অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর দর্শনই রক্ষাকবচ
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৫১
বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পূর্ণ করেছে। এই সময়কালে বাংলাদেশের অনেক ভালো অর্জন আছে, তার মধ্যে কিছু অপূর্ণতাও রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-শিশুর মৃত্যুহার হ্রাস, সব শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, দেশকে ডিজিটালে রূপান্তর, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, এমন কি বৈশ্বিক মহামারী নিয়ন্ত্রনসহ অনেকক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বিশ্বের রোলমডেল। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে কিছুটা হলেও আমাদের বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে।
মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। অথচ উগ্রপন্থী মৌলবাদীরা মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে তার ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র দিয়ে বিবেচনা করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে। এটি এমন একটি সংস্কৃতি, যা মানুষকে পশুতে পরিনত করে। ভিন্নমত ও পথের মানুষদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের জন্ম দেয়। অথচ প্রতিটি ধর্মের মর্মকথা হচ্ছে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি।
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস নতুন নয়। মূলত ইংরেজরা তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। সেই বিভাজন থেকে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। উনিশশতকের শুরু থেকে বিছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িকতা শুরু হয়েছে। কিন্তু ১৯৪০ সালের পর হিন্দু -মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ রাজনৈতিক দাঙ্গায় পরিনত হয়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় তার রেশ বিহার, পাঞ্জাব ও পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীসহ অনেক জায়গায় ভয়াবহ রূপ নেয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, ইংরেজরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। যার কারণে ১৯৪৭ সালের আগস্টে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হলেও পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার রেশ তখনও চলতে থাকে। ১৯৪৮, ১৯৫০, ১৯৫৮ এবং ১৯৬৪ সালে দাঙ্গায় পূর্ব বাংলাকে বিপর্যস্ত করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রত্যক্ষ মদতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন হামলার শিকার হয়। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় একটি মিথ্যা সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার কারনে ঘটনার সূত্রপাত হয়। ওই খবরে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের হযরত বাল মসজিদে সংরক্ষিত হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর চুল চুরি হয়েছে এমন মিথ্যা গুজব রটানো হয়। যার কারনে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের উপর নেমে আসে তীব্র নির্যাতন। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান হামলা প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে নেতৃত্ব দেন এবং অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন শ্রেনী পেশার গুনীজনদের সমন্বয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘বেসরকারী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে আহবায়ক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, খাজা খায়ের উদ্দিন, ডক্টর আলি নূর রাজি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, বেগম রোকেয়া আনোয়ার ও বেগম সুফিয়া কামালকে সদস্য করা হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ১৭ জানয়ারি ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা বিরোধী গনজাগরণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে। যার কারনেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পরাজিত করেই ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিজয়ী হয়। জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১২ জানয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েই জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতীয় চার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন। তখনকার সময়ে বাংলাদেশের মতো সদ্যস্বাধীন মুসলিমপ্রধান একটি দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতানীতি বাস্তবায়নের জন্য সংযুক্ত করা হয়েছে- (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা; (খ) রাষ্ট্রকর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান; (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার;(ঘ) কোনও বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির উপর প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। … মুসলমানরা তাদের ধর্মপালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্মপালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্মপালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মপালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় চরিত্র থাকতে পারে না। যে যার মত করে ধর্ম পালন করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই হল প্রত্যেকেই তার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। এজন্যই বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্ভূক্ত করে সব ধর্মের মানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করেছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হৃদয় দিয়ে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এ বিষয়ে তিনি কোনো প্রকার কম্প্রোমাইজ করেন নি। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে সৌদি বাদশা ফয়সালের সাথে সাক্ষাৎকালে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের হজ পালনের অনুমতির জন্য অনুরোধ করেন। বাদশা ফয়সাল শর্ত জুড়ে দেন, তাহলে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং বলেন বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম দেশ হলেও প্রায় এক কোটি অমুসলিম নাগরিক আছে। সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে আপনার প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। সৌদি আরবও যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয় সেটিও তাকে স্মরণ করিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার ঘোষণা করেন, তখন মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল একমাত্র তুরস্ক। বাংলাদেশ দ্বিতীয়। তুরস্ক আজ আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নেই। ২০০২ সালে এরদোগানের ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে অসাম্প্রদায়িকতার পথ থেকে সরে গিয়েছে। আলজেরিয়া ও মিশর মুসলিমপ্রধান দুটি রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও তারা সফল হতে পারে নি। আলজেরিয়ায় সেনা নির্ভরতা ছিল বলে ধর্মনিরপেক্ষতা টিকেনি। অন্যদিকে মিশরে উগ্র ইসলামী মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুডের কারনে বারবার ধর্মনিরপেক্ষতা হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা অন্যান্য দেশগুলো থেকে ভিন্ন। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে ধর্মভিক্তিক রাজনীতিকে পরাজিত করেই অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। পাকিস্তানপন্থীদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। বাংলাদেশের যতটা ক্ষতি হয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছে দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। অবৈধভাবে ক্ষমতা নিয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমেই সংবিধানের উপর কাঁচি চালান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেন। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেন এবং ৩৮ ধারায় যেখানে রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে বলা ছিল, সকল নাগরিকের সংগঠন করবার অধিকার থাকবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক কোনওও সংগঠন বা কোনওও ধর্মভিত্তিক কোনওও সংগঠন করবার অধিকার থাকবে না। এই দুইটি ধারা বাতিল করে একদিকে যেমন পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা হয়, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। আরেক সামরিক শাসক এরশাদ ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকিয়ে দেন। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান অন্তর্ভূক্ত করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। অথচ রাষ্ট্রের কোনওও ধর্ম থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এ গর্হিত কাজটি করা হয়। বাংলাদেশের হৃদয়ে একটি স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেয়। যার কুফল ভোগ করছে এদেশের জনগন।
২.
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রতিককালেও ঘটছে। বিগত কয়েকদশক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশ মূলত দুটো কারনে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়- (১) রাজনৈতিক কারণে, যেখানে যেখানে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, দেশে অশান্তি তৈরি করা, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা বা (২) স্থানীয় পর্যায়ে সম্পত্তি বা ধনসম্পদ দখল করা।
১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার খবরে বাংলাদেশে ঘটে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটে। যা একটানা ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর প্রায় সারাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কল্পনাতীত ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে। শুধুমাত্র ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সহিংসতার যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তার সংখ্যা ৩ হাজার ৬২৫টি। আরও তো শত শত ঘটনা সামনেই আসেনি। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে ৩৫৫টি। এছাড়া অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, গনধর্ষণ, লুটপাট, চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ গুলো রয়েছে। এসব ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ভিকটিম থানা কিংবা আদালতে মামলা করতে পারেনি। আবার কেউ অভিযোগ করলেও রাজনৈতিক কারনে তার তদন্ত হয়নি। জোট সরকারের পুরো পাঁচ বছরই এভাবে সংখ্যালঘুদের উপর রাষ্ট্রীয় মদতে হামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশে গত তিনদশকে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে যে দলই জিতুক না কেন প্রতিটি নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। সংখ্যালঘুদের কাছে নির্বাচন মানেই নির্যাতনে পরিনত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়কালেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বিগত দিনে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে রাষ্ট্রীয় মদতে আর বর্তমান সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে সরকারকে বিব্রত করতে কিংবা বিপদে ফেলতে। সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তখন বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করতে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে দেশে অশান্তি তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবির দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর ব্যাপক সহিংসতা চালায়। প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পর কম-বেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
২০১২ সাল থেকে মৌলবাদীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুককে ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর নতুন কৌশল নিয়েছে। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে রামু, উখিয়া, টেকনাফ, পাবনা, দিনাজপুর, কুমিল্লা, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ভোলার বোরহানউদ্দিনসহ অসংখ্য জায়গায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলো যে পরিকল্পিত সেটা দিবালোকের মত স্পষ্ট ছিল। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে রসরাজের পোষ্টকে ঘিরে গুজব ছড়ানো হয়েছিল, আসলে সেই রসরাজের ফেসবুক সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। সে ছিল পেশায় একজন জেলে। অনুরূপভাবে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় টিটু রায় নামে যাকে অভিযুক্ত করে হামলা করা হয় পুলিশি তদন্তে দেখা যায়, সে ফেসবুক পোষ্ট তো দূরের কথা পড়ালেখাই জানে না। টিটুকে ফাঁসানোর জন্য আরেকজন তার ছবি দিয়ে আইডি খুলে ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করে পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়। কুমিল্লা পূজামন্ডপে কোরআন শরীফ রেখে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করা হয়েছে। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে সেটা একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকই করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে একযোগে হামলা করা এটি মৌলবাদীদের আধুনিক সংস্করণ। পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু একজনের নামে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দাও, মাইকিং করে ঘোষণা দাও, একযোগে হামলা কর। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে অসংখ্য বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ। অতিসম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডল, চট্টগ্রামের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া ও নওগাঁর সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পাল, নড়াইলে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকদের হেনেস্তা করতে যেভাবে ধর্মকে ঢাল করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের। বিষয়টিতে নজর না দিলে শিক্ষা ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়তে পারে।
৩.
একসময় ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্যে স্লোগান হত ‘আমরা হব আফগান, বাংলা হবে তালেবান’। ১৯৯৯ সালে ৭ মার্চ যশোরে উদীচি শিল্পগোষ্ঠীর উপর বোমা হামলা করে ১০ জনকে হত্যার মধ্যদিয়ে জঙ্গী গোষ্ঠী তাদের উত্থানের জানান দেয়। এরপর ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখাসহ আরও অনেক হামলা করে তাদের শক্তি সম্পর্কে জানান দিয়েছে। আর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তো সারা বাংলাদেশে জঙ্গীদের অভয়ারন্যে পরিনত হয়েছিল। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বোরচিত গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা করাসহ অসংখ্য হামলা করে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় উপাসনালয়, এমন কি ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী নিরাপরাধ মানুষও তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি। পুরো উত্তরবঙ্গে সরকারের সমান্তরাল আলাদা শাসন চালু করেছিল।
বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারনে জঙ্গীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশ যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছে সেটাও বিশ্বে রোলমডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের কঠোর মনোভাবে জঙ্গিবাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পুরোপুরি চলে গেছে সেটা বলা যাবে না। এখন অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিষাক্ত বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা বিয়ে একশ্রেনীর তরুনদেরকে বিভ্রান্ত করে তাদের পথে টানার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
৪.
সাম্প্রদায়িক গোষ্টী মৌলবাদীরা শুধুমাত্র সংখ্যালঘু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। তারা জাতির পিতার প্রতিও আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করছে না। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রাজধানীর ধোলাইখালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করার পরিকল্পনা করলে, সেটি গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে বলে প্রকাশ্যে হুমকি দেয় মৌলবাদীগোষ্ঠী। কুষ্টিয়ায় তো রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেও ফেলেছে। অতীতেও ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে বার বার ভাস্কর্যের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের শাসনামালে কার্ফুর মধ্যে ঢাকার জিপিওর সামনে স্থাপিত বর্ষা নিক্ষেপের ভাস্কর্যটি রাতের অন্ধকারে সকলের অগোচরে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে রাজধানীর বলাকা ভবনের সামনের রাস্তায় ‘বলাকা’ ভাস্কর্যে হামলা চালায় ওলামা আঞ্জুমানে আল বাইন্যাত নামের উগ্রবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। একই বছর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোল চত্বরে ‘বাউল’ ভাস্কর্যে হামলা চালায় মৌলবাদীগোষ্ঠী। চোখের পলকে হারিয়ে গেছে শিশু একাডেমিতে স্থাপিত ‘দুরন্ত’ শিশু ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অমর সৃষ্টি অপরাজেয় বাংলা ও রাজু ভাস্কর্যে হামলা হয়েছে অনেকবার। এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদীগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ধর্মের প্রতি আক্রমণের অংশ হিসেবে অসংখ্য হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি, মন্দির, বৌদ্ধমূর্তি ভেঙেছে। তাদের এই আস্ফালন একদিনে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র তাদের সাথে সমঝোতা করেছে বলেই তারা এতবড় দুঃসাহস দেখানোর ধৃষ্টতা পাচ্ছে।
৫.
বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা ও ইংরেজী মাধ্যম এই তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। এর মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা ও ইংরেজী মাধ্যমগুলোতে সরকারের যথেষ্ট মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। সেখানে জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয় না, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে। একটি শিশু যদি শৈশব থেকে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে না জানে তাহলে ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে দেশপ্রেম আশা করা যায় না। এর জন্য অন্ততপক্ষে প্রাথমিক স্তরে হলেও একমূখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা দরকার। একটি শিশুর মাইন্ড সেটআপ অনেক বড় বিষয়। প্রাথমিক স্তর থেকে যদি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়সমুহ জানতে পারে তাহলে পরবর্তীতে তাদের উগ্রপন্থী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। ছোট থেকেই শিশুদের মাঝে সম্প্রীতির শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই দীর্ঘমেয়াদে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন করা যাবে। প্রতিটি ধর্মেই সম্প্রীতির কথা বলা হয়েছে। নিজ ধর্মকে লালন, অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধার কথা বলা হয়েছে। সব ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানোই অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা।
৬.
আজকের বাংলাদেশের লড়াইটা হচ্ছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা এখনও বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারে না। যে কোনও মূল্যেই পরাজিত করতে চায়। এদের মূলোৎপাটনে একাত্তরের মতো আরেকবার জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধুমাত্র প্রশাসনিকভাবে এদের পরাজিত করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্যই হবে ধর্মান্ধ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লড়াই।
বঙ্গবন্ধুর দর্শনই বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। তিনি যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন এখনও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আমাদের শক্তির জায়গা হল বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি তার পিতার মতোই অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ ও লালন করেন। স্পষ্টভাবেই অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কথা বলেন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি অনেক অসাধ্য কাজ সম্পাদন করেছেন। আমরা সকলেই বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তারই সুযোগ্য কন্যার হাতেই সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন হবে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ তাপস হালদার নিবন্ধ