Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সন্তান


২২ এপ্রিল ২০২৩ ২২:১৬

ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে নহর আলী। রাত পেরিয়ে কেবল সকাল হয়েছে। বাড়ির এক কোণে নড়বড়ে বাঁশের মাচায় লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে একটি লাউগাছ। সকালের নরম রোদে যেন প্রাণখুলে হাসছে লাউয়ের পাতাগুলো।

নহরের বউ রুবিনা লাগিয়েছে গাছটা। কদিন আগেই। সন্তানের মতো যত্ন করে রোজ। অবশ্য সন্তানের যত্ন কীভাবে করতে হয় রুবিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নয়তো এত যত্ন করার পরও তিন-তিনটা সন্তান কেন মারা যাবে! লোকজন বলে রুবিনা অপয়া। নহরেরও মাঝে মাঝে মনে হয় লোকজন ঠিকই বলে! অপয়া না হলে কি কোনো মেয়ের পরপর তিন-তিনটা সন্তান মারা যায়!
অনেকবার বউকে তালাক দেওয়ার কথাও ভেবেছে নহর। কিন্তু বউয়ের মুখের দিকে তাকালেই ভাবনাটা কেমন গুলিয়ে যায়। দৌলতপুর গ্রামের সবাই জানে, বউকে নহর বড় ভালোবাসে। রুবিনার চেহারায় বড় মায়া! এই মায়ার ঘোর কিছুতেই কাটতে চায় না নহরের। তাই তিন-তিনটা সন্তান মারা যাওয়ার পরও বউকে সে আগলে রাখে বুক পেতে। বাঁচিয়ে রাখে আশপাশের মানুষের কথার তীর থেকে।

বিজ্ঞাপন

ভেতরের ঘরে রুবিনার কান্নার শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শেষ রাতের দিকে চতুর্থবারের মতো প্রসববেদনা উঠেছে তার। নহরের বড় ভয় করে। আবারও কি সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হবে তাকে!

সামান্য জ্বরে মাত্র তিনমাসের মাথায় নহরের প্রথম সন্তান পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়! প্রথম সন্তানের মৃত্যুর বছর দুয়েক পর আবারও এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী হয় নহর ও রুবিনা। দ্বিতীয় সন্তানকে রুবিনা বড্ড যত্ন করে একটু একটু করে বড় করে তুলছিল। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় সেও ফাঁকি দিল! দিনকয়েক পেটের অসুখে ভুগে মারা গেল একদিন! এরপর ওদের কোল আলো করে এলো তৃতীয় সন্তান। এবং এবারও পুত্র সন্তান। নহর আর রুবিনার তৃতীয় সন্তানটিও ভালোই বেড়ে উঠছিল। বছর তিনেকের মাথায় একদিন পুকুরপাড়ে খেলতে খেলতে পানিতে পড়ে গেল সে। নহর আর রুবিনা যখন টের পেল ততক্ষণে সব শেষ!

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ নবজাতকের কান্নার শব্দে নহরের চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। নড়েচড়ে ওঠে নহর। তার খুব অস্থির লাগে। দরজা খুলে এক টুকরো পুরনো কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তাহমিনা। অভিজ্ঞ ধাত্রী সে। দৌলতপুর গ্রামে কোনো নারীর প্রসববেদনা শুরু হলেই তাহমিনার ডাক পড়ে। কেবল তাই নয়, আশপাশের দু-তিন গ্রাম থেকেও ইদানীং তার ডাক আসে। দিন নাই রাত নাই তাহমিনাও ছুটে যায় যখন-তখন। পৃথিবীতে নতুন প্রাণের এই আগমন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে তার বড্ড ভালো লাগে।
নহরকে দেখতে পেয়ে হাত মোছার পুরনো কাপড়ের টুকরাটি দাওয়ার এক কোণে রাখা হাঁড়ি-পাতিলের ওপর ছুড়ে ফেলে তাহমিনা বলল, ‘নহর মিয়া, তোমার তো আবার পোলা হইছে। এইবার একটু সাবধানে রাখবা।’
শুনে নহরের আনন্দ হয়, আবার ভয়ও হয়। নহর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাহমিনার দিকে। এই সন্তান বাঁচবে তো! নাকি আবারও…! আর ভাবতে পারে না নহর।

বিকেল বেলা মনিরের চায়ের দোকানে পা রাখতেই নহরকে দেখে সে বলল, ‘নহর মিয়া, আশা করছিলাম মিষ্টি নিয়া আসবা। শুনলাম আবার পোলা হইছে তোমার, এইবার কিন্তু খুব সাবধানে রাখবা।’

গ্রামের হামিদ গাছি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘নহর, এইবার আর ভুল করিস না বাপ। মাছ ধরার একটা বড়শি আগুনে গরম কইরা পোলাডার কপালে একটা দাগ দিয়া দিস। আর কোনো সমস্যা অইব না। তোর চাচির বাপের বাড়িতেও একজনের তোর মতো জন্মের পর পর খালি পোলা মইরা যাইত। শেষে চাইর নম্বর পোলাটারে জন্মের পর পর কপালে মাছের বড়শি গরম কইরা দাগ দিয়া দিছিল। সেই পোলা বাঁইচা গেছে!’

নহর শুনে যায় চুপচাপ। কেবল হামিদ গাছি নয়, নহর গ্রামের আরও কয়েক জনের কাছে শুনেছে, জন্মের পরপর কারও যদি বারবার ছেলে সন্তান মারা যায় তবে মাছের বড়শি গরম কইরা কপালে দাগ দিয়া দিলে সন্তান আর অকালে মরে না!

রাতে বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে নহর, ‘বউ, তুই কী কস? বড়শি পুইড়া পোলাটার কপালে দাগ দিয়া দিমু?’

ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় রুবিনা। তার খুব ভয় করে, ‘এত অল্প বয়সে পোলাটা সহ্য করতে পারব তো?’

‘গেরামের অনেক মাইনষেই তো কইতাছে। হামিদ গাছি কইল, তার শশুর বাড়ির দিকে এক লোকের নাকি জন্মের পরপর তিন-তিনটা পোলা মইরা যায়। শেষে চার নম্বরটারে জন্মের কয়েকমাস পর মাছের বড়শি আগুনে পুইড়া কপালে দাগ দিয়া দিছিল। সেই পোলা বাঁইচা গেছে। এখন বিদেশ থাকে!’
রুবিনা গভীর মমতায় কোলের দিকে তাকায়। তার কোলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট এক মানব শিশু। নহর-রুবিনার আদরের সন্তান। রুবিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী করবে! কী বলবে স্বামীকে! তার চোখের সামনে একে একে ভাসতে থাকে মৃত তিন সন্তানের মুখ। আর ভাসতে থাকে আগুনে পোড়া লাল রঙের একটি মাছ ধরার বড়শি। বড়শিটা দুলতে থাকে চোখের সামনে। এদিক-ওদিক। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য! আতঙ্কে রুবিনার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

একটু থেমে আবারও মুখ খুলে নহর, ‘মুন্সি বাড়ির হাসেমও কইল কথাটা। ঠিক না অইলে তো এমনি এমনি একটা কথা এত মাইনষে কইত না!’
কথাটা রুবিনাও শুনেছে। নহর আর রুবিনার ছেলেকে দেখতে এসে কাজী বাড়ির সিরাজ কাজীর বউ সেলিনাও বলে গেছে সেই একই কথা। পরপর কয়েক সন্তান মারা যাওয়ার পর ছেলে হলে মাছ ধরার বড়শি পুড়ে কপালে দাগ দিলে নাকি বিপদ কেটে যায়! এরপর আর সন্তান অকালে মরে না!
ঘরের বাইরে কার্তিকের রাত। জানালার ফাঁক গলে মলিন দৃষ্টিতে নক্ষত্রহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে রুবিনা। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে।
নহর যেন এবার বিরক্ত হলো খানিকটা, ‘এত ভাবস ক্যান! তিন-তিনডা পোলা অকালে মরল। কোনো ব্যবস্থা না নিলে এইটাও যে মরব না ক্যামনে কই!’
রুবিনা এবার স্বামীর দিকে তাকায়। হঠাৎ স্বামীর জন্য বড্ড মায়া হয় তার। আর কত সন্তানের লাশ কাঁধে নেবে লোকটা! নাহ, রুবিনা আর সন্তান হারানোর শোক সইতে পারবে না। একটা কিছু বিহিত করতেই হবে।

ভাবতে ভাবতে আরও কয়েকটা দিন কেটে যায়। রুবিনা কোলে কোলে রাখে আদরের সন্তানকে। সামান্য চোখের আড়াল করতেও তার খুব ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি চিরদিনের মতো চোখের আড়াল হয়ে গেল তার বুকের ধন!

দিনকয়েক বাদে এক সন্ধ্যায় ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়ে রুবিনা টের পায়, ছেলের শরীর গরম। ভয়ে আঁতকে ওঠে রুবিনা। তবে কি আবারও সন্তান হারানোর শোক অপেক্ষা করছে তার জন্য! রুবিনার অস্থির লাগে খুব। নহর বাড়ি ফিরতেই উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘পোলাটার গায়ে তো জ্বর। আমার খুব ভয় করে!’

শুনে নহর তার ডান হাত ছেলের কপালে ঠেকিয়ে জ্বর মাপে। শরীরে জ্বর নিয়েও ছেলে দিব্যি হাসছে রুবিনার কোলে। হাত-পা ছুড়ে খেলতে থাকে। পিটপিট করে তাকায় নহরের দিকে। রুবিনার দিকে।

নহরের মুখটা শুকিয়ে যায়। চিন্তিত কণ্ঠে বলে, ‘আর দেরি করন ঠিক হইব না বউ। তুই কেবল ছেলেটারে আইজকার রাইতটা দেইখা রাখ। সবকিছু ডাক্তার-কবিরাজ দিয়া হয় না। মুরুব্বিগো কথার একটা দাম আছে। আমি কাইল সকালেই বাজারে যামু। মাছের একটা বড়শি কিনা গরম কইরা ছেলেটার কপালে দাগ দিয়া দিমু!’

রুবিনা কোনো জবাব দেয় না। তার কেবল ভয় করে। গরম বড়শির উত্তাপ ছেলেটা সইতে পারবে তো! কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী! কেবল ডাক্তারের উপর নির্ভর করতে মন ঠিক সায় দেয় না। তিন-তিন বার যাকে সন্তান বিয়োগের শোক সইতে হয়, তার বিশ্বাসের ভিতটাও নড়বড়ে হয়ে যায়। কোনো কিছুই আর বিশ্বাস করতে পারে না। নহর আর রুবিনার অবস্থাও তাই।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই এক প্লেট পান্তা ভাত খেয়ে সকাল সকাল পায়ে হেঁটে মুন্সিরহাট বাজারে হাজির হয় নহর। মাছ ধরার একটা বড়শি কিনে বাজারে আর দেরি করে না। দ্রুত ফিরে আসে গ্রামে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নহরের পথ আটকে দাঁড়ান মোমিন মাস্টার, ‘নহর মিয়া, তোমার পোলার এখন অবস্থা কেমন?’

‘ভালা না কাকা, কাল থেইকা জ্বর।’
‘বলো কী! জলদি হাটে গিয়া ডাক্তার দেখাও। এখন তো হাটে একজন ভালো ডাক্তার বসে শুনছি।’
‘ডাক্তার দেখায়া আর কী হইব কাকা! আমাগো কপাল খারাপ! সবই তো জানেন। আমাগো কপালে মনে হয় সন্তান নাই!’
‘মন খারাপ কইরো না। সব আল্লাহ পাকের ইশারা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন কোথায় মানুষের ভালো আর কোথায় মন্দ। আর দেরি না কইরা ডাক্তার দেখাও।’

‘না কাকা, এইবার ভাবতাছি অন্য ব্যবস্থা নিমু। অনেকে কইল পরপর কয়েক সন্তান মইরা যাওনের পর আবার সন্তান হইলে সেই সন্তানের কপালে বড়শি পুইড়া দাগ দিলে নাকি সেই সন্তান দীর্ঘজীবী হয়!’

‘খবরদার নহর, এই কাজ মনের ভুলেও করবা না। এইসব হইল গ্রামদেশের কুসংস্কার। কবে যে মানুষ একটু শিক্ষিত হইব! আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখো। এইসব কুসংস্কার বিশ্বাস করাও বিরাট গুনাহর কাজ। জলদি ছেলেরে ডাক্তার দেখাও।’

নহর আর জবাব দেয় না। বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে সে মাটি খুড়তে থাকে। নহর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এইবার আর ডাক্তার-কবিরাজের কাছে যাবে না সে। আগের তিনটারেও তো ডাক্তার-কবিরাজ কম দেখায় নাই। কই, ওরা তো শেষ পর্যন্ত বাঁচল না!

রুবিনা ঘরের দাওয়ায় বসে ছেলের কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। নহরকে দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, ‘জ্বর তো কমে না।’

নহর এসে রুবিনার শরীর ঘেঁষে বসে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক হয়। শরীরে জ্বর নিয়েও ছেলেটা হাত-পা ছুড়ছে, খেলছে, হাসছে। নহর ধীরে ধীরে পকেট থেকে মাছের বড়শিটা বের করে। রুবিনা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে বড়শিটার দিকে। তারপর ভয়ে ভয়ে নহরকে বলে, ‘ছেলেটা সহ্য করতে পারব তো?’

‘মনটারে একটু শক্ত কর বউ। এত মানুষ যখন এক কথা কইতেছে নিশ্চয়ই এর একটা ফল আছে। কোনো কারণ ছাড়া একটা কথা সবাই কইব ক্যান!’ বলতে বলতে পকেট থেকে মাছ ধরার বড়শিটা বের করে নহর। কাগজের পুটলি থেকে সেটা বের করতেই রুবিনা ভয়ে ভয়ে বড়শিটার দিকে তাকায়। ছোট্ট একটা মাছ ধরার ধাতব বড়শি। রুবিনা নিজেও তো অল্প বয়সে এই বড়শি দিয়ে বাড়ির পাশের শাপলার বিলে কত মাছ ধরেছে। কই, তখন তো ক্ষুদ্র এই বড়শিটাকে এত ভয় লাগেনি! আজ কেন এত ভয় লাগছে! কপালে ছোট্ট একটা দাগ দরকার ছেলেটাকে বাঁচাতে! একটা দাগ হলেই কি সত্যি সত্যি সব বিপদ কেটে যাবে! রুবিনার মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়, আবার মাঝে মাঝে হয় না।

এর আগে তিন তিনবার সন্তান বিয়োগের শোক যদি সইতে না হতো তবে বড়শি পুড়ে কপালে দাগ দেওয়ার এমন চিন্তা রুবিনা কখনও করত না। করত না নহরও। সন্তানকে বাঁচাতে রুবিনা এখন যে কোনো কিছু করতে রাজি। এমনকি কপালে যদি বড়শি পুড়ে দাগ দিতে হয় তবে তাতেও তার আপত্তি নাই! তাই স্বামীকে বাধা দেয় না রুবিনা।

রান্নাঘরের মাটির চুলায় আগুনে পুড়ে তপ্ত বড়শিটা নিয়ে আবারও রুবিনার শরীর ঘেঁষে বসে নহর। আগুনে পুড়ে পুড়ে এরমধ্যে রক্তবর্ণ ধারন করেছে বড়শিটি। সেদিকে তাকাতেই রুবিনার বুকের ভেতর কেমন ধক করে ওঠে। বুক ধড়ফড় করে তার। রুবিনা চোখ বন্ধ করে। নহর গরম বড়শির এক মাথা কাগজে মুড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত মাথাটা সজোরে বসিয় দেয় ছেলের কপালে।
সঙ্গে সঙ্গে রুবিনার কোলে চিৎকার করে ওঠে ছেলে। ছটপট করতে থাকে ব্যথায়। হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে শুরু করে শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে। নহর বড়শিটা সরিয়ে নিতেই রুবিনা ছেলেকে বুকের ভেতর চেপে ধরে। কিন্তু তাতে ছেলের কান্না থামে না। ছেলের এমন কান্না দেখে রুবিনার চোখও ভিজে ওঠে জলে। ছেলেকে বুকে চেপে ধরে ঘরের দাওয়ায় এদিক-ওদিক হাঁটতে থাকে রুবিনা। নহর বড়শিটা আবর্জনার স্তুপে ছুঁড়ে ফেলে আবার দাওয়ায় এসে বসে। ছেলেটার কান্না তার বুকেও লাগছে খুব। কিন্তু মনটাকে শক্ত করে ফেলেছে নহর।

কিছুক্ষণ দাওয়ায় বসে থেকে একসময় উঠে দাঁড়ায় সে। দুপুর হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে লুঙ্গি আর গামছাটা হাতে নিয়ে গোসল সারতে কাজী পুকুরের দিকে পা বাড়ায় সে। রুবিনা তখনও ছেলেকে কোলে নিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বুকের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে ছেলের মুখে স্তন গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ছেলের সেদিকে খেয়াল নেই। কিছুতেই কান্না থামছে না তার।

সারাদিন থেমে থেমে কাঁদতে থাকে নহর এবং রুবিনার আদরের সন্তান। বিকেলের দিকে ছেলের জ্বর আরও বাড়তে থাকে। রুবিনা চিন্তিত মুখে নহরকে বলে, ‘ছেলের জ্বর তো আরও বাইড়া গেছে। জলদি একটা কিছু ব্যবস্থা করেন। হাটে তো এখন ডাক্তার বসে শুনি।’

‘এত অস্থির হইস না বউ, একটু ধৈর্য ধর। ছোট মানুষ, শরীরের উপর একটা ধকল গেছে- সারতে তো একটু সময় লাগব। আর ডাক্তার যে দেখামু পকেটে টাকা-পয়সাও তো নাই।’ নহরের কণ্ঠে যেন খানিকটা বিরক্তি টের পায় রুবিনা।

‘তাই বইলা ছেলেরে ডাক্তার দেখাইবেন না এইটা কেমন কথা! দরকার হইলে কারও কাছ থেইকা টাকা-পয়সা ধার নেন।’

‘কইলাম তো একটু ধৈর্য ধর। আইজকের রাতটা দেখি, কাল সকালেও জ্বর না কমলে ডাক্তারের কাছে নিয়া যামু। তুই ভালো কইরা ছেলের মাথায় জলপট্টি দে।’ নহর আর কথা বাড়ায় না। উঠে ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

রাতের দিকে ছেলের কান্না ধীরে ধীরে কমে আসে। রুবিনা ছেলের কপালে বিরতিহীন জলপট্টি দিয়ে যায়। ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে ছেলে মাঝে মাঝে রুবিনাকে দেখে। দেখে নহরকে। নহর ভেতরের ঘর থেকে উঠে গিয়ে বাইরের দাওয়ায় এসে বসে। লুঙ্গির গিট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে বিড়ি ধরায় আগুনে। কার্তিকের রাত। হঠাৎ বাড়ির পেছনের জাম গাছের ডালে বসে শব্দ করে ডেকে ওঠে একটি অচেনা পাখি। এত রাতে পাখি তো কখনও ডাকে না! তবে আজ কেন ডাকছে! নহর উঠান থেকে কুড়িয়ে জাম গাছটা লক্ষ করে একটা মাটির ঢিল ছুড়ে মারে অন্ধকারে। জাম গাছের পাতা ভেদ করে ঢিলটা চলে যায় কাসেম মন্ডলের ধান ক্ষেতের দিকে।

থেমে যায় অচেনা পাখির শব্দ। তবু কান খাড়া করে রাখে নহর। তার চোখে আজ ঘুম আসে না। প্রথম বিড়িটা শেষ হতেই নহর দাওয়ায় বসে খুটিতে হেলান দিয়ে আবারও লুঙ্গির গিট থেকে বিড়ি বের করে। আবারও রাতের অন্ধকারে কার্তিকের হাওয়ায় মিশে যায় নহরের বিড়ির ধোঁয়া।

হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে রুবিনার তীব্র চিৎকারে নহর হকচকিয়ে যায়। রুবিনা এভাবে চিৎকার করছে কেন! নহর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসে ভেতরের ঘরে। রুবিনা স্বামীকে দেখে চিৎকার করে বলল, ‘ছেলের শরীর তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত-পাও নড়ে না!’

নহর ধপাস করে নড়বড়ে কাঠের চৌকিতে বসে পড়ে। ভয়ে ভয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকায়। স্থির হয়ে আছে মুখটা। কোনো অভিব্যক্তি নেই। শরীরটা নিস্তেজ। নহর কাঁপা হাতে ছেলের কপালে স্পর্শ করে। কী আশ্চর্য! মানুষের শরীর কখনও এত ঠান্ডা হতে পারে! নহর এবার রুবিনার দিকে তাকায়। রুবিনার চিৎকারে নীরবতা ভেঙে আবারও সরব হয়ে ওঠে কার্তিকের রাত। আশপাশের বাড়ি থেকে প্রতিবেশীরা ছুটে আসতে থাকে এক এক করে। নহর নির্বাক তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। বিছানায় স্থির হয়ে আছে ছেলের পুঁটলির মতো ছোট্ট শরীরটা। চিরদিনের মতো স্থির। প্রাণহীন।

মোমিন মাস্টারের কথাগুলো এক এক করে মনে পড়ে নহরের! তবে কি নহরই তার ছেলেকে নিজ হাতে খুন করল! রাত বাড়ছে। রুবিনার কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে রাতের পরিবেশ। কেউ একজন তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। নহর দাওয়ায় বসে আছে নির্বাক। তার চোখের সামনে ভাসছে ছোট্ট ছোট্ট চারটি কবর, লাশ বহনের একটি খাটিয়া, মানুষের ভিড়, আর একটি মাছ ধরার বড়শি। আগুনে পোড়া। টকটকে লাল। বড়শিটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে নহরের দিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে নহর।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমন চৌধুরী ইমন চৌধুরীর গল্প 'সন্তান' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প গল্প-উপন্যাস সন্তান সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর