কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা [চতুর্থ পর্ব]
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৩১
[চতুর্থ পর্ব]
বাসার মধ্যে ঢুকে বিভ্রান্ত মিলিয়া রহমান, মি. খোন্দকার মোশতাক, জয়নাল হোসেন।
আমপুরা ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায় ড্রয়িংরুমে সোফায় চুপচাপ বসে আছে। বিদেশি মেহমানদের দেখছে না। গম্ভীর চোখে তাকায় মি. দিগ্বিজয় রায়। চোখের মধ্যে আগুন জ্বলছে। মি. খোন্দকার মোশতাক সকল অপকর্মের সৈনিক মি. দিগ্বিজয় রায়ের। বাকি দুজনকে পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবহার করে। জয়নাল হোসেন কাজগপত্র বোঝে ভালো। ঠাডা শহরের কোনো কোনো এলাকার কোনো জমিতে ঝামেলা আছে, কার বাড়ি নিয়ে মামলা আছে, নিজের আমপুরা ওয়ার্ডের মধ্যে কোনো কোনো বাড়ি বা জমির কাগজপত্র ঠিক নাই, সব খবর জানা জয়নাল হোসেনের। আর মিলিয়া রহমান সুন্দরীকে রাখে নিজের মতো করে ব্যবহার করার জন্য। নিজেতো বিছানায় নেয়ই, যখন তখন অন্যর কাছেও পাঠায়।
মিলিয়া রহমানের হাজবেন্ড মি. ফারুক রহমান সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার। বেচারার চাকরি চলে যায় অন্য অফিসারের স্ত্রীর সঙ্গে ধরা পড়ে। বেচারা সেনাবাহিনী কোনোও সুযোগ সুবিধাই পায় নাই। ফলে স্ত্রী মিলিয়া রহমানের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। মিলিয়া রহমান ভীষণ উচ্চাভিলাষী। ওর পরিকল্পনা, আগামী নির্বাচনে আমপুরা ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ড কমিশনারের পদে নির্বাচন করা। কিন্তু মি. দিগ্বিজয় রায় জানে, মিলিয়া রহমানকে কি করতে হবে। নির্বাচনের এখনও আড়াই বছর বাকি। হিসাব পরিস্কার, নির্বাচনের এক বছর আগে ফেলে দেবে মিলিয়া রহমানকে। দাবার গুটি ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে আনছে মি. দিগ্বিজয় রায়।
ফারুক রহমানকেও নিজের হাতে তুলে নিয়েছে মি. দিগ্বিজয় রায়। আমপুরার বাইরে বাকরাইলে একটা মার্কেট আছে মি. দিগ্বিজয় রায়ের। সাততলা বাড়ি। নিচের তিনতলায় মার্কেট। বাকি চারতলায় বাসা বাড়ি। প্রতিমাসে তিন কোটি টাকা ভাড়া আসে। সেই মার্কেটের ম্যানেজার বানিয়ে দিয়েছে― ফারুক রহমানকে। ফারুক রহমানও ঘাগু মানুষ। দিগ্বিজয় রায়ের লোক জানিয়েছে, ফারুক বাকরাইলের জায়গা দখলের পরিকল্পনা করছে। শুনে হাসছে মি. দিগ্বিজয় রায়।
তাই নাকি!
হ বস।
তুই কি করে বুঝলি? বাকরইলের মি. দিগ্বিজয় প্লাজার তিন তলার অফিসের পিওন রজব আলী দেওয়ান সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
গত কয়েক মাস ধরে ফারুকের কাছে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লোকরা আসে। চা খায়, সিগারেট খায়। পানীয় খায়। মাঝে মাঝে একজন মহিলাও আসে। মোটা, কালো সেই মহিলা। কিন্তু বিশাল একটা গাড়িতে আসে।
তাই? মাথা নাড়ায়।
ওরা বলে কি!
সেটাতো জানি না স্যার।
কেনো জানিস না?
