রুচিতে চুরি
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৫৮
পেশায় চোর। বনেদি-খান্দানি চোর। চুরি করে বংশপরম্পরায়। যার-তার ঘরে ঢোকে না। টোটকা চুরিতে গিয়ে হাত নষ্ট করে না। মোটকথা এ চোরদের একটা ক্লাস আছে। ভাব আছে। ভাবের সঙ্গে ভঙ্গিও ব্যাপক।
তাদের রাজ্যটিও আচানক। ঘটনাচক্রে এক ওস্তাদ-সাগরেদ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছান ওই আজব দেশে। দেশটিতে ভালো-মন্দ, উপর-নিচ সব কিছুর একই দাম। তেল-ঘিরও এক দর, এক রেট। আপেল-টমেটো, আঙুর-চালতাও তাই। সাগরেদ এতে যারপরনাই চমকিত-পুলকিত।
সাগরেদ যদ্দিন বাঁচে এই চোরের দেশটিতেই পাকাপোক্তভাবে থেকে যেতে চায়। ওস্তাদ তাকে বাধা দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যে দেশে সোনা-রূপার এক দাম-এমন দেশে থাকা বিপজ্জনক। কিন্তু সাগরেদ নিজ বুঝে অটল। সে প্রয়োজনে দীর্ঘদিনের এ ওস্তাদকে ছেড়ে দেবে, তবুও এমন মজার দেশ ছাড়বে না।
অবস্থা বেগতিক। ওস্তাদ মেনে নেন সাগরেদের বশ্যতা। উপায়ন্ত না দেখে শিষ্যকে রেখেই দেশটি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যাওয়ার আগে সাগরেদের হাতে একটা পাখির পালক তুলে দেন। বলেন, কখনও বিপদ হলে পালকটিতে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে তিনবার ঘষবে। এতে আমি তোমার সব খবর পেয়ে যাব। পারলে কিছু করব।
ওস্তাদকে ছাড়াই সাগরেদের দিন কাটে মহানন্দে। বাছা-বাছা খাবার খায়, মোজ–ফূর্তি তো আছেই। অল্প ক’দিনেই মোটাতাজা- তেলতেলে হয়ে ওঠে সে। দেশটিতে নানা আজব কাণ্ড ঘটে চলে। সেদিকে খবরই নাই তার। কোনো ঘটনায় আক্রান্তও হয় না সে। যা দেখে সবই ভালো লাগে। আচানক কতো কিছু এনজয় করে।
আচানক দেশটির রাজ দরবারে একদিন আচানক ফরিয়াদ নিয়ে ওই চোর সম্প্রদায়ের এক সদস্যের আগমন। চোরের বেশ শিনাজুরি।
রাজার কাছে তার ফরিয়াদ: হুজুর আমরা বংশ পরম্পরায় সাত পুরুষ ধরে চোর। নানান বাধা ও কষ্টের মাঝেও চুরি পেশাটাকে টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু, আমাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও নিরাপত্তা নেই।
সবিস্তারে তার অভিযোগ জানতে চান রাজা।
বর্ণনায় চোর জানায়, গতরাতে এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে তার একজন সম্মানিত চোরের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। পা কেটে গেছে। বাড়ির মালিক খামাখাই বালিশের পাশে ধারালো ছুরি রেখে ঘুমিয়েছিল। এতে তার চোর সদস্যটির ওই বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ ছুরিতে পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এতে রাজ্যের চোরমহল ভীষণ মাইন্ড করেছে। এরকম ঝুঁকি নিয়ে তারা আর এ পেশায় থাকতে চাইছে না। এতে ঐতিহ্যবাহী চুরি পেশাটি ওই রাজ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
আপনি এর একটা বিহিত না করলে আমার করার কিছু থাকবে না মহারাজ! চোরের সাফ কথা।
মহামান্য রাজা চোরের আল্টিমেটামে বিচলিত। বিষয়টিকে যারপরনাইনাই গুরুত্বের সঙ্গে নেন তিনি। পারিষদকে নিয়ে বসেন হাই-প্রোফাইল বৈঠকে। জানিয়ে দেন চোরদের নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্সের কথা। সিদ্ধান্ত দেন খতিয়ে দেখা হবে বিষয়টি। দোষী যে-ই হোক তার কোনো ছাড় নেই। নিয়ে আসা হবে বিচারের আওতায়। দায়ীকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে। শুরু হয় অ্যাকশন, অভিযান। ধরে নিয়ে আসা হলো চুরিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা সেই বাড়িঅলাকে। জানতে চাওয়া হয়- কেন তার ছুরিটি এতো ধারালো?
বাড়িঅলা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। চোরের জখম হওয়ায় তার কোনো হাত ছিল না বলে জানায়। সরল বিশ্বাসে তিনি ছুরিটা রেখেছিলেন। দোষ যতোটুকু তা কামারের। ওই ব্যাটায় ছুরিটাকে এতো ধারালো করেছে যা তার জানা ছিল না।
এবার ডাকা হলো কামারকে। তার জবাব, হুজুর, ছুরিতে ধার দেওয়ার সময় সে স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। তার অ্যাটেনশন নষ্ট করেছে হাতিরা। ছুরিটি ধারাতে আগুন জ্বালানোর সময় রাজ প্রাসাদের সমস্ত হাতি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। রাজ্যের সব মানুষের সাথে সেও হাতি দেখতে যায়। এই ফাঁকে ছুরিটা বেশি ধারালো হয়ে যায়। তাই ছুরিতে বেশি ধারের জন্য দায়ী রাজার হাতির পালের প্রধান মাহুত। তার সবগুলো হাতিকে এভাবে একসাথে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি।
এবার ডাক পড়ে প্রধান মাহুতের। কেন সব হাতি একসাথে ছাড়া হলো- জানতে চাওয়া হয়। তার করজোড়ে বর্ণনা, হুজুর দীর্ঘদিন আপনার ঘরে কোন সন্তানাদি হয়নি। প্রজারা গোপনে গোপনে আপনাকে আটকুঁড়ে রাজা বলতো। স্রষ্টার অপার মহিমায় ঘটনার দিনই রাজপ্রাসাদ আলো করে আমাদের রাজকুমারের জন্ম হয়েছে। সেই খুশিতে রাণীমার নির্দেশে হাতিশালের সব হাতি নিয়ে রাজ্যময় আনন্দ শোভাযাত্রা করা হয়েছে। সেজন্য দোষ কারো হয়ে থাকলে তা রাণীমার। আমি তার নির্দেশ পালন করেছি মাত্র। মাহুতের জবানবন্দিতে এবার কাঠগড়ায় স্বয়ং রানী।
রাণীর জবাব, বাদশা নামদার, গত এক যুগেও আমি আপনার কোনো মাহুতকে একটি নির্দেশও দেইনি। সেদিনই একটা নির্দেশ দিয়েছি। উপলক্ষটা ছিল আপনার আদরের রাজপুত্র। তাই সে-ই মূল দোষী। রানীর আরজি মোতাবেক এবার সদ্যজাত রাজপুত্রকেই শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হুকুম দেন রাজা। এতে রানী পড়েন মহাবিপাকে। এমনটি ভাবতেই পারেননি তিনি। বিয়ের দু’যুগ পর সন্তানের মা হয়েছেন। তার এই সন্তান হবে এই বিশাল রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। বিষয়টি নিয়ে রাজার কয়েকজন বিশ্বস্ত ও সিনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শে বসেন রানী। কীভাবে রাজপুত্রকে রক্ষা করা যায়? এক মন্ত্রী রাণীকে ভরসা দিলেন তিনি একটা বুদ্ধি বের করবেন।
পরদিন দরবারে বৈঠক। মন্ত্রীজি উত্থাপন করেন বিষয়টি। বললেন, হে মান্যবর রাজাধিরাজ, আপনার পিতার রাজত্বকালেও মন্ত্রী ছিলাম। আপনার আমলেও আছি। সুদীর্ঘ এ মন্ত্রীত্বের কালে কখনও এতো ছোট্ট শিশুকে শূলে চড়াতে দেখিনি। তার প্রধান কারণ শিশুরা বিধাতার রূপ, তারা শূলে চড়ার মতো কোনো পাপই করতে পারে না। তাই এ শাস্তি তাদের প্রাপ্য হতে পারে না। সেইক্ষেত্রে পাপী হবেন আপনি।
এবার রাজা জানতে চান, তাহলে কী করনীয়? মন্ত্রী বলেন, জরুর মহারাজ। উপায় অবশ্যই আছে। আমাদের রাজপুত্রের নামেরই একটা তাগড়া মানুষ ধরে এনে শূলে চড়িয়ে দিলেই হয়ে যায়। রাজার মনে ধরে বুদ্ধিটা। হুকুম দেন তার রাজ্যে রাজপুত্রের নামের সব লোককে কালই ধরে নিয়ে আসতে। পরদিন, রাজপুত্রের নামের কয়েক শ’ লোককে জড়ো করা হয় একটি মাঠে। এদের মধ্য থেকে নাদুস-নুদুসটাকে রেখে বাকিগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর এ হাম্বাটাই ওই সাগরেদ। যে সব জিনিসের এক দাম হওয়ায় গুরুকে ছেড়ে এই আজব দেশের মজায় মেতে আছে।
তাকে শূলে চড়াতে রাজ্যময় প্রস্তুতি। চলতে থাকে শূলের মহড়া। তার সামনে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এ সময় মনে পড়ে তার গুরুর কথা। যিনি বলেছিলেন, ভালো-মন্দের তফাৎ না থাকা এ আজব দেশটি বিপজ্জনক।
বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে গুরুকে স্মরণ। গুরুর দেওয়া পাখির পালকটিতে তর্জনী দিয়ে তিনবার ঘঁষা দেয় সে। ম্যাসেজ পেয়ে যান ওস্তাদ। ম্যাসেজটা সিন করে দ্রুত চলে আসেন আজব দেশে। ঘটনা বুঝে লেগে যান তার সাগরেদকে রক্ষার কাজে। নাটকীয় এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।
শূলে চড়ানোর তারিখে আকস্মিক একজন গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়েন রাজার পায়ে। বলেন, হুজুর ওই বন্দীকে ছেড়ে দিন। আসল অপরাধী আমি। একটু পর আরেকজন গিয়ে ঠিক একই কথা বলে। এরপর আরেকজন। সবার একই কথা। ওরা নয় আমি দোষী, আমাকে শুলে চড়ান।
এভাবে আট/দশ জনের পর বাধে চরম হট্টগোল-বিশৃঙ্খলা। রাজা বিরক্ত হয়ে জানতে চান বিষয়টা কী?
এবার সামনে আসেন গেরুয়া বসনে, সফেদ শশ্রূমণ্ডিত, সৌম্যকান্তি, শান্ত একজন। তার আকুতি- হে মহামান্য ভূপতি, এরা আপনার মঙ্গল চায় না। সবাই আপনাকে ধোঁকা দিয়ে নিজের আখের গোছাতে চাচ্ছে। আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন, আজ পূর্ণিমা তিথি। প্রতি একশো বছরে একবার আসে দিনটি। এ দিনে কোনো ব্যক্তির শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হলে সে জাগতিক দেহ নিয়েই সরাসরি স্বর্গে চলে যায়। এরা সবাই তথ্যটা জানে। তাই নিজেকে দোষী বানিয়ে শূলে চড়ে স্বর্গবাসী হতে চায়।
এমন বর্ণনা শুনে নড়েচড়ে বসেন রাজা মশাই। বলেন, আমার টাকায় তৈরি চকচকে শূল। আমার টাকায় বেতন নেয়া পাইক, পেয়াদা, জল্লাদ। আর সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার মতলবে এই দুর্জনেরা? কোথায় মন্ত্রী, পাইক- পেয়াদা জল্লাদেরা। তোমরা কোনো সময় নষ্ট না করে তোমাদের রাজাধিরাজের সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।
রাজার শূলে চড়ার দুর্নিবার আগ্রহ দেখে এক ভিন্ন আবহ। উজির-নাজিরদের কয়েকজনও শূলে চড়তে পাগলপারা হয়ে ওঠেন। মহাহুলস্থুল তাদের মধ্যে। ছোটখাটো দাঙ্গা বেধে যাওয়ার অবস্থা। এ হাঙ্গামার মধ্যে শিষ্যকে নিয়ে চোরের রাজ্য থেকে সাফল্যের সঙ্গে চম্পট দেন ওস্তাদ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামালের রম্য 'রুচিতে চুরি' রম্য রুচিতে চুরি সাহিত্য