ছাতিম ফোটার সন্ধ্যা
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৫৫
ছাতিম ফোটার সন্ধ্যায় কোনো একদিন মানুষ হয়েছিলাম আমি। আর জেনেছিলাম কেবল মানুষই যন্ত্রণার আত্মজ। সেদিন থেকে শিরার ভিতর ফোটে ছাতিমের ফুল। ফুলের গন্ধ এসে ঢেকে দেয় আরক্ত যাপন। আর সেই ঘ্রাণে দগদগে যন্ত্রণা অমর হয়ে ধায় একটি নদীর দিকে।
কোথায় নিয়ে যাবে? নদী জানে না। গাছও জানে না। তবু এইসব ভাসাভাসি, ভালোবাসা-বাসি চলে নিরন্তর, গাছে-রোদে-ছায়াতে-নদীতে আর স্রোতে পরস্পর। হয়তো নিয়ে যাবে কোনও অজানিত বাগানে।
অদ্ভুত ফুলের তলে শুয়েছে বাগান,
ছোটপাখি গেয়ে যায় বাগানের গান।
কেউ এসে ছুঁয়ে থাকে যাপনের ছয়,
ফুল পাখি সে মিলে গভীর প্রণয়।
এই প্রণয় জেনে সন্ধ্যার ডানা বেয়ে নামছিল অজানিত কুসুমের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ আর কেউ পাচ্ছিল না, কেবলই আমার মাথার ভিতর একটা অনুভূতির সুতো হয়ে চলছিল আরও দূরে, গাঢ়তর কোনো বৈকুণ্ঠের দিকে।
ভোরবেলা লেবুপাতার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা দেখে ভাবি শিশির বুঝি। আর আমার মা মনে আসে। কেন আসে জানতে পারি না কিছুই। প্রিয় লেবুপাতা, তুমি কি জানতে পারো?
লেবু ছিল না ঘরে, লেবুপাতা ছিলো টবের একজোড়া গাছে। সেইপাতা দিয়ে বারো শট টাকিলার সঙ্গে একলা একা সালুথ করার পর গরম স্যুপ খাই। নিজের হাতে বানানো। স্যুপের রং সেই রকম, তাহিতির রাজকুমারীদের মায়ায় যেমন রং থাকে। স্যুপের বাটিতে নাক ডুবিয়ে নিই শেষবার অরণ্যের ঘ্রাণ। অরণ্য বেবিলনে এখনো ঝুলে আছে। কেবল আমি সুতা ছেড়ে দিই।
স্যুপের বাটিতে ডুবে যাই আমি, মাছি আর মহাকাল,
স্যুপের বাটিতে বয়ে যায় একা বহুদূর জিব্রাল্টার খাল।
জিব্রাল্টার খালে ঘুরে আসি মনে মনে। এই খাল সম্পর্কে শৈশবে ভূগোলে পড়া সব ভুলে গেছি। কেবল নামটাই মনে আছে। অবশ্য গুগলে খুঁজলেই পাওয়া যায়। কিন্তু না খুঁজে ভাবি ওইটা কেমন। ধরি, এটা একটা খাল, সুয়েজ খাল যেমন। অবশ্য সুয়েজ খাল কেমন তাও জানি না। পল গগ্যাঁ যখন শেয়ার মার্কেটের দালালি আর স্ত্রী-সন্তানদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে বাড়ি পালালো, তখন সুয়েজ খাল কাটা হচ্ছিল। কদিন পেটের দায়ে গগ্যাঁ সেই খালের মাটি কেটেছিল। তারপর তাহিতি দ্বীপে গিয়ে শিল্পী হয়ে গেলো। অনেকেই এইভাবে শিল্পী হতে পারে। আমি কোনোভাবেই পারি না।
জিব্রাল্টার আসলে একটা উল্টা আকাশের নাম। সব একচক্ষু প্রজাপতি সেই আকাশের মেঘ খুঁটে খায়। জোয়ান বায়েজের গোরুর বাছুরটা তার একপাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের বেড়াল হয়ে যায়।
জিব্রাল্টার আসলে একটা বনারণ্যের নাম। এখানে বনের ভিতর ধনেশের হলুদ চঞ্চু ছাই হয়ে আছে তারপর ধনেশ ধূসর, ধনেশ গিয়েছিলো প্রেমের দিকে। প্রেমের লালে মিশে সে কমলা হতে পারলো না বৈকি, তাতে কী! হয়ে গেলো সে ধূসর, জীবনদাশের ধূসর পাণ্ডুলিপি যেন।
জিব্রাল্টার আসলে আমার আনোখা এক প্রেমিকার নাম। প্রেমিকার কনুই থেকে গড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর তিনটি নদী। প্রেমিকার বুক থেকে ঝরে পড়ে দুইশো দশটা রূপালী মাছ।
জিব্রাল্টার আসলে একটা অন্ধ জানালা, দেয়ালরহিত ঘরে ঝুলে আছে। আমি সেই ঘরে যাই। সেই ঘরে ঘনায় শীতকাল চিরদিন। আমি তো শীতকাল ভালোবাসি। শীতকালে আমার প্রেম ও শ্বাসকষ্ট হয়। শীতকালে মরে পড়ে থাকি নর্দমায়, কেবল ক্লেদজলে লেগে থাকে একটি দীর্ঘশ্বাসের দাগ। এই দাগ উড়ে যায় ফুল হয়ে ফল হয়ে মাছি হয়ে, আরও কোনও ধনেশের চঞ্চুতে রেখে যায় চৈত্রের দাগ। মীনকুমারীর চোখের মায়া হয়ে ফুরিয়ে যায়, আমারই অংশ হয়ে।
আমি কাউকে বলি, ‘ফুল নিও হাতে। চালধোয়া আঙুল নিও মুখে। জাম নিও জিভে, তারপর দিগন্তে গিয়ে সন্ধ্যার আকাশে ঘষে দিও। তারপর একদিন যদি পাখি হতে পারো, আকাশের নীলে কেটে এসো ডানার দাগ। পতনের আগে জেনেও নিও আকাশ বলে কিছু নাই। আমি আসছি একটু পর। এর মধ্যে বাগানটাকে তুমি অরণ্য বানিয়ে রেখো। আমার বাগান ভালো লাগে না’।
কোথায় যাই জানি না। ফিরে এসে দেখি বাগানের গায়ে বাগানই পড়ে আছে। রিকশা নিলাম কোথাও বনে বনে ফিরবো বলে, আমি আর কেউ। রিকশা চলতে শুরু করে। পাশে বসা কেউ বলল, তুমি একটাও গাছ চেনো না, চেনো না মীনগাছ, চেনো তারার তরু, চেনো না কাকবৃক্ষ।
আমি তাকে আশ্বস্ত করতে চাই। বলি, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আবারও আমি পৃথিবীর সকল গাছের নাম মুখস্থ করে নেবো। উচ্চতা, ঘের, পাতার আকার আর গন্ধ মনে রাখতে পারলেই হবে। ফুলের গাছ, তারপরে ফলের গাছ আগে, তারপরে আছে পাখিদের গাছ ইত্যাদি। একটু করে প্রতিদিন নিশ্বাস জমিয়ে রাখছি বুকের ভিতর। পৃথিবী বৃক্ষশূন্য হওয়ার আগেই আমি গাছ মুখস্থ করবো, কথা দিচ্ছি’।
তারপর বললাম, ‘জানো তো! মাঝে মাঝে যখন নিজেকে এম্মা বোভারি মনে হয়, তখন মনে হয় বুকের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। এইসব প্রতারক মেঘ দেখে দেখে বুকের ভিতর খরা রেখে দিই। দুহাতে বুক বেঁধে মনে মনে বলি, খরা সুন্দর। আর সন্ধ্যা আসে, ঠান্ডা হাওয়ার ভিতর ছাতিম ফোটে শাদা শাদা।’
রাস্তায় আরও আরও মানুষ। ফোন বাজে আমার। অচেনা নম্বর। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে, ‘হ্যালো…’।
আমি চিনে ফেললাম কণ্ঠস্বর, তারপরও শুনতে ইচ্ছে হলো প্রিয়তম নাম, ‘কে?’
‘গীতবিতান।’
আমার আবারও শুনতে ইচ্ছে হলো, ‘হ্যালো, কে?’
‘আমি গীতবিতান।’
‘কতো নম্বর পৃষ্ঠা?’
‘২৩৭ পৃষ্ঠার ৬০৪ নম্বর। বিশ্বভারতী, ১৩৭১ আশ্বিনের অখণ্ড সংস্করণ।’
আমি চোখের পাতায় গীতবিতানের অঙ্গবিহীন স্পর্শ টের পেলাম। আর মুহূর্তেই চিনতে পারলাম সন্ধ্যার ডানা বেয়ে নামছিল কোন সে ফুলের গন্ধ।
আমার কেউ শুধালো, ‘কোন ফুল?’
বললাম, ‘ছাতিম।’
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ ছাতিম ফোটার সন্ধ্যা নির্ঝর নৈঃশব্দ্য নির্ঝর নৈঃশব্দ্যর মুক্তগদ্য 'ছাতিম ফোটার সন্ধ্যা' মুক্তগদ্য