Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফিরে আসা কমলালেবু


২২ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:০৭

প্রচন্ড জ্বরে প্রলয় বকছে আসাদ, গভীর রাতে এসেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালতে হবে বলে কোথায় যেন ছুটে গেলেন উকিলউদ্দিন। মনোয়ারা বেগম অন্য কোনো সময় হলে চিল্লাচিল্লি করা শুরু করতেন। যে এতো রাতে এই বিদেশবিভূঁই, তুমি বালতি কই পাবে, মগ-ই বা কই পাবে, আর এই বিদেশি হাসপাতাল কি মাথায় পানি ঢালতে দেবে, তোমার কি আক্কেলজ্ঞান কোনোদিন হবে না… ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু না, মনোয়ারা বেগম উৎকণ্ঠায় ভরা চোখে তাকালেন। সজোরে হেঁটে যাচ্ছেন উকিলউদ্দিন। পাবে তো একটা বালতি আর মগ? জ্বর নামাতে হবে নইলে…! ভাবতে ভাবতে বোতলের খাবার পানি দিয়ে আসাদের কপাল মুছে দিতে থাকেন তিনি। সিস্টার আসছে না কেন? আসাদকে একা ফেলে ডাকতে যেতে ভয় পাচ্ছেন মনোয়ারা বেগম।

বিজ্ঞাপন

‘একটা বালতি হোয়েগা? আর একটা মগ মিলতা হায়?’ উকিলউদ্দিনের প্রশ্ন ছিলো রাতে খোলা থাকা একটা দোকানে। হিন্দিটা এখনও রপ্ত করতে পারেননি। আসলে ডিশের লাইনটা নিয়েই নেওয়া উচিত ছিলো। আকাশসংস্কৃতি খারাপ ঠিক আছে, কিন্তু তখন গোটাকয়েক ‘কাহিনী ঘার ঘার কি’-এর কয়েকটা পর্ব দেখলে আজ এই ‘হোয়েগা’ আর ‘মগ মিলতা হায়’ এর খপ্পরে পড়তে হত না। দোকানদার চিড়িয়াখানার কোনো জীব দেখছে এমনভাবে তাকাল উকিলউদ্দিনের দিকে। দোকানদার হিন্দি জানো রিলেটেড জ্ঞান দিতে যাবে, এমন সময় করজোড়ে হাত জুড়লেন উকিলুদ্দিন। চোখের পাশ দিয়ে পানি পড়তে লাগল তার। ‘একটাই লাড়কা আমার, অনেক বুখার, অসুস্থ আমার বাবাটা। একটু মাথায় পানি দেওয়ার কিছু হবে ‘ ভাঙা গলায় বলে চললেন উকিলউদ্দিন। দেশের চাকরি, সব বাধার- কোনো পরোয়া না করে তিনি ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছেন এই অপরিচিত দেশে, করজোড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। একটা মগে আসাদের মাথায় পানি ঢালতে হবে, একটাই ছেলে তার। সব কিছু তার ওকে ঘিরে।

বিজ্ঞাপন

সোডিয়াম লাইটের আলোগুলো কেমন জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল সে সময়। অদ্ভুত আলো উকিলউদ্দিনের চারপাশে। প্রকৃতির সকল আলোকবিন্দু শো শো বেগে চলে আসছে! ঘিরে ধরছে পুত্রের জীবন বাঁচাতে দাঁড়িয়ে থাকা পিতাকে, কারণ তাকে উজ্জ্বলিত করতে হবেই যে। নয়তো ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে না। এত স্নেহ আর ভালবাসাকে প্রকৃতি উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। নক্ষত্ররাও জ্বলে ওঠে প্রবলভাবে। সাক্ষী হয়ে থাকল প্যারেল স্ট্রিটের এক দোকানদার।

বালতি মগ নিয়ে হাসপাতালের লিফটের সামনে উকিলউদ্দিন। লিফট রাতে একটা বন্ধ করে রাখে, আরেকটা নামতে নামতে, নাহ, সে সিঁড়ি বাইতে শুরু করেন। একতলা, দুইতলা, তিনতলা, চারতলা… এইতো, পাঁচতলা… ছয়তলা…।

বালতি হাতে, আরেক হাতে মগ। আসাদের বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন উকিলউদ্দিন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার বাম হাত কাঁপছে। ভাঙা গলা দুবার ডাকলেন মিনু। মিনু বলে মনোয়ারা বেগমকে। কিন্তু সেই শব্দ বেরোতে চাচ্ছিল না, গলায় দলা পাকিয়ে আটকে আছে কিছু যেন।

