ঈদগাহ
২২ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:১২
উর্দু মূল: মুন্সি প্রেমচাঁদ, অনুবাদ: এহছানুল মালিকী
রমজান সম্পূর্ণ তিরিশটি দিন পেরিয়ে অবশেষে ঈদ এল। ঈদের সকালটা কত মনোরম, আর কতই না সুন্দর। যেদিকে দু চোখ যায় সারি সারি তরুবীথির ওপর সবুজের অপূর্ব সমারোহ। ক্ষেত-খামারগুলো হরিৎ-শ্যাম শোভায় শোভিত, গোলাভর্তি ধান। মেঘমুক্ত আকাশ নীল নীলিমায় ছেয়ে আছে। অন্যদিনের চেয়ে আজকের ভোর হওয়ার দৃশ্যটা অনেক বেশি সুন্দর, আজকের পূর্বাকাশের সূর্য অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি মিষ্টি-মধুর। আর রৌদ্রের কোনও প্রখরতা নেই, শান্ত শীতল, এভাবেই যেন সে বিশ্ববাসীকে ঈদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। গ্রামের মানুষজনও কোলাহলমুখরিত হয়ে তাদের মধ্যে উৎসবের ঢল নেমেছে মহাসমারোহে। ঈদ্গাহে যাবার জন্য ধূম পড়ে গেছে। তোড়জোড় চলছে মহা-উদ্যমে, সবাই ব্যস্ত। কারওর জামার বোতাম নেই, বোতাম লাগাবার জন্যে পাড়াপড়শীর বাড়িতে ছুঁচ-সুতো আনতে ছুটছে। কারওর জুতো শক্ত হয়ে গেছে। তাতে তেল লাগিয়ে নরম করার জন্যে তেলির বাড়ি ছুটছে। তাড়াতাড়ি বলদগুলোকে খাবার খাইয়ে নিচ্ছে।
ঈদগাহ থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেতে পারে। তিনক্রোশ পথ হাঁটা, তারপর সেখানে শয়ে শয়ে লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, বার্তা বিনিময়, শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ইত্যাদি। তাই দুপুরের আগে ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না। বড়দের চেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ ছোট ছোট ছেলেদের, বড়দের তুলনায় তাদের উৎসাহে একটুকৃ কমতি নেই, বরং একটু বেশিই বলা যায়। কেউ এক দিনের রোজা রেখেছে, তাও দুপুর পর্যন্ত, কেউ আবার তাও রাখেনি। কিন্তু ঈদ্গাহে যাবার উৎসাহ, উদ্দীপনা আর আনন্দ তাদের একটু বেশিই, এটা যেন তাদের বড় অধিকার। তারা মনে করে রোজাটা হল বড়দের ব্যাপার, আর তাদের জন্যে হল ঈদ। প্রতিদিনই কবে আসবে, কবে আসবে করে ঈদের নাম জপছে। সেই পবিত্র ঈদ এসে গেছে। তাই কি তাদের এত ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি। বড়রা তাড়াতাড়ি যাচ্ছে না কেন? তাদের ঘর-সংসারের চিন্তারই বা প্রয়োজন কি? সেমাইয়ের জন্য দুধ ও চিনি ঘরে আছে কি নেই, তা তাদের দেখার দরকার কি, তারা তৈরি সেমাই খেতে পেলেই হল। আব্বাজানই বা কেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে চৌধুরী কাসেম আলীর বাড়িতে ছুটছে, সে খবরে তাদের দরকার কী? আর চৌধুরীসাহেব বিমুখ হলে খুশির ঈদ কান্নার মহরমে পরিণত হবে, তা তাদের জানবার কথা নয়। কারণ তাদের পকেট এখন ভর্তি। তারা থরে থরে পকেট থেকে যে যার নিজের ভাণ্ডার বের করে গুনছে, আবার খুশি হয়ে পকেটে চালান করে দিচ্ছে। মাহমুদ গুনছে, এক, দুই, তিন, পাঁচ, দশ, বারো। তার মানে বারোটা পয়সার অধিকারী সে। আর মহসীনের কাছে এক, দুই, তিন, পাঁচ, দশ, বারো, চোদ্দ, পনেরো পয়সা। অর্থাৎ সে পনেরো পয়সার মালিক। এই এত পয়সা দিয়ে মনের মত অসংখ্য জিনিষ কিনে আনবে তারা, যেমন খেলনা, মিষ্টি, বাঁশি, বল, আরও অনেক কিছু!
বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হামিদ। বছর চার-পাঁচ বয়স তার। রোগাটে গড়ন। তার বাবা গত বছর কলেরায় দেহ রেখেছেন। আর মা, তারপর থেকে কেন জানি না তার দেহটা হলদেটা হতে থাকে। একদিন তিনিও দেহ রাখলেন। রোগটা যে কি কোনও হেকিমই ধরতে পারল না। তাছাড়া কেই বা তার রোগের কথা শুনতে চায়? নিজের মনের যত জ্বালা, ক্ষোভ, অভিযোগ সবকিছুই মনের মধ্যে চেপে রাখতে রাখতে একদিন যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন তিনি এই দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে বেহেস্তে চলে গেলেন। এখন হামিদ তার বুড়ি ঠাম্মা আমিনার কোলেই ঘুমোয়, তাতেই তার সুখ, শান্তি সবকিছু। খুশিও তাতে সে। তার আব্বাজান টাকা রোজগারের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। টাকা ভর্তি অনেকগুলো থলে নিয়ে ফিরবেন। আর আম্মাজান আল্লাহ মিঞার ঘরে গেছেন তার জন্যে ভাল ভাল জিনিষ আনতে। এই সব কথা ভেবে নিয়ে হামিদ সবসময় বেশ খোশমেজাজেই থাকে। আশা এমনিতেই বড় ভাল জিনিষ। তার ওপর আবার বাচ্চাদের আশা বলে কথা। তারা তাদের শিশুমনের কল্পনায় হামেশাই আকাশে প্রাসাদ তৈরি করে। অথচ হামিদের পায়ে সেই কতদিনের পুরনো জুতো, মাথার টুপিটাও পুরনো, রঙচটা। তার পাটিতে কালো দাগ ধরে গেছে। তবুও সে খুশি। আশায় বুক বাঁধে সে। তার আব্বাজান, আম্মাজান দুজনেই যখন রাশি রাশি ঐশ্বর্য নিয়ে ফিরে আসবেন, তখন তাদের সংসারে অভাব বলতে কিছু থাকবে না। তার মনের সব গোপন ইচ্ছা আর সব কামনা-বাসনা কানায় কানায় ভরে যাবে। তখন সে দেখে নেবে, মনে মনে হামিদ পরিকল্পনা করে, তখন সে দেখে নেবে মহসীন, নূর আর সম্মী কোথথেকে অত পয়সা পায়! ওদিকে অভাগিনী আমিনা তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসে কাঁদছে। আজ ঈদ। অথচ ঘরে খাবার নেই। আজ যদি তার আবিদ থাকত তাহলে এমন দুঃখের মধ্যে দিয়ে ঈদ আসত আর চলে যেত? এরকম আশাহত হয়ে অন্ধকারে কি তলিয়ে যেত! কেই বা এই দুঃখিনী আমিনার অন্ধকার ঘরে যেচে ঈদকে আহ্বান করতে যাবে? না, এই জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে তাকে আনতে হবে না। কিন্তু বেচারা হামিদ! তার কাছে মরণ বাঁচনের মধ্যে কি তফাৎ আছে? তার আলোয় ভরা হৃদয়, আর বাইরে আশায় বুক বাঁধা। যতই দুঃখ-দুর্দশা আসুক না কেন দল বেঁধে, হামিদের ভুবন মোহিনী হাসি তাদের ধ্বংস করে দেবে।
