সারপ্রাইজ
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:১৪
সানডের কভার স্টোরিটাতে ফাইনাল টাচ দেবে এমন সময় ফ্লিপকার্ট থেকে কলটা এলো ‘দাদা আপনার পার্সেলটা নিয়ে এসেছি। ল্যান্ডমার্ক দেওয়া লোকেশনেও পৌঁছে গেছি। কিন্তু বাড়িটা চিনতে পারছি না। আপনি যদি একটু এড্রেসটা গাইড করেন…।’ প্রত্ত্যুত্তরে অরুনাভ জানায় তার বাড়ির একজনের নম্বর সে মেসেজ করে পাঠাচ্ছে, পার্সেলটা তাকে দিয়ে দিলেই হবে। সে এখন অফিসে।
অরুনাভ সান্যাল, কলকাতার নামী একটা ডেইলি নিউজপেপারের সাব-এডিটর। প্রায় ছ’ফুট লম্বা স্মার্ট চেহারার যুবকটির সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তার চোখ দুটো। ফোনটা রাখার পর অরুনাভ একটু মুচকি হাসি দিয়ে কি-বোর্ডে কন্সেন্ট্রেট করল। যাই হোক আজই সারপ্রাইজটা দেবে সে। আজকের কভার স্টোরির সাবজেক্টটা ‘বৃষ্টি, প্রেম, মন খারাপ’ এই ব্যপারটা ওরও হট-ফেভারিট একটা টপিক। লেখাটাও জমিয়ে লিখেছে তবে লেখাটাতে যেন আরও কিছু পাঞ্চ-লাইন চাইছে। এইসবই ভাবছিল অরুনাভ। হঠাৎই আবার ফোনটা বেজে ওঠে, ‘দাদা যে নম্বর দিলেন সেই ফোন তো সুইচ অফ বলছে। আপনি একটু ট্রাই করে দেখুন না।’
ফোনটা রেখে অরুনাভ বারকয়েক ট্রাই করল কিন্তু সেই মোবাইল কোম্পানির মেয়েটা ফাটা ক্যাসেটের মত বারবার বলে চলেছে ‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড, ইজ সুইচড অফ রাইট নাউ’। ল্যান্ড ফোনটাতেও রিং হয়ে গেল কেউ ফোন তুলল না। খানিকটা বিচলিত হয়েই এডিটরের রুমে ঢুকে কথা বলে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। আসলে ঐ পার্সেলটা যে আজই নিতে হবে। এই দিনটার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করে আছে ও।
অফিস থেকে বেরিয়ে ফ্লিপকার্টের ডেলিভারি বয়কে ফোন করল অরুনাভ, ‘ভাই পার্সেলটা আমার আজই লাগবে, তুমি কি ঘন্টা দু’য়েক ঐ এরিয়ায় থাকছো? আমি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছি। তাহলে এসে কোনও একটা কমন প্লেসে মিট করে ওটা নিয়ে নেব।’ ছেলেটি জানায় তার ঐ এরিয়ায় অনেকগুলো ডেলিভারি দেওয়ার আছে। সে থাকছে। পৌঁছে ফোন করলে ও এসে পার্সেলটা দিয়ে যাবে। অফিসের সামনের সিগারেটের দোকান থেকে একটা কিং সাইজ গোল্ড ফ্লেক ধরালো অরুনাভ। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওর মনে হল একটা-দুটো করতে করতে কবে যেন সিগারেটটা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ও বুঝতেই পারেনি। আসলে অভ্যাস তো এমনি একটা জিনিস এক পা দু পা এগোতে এগোতে কবে সে সম্পূর্ণ অধিকার কায়েম করে নেয় বুঝতেই পারা যায় না। তবে একা থাকার অভ্যাসটা কেন এখনও আয়ত্ত করতে পারল না অরুনাভ? নাকি ও একা থাকতে ভয় পায়?
সিগারেটটা শেষ করে স্টেশনের দিকে এগোতে লাগলো অরুনাভ। রাস্তায় যা জ্যাম, তারপর আবার তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর তাড়া, এক্ষেত্রে ট্রেনের কোনও বিকল্প নেই। যদিও অরুনাভর ট্রেনে-বাসে জার্নি করার অভ্যাসটা চলে গেছে অনেকদিনই। তবে আজ দু’দিন ড্রাইভার আসছে না তাই হয় বাস, নয় ট্রেন নাহলে ওলা-উবারই ভরসা। কতবার ভেবেছে ড্রাইভিংটা শিখে নেবে, তা আর হয়েই ওঠেনা। আসলে জীবনের ড্রাইভিং সামলাতে সামলাতে এই কর্পোরেট লাইফে আর সময় কোথায়!
টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছতেই ট্রেনটা পেয়ে গেল। দুপুরের ট্রেন তুলনামূলক ফাঁকা। ট্রেনে উঠে এদিক ওদিক দেখে জানলার পাশের একটা সিটে গিয়ে বসলো অরুনাভ। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে এটা সেটা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে।
২.
ছোটবেলা থেকেই অরুনাভর অ্যাটিটিউড খুব অ্যাট্রাক্টিভ আর খুব সুন্দর কথা বলতে পারে। তাই ঘরভর্তি লোকের মধ্যেও নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করে নিতে খুব বেশি সময় লাগে না। অরুনাভ তখন সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। সেন্ট্রাল কলকাতার নামী কলেজ। কৃষ্ণনগরের ছেলে অরুনাভ গ্রামে বড় হলেও খুব তাড়াতাড়িই কলকাতার অ্যাটমোস্ফিয়ারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। ফার্স্ট ইয়ারে কলেজ শুরু হবার দিনকয়েকের মধ্যেই সে ডিপার্টমেন্টের আর কয়েক মাসের মধ্যেই কলেজের হার্টথ্রব হয়ে উঠেছিল। কলেজ শুদ্ধ মেয়েদের কাছে অরুনাভর নামেই একটা অন্যরকম ফিলিংস।
তৃষা আর ও একই সাথে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টেই পড়ত। একসাথে প্র্যাক্টিক্যাল, একসাথে টিউশন, অফ পিরিয়াডের আড্ডা যে কবে কবে প্রেমে পরিনত হল দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি। তারপর ধীরে ধীরে বাগবাজার ঘাট, ভিক্টোরিয়া, সেন্ট্রাল পার্ক হয়ে দীঘার সমুদ্রের অমোঘ হাতছানি। দুজন যেন জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের জন্যই শুধু দু’জনের। কে কি বললো, কে কি ভাবল সে নিয়ে প্রথম প্রেমে পড়ে কে কবে ভেবেছে! বারাসাতের মেয়ে তৃষাও বান্ধবীর বাড়িতে গ্রুপ স্টাডি করবার নাম করে মাসে এক আধটা দিন ম্যানেজ করে নিত। ওরা প্রতিমাসেই একটা দিন একসাথে দীঘায় কাটাত। প্রেমের গভীরতা ক্রমশ বাড়ছিল। আর বাড়ছিল তৃষার অধিকারবোধ। যেমনটা সচরাচর হয় আর কি। মাঝে মাঝেই তুমুল ঝগড়াও হত দুজনের। একদিন দীঘার একটা হোটেলের বেডে শুয়ে অরুনাভর মাথার চুলে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে তৃষা বলেছিল, ‘অরু আমরা কবে বিয়ে করবো? তুমি আমায় একটা লাল বেনারসী শাড়ি কিনে দেবে?’
সময় এগিয়েছে। বদলে গেছে পরিস্থিতি। সেইবারই ওদের শেষ একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। অরুনাভর ক্রমশ মনে হচ্ছিল রিলেশনশপ শুরুর সময়ে এটা যতটা আনন্দের ছিল এখন ততটাই বারডেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন কেউ এসে গলায় একটা ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে। এদিকে গেলে সমস্যা ওদিকে গেলেও সমস্যা।
কলেজের ওদের রিলেশনের ব্যাপারটা জানাজানি হতেই অনেক প্রত্যাশিত বান্ধবীরাই অরুণাভর সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিল। তার ওপর কিছু না কিছু নিয়ে তৃষার সাথে ঝামেলা তো লেগেই আছে। একটা সময় অরুনাভ ভেবে নিল সে এই রিলেশনশিপে আর থাকবে না। সে বুঝেছে এই প্রেম ভালোবাসার মধ্যে কিছু রাখা নেই। এতে পড়াশুনোও ডিস্টার্বড হচ্ছে। আরও হাজারও রকম সমস্যা। আর তার থেকে বড় কথা হল যার হাতের কাছে হাজারটা অপশন তার কি আর একটা জিনিসে খুব বেশিদিন মন আটকে থাকে! ধীরে ধীরে অন্য মেয়েদের সাথে অরুনাভর মেলামেশা বাড়তে থাকে।
ক্রমশ ডাইভার্ট হচ্ছিল অরুনাভ। তৃষার সাথেও আগের থেকে অনেক কম কথা হয়, কেমন যেন একটা এড়িয়ে যাবার প্রবণতা। একদিন ফাঁকা ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে তৃষা যাচ্ছিল। ও ভাবতেও পারেনি এমন কোনও দৃশ্য ওর জন্য এ জীবনে অপেক্ষা করছে। তৃষা থাকতে অরুনাভ অন্য কোনও মেয়ের সাথে এত ঘনিষ্ঠ হতে পারে কি করে? অরুনাভর মুখোমুখি সেটাই তৃষার শেষ দিন। অরুনাভ বলেছিল, ‘দেখ তুই আমি ভালো বন্ধু হতে পারি। আমি আর তোর সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করতে পারবো না। সরি।’ তৃষার মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তের জন্য যেন মাটি ভাগ হয়ে সে অতলান্ত পাতালের দিকে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার। তবু চেষ্টা করল অরুনাভকে বোঝাবার। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। তারপর থেকে তৃষা আর কোনওদিন কলেজে আসেনি। মোবাইল নম্বরও চেঞ্জ করে নিয়েছে। হাজার রকম ভুলে যাওয়ার মাঝে অরুনাভও ভুলে গেছে তৃষাকে। তার কাছে তখন একের পরের এক ওপেন রিলেশনশিপের হাতছানি। প্রেম তখন শুধুই পিটুইটারির খেলা।
৩.
বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি অরুনাভ। গায়ের ওপর কী একটা ভারি জিনিস পড়তেই সম্বিত ফেরে ওর। কেউ একজন সামনের সিটটাতে বসতে যাচ্ছিল। ট্রেন ব্রেক কষায় টাল সামলাতে না পেরে ওর গায়ের ওপর পড়ে গেছে। লোকটি দুঃখপ্রকাশ করে সামনের সিটটাতে বসলো। দেখতে দেখতে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছে ট্রেন। কত লোক উঠলো কত লোক নামল। অরুনাভর মনে হতে লাগলো আমাদের জীবনটাও এরকমই একটা ট্রেন কম্পার্টমেন্টের মত। কত মানুষ আসে, কত মানুষ চলে যায়। সময়ের সাথে সাথে আমরা হয়তো কত মানুষকে ভুলেও যাই। এই যেমন তৃষাকে তো ভুলেই গিয়েছিল অরুনাভ। কবে কলেজ ছেড়েছে। তারপর কত তৃষা এল গেল। যদিও এখন অরুনাভ একাই। এখন ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভয় হল একা থাকার ভয়। মাকে অনেকবার বলেছে এখানে এসে থাকতে, মা কিছুতেই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে থাকতে রাজি নন। যত রাত বাড়ে অরুণাভর মনে হয় যেন তার সারা বিশ্বের যত শুন্যতা তার ফ্ল্যাটে এসে ভিড় করে।
সেদিনও অফিসের কাজ শেষ করে ঘুমোনোর আগে রোজকার অভ্যাস মত ফেসবুকটা লগইন করল। একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। নামটা দেখেই বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠলো অরুনাভর। তৃষা দত্ত। কারেন্ট সিটি আলিপুরদুয়ার। হোম টাউন বারাসাত। একটা ফুলের ছবি প্রোফাইল পিকচারে লাগানো আছে। গত ছ’বছরে কত কিছু বদলে গেছে। কলেজ ছাড়ার পর এমএসসি তারপর একটা স্কুলে চাকরি, সেখান থেকে একটা প্রাইভেট সেক্টরে এইচআরআরও দু’চারটে চাকরি বদল করে এখন একটা নিউজপেপারে। অরুনাভ শুধু স্টেবিলিটি খুঁজে গেছে। এক সময়ের ওপেন রিলেশনশিপের প্রেয়সীরাও আজ আর কেউ নেই। একাকিত্ব যেন জড়িয়ে বেঁধে রেখেছে ওকে। মা অবশ্য অনেকবার বলেছে বিয়েটা করে নিতে, কিন্তু অরুনাভর প্রতিবার একই কথা, ‘আর একটু স্টেবল হয়ে নিই’।
ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেই অরুনাভর প্রথম মেসেজ, ‘তুমি কি সেই তৃষা? মনীন্দ্র কলেজ, ফিজিক্স অনার্স?’ সারারাত অপেক্ষার পরও রিপ্লাই আসেনি। পরদিন অরুনাভ তখন অফিসে পৌঁছে একটা আর্জেন্ট মিটিং এ, হঠাৎ মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এল ‘হ্যাঁ আমিই সেই তৃষা অরু’। সারাদিন অফিসে কাজ করছে অরুনাভ তবু মনটা যেন অন্য কোথাও পড়ে আছে। বারবার মোবাইলটা হাতে একটার পর একটা মেসেজ করছে আর অধীর আগ্রহে দেখছে রিপ্লাই এল কিনা। আসলে এত বছরের জমা কথা তো। ফেসবুকে ফোন নম্বর আদানপ্রদান হল দু’জনের। বাড়ি ফিরে রাতে ফোন করল অরুনাভ। জানতে পারল তৃষার বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগে আলিপুরদুয়ারে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলেও মানিয়ে নিল অরুনাভ। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চলতেই থাকল। কথায় কথায় অরুনাভ জানতে পারল তৃষার হাসব্যান্ড বড় বিজনেসম্যান। প্রতিদিনই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে।
পরদিন থেকে তাই সন্ধ্যে থেকেই ওদের কথা শুরু আর রাতে ফেসবুকে চ্যাটিং। কয়েকদিনের মধ্যেই তৃষা অরুনাভকে জানায় তার সাংসারিক অশান্তির কথা, স্বামী আর স্বামীর পরিবারের লোকদের খারাপ ব্যবহারের কথা, স্বামীর বিভিন্ন মহিলাদের সাথে সম্পর্কের কথা এমনকি রাতে মদ্যপ স্বামীর গায়ে হাত তোলার কথা পর্যন্ত। এভাবে রোজই প্রায় কোনও না কোনও কারনে তৃষা ভেঙ্গে পড়ে, কাঁদে আর অরুনাভ ওকে স্বান্তনা দেয়। কবে কবে এই স্বান্তনার সুক্ষ সেতু ধরে দুজনের একটা মানসিক সম্পর্ক আবারও তৈরি হয়ে গেল তৃষা বা অরুনাভ কেউই টের পেল না। দুজনেরই তখন অবলম্বন চাই, বুকে মুখ গুজে কাঁদার একজন কাছের মানুষ চাই।
এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাত তখন প্রায় একটা তৃষা ফোন করল অরুনাভকে। মদ্যপ স্বামীর অকথ্য গালিগালাজ আর মারধোরের কথা জানালো অরুনাভকে। সাথে এটাও জানালো সে ঠিক করেছে তার স্বামীকে ডিভোর্স দেবে। অরুনাভ রক্ত ফুটছে রাগে। অরুনাভ বলল, ‘তৃষা মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি তোমার স্বামীর সাথে কাল একবার কথা বলি। তারপর যা ভালো বুঝবে ডিসাইড কোরো।’ উত্তরে তৃষা বলে, ‘ওর মত নরপশুর সাথে তোমার কথা বলার দরকার নেই। যা ডিসিশন নেবার আমি নিয়ে নিয়েছি।’ দিন দুয়েক পরে তৃষা ফোন করে বলল, ও শিলিগুড়িতে মামার বাড়িতে আছে। ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করে দিয়েছে ও। কথা হয় সারাদিনই। তারপর অরুনাভ রোজই বলে, ‘তোমার স্বামীর খবর কী? সে কি ডিভোর্স দিতে রাজী?’ স্বামীর কথা বললেই বা কোর্টের কথা জিজ্ঞেস করলেই তৃষা প্রচন্ড রেগে যায় বলে, ‘ওসব নিয়ে ভেবো না। ও তো হাজারটা মহিলার সাথে রিলাশনে থাকা লোক। ডিভোর্স না দিলে অন্য কেস দিয়ে দেব।’ কথা হলে অরুনাভ তারপর আর ঐ বিষয়ে খুব একটা কিছু তোলে না। অরুণাভর মনে হয় সে যে তৃষাকে চিনতো, এ একেবারে অন্য তৃষা।
তবু সময় এগোচ্ছিল। কথার সূত্রে কথার গভীরে আবারও হারিয়ে যাচ্ছিল দুটো মানুষ। এরই মাঝে একদিন অরুনাভ বলেই ফেলল, ‘তৃষা আমরা আবার এক হতে পারি না? উইল ইউ ম্যারি মি? কথা দিচ্ছি জীবনে আর কক্ষনও তোমায় কষ্ট দেব না। আগলে রাখবো।’ তৃষাও একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বীকৃতি দিল। ততদিনে অরুনাভর রোজকার রুটিনে তো পারমারেন্টলি ঢুকে পড়েছে তৃষা নামটা। সকালে তৃষার ফোনেই ঘুম ভাঙ্গে। আর কথা তো হতেই থাকে সারাদিন। রাতে ঘুমও আসে তৃষার মেসেজ দেখার পরই। এবার সত্যি সত্যিই মন-প্রান দিয়ে জীবনে কাউকে আগলে রাখতে চাইছে অরুনাভ।
৪.
‘মিহিদানা… মিহিদানা…’ মিহিদানাওয়ালার চিৎকারে ঘোর কাটলো অরুনাভর। মাথার ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্রেনে আসতে আসতেও তো কতবার ফোন করল, তৃষার ফোন কেন সুইচ অফ! এমন তো একবারের জন্যও হয়নি গত কয়েক মাসে। ওর কোনও বিপদ হয়নি তো! ওর হাসবেন্ডের অ্যাড্রেস এতবার বলার পরও কিছুতেই জানায়নি তৃষা। ছবি অবধি দেখায়নি। শুধু বলেছে ‘ওর ব্যাপারে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবে না ভালো লাগে না।’ কৌতূহল হলেও অরুনাভও কিছু জানতে চায়নি। তৃষা ওর কাছে ফিরে এসেছে, সেই একাকিত্বের তো অবসান হয়েছে। এখন ওর বারবার মনে হচ্ছে ঐ লোকটা কিছু অঘটন ঘটালো না তো? আবার নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করে অরুনাভ, তৃষা হয়ত বাইরে কোথাও বেরিয়েছে, ফোনে চার্জ নেই। আসলে গত দশদিন তৃষা ওর ফ্ল্যাটে পারমারেন্টলি চলে আসার পর থেকে জীবনের ডেফিনেশনটাই কেমন যেন বদলে গেছে। দেখতে দেখতে তৃষার ওর জীবনে ফিরে আসার প্রায় দেড় বছর কেটে গেল। এর মধ্যে দেখা বলতে শুধু একবার। অরুনাভ সত্যি সত্যিই সত্যিকারের প্রেমে পড়েছে এবার। তৃষাকে ও কোনোমূল্যেই হারাতে চায় না আর।
স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। বাঙ্কার থেকে ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেই ফ্লিপকার্টের ছেলেটাকে ফোন করল অরুনাভ। ছেলেটি বলল, ‘আমি স্টেশনের কাছেই আছি দাদা আপনি এক নম্বরের টিকিট কাউন্টারে আসুন। আমি আসছি’। অরুনাভর এক মিনিট যেন এক একটা বছর বলে মনে হচ্ছে এখন। টিকিট কাউন্টারের সামনে পৌঁছে ফোন করল আবার। ছেলেটি এসে দিয়ে গেল পার্সেলটা। আর এক সেকেন্ডও সময় নস্ট করল না অরুনাভ। সোজা রিক্সা স্ট্যান্ড গিয়ে একটা রিক্সায় বসে বলল ‘শীতলা মন্দিরের মোড়। একটু তাড়াতাড়ি চলুন দাদা।’ রিক্সায় বসেই পার্সেল খুলে লাল বেনারসি শাড়িটা বের করে দেখল অরুনাভ। তৃষাকে দারুণ মানাবে এটাতে। গতকালই ওর ডিভোর্সের ঝামেলা চুকে গেছে। এখন তো আর বিয়ে করতে অসুবিধার কিছু নেই। এই লাল বেনারসিটা নিশ্চই বেশ পছন্দ হবে তৃষার। এটা ওর কাছে আজকের দিনে একটা দারুণ সারপ্রাইজ হবে। অনেক বছর আগে যে ভুল করেছিল আজ তা শুধরে নিতে চায় অরুনাভ। রিক্সায় যেতে যেতেও বারবার ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে। কিন্তু ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে রিক্সা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে লিফটে সোজা তিনতলা। বারবার ডোরবেল বাজাতে লাগলো অরুনাভ। ওর দুশ্চিন্তার পারদ ক্রমশ চড়ছে। তৃষা ঠিক আছে তো? ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে সোজা বেডরুম। না বেডরুম-কিচেন-বাথরুম কোথাও তৃষা নেই। উদ্ভ্রান্তের মত লাগছে অরুনাভর। কি করবে? কাকে জিজ্ঞেস করবে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎই ডাইনিং টেবিলটাতে চোখ যেতেই থমকে গেল অরুনাভ। একটা চিঠি চাপা দিয়ে রাখা আছে পেপারওয়েট দিয়ে। হাতে নিয়ে অরুনাভ পড়তে শুরু করল, ‘প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা অবলম্বন দরকার হয় অরু। সেদিন আমারও ছিল। আজ তোমারও। তুমি হয়তো জানোনা কাউকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসার পর, তার কাছে নিজের সর্বস্ব সঁপে দেবার পর তাকে ছাড়া এই জীবনে আর কিছুই থাকে না। এবার তুমি বুঝবে ভালোবাসা জীবন থেকে হারিয়ে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়। এই ক’দিন তোমার সাথে থেকে আমার জীবনের অনেক প্রিয় মুহূর্ত কাটিয়েছি। ভালো থেকো- তৃষা।’
অরুনাভর মনে হচ্ছে বুকের মাঝখান দিয়ে কে যেন ব্লেড দিয়ে চিরে দিয়েছে। হাউ হাউ করে কাঁদছে অরুনাভ। ডানহাতে চিঠিটা আর বাঁ হাতে সদ্য আনা শাড়িটা, যেটা সে আজ তৃষাকে নতুন জীবনে স্বাগত জানাতে সারপ্রাইজ গিফট হিসাবে দেবে ভেবেছিল। কিন্তু সে কি আর জানতো তৃষা তার জন্য এমন একটা সারপ্রাইজ রেখে গেছে!
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প তন্ময় মন্ডল তন্ময় মন্ডলের গল্প 'সারপ্রাইজ' সারপ্রাইজ সাহিত্য