আসাদের বেড খালি।

আসাদ কোথায়! আমার বাবা! শব্দ পেয়ে জেগে ওঠে আসাদের বেডের পাশে থাকা বেডটির লোক। তার ছেলেও ভর্তি, আয়ুশ পান্ডে, মধ্যপ্রদেশের মানুষ। সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালে সে গুটকা খায়। সাহসী লোক, মনও বড়। আয়ুশ পান্ডের বাবা উকিলউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমহারা লাড়কাকো আইসিইউমে শিফট ক্যার দিয়া। বহুত খুন নিকাল রাহা থা।’

আসাদ আইসিইউতে।

সাল ১৯৯৯, স্থান মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল এর পেডিয়াট্রিক অনকোলোজি ওয়ার্ড। সময় ভোর হবে হবে, দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোর হলেই ঈদের দিন। শেষ সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গিয়েছিল কি না সঠিক জানেন না উকিলউদ্দিন সাহেব, দেশে উনি একবার উড়ন্ত প্লেন দেখে চাঁদ চাঁদ বলে লাফিয়ে উঠেছিলেন একবার। গত রোজার সময়, ইফতারের আগে ইফতার চাইতে আসা এক বৃদ্ধার ‘আল্লার নামে ইফতার দেন…’ পুরোটা না শুনে আল্লাহটুকু শুনেই ঢক ঢক করে পানি খেয়ে পিঁয়াজুতে দুই কামড় দিয়ে মুড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে, বুট নিয়ে মাখানোর মধ্যেই খেয়াল করলেন মাত্র আজান দিচ্ছে। যা হবার তো হয়েই গেছে ততক্ষণে। আসাদের বয়স তখন সাত, হাসতে হাসতে সে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, এত বোকা বাবা মানুষের হয়! অদ্ভুত এক লোককে সে বাবা হিসেবে পেয়েছে। আসাদের হাসি থামেই না, মনোয়ারা বেগম বললেন, এত হাসে না, বিপদ আনবি নাকি। আসাদ হেসেই চলে। মনোয়ারার মূখেও হাসি, জীবনে আর কিছু তেমন তার চাওয়ার ছিলো না। ছোট্ট একটা সংসার, স্বামী-সন্তান এই তো।

কিন্তু মানুষের সুখের মাঝেও চলে আসে প্রকৃতি। ভারসাম্য রাখতে হয় যে স্রষ্টার ইশারায় আসতে হয় তাকে। এত সুখ একটা ঘরে দেওয়া যাবে না, কমাতে হবে। হাস্যোজ্বল পরিবারটির ঘরের আলো একটু কমে আসে। আলোর সাথে সাথে দিনে দিনে কমতে শুরু করে আসাদের হাসি।

সাল ১৯৯৮ এর শেষের দিক। স্থান ঢাকা, একটা ছোট্ট সংসারের ছবি। সাদা টকটকে একটা ছেলে হাসছে, সাথে হাসছে বাবা। মা না হাসার ভান করে আছেন, কিন্তু মা আল্লাহর কাছে একটাই জিনিস চাইছিলেন, আমার সংসারটা যেন এমনই থাকে। এই, হাসা বন্ধ করো, বুট নাও… আরো মৃদু ধমকে স্বামীকে বললেন মনোয়ারা বেগম। এতে নাকি গভীর ভালবাসা আছে, উকিলউদ্দিন বলেন। মৃদু ধমক হলো অত্যন্ত গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। মনোয়ারা বেগম এগুলো শুনে ঠোঁট বাঁকান। আসছে ভালবাসার ঢেঁকি!

উকিলউদ্দিনের সাথে তার বিয়ে কখনোই হবার কথা ছিলো না। বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার ডিভি লটারি জেতা একজনের সাথে। উকিলউদ্দিনের মামাতো ভাইয়ের সাথে। আমেরিকা যাবে, ডলার কামাবে, কোনো অভাব থাকবে না। কিন্তু উকিলউদ্দিন ব্যাপারির বাবা মোহাম্মদ লালমিয়া ব্যাপারি একটা প্যাঁচ খেললেন। তার মেয়ে পছন্দ হয়েছে, ওকির জন্য তিনি মেয়ে ঠিক তো করলেনই, সে দিন রাতেই কাবিন টাবিন করে বিয়েশাদি শেষ।

মনোয়ারা বেগমের ভাইবোনরা তখন উত্তপ্ত, দেশের বাড়িতে কান্নাকাটি। উকিলউদ্দিনরা ৫ ভাই, ৪ বোন এবং তিনিই সবার বড়। বিএ পরীক্ষায় পেয়েছে থার্ডক্লাস, হাসিমুখে সেটা জানানোর পর ঠাস করে চড় বসিয়েছিলেন লাল মিয়া ব্যাপারি। তবে চড় কি দিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপারটা বিতর্কিত। উকিলউদ্দিন বলেন, হাত নয়, স্যান্ডেল দিয়ে দিয়েছিল। কারণ চড় খেয়ে তিনি স্যান্ডেল টুকিয়ে তুলেছিলেন। মনোয়ারা বেগম এই মতবাদে ছিটেফোঁটাও বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, স্যান্ডেল? স্যান্ডেল কেনার টাকা থাকলেই তো স্যান্ডেল দিয়ে মারবে। উকিলউদ্দিন কখনওই এসব কথায় মন খারাপ করেন না।
মনোয়ারা বেগম ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স এবং ডাবল মাস্টার্স করা মেয়ে। বিএড করা শেষ, বিসিএস দেবেন এমন সময়। হ্যাঁ, এমন একটা সময়, এক রাতে মনোয়ারা বেগম কেন যেন কবুল বলে ফেললেন। বারোজনের পরিবার চালানো বড় ছেলেকে গ্রহণ করলেন স্বামী হিসেবে, বিদেশের হাতছানি ভুলে গিয়ে স্বীকার করলেন ভিটেমাটি বন্ধক রাখা পরিবারের ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিলেন। সারারাত ভেবেছেন তিনি। ইকোমিক্সে অনার্স করা মাথা কি না! উকিলউদ্দিন সাহেব কি তার পাশে বসে ছিলেন! উঁহু, ওগুলো ছায়াছবিতেই হয়। বাস্তবে উকিলউদ্দিন ছিলেন না বাসররাতে। বাসর বলা চলে না যদিও এটাকে। উকিলউদ্দিন লাল মিয়া ব্যাপারিকে দেশের বাড়ি পৌঁছে দিতে গেছেন।

সাল ১৯৮৬। স্থান ঢাকা। সময়টা আবার গুরুত্ব দিতে হবে। ভোর শেষ হবে হবে। শেষ রোজায় বিয়ে হয়েছিল তাদের। সকালে ঈদ, একজন নববধূর জীবনের প্রথম ঈদ।

হ্যা, আসাদকে আইসিইউতে ফেলে রেখে এসেছি, মনে আছে। ভুলিনি। থাকুক একটু আইসিউতে, কারণ সময়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, দিনটা আসাদের জীবনের একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায়ের সুচনা করতে যাচ্ছে যে! প্রকৃতি তার আপন নিয়মে কাজ করে চলছে, এখানে বাধা দেওয়া যাবে না!

শীতের রাত, অখ্যাত একটি ক্লিনিকে প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছেন মনোয়ারা বেগম। কোন পেথেডিন নেই, ক্লিনিকের ব্রাদারগুলো আসক্ত নেশায়। তারা বাইরে থেকে কিনে আনা সব ব্যথানাশক নিয়ে গেছে চুরি করে। মনোয়ারা বেগমের পাশে অপরিচিত এক ভদ্রমহিলা। উনি উকিলউদ্দিন সাহেবের সহকর্মীর স্ত্রী।

উকিলউদ্দিন সাহেব মনযোগ দিয়ে হিসেব করছেন। দিনশেষে হিসাব না মিলিয়ে ওঠাই যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কথা। কিন্তু মিলছে না, আদানপ্রদান সমান আসছে না। না আসলে…, ওটা আর চিন্তা করতে চাইলেন না তিনি। ভাইবোনগুলোকে পড়াশুনা করানোর অনেক চেষ্টা করছে। ব্যাংক থেকে যত প্রকারের লোন আছে নেওয়া শেষ। ভিটেমাটি বন্ধক দেওয়া, ছাড়িয়েছেন। মোহাম্মদ লাল মিয়া ব্যাপারি হাটে যান একদিন। একটা বড় মাছের চারপাশে সবাই জটলা পাকিয়ে আছে। তিনিও এগোলেন, বাহ, অনেক বড় মাছ। দেশের মানুষের যে স্বভাব, কেউ একজন টিটকারি মেরে বসে, তার মাছ কেনার আদৌ টাকা আছে কি না। কথিত আছে তিনি সরাসরি বন্ধক রাখেন ভিটার জমি ও তার পাশের কিছু সুপারি বাগান। টাকা নিয়ে তারপর মাছ কেনেন, মাছ এতটাই বড় ছিলো এটা জন্য নাকি আলাদা ভ্যানের প্রয়োজন হয়েছিল। থাকবার জায়গা বন্ধক রেখে রাতে আয়েশে মাছ খেয়ে ঘুমুতে যান তিনি। জমির কি হবে! উত্তর ছিলো, ওকি আছে না? ও জমি ছাড়াবে।

হ্যা, উকিলউদ্দিন সাহেব তাই করছেন। হিসেব মিলাচ্ছেন। ল্যান্ডফোনের যুগ, সেটাও বড় স্যারের কাছে, রাত্র ৪টায় একটা ইমারজেন্সি সিজার হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। বাচ্চা পেটেই ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছে, নাড়ী গলায় পেঁচিয়ে আছে। প্রিম্যাচিউর একটি সন্তানের বাবা হন একা অফিসে হিসেব করতে থাকা উকিলউদ্দিন। তাড়াতাড়ি করে কারা যেন নিয়ে গেল বাচ্চাকে। আধোআধো শুনতে পেলেন, বাঁচবে না। বাচ্চা বাঁচে কি-না তা নিয়ে সবার যথেষ্ট সন্দেহে আছে সবার! কিন্তু না, তারা কেউ জানে না, ‘Thrive to live’ বাক্যটিকে আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবন চলবে শিশুটির। Thrive……… বেঁচে থাকার প্রচন্ডতম ইচ্ছা। শিশুটির সংগ্রাম শুরু হলো। তার নাম রাখা হলো, আসাদ।

ফুসফুস ইনফেকশন নিয়ে কোনো একটা ইনকিউবেটরে আছে আসাদ। যুদ্ধ যে সবে শুরু। উকিলউদ্দিন সকালে এসেছেন অপরাধীর মতোন, ভেতরে ভেতরে গভীরভাবে আনন্দিত। মনোয়ারা বেগম তাকে দেখে কিছু একটা ছুঁড়ে মেরেছিলেন, উকিলউদ্দিন সেটা ফ্লোর থেকে তুলে আবার যখন মনোয়ারা বেগমের হাতের কাছে রাখতে যাবেন, পাশের আয়ারা তাকে বিদেয় করে দেন, ছেলে দেখতে যেতে বলেন। ছুঁড়ে মারা জিনিস যে আবার ফেরত দেয়, তার জগতে বিভিন্ন কাজ থাকলেও, আপাতত ঐ খানে কোনো কাজ নেই।

ইনকিউবেটরগুলোতে অনেকগুলো বাচ্চা। উকিলউদ্দিন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাচ্চা চিনবেন কীভাবে? এমন তো নয় যে বাচ্চা তাকে দেখে বাবা বাবা বলে ছুটে আসবে। বাচ্চাদের হাতে না নম্বর দেওয়া থাকে! কয়েক বাচ্চার আছে, কয়েকজনের নাই। সারারাত হিসেব করে এসে এখন সংখ্যা মেলাতে মাথা ঘুরাচ্ছে। এক খালাকে ৫০ টাকা দিয়ে উকিলউদ্দিন সাহেব বসলেন।

স্থান: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। দিন: কোনো এক শুক্রবার এবং ঈদের দিন।

কেউ একজন মিষ্টি খাওয়াবেন বলে ২০০ টাকা নিয়ে চলে গেল উকিলউদ্দিনের কাছ থেকে, আর আসলো না। তাই নিজ গরজে বের হলেন মিষ্টি কিনতে। সবাইকে খাওয়ালেন, হঠাৎ মনে হলো বাচ্চার কানে আজান দিতে হবে। কিন্তু, বাচ্চা কোনটা! উকিলউদ্দিন সাহেব অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। সব বাচ্চার কানে আজান দেওয়া শুরু করলেন। আয়া সিস্টার বলে, আরে আরে, এটা তো মেয়ে বাবু। তিনি কাঁচুমাচু করে আরেক বাচ্চার কানে আজান দেন। ওদিকে বাকি বাচ্চার বাবা মা তো আগুন, আমার ছেলের কানে আমি আজান দেব, উনি কে! এদিকসেদিক হয়ে, তার চোখ গেল একটা বাচ্চার উপর। তার চোখে পানি চলে আসলো। সংখ্যার কোনো দরকার নেই! ঐযে, ঐটা আমার ছেলে… আসাদ। সিস্টারের কাছে ছেলেকে রেখে উকিলউদ্দিন মসজিদে গেলেন। ছেলের জন্য, ছেলের মায়ের জন্য দোয়া করতে থাকলেন।