হামিদ কুঁড়েঘরের ভেতরে গিয়ে আমিনাকে বলল, তোমার ভাবনা নেই আম্মা, আমি সবার আগেই চলে আসব, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিনার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চা ছেলেরা তাদের যে যার বাবার সঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু হামিদের মা-বাবা বলতে আমিনা ছাড়া আর কেই-বা আছে! হামিদই তো তার বংশের একমাত্র দিয়া! তাই সে তাকে একা কী করেই বা মেলায় যেতে দেয়? মেলায় খুব ভীড় হয়। সেই ভীড়ে যদি সে হারিয়ে যায়, তাহলে কী হবে তখন। কে তার নাতীকে ফিরিয়ে নেবে? না, না, আমি ওকে মেলায় যেতে দিতে পারি না। একেবারে বাচ্চা ছেলে, দুধের শিশুও বলা যায়। আর দীর্ঘ তিন ক্রোশ পথ সে হাঁটবেই বা কি করে? পায়ে যে তার ফোস্কা পড়ে যাবে।
কিন্তু আমিনা গেলে ঘরে সেমাই রান্না করবে কে? পয়সা থাকলে মেলা থেকে ফেরার পথে জিনিসপত্র কিনে এনে বাড়িতে এসে চটজলদি রান্না করে নিতে পারত। কিন্তু সেসব জিনিষও তো জোগাড় করতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। কারণ সবই তো চেয়ে-চিন্তে করতে হবে। সহজে কেউ কি মাগনা দিতে চাইবে? তার সঞ্চয় বলতে তো শুধু একটা ব্যাঙের আধুলি। এই ঈদে খরচ করার জন্য জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু গতকাল গোয়ালিনী এমনি নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছিল এক ধারে আর দুধ দিতে পারবে না বলে শাসিয়ে ছিল যে, কি আর করে সে, হামিদের জন্য রোজ দু পয়সা করে দুধ কেনে, সেটা তো আর বন্ধ করতে পারে না। তাই তার ধার মিটিয়ে আনা দুই পয়সা মাত্র বেঁচেছে। তা থেকে মেলায় খরচ করার জন্য তিনটে পয়সা দিয়ে আমিনার হাতে আছে মাত্র পাঁচ পয়সা। এই তো সামান্য সম্বল। এদিকে ঈদের উৎসবে ভাবে সে, যিনি মালিক তিনিই যা করবার করবেন। তাছাড়া প্রতিবেশীরা তো আছেই। ধোপানি, নাপতেনি, মেঘরানী, এরা সবাই সামলাতে আসবে। কিন্তু তাদের হাতে একটু করে সেমাই তো দিতে হবে। আবার কেউ কেউ এমন আছে, অল্পে সন্তুষ্ট হয় না। তাহলে সেক্ষেত্রে কাকে বাদ দি কাকেই বা ভুষ্ট করবে সে? আর কাউকে বাদ দেবার কথাই বা ভাবছে কেন সে। পবিত্র ঈদ উৎসব। আহা, সবাই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে এই উৎসবের দিনটির জন্য। তাদের তো আর নিরাশ করতে পারে না সে। আমার হামিদকে খোদা ভাল রাখুন, সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকুক সে। পাড়ায় কেউ কি আর পর! ভাগ্যটা কি চিরকাল এমন অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে চলবে? বাছার ওপর খোদা দয়া করলে, তার আশীর্বাদে একদিন এই দুর্দিন ঠিকই কেটে যাবে।
এক সময় গ্রাম থেকে সবাই মেলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। অন্য সব বাচ্চাদের সঙ্গে সামিল হয়েছে হামিদও। সেও চলেছে সার বেঁধে সবার সঙ্গে। কখনও তারা সবার আগে ছুটে যায়, আবার কখনও বা সঙ্গীদের জন্যে গাছতলার ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আচ্ছা, লোকগুলো এত আস্তে আস্তে পা চালায় কেন?
এক সময় তারা শহরতলিতে এসে পড়ল। রাস্তার দু ধারে বিত্তবান জমিদারদের বাগান-বাড়ি। পাকা পাঁচিল দিয়ে চারপাশ ঘেরা। গাছে গাছে থোকা থোকা আম আর লিচু ঝুলে রয়েছে। মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলেরা কেউ হয়তো ঢিল ছুঁড়ে ঝুলন্ত আম-লিচুর থোকায় নিশানা লাগাচ্ছে। আর তা দেখে বাগানের মালী ভেতর থেকে গালিগালাজ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে ছেলেরাও সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিচ্ছে। একটু দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাসতে থাকে। মালীকে বোকা বানিয়ে হাসছে তারা।
বিরাট বিরাট ইমারত চোখে পড়ে। এটা আদালত এটা কলেজ আর ওটা হল ক্লাবঘর। এত বড় কলেজে কত ছেলে পড়ে? সবাই কিন্তু বড় একটা ছেলেমানুষ নয়, বুঝলে। বেশ কিছু বয়স্ক লোক আছে, হ্যাঁ মশাই। তাদের ইয়া বড় বড় সব গোঁপ! এত বয়স হয়ে গেছে, তবু এখনও পড়তে আসছে এখানে। কে জানে, আর কত পড়বে, আর এত সব পড়েই বা কি করবে ওরা! হামিদের মাদ্রাসা স্কুলে তিনজন বেশ বড় বড় ছেলে পড়ে। লেখাপড়ায় কোনও মন নেই, একেবারে বাজে ছেলে। ক্লাসে রোজ মার খায়। তবু পড়ার নাম-গন্ধ নেই। এখানেও মনে হয়, ছেলেগুলো ওই ধরনেরই হবে। এছাড়া আর কী হতে পারে? ক্লাব ঘরে নাকি জাদুর খেলা হয়। শোনা যায় যে, ওখানে নাকি মড়ার খুলিও জীবন্ত মানুষের মতো দৌড়য়। এরকম আরও অনেক ধরনের রঙ-তামাশা হয়। কিন্তু বাইরের কাউকে তা দেখতে দেওয়া হয় না। প্রবেশ নিষেধ সেখানে। এখানে সন্ধ্যাবেলায় সাহেবরাও খেলতে আসে। আবার মেমসাহেবরাও খেলে, জানো! আমাদের আম্মাকে দিয়ে দেখো না, ওই যে কি বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে। ব্যাট দাও না, দেখবে ধরতেই পারবে না। একবার ঘোরাতে গেলেই কুপোকাত, উল্টে পড়ে যাবে।
মাহমুদ বলল, আর আম্মা তো তবৈচ। সত্যি বলছি, ব্যাট ধরলে আম্মার হাত ঠিক কাঁপবেই কাঁপবে।
মহসীন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল। বাজে কথা বলিস না, মণকে মণ যারা আটা পিষছে, তাতে তাদের হাত একটুও কাঁপে না। অথচ একবার ব্যাট ধরলেই হাত কাঁপবে? বললেই হল। ভারি তো একটা কাঠের ব্যাট। কত কলসি করে কুয়ো থেকে জল তোলে রোজ তোর আম্মা, পাঁচ কলসি জল তো তোর মোষেই শুধু খায়! তাহলেও? বলত তোর মেমসাহেবকে এক ঘরা জল কুয়ো থেকে তুলে আনতে, দেখবি সে তখন চোখে সরষে ফুল দেখবে।
মাহমুদ বলে উঠল, তোমরা যে যাই বলো না কেন, মা তো আর দৌড়তে পারবে না, আর লম্প-ঝম্পও করতে পারবে না।
তা হয়তো পারবে না, মহসীন বলল, কিন্তু সেদিন আমাদের গরুটা দড়ির বাঁধন খুলে চৌধুরীদের ক্ষেতে গিয়ে পড়তেই আম্মা এমন একটা ছুট দিল, যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি তো ধরতেই পারলাম না।
আম্মাজানদের কথা বলতে বলতে তারা এগিয়ে চলে। আরও খানিকটা যেতেই মিষ্টির সারি সারি দোকান শুরু হল। মিষ্টির দোকানগুলোয় আজ খুব সাজ-সজ্জার বহর চোখে পড়ে। কিন্তু এত সব মিঠাই কে বা কারা খায়? দেখ না, এক একটা দোকানে ঘরে ঘরে সাজানো মণকে মণ মণ্ডা-মিঠাই। শোনা যায় যে, রাতে নাকি জিনেরা আসে মিঠাই কিনতে। আব্বা সেদিন বলছিল, মাঝরাতে দোকানের বেঁচাকেনা বন্ধ হয়ে গেলে যত মিষ্টি বেঁচে যায়, সব মিষ্টি ওজন করিয়ে কিনে নেয় সেই জিন। আর তার দাম হিসেবে সত্যিকারের টাকাই দেয়। ঠিক এই রকম টাকা আর কি!
হামিদ বিশ্বাস করতে পারে না। তার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলে, তো এরকম আসল টাকা সে পাবে কোথেকে?
মহসীন জোর দিয়ে বলল, কি যে বলো, জিনের আবার টাকার অভাব হয় নাকি? যে কোনও টাকার ট্যাকশাল কিংবা ব্যাঙ্কে চলে গেলেই হল। লোহার দরজাও ওদের কাছে কোনওরকম বাধার সৃষ্টি হয় না। অনায়াসে তারা স্ট্রংরুমে ঢুকে যেতে পারে। একি তুই আমি, বাচ্চা, রোগা-পটকা? টাকা-পয়সা ছাড়া হীরে মুক্তোও ওদের কাছে থাকে। যাকে খুশি তাকেই মণিমাণিক্য বিলিয়ে দেয় ওরা। এখন এখানে বসে আছে, আবার নিমেষের মধ্যেই কলকাতায় পৌঁছে যেতে পারে।
এবার হামিদ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, জিনেরা খুব বিরাট বিরাট চেহারার হয় শুনেছি, ওরা নাকি দৈত্যের মতো দেখতে!
ঠিক জানি না, উত্তরে মহসীন বলে, তবে শুনেছি, আমাদের চৌধুরীসাহেবের হাতে নাকি অনেক জিন আছে। কারওর কিছু চুরি গেলে চিন্তার কিছু নেই। চৌধুরীসাহেব ঠিক তার হারানো জিনিষ বার করে দেবেন। এমনকি যে চুরি করেছে তার নামধামও বলে দেবে। এই তো সেদিন জুমারতীর বাছুর হারিয়ে গেছিল। তিনদিন ধরে খুঁজে খুঁজে বেচারা হয়রান। কোথাও তার হদিশ পাওয়া গেল না। শেষে ব্যর্থ হয়ে চৌধুরী সাহেবের কাছে গেল সে। সব শুনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, খোয়াড়ে গিয়ে খোঁজ করো! ব্যস, এর বেশি কিছু তিনি বললেন না। তিনি কথা কম বলেন। কিন্তু কাজ বেশি করেন। ওঁর এই গুণের পরিচয় হাতে হাতে পাওয়া গেল পরক্ষণেই। ওঁর কথা মতো ঠিক খোয়াঙেই পাওয়া গেল জুমারতীর বাছুরটা। জিনেরা এসে তাকে দুনিয়ার সব খবরই বলে দিয়ে যায়। ”
হামিদ এখন বেশ বুঝতে পারছে, চৌধুরীসাহেব কেন এত বিত্তবান, কেন তিনি প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক। আর তার এত মান-সম্মানই বা কেন!
এরপর তারা সামনে আরও এগিয়ে যায়। এই হল পুলিশ লাইন। এখানেই কনস্টেবলেরা অভিযুক্তদের কয়েদ করে। বেচারীরা মাঝরাত জেগে থেকে গৃস্থদের ঘরে ঘরে পাহারা দেয়, না হলে তাদের সর্বস্ব চুরি হয়ে যাবে। মহসীন প্রতিবাদ করে উঠল, ওই কনস্টেবলেরা পাহারা দেয় না আর কিছু! তুমি খুব জানো! আরে ওরাই তো চুরি করায়। গৃহস্থদের বলে সজাগ থাকো। আর চোরদের বলে, চুরি করো। শহরে যত সব দাগী চোর-ডাকাত আছে সব ওদের পরিচিত, চোরেদের নাড়ী-নক্ষত্র পুলিশের জানা হয়ে গেছে। রাতে কোনও এক পাড়ায় চোরেদের চুরি করতে বলে তারা অন্য পাঙায় গিয়ে লাঠি ঠুকে হাঁক- ডাক করে বলে, “জেগে ওঠো, সতর্ক হও, চোর আসছে। ” আর তাই তো ওদের কাছে এত ঐশ্বর্য, এত টাকা! আমার কথাগুলো তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। তাহলে বলি শোনো। আমার মামা একটা থানার কনস্টেবল। কুড়ি টাকা বেতন পায়। অথচ এই মামাই বাড়িতে পাঠায় পঞ্চাশ টাকা। আল্লাহর কসম, আমি একদিন মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামা, এত টাকা তুমি কোথথেকে পাও? মামা একগাল হেসে জবাব দেন, আল্লাড দেন, খোদার ইচ্ছে, আমি না নিয়ে কি থাকতে পারি? তারপর সে আপন মনে বলল, আমরা ইচ্ছে করলে দিনে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করতে পারি। আমরা এমন ভাবে হাত-সাফাই করি কেউ জানতেও পারে না। তাই বদনাম হয় না, আর চাকরিও যায় না।
হামিদ জিজ্ঞেস করল, ওরা যে এত সব চুরি করায়, কিন্তু ওদের ধরার কোনও উপায় নেই, মানে কোনও ভাবেও ওদের কেউ কি ধরতে পারে না?
হামিদের অজ্ঞতা দেখে মহসীনের করুণা জেগে উঠল তার প্রতি। তাই সে বলল, দূর পাগল, ওদের ধরবে কে? ওরা নিজেরাই তো চোর ধরবার লোক। কিন্তু আল্লাহ ওদের সাজাও খুব দেন। পাপের ধন পাপেই যায়। এমনি হয়, যাকে বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে আর কি! এই তো সেদিন মামার বাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। সেই আগুনে তার সর্বস্ব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমনকি একটা বাসন পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। সর্বস্ব খুইয়ে কদিন গাছতলায় শুয়েছে। আল্লাহর কসম, যাকে বলে একেবারে গাছতলায় আর কি। তারপর কোথেকে একশ টাকা ধার করে এনে প্রয়োজনীয় বাসনপত্র কিনে আনে।
হামিদ লেখাপড়া জানে না, মূর্খ সে। তাই সে মূর্খের মতোই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, একশ তো পঞ্চাশেরও বেশি, তাই না?
কোথায় একশ টাকা আর কোথায় পঞ্চাশ টাকা? পঞ্চাশ টাকা তো একটা থলিতেই ধরে যায়। আর একশ টাকা দুটো থলিতেও ধরবে না। তাহলেই বুঝে নাও, তফাতটা কোথায়?
ওদিকে ধীরে ধীরে লোকালয় ক্রমশই ঘনীভূত হতে থাকল। ঈদের নামাজ পড়ার জায়গায় যাত্রীদের আরও কয়েকটি দল চোখের সামনে ভেসে আসছে। পরনে তাদের নানান রঙের পোশাক। আসছে কেউ এক্কায়, কেউ টাঙ্গায়, কেউ বা মোটর গাড়িতে চড়ে। সকালের গায়েই আতরের গন্ধ, সবাই খুব খুশি, সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। মফঃস্বলের একটা ছোট্ট গ্রামের এই ছোট্ট তীর্থযাত্রী দলটি নিজেদের অভাব, দুঃখ, দৈন্য-দুর্দশার কথা সব ভুলে গিয়ে শান্ত প্রসন্ন চিত্তে ধর্ম স্থানের দিকে এগিয়ে চলেছে। আহাঃ কি সুন্দর মনোরম দৃশ্য! ছবি করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতোই বটে। গ্রামের ছেলেদের চোখে শহরের সব কিছুই চমৎকার লাগে যেন। যে দিকে তাকায়, সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া দূরে থাক, চোখের পলক ফেলতে বুঝি ভুলে যায় সে। এমন কি পিছনে গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়েও তার হুঁস হয় না। আর একটু হলে হামিদ তো গাড়ি চাপা পড়ে যেত।
এই সময় হঠাৎ ঈদের উপসনাস্থল চোখে পড়ল। মাথার ওপর তেঁতুল গাছের নিবিড় শান্ত-স্নিগ্ধ ছায়া। নীচে শান-বাঁধানো রকের ওপর জাজিম বিছানো। যারা একমাস ধরে রোজার ব্রত পালন করে এসেছে, তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট সারি ছড়িয়ে পড়েছে রকের নীচে পর্যন্ত। সেখানে কিন্তু জাজিমের অস্তিত্ব নেই। যারা দেরী করে আসছে, তাদের স্থান পিছনেই হচ্ছে। এখন এখানে তিল ধারণে জায়গা নেই। এখানে কোনও ধন-সম্পদ বা পদাধিকারের বাছ বিছার চলে না। ইসলামের চোখে তারা সবাই সমান। গ্রাম থেকে আসা তীর্থযাত্রীরাও উজু করে গিয়ে পিছনের সারিতে দাঁড়ালো। প্রধান মৌলবী সাহেব কি সুন্দর ভাবেই না এই উপাসনা পরিচালনা করছেন, কি সুন্দর ব্যবস্থা। হাজার লক্ষ মানুষের মাথা সারিবদ্ধভাবে একসঙ্গে আভূমি প্রণত হচ্ছে। আবার সবাই একসঙ্গেই সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একসঙ্গে সবাই আবার কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর তারপরেই হাটু মুঙে বসছে একসঙ্গে। নমাজের এইরকম প্রক্রিয়া বেশ কয়েকবার ধরে চলল। মনে হল যেন একটিমাত্র বোতাম টিপতেই লক্ষ লক্ষ বিজলীবাতি একসঙ্গে জ্বলছে আর নিভছে। পালা করে এই রকমই চলতে থাকে। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। একটা অদ্ভুত ছন্দে সারিবদ্ধ ভুক্ত তীর্থযাত্রীদের সমবেত প্রণতির মধ্যে এক অন্তহীন বিস্তারের আভাস রয়েছে, যা প্রতিটি রোজার ব্রতধারী হৃদয়কে ভক্তিতে আর ভূষার পরম ঐশ্বর্যের সম্ভারে কানা কানায় ভরিয়ে তোলে। এ যেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের একটি মাত্র অচ্ছেদ্যসূত্রে দুনিয়ার সমস্ত মানুষের আত্মা গাঁথা হয়ে আছে।
ঐদিকে নমাজ পড়া শেষ। এ ওকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছে। মিষ্টি ও খেলনার দোকানের সামনে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের দল এ ব্যাপারে বাচ্চাদের চেয়ে কম উৎসাহী নয়। ওই তো নাগরদোলা। এক পয়সা দিয়ে ওই নাগরদোলায় চড়ে বসো, মনে হবে তুমি যেন ডানা মেলে পাখিদের মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছো। আবার পরক্ষণেই দেখবে, মাটিতে আছড়ে পরছ। ওই দেখো, ওটা চরকি, ওই তো ওখানে কাঠের হাতি, ঘোড়া, উট, সবাইকে লোহার শিক দিয়ে গেঁথে রেখেছে। এক পয়সা দিয়ে বসতে পারো তুমি। তাহলে পঁচিশটা চক্করের মজা লুটতে পারো। মাহমুদ, মহসীন, নূর আর শম্মী সবাই একবার করে ঘোড়ায় চড়ল। হামিদ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের মজা দেখছে। তার পকেটে মাত্র তিনটি পয়সা। তার এই ধন-ভাণ্ডার থেকে এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে একটু চক্কর খেতে রাজী নয় সে।
একটু পরেই চরকি থেকে নেমে এল তারা। এবার খেলনা কেনার পালা। সারি সারি খেলনার দোকান। দোকানে দোকানে রকমারী সব খেলনা সাজানো রয়েছে। যেমন, সিপাই ও ফেরিওয়ালা, রাজা ও উকিল, ভিত্তি, ধোপানী এবং সাধু। সত্যি কি সুন্দর সব খেলনাগুলো। দরদাম করা আর দেখাদেখি চলছে। মাহমুদ একটা সিপাই কিনল। তার খাঁকি পোশাক, লাল পাগড়ি আর কাঁধে বন্দুক। দেখে মনে হচ্ছে, পুতুল তো নয় যেন রক্ত-মাংসের মানুষ। এইমাত্র কাউকে কয়েদ করে নিয়ে এল। মহসীনের পছন্দ ভিস্তি। মশক কাধে কোমর ভেঙে চলেছে। এক হাতে মশকের মুখটা চেপে ধরা। বেশ খুশি খুশি ভাব। মুখে হাসি, যেন গান গাইছে, দিল বুঝি মশকের জল ঢেলে। এদিকে নূর উকিলের প্রেমে পড়েছে। উকিলের গায়ে কালো চোগা, সাদা আচকান। আর আচকানের পকেটে ঘড়ি, সোনার চেন দিয়ে বাঁধা ঘড়ি, হাতে আইনের মোটা একটা বই। দেখে মনে হচ্ছে, উকিলসাহেব বুঝি এই মাত্র কোনও বিচারপতির এজলাস থেকে জেরা করে বেরিয়ে আসছে। এ সব খেলনার দাম মাত্র দু পয়সা। হামিদের পুঁজি বলতে মাত্র তিনটে পয়সা। তাই এত দামি দামি খেলনা সে কিনবেই বা কি করে। তাছাড়া খেলনাগুলো তো মাটির। হাত থেকে পড়লেই চুরমার হয়ে ভেঙে যাবে। আবার একটু জল লাগলেই হয়, রঙ গলে যাবে। তাই এসব খেলনা নিয়ে কি হবে, সংসারের কোনও কাজেই তা লাগবে না।
মহসীন তার খেলনাটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, আমার এই ভিস্তি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা জল দিয়ে যাবে।
মাহমুদ বলল, আমার সিপাই বাড়ি পাহারা দেবে। চোর-ডাকাত এলে সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক হাতে নিয়ে ফায়ার করে দেবে।
নূর বলে, আমার উকিল মামলা লড়বে।
সম্মী বলে, আমার ধোপানী রোজ ময়লা কাপড় কেচে দেবে।
