পেপার বয়
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০৯
আপা, পেপার নিবেন? মাত্র ৫ টাকা। কি হল আপা? একটা পেপার নেন?
আহা! ডিস্টার্ব করিস না তো! ভাগ এখান থেকে…।
প্রায় প্রতিদিন অপরিচিত অনেক মানুষের এরকম কথা শুনতে হয় রানার। আরার অনেকের আদরও পায় সে। রানা, এতিম একটি ছেলে। সত্যিকার অর্থে রানা এতিম নয়। রানার বাবা মা আছে। কিন্তু রানা তাদের সঙ্গে নেই। তাই সবাই রানাকে এতিমই ভাবে। রানার বয়স দশ অথবা এগারো। ক্লাস থ্রি পাস করেছে রানা। এরপর রানার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।
এখন রানার স্কুল ঢাকার রাস্তা-ঘাট। প্রতিদিন সকালে সব বাচ্চারা যখন কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায় তখন রানা পত্রিকা স্টল থেকে ৫০টা খবরের কাগজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢাকার অলিতে গলিতে। কখনও বাসস্ট্যান্ডে, কখনও রেল লাইনের ধারে, কখনও চায়ের দোকানের আশেপাশে। এভাবেই দিন চলে যার রানার।
আজ শুক্রবার। সরকারি ছুটির দিন। এইদিনে রাস্তায় খবরের কাগজ বিক্রি হয় কম। তাই রানা একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। আজও এর ব্যতিক্রম হল না। রানার ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। ঘুম থেকে উঠে রানা হাতে-মুখে পানি দিল। রানার প্রতিদিনের নাস্তার মেন্যু কলা আর পাউরুটি। প্রতিদিনের মতো আজও সে অনেক তৃপ্তি নিয়ে একই নাস্তা খেয়ে নিল। তারপর পত্রিকা স্টল থেকে ৩০টি খবরের কাগজ নিয়ে বেড়িয়ে পরল। আজ রানা ২০টি কাগজ কম নিল কারণ শুক্রবারে বাইরে কাগজ কম বিক্রি হয়।
এখন কার্তিক মাস। একটু একটু শীত পরতে শুরু করেছে। রাস্তা বেশ ফাঁকা। বাসগুলোতেও খুব একটা যাত্রী নেই। রানা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে রানা ধরে নিল আজ তার একটি কাগজও বিক্রি হবে না। কি আর করা! রাস্তার পাশে এদিক এদিক ঘুরছে রানা। হঠাৎ এক ভদ্রলোক রানার কাছে এসে বলল,
কতগুলো পেপার আছে?
স্যার ৩০টা। এখনও একটা বিক্রি করতে পারিনি।
আচ্ছা, আমাকে সবগুলো পেপারই দে।
সবগুলো স্যার?
হুম, সবগুলো। আমার ছেলে জেএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। কাল পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। আজ ছাপানো হয়েছে।
স্যার, দেখি আপনার ছেলের ছবি?
এই দেখ…
বাহ! খুব সুন্দর দেখতে।
পেপারগুলোর দাম কত হল?
স্যার, ১৫০ টাকা…
২৫০ রাখ…
১০০ টাকা তোর বখসিশ।
স্যার আমি তো বখসিশ নেই না।
শোন কেউ খুশি করে কিছু দিলে রাখতে হয়। আর তুই তো আমার ছেলের মতই।
রানা এবার নরম হলো। মনে মনে একটু খুশিও হল। রানার বসের নাম রফিক। রফিকের নিজের একটা পত্রিকা দোকান আছে। সেখানে চার পাঁচজন ছেলে কাজ করে। তাদের প্রতিদিনের কাজ হল সকালবেলা কিছু খবরের কাগজ নিয়ে বিক্রি করা। আর বেতন! সেটা দেওয়া হয় না। ৫ টাকার কাগজ বিক্রি হলে, রফিক প্রতি কাগজ প্রতি ১ থেকে দেড় টাকা দেয়। এতে রানাদের আয় হয় খুব সীমিত। কোনও রকম দিন চলে যায়। রানার অনেক বন্ধু কারখানা, দোকানের কর্মচারী অথবা গাড়ির হেল্পারের কাজ করে। তারা রানার থেকে বেশি টাকা আয় করে তারা গ্রামে বাবা মার কাছে পাঠায়। কিন্তু রানার তো কাউকে টাকা দিতে হয় না। আর রানার এই পেশাই বেশি ভাল লাগে।
এর পিছনে একটা কারণও আছে। খবরের কাগজে দেশ বিদেশের অনেক খবর থাকে। রানা চুপ করে মাঝে মাঝে সেই সব খবর পরে। খেলার খবর পড়তে রানার বেশি ভাল লাগে। ক্রিকেটার সাকিবের ভক্ত সে। সাকিবের খবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে রানা। আর মনে মনে ভাবে ইস! আমার কাছ থেকে সাকিব যদি একদিন কাগজ কিনত! অনেক প্রাইভেট কারে সাকিবকে খোঁজেও রানা। কিন্তু কোনওদিন সাকিবের দেখা মেলেনি। তবে গাড়িতে ফিল্মের অনেক নায়িকাকে রানা দেখেছে। তারা রানার কাছ থেকে কাগজও কিনেছে। রানা জানে নায়িকারা কেন কাগজ কিনে। কারণ বিনোদন পাতায় তাদের খুব বড় করে ছবি ছাপা হয়। রানা সেই ছবি গুলোও দেখে।
একদিন রাস্তার জ্যামে গাড়িতে বসে ছিল নায়িকা অপু বিশ্বাস। রানা তাকে কাগজ দিয়ে বলেছিল,
আপা, পেপারটা কিনেন, আপনার আজ বড় রঙিন একটা ছবি এসেছে।
অপু বিশ্বাস সুন্দর একটা হাসি দিয়ে রানার কাছ থেকে সেদিন কাগজ কিনেছিল।
আর রানা কে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার নাম কি?
রানা তখন বলেছিল, আমার নাম শফিকুর রহমান রানা।
আর অপু বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্প রানা তার বন্ধুদের অনেক বার বলেছে। রানার বন্ধুরা এই গল্প শুনে বলেছে, তুই খুব ভাগ্যবান রানা। আমরা কত অপেক্ষা করি কিন্তু কোনও দিন দেখি না।
বেশি আফসোস করেছে রানার প্রিয় বন্ধু রাজা। একটা বাসের হেল্পার সে। আজ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে তাই রানা রাজার সঙ্গে দেখা করতে রেলস্টেশনে এসেছে।
রাজা : কি রে রানা কহন আইসোস?
রানা : তোয়, এক ঘণ্টা তো হইবো।
রাজা : তোর ডিউটি তো সকালেই শেষ হয়। আর আমার কোনও টাইম-টেবল নাই। আর ঢাকার রাস্তায় যা জ্যাম রে বাবা!
রানা : এজন্যই তো তরে কই, গাড়ির হেল্পারি ছাড়! আমার সঙ্গে পেপার বেছ। তুই তো হুনস না।
রাজা : তুই তো বোকা। পেপার বিক্রি করে কয় টাকা পাস? দিন আইনা দিন খাস। আর আমি তো মাস শেষে বেতন পাই। আবার উপরি ইনকামও আছে। কিছুদিন পর গাড়ির ড্রাইভার হমু।
রানা : তুই কি গাড়ি চালানো শিখছোস? ড্রাইভার হইবি কেমনে?
রাজা : ও শেখান লাগে না। এমনি হইয়া যাব।
রানা : এজন্য তো আমাগো দেশে এতো এক্সিডেন্ট হয়।
রাজা: এত কিছু ভাইবা আমাগো কাম কি? রানা তুইও আমার লগে কাজ শুরু কর।
রানা : না রে আমি পেপারেই বিক্রি করমু। পেপারে অনেক কিছু লেখা থাকে। দ্যাশ-বিদেশের অনেক কিছু জানা যায়।
রাজা : হ, তুই তো আবার ক্লাস থ্রি পাশ। পড়তে পারস। আমি তো ব-কলম। কিন্তু পেপারে আমি চুপিচুপি ছবি দেখি। আর ভাবটা এমন নেই যাতে করে সবাই বোঝে আমি পড়তে পারি। হি হি। আজ তো সাকিব-আল হাসানের অনেক বড় একটা ছবি দেখলাম। ব্যাটা যে ভাল ক্রিকেট খেলে!
রানা : হ, জানস আমার খুব ইচ্ছা সাকিব আল-হাসান আমার কাছ থেকে যদি একটা পেপার কিনত!! আমি রাস্তায় দামি গাড়ি দেখলে ছুটে যাই। কিন্তু সাকিব ভাই রে কোনও দিন দেখলাম না। ইস! স্বপ্নেও যদি একদিন সাকিব ভাই আইসা বলত, রানা আজকের পেপারটা দাও তো… আমি দিতাম। তারপর বলত টাকাটা রাখ। আমি বলতাম সাকিব ভাই আপনার কাছ থেকে আমি টাকা নিব না।
রাজা : ওই আশা আমাগো কি পুরন হইবো? আমার নাম তো রাজা। আর কামটা হইল গাড়ির হেল্পার। আমার নাম আসলে হওয়া দরকার ছিল ফকির। হা হা হা…
রানা : তোয় রাজা, আমি ছবির অনেক নায়ক-নায়িকারে দেখছি।
রাজা : বলস কি? কেমনে?
রানা: রাস্তায় গাড়ি যখন জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকে তহন। অনেককেই দূর হইতে দেখছি। একবার তো অপু বিশ্বাস এর কাছে পেপারও বিক্রি করছি।
রাজা : কস কি রানা???? ঘটনা খুইলা বল…
রানা অপু বিশ্বাসের সঙ্গে কী কথা হয়েছে এটা রাজাকে খুলে বলল। এরপর একসঙ্গে হোটেলে গিয়ে দুজন ডাল-মাছ ভাত খেল। সেদিনের মতো রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রানা।
ফিরে রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা করল রানা।
কিরে রানা, কি খবর? হাতে কোনও পেপার নাই।
হুম ভাই। আজ সব পেপার বিক্রি হইছে।
কেমনে?
এক স্যার সবগুলো পেপার কিনছে। আর আমারে একশ টাকা বকশিসও দিছে। এই নেন ১৫০ টাকা।
ঠিক আছে বকশিস তোর কাছেই রাখ। আর এই নে তোর আজকের টাকা।
রানা গুনে দেখল, রফিক ভাই আজ তারে ৩৫ টাকা দিয়েছে। যদি সে বেশি পেপার নিয়ে বিক্রি করত তাহলে আরও টাকা পেত। কিন্তু রানা অনেক পেপার কাঁধে নিয়ে ঘুরতে পারে না। আর বেশি টাকার লোভও করে না।
আজকে রানার হাতে ১৩৫ টাকা। টাকা নিয়ে রানা ভাবছে, ইস! আমি যদি লেখাপড়া করতাম তাহলে পেপারে আমারও ছবি আসত। এসব ভাবতে ভাবতেই রানা ফার্মগেট ওভার ব্রিজের কাছে আসল।
সেখানে রানা দেখল টি-শার্ট বিক্রি ইচ্ছে।
কিছু লোক উচ্চস্বরে বলছে, এই লন, একদাম ১০০, ১০০।
রানা ভাবল পকেটে তো আজ একশ টাকা আছে। নতুন একটা টি-শার্ট কিনলে কেমন হয়? এই ভেবে সে টি-শার্ট দেখতে লাগল। সবুজ রঙের একটা টি-শার্ট ভাল লাগল রানার। টি-শার্টের গায়ে লাল কালি দিয়ে লেখা আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
রানা জানে এই কথা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রানা যখন স্কুলে পড়ত তখন এই গান গেয়ে তাদের ক্লাসে যেতে হত। এটা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
রানার মন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। টি-শার্টটি কিনে দুঃখ বাড়াতে চাইল না সে। তারপর হেঁটে হেঁটে রানা আনন্দ সিনেমা হলের কাছে এল। সেখানে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাসের ছবি চলছে। রানা ছবির পোস্টার গুলো মন্ত্র-মুগ্ধের মতো দেখতে লাগল। ছবির পোস্টার দেখতে রানার অনেক ভাল লাগে। রানার অবসরের একমাত্র বিনোদন হল ছবির পোস্টার দেখা। প্রায় সে সিনেমা হলে এসে ছবির পোস্টার দেখে। কিন্তু ছবি দেখার মতো টাকা তার কাছে থাকে না। কিন্তু আজ তো তার কাছে টাকা আছে।
রানা দেখল সিনেমা হলের সামনে দুই একজন লোক চিৎকার করে বলছে, ভাই টিকিট নেন, শাকিব-অপুর নতুন ছবি। মিশা সওদাগরও আছে। ডিসি ৫৫ আর রিয়েল ৩৫ টাকা।
রানা পকেট থেকে টাকাটা বের করে আর একবার গুনে নিল। কিন্তু ছবি দেখার সাহস করল না। হলের পর্দাও রানা কোনওদিন দেখেনি। বন্ধুদের কাছে শুনেছে হলের পর্দা নাকি অনেক বড়। কিন্তু রানা শুধু পোস্টারেই দেখে। ছবি কখনও দেখেনি। আজও রানা ছবি দেখল না।
পায়ে হেঁটে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ আসল রানা। রাস্তায় মাঝে মাঝে অকারণে হাঁটতে পছন্দ করে সে। কারণ রাস্তায় হাঁটলে নানারকম মানুষ দেখা যায়।
অচেনা মানুষ দেখার মাঝেও এক ধরণের আনন্দ আছে। রানার তো আপনজন কেউ নেই। অচেনা মানুষের ভিড়ে আপন মানুষ সে খুঁজে বেড়ায়।
এখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল। রানা সাধারণত দুপুরের খাবার খায় না। সকাল আর রাতে খায়। আজ পকেটে বেশি টাকা আছে। তাই রানা ভাবল আজ বিরিয়ানি খেলে কেমন হয়? এই ভেবে সে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আসে দাঁড়াল। জাদুঘরে দেখার জন্য অনেকেই এসেছে। রানা মানুষের বেশ বড় লম্বা একটা লাইন দেখতে পেল। অপলক দৃষ্টিতে সে লাইনটি দেখতে লাগল। আর ভাবতে লাগল এত বড় দালানের ভেতর কি আছে? যা দেখার জন্য এত ভিড় হয়!
রানার তাকানোর এই দৃশ্যটা ক্যামেরা বন্দি করল এক সাংবাদিক।
রানা খুব খুশি হয়ে সেই সাংবাদিকের কাছে আসল।
স্যার, আপনি কি সাংবাদিক? আমার ছবি কি পেপারে দেবেন?
তুমি কি পেপার পড়?
হ্যাঁ, মানে আমি পেপার বিক্রি করি।
এর মানে তুমি পেপার বয়।
জি¦ স্যার।
আমাকে তোমার স্যার ডাকতে হবে না। আমার নাম তুষার। তুমি আমাকে তুষার ভাই ডাকবে।
ঠিক আছে তুষার ভাই।
আচ্ছা, তোমার নাম কি?
আমার নাম রানা।
থাক কোথায়?
কাওরান বাজারে।
তোমার সঙ্গে কে কে থাকেন?
আমার কিছু বন্ধু।
তোমার বাবা মা নেই?
রানা মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল।
তুষার রানাকে তার ভিজিটিং কার্ড দিল। শোন রানা কখনও প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন দিও। ফার্মগেট এলাকায় আমার বাসা।
ঠিক আছে তুষার ভাই।
এরপর তুষার বাসায় ফিরল। একটু ফ্রেশ হয়ে আজকের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগল সে। রানার ছবিটির দিকে অনেক ভাল করে খেয়াল করল তুষার। ছেলেটির চেহেরা অনেক মায়াবী। সাধারণ কোনও ছেলে রানা কে দেখে মনে হয় না। তাহলে ও রাস্তার টোকাই কেন? আনমনে এসব কথা ভাবতে লাগল তুষার।
এমন সময় আদুরির ফোন এল।
হ্যালো তুষার …
বলো…
সারাদিন তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন?
ফোনে চার্জ ছিল না।
তাই বলে তুমি আমাকে জানাবে না…আমি অনেক চিন্তা করছিলাম।
স্যরি আদুরি।
ঠিক আছে। আর এরকম করবে না…জরুরি কথা আছে। কাল সকালে দেখা করবে।
ঠিক আছে আদুরি।
আদুরি, তুষারের বন্ধু। ঠিক বন্ধুও বলা যায় না, প্রেমিকাও বটে। আদুরির আসল নাম অনামিকা। পেশায় সাংবাদিক। তুষার অনামিকাকে আদুরি বলে ডাকে।
এখন রাত দুইটা। রানার চোখে ঘুম নেই। তুষার ভাই বাবা মার কথা জিজ্ঞাসা করাতে মনটা ভাল নেই রানার। রানা ভাবতে লাগল এই শহরে সবার বাবা-মা, আপন মানুষ আছে। কিন্তু আমার কেউ নেই।
অথচ এক সময় বাবা মার সঙ্গে ঘুমাত রানা। প্রতিদিন স্কুলে যেত। মা টিফিন রেডি করে দিত। অনেক ভাল খাবার খেত রানা। আর এখন! একবেলা খেতে পারলে আর একবেলা খাবার জুটে না রানার। বিকেল হলে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতেও যেত রানা। ভাল ক্রিকেটও খেলত। আগের সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে রানার অনেক কষ্ট হয়। খুব সহজে কান্না করে না রানা। কিন্তু আজ সে কেঁদে দিল।
ছোট শিশুর মত হু-হু করে কাঁদল। রানার কান্নার শব্দ রাতের নীরবতায় অনেক গভীর শোনা গেল। কিন্তু কারও ঘুম ভাঙল না। কেউ কাছে এসে বলল না, রানা, আমারা তোর পাশে আছি। কাঁদিস না।
পরদিন খুব সকালেই ঘুম ভাঙল রানার। রাতে কান্না করলেও রানার মন এখন ফুরফুরে। পেপার নিয়ে রায় বেড়িয়ে পড়ল সে।
তুষারের সঙ্গে আদুরির সাক্ষাত হল ঠিক সকাল এগারটায়।
তুষার আজও তুমি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছো? আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।
এখন তো এসেছি, বলো।
শোন, আমি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই। আই মিন যারা টোকাই অথবা যে কোনও ছোট কাজ করছে। প্রথমে তাদের নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে চাই। এরপর তাদের কে নিয়ে ভাবব।
খুব ভাল একটা কাজ হবে।
কিন্তু তোমার একটা হেল্প লাগবে। আমি যে শিশুদের নিয়ে কাজ করব তাদের জীবন যাপনের ছবি আমার লাগবে। এতে আমার রিপোর্টের গুরুত্ব থাকবে।
ঠিক আছে। তুমি রিপোর্ট লেখা শুরু কর। যাদের নিয়ে লিখবে আমি তাদের ছবি তুলে দিব। কাল একজনের তুলেছি।
দেখি তার ছবি?
এই যে…
বাহ! খুব মিষ্টি দেখতে। কি নাম ওর?
রানা। রাস্তায় পেপার বিক্রি করে।
গুড। এই ছবিটা আমার লাগবে। কিন্তু ওকে খুঁজে পাব কিভাবে?
রানা ফার্মগেট এলাকায় থাকে। এরপর দেখা হলে আমি তোমার ঠিকানা
ওকে দিব।
ধন্যবাদ তুষার। এখন আসি। ফোন দিও।
এখন দুপুর দুইটা। রানার সব পেপার বিক্রি হয়েছে। এখন তার কোনও কাজ নেই। রানা মাঝে মাঝে দোতালা বাসে উঠে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা করে। ফার্মগেট থেকে গাবতলি যায় আবার গাবতলি থেকে ফার্মগেট আসে। দোতালা বাসের জানালা দিয়ে ঢাকা শহর দেখতে ভালই লাগে রানার। আর বাসেও কত রকম মানুষ যে প্রতিদিন যাতায়াত করে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, রানা এক মানুষ দ্বিতীয় বার কখনও দেখেনি।
রানা আজ দোতালা বাসে উঠল। বাসে উঠে একটা সিটে বসল রানা। হঠাৎ সে খেয়াল করল তার পাশের সিটে একজন বই পড়ছে। একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখল এই তো সেই তুষার ভাই, যে তার ছবি তুলেছিল।
রানা ডাক দিল…আপনি তো সাংবাদিক তুষার ভাই!
আরে রানা, তুমি? কেমন আছো?
কই যাচ্ছ?
আমার কোনও ঠিকানা নাই। যেখানে মন চায় চলে যাই আবার ফিরে আসি।
তোমার পেপার বিক্রি কেমন চলছে…?
ভালই।
জানো আমারও তোমার মত পেপার বিক্রি করতে ইচ্ছে করে।
কি যে বলেন ভাই! আমি তো পেপার বিক্রি করার সময় ভাবি ইস! আমি যদি এইখানে লিখতে পেতাম!
চলো আমরা চাকরি বদল করি।
এই বলে তুষার এবং রানা এক সঙ্গে হেসে দিল।
তুষার ভাই, আমি অনেকদিন পর হাসলাম।
আচ্ছা রানা তোমার বাবা মা কি মারা গিয়েছেন?
না, তারা বেঁচে আছেন।
তাহলে তুমি একা থাক কেন?
তুষার ভাই, আমার সব থেকেও নেই। আমাদের পরিবার খুব ভাল ছিল। আমিও সবার মত স্কুলে যেতাম। অনেক স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে অনেক বড় হব। আমি ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম। আমার বাবার ছোট একটা মুদি দোকান ছিল। একদিন বাবা আমার মার কাছ থেকে কিছু টাকা চাইল। কারণ সে দোকানে আরও মালামাল তুলবে। মাকে বাবা বলছিল, তোমার বাসা থাইকা টাকা আইনা দাও।
মা তার বাবার বাসা থেকে টাকা আনতে পারে নাই। এরপর শুরু হতে থাকে বাবা-মার ঝগড়া। মাকে বাবা খুব মারত। মা সব অত্যাচার সহ্য করত।
একদিন বাবা এক মহিলাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে। ঐ মহিলা বাবাকে টাকা দিয়েছিল। এরপর মা আমাকে নিয়ে নানা বাড়িতে চলে আসে। মামারা কিছুদিন পর মার অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়। আমি তাদের সঙ্গেই থাকতাম। কিন্তু আমার সৎ বাবা আমাকে স্কুলে যেতে দিত না। আমাকে দিয়ে বাড়ির অনেক কাজ করাইত। একদিন আমার জ্বর হল। আমি কাজ করতে পারলাম না। আমার সৎ বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিল। বলল, আমি কাউরে বসায় খাওয়াতে পারব না। আমার মা অনেক কাঁদল কিন্ত কিছুই করতে পারল না।
এরপর থেকে আমি একা। রানা হু-হু করে কাঁদতে শুরু করল।
তুষার বলল, কে বলেছে তুমি একা? আমরা তো আছি। শোন, আমি তোমাকে একটা মোবাইল নাম্বার দিচ্ছি। ওর নাম আদুরি। তুমি আদুরিকে ফোন করে আমার কথা বলবে।
