নামী
২২ এপ্রিল ২০২৩ ২১:১১
১
ভাবি, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, আপনার মেয়েটা কি অসুস্থ?
প্রশ্নটা খুব একটা অশালীন নয়, একজন মানুষের অসুস্থতার কথা জিজ্ঞেসই করা যায়, কিন্তু তবুও দীনার মনে হল ভদ্রমহিলা ইচ্ছে করেই তাকে অপমান করতে এই প্রশ্নটা করেছে। এবং জেনেশুনেই করছে। কারণ তার একমাত্র মেয়ে মীনা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক চাইল্ড। আর শুধু এই কারণে তারা টোলারবাগের বাসা বদলে এখানে এই অভিজাত এলাকার দামি ফ্লাটে উঠেছে, যাতে কেউ তাদের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে তাদেরকে তাদের মত থাকতে দেয়। লোকে বলে, ঢাকা শহরে পাশের ফ্লাটের খবর পাশের ফ্লাটে রাখে না। দীনার তা মনে হয় না, বরং মনে হয়, খারাপ খবর হলে শুধু পাশের ফ্লাট কেন গোটা বাড়ি ছাড়িয়ে গোটা মহল্লায় সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। টোলারবাগে থাকতে তাদের বাড়িওয়ালার পুরো বিল্ডিংই নয়, তরকারী মাংসের দোকানদার পর্যন্ত তাকে সামনাসামনি প্রতিবন্ধী বাচ্চার মা বলে মুখে সহানভুতি দেখালেও আড়ালে আবডালে, পাগল ছাগলের মা বলেই সম্বোধন করত। অথচ তার মেয়েটা মোটেই পাগল ছাগল না।
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। দীনা চোখমুখ শক্ত করে এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে।
ঠিক আছে ভাবি, বলতে না চাইলে বলবেন না। তবে অসুস্থতা কোনও লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। বলতে বলতে পাশের ফ্লাটের ভাবি ট্রলি ঠেলে সুপারশপের সারবাঁধা ঊঁচু ঊঁচু তাকের আড়ালে চলে গেল।
দীনার কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। বুঝতে পারছে ওই মুখরা ভাবির কল্যাণে তার মেয়ের অসুস্থতার কথা গোপন থাকবে না। দুদিন পরেই দেখা যাবে আশেপাশের অন্যান্য ফ্লাটের ভাবিরাও পরিচিত হওয়ার নাম করে এসে বাসার ভেতরে উঁকি ঝুকি মেরে হঠাৎ বলে বসবে, আপনার মেয়েটাকে একটু ডাকুন, কথা বলি।
মীনা যে কথা একেবারেই বলে না তা নয়, কিন্তু সামাজিকভাবে যে কথাবার্তা তা বলে না। হঠাৎ হঠাৎ একটা শব্দ বলে সেটাই ভাঙা রেকর্ডের মত বাজাতে থাকে। নাম ধাম বাবা মার নাম এসব জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলবে না। হয়তো হঠাৎ করে বলে উঠবে, ব্যথা, ব্যথা, ব্যথা। তার এই স্বভাবের সাথে যারা পরিচিত নয় তারা তখন স্বাভাবিকভাবেই ভাববে মীনার শরীরের কোথাও না কোথাও ব্যথা হচ্ছে এবং স্বভাবতই জানতে চাইবে কোথায় ব্যথা। কিছুই জানতে পারবে না। তবে হয়তো সেই ভদ্রমহিলাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অথবা গেটের বাইরে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েই বুঝতে পারবে কেন মীনা ব্যথা ব্যথা করছিল। আর এই ব্যাপারটাই দীনাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।
মীনা অনেক কিছুই আগেভাগে বুঝতে পারে!
২.
কলিংবেলের শব্দ হচ্ছে। সুরেলা আওয়াজ। মীনার জন্য এত সুরের ব্যবস্থা। ও মিউজিক শুনতে পছন্দ করে। মিউজিক শুনলে অনেক শান্ত থাকে।
বাইরের কেউ হবে না। তাহলে দারোয়ান ইন্টারকমে ফোন দিত। মীনার বাবারও আসার সময় হয়নি। কে হতে পারে?
দীনা বুকের উপর একটা ওড়না টেনে দিয়ে কী হোলে চোখ রাখল।
পাশের ফ্লাটের ভাবি। এখন ইচ্ছে না থাকলেও দরজা খুলতে হবে। তাছাড়া ভদ্রমহিলার হাতে একটা প্লাস্টিকের প্লেটের মত দেখা যাচ্ছে। খাবার জাতীয় কিছু হবে। এই অবস্থায় দরজা না খোলাটা অশোভনই নয়, অপমানকর।
দীনা দরজা খুলতেই ভদ্রমহিলা প্লাস্টিকের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে হড়বড় করে বলল, ভাবি, আমাদের বাড়ির গাছের কাঁঠাল। খুব মিষ্টি। একটু শক্ত শক্ত খাজা মত আছে। সেজন্যই কামড়ে খেতে ভাল লাগে। মুড়ি মেখে খেয়ে দেখবেন, একদম ফ্রেশ জিনিস। গাজিপুরের বাবার বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। ইয়া বড় কাঁঠাল। ভাল জিনিস একা একা খাওয়া যায় না, তাই ভাবলাম পাশের বাসার ভাবিকে দেই। ভাবি বাসায় মুড়ি আছে তো? না থাকলে বলেন, আমার বাবার বাড়িতে নিজের হাতে বানানো মুড়ি আছে। নিয়ে আসব?
ঘরে মুড়ি নেই। তারপরেও ঝামেলা এড়াতে দীনা বলল, মুড়ি আছে ভাবি। লাগবে না।
ভদ্রমহিলা কাঁঠালের প্লেট এগিয়ে দিল। প্লাস্টিকের প্লেট বেশ সুন্দর করে সেলোটেপ দিয়ে মোড়ানো। বাইরে থেকেই বাড়িয়ে দিল। এখন ভদ্রতা করে হলেও মহিলাকে ভেতরে আসতে বলতে হবে। কিন্তু দীনার এই মুহুর্তে তেমন কোনও ইচ্ছেই নেই। কারণ মীনার এ্যাপিলেপটিক এ্যাটাক হয়েছে। এসময় সে মীনাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। তখন আস্তে আস্তে ওর এ্যাটাক কেটে যায়।
ভাবি, ভেতরে এসে বসেন। দীনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল। মানুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রণা! অনিচ্ছায়ও অনেক কাজ করতে হয়।
ভদ্রমহিলা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, না, ভাবি, এখন আর বসব না। দুপুরের রান্না চাপানো হয়নি। আপনার ভাই আবার আমার হাতে রান্না ছাড়া খেতে পারে না। কাজের বুয়া কোনও একটা আইটেম রান্না করলে ঠিকই ধরে ফেলে। কি যে যন্ত্রণায় আছি! ভদ্রমহিলার মুখের ভাব দেখে মোটেই যন্ত্রণায় আছে তা মনে হল না।
ভদ্রমহিলা ড্রয়িংরুমে এসে বসে বাসার চারিদিকে দেখতে লাগল। তখনই বেডরুম থেকে চাপা গোঙানীর সাথে ছাড়া ছাড়া কথা শোনা যেতে লাগল, বিষ! বিষ! বিষ!
দীনা কাতর স্বরে বলল, ভাবি আপনি একটু বসুন। আমি আসছি। আমার মেয়েটা অসুস্থ।
ভদ্রমহিলা সোফায় না বসে থেকে ঠিকই দীনার পেছন পেছন অগোছালো বেডরুমে এসে ঢুকল।
মীনা বিছানার উপর কুকড়ে শুয়ে আছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। দীনা এসব ব্যাপারে অভ্যস্থ। ওর দাতের ফাকে প্লাস্টিকের টুথক্যাপ দিয়ে দিতে হয় তাহলে জিবে কামড় লাগে না।
দীনা দেখল মীনার ইপলেপটিক এ্যাটাক শেষ হয়েছে, সে শুয়ে থেকে একঘেয়ে স্বরে বিড়বিড় করে, বিষ! বিষ! বিষ! বলেই চলেছে।
ভদ্রমহিলা মীনার অবস্থা দেখে হকচকিয়ে গেছে। দশ এগারো বছরের ফুটফুটে পরীর মত একটা মেয়ে এই জাতীয় অসুস্থ তা সে আশা করেনি। নিচু স্বরে বলল, আপা, আমি যাই। একদিন ভাবি ডাকছিল, তাও ভুলে গেছে।
দীনা বলল, বসুন, ভাবি। ও শান্ত হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড়বে। এ্যাটাকের ঝড় শেষ হলে ঘুমায়। তারপর একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়। আপনি একটু ড্রয়িংরুমে বসুন। আমি চা চাপিয়ে দিয়ে আসি।
আরে ভাবি, না, না এখন এই দুপুরবেলা চা লাগবে না।
বসুন না, নিজের জন্য করব। সেই সাথে আপনারও এককাপ। ওর এ্যাটাক হলে আমারই খুব ক্লান্ত লাগে।
দুজনে চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছে। দীনা কেন জানি আগের চেয়ে অনেকখানি সহজ হয়েছে। হয়তো লুকানো জিনিস প্রকাশ হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে যে ড্যামকেয়ার ভাব চলে আসে তেমনটিই হয়েছে। সে খুব স্বাভাবিক স্বরেই বলল, ভাবি, আপনি আগেরদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আমার মেয়েটা অসুস্থ কিনা? হ্যা, ও অসুস্থ। তবে সেই অসুখ শারীরিক বা কোনও ভাইটাল অর্গানের অসুখ না। ওর অসুখটা ওর মস্তিস্কে। ও মানসিক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। অটিস্টিক বেবি। এটা ও জন্মগতভাবেই পেয়েছে। ডাক্তারি ভাষায় ওর সমস্যাটাকে ডাউন সিনড্রোম বলে। ডাউন সিনড্রমে বাচ্চারা একটা বাড়তি ক্রোমোজম নিয়ে জন্মায়। সব মানুষের ৪৬টা ক্রোমোজোম থাকে। বাবার কাছ থেকে আসে তেইশটা, মায়ের কাছ থেকে তেইশটা। ও শরীরে একটা বাড়তি ক্রোমোজম আছে। কোথা থেকে এসেছে আমি জানিনা। একটা এ ক্রোমোজম বা অজানা ক্রোমোজমই ওকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটানা কথাগুলো বলে দীনা দম নিল। মীনা অটিস্টিক বেবি জানার পর থেকে ওরা স্বামী স্ত্রী ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট, স্পেশালিস্ট দেখাতে দেখাতে নিজেরাই স্পেশালিস্ট বনে গেছে।
ভদ্রমহিলা, দীনা এখন যার নাম জানে, শায়লা ভাবি, হঠাৎ বলে উঠলেন, ও বিষ, বিষ করে বিড়বিড় করছিল? তার মানেটা কি?
মানেটা কি ঠিক আমিও জানি না, ও কারওর কোনও কথায় রেসপন্স করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে অর্নথক কিছু শব্দ আওড়ে যায়। ডাক্তারেরা বলেছেন, ওর মস্তিস্কে ওখন ওই জিনিসটা ঘুরে ঘুরে আসে।
ওকে কোনও বিশেষায়িত স্কুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ভাবি? ঢাকা শহরে ও তো এখন বিশেষ শিশুদের জন্য অনেক স্কুল আছে।
দীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দিয়ে দেখেছি। খুব একটা কাজ হয় না। মাঝে মধ্যে রিভোল্ট করে। তখন টিচার বা অন্য বাচ্চাদের হাত টাত কামড়ে একাকার করে দেয়।
ভাবি, শুনুন, আমি জানি, এসব বিষয়ে আপনি অনেক বেশিই জানেন। তবুও আমি বলি কি, ওকে কোনও একটা বিশেষ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। একজন স্টুডেন্ট একজন টিচার এরকম দুএকটা স্কুল আছে। ওখানে ও কিছুটা সময় কাটিয়ে এলে আপনিও একটু রিলাক্স হতে পারবেন, মীনারও ভাল লাগবে। হয়তো ধীরে ধীরে ও সুস্থ হয়েও উঠতে পারে।
সত্যি বলতে কি, স্কুলের দেওয়ার কথা যে ভাবছি না, তা নয়। তবে আপনার ভাই অনেক আপসেট হয়ে পড়েছে। মেয়ের পিছনে সময় দিতে দিতে তার ব্যবসার বেশ ক্ষতি হয়েছে। বেশ কিছুদিন লস দিয়ে এসেছে। এখন একটু থিতু হয়েছে, এজন্য ব্যবসার দিকে মনোযোগ বেশি।
ভাবি, ভাইয়ের সময় দেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। আপনিই মুভ করবেন। আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে যেতে পারি। তাছাড়া আমার নিজের পরিচিত একটা স্কুল আছে। এই গুলশান বাড্ডাতে। পরিচালকের নিজের বাচ্চা অটিস্টিক হওয়ায় খুব যত্ন নিয়ে কেয়ার করে। ওখানে আমার এক কাজিন টিচার হিসাবে চাকরি করে। আপনি চাইলে আমি এ ব্যাপারে আপনাকে হেল্প করতে পারি।
থাঙ্ক ইউ ভাবি। আমি আপনার ভাইয়ের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাব। তারপর না হয় সময় করে দুই বোন এক সাথে স্কুলটা ভিজিট করে এলাম।
সেদিন রাতেই কাঁঠাল দুধ দিয়ে ভাত খেয়ে শোয়ার পর ভোররাতের দিকে দীনা আর পলাশ দুজনের শরীর খারাপ লাগতে থাকে। এবং তা এমনই খারাপ যে মীনাকে শায়লা ভাবির কাছে রেখে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। ডাক্তার দেখে শুনে বললেন, সন্ধ্যে রাতের খাবার থেকেই ফুড পয়জনিং হয়ে গেছে। নিরীহ খাবার কোনও এক বিক্রিয়ার কারণে পেটের মধ্যে গিয়ে বিষ হয়ে গেছে।
তখনই দীনার মীনার বলা সেই বিষ! বিষ! শব্দটা ঘুরঘুর করতে থাকে।
৩.
সবকিছু এত সহজে হয়ে যাবে তা দীনা ভাবেনি। এবং এই সহজটা হয়েছে শায়লা ভাবির কল্যাণে। শায়লা ভাবির কাজিন সায়রা মিস অনেক হেল্প করেছেন। আর দেবশিশু স্কুলের পরিচালক তাহমিদা ম্যাডাম এত আন্তরিকতার সাথে মীনাকে গ্রহণ করেছে যে দীনার মনে হয়েছে এখানে অন্তত তার মেয়েটার অযত্ন হবে না। এর আগে যেসব স্কুলে মীনাকে দিয়েছিল তাদের মধ্যে কেমন যেন ব্যবসায়ী ভাবটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর এখানে ব্যবসার চেয়েই যে সেবাযত্নই প্রধান তা এখানকার সবার বডি ল্যাংগুয়েজেই ফুটে উঠেছে।
বাসায় ফিরেই দীনা শায়লা ভাবির দু’হাতে ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ভাবি। আপনি আমার জন্য নিজে কষ্ট করে যা করলেন তা আমার নিজের বোনও করত কিনা সন্দেহ।
শায়লা ভাবি গাঢ় স্বরে বলল, আপন মানুষ পর হয়। পর মানুষ আপন, এই তো জগতের নিয়ম।
শায়লা ভাবি যে ওদের সংসারের অনেকখানি আপন হয়ে গেছে তা দীনা বুঝতে পারছে। এই মহিলা নিসঙ্গ। এবং সন্তানহীন। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। সারাদিন বাইরেই থাকেন। মহিলার অফুরন্ত সময়। সেই সময় এবং সন্তানহীনতার মমত্ব অনেকখানিই মীনার উপর ঢেলে দিয়েছে। শায়লা ভাবির কাছে মীনাও বেশ শান্ত থাকে। মীনাকে রেখে এখন ওরা দুজন নিজেদের মত করে একটু সময় কাটাতে পারে। তাতে শায়লা ভাবি, মীনা কেউ কিছু মনে করে না। এই তো সেদিন ভাবির কাছে রেখে দুজনে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে থ্রিডি মুভি দেখে এল।
মীনাকে দেবশিশুতে দেওয়ার পরে দীনার হাতে বেশ অনেকটা সময় থাকে। প্রায় দুপুর পর্যন্ত বাসায় কোনও কাজ করার নেই বললেই চলে। পলাশ বলেছিল, ড্রাইভিংটা শিখে নিতে। তাহলে টাকা জমিয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেলত। দীনা গাড়িতে চড়ে মীনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত। পলাশ নিজে ড্রাইভিং জানে। তার মোটরবাইক আছে। তাতে করেই নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যায়। এখন একটা গাড়ি কেনার জন্য খুব ঝোঁক দিচ্ছে। দীনা ভাবতে থাকে, মীনাকে স্কুলে দিয়ে আসার এই অবসরে কোথাও ড্রাইভিংটা শিখে ফেলবে কিনা। এসব খবরাখবর জামাল ভাই খুব ভাল জানে। জামাল ভাই মীনার খালাতো ভাই। মীনার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। কাজিনদের মধ্যে যে ভাইবোন প্রেম হয় তেমনটি কিছুটা হয়েছিল। তাছাড়া বাড়ির দিক থেকে জামাল ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া যায় কিনা, এরকম কথাবার্তা চলছিল। তখনই পলাশের সাথে পরিচয় অতঃপর প্রেম এবং বাড়ির সবার সম্মতিতে দুপরিবার মিলেই বিয়ে।
দীনা জামাল ভাইকে মোবাইলে কল দিল, কিরে দীনু, এতদিন পর মনে পড়ল?
আমার তো তাও মনে পড়ে। তুমি তো ভুলেও একবারও ফোন দাও না।
ভয়ে দেই না। তোর জামাই ধরে ফেললে কি ভাববে বলত। আমাদের দুজনেরই ঘর সংসার আন্ডা বাচ্চা হয়ে গেছে তারপরও তোর জামাইয়ের সংকোচ যায় না।
ও একটু ওরকম মানুষই জামাল ভাই। সোজাসাপটা ধরনের। ওর কথায় কিছু মনে নিও না।
কি জন্য ফোন করেছিস বল? নিশ্চয় জামাইয়ের সাফাই গাওয়ার জন্য না।
জামাইয়ের সাফাই গাইলে তোমার কোনও অসুবিধে আছে? পতিব্রতা স্ত্রীরা জামাইয়ের সাফাই গায়। কেন তোমার বউ গায় না?
কি জানি। আমার সামনে তো সাফাই কেন কোনও কিছুই গাইতে শুনিনি। হা, হা হা।
হা হা বন্ধ কর। শোনো, ড্রাইভিং শিখতে চাচ্ছি। কোথায় শেখা যায় বলো তো?
কেন, তোর জামাই গাড়ি কিনেছে নাকি? জানতেই তো পারলাম না।
কিনলে না তবেই জানবে। কিনিনি। আমি ড্রাইভিং শিখি তারপর কিনবে। এখন বল কোথায় ড্রাইভিং শিখব। তোমার কারওর সাথে পরিচয় আছে?
আছে। আমার নিজের সাথে। আমি খুব ভাল ড্রাইভার। আমি তোকে ফ্রিতে শিখিয়ে দেব।
ফাজলামি রাখ। আমার ইনফরমেশন দরকার।
ঠিক আছে। আমি তোকে ডিটেলস জানাচ্ছি। একটু সময় লাগবে। শোন, তুই এখন আছিস কই?
কেন?
চট করে চলে আসতাম। ড্রাইভিংয়ের প্রথম হাতেখড়িটা আমার হাতেই হতো।
আধঘন্টার মধ্যে জামাল ভাই গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। নতুন মডেলের প্রিমিও গাড়ি। সিলভার কালার।
জামাল ভাই বলল, আমি বসব না। তুই রেডি হয়ে নে। দুপুরে তো তোর জামাই বাসায় আসে না। বাইরেই খেয়ে নিস। মীনা কই?
ও স্কুলে। আর ঘন্টাখানিক পর ওকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। তোমার সাথে বের হতে পারব না।
মীনা স্কুলে। খালি বাসা। এসব জেনে বোধ হয় জামালের চোখ চকচক করে উঠল। খালাত বোনের সাথে গাঢ় শারিরীক সম্পর্ক না হলেও বিয়ের আগে দুজনেই জড়াজড়ি চুমাচুমি হাতাহাতি বেশ ভালই হয়েছে। কাজিনদের মধ্যে অমনটি হয়েই থাকে।
বসব না বসব না করেও জামাল বসে পড়ল। দীনা নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে চাইলে জামাল বলল, তোর এখানে নাস্তা খেতে আসেনি। একটু পাশে বস। সৌন্দর্যে ঢলঢল করছিস, তাই একটু দেখি। বিবাহিত মহিলাদের যে সৌন্দর্য সেই সৌন্দর্য কখনও বিয়ের আগে পাওয়া যায় না।
সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছ দেখছি। মোটা হয়ে গেছি সেটা খেয়াল করেছো।
মেয়েদের একটু মোটার ধাঁচই ভাল লাগে। বলতে বলতে দীনা বিয়ের আগে কেমন ছিল আর এখন কতখানি মোটা হয়েছে তাই পরখ করতে চাইল জামাল। দীনা প্রথমে বাধা দিতে চাইলেও আস্তে আস্তে নিজেকে সমর্পণ করল প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে। দৈহিক ঝড়ের মধ্যেও দীনার মাথা থেকে মীনার স্কুলের ব্যাপারটা ঘুর ঘুর করতে লাগল। সে গোঙাতে গোঙাতে বলল, জামাল ভাই, মীনার স্কুলের ছুটির সময় হয়ে যাচ্ছে। ছুটির পরে আমাকে না দেখলে ও দিশেহারা হয়ে পড়ে।
জামাল দৈহিক কসরতে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপনের চেষ্টা করতে করতে বলল, গাড়িতে একটানে তোকে স্কুলে দিয়ে আসব।
স্কুল থেকে ফেরার পথে মীনা একটা কথাও বলল না। দীনা নিজের মনেই অনেক কিছু জিজ্ঞেস করল, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে? মিস আদর করে কিনা? ক্লাসে কি শিখিয়েছে?