ওদের মধ্যে হামিদই কেবল ব্যতিক্রম। খেলনার নিন্দে করে সে বলল, মাটির তৈরি, হাত থেকে পড়লেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। অবশ্য সে মুখে নিন্দা করলে কি হবে, লোলুপ দৃষ্টি তাদের হাতের খেলনাগুলো দেখছে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার খেলনাগুলো হাতে নিয়ে পরখ করে দেখে। মাঝে মাঝে সে হাত বাড়িয়েও দিচ্ছে। কিন্তু তার বন্ধুরা তার হাতে তাদের খেলনা তুলে দিতে ভরসা পায় না। নতুন খেলনা। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগেই যদি… তাই হামিদের ইচ্ছাপূরণ আর হয় না।
এরপর মিষ্টি কেনার পালা, কেউ গোলাপজাম কেনে, কেউ রাবড়ি, আর কেউ বা শোনপাপড়ি। খুব মজা করে খাচ্ছে ওরা। হামিদ ওদের দল থেকে পৃথক হয়ে গেছে। বেচারার কাছে মাত্র তিনটি পয়সা আছে। কোনও মিষ্টি কিনে খাচ্ছে না কেন সে? কিন্তু লোলুপ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে তাদের খাওয়া দেখে।
মহসীন বলে উঠল, এই হামিদ রাবড়ি খাবি? একটু চেখে দেখ না, কি সুন্দর গন্ধ আর সুস্বাদু।
হামিদের কেমন সন্দেহ হয়, এটা তার নির্মম নিষ্ঠুর কৌতুক নয় তো! সে বেশ ভাল করেই জানে যে, এমন উদার ছেলে না মহসীন। কিন্তু তা জেনেও রাবড়ি খাবার লোভটা দমন করতে না পেরে সে তার কাছে এগিয়ে যায়। মহসীন তার পাতায় ঠোঙা থেকে একটা রাবড়ির টুকরো তুলে নিয়ে হামিদের দিকে বাড়িয়ে ধরে। হামিদ যেই হাত বাড়িয়েছে, অমনি মহসীন অতর্কিতে সেটা নিজের মুখে পুরে দিল। মাহমুদ, নূর ও সম্মী জোরে জোরে হাততালি দিয়ে হা-হা, হি-হি করে হাসতে লাগল। হামিদ মুষড়ে পড়ল।
মিষ্টির দোকান পেরিয়ে তারা এবার লোহার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার পাশেই ছিল কিছু গিলটি করা নকল সোনার গহনা। কোনও দোকানই তাদের পছন্দ নয়। তাই তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলে। হামিদ কিন্তু একটা লোহার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানে কতকগুলো চিমটে দেখতে পেল। রান্নাঘরে তার ঠাম্মার কোনও চিমটে নেই। হামিদের হঠাৎ খেয়াল হল। চাটুতে কটি সোঁকার সময় তার হাত পুড়ে যায়। তাই ঠাম্মায় জন্যে একটা চিমটে কিনে নিয়ে গেলে না জানি কতই না খুশি হবেন তিনি। এরপর তার হাত আর পুড়বে না। আর ঘরেও একটা কাজের জিনিষ হবে। খেলনা কিনে কি লাভ? মিথ্যে শুধু শুধু পয়সা নষ্ট বই আর কিছু নয়। কয়েকদিন হয়তো খেলনা ভাল লাগবে, কিন্তু তারপর কেউ আর ফিরেও তাকায় না সেদিকে। তাছাড়া খেলনা কিনে বাড়িতে যাওয়ার পথে সেটা যে ভেঙে যাবে না তার কি গ্যারান্টি আছে! অথচ চিমটি কতই না কাজের জিনিষ। চাটু থেকে চিমটে দিয়ে রুটি তুলে নিয়ে উনুনে সেঁকে নাও, হাত আর পুড়বে না। আবার কেউ আগুন চাইতে এলে চিটে দিয়ে উনুন থেকে চট্পট্ আংরা তুলে তাকে দিয়ে দাও। ঠাম্মা বেচারীর তো সময় নেই যে, বাজার থেকে চিম্ট কিনে আনবেন। তাছাড়া চিটে কেনার পয়সাই বা কোথায় তার?
ওদিকে হামিদের সঙ্গীরা তাকে ফেলেই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা তখন একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সরবৎ খাচ্ছে। হামিদ ভাবে, সবগুলোই পেটুক। এতগুলো মিষ্টি কিনল, আমাকে কেউ এক টুকরো খেতেও দিল না। এরাই আবার বলে কিনা, চল্ এক সাথে খেলা করা যাক। এটা করে দে, ওটা করে দে। এরপর বলে দেখুক না, কেমন ওদের কাজ করে দিই। একা একা তোরা যত পারিস মিষ্টি খা না, দেখবি মুখে ঘা হবে, গায়ে ফুসকুড়ি বেরোবে, কৃমি হবে, ফোঁড়া হবে দেখবি। তখন বুঝবি একা একা খাওয়ার কি পরিণতি হয়! লোভে পড়ে বাড়ি থেকে পয়সা চুরি করে এসে এখানে নবাবি করছিস। বাড়ি ফিরে গিয়ে পয়সা চুরির অপরাধে যখন মার খাবি তখন বুঝবি। বইয়ে কখনও মিথ্যে কথা লেখা থাকে না। আমার জিভ কেন খারাপ হতে যাবে? ঠাম্মা দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে চিম্টটা নিয়ে বলবে, আমার আদরের নাতি আমার জন্যে চিমটে কিনে এনেছে। তোমরা সবাই দেখে যাও, আমার নাতির কি রকম কর্তব্য জ্ঞান! চিমটেটা পাড়ার মেয়েদের দেখিয়ে এভাবে আমার গুণগান গাইবেন। আমাকে কত আদর-যতœ করবেন। সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে, হামিদ চিমটে নিয়ে এসেছে, কত ভালই না ছেলে সে। আর ওদের খেলনা দেখে কেই বা প্রশংসা করবে? বড়দের আশীর্বাদ সরাসরি আল্লার দরবারে পৌঁছে যায়। আর আল্লাও তা মন দিয়ে শোনেন। আজ আমার কাছে পয়সা নেই বলে মহসীন আর মাহমুদ আমাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করল, মেজাজ দেখালো। আমিও ওদের মেজাজ দেখাতে জানি। যত পারো মিষ্টি খাও। যত পারো খেলনা তোমাদের খেলো নিয়ে। আমার ওসব কিছুই চাই না। আমার অত শখ-আহ্লাদ নেই। মেজাজ দেখাবে তোমরা। আর তোমাদেরই খেলনা নিয়ে আমি খেলতে যাব? আমি গরীব আছি তো আছি। তোমাদের কাছে তো কিছু চাইতে যাইনি। আমার আব্বা আর আম্মা ফিরে আসুক, তখন আমিও তোদের মেজাজ দেখাবো। তোরা কত খেলনা কিনতে পারিস, তখন দেখা যাবে। আমিই তখন খেলনা ভর্তি ঝুড়ি দেব তোদের এক একজনকে। দেখিয়ে দেব, বন্ধুদের সঙ্গে কী করে মিশতে হয়। কিনেছিস তো এক পয়সার রাবড়ি, দেখিয়ে দেখিয়ে খাবার কি আছে শুনি? চিমটে দেখে কেউ যদি হাসে হাসুক গে। আমি থোরাই কেয়ার করি।
অবশেষে হামিদ দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, চিমটেটার কত দাম?
দোকানদার দেখল, বাচ্চা ছেলেটার সঙ্গে বড় মানুষ কেউ নেই। ছেলেটা বোধহয় ওটা একটা খেলনা ভেবে কিনতে চাইছে। তাই সে বলল, ওটা তোমার খেলার জিনিষ নয় খোকা।
ওটা নিয়ে আমি খেলি কিংবা যাই করি না কেন, সেটা তোমার দেখার কথা নয়। এখন বলো, ওটা তুমি বেচবে কি বেচবে না?
হ্যাঁ, বেচবো বৈকি! বেচবো বলেই ওটা বয়ে নিয়ে এসেছি এখানে।
ছ পয়সা।
দামটা শুনে হামিদের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার যা পুঁজি, তাতে চিমটে কেনা স্বপ্ন দেখার মতোন। তবু সে আবার বলল, ঠিক করে বলো, কত দিলে ওটা তুমি আমাকে বেচবে?
তাহলে শোনো বাছা, ঠিক পাঁচ পয়সা লাগবে। নেবে তো নাও। নইলে কেটে পড়ো এখান থেকে।
হামিদ বুকে সাহস এনে বলল, আমার কাছে মাত্র তিনটে পয়সাই আছে। এই তিন পয়সায় চিমটেটা বেচবে আমায়? এই বলে সে আর মুহূর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে, যাতে কম দাম বলেছে বলে দোকানীর মুখঝামটা শুনতে না হয়। কিন্তু দোকানী মুখঝামটার বদলে তাকে ডেকে চিমটেটা তার হাতে তুলে দিল। দাম মিটিয়ে হামিদ চিমটেটা বন্দুকের মতো কাধে তুলে নিল। তারপর গটমট্ করে বুক ফুলিয়ে সঙ্গীদের কাছে গিয়ে হাজির হলো। সে এখন জানতে চায়, ওদের মধ্যে কি এত আলোচনা হচ্ছে।
মহসীন টিপ্পনী কাটল, চিটেটা কিনেছিস কেন রে পাগলা? এটা দিয়ে তুই কি করবি?
হামিদ চিমটেটা মাটিতে আছাড় দিয়ে বলল, হিম্মত থাকে তো তোর হাতের ভিস্তিটা এমন করে আছাড় মার তো দেখি! ওটায় বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে চুরমার হয় না রক্ষা পায় দেখতে চাই।
মাহমুদ বিরূপ করে বলল, আরে, ওই চিটেটা কি খেলনা?
হ্যাঁ, খলনাই তো বটে! হামিদ জোর দিয়ে বলল, এটা কাঁধে রাখলে বন্দুক, হাতে নিলে ফকিরের চিমটে। আর যদি ইচ্ছা করে এটা দিয়ে বাজনাও বাজাতে পারি। এই চিটে দিয়ে এক ঘা মেরে তোদের সব খেলনা একসাথে যমের বাড়ি চালান করে দেব। আর তোদের সব খেলনা এক সাথে করেও যদি খা মারিস, তাহলে আমার চিটের কিছুই হবে না। এ চিমটে আমার বাঘের বাচ্চা, বুঝলি?
সম্মী একটা ডুগডুগি কিনেছিল। চিমটে বাঘের বাচ্চা শুনে তার খুব লোভ হল। লোলুপ দৃষ্টিতে চিমটেটার দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমার ডুগডুগির সঙ্গে তোর ওই চিমটেটার বদলা বদলি করবি? এর দাম দু আনা।
হামিদ ডুগডুগিটার দিকে অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে বলল, আমার চিমটের এক খোঁচায় তোর ওই ডুগডুগি ফাসিয়ে দিতে পারি। ভারি তো ডুগডুগি! তোর ডুগডুগি তোর কাছেই রেখে দে। এক পর্দা চামড়া লাগিয়ে দিলেই ঢ্যাবটেবে আওয়াজ করবে। একটু জল লাগলেই তোর ওই ডুগডুগির দফারফা হয়ে যাবে। আর আমার এই বাঘের বাচ্চা, চিটে-বাহাদুরকে আগুনে, জলে, ঝড়ে যেখানে খুশি রাখো না কেন ঠিক থাকবে।
ইতিমধ্যে চিমটেটা সবাইকেই রীতিমতো বশীভূত করে ফেলেছে। কিন্তু মুশকিল হল, সবার পকেট এখন একেবারে ফাঁকা। একটা কানাকড়িও নেই কারওর কাছে যে, একটা চিটে কিনবে। তাছাড়া তারা মেলাপ্রাঙ্গন ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছিল ততক্ষণে। এদিকে বেলা ন টা কখন বেজে গেছে, রোদের তেজ বেড়ে চলেছে। বাড়ি ফেরার তাড়া আছে সবার। বাবার কাছে বায়না ধরলেও চিটে পাওয়া যাবে না। হামিদ খুবই চতুর, ধুরন্দর। শয়তানটা পরে চিমটে কিনবে বলে বাজে খরচ না করে পয়সা জমিয়ে রেখেছিল।
এ অবস্থায় ছেলেরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল। মহসীন, মাহমুদ, সম্মী আর নূর একদলে এবং অপর দিকে হামিদ বেচারা একেবারে একা। সম্মী তো বিধর্মী হয়ে গেছে। বিপক্ষ দলে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু বাকি সবাই হামিদের চেয়ে দু এক বছরের বড় হলেও তার ক্ষুরধার আক্রমণে তারা শুধু বিপর্যস্তই নয়, আতঙ্কিত বটে! ন্যায় ও নীতির শক্তি হামিদের পক্ষে। এখন এক পক্ষে মাটি, অন্যপক্ষে লোহা, তাতে আবার ইস্পাতের তীব্রতা যার ঝাঁঝে অন্যেরা সবাই কুপোকাত। সেটা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী আর ঘাতকও বটে! যদি সত্যিকারের কোনও বাঘ এসে পড়ে তাহলে তো মিঞা ভিস্তি ছুটে পালাবে, সিপাই মাটিতে বন্দুক ফেলে ছুট দেবে। উকিলসাহেবের নানী মারা যাবে, আর চোগায় মুখ লুকিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়বে। কিন্তু আমার এই চিমটে বাহাদুর, এ হলো বিক্রমশালী, এক লাফে বাঘের ঘাড়ে চেপে বসবে এবং তার চোখ দুটো খাবলে নেবে।
মহসীনের অবস্থা হল গভীর সমুদ্রে ডুবন্ত খড়কুটোর মতো, একেবারে ডুবে যাবার অন্তিম লগ্নে কোনওরকমে একটা যুক্তি খাড়া করে সে বলল, কিন্তু তোর চিমটে তো আর ভিস্তির মতো জল ভরতে পারবে না, সিপাইয়ের মতো গুলো ছুঁড়তে পারবে না, আর-
হামিদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, থামো! অনেক বাতেলা হয়েছে আর নয়। এটা দিয়ে তোমায় ভিস্তিকে একটা ঘা দিলেই ছুটে গিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে এনে দরজায় ছিটোতে থাকবে। আর সিপাইয়ের বন্দুকে চিমটে দিয়ে আঘাত করতেই সে গুলো ছুঁড়তে শুরু করবে।
মহসীন হেরে ভূত হয়ে গেল। কিন্তু মাহমুদ হারবার পাত্র নয়। মহসীনকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসে বলল, যদি কেউ গোঁ ধরে বসে কোনও অন্যায় কিছু কাজ করার জন্য, তাহলে তাকে ধরে বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তো আমার ওই উকিলসাহেবেরই পা ধরতে হবে।
হামিদ তার এই যুক্তির জবাব দিতে পারল না। উল্টো সে বলল, কার এমন সাহস আছে যে, আমাকে ধরতে আসবে?
নূর উচ্চতা দেখিয়ে বলল, কেন এই বন্দুকধারী সিপাই ধরবে।
হামিদ মুখ ভেংচিয়ে বলল, এই ক্ষীণজীবি সিপাই আমার বীর বাহাদুরকে ধরবে? আচ্ছা নিয়ে আয় তোর ওই সিপাইকে। এখনি এদের দু জনের মধ্যে কুস্তি হয়ে যাক। দেখি কে হারে কে জেতে! তা এর চেহারা দেখেই তো সে, পালাবে। জানি না, কি করে একে ধরবে সে!
মহসীনের মনে নতুন এক বদবুদ্ধি এল। সে বলল, তোর ওই চিটের মুখ রোজই আগুনে পুড়বে, সে খেয়াল কি আছে তোর? সে ভেবেছিল তার এ কথা শুনে হামিদ একেবারে নীরব হয়ে যাবে, কিন্তু তা হল না।
হামিদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, যারা বীরপুরুষ তারাই তো আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু তোমাদের ওই উকিল, সিপাই আর ভিত্তি আগুন দেখলে লেড়ি কুত্তার মতো লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে। আগুনে ঝাপ দেওয়া, এই বীর বাহাদুর ছাড়া আর কারও সাহস থাকতে পারে না।
এবার মাহমুদ বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, আমাদের উকিলসাহেব আদালত কক্ষে চেয়ার-টেবিলে বসবে। আর তোর ওই চিমটের স্থান হবে রান্নাঘরে মেঝেতে কিংবা উনুনে।
মাহমুদের এই যুক্তি সম্মী আর নূরকে বেশ সজীব করে তুলল। ও তো খাঁটি কথাই বলেছে। চিমটের স্থান রান্নাঘরে হবে না তো কি চেয়ারে বসবে?
হামিদ সঠিক জবাব খুঁজে না পেয়ে চোটপাট করতে শুরু করে দিল। না, আমার চিটে রান্নাঘরে পড়ে থাকতে যাবে কেন? তোদের উকিলসাহেব চেয়ারে বসলে আমার চিমটে গিয়ে তাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে ছাড়বে। আর তার সব আইন তার পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে।
সব কথাই যুক্তি তর্কের নয়, কেবল গালিগালাজ মাত্র। কিন্তু আইন-কানুন পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবার ব্যাপারটা কেমন যেন বাজিমাৎ করে দিল। যুক্তিতর্কের ব্যাপারটা এমনি এক পর্যায়ে এসে পড়ল যে, প্রতিপক্ষ তিনজনই পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। তাদের হাবভাব দেখে মনে হল, যেন ঢোঁড়া সাপ কোনও গোখরো সাপকে কামড়ে দিয়েছে। আইনের ধর্ম হল, মুখ থেকে বেরিয়ে আসা। সেটা পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবটা একেবারে অচল হলেও কথাটার মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে। শেষ পর্যন্ত হামিদেরই জয় হল। তার চিমটে বীর বিক্রমশালীই বটে! অতএব অবশেষে মহসীন, মাহমুদ, নূর ও সম্মী এ ব্যাপারে কোনও আপত্তিই আর করল না।
জয়ী ব্যক্তি পরাজিতদের কাছে স্বভাবত যে সম্বর্ধনা পায়, হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। প্রচুর সম্বর্ধনা পেল সে। অন্যেরা তিন-চার আনা করে তিল তিল করে জমানো পয়সা খরচ করলেও কখনও তার মতো কোনও কাজের জিনিষ কেউ কিনতে পারেনি। অথচ মাত্র তিন পয়সা খরচ করে হামিদ সবাইকে টেক্কা দিয়ে ফেলেছে। হামিদ ঠিকই তো বলেছে। খেলনার কি আর ভরসা? মাটির খেলনা, ভেঙেচুরে যাবে দু চারদিনের মধ্যেই। কিন্তু হামিদের চিমটে তো বহু বছর ধরে থাকবে।
এরপর সন্ধির পালা। তাই সন্ধির শর্ত কি হবে তার নির্ধারণ হতে লাগল। মহসীনই সন্ধির প্রথম শর্ত হিসেবে বলল, দে তো তোর চিমটেটা একবার, হাতে নিয়ে দেখি ওটার গুরুত্ব কতখানি। আর তুই আমার ভিস্তিটা পরখ করে দেখ।
মাহমুদ এবং নূর তারাও যে যার নিজের খেলনা বিনিময়ের প্রস্তাব করল।
এইসব শর্ত মানতে হামিদের কোনও আপত্তি ছিল না। এবং সেই মতো তাদের খেলনার জিনিষ বিনিময় হতে থাকল একে অপরের হাত ঘুরে ঘুরে। হামিদের চিমটে হাতে হাতে ঘুরতে থাকল। আবার সকলের খেলনাই হামিদের হাতে এল এক এক করে। সত্যি, কি সুন্দর খেলনাগুলো!
হঠাৎ হামিদ বদলে গেল। এতক্ষণ সে তার প্রতিপক্ষ বন্ধুদের পুতুলের বিরূপ সমালোচনা করে এসেছিল, তাদের খেলনাগুলো অকাজের বলে জাহির করে এসেছিল এবং তার বন্ধুরা তার কাছে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত। কিন্তু হামিদ এখন পরাজিত বন্ধুদের সান্ত¡না দিয়ে বলল, সত্যি বলছি, আমি তোদের রাগাবার জন্যে তোদের পুতুলগুলো খারাপ, মিথ্যে করেই বলেছিলাম। আমার চিমটেটাও ভাল। কিন্তু এইসব খেলনার কাছে চিটেটা কি মানায়, বড় ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছে। আমি নিজেই নিজের জিনিষের প্রশংসা করেছিলাম।
কিন্তু মহসীনের দল এরকম খোসামুদে কথায় ভুলল না। চিমটের জয়জয়কার ডাকটিকিট একবার খামের ওপর সেঁটে গেলে শত জল দিয়েও আর খোলা যায় না। তাদের খেলনাগুলো সম্পর্কে হামিদের কটূ মন্তব্যের পরিবর্তন আর সম্ভব নয়। এ কথা ভেবেই মহসীন হতাশসুরে বলল, কিন্তু এই খেলনাগুলোর জন্যে কেউ কি আমাদের আশীর্বাদ করবে না?
মাহমুদ বিদ্রুপ করে বলল, তুই আবার আশীর্বাদের আশা করছিস, দেখে বাড়ি ফিরে গিয়ে উল্টে মার খেতে না হয়! আমাদের ঠিক বলবে, মেলায় মাটির খেলনা ছাড়া অন্য আর কিছু পেলি না?
