গন্ধরাজের ঘ্রাণ
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৫০
মা আজ আমরা বিয়ে করব।
শাহানা কী একটা হিসাব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই তার কানে বোধ হয় কথাটা স্পষ্টভাবে পৌঁছায়নি। তিনি হিসাবের কাগজ থেকে মুখ তুলে মেয়ে সারানার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বললি বুঝতে পারিনি।
সারানা একটু ঢোক গিলে বলল, আজ আমরা, মানে আমি আর তানজির বিয়ে করতে যাচ্ছি।
কী বললি? বলেই শক্ত একটা চড় সারানার গালে বসিয়ে দিলেন শাহানা। সারানা মুখ নিচু করে আছে। চুলগুলো সামনের দিকে এসে ঝুঁকে পড়ায় মুখটা ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছে না। শাহানার সমস্ত শরীর কাঁপছে। এতটা হতবুদ্ধি এর আগে তিনি কখনোই হননি। তার কী বলা উচিত কিংবা করা উচিত এই মুহূর্তে কিছুই মাথায় আসছে না। কিছুটা সময়ের জন্য শাহানার জগত যেন অন্ধকার হয়ে যায়।
সারানা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে তাকে কিছু একটা বলতে গিয়ে গলটা কেঁপে ওঠে শাহানার। আর বলা হয় না। হাতের হিসাবের কাগজটা কুটিকুটি করে ছিঁড়তে থাকেন তিনি। কাগজের টুকরোগুলো এত ছোট ছোট হয়েছে যে আর সেগুলোকে ছেঁড়া সম্ভব নয়, তাও প্রাণপণ ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন শাহানা। একপর্যায়ে হতদ্যোম হয়ে তার অক্ষমতাকে কাগজের টুকরার সাথে শূন্যে ছড়িয়ে দেন। টুকরা কাগজগুলো ফ্যানের বাতাস পেয়ে কিছুক্ষণ এলমেলো ওড়াউড়ি করতে থাকে। শাহানার দৃষ্টি উদাস। তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে কিন্তু তার দৃষ্টি কোথাও নিবদ্ধ নয়। শাহানা হারিয়ে গেছেন এক গভীর সমুদ্রে। যে সমুদ্রে গত আট বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তিনি। সাঁতরে কূলে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কোনও মতেই কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যখন কূলের দেখা পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল, তখনই এমন একটা ঘটনা ঘটলো।
আট বছর আগে শাহানার স্বামী আসিফ মারা যান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। আকস্মিক আসিফের মৃত্যুতে শাহানার জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সেই থেকে শাহানা তার দুটি সন্তান নিয়ে অথৈজলে খাবি খাচ্ছেন। একটা ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার জীবন শাহানা পার করে চলেছেন। অথচ কী সাজানো গোছানো সংসার ছিল তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে আসিফ আর শাহানা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলন। এ নিয়ে দুই পরিবারে অসন্তোষ থাকলেও ওরা সুখি ছিলেন। শুরুতে নতুন সংসারে কিছুদিন অভাব অনটন ছিল। বছরখানেকের মধ্যে দুজনেরই দুটি ভাল চাকরি হয়। শাহানা একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ পান। আর আসিফ একটা বিদেশী ব্যাংকে। চাকরির বছরখানেকের মধ্যে শাহানা সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়লে আসিফের অনুরোধে চাকরিটা ছেড়ে দেন তিনি। আসিফের একার আয়েই তাদের সংসার চলছিল। চলছিল, মানে ভালই চলছিল। মোটামুটি ভদ্রস্থ এলাকায় একটা মধ্যমানের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস করতন ওরা। আর নিজেদের চলাচলের জন্য একটা ব্যক্তিগত গাড়ি কিনে নিয়েছিলেন আসিফ। নিশ্চিন্তে জীবন কেটে যাচ্ছিল তাদের। প্রথম সন্তান সারানার জন্মের বছর তিনেক পরে আরও একটি সন্তান জন্ম নেয় তাদের ঘরে। এবারেরটি ছেলে সন্তান। নাম সায়ান।
স্বামী ও দুসন্তান নিয়ে শাহানার দিন বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল। সন্তানদের স্কুল-পড়াশুনা নিয়েই সময় কেটে যায় শাহানার। আসিফের অফিসে কাজের চাপ থাকে বেশ। মাঝে মাঝে রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হয়। কখনও কখনও একটু বেসামাল হয়েও ফেরেন। এ নিয়ে শাহানা তেমন কিছু বলেন না আসিফকে। কাজের চাপ থেকে রেহাই পেতে মাঝে মাঝে একটু বেসামাল হয়ে ফিরলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়! আসলে শাহানা পারতপক্ষে চাননি তাদের মাঝে কোনও ঝামেলা হোক, চ্যাঁচামেচি হোক এবং সন্তানরা সেটা জেনে যাক। সেজন্য আসিফ যেদিন রাত করে টালমাটাল পায়ে দরজায় এসে বারবার কলিং বেল বাজাতেন, সেদিন শাহানা নানা কৌশলে ছেলেমেয়েদের চোখের আড়াল করে আসিফকে বেডরুমে নিয়ে যেতেন। মাঝেমধ্যে বেসামাল হয়ে রাতবিরেতে বাসায় ফেরা ছাড়া আসিফ সবসময়ই ওদের প্রতি যত্নশীল। সপ্তাহে একদিন কোনও না কোনও রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান ডিনার করাতে। প্রতিসপ্তাহে না হলেও এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর ডে লংড্রাইভে নিয়ে যান কোথাও। বছরে একবার দেশের বাইরে আর একবার দেশের ভেতরে বিখ্যাত কোনও পর্যটন এলাকায়ও বেড়াতে নিয়ে যান। এর থেকে আর বেশি কী দরকার পড়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক নারীর? এ রকমভাবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। শাহানার এর থেকে বেশি চাহিদাও নাই জীবনে। কিন্তু জীবন কি আর সে কথা বোঝে?
