Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নবজাগরণে অদম্য ইসমাইল হোসেন সিরাজী


২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৩৩

সমাজে কেউ কেউ দেশ ও দশের সেবা করাকে এক জীবনের প্রধান ব্রত বলেই যাপন করেন জীবন। তার জন্য বিশেষত প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে গড়ে তোলেন তিলে তিলে ভালবাসার নিবিড় সম্পর্ক। কাঠখড় পুড়িয়ে সোনার জীবন বিলিয়ে দেন বেলা অবেলায়। লিখেন বলেন আলোচনা করেন সমাজের সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। ভেতর বাইর নাড়িয়ে দেন সামাজিক মুক্তির জন্য। তেমনি একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহ্যবোধের কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
তিনি লেখালেখি ছাড়াও প্রধানত গ্রাম বাংলার সভা-সমিতিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। হাজার হাজার মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। তার মননশীল মেধা, ধীশক্তি ও গৈরিক নিঃস্রাবের মতো অনলবর্ষী বক্তৃতায় ঘুমন্ত মুসলমান ঘুমের ঘোর কেটে, ফিরে পায় আত্মপরিচয়। জাতির মনোভাব সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা করেন। দরদী মনে সমাজের উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন এবং জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বহুমূখী কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক জীবন যাপন করেছেন।
১৯০৬ সালে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় সিরাজীর নিজের কয়েকটি উদ্দীপনামূলক কবিতা পড়েন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক মুনশী মেহেরুল্লাহ। তার পঠিত কবিতাগুলো শুনে মুগ্ধ হন উপস্থিত সকলে। পঠিত কবিতাসহ আরও কিছু নতুন কবিতা নিয়ে অনলপ্রবাহ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন মুনশী মেহেরুল্লাহ। বিষয়বস্তু ও প্রতিবাদের ভাষায় ব্রিটিশ সরকার সাথে সাথে বইটি বাজেয়াপ্ত করে এবং কবিকে গ্রেফতার করে। বাংলা সাহিত্যে অনলপ্রবাহ সর্বপ্রথম বাজেয়াপ্ত কাব্যগ্রন্থ। দু বছর কারা-অন্তরীণ থাকেন। কবি যখন মুক্ত হন তখন তুরস্কে চলছে ব্যাপক যুদ্ধ। সিরাজী তুরস্কে চলে যান দেশটিকে সাহায্য করার জন্য। যুদ্ধে অসীম সাহস আর নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তুরস্ক সরকার কর্তৃক গাজী উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯১৩ সালে দেশে ফিরে সারাদেশ ঘুরে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দেন। ব্রিটিশ সরকার প্রায় ৮২ বার তার সভা পণ্ড করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তার পরও সিরাজীর আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয় মানুষ। সারা দেশে গড়ে উঠতে থাকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, পাঠাগার ইত্যাদিসহ সামাজিক মুক্তির সংগঠন।
তিনি কলমপেশাকে পরবর্তী সময়ে জীবনের প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। যা ভাবাও সে সময় যেত না। তার বাস্তবতায় অনলপ্রবাহ নামক কাব্যই সংগ্রামের প্রধান কীর্তিস্তম্ভ। এই কাব্যে তিনি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারত সঙ্গীত নামক গাঁথার ছন্দে যে অনলবর্ষী ছন্দ সৃষ্টি করেন, তা ইংরেজ কামানের গোলাবর্ষণ থেকেও ফলদায়ক হয়ে উঠেছিল। তাই বাধ্য হয়েই এই অনলপ্রবাহ কাব্য ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তিনিই প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে কারাদণ্ডভোগকারী উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যিক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মিথ্যা অপপ্রচার করত তখন হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা। বিশেষ করে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখায় সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী এ সমস্ত কুৎসিৎ লেখার জবাব দিতে গিয়ে উপন্যাসও রচনা করেন। তার উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে তারাবাই, ফিরোজা বেগম, নুরুদ্দীন, রায়নন্দিনী ও বঙ্কিম দুহিতা। না, জবাব দিতে গিয়ে সিরাজী প্রতিআক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেছে নেননি। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসে তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রায় নন্দিনী।
ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সমাজসংস্কারক সিরাজী লেখায় বক্তৃতায় নানাভাবে মানুষকে সজাগ করতেন, আত্মসচেতনতায় নানাভাবে উদযোগ নিয়েছেন। তার আহ্বানের নমুনা :
আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভূ নাম স্মরণ করি।

বিজ্ঞাপন

খ.
সিরাজগঞ্জে ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রধানত বক্তা হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন।
বক্তৃতা করতেন তৎকালীন বাঙালি মুসলমানদের পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিজ্ঞান-সাধনা, মাতৃভাষা চর্চা, নারী শিক্ষা বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। সিরাজী একাধারে কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, শিক্ষাব্রতী, সমাজ হিতৈষী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। মুসলিম জনগণের প্রতি তার যেমন প্রেম ছিল তারপরেও তিনি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। তার কলমের ভাষায় উদাহরণ দিতে পারি-
যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর,
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।
অদম্য এই দেশপ্রেমিকের বাবা সৈয়দ আবদুল করীম ও মা নূরজাহান বেগম। তারা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার। শিশু ইসমাইলের প্রথম সবক দেন তার মা। নূরজাহান খানম তার শিশুপুত্রকে প্রথমেই কুরআন শিক্ষা দেন। কুরআন শিক্ষা শেষে তাকে মধ্য ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করেন। কৃতিত্বের সাথে ইংরেজি বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে অগ্রসর হতে পারেননি। তাছাড়া স্বদেশের পরাধীনতা, সমগ্র মুসলিম জাহানের দুর্দশার জন্য বেদনাবোধ হতে সৃষ্টি উৎকণ্ঠাও তাকে স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে থাকতে দেয়নি।
জনশ্রুতি আছে দরিদ্র ছিলেন বটে, কিন্তু তা তার স্বল্প আয়ের জন্য নয়। তিনি দয়ার সাগর নামে পরিচিত। গ্রন্থ বিক্রয় ও বহু বক্তৃতা দিয়ে তার সে-সময় প্রচুর অর্থ উপার্জন হতো। তা বাড়িতে দরিদ্র ছাত্রের জন্য দানসত্র খুলেছিলেন। শত শত ছাত্র তার এই অর্থে লেখাপড়া করত। নারীশিক্ষার জন্যও তিনি নানান উদ্যোগ নিয়েছেন।
সে সময়ে নির্যাতিত অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও পদদলিত মুসলিম জাতির জন্য বেদনাবিধুর, এতই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে তুরস্কের উদ্দেশে রওয়ানা হন। এ যাত্রায় তিনি তুরস্কে যেতে পারেন নি ঠিক কিন্তু সেই যে মুসলিম জাহানের কল্যাণের মানসে ঘর হতে বের হলেন আর কখনই সুবোধ বালকের মতো ঘরে বসে থাকেননি। ছুটে বেড়িয়েছেন দিকবিদিক মানুষের মুক্তির সন্ধানে।
ভাষাবিজ্ঞানী এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্তার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাঙ্খা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।
আন্তরিকতায় দেখলে মিলবে উনিশ শতকে বাঙালি জাতির নবজাগরণ প্রচেষ্টায় তার প্রধান মাধ্যম ছিল সাহিত্য। শতকের প্রান্তপর্বে কবি হিসেবে তরুণ সিরাজীর আবির্ভাব ঘটেছিল। বাঙালি মুসলমানের পরাধীনতা, দুরবস্থা, অবর্ণনীয় দুর্দশা তার ভেতরে যে দুঃসহ জ্বালার সৃষ্টি করেছিল, তাই কবিতার ছন্দকে আশ্রয় করে অনল প্রবাহ উপস্থাপিত। সিরাজীর উনিশ বছর বয়সে তারুণ্যের বেপরোয়া ও উচ্ছ্বসিত আবেগ তার নিরাপস স্বাধীনতা চেতনা ও জাতীয় জাগরণের ঐকান্তিক ইচ্ছার সঙ্গে মিলে অগ্নিপ্রবাহে রূপ নেয়। বইয়ের উৎসর্গে লক্ষণীয় বিষয় যে, ‘ইসলামের গৌরবের বিজয় কেতন / হে মোর আশার দীপ নব্য যুবকগণ’।
জসিমউদ্দীন সিরাজী স্মরণে লেখেন (হোসেন মোহাম্মদ সম্পাদিত) সকালবেলা সিরাজী সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় তিনি আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, জসীম! তুমি তো কবি! কবিরা নাকি দেশের দূর-ভবিষ্যৎ দেখতে পাও। বলতে পার আমার এই আজন্ম সাধনা কি একদিন সফল হবে? আমি নিজের জন্যে সম্মান চাইনে, অর্থ সম্পদ চাইনে, আমি চাই এই ঘুমন্ত জাত আবার মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠুক। সিংহ গর্জনে হুঙ্কার দিয়ে উঠুক। আমি চাই এমনই একটি মুসলিম-সমাজ, যারা বিদ্যায়, সাহিত্যে, সাহসে, আত্মত্যাগে কারুর চাইতে পিছপা হবে না। যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু অন্ধ কুসংস্কার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। দেশের মেয়েদের পরদায় আবদ্ধ রেখে তাদের কাছ থেকে দুনিয়ার আলো-বাতাস বন্ধ করে রাখবে না স্বাধীন সজীব একটি মুসলিম জাতি। বল তো জসীম! একি আমি দেখে যেতে পারব?
আমি বলিলাম, আপনি আজীবন সাধনা করেছেন আমাদের জন্যে। আমাদের অনাগত জীবনের সাধনায় আপনার সেই স্বপ্নকে আমরা রূপ দেব। নিশ্চয় আপনার স্বপ্ন সার্থক হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ সিরাজীকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে সিরাজী রচনাবলি উপেক্ষিত। সিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। সিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সিরাজীর অনলবর্ষী বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিল ব্রিটিশ সিংহাসন। তার কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তার বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিল লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনও প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাকে কারাবন্দিই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিল।

বিজ্ঞাপন

গ.
উনিশ শতকের শেষ দুটি দশকে তৎকালীন মুসলিম পরিচালিত ও সম্পাদিত পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সেকালের বাঙালি মুসলিম লেখকরা আধুনিক বাংলা মুসলিম সাহিত্যের গোড়াপত্তন করেন। তারা একদিকে যেমন ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, আদর্শকে তাদের লেখায় উপস্থাপন করতে থাকেন, অন্যদিকে বিভিন্ন সংস্কারধর্মী, উদ্দীপনাময়, জাগরণমূলক লেখার মাধ্যমে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর জাতিকে জাগিয়ে তুলতেও ব্রতী হন। এ কথা অনস্বীকার্য, বিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে জাতীয় জাগরণের যে প্রাথমিক প্রাণাবেগ দেখা যায়, তার কাজ শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শেষার্ধের এ জাগরণকামী সাহিত্যকর্মীদের হাতে।
বলতে হয়, সেদিনের জাতীয় জীবনের অন্ধকার সময়কালে তারা প্রজ্বলিত মশাল হাতে জাতিকে জেগে ওঠার পথনির্দেশনা দান করেছিলেন। আত্মস্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থই সেদিন তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। জাতি তাদের প্রদর্শিত সেই আলোর শিখা অনুসরণ করে নবজাগরণের পথে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এ পথনির্দেশক ও মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ভিত রচয়িতারা প্রকৃতপক্ষে সেদিন জাতির কাণ্ডারী হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এমন কীর্তিমান পুরুষদের অন্যতম ছিলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। কথাগুলো বলেছিলেন প্রাবন্ধিক হোসেন মাহমুদ।
এ ছাড়াও গবেষণায় দেখা যায় সিরাজী ছিলেন বাঙালি মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত, স্বাধীনচেতা প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি মীর মশাররফ হোসেনের পর প্রধান ঔপন্যাসিক, বিশ শতকের প্রথম দুটি দশকের সর্বপ্রধান লেখক, সমকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম বাগ্মী, পিছিয়ে পড়া মানুষের আত্মমর্যাদার দৃষ্টান্ত, সামাজিক মুক্তির চিন্তক ও সাহিত্য সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
সিরাজীর লেখা ও বক্তৃতার প্রধান বিষয় ছিল বাংলার অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলা। বাগ্মী হিসেবে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। মুসলমানদের স্বার্থের পক্ষে কথা বললেও তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, সম্পদের সুষম বণ্টনের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্দ নির্ভর করছে। গবেষকরা বলেন, শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) ও মুহম্মদ ইকবালের (১৮৭৬-১৯৩৮) প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল সিরাজীর ওপর। তাদের মতো তিনিও অনুভব করেছিলেন যে ধর্মীয় ও সেক্যুলার চিন্তার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একদিকে যেমন ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলা সম্ভব, অন্য দিকে তেমনি সম্ভব অবনতিশীল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নয়ন।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলকাতা সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরি ও ফ্রি রিডিং রুম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সভাপতির ভাষণে বলেন, সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অন্তিমে মৃত্যু তাহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।
খবর পাইলাম সিরাজী সাহেবের মৃত্যু হইয়াছে। কিছুদিন পর সিরাজী সাহেবের পুত্র আসাদুদ্দৌলার সঙ্গে আলাপ হইল। অশ্রুসিক্ত নয়নে আসাদ বলিল, বাপজানের এন্তেকালের পর আমাদের ঘরে একটি টাকাও ছিল না। বউ এর গহনা মহাজনের বাড়িতে বন্ধক দিয়ে টাকা এনে বাপজানের শেষ কার্য সমাধা করলাম।
কান্নায় বুক ফাটিয়া যায় এতবড় সিরাজগঞ্জ শহরে কি একজনও মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিল না যে, আপন ইচ্ছায় আগাইয়া আসিয়া এই কাজে আসাদকে সাহায্য করিতে পারিত। এই বিশাল মহীরুহ একদিন কত ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছেন। আর্থিক দুর্গতি যদি তাহার না থাকিত, যদি ভালমতো চিকিৎসার ব্যবস্থা হইত, তবে এই মহানকে হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচাইয়া রাখা যইত। মরাকে বাঁচাইবার জন্য যাহারা চেষ্টা করেন, তাহাদের বুঝি এমনই করিয়া তিলে তিলে নিজেকে দান করিতে হয়।
(যাদের দেখেছি : জসীমউদ্দীন)
দেশের প্রথম কোনও কবি বাগ্মীশ্রেষ্ঠের মৃত্যুর পর তুরস্কের জাতির জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুসহ বিখ্যাত ব্যক্তিরা শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। কোনও বিদ্রোহী কবির বই বাজেয়াপ্ত করার পর ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মি লয়ের তার পারিবারিক লাইব্রেরি পরিদর্শন করেনির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, সিরাজী শুধুমাত্র একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নয় একজন বিরাট পণ্ডিতও বটে। হ্যাঁ! তিনিই আমাদের সিরাজী। তিনি মোট ৩২টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার জীবদ্দশায় ছয়টি কাব্য, চারটি উপন্যাস ও কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও বাকিগুলো অপ্রকাশিত ছিল।
সর্বোপরি সন্দেহ নেই যে সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ নবজাগরণের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। যা সারাজীবন করে গেছেন। তার জনপদকে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নিজে যেমন কোনও চাকরি করার কথা কখনও ভাবেননি, তেমনি স্ব-সমাজের লোকদের জন্যও তা কামনা করেননি।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জীবনাদর্শে সব ধরনের নীচতা-হীনতা থেকে মুক্ত ছিলেন। সমাজকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি এক জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন, বৃটিশদের সঙ্গে অভিমান করা মুসলমান আধুনিক শিক্ষালাভ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করুক, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিক, তারা মনের দিক দিয়ে ও বিত্তের দিক দিয়ে ঐশ্বর্যশালী হোক। তারা এক হাতে কুরআন আরেক হাতে বিজ্ঞান নিয়ে জীবনের চলার পথে অগ্রসর হোক।

সহায়ক গ্রন্থ
১. উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা : ড. ওয়াকিল আহমদ
২. মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিক : ড. গোলাম সাকলায়েন
৩. মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য : ড. আনিসুজ্জামান
৪. সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী : হোসেন মাহমুদ
৫. দীপ্ত আলোর বন্যা: আজহারউদ্দীন খান
৬. যুক্তিবাদ ও আধুনিকতা : সৌম্যেনাথ ঠাকুর
৭. ইসমাইল হোসেন সিরাজী : মীম মিজান

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান মাহফুজ ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ নবজাগরণে অদম্য ইসমাইল হোসেন সিরাজী নিবন্ধ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর