ন্যায়পাল, কাজীর গরু গোয়ালে নেই কেন?
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৪৫
বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের পরে প্রথম যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেখানেই বিধানটি ছিল। সংবিধান প্রণয়নের ৮ বছরের মাথায় ওই বিধানের আলোকে সংসদে একটি আইনও পাস হয়। কিন্তু সেটি এখনও ‘কাজীর গরু’। অর্থাৎ কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। সেটি হচ্ছে ‘ন্যায়পাল’। সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এবং ওই বিধানের আলোকে ‘ন্যায়পাল আইন’ তৈরি করা হলেও আজ পর্যন্ত কাউকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন?
ন্যায়পাল কী?
বাংলায় ন্যায়পাল বলা হলেও এটি নেওয়া হয়েছে সুইডিশ শব্দ ‘Ombudsman’ থেকে। যার সহজ অর্থ প্রতিনিধি বা মুখপাত্র। অর্থাৎ ন্যায়পাল হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যিনি অন্যের জন্য কথা বলেন বা অন্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এমপি-চেয়ারম্যান-মেয়ররাও তো জনপ্রতিনিধি। মূলত তারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাহলে আলাদা করে এই প্রতিনিধিত্বে কী প্রয়োজন বা জনপ্রতিনিধির সঙ্গে ন্যায়পালের তফাৎ কী?
‘Ombudsman’ শব্দের ব্যাখ্যায় মার্কিন গবেষক এন্ডারসন লিখেছেন, ‘Om’ হচ্ছে সম্পর্কে (About) এবং ‘Bud’ হচ্ছে জরিমানা (Fine) আদায়কারী ব্যক্তি। তার কল্পনায় মধ্যযুগে একজন ভাইকিং মাথায় শিংযুক্ত হেলমেট পরে জরিমানা আদায়ের জন্য অপরাধীদের দরজায় করাঘাত করতেন। তখন পরিবারের কেউ দরজা খুলে চিৎকার করে বলতেন, ‘It’s the man about fie: the Ombudsman’।
গার্নারের উদ্বৃতি দিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এএসএম মাহমুদুল হক (বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা) লিখেছেন, ন্যায়পাল হচ্ছেন সংসদের এমন একজন কর্মকর্তা বা এজেন্ট যিনি নির্বাহী বিভাগকর্তৃক প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার হতে নাগরিকদের রক্ষা করেন।
ন্যায়পাল ধারণার উৎপত্তির পেছনে রয়েছে নাগরিক অধিকারকে প্রশাসনের দুর্নীতির হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনী এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দেশের আইন সঠিকভাবে পালন করছেন কি না; নাগরিকরা তাদের দ্বারা কোথাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন কি না ইত্যাদির ব্যাপারে অভিযোগ তদন্তকারী দপ্তর হিসেবে কাজ করার জন্যই ন্যায়পাল ধারণার সৃষ্টি।
মূলত আমলা ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ন্যায়পাল থাকেন স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অভিগম্য বা যার কাছে সহজে পৌঁছানো যায়। বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের তদন্ত এবং সে সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করার ক্ষমতা ন্যায়পালের ওপর অর্পিত থাকে।
ন্যায়পালের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে বেসরকারি প্রশাসন ও আদালতগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা। তাকে বেআইনি কার্যকলাপ, কর্তব্যে অবহেলা ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করতে হয়। বিশেষভাবে প্রতারণামূলক অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কার্যকলাপের প্রতি তাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। যে কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সংবিধানের বিধি বা দেশের আইন লঙ্ঘন কিংবা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ভঙ্গ করলে ন্যায়পাল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
সাধারণভাবে ন্যায়পাল পদের মূল উদ্দেশ্য হল সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের সমতা, সততা ও স্বচ্ছতা বিধান এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রশাসনের যেকোনো ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ; সরকারি কর্মকর্তারা যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নীতিবিচ্যুত না হন তার প্রতি দৃষ্টি রাখা। একটি সৎ দক্ষ কর্মপরায়ণ নির্বাহী বিভাগ গঠন করতে ন্যায়পাল বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।
ন্যায়পালের কয়েকটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। যেমন তাকে হতে হয় স্বাধীনচেতা, সাহসী, সৎ, দলনিরপেক্ষ, সরকার তথা রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং প্রশাসনিক দক্ষসম্পন্ন।
সুইডেনে প্রথম ‘Ombudsman’ প্রথা চালু হয়, যাকে সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইরাকি গবেষক ড. ইবরাহিম আল ওয়াহাবের মতে, সুইডেনের এই ন্যায়পাল পদ্ধতি গড়ে উঠেছে ইসলামি বিচার প্রথার আলোকে। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, সুইডেনে ন্যায়পাল প্রথা চালু হয়েছিল রাজা দ্বাদশ চার্লসের আমলে। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৭০৯ সালে তুরস্কে আশ্রয় নেন এবং বছরকয়েক সেখানে স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটান। এ সময় রাজা চার্লস সেখানকার কাজির বিচার পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হন। তুরস্কে প্রধান কাজি বা প্রধান বিচারপতির কাজ সরকারি কর্মকর্তা এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান (সুলতান) সরকারি কার্যাবলি সঠিকভাবে পালন করছেন কি না; ইসলামি বিধি-বিধান অনুসরণ করছেন কি না, সে বিষয়ে কঠিন নজর রাখা। কাজি মূলত রাষ্ট্রের সকল অন্যায় সিদ্ধান্ত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতেন।
রাজা চার্লস তুরস্কে অবস্থানকালে এবং রাশিয়ানদের প্রস্থানের পরে সুইডেনে ব্যাপক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনি তুরস্কের প্রধান কাজির অনুকরণে একটি অফিস খোলার ফরমান জারি করেন। এই অফিসের প্রধান কাজ ছিল সরকারি কমকর্তা ও বিচারকররা আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কি না, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা। এই অফিসটি পরবর্তীকালে ‘he office of the kings chancellor of justice’ নামে পরিচিতি পায় (মো. নজিবুর রহমান, স্পীকার ও ন্যায়পাল নৈতিকতা ও সুশাসন, পৃষ্ঠা ৩১)। তবে সুইডেনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘Ombudsman’ বা ন্যায়পালের পদ প্রথম সৃষ্টি করা হয় ১৮০৯ সালে।
ভারতসহ অন্যান্য দেশে লোকপাল
১৮০৯ সালে সুইডেনের সংবিধানে যে ‘Ombudsman’ বা ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা হয়, সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের আরও অনেক দেশ ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম কোনো পদ না থাকলেও ব্রিটেনে সংসদীয় কমিশনার নামে ন্যায়পালের মতো একটি পদ রয়েছে। সুইডেনে ন্যায়পালের পদ সৃষ্টির ১০ বছর পরে ১৯১৯ সালে ফিনল্যান্ড, ১৯৫৫ সালে ডেনমার্ক, ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ড, ১৯৬৩ সালে নরওয়ে, ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এমনকি ১৯৮২ সালে পাকিস্তানেও ‘ওয়াকাফি মহতাসিব’ নামে ন্যায়পালের মতো একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। ভারতে ‘লোকপাল’ নামে সমমর্যাদার একটি পদ সৃষ্টি করা হয় ২০১৯ সালে।
মূলত দুর্নীতিরোধ আন্দোলনকে পূর্ণতা দেওয়ার চিন্তা থেকে ভারতে লোকপাল পদ সৃষ্টি করা হয় এবং প্রথম লোকপাল হিসেবে শপথ নেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ। ভারতীয় সংসদের উভয়কক্ষের বর্তমান ও সাবেক সদস্য এবং বর্তমান ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করার অধিকার রয়েছে লোকপালের। ভারতে লোকপালের মোট সদস্য সংখ্যা ৮। তাদের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে চারজন বিচার বিভাগীয় সদস্য। ভারতে লোকপালের মেয়াদ পাঁচ বছর অথবা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১১ সালে দুর্নীতি দূর করার দাবিতে তিনি দিল্লিতে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে। সেই অহিংস আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেই সময়কার কেন্দ্রীয় সরকারকে। দাবি ছিল একটাই। দুর্নীতি দূর করতে সরকারকে জন লোকপাল আইন আনতে হবে। সেই আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্তরে নিয়োগ করতে হবে লোকপাল। এরপর ২০১৩ সালে ভারতীয় সংসদে ‘লোকপাল’ ও ‘লোকায়ুক্ত বিল’ পাস হয়। পরের বছর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি সেই বিলে সই করে তা আইনে রূপান্তর করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি (প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৯)।
সংসদীয় কমিটি, উচ্চ আদালত, দুদক বনাম ন্যায়পাল
অনেক সময় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে ন্যায়পালের মিল পাওয়া যায়। কেননা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোরও সরকার তথা নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষমতা রয়েছে। যদিও কমিটিগুলো সেই কাজ কতটা করে বা করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এর প্রধান কারণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য পদে সংসদ সদস্যরাই থাকেন। একাডেমিক্যালি যা-ই বলা হোক না কেন, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা যেহেতু সরকার তথা নির্বাহী বিভাগেরও অংশ, ফলে ওই অর্থে সরকারের কাজকর্মকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
ন্যায়পালের কাজের সঙ্গে উচ্চ আদালতের কাজেরও কিছুটা মিল পাওয়া যায়। যেমন জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে অধস্তন আদালত বা সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু করতে না পারলে বা না করলে কিংবা সরকার নিজেই কোনো গণবিরোধী কাজ করলে বা প্রশ্রয় দিলে উচ্চ আদালতে গিয়ে সেটিকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে, নদী ও পরিবেশ রক্ষা; ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো অনেক ঘটনাই উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তারপরও ন্যায়পালের সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা রয়েছে যা এ সম্পর্কিত আইনেও বলা আছে।
ভারতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাস হয় লোকপাল বিল যেটি মূলত ন্যায়পালেরই অনুরূপ। বাংলাদেশেও দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আলাদা করে ন্যায়পালের প্রয়োজন আছে কি না? উত্তর হল, দুদকের এখতিয়ার ও কার্যপরিধি সীমিত। সবক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতা করতে পারে না বা সব সমস্যা নিয়ে কাজ করতে পারে না।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার সময় দেশের স্বার্থে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করা দুদক তাদের সুপারিশে বলেছিল, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও ন্যায়পাল নিয়োগ না হওয়ার বিষয়টা দুদকের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে ন্যায়পাল
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেখানেই ন্যায়পালের বিধান রাখা হয়। খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়, সেখানে ১৯৭২ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় পরিষদ সদস্য খোন্দকার আবদুল হাফিজ (যশোর-৭) বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি নতুন ব্যবস্থা। আমাদের ধারণা, এই ন্যায়পাল সৃষ্টির দ্বারা আগামিতে পার্লামেন্ট হাউজের যারা সদস্য হয়ে আসবেন, তারা দেশের সংবিধানের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। ’ (গণপরিষদ বিতর্ক, মো. আবদুল হালিম, পৃষ্ঠা ১৬৭)।
প্রসঙ্গত, খসড়া সংবিধান বা সংবিধান বিলের উপরে গণপরিষদে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হলেও ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল ইস্যুতে কোনো সংশোধনী ছিল না। অর্থাৎ বিধানটি যেভাবে খসড়ায় ছিল, সেভাবেই পাস হয়েছে। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
(১) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।
(২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যে কোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।
(৩) ন্যায়পাল তাহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং এই অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।
কিন্তু বাস্তবতা হল, এরপরে অর্ধশতাব্দী চলে গেলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় ন্যায়পাল পদ সৃষ্টি করা হয়নি বা এই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ন্যায়পাল আইন
১৯৮০ সালে ন্যায়পাল আইন পাস হয়েছিল। যেখানে বলা হয়- মন্ত্রণালয়, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা অথবা সরকারি কর্মকর্তার বিষয়ে ন্যায়পালের কাছে অভিযোগ জানানো যাবে। অভিযোগ ছাড়াও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ন্যায়পাল তদন্ত করতে পারবেন। পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে ন্যায়পাল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন। তদন্তের জন্য ন্যায়পাল যে কোনো স্থানে প্রবেশ এবং নথিপত্র জব্দ করার অধিকার রাখেন। দায়িত্বপালনে বাধাদানকারীকে তিন মাসের জেল অথবা জরিমানা করার ক্ষমতা ন্যায়পালের থাকবে। তদন্তের পর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ন্যায়পাল উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করবেন। কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, কতদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে তা প্রতিবেদনে উল্লিখিত থাকবে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত সময়সীমা পার হওয়ার এক মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ন্যায়পাল সন্তুষ্ট হলে বিষয়টির সেখানেই ইতি ঘটবে। আর সন্তুষ্ট না হলে রাষ্ট্রপতির কাছে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠাতে পারবেন। আইনে বলা হয়েছে, কোনো কাজের জন্য ন্যায়পালের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না এবং ন্যায়পালের সিদ্ধান্ত, প্রতিবেদন অথবা কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
কিন্তু আইনপাসের দুই দশকেও এটি কার্যকর না হওয়ায় ২০০১ সালে মতামতের জন্য আইনটিকে আইন কমিশনে পাঠানো হয়। আইন কমিশন পর্যালোচনা করে কিছু মতামত দেয়, যা এরকম-
১. ন্যায়পাল আইনে মন্ত্রণালয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তাদের এখতিয়ার নেই। যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রী, মহা হিসাবনিরীক্ষক কিংবা সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তার তদন্ত করার এখতিয়ার ন্যায়পালের নেই।
২. স্থানীয় সরকারের কোনো কার্যাবলির বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার এখতিয়ার ন্যায়পালের নেই। অথচ সকল গণতান্ত্রিক দেশে ন্যায়পালের এই এখতিয়ার রয়েছে।
৩. ন্যায়পাল আইনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের তথ্য গোপন করার অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও অজুহাত দিয়ে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কাজগপত্র কিংবা তথ্য সরবরাহ স্থগিত রাখতে পারে। সুতরাং এ অবস্থায় ন্যায়পালের পক্ষে সুষ্ঠু ও তদন্ত করা অসম্ভব।
৪. ন্যায়পাল আইনের অধীনে ন্যায়পালকে অর্থ ব্যয় করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়সহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। সুতরাং ন্যায়পালের বাস্তব অর্থে কোনো স্বাধীনতা থাকবে না।
৫. এই আইনের বলে সরকার যে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কার্যাবলিকে ন্যায়পালের এখতিয়ারের বাইরে রাখতে পারবে।
৬. ন্যায়পালের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। জনসাধারণের সম্পত্তি বেদখল হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করার ক্ষমতাও তার নেই।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ন্যায়পাল পদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের জুনে প্রস্তাবও তৈরি করা হয়। ন্যায়পাল ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস খরচ, গাড়ি ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয়সংবলিত আর্থিক প্রস্তাব পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ন্যায়পালের দপ্তরের জন্য ১২৭টি পদের প্রস্তাব করা হয়। অর্থ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ৩৫টি পদ অনুমোদন করে। কিন্তু সংসদ সচিবালয় দীর্ঘ ছয় মাস ফাইলটি আটকে রাখার পর আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব নোটে উল্লেখ করেন, ‘উল্লিখিত আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত কোনো বিবৃতি নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নেই। এমনকি মন্ত্রীর স্বাক্ষরও নেই। অতএব ফাইলটি ফেরত পাঠানো হল।’ এরপর আর ন্যায়পাল নিয়োগ- সংক্রান্ত কার্যক্রম আর এগোয়নি।
কেন ন্যায়পাল ইস্যুতে সরকার নির্লিপ্ত
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির জন্য একটি আইন করা হলেও এটি মূলত আইওয়াশ। এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলে কোনো ন্যায়পালের পক্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে না। বরং এই আইন ন্যায়পালকে ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারে পরিণত করবে। সেই হিসাবে দুর্বল গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। অর্থাৎ এখন যে ন্যায়পাল নেই, সেটিই ভালো। কারণ যে আইন করা হয়েছে, সেই আইনের প্রয়োগ করে ন্যায়পাল আদতে কোনো ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারবে না। অতএব, ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির আগে এই আইন বাতিল বা সংশোধন করে সুইডেন, নরওয়ে এমনকি ভারতের আদলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ যে কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে। ন্যায়পাল যদি স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে না পারেন, তাহলে এরকম একটি পদসৃষ্টির কোনো মানে নেই।
আইনজীবী শাহদীন মালিকের ভাষায়, ন্যায়পালের কাজ হল নির্বাহী বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না সেটা তদারকি করা। কিন্তু আমাদের দেশের আমলারা এত শক্তিশালী যে, তারা নিজেদের ওপর কারও খবরদারি সহ্য করেন না। আর এ কারণেই গত প্রায় ৫০ বছরেও ন্যায়পাল নিয়োগে উদ্যোগ নেয়নি সরকার। তিনি বলেন, বিষয়টি যেহেতু সময় দিয়ে বাধ্যতামূলক হয়নি তাই এই সুযোগ সরকার নিচ্ছে। আর আমলাতন্ত্রের দাপটের কারণে সরকার এই উদ্যোগ নেবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগও তো স্বাধীন হওয়ার কথা, সেটা তো হয়নি (কালের কণ্ঠ, ৩ জুলাই, ২০১৬)।
সবচেয়ে বড় কথা, এখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হতে গেলেও তাকে যেরকম দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, সেখানে ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য একজন দলনিরপেক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া যাবে কি না বা কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে এই পদে বসানো হবে কি না- সেটিও বিরাট প্রশ্ন। ধারণা করা হয়, এ যাবৎ যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের দ্বারা সম্পাদিত অনিয়মগুলো যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য কেউই এই আইনকে কার্যকর করতে আন্তরিক হয়নি বা একটি আধুনিক ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করে সেই আলোকে একজন সত্যিকারের ন্যায়পাল নিয়োগ করেনি। কারণ সরকারের কার্যক্রমে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আসুক, সম্ভবত এটি কোনো সরকারই চায় না।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমীন আল রশীদ ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ নিবন্ধ ন্যায়পাল- কাজীর গরু গোয়ালে নেই কেন?