
আমি বাসরঘরে গিয়ে যে মেয়েকে আবিস্কার করলাম সেটা ওই মেয়ে নয়। সম্ভবত দুই তরুনীর অন্যজন। কিন্তু তখন আমার কিছুই করার নাই। না চিৎকার চ্যাঁচামেচি, না মেয়েটিকে কিছু বলা। এমনকি শোধরানের কোনো সুযোগ। এ কারণে আমি ওরকম ভুল মানুষের সঙ্গে সংসার করে যাচ্ছি সাড়ে পাঁচ বছর হলো।
বলেন কি?
হু। বলে চুপ হয়ে যান গৌরব।
ততক্ষণে ট্রেনের হুইসেল পড়ে। নিরব স্টেশন হঠাৎ সরব হয়ে যায়। শরীফ রায়হান তাকিয়ে থাকে গৌরবের দিকে। গল্পের শেষটুকু শুনবে হয়তো!
আমাদের তিন বছরের একটা ছেলে আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমার গল্পটা কোনো অচেনা মানুষকে বলতে ইচ্ছা করে। বলিও! আজ আপনাকে বললাম। মনটা কয়েকদিনের জন্য হালকা হয়ে গেল সম্ভবত।
শরীফ কোনো কথা বলে না। হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের স্ত্রী ও সন্তানের আসার সময় হয়েছে। উঠতে হবে। ততক্ষনে ট্রেন এসে দাঁড়ায়। বিদায় নেয় গৌরব। স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় একবার পেছন ফিরে তাকায়।
শরীফ রায়হানের স্ত্রী নেমেছে। কোলে ছোট্ট একটা শিশু। এক বছর সম্ভবত। শরীফ রায়হানের হাতে ব্যাগ।
গৌরব ফিরে তাকাতে গিয়ে ঘুরে ওঠে।
পাঁচ বছর আগে রিকশায় দেখা মেয়েটা না! চুলটা তো আগের মতোই আছে।
দ্রুত স্টেশন ছেড়ে মতিন মিয়ার বাড়ির গলিতে ঢুকে পড়ে গৌরব।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অপূর্ণ রুবেল অপূর্ণ রুবেলের গল্প 'কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায় গল্প সাহিত্য