অপরদিকে হামিদ স্বীকার করল, চিমটে দেখে তার নানী যত খুশি হবে, খেলনাগুলো দেখে কারওর মা সেরকম খুশি হতে পারবে না। সে তিন পয়সাতেই দুনিয়ার সব সুখ কিনে নিয়েছে, আর সে যা কিনেছে তাতে অনুশোচনা করার কিছু নেই। তাছাড়া চিমটে তো বীর বিক্রমশীল এবং দুনিয়ায় সব খেলনার বাদশাহ।
ফেরার পথে রাস্তায় মাহমুদের খুব খিদে পেল। তার আব্বাজান খাবার জন্যে তাকে কলা কিনে দিয়েছিলেন। মাহমুদ কেবল হামিদকেই তার খাবার কলার ভাগ দিল। তার অন্য সব দোস্তরা তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারা সবাই বুঝল, সেটা চিমটেরই প্রসাদ বলে ধরে নিতে হবে।
বেলা তখন এগারোটা। গ্রামে খুব হৈচৈ পড়ে গেল। তার কারণ, মেলায় যাত্রীরা সবাই ফিরে এসেছে। মহসীনের ছোট বোন তার হাত থেকে ভিস্তিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে আনন্দে লাফাতে লাগল, এর ফলে তার হাত থেকে মিঞা ভিত্তি পড়ে গিয়ে ইহলীলা ত্যাগ করল। আর এরপরেই শুরু হয়ে গেল ভাই-বোনের ঝগড়া আর মারপিট। দু জনেই কাঁদতে থাকে। কান্না শুনে তাদের আম্মাজা ছুটে এলেন। দৃশ্যটা দেখে বিরক্ত হয়ে তিনি দুজনকেই আরও কয়েকটা যা চালিয়ে দিলেন তাদের ওপর।
ওদিকে নূর মিঞার উকিল সমাজে একজন গণ্যমান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাই তার পরিণতি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো তো হতে পারে না, তার পরিণতির ইতিহাসটা একটু বেশি বর্ণময় ও গৌরবময় হওয়া উচিত। উকিল বলে কথা। তিনি তো আর সাধারণ মানুষের মতো মাটিতে বা তাকে বসতে পারেন না। তার সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রে মর্যাদার কথা তো স্মরণ রাখা উচিত। তাই খুব যতœ করে দেওয়ালে দুটো লম্বা লম্বা হক পোঁতা হল। তার ওপর রাখা হল একটা কাঠের তক্তা। আর তক্তার ওপর পাতা হল রঙীন কাগজের গালিচা। উকিলসাহেব রাজার মতো সিংহাসনে উপবেশন করলেন। একান্ত অনুগত নূর তাকে চামর দুলিয়ে হাওয়া করতে লাগল। সাধারণ আদালতকক্ষে থাকে খসখসের পর্দা আর বিজলী পাখা। তাই নূররা যতোই গরীব হোক না কেন সেখানে কি একটা মামুলি পাখাও থাকবে না? তাছাড়া আইনের গরম ঠাণ্ডা মাথাকেও গরম করে তোলে। তাই বাশের তৈরী পাখা এল। আর নূর সেই পাখা দিয়ে উকিলসাহেবকে হাওয়া করতে থাকে বেশ জোরে জোরে। বোঝা গেল না, পাখার হাওয়ায় নাকি পাখার আঘাতে উকিলসাহেব কখন ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পৌঁছে গেছেন এবং তার মাটির দেহ মাটিতেই পরিণত হয়ে গেছে। তারপর কান্নার রোল উঠল সেখানে। চিৎকার করে শোক প্রকাশ এবং বিলাপ সেরে উকিলসাহেবের অস্থি ও হাড়গোড় আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হল।
এবার মাহমুদের পিপাইয়ের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। গ্রামে পা দেওয়া মাত্রই তিনি সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম পাহারা দেওয়ার ভার পেয়ে গেলেন। কিন্তু পুলিশের সিপাই বলে কথা! পুলিশের সিপাই সাধারণ মানুষ নয় যে, নিজের পায়ে হাঁটবেন। তাই তিনি পালকিতেই যাবেন গ্রাম পাহারা দিতে। তাই একটা ঝুড়ি এল। আপাতত এই ঝুড়িটাই তার পালকি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাতে লাল রঙের কিছু ছেঁড়া কাপড় বিছানো হল। আর সিপাইসাহেব সেখানে আরাম করে শুয়ে পড়লেন। মাহমুদ ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে নিজেদের ঘরের দরজায় পায়চারী করতে লাগল। তার দুই ছোট ভাই সিপাহীদের মতো আধো-আধো স্বরে ছোনেবালে জাগতে লহো বলে হাঁক দিতে থাকে। কিন্তু এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘন আঁধারে রাত নামতেই মাহমুদ দরজার চৌকাঠে ঠোকর খেলো। সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়িটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ল আর সিপাই বন্দুকসহ ঝুড়ির আরামদায়ক বিছানা থেকে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল এবং এর ফলে তার একটা পা গেল ভেঙে।
এ অবস্থায় হামিদ আজ নিজেকে ভাল অভিজ্ঞ ডাক্তার বলে মনে করল। তার এমন একটা মলমের কথা জানা আছে যে, খোঁঙা পা অনায়াসে জোড়া লেগে যায়। তবে এর জন্যে একটু ডুমুরের আঠা দরকার। তা ডুমুরের আঠাও এসে গেল। জোড়া লাগানো হল ডুমুরের আঠা দিয়ে। কিন্তু সিপাইকে দাঁড় করানো যার তার ভাঙা পাটা আবার খসে পড়ে গেল। শল্যচিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ায় তখন কি আর করা যায় ল্যাংঙা পা নিয়ে তো আর চলা যায় না। তাই অপর পাটাও এবার ভেঙে দেওয়া হল। দুটো পা না থাকুক এখন কোনওরকমে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থিতু হয়ে বসে তো পাহারা দিতে পারবেন তিনি, আর এভাবেই সিপাই সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে তিনি পাহারা দিতে থাকেন। কখনও কখনও আবার দেবতাও হয়ে যান তিনি, তার মাথার লাল পাগড়িটাও খুলে নেওয়া হয়েছে। মাহমুদ এখন তাকে যে কোনও ভূমিকায় রূপান্তরিত করতে চায়, করতেও পারে। কখনও কখনও বা তাকে দিয়ে বাটখারার কাজও চালিয়ে নেওয়া যায়।
এবার হামিদের চিমটের অবস্থাটা কী হল দেখা যাক। আমিনা তার সাড়া পেয়েই ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকেন। হঠাৎ হামিদের হাতে চিমটে দেখে অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আরে, এ চিমটে কোথায় পেলি?
মেলা থেকে কিনে এনেছি তোমার জন্যে।
দাম কত?
তিন পয়সা।
আমিনা বুক চাপড়ালেন। কি রকম বে-আক্কেলে ছেলে তুই রে! এত বেলা হল তবু কিছু খাওয়া-দাওয়া করিসনি? তোকে আমি কিনা খাবার জন্যে পয়সা দিলাম, আর তুই কিনা একটা চিমটে নিয়ে এলি? সারা মেলায় ওই লোহার চিমটে ছাড়া আর কিছু কি তোর চোখে পড়েনি বাছা?
হামিদ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, রুটি সেঁকতে গিয়ে তোমার হাত উনুনের আগুনে পুড়ে যায় বলেই তো এই চিমটেটা নিয়ে এলাম।
আমিনার সব রাগ সঙ্গে সঙ্গে স্নেহ আর ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। আনন্দে, নাতির গর্বে এবং বিস্ময়ে তিনি যেন কেমন হয়ে গেলেন। এতটুকু বাচ্চা ছেলে, এর মনে এত আত্মত্যাগ, এত মমতা, এত কর্তব্যবোধ, এত বড় বিবেক। বন্ধুরা খেলনা ও মিষ্টি কিনেছে দেখে নিশ্চয়ই ওর-ও ইচ্ছে হয়েছিল। তাহলে? এত ধৈর্য, এত সংযম ও কোথায় শিখল। আশ্চর্য! মেলায় গেছে, সেখানেও বুড়ি নানীর কথা মনে পড়েছে। তার কথা ভেবেছে। আমিনার মন খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল।
এরপর একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে দেখা গেল। সেটা হামিদের থেকেও বিচিত্র। ওদিকে বাচ্চা হামিদ বুড়ো মানুষের মতো গম্ভীর হয়ে ঠাম্মার হাবভাব দেখছে। আর বৃদ্ধা আমিনা বালিকা আমিনায় পরিণত হয়ে গেছেন। অঝোর ধারায় তিনি কাঁদছেন এবং তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুর বাদল নামতে দেখা গেল। হামিদ তার নানীর দিকেই স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার রহস্য সে কি আর বুঝবে!
সারাবাংলা/এসবিডিই
অনুবাদ গল্প অনুবাদ: এহছানুল মালিকী ঈদগাহ উর্দু মূল: মুন্সি প্রেমচাঁদ এহছানুল মালিকী এহছানুল মালিকীর অনুবাদ গল্প 'ঈদগাহ' গল্প সাহিত্য