উকিলউদ্দিনের জীবনের সবটুকুজুড়ে বসবাস করবে এই আসাদ। এই ছেলেকে কোনদিন তিনি কষ্ট দেবেন না। কোনোদিন কিছুর অভাব বুঝতে দেবেন না। কিন্তু উকিলউদ্দিনের জানা ছিলো না, আসাদের আগমন পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টির জন্য।

মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার এন্ড রিসার্চ হাসপাতাল। আইসিইউ গেট। ভেতরে যাওয়া যাবে না। আর ব্লাড ক্যান্সারের বাচ্চাদের তো ধরাও যাবে না। উকিউদ্দিন সাহেব একটি ক্ষমতা পেয়েছেন আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি মোটামুটি সব ম্যানেজ করে ফেলেন কিভাবে যেন। মনোয়ারা বেগমের ধারনা এইটা তাদের রক্তে মিশে আছে। হিপনোটিজমের মত কিছু। নইলে মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বলে সে রাতে কিভাবে বিয়েও করায় মানুষ!

তো উকিলউদ্দিন সাহেব কয়েছেন কি, বালতি আর মগ কিভাবে কিভাবে যেন আইসিইউ এর ভেতর পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওখানে একটা প্রটোকল থাকে, দেশের মত অবাধ যাতায়ত সম্ভব না। বালতি আর মগ কিভাবে দিয়েছেন সেটা রহস্য। আইসিইউ থেকে ডাক্তার বের হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি, এগুলো কে পাঠিয়েছে, বালতি মগে জীবাণু থাকে, কৌন হে-ও?

উকিলউদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, ডাক্তার ঠিক বলতা হ্যায়, কুন হে লোক বালতি পাঠাইছে! শুনে ডাক্তার আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, লিসেন, দিস ইজ নট এ জোক। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস।

তারপর ডাক্তারকে বললেন, এরা আর করতা নেহি হ্যায়।

মনোয়ারা বেগম নাটক দেখলেন। অদ্ভুত লোককে সে হ্যাঁ বলেছে, যে বালতি মগ পাঠায় ছেলের জন্য আইসিইউতে! বোধহয় এজন্যই এই লোককে স্রষ্টা তার জীবনসঙ্গী বানিয়েছে।

আসাদকে বিকেলে বেডে দেবে। তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে। ইনফেকশন হলে আর রক্ষা নেই। ব্লাডক্যান্সারের বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে। আসাদের অন্যরকম সেবা শুরু। মেথি, বিট, গাজর সেদ্ধ করে তার রস ছেঁকে খাওয়ানো এর মধ্যে একটি। কে বা কারা এটা বলেছে যে এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। দিনে দুইবার করে এগুলো চলছে। সাথে মাস্ক, যেটা কোভিড আসার পর সবাই পরা নিয়ে পক্ষবিপক্ষে হাতাহাতি মারামারি জেল জরিমানা করেছে। তবে আসাদ মাস্ক পরে সেই ৭-৮ বছর বয়স থেকে।
এরপর, আসাদ বদলে যাওয়া শুরু করল। অনেক গভীর চিন্তাতে ডুবে থাকত সে। নিজেকে গুটিয়ে নিলো বলা ঠিক হবে না, নিজেকে গোটাতে হলো। কারণ আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মত তার ধুলোবালিতে যাওয়া নিষেধ। আরও কত-শত নিষেধাজ্ঞা। আসাদ জীবনের সব শখ-চাওয়া থেকে দূরে চলে গেল। সে ডায়রি লেখা শুরু করল। দীর্ঘদিন তার কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি চলল। আসাদ একটি একটি প্রতিজ্ঞা করেছে হাসপাতালের বেডে শুয়ে। সেটা কী পূর্ণ হয়েছে? দেখা যাক!

এরপর কী হলো? সুখে শান্তিতে সবাই বসবাস শুরু করল! উঁহু, শব্দটা ভুলে গেলে চলবে না; ‘Thrive to Live’। হঠাৎ করে ইনফেকশন হোক বা ট্রান্সপ্লান্ট রিজেকশনের জন্য হোক, একটি একটি করে শিশু মারা যেতে থাকল পেডিয়াট্রিক অনকোলোজি বিভাগে। প্রথমে আয়ুশ পাণ্ডে মারা গেল আসাদের চোখের সামনে। ৮-১০ বছরে কেউ যখন এই কষ্টের মৃত্যু দেখে, তাকে বদলে যেতে হবেই। আয়ুশ পাণ্ডের বাবা ছেলের লাশ কোলে নিয়ে চলে গেলেন। উকিলউদ্দিন সাহেব ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছিলেন তাদের। সেইরাতেই একসাথে মারা গেলেন তিনজন। রাতে তিনি স্ত্রীর সাথে কথা বলে ঠিক করলেন, এখানে আর নয়, বাকি সব ঢাকাতে। এখানে থাকলে… কিন্তু ভিসা? সে গল্প অন্য কোনোদিন।

শেষ দৃশ্য:

সাল ২০২২। স্থান: ঢাকার কোনো এক হাসপাতাল। ঈদের দিন সকালে।

৯ বছরের লিউকোমিয়ার পেশেন্টকে কেমো দিচ্ছে একটি ডাক্তার ছেলে। আর গল্প করছে বাচ্চাটির সাথে। একেকটা কেমোর দাম অনেক। তার ওপর প্রপার হাইজিন মেইন্টেইন করতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। আর গল্প করছে, নইলে একটু পর বমি করে পুরোটাই নষ্ট হবে। রোগীর বাবা-মাকে মাস্ক পরিয়েছে, বাচ্চাকেও। কেমো দেওয়ার পর ফাইল নিয়ে বসল ছেলেটি। রোগের নামটি লিখে রাখল তার ডায়রিতে। একটা কেমোথেরাপির চার্জ বেশ ভালই। এই চিকিৎসক কি নিয়েছিলেন টাকাটা? তার জানা নেই।

রোগীরা জিজ্ঞেস করছে, ঈদে বাড়ি যাননি? ডাক্তার ছেলেটির অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ঈদের দিন আমার হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল, আমি এখানেই ছিলাম এবং থাকব। কতটা পথ এই ডাক্তার পাড়ি দিয়েছে, তা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই এত কথা না বলে, সে পাশ কাটিয়ে যায়। ক্যান্সারের রোগী যখন বলে, আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না; তখন সে বলে- জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকার আনন্দে আনন্দিত হন। কোন রোগীরাই এটা বোঝে না।

ছেলেটা কাজ করে চলে। রোগির ফাইল খোলে, যদি মিলে যায়, তবে টুকে রাখে ডায়রিতে। জীবনের গভীরতম রহস্য সে অনুভব করেছে। সে জানে সব মিথ্যে। সব মোহ। শুধু সে জানে জীবন সুন্দর, ‘Thrive to Live’।

পরিশিষ্ট:
“ একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে!
আবার যেন ফিরে আসি
কোনও এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনও এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।”
কমলালেবু/ জীবনানন্দ দাশ

পাদটিকা ১: উকিলউদ্দিন সাহেব ৬ ঘন্টার ভেতর বাংলাদেশের ভিসা করিয়ে আসাদকে ঢাকা আনেন।

পাদটিকা ২: আসাদের সাথের যে কয়জন চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের ভেতর শুধু আসাদ এবং আরেকজন ইন্ডিয়ান ছেলে বেঁচে আছে।

পাদটিকা ৩: আসাদের সাথে এখনও কথা হয় ছোটবেলার দেশ ও বিদেশে তার চিকিৎসা করা চিকিৎসকদের সাথে।

পাদটিকা ৫: কাল্পনিক আসাদের জীবনের ১০০ ভাগের ১ ভাগ বর্ণনা রইল।

পাদটিকা ৪: আসাদ এবং উপরোক্ত সকল চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনও মিল নেই, পেলেও তা কাকতালীয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প তানজির ইসলাম বৃত্ত তানজির ইসলাম বৃত্তের গল্প 'ফিরে আসা কমলালেবু' ফিরে আসা কমলালেবু সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর