সুনন্দার স্মৃতি
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ২১:২২
সেদিন দুপুরে সাগরকে দেখলাম কলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে ভবনটাকে। আমি ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছিলাম বাসায় গিয়ে ভাত খাবো বলে। সাগরকে দেখে থামলাম। ১০/১৫ বছর পর ওকে দেখলাম। কোনো সোশ্যাল মিডিয়াতে ওর অস্তিত্ব নেই। ওর স্থায়ী বা বর্তমান কোন ঠিকানাও আমি জানি না।
সাগর আমার সাথে পড়তো ভার্সিটিতে। বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম আমরা। আমাদের দুজনেরই কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। সাগর অবশ্য পরে কবিতা ছেড়ে প্রেমে বেশি জড়িয়ে পড়ে। সুনন্দাকে ভালোবাসতো সাগর। সুনন্দা সরকার। ময়মনসিংহের মেয়ে। সাগরের বাড়ি কোথায় ছিল আজ আর আমার মনে পড়ছে না। সুনন্দারটা খুব স্পষ্ট মনে আছে, কারণ সাগর সে সময় ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’ নামে একটা কবিতা লিখেছিল সুনন্দাকে নিয়ে। একটা না বেশ কয়েকটা লিখেছিল। প্রেমে পড়ার আগে পরে, সাগরের সব কবিতাতেই সুনন্দা এসে পড়তো।
পেটে খিদে। বাসায় যাব তাড়াতাড়ি। তাই সাগরের কাছে গেলাম। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে? কি দেখিস এত? কলা ভবনের কি নতুন রুপ গজালো নাকি?’
সাগর আমার দিকে তাকালো। হাসলো। খুব মৃদুস্বরে বললো, ‘আমার মনে হয়েছিল ক্যাম্পাসে এলে একমাত্র তোর সাথেই দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
‘হ্যাঁ। আমার সাথে তো দেখা হবেই। ক্যাম্পাসই তো আমার ঘরবাড়ি। তোর খবর কি?’
সাগর হাসলো। বললো, ‘ভালো।’
আমি তাড়া দিয়ে বললাম, ‘আমি খেতে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। তোকে দেখে এলাম। চল, আমার সাথে বাসায়। দুই বন্ধু একসাথে খেতে খেতে গল্প করবো। তোর তো কোন খবরই জানি না।’
সাগর বললো, ‘আমার যে একটু কাজ ছিল।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জরুরি কিছু?’
সাগর বললো, ‘আমার কাছে জরুরি।’
আমি বললাম, ‘কি কাজ?’
ও বললো, ‘কলা ভবনটাকে আরো কিছুক্ষণ দেখবো।’
বয়স হয়েছে। এখন আর তেমন বিস্মিত হই না বা চমকাই না। ওর কথা শুনে অনেকদিন পর চমকে গেলাম। প্রথমত ওর কথা শুনে, দ্বিতীয়ত ওর সিরিয়াসনেস দেখে। এত সিরিয়াসলি বললো, মনে হলো এটাই ওর চাকরি! আট ঘণ্টা কলা ভবন দেখার জন্য ও মাস শেষে বেতন পায়!
আমিও বেশ সিরিয়াসলি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনো আর্কিটেকচারাল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিস নাকি?’
ও বললো, ‘না। শুধু দেখছি। সুনন্দা এই সিঁড়িতে বসে থাকতো, তোর হয়তো মনে নেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওর সবুজ রংয়ের একটা সালোয়ার কামিজ ছিল। ওর খুব প্রিয় ছিল। সেটা পরে বসে থাকত। আমার মনে আছে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলের কথা। আমাদের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে কলাভবনে আটকা পড়েছি। এই সিঁড়িটার এক কোণায় গিয়ে বসেছিল সুনন্দা। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসের ঝাপটায় ওর গায়ে এসে বৃষ্টির পানি লাগছে। কিন্তু ও সেখান থেকে সরছে না। সবুজ রংয়ের জামা পরে বসে আছে। বসে আছে তো আছেই। এদিকে টানা বৃষ্টিতে কলা ভবনের সামনে পানি জমে গেল। সেই জমা পানিকে আমার মনে হল পুকুর আর সবুজ জামা পরা সুনন্দাকে মনে হল কচুরিপানা। আমাদের বাড়ির পুকুরটা এরকম সবুজ কচুরিপানায় ভরে থাকতো। পানি দেখা যেত না, শুধু কচুরিপানা। সুনন্দাকে দেখে আমার তখন কলাভবনের সামনে জমা বৃষ্টির পানিতে নেমে গড়াগড়ি করতে খুব ইচ্ছা করছিল। লোকে পাগল বলবে ভেবে আর নামিনি। কলা ভবনের বারান্দায় সুনন্দা প্রায় দাঁড়িয়ে থাকতো। বারান্দা ছিল ওর পছন্দের জায়গা। হলেও নাকি বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতো। বারান্দায় গিয়ে পড়তো, চুল আঁচড়াতো। আর স্বপ্ন দেখতো ওর নিজের যখন বাড়ি হবে তখন বিশাল এক বারান্দা থাকবে, যার অর্ধেক থাকবে খোলা। বৃষ্টি এসে পড়বে সেই বারান্দায়। বারান্দায় বসে বসে চা খাবে আর বৃষ্টি দেখবে।’
আমি এবার সাগরের দিকে মনোযোগ দিলাম। ক্ষুধার কথা ভুলে গেলাম। কিছু একটা গোলমাল তো নিশ্চয়ই আছে। অসংলগ্ন কথাবার্তা ও এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলছে কীভাবে? আমার তো মনে হচ্ছে ও ২০২২ সালে না ২০০০ সালে কলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে লাইভ কমেন্ট্রি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সুনন্দা এইতো একটু আগে কলাভবনের সিঁড়িতে সবুজ সালোয়ার কামিজ পরে বসেছিল। আমরা একসাথে ক্লাস করে বেরিয়েছিলাম। আজকে বাইরে প্রচণ্ড রোদ, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন একটু আগেও তুমুল বৃষ্টি হয়েছে।
আমার নীরবতা সাগরকে যেন আরো উস্কে দিল, নিজের মনেই বলতে থাকলো, ‘তুই জানিস সুনন্দা ছিল ওদের স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। খুবই পড়ুয়া মেয়ে। শিক্ষক বাবা-মায়ের মেয়ে তো। বাড়িতে পড়ার চর্চাটা ছিল। পড়তে খুব ভালোবাসতো। কখনো ক্লাসের বই, কখনো গল্পের বই। পড়ার বইয়ের অভাব ছিল না। পড়তেই থাকতো সারাদিন।’
এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলার পর সাগর থামলো। আমার দিকে তাকালো। হাসলো। বললো, ‘ভাবছিস, কিসব আবোল তাবোল বকছি! দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছিলি না? তোর বাসায় যাবো না। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। টিচার্স ক্লাবে যেতে পারি বা কোনো রেস্টুরেন্টে। খেতে খেতে তোকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলি।’
আমি বললাম, ‘চল, রেস্টুরেন্টে বসি। টিচার্স ক্লাবে মানুষজন আসা যাওয়া করে, সবার সাথে হাই হ্যালো করতে হয়। আরাম করে কথা বলা যায় না।’
আমরা কলতান রেস্টুরেন্টে গেলাম। খাবারের অর্ডার দিয়ে দুই বন্ধু বসে পড়লাম। আমি মজা করে বললাম, ‘তোর কলা ভবন দেখায় একটা বাগড়া দিয়ে দিলাম। ঠিকমত তো দেখতে পারলি না।’
হাল্কা করে হাসলো সাগর। বললো, ‘না দেখেছি। পরে আবার দেখবো। তুই ভাবছিস, কলা ভবন এত দেখার কি আছে? কত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এক সময় তো প্রতিদিন কতবার এই ভবনে আসা যাওয়া করেছি। তুই তো রোজ দেখিস, তোর ব্যাপার আলাদা। তবে আমার কাছে কলা ভবন মানেই সুনন্দা। ওর সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে আমি খুব নিবিড় করে দেখি, স্পর্শ করি, আপন করে নেয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে দিয়ে আমি সুনন্দাকে আমার সাথে রেখে দেই। আমার সাথে তুই যতক্ষণ গল্প করবি, কথা বলবি, ঘুরেফিরে আমি সুনন্দার কথাই বলবো, যে কোন টপিক আমি সুনন্দার দিকে নিয়ে যাবে। এটাই আমার জীবন রে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুনন্দা কোথায়?’