শাহানা একদিন জানতে পারেন আসিফ অন্য এক নারীতে আসক্ত। শাহানা ব্যাপারটা যেদিন জানতে পারেন সেদিন রাতেই তিনি আসিফের কাছে প্রসঙ্গটি তোলেন। আসিফ প্রথমদিকে হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইলেও পারেননি। শাহানার নানাবিধ প্রশ্নবানে এবং অকাট্য তথ্যপ্রমাণে আসিফ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তিনি অন্য এক নারীতে আসক্ত। আসিফ শাহানাকে যতকিছুই বোঝানোর চেষ্টা করেন না কেন কোনও কাজ হয় না। শাহানা সেই রাতেই সন্তানদের নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সন্তানদের কথা ভেবে আর বাসা ছেড়ে যাওয়া হয়নি। বরং বাসা ছেড়ে চলে যান আসিফ। এরপর আসিফ মাসে দু একবার এ বাসায় আসতেন সন্তানদের দেখতে। মাস শেষে একটা খামে করে সংসার খরচের টাকাটা রেখে যেতেন।
শাহানা কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এই বয়সে আর চাকরি পাবেন কোথায়? তবুও নানা জায়গায় সিভি পাঠাচ্ছেন। এভাবেই চলছে। মাসছয়েক কেটেও গেছে এর মাঝে। শাহানার জীবনটাকে একেবারে শূন্য করে দিয়েছেন আসিফ। একদিন আসিফের অফিস থেকে ফোন আসে, তার শরীর খারাপ হয়ে পড়েছে, সহকর্মীরা তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন, শাহানাও যেন হাসপাতালে চলে আসেন। শাহানা দুসন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে যথাসময়ে পৌঁছালেও যথাসময়ের আগেই আসিফ পৌঁছে গেছেন পরলোকে।
আসিফের মৃত্যু শাহানাকে দিগ্বিদিকশূন্য করে ফেলে। মারা যাওয়ার আগে আসিফ বিশাল অংকের টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের বেশ কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতেন, সেখানেও প্রচুর টাকা ঋণ হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংক এখন ঋণ পরিশোধের জন্য শাহানার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। শাহানার কাছে কোনও টাকা নাই যে সেখান থেকে তিনি ঋণশোধ করতে পারবেন। এমন কোনও আত্মীয়স্বজনও নাই যাদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংক লোন পরিশোধ করবেন। লোন পরিশোধে যত দেরি করবেন, পরিশোধের টাকার অংক ততই বাড়তে থাকবে। উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে আসিফের সব ঋণ পরিশোধ করেন শাহানা। এরপর ভাসুর-দেবর-ননদদের গলগ্রহ হয়ে আসিফদের পৈত্রিক চারতলা বাড়ির নিচের তলায় দুকামরার একটি ফ্ল্যাটে থাকার সুযোগ পান দুসন্তানকে নিয়ে। বড় ঘিঞ্জি ঘর দুটো। আলোবাতাস নেই। তার ওপর স্যাঁতসেতে। বৃষ্টি হলে চারপাশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ড্রেনের পানি উছলে উঠে মেঝেতে চলে আসে। সে যে কী দুর্বিষহ জীবন! শাহানা তারপরও হতোদ্যম হননি। সন্তান দুটিকে মানুষ করতে হবে। অনেক চেষ্টার পরে একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি মিলে যায় তার। বেতন খুব কম কিন্তু বেশ কটি টিউশনি করে অনেক কষ্টে চলছিল তার সংসার। আসিফ যখন মারা যায়, সারানা তখন মাত্র নবম শ্রেণিতে উঠেছিল আর সায়ান মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
এই আট বছরে শাহানা কি শুধু একাই স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটেছে? না, তার দুসন্তানও অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছে। সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই শাহানা করতে পারেননি। কোনও শখ-আহ্লাদ ছিল না তাদের জীবনে। সন্তানেরা মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারত। বিশেষ করে সারানা একটু বড় হওয়ায় সে মায়ের কষ্টটা অনুভব করতে শিখেছিল। মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিল সাংঘাতিক রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে সে টিউশনি করেনিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে শুরু করেছিল। এতে মায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছিল। সারানার মাস্টার্স পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। রেজাল্ট হতে আরও কয়েক মাস লাগবে। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদনও শুরু করে দিয়েছে। সায়ানের তৃতীয় বর্ষ চলছে। আর দুতিনটা বছর কোনওমতে চালিয়ে নিতে পারলে শাহানার আর চিন্তা নাই। দুসন্তানই পড়াশুনা শেষে কোনও না কোনও চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবে। গত আট বছরে যে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে তার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে, এবার যেন তার অবসান হতে চলেছে। শাহানা নানারকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। ওরা চাকরি পেলে প্রথমই যে কাজটা করবেন, সেটা হলো এই বাসাটা ছেড়ে মোটামুটি ছোট হলেও ভদ্র এলাকায় একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠবেন। বর্ষার সময় ঘরের মেঝের নোংরা পানি সেঁচতে সেঁচতে তার হাতে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। এর থেকে মুক্তি চান তিনি। ভাসুর-দেবর- ননদদের গলগ্রহ হয়েও থাকতে চান না। মুক্তি চান।
কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল তার! সন্তানদের গায়ে কোনওদিন হাত তোলেননি শাহানা। কিন্তু আজ তিনি এ কী করলেন! এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুললেন? সারানা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই অনুশোচনায় ভুগছেন তিনি। নিজেকে অত্যন্ত স্বার্থপর-লোভী এক মানুষ মনে হতে থাকল তার। শাহানা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে তিনি এটা বুঝতে পারছেন যে, ভালবাসারজনের কাছে কোনও প্রত্যাশা থাকা উচিত নয়। সারানার গায়ে হাত তোলার গ্লানি তিনি কী করে কাটাবেন? শাহানা তার আলমারির ভেতরে বিভিন্ন কাগজের ফাঁকফোকর খুঁজে জমানো টাকাগুলো বের করতে থাকলেন। সব টাকা একত্র করে খুশিতে তার মুখটা চকচক করে উঠল। না টাকার পরিমাণটা একেবারে মন্দ নয়। তিনি সবগুলো টাকা একটা খাম ঢোকালেন।
আজ বারবার আসিফের কথা মনে পড়ছে তার। তাদের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ছে। দুই বাড়ির কেউ বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওরা নিজেরা বিয়ে করে সেদিন ওদের এক ব্যাচেলর বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন। বন্ধু ওদের জন্য সে রাতে তার শোবার ঘর ছেড়ে দিয়েছিল। একটু বেশি রাতে তিন প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি আর কিছু গন্ধরাজ ফুলের মালা নিয়ে এসেছিল।
শাহানার নাকে আজ গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। আজ বৃষ্টি না হলেও দিন দুই আগের বৃষ্টির পানি এখনও ড্রেনে থৈ থৈ করছে। তবুও শাহানা যেন তার প্রিয় গন্ধরাজের ঘ্রাণই পাচ্ছেন সারা ঘর থেকে।
ঘরের দরজা খোলাই ছিল। সারানা তার নববিবাহিত বর তানজিরকে নিয়ে কখন ঘরে ঢুকেছে শাহানা টের পাননি। হঠাৎ ছায়ার মতো দুটো মানুষ এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে।
– মা, জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, তবুও ক্ষমা চাইছি। আমরা বিয়ে করেছি। তোমাকে সালাম করতে এসেছি। তানজির অনেক ভাল ছেলে, ওই আমাকে জোর করেনিয়ে এল। ওর বাবা-মা কেউ নেই। তুমি ওর ওপর রাগ করো না। যা বলার আমাকে বলো। আই অ্যাম সরি।
সারানা খুব বিনীত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে। কথা শেষ করেই অপরাধীর মতো মায়ের পা জড়িয়ে ধরে। শাহানার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। আলমারি থেকে খামটা বের করে সারানার হাতে দেন শাহানা।
– যা কোনও একটা দামী হোটেলে গিয়ে আজ তোরা ডিনার খা আর তোদের বাসর রাত কাটা। এটা তোদের জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার।
মা মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। চারপাশে গন্ধরাজ ফুলের ঘ্রাণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক বসু অলোক বসুর ছোটগল্প 'গন্ধরাজের ঘ্রাণ' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গন্ধরাজের ঘ্রাণ গল্প সাহিত্য