মীনা কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু বাম হাতের আঙুল দিয়ে নাকের উপর চেপে ধরে নিশ্বাস বন্ধ করে আবার ছাড়ার খেলা খেলতে লাগল।
ফ্লাটে ঢোকার মুখেই শায়লা ভাবির সাথে দেখা হল। উনি বাজার নিয়ে ফিরছেন। আর তাকে দেখেই মীনা জিকির করতে শুরু করল, জামাল ভাই! জামাল ভাই! জামাল ভাই!
দীনার মুখ রক্তশুণ্য হয়ে গেল। দরজার নবে কী ঢোকাতে গিয়ে হাত কাঁপতে লাগল। শায়লা ভাবি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, ও জামাল ভাই, জামাল ভাই করছে কেন?
দীনা থতমত স্বরে জবাব দিল। স্কুল থেকে বোধ হয় শিখেছে। হয়তো কেয়ারটেকার-ঠেকার কারও নাম হবে। ও অনর্থক অনেক কিছু বলে। বলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। কারণ দীনা ভাল করেই জানে মীনা অনর্থক কিছুই বলে না।
মীনার স্কুল ড্রেস খুলে ঘরের পোশাক পরিয়ে দিল। তখনও সে এক নাগাড়ে জামাল ভাই, জামাল ভাই করেই যাচ্ছে। দীনা বিছানায় মুখ লুকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর মোবাইল বের করে ফোন দিল জামাল ভাইকে। কাটা কাটা রূঢ় স্বরে বলল, আপনি আর কখনও আমার বাসায় আসবেন না। কখনও যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না। আমি বাকি জীবন আর আপনার মুখ দর্শন করতে চাই না। তারপর লাইন কেটে দিল।
মীনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর সুর করে একঘেয়ে স্বরে বলতে শুরু করল, গাড়ি! গাড়ি! গাড়ি!
৪.
দীনা যখন জামালকে ফোন দিচ্ছিল, জামাল তখন ড্রাইভিংয়ে। ড্রাইভিং করতে করতে মনে মনে মাঝে মধ্যে দীনার এখানে এসে অযাচিত সুখ নেওয়া যাবে ভেবে পুলকিত হয়ে সুখ স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু দীনার রাগি ফোন সেই সুখ স্বপ্নে শুধু পানিই ঢেলে দিল না, একটা ছোটখাট এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে বসল। ওয়ান ওয়ে রোড হওয়ায় বড় ধরণের কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। পেছনের গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ড্যাশ বোর্ডে মাথায় আঘাত পেয়ে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে কয়েকটা স্টিচও দিতে হয়েছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার খবর দীনা কিছুই জানেনি। আর জানেনি বলে মীনার গাড়ি, গাড়ি বলাতে একটু অবাক হলেও ওর মনে হয়েছে মনে হয় ওদের নিজেদের গাড়ি কেনার ব্যাপারটাই তার মেয়ে আগেভাগে জেনে বসে আছে ভেবে গাড়ি কেনাটা ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাতে পলাশ ফিরলে দীনা একটু ভয়ে ভয়ে ছিল, না জানি মীনা এবার এক সুরে জামাল ভাই, জামাল ভাই বলতে থাকে কিনা। তাহলে পলাশের বুঝে নিতে একটুও সময় লাগবে না। এবং একদিনের দুর্ঘটনাই পলাশ হয়তো ওদের দীর্ঘদিনের অভিসার ভেবে বড় ধরণের কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে না বসে। কিন্তু মীনা যখন বাবার সামনে এসেও গাড়ি গাড়ি বলতে থাকে তখন দীনা স্বস্তি পায়।
ও ওরকম গাড়ি গাড়ি বলছে কেন? পলাশ দীনার কাছেই জিজ্ঞেস করে। জানে মীনার কাছ থেকে এর সদুত্তর পাওয়া যাবে না।
মনে হয় আজ শায়লা ভাবির কাছে আমাদের গাড়ি কেনার ইচ্ছের কথা বলেছিলাম সেটা শুনেই হয়তো। আমি ড্রাইভিং শেখার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। দীনা তাড়াতাড়ি বলল।
হু। ব্যাপারটা নিয়ে আমিও গত কদিন ধরে ভাবছি। তোমাদেরকে বলিনি। অলরেডি আমি ওএলএক্সে আমার মোটরবাইকটা সেলের জন্য পোষ্ট করে দিয়েছি। ভাবছি সেকেন্ডহ্যান্ড না কিনে একবারে একটা রিকন্ডিশনই কিনে ফেলি। ব্যবসার কিছু টাকা আছে। ব্যাংক থেকে লোন নিলেও হয়ে যাবে।
তোমার মেয়ের স্কুলে মাসে মাসে কিন্তু বেশ টাকা খরচ হচ্ছে।
অসুবিধে নেই। সামলে নিতে পারব। আসলে আমার নিজের ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্যও গাড়ি দরকার। বড় বড় মার্চেন্টট ক্লায়েন্টদের কাছে মোটর বাইক নিয়ে গেলে মুখ থাকে না। তোমাদের নিয়ে আউটিংয়ে বেরুনো গেল। আর তুমি ড্রাইভিং শিখলে ওকে স্কুলে আনা নেওয়ারও সুবিধে হল।
আজ ছুটির দিন আছে। আজকে বিকেলেই চলো গাড়ির শো-রুমগুলো থেকে ঢু মেরে আসি।
তা যাওয়া যায়। মীনাকে কি তোমার শায়লা ভাবির কাছে রেখে যাওয়া যায়। মীনা তো বাইকে চড়তে চায় না।
হু। গাড়ি দেখতে যাচ্ছি বললে রাখা যাবে। তবে ভাবিকে অতো বিরক্ত করতে ভাল লাগে না।
তোমার ভাবি তো এনজয় করে মনে হয়। খুব আগ্রহ নিয়েই তো রাখে।
হু। ছেলেপুলে না হওয়ার যে কষ্ট আছে তা ভাবিকে দেখলে খুব বুঝতে পারি। তখন আমাদের মীনাকেই সাত রাজার ধন মনে হয়।
ওরা কি হাল ছেড়ে দিয়েছে নাকি?
কেন ভাইয়া হাল ছেড়ে দিলে তুমি ভাবির হাল ধরে চেষ্টা করে দেখবা নাকি? দীনা রসিকতা করে। কিন্তু রসিকতাটাকে পলাশ খুব সহজভাবে নেয় না। কারণ মীনার জন্মও খুব স্বাভাবিকভাবে হয়নি। অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়েছে।
ওরা ডাক্তার কবিরাজ দেখাচ্ছে। এখনও আশা ছাড়েনি। ডাক্তাররাও আশা দিয়ে যাচ্ছে।
পলাশের এই প্রসঙ্গ ভাল লাগছিল না। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
দীনা সহজ স্বরে বলল, মীনাকে ভাবির কাছে রাখতে পারব। তুমি আজকেই চলো। আমারও মাথার মধ্যে গাড়ির ব্যাপারটা ঢুকে গেছে।
শায়লা ভাবি খুব আন্তরিকতার সাথেই মীনাকে নিজের বাসায় রাখল। কোনও এক বিচিত্র কারণে মীনা শায়লার কাছে খুব শান্তই থাকে। অটিস্টিক বেবিরা নিজেকে নিয়ে গুটিয়ে থাকতে পছন্দ করে। কোনও কান্নাকাটি করে না। কখনও ইপিলেকটিক সিজারও হয় না। কোনও খাবার দিলে শান্তভাবে খায়। তবে মীনা একটা জিনিস খুবই অপছন্দ করে। কেউ তাকে গায়ে হাত দিয়ে আদর করলে সে পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়। শায়লা ভাবি এই ব্যাপারটা জানে বলেই কখনও ওকে জড়িয়ে ধরে না। যদিও পরীর মত সুন্দর এই মেয়েটাকে তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে।
আজ মীনা শায়লাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। শায়লার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তখন মীনা আপনমনে বলতে শুরু করল, বাবু! বাবু! বাবু! বাবু! বাবু!
৫.
গাড়ি দেখতে গিয়েই গাড়ি কেনা হয়ে যাবে এরকম পলাশ নিজেও ভাবেনি। কিন্তু যা অনেক সময় ভাবা যায় না তাই হয়ে যায়। শোরুমের গাড়ি তবে রিকন্ডিশনড নয়। সেকেন্ড হ্যান্ড। কিন্তু প্রায় নতুনের মতই। গাড়ির কন্ডিশন এতই টিপটপ যে নতুন গাড়ি বলে চালানো যায়। ফার্স্ট পার্টির গাড়ি। তারাই শো-রুমে বিক্রির জন্য রেখেছে। নয় লাখেই করোলা গাড়ি কেনা হয়ে গেল।
নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুবিধে অনেক। গাড়ি হাতে আসার প্রথম দিনেই পলাশ গাড়ির পেছনেই লেগে রইল। বাংলামটর থেকে গাড়ির ভেতরের জন্য সৌখিন কিছু জিনিসপত্র কিনল। এসির সেন্ট, পাপোশ, ঝাড়ু, কভার, কুশন এইসব হাবিজাবি। তারপর ওখান থেকেই রওনা হল চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। মীনা চিড়িয়াখানায় যেতে পছন্দ করে। জীবজন্তুর কান্ডকারখানা দেখে তার মুখ উজ্জল হয়। শুধু তাই নয়, তখন তাকে যা শেখানো হয় তাই মুখ দিয়ে বলে। হাতি বললে হাতি বলে, বানর বললে বানর বলে।
চিড়িয়াখানার কাছাকাছি আসার আগেই মীনা ক্রমাগত কুকুর! কুকুর! কুকুর! বলছিল।
পলাশ আনন্দিত মুখে সর্তকতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলল, মনে হয় চিড়িয়াখানায় যাওয়ার আনন্দেই মিনু মা কুকুর কুকুর বলছে।
দীনা মীনাকে বোঝানোর মত করে বলল, মা কুকুর তো থাকে রাস্তা ঘাটে। চিড়িয়াখানায় কুকুর রাখে না। তুমি দেখতে চাইলে রাস্তার পাশেই তো কুকুর দেখতে পার।
পলাশ হাসতে হাসতে বলল, কুকুর বেড়াল দেখতে কেউ চিড়িয়াখানায় যায় না। তবে বাচ্চাদের জন্য এসব প্রাণিও রাখা উচিত ছিল। বলতে বলতেই রাস্তার মোড় এসে গেল। আর মোড় ক্রস করতেই গাড়ির নিচে একটা রাস্তার নেড়ি কুকুর পড়ে গেল। পলাশ ঘ্যাঁচ করে গাড়ি ব্রেক করল। নেমে এসে দেখল কুকুরটার এক পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। কুকুরটা তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে তার ব্যথা বেদনা অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করছে। পলাশ ভেবেছিল আশেপাশের সাধারণ পাবলিক তার উপর তেড়ে আসবে। সামান্য একটা কুকুর তাদের কাছে অসামান্য হয়ে দেখা দেবে। যাদের গাড়ি নেই তারা গাড়িওয়ালাদের শুধু ঘৃনা করে তাই নয়, তাদের অপদস্থ করে এবং সুযোগ পেলে গাড়ি ভেঙে বিমলানন্দ উপভোগ করে। এক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটল না। সে ইচ্ছে করলে এখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। সামান্য কুকুরের পা ভাঙা নিয়ে কেউ তাকে কোনওরকম দোষারুপ করবে না। কিন্তু বিপত্তি বাধাল মীনা নিজেই। সে স্পষ্ট গলায় পুরো একটা বাক্য বলল, আমি কুকুরটাকে নিয়ে যেতে চাই।
দীনা আর পলাশ খুব বেশি অবাক হল না। মীনা পুরো বাক্যগঠন জানে। কিন্তু কখনও ব্যবহার করে না। যখন তার আকাঙ্খা তীব্র হয়, অথবা তীব্র ব্যথায় কাতর হয় তখনই সে পুরো বাক্য বলে। আর আগে একবার হাত কেটে ফেলে বলেছিল, আমার হাতে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। যে মেয়ে যন্ত্রণার মত শব্দ বলতে পারে, সে সব পারে।
দীনা পলাশের দিকে তাকাল। তাদের চোখে চোখে যে কথা হল তা হল, আজ চিড়িয়াখানা গোল্লায় যাক, এই কুকুরটাকে বাড়িতে না নিয়ে গেলে মীনাকে শান্ত করা যাবে না। কারণ মীনা চাপা গলায় বলছে, আমি কুকুরটাকে নিয়ে যেতে চাই। আমি কুকুরটাকে নিয়ে যেতে চাই। আমি কুকুরটাকে নিয়ে যেতে চাই।
আহত একটা কুকুরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। কুকুরের পায়ের চিকিৎসা হওয়া দরকার। একজন টোকাই টাইপের লোককে একশ টাকা দিয়ে পলাশ কুকুরটাকে গাড়ির পেছনের ডিকে তুলে নিল। তারপর আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, এখানে পশু হাসপাতাল কোথায়? দেখা গেল ঢাকা শহরের পশু হাসপাতাল কোথায় কেউ জানে না।
শেষ পর্যন্ত রাস্তার পাশের একটা ছাপড়া টাইপের দোকানের এক বুড়ো হাতুড়ে ডাক্তার পাঁচশ টাকার বিনিময়ে কুকুরের চিকিৎসা করানোর জন্য রাজি করানো গেল। বুড়োর কম্পাউন্ডার ছোকড়া মহা বিরক্ত। সে কুকুরের পায়ে হাত দেওয়ার জন্য হাতে গ্লাভস পরে নিয়েছে। ডাক্তার পা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ টানাটানি করে কুকুরের ঘেউ ঘেউ চরমে তুলে কোনওমতে কুকুরের ভাঙা পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। এত অত্যাচারেও কুকুর যে তাকে কামড়ে দেইনি সেটাই বড় কথা। বিপদে পড়লে জীবজন্তুও বোধ হয় নিজে স্বভাব ভুলে যায়, শুধু মানুষই ভোলে না!
চিড়িয়াখানায় পশু পাখি দেখতে গিয়ে বোটকা গন্ধের পশুপাখি দেখা হল না। লাভের মধ্যে লাভ হল তিন ঠাংয়ে এক রাস্তার কুকুরকে ফ্লাটবাড়ির নিচতলায় জায়গা করে দেওয়া হল।
কুকুরটা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। সে চুপচাপ শুয়ে থাকে। খাবার দিলে খায়। না দিলেও কোনও সাড়াশব্দ করে না। শুধুমাত্র মীনা নিচে নেমে এলে কুকুরটার চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। তখন কুকুরটার মধ্যে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা দেখা দেয়। মীনা কুকুরটাকে ডাকে না। তবুও যেন মীনার গায়ের গন্ধে ওর নিজস্ব জায়গা ছেড়ে তিন ঠাংয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে আসে। তখন কুকুর ও মীনার মধ্যে একটা খেলা চলে। মীনা কুকুরের সামনে বসে কোনও শব্দ না করে কি যেন বলতে থাকে। আর কুকুরটা মাথা নিচু করে চাপা স্বরে এক ধরণের আওয়াজ করে। যেন মীনার না বলা কথা বোঝার মত বুঝদারের আওয়াজ। বিকেলের দিকটা মীনার বলতে গেলে কুকুরের সাথেই কাটে। প্রথম প্রথম দীনা আর শায়লা পালাক্রমে দুজনেই এসে দাড়িয়ে থাকত। কিন্তু এখন বন্ধ গেটের বাইরে যাতে মীনা কোনও ভাবে যেতে না পারে দারোয়ানকে সেরকম নির্দেশনা ওরা দুজনে উপরে এসে গল্প করে।
বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে রেখে এখানে চাকরি করতে আসা মাঝবয়সী দারোয়ান প্রথম প্রথম মজা দেখার জন্য কুকুর আর মীনার দিকে তাকাত। কিন্তু এখন অন্য কিছু দেখার জন্য তাকায়। মীনা এগারো বছরে পড়ায় শিশু থেকে কিশোরী হতে শুরু করেছে। বুকের কাছটা বেশ খানিকটা ফুলে দেশি কমলার মত দেখায়। মীনা যখন উবু হয়ে বসে কুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন তার পশ্চাতদেশ ভরভরন্ত উত্তেজক হয়ে ওঠে।
মীনা মনে হয় কুকুরটার কোনও একটা নাম দিয়েছে। কারণ সে শব্দ না করেও কুকুরটাকে কিছু একটা বলে ডাকে। কুকুরটা তাতে সাড়া দেয়। ব্যাপারটা শুধু দারোয়ান না, দীনাও লক্ষ্য করেছে। এমনকি একদিন রাতে সে মীনাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কুকুরের একটা নাম আছে তাই না মা?
মীনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
নামটা কি তুমি কি আমাদের বলবে?
মীনা চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল।
তুমি বলবে না? তাই না?
না।
কুকুরটা কি তোমার বন্ধু?
হু।
তোমার আর কোনও বন্ধু আছে? স্কুলে? কাজিনদের মধ্যে?
না।
তুমি কি কুকুরটার সাথে কথা বল?
মীনা কোনও উত্তর দিল না।
কুকুরটা কি তোমার কথা বুঝতে পারে?
মীনা উঠে ওর রুমে চলে গেল। দীনা বুঝল মীনা এই প্রসঙ্গে আর কোনও কথা বলতে চায় না।
মীনা উঠে যে ওর রুমে যায়নি তা দীনা কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারল। কারণ মীনা ওর রুমে নেই। মীনা বাবা মায়ের বেডরুমেও নেই। ড্রয়িংরুমেও নেই। পলাশ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। দীনা এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মীনাকে কোথাও দেখছি না।
কোথাও দেখছি না মানে কি? একটু আগেই তো মা মেয়ে কুকুরের প্যাচাল পাড়ছিলে। তারপর উঠে রুমে গেছে। রুমে না থাকলে বাথরুমে গেছে।
মীনা কখনও আমাকে ছাড়া বাথরুমে যায় না।
আগে যেত না। আজ গেছে। বাথরুমে দেখেছো?
দীনা কোনও কথা না বলে দৌড়ে বাথরুমের দিকে গেল। বাথরুম ভেতর থেকে বন্ধ। মীনা কখনও তাকে ছাড়া বাথরুমে যায় না। সেও পাঠায় না বা অভ্যাস করায়নি। তার ভয় ছিল ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে যদি আর দরজা না খুলতে পারে।
সেটাই হয়েছে। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে লক হয়ে গেছে। মীনা দরজা খুলতে পারছে না। দীনা কয়েকবার জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিল। তাতে কোনও কাজ হল না। ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই। পানি পড়ার শব্দ নেই। দীনা বাথরুমের সামনে থেকে চেচিয়ে ভয়ার্ত গলায় পলাশকে ডাকল।
পলাশ এসেই পুরুষ মানুষের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দুড়ুম দুড়ুম করে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল। এত শব্দে মেয়েটা যে ভয়ে আধমরা হয়ে যাবে সে আক্কেলজ্ঞান তার নেই। অটিস্টিক শিশুরা প্রচন্ড শব্দ সহ্য করতে পারে না।
পলাশ বলল, আর দেরী করা যাবে না। দরজা ভেঙে ফেলতে হবে।
ফেলতে হল ফেল। দেরী করছ কেন?
বাথরুমের প্লাস্টিক টাইপের দরজার নবের কাছটাতে জোরে মোচড় দিয়ে ধাক্কা দিতেই এক চলটা ভেঙে এসে দরজা খুলে গেল।
ওরা দেখল বাথরুমের সাদা চকচকের টাইলসের মেঝেতে উবু হয়ে মীনা বসে আছে। আর মীনার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া রক্ত সাদা মেঝেতে লাল মানচিত্র এঁকে রেখেছে। মীনা রক্তের দিকে শুণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
পলাশ তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েটার শরীরে প্রকৃতি তার খেলা শুরু করেছে। তাকে নারী করে তুলছে।
৬.
দীনাদের ফ্লাটে যখন মীনার প্রথম রজোঃদর্শন নিয়ে প্রবল ঘোর চলছে, মেয়েটি প্রথম রক্তদর্শনে প্রবল ভয় পেয়ে হিস্টোরিয়াগ্রস্থের মত হয়ে গেছে তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
দীনা কীহোলে চোখ দিয়ে দেখল শায়লা ভাবি। হাতে একটা প্যাকেট জাতীয় কিছু। শায়লা ভাবির এই বাতিক আছে। বাসায় কিছু বানালে তার কিয়দংশ এ বাসায় চালান করা। মাঝে মাঝে এই অত্যাচার ভাল লাগলেও পারিবারিক ঝামেলার সময় এই অত্যাচার ভাল লাগে না।
শায়লা ভাবি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার হাতে যে সুদুশ্য মিষ্টির প্যাকেট সেটাও বাড়িতে দিতে ভুলে গেছে। দীনা শায়লার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বলল, ভাবি, বসেন। মিষ্টি কি জন্য?’
শায়লা বিড়বিড় করে অস্ফুট স্বরে বলল, বাবু! বাবু! বাবু!
আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।
বুঝিয়ে বলার মত অবস্থায় আমি নেই। শায়লা যান্ত্রিক স্বরে বলল।
মানে? কি হয়েছে? ভাবি এখানে বসে ঠান্ডা মাথায় বলুন।
আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। মীনা আমার কাছে এসে বাবু বাবু বাবু বলছিল। তখনও বুঝিনি আমার বাবুর কথা বলছে। এ মাসের মেনস্ট্রেশনের ডেট আরও কয়েক দিন আগে পার হয়ে গেছে। তাতেও সন্দেহ করিনি। ওরকম এলমেলো আমার হয়ে থাকে। গত দুদিন যাবৎ বমি হচ্ছে। মাছের আঁশটে গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। আজ সকালে প্রেগনেন্সি টেস্ট করে দেখি পজেটিভ। তাও ওই দুই দাগের উপর ভরসা না পেয়ে গাইনী ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে জানতে পারলাম আমি কনসিভ করেছি। মীনা আগেই বুঝতে পেরেছিল। বাবু বাবু বলছিল…।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন মীনা বাবু বাবু বলছিল বলেই…।
আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে এর মধ্যে মীনার হাত আছে। ওই এই মীরাকলটা ঘটিয়েছে। আমার স্বামী অবশ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছে, মীনাকে কাছে পিঠে পাওয়ার পরে আমার সন্তান ধারণের আকাঙ্খা আরও তীব্র হওয়ায় এমনটি হয়েছে। ওসব ব্যাখ্যা আমি মানি না। আমার সন্তান ধারণের তীব্র আকাঙ্খা আগে থেকেই ছিল। আমি জানি, ও ইচ্ছে করেই এই কান্ডটা ঘটিয়েছে। মীনা ইচ্ছে করলে অনেক অসাধ্য সাধণ করতে পারে। ও কোনও সাধারণ শিশু নয়। ও বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত শিশু। ভাবি, এই আপনাকে বলে রাখলাম। আপনি দেখে নিয়েন। ওকে কখনই অবহেলা করবেন না।
দীনা ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মীনার যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে তা ওরা নিজেরা আগেই টের পেয়েছে। কিন্তু সেটা অনেকটা যেন কাকতালীয় ব্যাপারের মতই মনে হয়েছে। কুকুরের সাথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করার আগেই ওর কুকুর কুকুর বলাটা অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শায়লা ভাবির কথা শুনে মনে হচ্ছে সন্তানহীন মহিলার সন্তান ধারণের মতো অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারীও হয়ে গেছে মেয়েটা। মীনার উপর শায়লা ভাবির যে অলৌকিক বিশ্বাস তা পীরফকির দেবদেবতাদের উপর বিশ্বাসের মতো। কিন্তু এই বিশ্বাস যদি শুধু তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে কোনও কথা ছিল না। কিন্তু তা থাকবে না। এক কান থেকে পাঁচ কান হবে। তাতে মেয়েটার ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। যে ভাবেই এরকম অলৈাকিকত্ব আরোপ বন্ধ করতে হবে।
ভাবি, আপনাকে একটা অনুরোধ রাখতে হবে। দীনা শায়লা ভাবির হাত এঁটে ধরে। মীনার এই ব্যাপারটা আপনি কোনও মতেই আর কাউকে বলবেন না। শুধুমাত্র আপনাদের আর আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। প্লিজ ভাবি, রাখবেন বলেন।
তার মানে আপনারা আগে থেকেও ওর এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা জানতেন?
আপনি যেভাবে বলছেন ওভাবে জানতাম না। কিন্তু ওর বাড়তি ক্রোমোজমের কারণে বাড়তি কিছু ক্ষমতা যে ওর আছে তা আমরা টের পেয়েছি। ও কিভাবে কিভাবে জানি দুএকটা নিকট ভবিষ্যতের কথা বলে দিতে পারে।
ওভাবে মেয়েটাকে অবহেলা করবেন না, ভাবি। ওর দিকে যত্ন নেবেন। আর আমি এসে সবসময়ই ওর খোঁজ নিব। আমার কাছে ওকে রাখতে মোটেই সংকোচ করবেন না।
শায়লা ভাবি বেরিয়ে যেতেই দীনার মনে সন্দেহটা দানা বাধল!
৭.
ফ্লাটের বাসিন্দারা মীনার প্রতিবন্ধকতার খবর আগেভাগে না জানলেও শায়লা ভাবির কল্যাণে এখন মীনার অলৌকিক ক্ষমতার কথা জেনে গিয়েছে। দীনা এমনটাই সন্দেহ করছিল। কিন্তু মীনার প্রতিবন্ধীকতার খবর খুব ভালভাবেই জেনে গিয়েছিল দারোয়ান হাবীব। আর জেনে গিয়েছিল এই মেয়েটাকে দলামোচা করলেও সহজে সে কোনও সাড়াশব্দ করবে না। করবে না বলেই সুযোগের সন্ধানে ছিল হাবীব।
একদিন দুপুরের পরপরই সুযোগটা এসে গিয়েছিল। মীনার বাবা গাড়ি নিয়ে অফিসের কাজে বেরিয়ে গেছে আগেই দেখেছে হাবীব। শুধু তাই নয়, দীনাও মীনাকে কুকুরের সাথে খেলতে পাঠিয়ে হাবীবকে বলেছে, আমার একটু মাথা ধরেছে হাবীব ভাই। ঘর অন্ধকার করে কিছুক্ষণ ঘুমাব। আপনি সেই সময়টা মীনার দিকে একটু খেয়াল রেখেন। যেন গেট দিয়ে বাইরে না যায়।
হাবীব খেয়ালই রাখছে। অনেকক্ষণ ধরেই উবু হয়ে বসে কুকুরের সাথে বসে থাকা মীনার ভরাট পশ্চাদদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। বুভুক্ষের মত তাকিয়ে থেকে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের বাসা বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করতে এসে ওড়না ছাড়া কাঁঠাল কাঁঠাল ভারী বুকের ম্যাডামদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে সবসময়ই ভাদ্রমাসের কুকুরের মত উত্তপ্ত হয়ে থাকে। তখন গ্যারেজের পেছনের নিজের এক চিলতে রুমে শুয়ে ছোট্ট মোবাইলের স্ক্রিণে পর্ণ ছবি দেখে মাস্টারবেশন করে নিজেকে শান্ত রাখে।
আজ আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না হাবীব। মীনার গানের সুরেলা আওয়াজের দিকে ঝোঁক আছে জেনে সে মোবাইলে গানের সুর উচ্চকিত করে মীনার দৃষ্টি আর্কষণ করল। মীনা কুকুরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হাবীবের দিকে তাকাল।
হাবীব ইশারা করে মীনাকে কাছে ডাকল। মীনা গানের সুরের উৎসের দিকে এগিয়ে গেল। তিন ঠেংয়ে কুকুরটা যেখানে শুয়েছিল সেখানেই চোখ মুখ শক্ত করে শুয়ে রইল।
মীনা এগিয়ে যেতেই হাবীব আলেয়ার মত করে একটু পিছিয়ে গেল। মীনাও সুরের দিকে আরও একটু এগুলো। হাবীব মীনার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গেটের দিকে তাকাল। গেটটা ভিতর থেকে ভালভাবে লক করা আছে। দুপুরের পরের এক সময়টাকে তেমন কেউ আসেও না, তেমন কেউ বাইরে যায় না। অন্তত কিছুক্ষণের মধ্যে গেটে কেউ সাড়া শব্দ করবে বলে তার মনে হয় না।
হাবীব আলেয়ার মত করেই মীনাকে সুরের প্রলোভন দেখিয়ে গ্যারেজের পেছনের তার এক চিলতে রুমের দিকে নিয়ে গেল। মীনা নির্দ্বিধায় হাবীবের রুমে ঢুকে গেল। হাবীব দরজা বন্ধ করে মীনাকে পেছন দিক থেকে ঝাপটে ধরল। মীনা গায়ে হাত দেওয়া পছন্দ করে না। সে পাথরের মত শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইল। তাতে হাবীব আরও মজা পেয়ে মীনাকে জাপটে ধরে দলাই মলাই করার চেষ্টা করতে লাগল।
মীনা তখনও নির্বিকার দাড়িয়ে। তার শরীরের উপর যে পুরুষের প্রলোভনের হাত পড়েছে তা এই মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েটা বুঝতে পারছে না।
রুমের নোংরা তেলচিটচিটে দুর্গন্ধময় কাঁথা বালিশের উপর মীনাকে চিৎ করে জাপটে ধরে শুইয়ে দিল। মীনা শারীরিক স্পর্শ পছন্দ করে না বলেই এক ধরণের জান্তব গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। হাত পা একটু অর্ধেক ছোড়াছুড়ির চেষ্টা করলেও প্রবল পুরুষ দারোয়ানের পেটানো শরীরের নিচে সেই হাতপা ছোড়াছুড়ি পিঠ উল্টানো অসহায় গুবরে পোকার মতই দেখাতে থাকল। প্রবল কসরতের মধ্যে দারোয়ান ফ্রকের নিচে হাত গলিয়ে মীনার ইজের টেনেটুনে হাটুর নিচে নামিয়ে দিল। এক হাতে মীনাকে শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাতে নিজের প্যান্টের জিপার খুলে ফেলল, অর্ধনগ্ন হয়ে উপগত হওয়ার চেষ্টায় উপক্রমের মুহুর্তেই হাবীব শুনতে পেল কেউ যেন তার দরজায় ধাকাচ্ছে। মীনার মুখ চেপে ধরে কান খাড়া করে শুনতে লাগল দরজার ওপাশে কে আছে। সে ভাল করেই জানে, তার এই এক চিলতে নোংরা রুমের দিকে ভুলেও ফ্লাট বাড়ির কোনও সদস্য এগিয়ে আসবে না, ম্যাডামরা তো দুরের কথা। কারওর প্রয়োজন পড়লে উচ্চ স্বরে ধমকের ভঙ্গিতে ডাকতে থাকে, না হলে মোবাইলে কল দেয়। গেট ভেতর থেকে বন্ধ হওয়ায় বাইরের থেকে কেউ আসার প্রশ্নই ওঠে না, এলে গেটে শব্দ করত। তাহলে দরজা কে ধাক্কাতে পারে? মীনার মা ম্যাডাম? কিন্তু একবারও মুখে কোনও ডাক নেই কেন? হাবীব ধন্ধে পড়ে গেল। কিছুটা যে ভয় ভয় করছে না তা নয়, এই অবস্থায় তাকে ধরে ফেললে পিটিয়ে আস্ত রাখবে না।
হাবীব কান খাড়া করে শুনতে লাগল। আর কোনও শব্দ নেই। সে আবার মীনার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কচি ডাসা পেয়ারার মত উদ্ধত ফোলা বুকে হাত দিতেই মীনার মুখ থেকে বিড়বিড় করে একটা শব্দও বের হতে লাগল, নামী! নামী! নামী! মেয়ে কুকুরটার নাম সে নিজের নাম উল্টেই রেখেছে। অটিস্টিক শিশুরা উল্টো করে নাম রাখা পছন্দ করে।
আবারও দরজার উপর ধাক্কা। এবারের ধাক্কার জোরও অনেক বেশি। সেই সাথে কেমন যেন আঁচড় কামড় আর হাচড়পাঁচড়ের শব্দ। হাবীব আর স্থির থাকতে পারল না। দরজার ওপাশে কে না দেখে আসা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। সে মীনার উপর থেকে উঠে কোনওমতে প্যান্টটা এক হাতে টেনে ধরে দরজার কাছে এগিয়ে গেল।
এক হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিতেই দরজার ওপাশ থেকে ঝড়ের মত মৃত্যু হাবীবের উপর এসে হামলে পড়ল। তিন ঠেংয়ে কুকুরটা হিংস্র নেকড়ের মত তার আদিমতম পূর্বপুরুষের হিংস্রতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল। হাবীবকে কোনওরকম প্রতিরোধের সুযোগ না দিয়ে অর্ধনগ্ন মানুষটার উপর নৃংশতায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার উপক্রম করল। হাবীবের কণ্ঠস্বর থেকে যে গোঙানি, যে আকুতি, যে আর্তনাদ ভেসে এল তা কেবলমাত্র মৃত্যু পথযাত্রীর মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে। আর সেই প্রাণঘাতী আর্তনাদের তীব্র নিনাদে প্রথমে ছুটে আসে নিচতলায় নামতে থাকা ড্রাইভার, একতলার কাজের বুয়া, ম্যাডাম, মীনার মা, গর্ভবতী শায়লা ভাবি এবং গোটা এপার্টমেন্টের সব ফ্লাটের ওই সময়ে থাকা বাসিন্দারা, তারপর দ্রুততার সাথে আরও জুটে যায় আশেপাশের ভবনের দারোয়ান, ড্রাইভার এবং উৎসুক জনতা।
দৃশ্যপট বিবেচনায় কারওরই বুঝতে বাকি থাকে না, ঘটনা কি ঘটতে চলেছিল, কিন্তু মীনাকে পাহারা দিয়ে দাড়িয়ে থাকা হিংস্রপঙ্গু কুকুরকে হটিয়ে মৃতপ্রায় দারোয়ানকে সরিয়ে আনাটা অসম্ভব হয়ে উঠলে ওরা লাঠিসোটা নিয়ে কুকুরটাকে আঘাত করে সরিয়ে দেয়। দীনা শায়লা ভাবির সহায়তায় মীনাকে কোনোমতে ওখান থেকে পাঁজাকোলা করে নিজ ফ্লাটে নিয়ে আসে। অন্য দারোয়ান আর ড্রাইভাররা মিলে ধরাধরি করে হাবীবকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পরবর্তীতে নারী নির্যাতন ও শিশু ধর্ষণের অভিযোগে তাকে পুলিশী হেফাজতে দেওয়া হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাবীবের ফাঁসির দাবিতে ঝড় ওঠে।
এই ঘটনা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে মীনাকে নিয়ে দীনা ওর স্কুলের কাছে একটা ফ্লাট বাসায় ভাড়া থাকতে শুরু করে।
পরিশিষ্ট:
যথাসময়ে শায়লা ভাবির পুত্র সন্তান হয়েছে। সন্তান সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক হয়েছে। শুধুমাত্র মাঝে মাঝে শায়লা ভাবির কাছে পুত্রের কিছু ব্যাপারে একটু খটকা লাগে। ও যত বড় হচ্ছে ততই যেন কিছু অস্বাভাবিকতা ওকে ঘিরে ধরে। শুধু সেই তা বুঝতে পারে। স্বামীকে বলার সাহস হয় না। ওর সব কিছুই কেমন যেন মীনার মত মনে হয় তার কাছে…!
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প-উপন্যাস নামী প্রিন্স আশরাফ প্রিন্স আশরাফের রহস্য গল্প ‘নামী’ রহস্য গল্প সাহিত্য