ওইসব লোকজনের সঙ্গে যখন সিরিয়াস কথা হয়, তখন আমাকে চা আনার জন্য বাইরে পাঠায়। একদিন আমি দ্রুত চা এনে পাশের ছোটরুমে চা ট্রেতে সাজাচ্ছি, শুনতে পাই― ওরা হিসাব করছে, কতো তলা। কতো বর্গফুট, কতো দাম! সাত ভাগ হলে কার ভাগে কতো টাকা যাবে এইসব।
মাথা দোলায় ঠাডা শহরের আমপুরা ওয়ার্ড কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায় পিওন রজব আলী দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে, তুই আগেই খবর দিয়ে ভালো করেছিস রজব। চিন্তা করিস না, অপেক্ষা কর, ভবিষ্যতে তোকেই আমি বাকরাইলের দিগ্বিজয় প্লাজার ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেব। তুই চোখ কান খোলা রাখ।
জি স্যার, বাইরে এসে রজব আলী দেওয়ান শূন্যে ডিগবাজি খায়। আমি, আমি হবো বাকরাইলের দিগ্বিজয় প্লাজার ম্যানেজার!
ভাই, কি হয়েছে আপনার? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে মি. খোন্দকার মোশতাক।
কিছু না, বস তোরা। নিজেকে সংযত করে নিয়েছে মি. দিগ্বিজয় রায়। নিজের জীবনের ঘটনা দূর্ঘটনা অপমান লজ্জা তো আর এইসব ছালবাকলদের বলা যায় না।
গত রাতের ঘটনা কোনোওভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না দিগ্বিজয় রায়। কুকুর! শেষ পর্যন্ত কুকুরের কাছে এমন লাঞ্চনা সইতে হলো? কোত্থেকে এসেছে এই কুকুরেরা? কোথায় ওদের শক্তির উৎস? আচ্ছা ক্ষমতাসীন সরকারকে হটিয়ে অন্য কোনোও গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসানোর কোনোও ষড়যন্ত্র না তো! রাস্তাঘাটের কুকুর, কুত্তা…। গতরাতে কুকুরের বাচ্চা কুত্তাগুলো চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ডিআইজি ব্যাগে আনা লুঙ্গি পরে, জামা খুলে পাঞ্জাবী কুর্তা পরে, পায়ের স্যু হাতে নিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দরজায় পৌঁছে ফিরে তাকিয়ে মি. খাইখাই খান বলে, ভাই আজকের পর থেকে আর আমার সঙ্গে কোনোও যোগাযোগ রাখবেন না। হালার কুত্তারা আমার খবর জানে। খোদা হাফেজ! বলে এক লাফে দরজা পার হয়ে যায় ব্যাটা।
কুকুরেরা চলে যাবার পর সোফায় উঠে কেবল বসেছে মি. দিগ্বিজয় রায়, সঙ্গে মি. খাইখাই খানের পগারপার হওয়ার দৃশ্যটা ভালো লাগে নাই। শালার মাকুন্দা, আমি তোমাকে কম টাকা দিয়েছি? বান্ডিলে বান্ডিলে টাকা দিয়েছি। সুত্তরায় আড়াই হাজার বর্গফুটের বিশাল ফ্ল্যাটের দেড় কোটি টাকাতো আমিই দিয়েছি। আর হারামজাদা, কুকুরের পায়ের নীচে অসহায়ভাবে পরে ছিলাম, কিচ্ছু বলিসনি। কেবল দুচোখ মেলে দেখেছিস! কুকুরের পায়ের নখরাঘাতে শরীরের কয়েক জায়গা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তাক্ত আমাকে ফেলে চলে গেলি. শালার বাঙালি মোনাফেক!
মি. দিগ্বিজয় রায়ের ভাবনার মধ্যে প্রবেশ করে পুরানো ঢাকার মি. আম্বিয়াচরণ, দিগ্বিজয়?
বস!
ঘটনায় তো টাসকি খাইয়া গেলাম। হালার কুত্তায় এইভাবে মানুষের উপর; মাথা নাড়ায় আম্বিয়াচরণ। পাশে বসা টাটিয়া ট্যাম্বোর বিশাল স্তনের দিকে নজর। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, অবিশ্বাস্য ঘটনা। কুকুরের কাছে মানুষের পরাজয়!
ব্যথা-মাথা শরীরে দাঁড়ায় মি. দিগ্বিজয় রায়, আপনি কই যাচ্ছেন? দাঁড়িয়েই বুঝতে পারেন, সারা শরীরে কি ভয়ানক ব্যথা। মনে হচ্ছে পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
আমি চলে যাব বাসায়। আমি ঠিক কি করবো, বুঝতে পারছি না মি. দিগ্বিজয় রায়― এক মনে বলে যায় আম্বিয়াচরণ।
আপনি আমার পরামর্শদাতা। আপনি আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে…
শোনেন মি. দিগ্বিজয় রায়। আমার মনে হচ্ছে শালার কুত্তাগুলো যে কোনো সময়ে আবারও চলে আসতে পারে। ওরা তো কুত্তা, থাকে রাস্তায়। খায় নর্দমার ময়লা, গু। কখনও বিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেনি। কি করে বুঝবে আমার মতো মানুষের মর্যাদা।
ঠিক আছে বুঝলাম, কুত্তারা আপনার মর্যাদা বুঝবে না, হাত কচলে বলে মি. দিগ্বিজয় রায়, কিন্তু যাবার আগে আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে যান।
আমি এখন কোনও পরামর্শ বা এ্যাডভাইস কিছুই দিতে পারবো না। মাথায় কিছুই আসছে না। আগে বাসায় যাই, পরে জানাব।
আমরা? আমাদের কি হবে? মি. আম্বিয়াচরণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উগান্ডার মতিয়ার মারবেল। আমি দেশ থেকে দুজন অতিথি আনলাম। কিন্তু আপনার বাড়িতে আমরা আর থাকতে চাই না।
মানে? বিরক্ত বোধ করে মি. দিগ্বিজয় রায়। তোমরা তো অতিথি, কুকুরগুলোতো বলেছে তোমাদেরই সামনে, আমরা অতিথিদের সম্মান করি।
ওরা তো কুকুর মি. দিগ্বিজয় রায়, হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয় টাটিয়া ট্যাম্বো। কখন কি করে বসে ঠিক আছে? আমি থাকবো না আপনার বাড়িতে।
টাটিয়া ট্যাম্বোর সঙ্গে যোগ দেয় রুথিয়া ক্যামবেল, আমিও থাকবো না।
মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে মি. দিগ্বিজয় রায়। ইতিমধ্যে মি. আম্বিয়াচরণের চোখের ভাষা পড়েছে। শুয়োরের বাচ্চাটা কালোমানিক নারীদের নিজের ডেরায় নিয়ে যেতে চাইছে এবং কুকুরের ঢংয়ে জিহবা চাটছে। রাগে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ঘাগু রাজনীতিবিদ মি. দিগ্বিজয় রায়। শুন্য থেকে আজ এখানে, কোটি কোটি টাকার মালিক, ঠাডা শহরের চারটে বাড়ি একটা মার্কেটের মালিক, একটা ওয়ার্ডের মালিক! সবই হয়েছে ধীর-স্থির ঠান্ডা মাথার জন্য।
হাসি আনে মি. দিগ্বিজয় রায় রক্তমাখা ঠোঁটে, কোথায় যাবে তোমরা? তোমাদেরকে তো আমিই আনিয়েছি আফ্রিকার উগান্ডা থেকে। বিমান ভাড়াসহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। না হয় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তোমাদেরতো কোনোও ক্ষতি হয়নি। তোমরা আমার এই বাড়িতে না থাকো, আমি অন্য বাড়িতে রাখবো।
রুমের মধ্যে হাওয়া থেমে যাচ্ছে। অন্য বাড়ির প্রসঙ্গ এনে মি. দিগ্বিজয় রায় নিজের আয়ত্তের মধ্যেই রাখার পথ বের করে নিচ্ছে, বুঝতে পারছে মি. আম্বিয়াচরণ। অনেক দিনের চেনাজানা মানুষ, রক্তে রক্তে বেইমানি আর প্রতারণা আর অন্যকে খুন করার অভ্যাস মি. দিগ্বিজয় রায়ের। কূটকৌশলের শেষ নেই। বেশি ঝামেলা করলে কালোমানিক নারীদের ফেলেও দিতে পারে। ফেলে দিক দিগ্বিজয় রায়, কিন্তু আগে একটু চেখে না নিলে আজীবন কষ্ট পাবে মি. আম্বিয়াচরণ।
কোথায় রাখবেন আমাদের? আম্বিয়াচরণের ভাবনার মধ্যে করাতের গতিতে ঢুকে যায় রুথিয়া ক্যামবেল। মেয়েটি হালকা-পাতলা হলেও ধারালো, সঙ্গে শাঁসালো।
এই ঠাডা শহরে কি আমার একটা বাড়ি? এখান থেকে এক কিলোমিটারের দূরত্বে আছে বাকরাইলে আমার সাততলা মার্কেট, দিগ্বিজয় প্লাজা। কুত্তারা এই বাড়ি চিনলেও সেই বাড়ি চিনবে না। বিশাল মার্কেট, সাততলায় আমার নিজের জন্য দুই হাজার বর্গফুটের বিশাল এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। সেখানে গেলে কাকপক্ষীও টের পাবে না।
কিন্তু যদি কুকুরেরা টের পায়, ঢুকে যায় মতিয়ার মারবেল। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি বড় প্রখর। মানুষের মতো ওদেরও গোপন বাহিনী থাকতে পারে। তখন?