সাগর বললো, ‘আমি তো জানতাম আমেরিকাতে থাকে। ঠিক খবর জানি না। আমি তো অনলাইনে নেই, ইন্টারনেট চালাই না। তোদের সাথে সুনন্দার যোগাযোগ নেই?’
আমি বললাম, “না, সুনন্দার সাথে আমার কেন, আমাদের ক্লাসের কারওরই যোগাযোগ নেই। সুখেই আছে মনে হয়। এক সুখী মানুষ আর এক দুঃখী মানুষ। এই দুই শ্রেণীর মানুষ পুরাতন মানুষদের সাথে যোগাযোগ রাখে না। এরা নিজেদের আলাদা একটা জগৎ তৈরি করে নেয়, যেখানে কেউ তাদের অতীত জানে না, জানে শুধু বর্তমান। মহীনের ঘোড়াগুলির একটা গান আছে না, ‘কাউকে চেনো না তুমি, তোমাকে চেনে না কেউ, সেই তো ভালো…’ এই নীতিতে বিশ্বাসী তারা।”
‘তোর শিক্ষকতা কেমন চলছে?’
‘ভালোই চলছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার আগ্রহ কম। চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনীতি এসব নিয়ে আগ্রহ বেশি। তাড়াতাড়ি টাকা আসবে কীভাবে সেই ধান্দা। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় একটা জেনারেশন পর দেশে আর কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক তৈরি হবে না। সব হবে ব্যবসায়ী মানসিকতার পেশাজীবী।’
‘ভারি ভারি কথা বলছিস।’
খাবার এসে গেল। খাবার খেতে খেতে আমাদের কথায় কিছুটা ভাটা পড়লো। মনোযোগ দিয়ে দুজন খাবার খেতে থাকলাম। খাওয়া শেষ করে শরীরে বেশ এক আলস্য ভর করলো। বললাম, ‘ঘুম পাচ্ছে।’
‘বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারিস। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করে বিকেলের বাসে করে ময়মনসিংহ চলে যাবো।’
‘ময়মনসিংহ? তুই কি এখন ময়মনসিংহে থাকিস?’
‘হ্যা। সুনন্দাদের বাসার গলিতে ভাড়া থাকি।’
সাগরের মুখে সেই তখন থেকে সুনন্দার কথা শুনতে শুনতে আমার বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। আমি বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ও তো ওখানে থাকে না।’
‘তাতে কি? ওর স্মৃতি তো ওখানে আছে। ভেবে দেখ ওই গলি দিয়ে বেরিয়ে ও প্রতিদিন স্কুলে যেত। ছোট্ট মেয়ে, কিশোরী মেয়ে সুনন্দা। তারপর ওই গলি পেরিয়েই একদিন এসেছিল কলা ভবনে। আমি সুনন্দার সাথে জড়িত সব জায়গার সাথে জড়িয়ে নিয়েছি নিজেকে।’
বিরক্তির কারণে মনে হয় আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। তাই ছোট ছোট করে প্রশ্ন করছি, কনভার্সেশনটা সামনে আগানোর জন্য। ওর কথা শুনে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যেমন?’
‘যেমন, আমি নিয়ম করে সুনন্দার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কল্পনায় এক কিশোরী সুনন্দার ছবি আছে, স্কুলের ড্রেস পরা সেই সুনন্দার একটা ছবি আমি মনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ওর স্কুলের গেটের সামনে…’
এই প্রথম ওকে থামালাম কথার মাঝখানে, বললাম, ‘… যেমন করে কলা ভবনের সিঁড়িতে সবুজ জামা পরে বসে থাকা সুনন্দাকে দেখছিলি?’
সাগর অনেকক্ষণ পরে হাসলো, সেই মৃদু হাসি। হাসিটা মুখে ধরে রেখে বললো, ‘তুই আমাকে পাগল ভাবছিস তাই না? আমি কিন্তু পাগল না। আমি শুধু একটা জিনিসকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। তোরা যেমন একসাথে অনেককিছু করতে পারিস, অনেক জায়গায় থাকতে পারিস, অনেক ভূমিকা নির্ভুলভাবে পালন করতে পারিস। সেটা আমি পারি না। আমার প্র্যাকটিস নেই। শুনেছি, চাকরি করলে নাকি এই প্র্যাকটিসটা হয়, মানে মাল্টি টাস্কিং করার অভ্যাসটা। আমিতো সেভাবে কখনো ধরাবাঁধা চাকরি করিনি। পাশ করে বের হয়ে কিছুদিন সেলসে কাজ করেছিলাম। ও চাকরিতে আমার পোষায়নি। এত রকম মানুষ, এত রকম ব্যবহার দেখে টিকতে পারিনি। স্টুডেন্ট লাইফ থেকে টিউশনির টাকায় চলার অভ্যাস। সেটাই করতে লাগলাম। এখনো তাই করি। টিউশনি আর ঢাকার একটা প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ আছে, ওদের প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করি। একা মানুষ, চলে যায়।’
‘কিন্তু তুই তো একা না!’
আমার কথা শুনে চমকে গেল সাগর। ওর চোখে এবার প্রশ্ন। মুখে আর কিছু বলার দরকার হলো না। ওর চোখ দেখেই প্রশ্ন বুঝে ফেললাম আমি। বললাম, ‘তোর সাথে তো সারাক্ষণ সুনন্দা থাকে। ভাবনায়, চিন্তায়, ঘরে বাইরে। তুই তো একা না।’
‘হ্যা। সেভাবে দেখলে একা না। কিন্তু একা বলতে যেটা বোঝাতে চাইছি যে মানুষ পোষার খরচ নেই। বাবা-মা গত হয়েছেন বেশ অনেকদিন। ভাই-বোনেরাও সবাই সবার মত সংসারী। আমি কারও সাথে যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী নই। তাই সবারও আমাকে ছাড়াই অভ্যাস হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধব তো নেই। তোরা যারা আছিস, তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। আমি আমার মত, সুনন্দাকে নিয়েই থাকি।’
‘সুনন্দাকে তুই ভালোবাসিস?’
এমন আচমকা প্রশ্নে সাগর চুপ হয়ে গেল। হয়তো ভাবতে বসেছে। সুনন্দা কি তার ভালোবাসা না অভ্যাস? অনেকক্ষণ ভেবে হয়তো কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। তাই পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘এই প্রশ্ন কেন করলি?’
‘দেখ, প্রেমে তো আমিও পড়েছি। একবার না বেশ কয়েকবার। তার মধ্যে কোনোটা ছিল একতরফা মানে শুধু আমার তরফ থেকেই আবার কোনোটা ছিল দুই তরফা। সম্পর্ক ভাঙার পর আমিও কখনো কখনো ভেঙে পড়েছি, আবার নতুন করে শুরু করেছি। তুই যেমন একজনের মাঝেই আটকে আছিস, আবার সে তোর কাছেও নেই এরকমটা আমার কখনো হয়নি। আমি যতটা বুঝি ভালোবাসলে তোরা একসাথে থাকতি, একসাথে ঘর না করলেও অন্তত যোগাযোগটা থাকতো। এইরকম একা একা তো ভালোবাসা হয় না। আমার মনে হয় তুই তোর একাকীত্বকে ভালোবাসিস। সেই একাকীত্বটাকে একটা খোলসের ভেতরে রেখে দিয়েছিস, যাতে সবাই সেটাকে প্রেমিকের আত্মত্যাগের মত বিশাল এক মহিমান্বিত বিষয় হিসেবে মেনে নেয়। তুই যদি সত্যিই সুনন্দাকে ভালোবাসতি, এতদিন ওকে না দেখে থাকতে পারতি? পারতি না। ওর সাথে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়তি। ওর স্কুলের সামনে না দাঁড়িয়ে থেকে ওর বাড়ি চলে যেতি, ওর বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করতি ও কোথায় আছে, কেমন আছে, যোগাযোগের উপায় কি? তার কিছুই তুই করিসনি। তুই নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছিস। এই একা বেঁচে থাকাটা তুই উপভোগ করছিস। চাকরি নেই, অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই, বাজার করার ঝক্কি নেই, ঘড়ি ধরে বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেয়ার নিয়ম নেই, বউয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কি অদ্ভুত, মুক্ত, স্বাধীন জীবন!’
আমার কথা শুনে ভাবতে বসলো সাগর। এই ফাঁকে আমি বিলটা দিয়ে দিলাম। তারপর ওকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। রোদের তেজ কমে এসেছে, অলস বিকেল খেলা করছে বাইরে। প্রেম প্রেম পরিবেশ, ছেলেমেয়েরা ক্লাস শেষে রিকশায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অদ্ভূত আনন্দ তাদের মনে। জীবনের এমন একটা জায়গায় এসে তারা পৌঁছেছে এর সামনে কি আছে বা পেছনে কি ছিল তা তাদের ভাবায় না। এখন কি আছে হাতের মুঠোয় সেটাই তাদের সবকিছু। কারও হাতে আছে আরেকটা হাত, যেই হাত ধরে সে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যেমন একসময় সাগর-সুনন্দা দেখেছিল। কারও হাত বড়ই ফাঁকা, কিন্তু সেই ফাঁকা হাতের ভেতরেও আছে দায়িত্ব, প্রেম, ভালোবাসা, কর্তব্য, শক্ত করে ধরে রাখার প্রতিজ্ঞা। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর আশেপাশে প্রতিদিন কত গল্প যে তৈরি হয়। ভাঙা-গড়ার গল্প। স্বপ্ন গড়ে, স্বপ্ন ভাঙে। প্রেম গড়ে, প্রেম ভাঙে। কিছু কিছু প্রেম, সাগরের মত মানুষেরা বয়ে বেড়ায়।
আমরা কোনদিকে যাব জানি না। আমি হঠাৎ থেমে গেলাম। সাগরও আমার সাথে সাথে থামলো। আমার কথাগুলো মনে হয় সাগরকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। ও কোনো কথা বলছে না। চুপ করে আছে, মনে হয় কিছু ভাবছে।
‘কোথায় যাবি এখন? চল, আমার বাসার দিকে যাই।’ সাগরকে বললাম।
‘নারে, যাব না। বাসা-বাড়িতে যেতে আমার ভালো লাগে না। কিছু কিছু মানুষ আছে না হাসপাতালে যেতে ভয় পায়, অসুস্থ রোগীকে দেখতে গিয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। গৃহস্থ ঘরবাড়িতে গেলে আমারও তেমন হয়। এতো সাজানো গোছানো সংসার, প্রেম, প্রয়োজন, বাজার, সন্তান এতসব দেখলে আমার অস্থির লাগে। এমন না যে আমি খুব সংসার করার স্বপ্ন দেখতাম এক সময়। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। শুধু ভালো লাগে না বললে ব্যাপারটা বোঝা যায় না। আমার অস্থির লাগে। মনে হয় এ কোন অদ্ভূত জায়গায় এসে পড়লাম আমি। মানুষ কীভাবে এত সুখী হয়? সংসারী মানুষ কি আসলেই সুখী না সুখের ভান করে থাকে?’
‘সুনন্দার প্রেম তো তোকে প্রেমিকের সাথে সাথে দার্শনিকও বানিয়ে ফেলেছে দেখি। চা খাবি?’
‘চল।’
আমরা পুকুরপাড়ে চলে গেলাম। ক্যাম্পাস লাইফে এটাই ছিল আমাদের আড্ডার প্রিয় জায়গা। পুকুরের সিঁড়িতে বসে দুই বন্ধু চা খাচ্ছি। আমি কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই কি আমার মত সংসারী মানুষদের ঘৃণা করিস না ঈর্ষা করিস?’
‘কোনোটাই না। আমি নির্বিবাদী মানুষ। আমার প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, ঘৃণা নেই। আমি আসলে বেশি মানুষের সাথে মিশি নাতো, তাই ঘৃণা করার সুযোগ কম। আবার যে কাজ করে খাই, তাতেও খুব বেশি যোগাযোগের প্রয়োজন হয় না। ছেলেমেয়েদের পড়াই আর বইয়ের প্রুফ দেখি। পড়ানোতে কিছুটা কথা খরচ হয়, বোঝাতে হয়। আর প্রকাশকের সাথে আমার যোগাযোগ পুরোটাই ডাক মারফত। ওরা লেখা পাঠিয়ে দেয়। আমি দেখে আবার ডাকে দিয়ে দেই। টাকাটা ফোনে পাঠিয়ে দেয়।’
‘তুই ফোন ব্যবহার করিস? নাম্বারটা দে। এভাবে অন্তত তোর সাথে যোগাযোগটা থাকবে।’
‘আগে করতাম না। কিন্তু প্রকাশকের সাথে কাজ করতে গিয়ে নিতে হল। ওরা আবার খুব যোগাযোগ করে। লেখা পাঠিয়ে ফোন দেয়। টাকা পাঠিয়ে ফোন দেয়। তাছাড়া বিলগুলো আগে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিতাম। সেটা ওদের জন্য ঝামেলা হয়ে যায়। ফোনেই নাকি সুবিধা। তাই ফোনটা নেয়া। ওটা বেশিরভাগ সময় সাইলেন্ট থাকে।’
‘তবু নাম্বারটা দে। যদি কোনোদিন সুনন্দার কোনো খোঁজ পাই, তোর কথা বলবো, আর নাম্বারটা ওকে দেব।’
সাগর পকেট থেকে কাগজ কলাম বের করে একটা নাম্বার লিখে দিল আমাকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর সাথে কি সবসময় কাগজ কলম থাকে?’
‘হ্যা। আমি তো কবিতা লিখি এখনো। তবে ছাপাতে দেই না কোথাও।’
‘আমাকে দিস তো, পড়বো। আমার পরিচিত প্রকাশক আছে কয়েকজন, ওদেরকে বললে ছেপে দেবে।’
‘ছাপানো জরুরি মনে হয় না আমার কাছে। তবু বলছিস যখন পাঠাবো তোকে। ছাপার জন্য না, তোর পড়ার জন্য। তোর মতামতকে আমি গুরুত্ব দেই।’
বিকেলটা পুকুরপাড়ে বসেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। সন্ধ্যা নামলো। চুপচাপ বসেই থাকলাম। কথা ফুরিয়ে গেল। সাগরকে বললাম, ‘আজকে থেকে যা।’
‘নাহ। বের হবো এখন। ফিরে যাই। ঢাকায় থাকতে ভালো লাগে না।’
‘আবার কবে আসবি? আসলে ফোন দিস। আমি সারাদিন ক্যাম্পাসেই থাকি।’
‘আচ্ছা। তোর নাম্বারটা দে।’
পকেট থেকে আবার সেই সাদা কাগজ আর কলম বের করে দিল সাগর। আমি সেখানে আমার নাম আর ফোন নাম্বার লিখে দিলাম। আমি জানি ও আর কোনোদিন আমাকে ফোন করবে না। এমনকি আমি ফোন করলেও ধরবে না। ও আজকের পর আবার হারিয়ে যাবে। এতদিন যেমন ছিল। আমি জানি কোনোদিন যদি সুনন্দা এসে ওর সাথে দেখা করতে চায়, তাও ও দেখা করবে না। জীবন্ত সুনন্দার চেয়ে সুনন্দার স্মৃতিই ওর বেশি প্রিয়। কে জানে সেই সুনন্দার সাথে ও আজকের সুনন্দাকে মেলাতে পারবে কিনা। হয়তো ওর স্বপ্নভঙ্গ হবে। তার চেয়ে ওর নিজের যে জগৎ সুনন্দাকে নিয়ে, সেটাই ওর জন্য ভালো। ওখানেই ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে। যেখানে ওই সাগর, ওই সুনন্দা, একটা মানুষকে ঘিরে গোটা পৃথিবী।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প ফাহিম ইবনে সারওয়ার ফাহিম ইবনে সারওয়ারের গল্প 'সুনন্দার স্মৃতি' সাহিত্য সুনন্দার স্মৃতি