ঠিক আছে তুষার ভাই।
সন্ধ্যায়, তুষার আদুরিকে রানার কথা সব খুলে বলল।
আদুরি জানাল, জানো তুষার, এদের মত ছেলেপেলের দিয়ে অনেক অবৈধ কাজ করানো হয়। যেমন মাদক পাচার, মোবাইল ছিনতাই করা এবং অনেক মেয়ে শিশু তো যৌন হয়রানির শিকার হয়। আবার অনেক শিশুকে বিদেশেও পাচার করা হয়। আমাদের সমাজে কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যেগে এদের জন্য কিছু করছেন। কিন্তু আমাদের আরও অনেক সচেতন হতে হবে। এইসব শিশুদের সন্ত্রাসীরা যাতে ব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুষারও আদুরির কথায় একমত হল।
আজ রবিবার। আকাশটা একটু অন্ধকার। রানা ঘুম থেকে উঠে ভাল একটি শার্ট পরল। এই শার্টটি গত ঈদে এক বড়লোক ম্যাম তাকে উপহার দিয়েছিল। শার্টটি অনেক যত্ন করে রেখে দিয়েছিল রানা। এই শার্ট পরার কারণ আজ পেপার বিক্রি শেষ হলে আদুরি আপার সঙ্গে দেখা করতে যাবে রানা। ছোট কাগজে লেখা আদুরি আপার নাম্বারটা জামার পকেটে সে রেখে দিল। এরপর প্রতিদিনের মতো টি স্টলের মামার কাছে সকালের নাস্তা খেতে আসল রানা।
মামা : কিরে রানা! ঘুম ভাঙলো তোর?
রানা : হ মামা। একটা পাউরুটি আর এককাপ চা দাও।
মামা : এই নে। তোর সকালের নাস্তা তো এটাই…
রানা : হ মামা। আর কি খামু কও! তুমি ছাড়া আমারে তো কেউ নাম ধরেই ডাকে না! বলে ঐ পিচ্ছি শুইনে যা!
মামা : তুই অনেক ভালা ছেলে রে রানা। আজকে নতুন শার্ট পরছোস। কী ব্যাপার?
রানা : দোয়া কইরো মামা। আমার কষ্টের দিন বেশিদিন আর থাকব না।
এখন সকাল আটটা। আদুরি আর তুষার আজ একসঙ্গে বের হয়েছে। সকালে বেশকিছু শিশুর ছবি তুলে তারা অফিসে যাবে। দুইদিন সরকারি ছুটি শেষে রাস্তায় আজ অনেক জ্যাম। একটু পর পর জ্যাম হচ্ছে। আর ভিড়ও অনেক।
এদিকে, প্রতিদিনের মত ঢাকার সকালের ব্যস্ত রাস্তায় রানা পেপার বিক্রি করতে লাগল। আজ রানার মন অনেক ফুরফুরে। তাড়াতাড়ি পেপার বিক্রি শেষ করতে পারলেই আদুরি আপার সঙ্গে দেখা হবে।
রানা দ্রুত গতিতে হাঁটছে আর বলছে, ভাই পেপার নিবেন, পেপার! দাম মাত্র ৫ টাকা! ৫ টাকা!
মিনিট পাঁচেক পর, রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ রানাকে একটা গাড়ি তাকে চাপা দিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে রানার মাথা থেকে ঝরতে লাগল রক্ত। রানাকে ঘিরে বাড়তে লাগল লোকজনের ভিড়ও। একজন পথচারী চিৎকার করে বলছে, কেউ একটা অ্যাম্বুল্যান্স ডাক।
কিন্তু ততক্ষণে রানা আর এই পৃথিবীতে নেই।
তুষার এবং আদুরি ওই পথেই যাচ্ছিল। রাস্তায় মানুষের ভিড় দেখে তারা কাছে আসল। রক্তাক্ত লাশ দেখে তুষার ক্যামেরায় একটা কিল্ক করতেই দেখল পরিচিত রানার নিষ্পাপ মুখটি। নীরবে দাঁড়িয়ে রইল আদুরি। চারপাশে এখন নিস্তব্ধতা। থমথমে পরিবেশ।
হঠাৎ তুষারের কানে ভেসে এল একটি মিষ্টি কণ্ঠ…
আপনি তো সাংবাদিক তুষার ভাই!
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কিশোর গল্প নাইস নূর নাইস নূরের কিশোর গল্প 'পেপার বয়' পেপার বয়