মন দিয়েছি যে চরণে
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৫৪
বৃষ্টি থেমে গেছে।
সাজিদা বানু ঘরের বাইরে পা রাখল। বারান্দায় থাকতেই শাড়ির আঁচলটা মাথায় আরও একটু টেনে দিল সে। সতর্ক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে ঘরের পেছনের খালপাড়ের দিকে এগুতে লাগল। পায়ে থাকা পুরনো স্যান্ডেলজোড়া কাদামাটিতে আটকে যাচ্ছে। খুব ধীরপায়ে এগুতে হচ্ছে ওকে। পা পিছলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কোমরে আঘাত পেলে ওকে কে দেখবে। বয়স্ক শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই ঘরে।
তিনদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। উঠানের মাটি পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। ঘরের পেছনের নিচু জমির অবস্থা আরও খারাপ। পানি জমে রয়েছে। আইলের দুর্বাঘাসের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটছে ছোট ছোট কেঁচো আর নানা জাতের ছোটবড় পোকা। পাতিহাঁসগুলোর খোঁজ নিতে না বেরিয়ে উপায় নেই।
ধীর পায়ে এগুনোর সময় একটা কেঁচো সাজিদা বানুর পায়ের পাতায় উঠে গেল। শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে কোনওরকমে খালপাড় পর্যন্ত এগিয়ে গেল সে। পা পানিতে ডুবিয়ে সজোরে নাড়া দিল। কেঁচোটা নামেনি। একবার, দুবার, তিন বার- ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সাজিদা। কেঁচোটা পায়ে রয়েই গেল। এবার হাঁটুর দিকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। হাত দিয়ে কেঁচো সরাতে গিয়ে শাড়িটা সামান্য তুলে ধরতে হলো। সাজিদার ধবধবে ফর্সা পায়ে লালচে কেঁচোটাকে দেখতে ওর নিজের চোখেই অদ্ভূত লাগছিল। কেঁচোটা বাম হাত দিয়ে সরাতে একটু ঘেন্না কাজ করছিল বৈকি। তবুও আনমনে হেসে উঠল সে- হায় রূপ, হায় যৌবন!
সাজিদা ১৩ বছরে বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার পর কেটে গেছে আরও ১৯ বছর। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিজে শাশুড়ি হয়ে গেলেও তেত্রিশের সাজিদা এখনও যে কোনও পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো রূপবতী। বিদেশ পাগল স্বামীর কারণে একা থাকতে হলেও কোনও কলঙ্ক ছুঁতে পারেনি ওকে। শাশুড়িকে নিয়ে মোটামুটি কেটে যাচ্ছে দিন। নিজের মায়ের মৃত্যু হয়েছে আটমাস হতে চলল। এখন এই শাশুড়িই তার সব। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে দূরের দুটি গ্রামে। খালি বাড়ির কথা চিন্তা করে কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের। এক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ছোটবেলায়ই, পানিতে ডুবে। একমাত্র ছেলেও মালয়েশিয়ায় চলে গেল মাস দুয়েক হলো, বাপের মতোই প্রবাসী সে।
সাজিদার স্বামী নূর মিয়া থাকে সৌদি আরবে, নির্মাণ শ্রমিক। কোনও কোনও প্রজেক্টে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করে এখন। বিয়ের দেড় বছর পর যে গেল, ১৮ বছর ধরে প্রবাসেই রয়েছে সাজিদার চোখে পাষাণ মানুষটি। মাঝখানে তিনবার বাড়িতে এসেছিল, প্রতিবার তিনমাস করে বেড়িয়ে গেছে। এই তিনবারে তিন মেয়ের জন্ম। ছেলের জন্ম বিয়ের প্রথম বছরেই। বিদেশে কি মজা যে পেয়েছে নূরু, সাজিদার মাথায় ধরে না। বাড়ি ফিরতে বললে ফিরতি চিঠিতে বছরের পর বছর একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে- আরও কিছু টাকা জমুক, একেবারে আইয়া পড়ুম।
হাঁসগুলো চোখে পড়ছে না। যতদূর চোখ যায় দেখার চেষ্টা করল সাজিদা। কোথাও নেই। খালের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানির তোড়। বাড়ির এক কিলোমিটার উত্তরের নদীতে গিয়ে মিশেছে খালটি। প্রশস্ত খালটির পশ্চিম পাড়ের কোনও বাড়িতে হাঁসগুলো উঠেছে কিনা কে জানে। ওই পাড়ার মানুষের সাথে এ পাড়ার মানুষের সম্পর্ক ভাল নয়। কারণে-অকারণে ঝগড়া লেগেই থাকে। এখন সে কার বাড়িতে গিয়ে হাঁস খুঁজবে? ঘরে ফিরতে দেরি করলে শাশুড়ি ডাকতে শুরু করবে- সাজদা, ও সাজদা কই গেছস লো। বুড়ির এই এক স্বভাব, কিছু সময় চোখের সামনে না দেখলেই ডাকাডাকি শুরু করবে। শান্তিতে নিজের মতো এক জায়গায় দাড়ানোর জো নাই।
শাশুড়ি শাহারা বানু ভাল মানুষ। গ্রামের আর দশটা শাশুড়ির মতো খিটখিটে মেজাজের নয়। শান্তশিষ্ট। মুখে হাসি লেগেই থাকে। সাজিদাকে আদর করে। কখনও কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, যেভাবে সাজিদার ননদীরা বেড়াতে এলে আদর করে মানুষটা।
পানের রসে সবসময় লাল হয়ে থাকা বৃদ্ধা শাশুড়ির ঠোঁটের হাসি সাজিদার খুব প্রিয়। শাশুড়ি হওয়ার আগে পাড়া সম্পর্কে চাচি হতেন তিনি। সংগ্রামের বছর সাজিদার বাবা কফিল উদ্দিন আর সফর মিয়া চাচা একইদিন মারা পড়েছিল পাঞ্জাবিদের হাতে। সেই থেকে দুঃখের অথৈ সাগরে পড়া স্বামীহারা দুই নারী; সাজিদার মা দিলবানু আর বর্তমান শাশুড়ি শাহারা বেগম একে অপরের আরও আপন হয়ে ওঠে। নিজেদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে বেয়াইন বনে যায় তারা। সাজিদা আর নূর মিয়ার মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টা তারা টের পেয়েছিল কিনা কে জানে! বেশ আনন্দ ফুর্তিতেই সাজিদাকে নূরুর বউ করে এনেছিল শাহারা বেগম।
বিয়ের দিনের মতোই এখনও সাজদা, সাজদা করে শাহারা বেগম মুখে ফেনা তোলে। যেভাবে সাজিদাকে সাজদা বলে ডাকত ওর মা। শাশুড়ি শাহারা বেগম না থাকলে এ বাড়িতে কিভাবে থাকত সে- ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে সাজিদার। প্রবাসীদের বউদের নিয়ে চারদিকে কত গল্প যে ভেসে বেড়ায়! উত্তরপাড়ার প্রবাসী তাইজুলের বউকে নিয়ে অনেকের মুখেই রসালো রটনা ঘুরছে। পশ্চিম পাড়ার কামালের বউ তো স্বর্ণের গয়নাগাটি নিয়ে চলেই গেল ভিনগাঁয়ের এক ছেলের হাত ধরে। সব প্রবাসীর বউ তো এক রকম নয়। বেশিরভাগই ভাল, ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বাভাবিক সংসার করছে। বছরের পর বছর স্বামীকে কাছে না পেয়ে কেউ একটু ভুল করলেই ছিঃ ছিঃ করে ওঠে লোকে।
গ্রামদেশে মুখরোচক খবর ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগে না। সব প্রবাসীর বউয়ের দিকেই সন্দেহ নিয়ে তাকায় বাচাল নারীরা। ওদের মুখে খেলে যায় রহস্যময় হাসি। সাজিদাকে অবশ্য এমন পরিস্থিতি পড়তে হয় না, শাশুড়ি শাহারা বেগম ওর রক্ষাকবচ।
নূর মিয়ার বাড়িতে পাড়ার একমাত্র দুতলা বিল্ডিং উঠেছে। লোকে বলে বিদেশি বাড়ি। বিল্ডিংটিতে বেশিরভাগ সময় মানুষ থাকে দুজন- তাও মেয়ে মানুষ। বিষয়টা ভেবে কখনও হাসি পায় সাজিদার। কোনও কোনও সময় কষ্টও চেপে বসে। পাড়ায় আর কোনও ছাদ দেওয়া বিল্ডিং পর্যন্ত নাই। সবই টিনের ঘর, দুয়েকটা বাড়ি আধাপাকা। পাঁচ-দশটা ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা কি দুইটা ঘরে গাদাগাদি করে বেশিরভাগ বাড়ির মানুষ। তাদের পরিবারে কত অভাব!
খালের পশ্চিম পাশের পশ্চিমপাড়ায় নজু মিয়ার মেয়ের বিয়ে আজ। খালের পাড়েই কলাগাছের গেইট বাঁধা হয়েছে। রঙিন কাগজের ঝালরে সাজানো গেইটটা দেখতে ভালই লাগছে। সাজিদার মন কেমন করে ওঠে। হায় রে বিয়া, জামাই যদি কাছেই না থাকে এমুন বিয়ার দরকার কিতা! স্বগোতক্তি করে সাজিদা।
কয়েকটি হাঁসের একটানা প্যাঁক প্যাঁক শব্দে বাস্তবে ফিরে আসতে হয় ওকে। খালের পাড় ঘেঁষে দুইবাড়ি পরে কচুক্ষেত থেকে হাঁসগুলোর ভয়ার্ত শব্দ ভেসে আসল। হয়তো কোনও বেজি বা ঢোড়া সাপ দেখে ভয় পেয়েছে। হাঁসের খোঁজ পেয়ে আয়, আয় বলে হাঁক ছাড়ে ও। মুহূর্তেই উচ্চশব্দে মাইক বাজার শব্দে ওর কন্ঠ চাপা পড়ে গেল। বরযাত্রী আসছে হয়তো। নৌকায় থাকা শ্যালোমেশিনের শব্দও বাড়ছে।
সাজিদা খালের উত্তর দিকে তাকাল। বরযাত্রীর নৌকা এগিয়ে আসছে এদিকেই। নজু মিয়ার বাড়ির দিকে আসা নৌকাটির ছইয়ে মাইক। গান বাড়িয়ে আসা বরযাত্রীরা বাজিও ফোটাচ্ছে। বর্ষাকালে বিয়েশাদির ধুম লাগে। এভাবেই মাইক বাজিয়ে আসে বিয়ের নৌকা। এখন মাইকে বাজছে শাহ আব্দুল করিমের গান-
‘প্রাণ বন্ধু আসিতে সখি গো
আর কতদিন বাকি
চাতক পাখির মতো আমি
আশায় চেয়ে থাকি।
ভালবেসে দুঃখ দেওয়া গো
সখি, ভাল হলো নাকি!
পাগল মন রে আর কতদিন
প্রবোধ দিয়ে রাখি গো।
নিবির রাতে কেউ নয় সাথে গো
আমি একা যখন থাকি
কত কথা মনে পড়ে
ঝরে দুটি আঁখি গো।
আসবে বলে আশা করে গো
সখি দিবানিশি ডাকি
করিম বলে দয়া হলে
আসবে প্রাণ পাখি।’
সাজিদা বিস্ফোরিত চোখে বিয়ের নৌকার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আনন্দের দিনে বরযাত্রীদের এমন বিরহের গান বাজতে দেখে অবাক হয় সে। অবশ্য নৌকার ছইয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কেউ কেউ নাচছে। হয়তো ক্যাসেটে একের পর এক গান বাজতে বাজতে কখন বিরহের গান শুরু হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি ফুর্তিতে থাকা বরযাত্রীরা।
হাঁসগুলো সাজিদার কাছাকাছি চলে এসেছে। কেঁচো খেতে খেতে একটা হাঁস ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। সাজিদা শিরশিরে অনুভূতিতে কেঁপে উঠল। স্বামী নূর মিয়াকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে ওর। কতদিন হলো স্বামীর পরশ পায় না সে। যাকে মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে বসে আছে সে আজ কত দূরে!
বরযাত্রীদের মাইকে নতুন গান শুরু হয়েছে-
‘ভাবিলে কি হবে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে
জাতি কুল যৌবন দিয়াছি
প্রাণ যাবে তার কাছে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে। ।
কালার সনে প্রেম করিয়া
কাল-নাগে দংশিছে
ঝাইড়া বিষ নামাইতে পারে
এমন কি কেউ আছে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে। ।
পিরিত পিরিত সবাই বলে
পিরিত যে কইরাছে
পিরিত কইরা জ্বইলা-পুইড়া
কতজন যে মরছে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে। ।
আগুনের তুলনা হয় না
প্রেম আগুনের কাছে
নিভাইলে নিভেনা আগুন
কি কইরা প্রাণ বাঁচে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে। ।
বলে বলুক লোকে মন্দ
কুলের ভয় কি আছে
আব্দুল করিম জিতে-মরা
বন্ধু পাইলে বাঁচে গো। ।’
হাঁসগুলো এবার সাজিদার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আশেপাশের সব কেঁচো খাওয়া শেষে এখন যেন সাজিদার পা খেয়ে নিতে চায়! শিরশিরে অনুভূতি বেড়ে চললেও ওর কোনও নড়াচড়া নেই ওর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিয়ের নৌকার দিকে। কলাগাছের গেইট বরাবর খালপাড়ে নৌকা ভিড়ানো। বরযাত্রীরা নেমে গেছে। মাইকের গান বন্ধ হয়নি, চলছেই।
নূরু মিয়া ততক্ষণে মরুর দেশ সৌদি আরব ছেড়ে জলকাদার বাংলাদেশে- বিয়ের নৌকার ছইয়ে। গানের তালে তালে নাচতে থাকা নুরুর দিকে তাকিয়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে সাজিদা। ঘোমটাপরা সাজিদার হাসি দেখতে এগিয়ে আছে নুরু। সাজিদা লজ্জা পাচ্ছে।
পিঠে হাত পড়ার আগ পর্যন্ত সাজিদা বুঝতেই পারল না কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিল ও। বৃদ্ধা শাশুড়ি সাহারা বেগমকে এভাবে কখনও রাগতে দেখেনি আগে। সাজদা, সাজদা বলে ডাকতে ডাকতে কাদা মারিয়ে বাড়ির পেছনে পর্যন্ত আসতে হয়েছে তাকে। রাগে শরীর কাঁপছে। কিছুটা ভয়ও পেয়েছে। সাজিদার পিঠে হাত রেখে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল- এই সাজদা, এইরহম একলা একলা হাসতাছোস কেরে? জ্বিনে ধরছে নি তোরে।
সাজিদা লজ্জিত হলো। কোনও কথা না বলে শাশুড়িকে নিয়ে ধীর পায়ে ঘরের দিকে এগুতে শুরু করল সে। পেটপুরে খেয়ে নেওয়া হাঁসগুলো নিজ থেকেই বাড়ির খোয়াড়ের দিকে এগুচ্ছে। লজ্জিত সাজিদার চোখ থেকে তখনও পুরোপুরি অদৃশ্য হয়নি নুরু। বিদেশ থেকে ফিরলে তাকে আর যেতে দেওয়া যাবে না- মনে মনে ভাবে সাজিদা। গানের কথার মতোই ওর বলতে ইচ্ছা করছে- মন দিয়েছি যেই চরণে/ প্রাণ যাবে তার সনে গো।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প মন দিয়েছি যে চরণে সাহিত্য সোহরাব শান্ত সোহরাব শান্তর গল্প 'মন দিয়েছি যে চরণে'