রাইট, আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম, দুইপক্ষের মাঝখানে দাঁড়ায় মি. আম্বিয়াচরণ। টাটিয়া ট্যাম্বোর উম্মুক্ত স্তনে আলতো আদর করতে করতে বলে, বরং আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চলে যাক ওরা। আরামে থাকবে। নিরাপদে থাকবে। অন্যদিকে আপনার বিপক্ষ দলের মি. পান্ডারও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ওরা যদি কেনোভাবে জেনে যায় আপনি ফরেন মাল বাসায় আমদানি করেছেন, টিভি চ্যানেল আর পত্রিকাঅলারা আপনার জীবন কাড়ানাড়া করে ছাড়বে। খুব সাবধানে থাকা দরকার। আপনি আপনার এদিকের ঝামেলা মিটিয়ে চলে আসুন। বোতল, মাংস, ভুনা সব প্রস্তত থাকবে; ঠিকাছে। আর আমি মাননীয় মন্ত্রী বারবার বুধাকেও আমন্ত্রন জানিয়ে রাখবো। আমার বাড়িতে মৌজ করতে করতে আপনার ব্যবসার ডিল করতে সুবিধা হবে মি. দিগ্বিজয় রায়।
রাইট, মি. দিগ্বিজয় রায়― মি. আম্বিয়াচরনকে সমর্থন করে মতিয়ার মারবেল। ওদের পিতামাতার কাছে আমার দায় রয়েছে। যে কেনোভাবেই হোক অক্ষত অবস্থায় টাটিয়া ট্যাম্বো আর রুথিয়া ক্যামবেলকে ওদের বাবা মায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা বরং আম্বিয়াচরণের সঙ্গেই যাই। আমরাতো আছিই।
চোখের সামনে দিয়ে ওরা চলে যায় গতরাতে মি. আম্বিয়াচরণের সঙ্গে। আর আম্বিয়াচরণের গলা ধরে হারামজাদী টাটিয়া ট্যাম্বো চুমু খেতে খেতে চলে যায়। সেই থেকে মেজাজ তেতে আছে। সারাটা রাত জেগে কাটিয়েছে মি. দিগ্বিজয় রায়। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে ঘুমাতে পারে না। চোখে ঘুম আসে না। নির্বাচনের দুইরাত আগে থেকে ঘুমাতে পারে মি. দিগ্বিজয় রায়। অস্বাভাবিক টেনশনে ভোগে। জানে, এই নির্বাচনের খাতায় কাগজে কলমে বিরোধীদল আছে, বাস্তবে নেই…। নির্বাচনে দিগ্বিজয় রায়ের মার্কা তিমি।
তিমি! তিমি জিনিসটা কি? কোনোও গাছের ফল? জীবনে নামতো শুনি নাই, নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দলের কর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে প্রতীক পাওয়ার পর আলোচনা করছে দিগ্বিজয় রায়।
একটু দূরে চা খাচ্ছে মিলিয়া রহমান আর মি. খোন্দকার মোশতাক। মিলিয়া রহমান কাছে আসলে আবার প্রশ্ন করে, তিমি ফলটা কি রে মিলিয়া?
তিমি ফল না ভাই, মিচকি মিচকি হাসে মিলিয়া। জীবনে একদিন ইস্কুলে যায় নাই। চুরি বাটপারি করে, মানুষের জায়গা জমি দখল করে টাকা পয়সার মালিক বনে গিয়ে এখন আসছে সরকারি দলের নমিনেশন কিনে ওয়ার্ড কমিশনার হতে। বলে, তিমি নাকি ফল!
ভাই, কাছে দাঁড়িয়ে শরীরের সঙ্গে হালকা শরীর রেখে বলে, তিমি হলো বড় সামুদ্রিক মাছ। ওজন কয়েক’শ টন। থাকে সমুদ্রের নীচে।
সেই মাছ আমাকে মার্কা হিসেবে কেনো দিল? ঘড়ঘড় করে কুকুরের গলায় মি. দিগ্বিজয় রায়। এতোবড় তিমি মাছ আমি কোথায় পাবো? কিভাবে পোস্টারে ছাপা হবে তিমি মাছ? নিশ্চয়ই বিরোধীদলের কোনোও ষড়যন্ত্র। তাকায় জয়নাল হোসেনের দিকে, চল তো নির্বাচন কমিশনারের কলার ধরে জিজ্ঞেস করি, কেনো আমাকে তিমি মাছ দিয়েছে, যে মাছ থাকে সমুদ্রের তলদেশে আর ওজন কয়েকশো টন!
আমার মনে হয় না ভাই, আপনাকে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে শত শত টনের তিমি ধরে এনে পোস্টারে ছবি ছাপাতে হবে― অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে জয়নাল হোসেন।
তাইলে? রেগে ওঠে দিগ্বিজয় রায়। আমি তিমি মাছের ছবি কোথায় পাবো? পোস্টারে কিসের ছবি দিবি?
শোনেন ভাই, মিলিয়া নিজের শরীরটাকে আর একটু চেপে ধরে দিগ্বিজয় রায়ের শরীরের সঙ্গে, তিমি মাছের অনেক ছবি আছে। আপনাকে তিমিমাছের জন্য সমুদ্রের তলদেশে যেতে হবে না।
আশ্বস্ত বোধ করে দিগ্বিজয় রায়, মিলিয়া তুমি বলছ― আমাকে সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে তিমি মাছ আনতে হবে না? এই দেশে তিমি মাছের ছবি পাওয়া যাবে?
হ্যাঁ, পাওয়া যাবে।
কিন্তু শালার নির্বাচন কমিশনার আমাকে একশো টন ওজনের তিমি মাছ কেনো দিলো?
দিয়েছে ভালো হয়েছে।
বাতাসে উড়ছে মিলিয়া রহমানের চুল, সেই চুল সরিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় প্রশ্ন করে দিগ্বিজয় রায়, তুমি বলছ তিমি মাছ আমার জন্য ভালো মার্কা?
মাথা নাড়ায় মিলিয়া, হ্যাঁ ভাই। আগেই বলেছি তিমি অনেক বড় মাছ। সেই বড় মাছ গোটা পোস্টার জুড়ে হবে আপনার মার্কার ছবি। জনগণ দেখবে আর ভাববে… কথা শেষ হয় না মিলিয়ার।
মাথার উপর দেবদারু গাছের উপর কাকেরা মিটিং করছিল। মিটিং করতে করতে কাকেরা হেগে দেয়, সেই হাগা এসে পড়ে মিলিয়া রহমানের রেশমীকোমল চুলে। কাকের হাগার গন্ধে মিলিয়া বমি করার জন্য হা করে। পকেটে রাখা টিস্যু বের করে দ্রুত মিলিয়া রহমানের উপর কাকের হাগা পরিষ্কার করে নিজের হাতে মি. দিগ্বিজয় রায়। পাশে দাঁড়ানো কর্মীদের মধ্যে সুলতান মৃধা এগিয়ে আসে, বস আমারে দ্যান। আমি ম্যাডামের শরীরের উপর হাগা মুইছা দিই?
মিলিয়া রহমানের শরীরের কাকের হাগা পরিষ্কার করতে করতে ত্যাড়া চোখে তাকায় মি. দিগ্বিজয় রায় সুলতান মৃধার দিকে, হারামজাদা ম্যাডামের হাগা কোথায় পেলি?
সরি স্যার, ম্যাডামের হাগা না, ম্যাডামের শরীলে কাউয়ার হাগা―
এই নে, এতোক্ষণে সুন্দর করে মুছে ফেলেছে মি. দিগ্বিজয় রায় ম্যাডামের শরীরের উপরে পরা কাকের হাগা, বাড়িয়ে ধরে কাকের হাগা মোছার টিস্যু।
সুলতান মৃধা হাত বাড়িয়ে নেতার দেওয়া কাকের হাগা মোছার টিস্যু নিয়ে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। হাতটা দিয়ে কাকের হাগার গন্ধ আসছে। শালার কাকের হাগায় এতো বিশ্রি গন্ধ!
কাকের হাগা মোছার পর বোতলের পানি নিয়ে মাথার চুলও ধুইয়ে দেয় মি. দিগ্বিজয় রায়। চারপাশে ঘিরে থাকা কর্মীরা, মাঝারিগোছের নেতারা কিছু মনে করে না। কারণ, মি. দিগ্বিজয় রায় চারপাশে ঘিরে থাকা এইসব কর্মীদের কুকুরের পালের মতো পালে। দিগ্বিজয় রায়ের সঙ্গে যারা রাজনীতি করে, সবাই জানে মিলিয়া রহমানের সঙ্গে গভীর নিবিড় সর্ম্পক। সামনে কর্মীরা সম্মানে মাথা নুইয়ে সালাম জানিয়ে, একটু দূরে সিগারেট-চা ফুঁকতে ফুঁকতে হাসে, শালার খানকি!
মিলিয়া রহমান জানেও সব। কিন্তু মজা লাগে এইসব ভিনেগারের স্বাদ। ক্ষমতারও একটা দাপট দেখানো যায়। ওয়ার্ডে, ঠাডা শহরের দলের কর্মীরা জানে মিলিয়া রহমানের ক্ষমতা। সামনাসামনি কেউ কিছু বলার সাহস রাখে না। রাতে বা দিনে, যখনই ইচ্ছে হয়, শরীর জেগে ওঠে― ডাকে মিলিয়া রহমানকে। পঙ্গপালের সুখে ছুটে আসে মিলিয়া রহমানও। খুব সুখ অনুভব করে দিগ্বিজয় রায়ের সান্নিধ্য।
দিগ্বিজয় রায়ের পাশে বসে মিলিয়া রহমান। সামনের সোফায় জয়নাল হোসেন আর মি. খোন্দকার মোশতাক বসে। তিনজনেই বুঝতে পারে, মি. দিগ্বিজয় রায় স্বাভাবিক নেই। রুমের মধ্যে সোফায় বসে আছে একলা। পড়নে একটা গামছা। পুরো শরীর উদোম। বুকের পশম কালো সাদা। সামনে টেবিলের উপর বোতল, গ্লাস আর কবুতরের মাংসের ভুনা। মাংস থেকে গন্ধ আসছে।
মিলিয়া রহমানের মাথার চুলে আলতো আদর করতে করতে মি. দিগ্বিজয় রায়, কি বলল আমপুরা থানার ওসি মি. খবির মিয়া?
ভাই! মুখ খোলে মি. খোন্দকার মোশতাক। কিন্তু আর বলার সাহস পায় না।
কি হলো? তুমি থেমে গেলে কেনো?
ভাই, আমপুরা থানার ওসি তো মি. খবির মিয়া না― জবাব দেয় জয়নাল হোসেন।
তোমাগো কি ভুতে পাইছে? মিলিয়া রহমানের কোমল চুলের বাগান ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে দিগ্বিজয় রায়। আমি নিজে ফোনে আমপুরা থানার ওসি মি. খবির মিয়ার সঙ্গে তোমাদের সামনে বসে ফোনে কথা বলি নাই? নাকি আমি মিথ্যা বলছি?
না, তুমি রাগ করো না। মিলিয়া রহমান নরম হাত রাখে দিগ্বিজয় রায়ের ঘাড়ে, আমরা তো থানায় গেলাম। ভাবলাম, আমরা যাবার সঙ্গে ওসি আমাদের সঙ্গে চলে আসবে। কিন্তু ওসির চেয়ারে বসা একটা কুকুর।
কুকুর? বিস্মিত গলা মি. দিগ্বিজয় রায়ের। কুকুর কি করে আমপুরা থানার ওসি হয়? দুনিয়ার কোথাও, কোনোও দেশে আছে, থানার ওসি হয় একটা কুত্তা! কি বলতেছো তোমরা? বাড়ি দখল করতে চায় কুত্তার দল। আবার থানায় কুত্তা!
হ্যাঁ বস, আমরাতো অবাক, আলাপের মধ্যে ঢুকে পড়ে জয়নাল হোসেন। আমরা ভাবছিলাম― কোথায় এলাম? ভুল দেশে ভুল জায়গায় নাতো? কিন্তু মি. চাংচুই আমাদের ভুল ভাঙ্গিয়ে বলল, না আপনারা ঠিক জায়গায়ই এসেছেন। একটু আগে আমপুরা ওয়ার্ডের কমিশনার মি. দিগ্বিজয় রায় ফোন করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, আপনারা আসবেন। আপনাদের অপেক্ষায় আছি।
একেবারে মানুষের মতো কথা বলল?
হ্যাঁ ভাই। একেবারে মানুষের মতো।
কিন্তু চাংচুটা কে?
ওই শালার কুকুর ওসির আসল নাম চাংচু।
দাঁড়িয়ে রুমের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে মি. দিগ্বিজয় রায়। বিরক্ত, অপমানিত, রাগান্বিত। শালার রাস্তাঘাটের কুকুরেরা সব দখল করে ফেলছে? কিন্তু শনিবার তো আগামীকাল। ওরা তো আসবে। শোনা গেছে আমপুরার এই গলির আরও তিনটা বাড়ি কুকুরেরা দখলে নিয়েছে। বাড়িঅলারা কোর্টে মামলা করেছে। কিন্তু…!
ভাই? এখন কি করা? প্রশ্ন করে মি. খোন্দকার মোশতাক।
মিলিয়া, তুমি আমার রুমে যাও। গোসল করে পবিত্র হও, আমি আসছি।
ওকে সোনা, উঠে চুমু খেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায় ভারী নিতম্ব দুলিয়ে। মিলিয়া রহমানের চমচমে নিতম্বের দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে থাকে মি. খোন্দকার মোশতাক। মনে মনে কতোবার ভেবেছে, মিলিয়া রহমানকে বিছানায়। কিন্তু লোটে সব মি. দিগ্বিজয় রায়। পাশে বসে চিমটি দেয় জয়নাল হোসেন। সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়া রহমানের নিতম্ব থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে মি. খোন্দকার মোশতাক।
অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের অংকের হিসেবনিকেশ করছিলো মি. দিগ্বিজয় রায়। দেখেনি প্রিয় সাগরেদ মি. খোন্দকার মোশতাকের নিতম্বলেহন।
এখন কি করা যায়? প্রশ্ন রাখে দুই সাগরেদের কাছে দিগ্বিজয় রায়।
কুত্তা তো কুত্তাই। ভয় পাওয়ার কি আছে? মি. খোন্দকার মোশতাক নিজের মতো করে মাথার কালো টুপি দুই হাতে নাড়াতে নাড়াতে বলে, আপনার তো বন্দুক আছে। আছে বাহিনী। সেই বাহিনীর কাছে আছে পিস্তল, বন্দুক। ওরা এসে কুত্তাদের তাড়িয়ে দিক, মেরে ফেলুক। আমি বুঝতে পারছি না আপনি কেনো কুত্তাদের ভয় পাচ্ছেন?
আবার বসে মি. খোন্দকার মোশতাক আর জয়নাল হোসেনের সামনে মি. দিগ্বিজয় রায়, তোমরা যা জানো না, আমি অনেক জানি। আমাদের এই গলির তিন তিনটা বাড়ি ইতিমধ্যে কুকুরেরা দখল করে নিয়েছে। কোর্টে মামলা হয়েছে। বিচারক তদন্তের ভার দিয়েছে তিন থানার ওসির উপর― কিন্ত বিশেষ খবরে জানলাম, সেই তদন্ত কর্মকর্তারাও কুকুর।
বলেন কি! আঁতকে ওঠে দুই সাগরেদ।
বলছি কি আর! কোথা থেকে এতো কুকুর এল আমাদের গলিতে? হাঁটা যায় না কুকুরদের কারণে। কটাকে আর গুলি করে মারা যাবে? একটা গুলি করলে শত শত কুকুর ছুটে আসবে। শত শত কুকুরের পায়ের নখের আক্রমণে, দাঁতাল দুইপাটি দাঁতের কামড়ে কেউ বাঁচবে?
বিচলিত বোধ করে জয়নাল হোসেন আর মি. খোন্দকার মোশতাক। কতো বছর ধরে দিগ্বিজয় রায়ের আশ্রয়ে থেকে, লালিত পালিত হয়ে ঠাডা শহরে বাড়ি করেছে দুজনে― কোনোওদিন সামান্য বিচলিত হতে দেখেনি নেতাকে, সবাইকে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিয়ে…। সেই লোক আজ কি বলছে!
তাহলে কি করবো আমরা?
খোন্দকার মোশতাকের প্রশ্নে থমথমে মুখে তাকায় মি. দিগ্বিজয় রায়। মাথা চুলকিয়ে বলে, তোমাদের মাথায় কোনোও বুদ্ধি আছে?
জয়নাল হোসেন মাথা নাড়ায়, না ভাই। আমার মাথায় কিছু আসছে না।
মি. দিগ্বিজয় রায় তাকায় অনেক ঘটনার সাক্ষী মি. খোন্দকার মোশতাকের দিকে― তুমি? তুমি একটা কিছু বলো।
আমার বুদ্ধি হলো ভাই, কুকুরদের লাই দিতে নাই। মাথার লম্বা আকারের কালো টুপিটা খুলে বুকের উপর বাতাস দিতে দিতে বলে, কুকুর আসলে আপনার বাহিনী দিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেবেন। কুকুর আর কয়টা আসবে আপনার কাছে? দশটা? কুড়িটা? পঞ্চাশটা? কোনোও ঘটনাই না আপনার বাহিনীর কাছে―
আমার মনে হয় না…
কেনো?
তোমরা দেখেছো, আমপুরা এলাকার কুকুরদের গতিবিধি? ভয়ানক চোখে তাকায়, সব সময়ে গলির মোড়ে মোড়ে দল বেঁধে অপেক্ষা করে লম্বা লাল জিহবার সঙ্গে ভয়ংকর দাঁত বের করে। আগেই জানিয়েছি, ওরা ইতিমধ্যে গলির তিনটি বাড়ি দখলে নিয়েছে।
কার কার বাড়ি দখলে নিয়েছে?
জয়নাল হোসেনের প্রশ্নে উত্তর দেয় মি. দিগ্বিজয় রায়, মি. আতিক আহমদ, মি. খয়রাত হোসেন আর মি. জয়রাম পোদ্দারের বাড়ি দখলে নিয়েছে।
মি. খয়রাত হোসেনের বাড়িও দখলে নিয়েছে? আঁতকে ওঠে মি. খোন্দকার মোশতাক। মি. খয়রাত হোসেন আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু―
হ্যাঁ, আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।
কেনো কিছুই করতে পারেন নি?
কি করে করব? আমাকে কুকুরদের লিডার সাদা কালো কুকুর ফোনে জানালো আমি যদি আমার বন্ধু মি. খয়রাত হোসেনকে সাহায্য করি, দার্জিলিংয়ে পড়ুয়া আমার মেয়েকে খেয়ে ফেলবে।
বলেন কি ভাই? ওরা আপনার মেয়ের খবরও…
হ্যাঁ পেয়ে গেছে, খুব মৃদুলয়ে উচ্চারণ করে মি. দিগ্বিজয় রায়। মেয়েটা যদি না বাঁচে আমার বেঁচে থাকায় কি আসে যায়! গলা ধরে আসে । জয়নাল হোসেন আর মি. খোন্দকার মোশতাক বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে, ইস্পাত দৃঢ় বস মি. দিগ্বিজয় রায় কাঁদে।
মনি হায়দারের উপন্যাস ‘কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা’ [প্রথম পর্ব]
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ উপন্যাস কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা মনি হায়দার