আলেকজান্ডারের জুতো
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪১
এক.
হঠাৎ করেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কল্লোল দেখে তার পায়ের জুতোজোড়া ছোট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে একসাইজ ছোট জুতো পড়েছে। কিন্তু একই জুতো সে পড়ছে অন্তত ছয়মাস ধরে। তার এমনটাই ধারণা। খুবই আরামের জুতো। আরামের চামড়ার জুতো সহসা পাওয়া যায় না। অনেক দোকান ঘুরতে ঘুরতে বসুন্ধরা সিটি শপিংমল থেকে এই জুতোজোড়া পেয়েছে কল্লোল। আরামদায়ক বলে জুতোজোড়া তার কাছে খুবই পছন্দের। কল্লোলের জুতোর সংখ্যা মোট তিনজোড়া। এক জোড়া কেডস আছে পুমার, এক জোড়া বাটার চামড়ার জুতো আর এখন সে যে জোড়া পরে আছে সেটি আরামের জুতো। এই জুতোর দামটা অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বেশি। তবে আরামের তুলনায় তাকে বেশি বলা যাবে না। যে কারণে এটির ব্যবহার বেড়ে গেছে। অফিস ছাড়া অন্যসময় কল্লোল পুমার কেডস পরতো, অফিসে বাটার জুতো আর আরামের জুতোটা পরতো কোনো পার্টি বা সামাজিক অনুষ্ঠানে। আরাম বলে কথা! অফিসে প্রায় নিয়মিতই এই আরামজুতো পরে কল্লোল। এই জুতোজোড়া কোনো ব্রান্ডের তা তার জানা নেই। অতশত ব্রান্ড সে চেনেও না। তবে সে শুনেছে, ইতালির জুতো নাকি দামী এবং ভালো। জুতোজোড়া যখন কেনে তখন দোকানি বলেছিল, জুতোজোড়া ইতালির, জেনুইন লেদার। দোকানদার তার পরিচিত, তাই তাকে বিশ্বাস করেছে। দোকানি বিশ্বাসের মূল্য দিয়েছেন, জুতোজোড়া আসলেই খুব আরামের।
কিন্তু এখন সেই আরাম নেই। জুতোজোড়া ছোট হয়ে গেছে নাকি পা বড় হয়ে গেছে? এই প্রশ্নটাও কল্লোলের মনে এসেছে। সে ভাবছে, বাসায় গিয়ে অন্য জুতোগুলো পরে দেখতে হবে। সেইগুলোও আবার ছোট হয়ে যায়নি তো! সবগুলোই যদি ছোট হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে, পা বড় হয়ে গেছে। তিরিশ বছর বয়সে পা বড় হবে কীভাবে! কোনো অসুখ করলো না তো!
এই জুতো নিয়ে আর হাঁটতে পারছে না কল্লোল।
কল্লোলের আবার এটাও মনে হলো যে, কোনো কারণে তার পা’দুটো সত্যি সত্যি বড় হয়ে যায়নি তো!
কল্লোল নিজেও জানে এমন ভাবনা খুবই হাস্যকর। শুধু পা দুটো বড় হবে কেন? সে কি কোনো কার্টুন ক্যারেকটার যে হঠাৎ করে পা’দুটো বড় হয়ে যাবে। মিথ্যা বললে পিনোকীওর যেমন নাক বড় হয়ে যেতো। পিনোকীও তো কল্পকাহিনি, বাস্তবে কী কারও এমনটা হয়েছে কখনো!
হার্টের সমস্যায় নাকি পা ফুলে যায়, আবার উচ্চরক্তচাপের একটা ওষুধ আছে তাতেও অনেকের পা ফোলে। এগুলো সে শুনেছে ডাক্তারের কাছ থেকে। কল্লোলের মায়ের হাই ব্লাডপ্রেশার, এমলোডিপ নামের একটা ট্যাবলেট দেওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মায়ের দুই পা ফুলে উঠে ছিলো । স্যান্ডেল পরতে যেয়েই কল্লোলের মা আতিকা খাতুন একদিন দেখলেন পা স্যান্ডেলের মধ্যে ফিট হচ্ছে না, টাইট টাইট লাগছে। আতিকা খাতুন তার স্বামী মোহাম্মদ আলীকে ডেকে বললেন- ‘এই দেখো তো আমার পা দুটো কেমন ফুলে ঢোল হয়ে আছে।’
মোহাম্মদ আলী হাঁটু গেড়ে বসে প্রিয়তমা স্ত্রীর পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন, সত্যিই তো পা ফুলে আছে। আঙ্গুল দিয়ে পায়ের উপরি পাতায় চাপ দিতেই আঙ্গুলের অংশটুকু দেবে গেল! কল্লোল পাশেই ছিলো, সেও দেখল বিষয়টা।
কল্লোলের বাবারও ছিল হার্টের সমস্যা। হঠাৎ একদিন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে হার্টের বামদিকের নিচের কুঠুরির দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসাড় হয়ে যায়। পরিণামে দেখা দেয় হার্টফেইল্যুর। সেই হার্টফেইল্যুর নিয়েও অনেক বছর চিকিৎসায় ভালোই ছিলেন কল্লোলের বাবা মোহাম্মদ আলী। খুব পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ একাই করতেন। নিউ ইয়র্কে ওয়ালমার্ট স্টোরের ম্যানেজার ছিলেন। গায়ে অনেক শক্তি ছিল বলে, স্টোরের কাজ তদারকি করতে যেয়ে অনেক কাজ নিজেই করে ফেলতেন। অনেক ভারি কাজ, যেমন- হ্যান্ড ট্রাক কিংবা ট্রলি ডলিতে করে নিজেই মাল নামানো উঠানোর কাজ করতেন অনায়াসে। স্টোরের কালো কিংবা স্প্যানিশদের সাথে সমানতালে কায়িক পরিশ্রম করতে পারতেন। কাজ করতে তিনি ভালোবাসতেন। কাজে ফাঁকি দেওয়ার কোনো অজুহাত তার কাছে ছিল না। হার্টফেইল্যুরের পর ভারি কাজ করার ব্যাপারে নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ডাক্তারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কাজ পাগল মোহাম্মদ আলী তা মানতে চাইতেন না। নিজের সীমাবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করতে যেয়ে পৃথিবীর কাছেই তিনি অগ্রাহ্য হয়ে যান।
দুই.
বাবার মৃত্যুর সময় কল্লোল পঁচিশ বছরের যুবক। বাবার মৃত্যু তাকে খুব একটা বিমর্ষ করেনি। শুধু মনে হয়েছে পরিবার থেকে একটা লোক কমে গেছে। তার সবচেয়ে বিরক্ত লাগতো বাবার নীতিকথা। তাছাড়া সারাদিন কোথায় কী করলো, পড়াশোনার কী অবস্থা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? এইসব বিষয় ছাড়া অন্যকোনো বিষয় নিয়ে কোনো কথা বাবা বলতেন না। কল্লোল বুঝতে পারত, তার বাবার নিউ ইয়র্কের পড়াশুনার কায়দাকানুন সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই এতসব প্রশ্ন করে। আসলেই তাই ১৯৯০ সালে ওপি ওয়ান ভিসায় আমেরিকায় আসেন মোহাম্মদ আলী। দেশে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে একটা মনোহারি দোকান চালাতেন ময়মনসিংহের আকুয়া পাড়ায়। সেখান থেকে দিনরাত খেটে ওয়ালমার্ট পর্যন্ত পৌঁছালেও ছেলে কল্লোলের কাছে সেটা কোনো বড় অর্জন বলে মনে হয় নি। মা আতিকা খাতুন কাজ করতেন কফিশপ ডানকিনে। এখনও করেন।
কল্লোল, বাবার এই দুর্মর লড়াই, না বোঝারই কথা। তার জন্ম হয়েছে নিউ ইয়র্কে। মোহাম্মদ আলী ছেলেকে কোনো কষ্টই বুঝতে দিতে চান নি। শুধু চেয়েছেন ছেলে জীবনে অনেক বড় কিছু হোক। কল্লোলও পড়াশোনাটা মন দিয়েই করেছে। কিন্তু পিতা পুত্রের বন্ধনের সুতোটা কেমন যেন আলগাই রয়ে গেছে। কচিহাতে বাঁধা জুতোর ফিতা যেমন একটু পরেই খুলে যায়, অনেকটা তেমন। কল্লোল কলেজের পড়াশুনা প্রায় শেষ করে এনেছে, সাথে ইতোমধ্যে আইটি সংক্রান্ত একটা চাকরিও করছে। বাবা একটা বাড়ি রেখে গেছেন, যার মর্টগেজ মা-ই টানছেন। মাল্টি ফ্যামিলির বাড়ি। বেসমেন্ট আর এটিক ভাড়া দিয়ে যা পায় তাতেই মর্টগেজের খরচ উঠে যায়। কল্লোল বলতে গেলে ভালোই আছে। ভাবছে পড়াশুনাটা শেষ হলেই পুরোপুরি কাজের খোঁজ করবে। শুরুতেই হানড্রেড থাউজেন্ড স্যালারি, তারপর তাকে আর পায় কে।
বাবা মারা যাওয়ার পর কল্লোল অবাধ স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে। বাবার দিকদারি নেই। ফ্যামিলিতে সে-ই এখন সব। যেহেতু মোহাম্মদ আলী নেই তাই একাকীত্বকে ঢাকার জন্য আতিকা খাতুন আরও ব্যস্ত হয়েছেন। সোসাল সিকিউরিটি থেকে স্বামীর নামে বেশ ভালো একটা অর্থ তিনি পাচ্ছেন, সাথে বাড়ির তদারকি, নিজের কাজ তো আছেই। এইসব নিয়ে সময় কেটে যায় আতিকার। তবে বাবার প্রতি কল্লোলের নির্মোহতা তাকে ব্যথিত করে। বন্ধুদের সাথে কল্লোলের আড্ডা, হ্যাংআউট ইদানিং বেড়েছে। মাঝেমাঝে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। বিষয়গুলো আতিকার দৃষ্টি এড়ায় না। দু-একবার জিজ্ঞাসাও করেছেন- কী রে কল্লোল, এনি প্রবলেম?
উত্তরে কল্লোল ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলেছে- না মা। তুমিও কি বাবার মত ইন্টারোগেট করবে নাকি?
ছেলে বড় হয়েছে। তাই এরপর এ নিয়ে আর এখনি কথা এগুতে চায় না আতিকা। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মেঘ তার চারপাশটাকে আরও অন্ধকার করে ফেলে। তিনি ভাবছেন, এখনি কিছু করা দরকার, কিন্তু কী করবেন? ছেলেটা কি বিপথে চলে যাচ্ছে? এইসব ভাবনা আজকাল আতিকাকে চরমভাবে গ্রাস করে ফেলছে। তিনি ভাবছেন, কিছু একটা করা দরকার। কিছুদিনের জন্য কি বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসবেন!
তিন.
কল্লোল জুতোজোড়া খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেগুলো পায়ের সাথে এমনভাবে লেগে আছে যে, হাত দিয়ে টেনে খোলা গেল না। টাইট জুতো নিয়ে সে আর হাঁটতে পারছে না। অসম্ভব টাইট। মনে হচ্ছে পা দুটোকে চিপে আঙ্গুল বানিয়ে ফেলবে। চাপ সহ্য করতে না পেরে কল্লোল এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল একটা স্টোর। মধ্যরাতেও ভেতরে সামান্য আলো জ্বলছে। চোখে ঠিক মতো ঠাহর করতে পারছিলো না স্টোরটা কীসের? কিন্তু যেভাবেই হোক পা থেকে জুতোজোড়া খুলতে হবে। এজন্য সাহায্য দরকার। কল্লোল সাহায্যের আশায় এক পা, দু’পা করে স্টোরের কাছে পৌঁছে দরজা টান দিতেই দরজাটা বাইরের দিকে খুলে গেল। স্টোরে ঢুকে কল্লোল অবাক! এতে দেখি জুতোর দোকান। কাউন্টারে সৌম্য দীর্ঘাকায় এক বৃদ্ধ ভরাট কন্ঠে কল্লোলকে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বললেন- আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? উত্তরে কল্লোল তার পা ও জুতোর নিদারুণ অবস্থার বর্ণনা শেষে জুতোজোড়া পা থেকে খুলে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে বলল- প্লিজ, জুতোজোড়া থেকে আমাকে বাঁচান।
বৃদ্ধ শান্তভাবে এগিয়ে এসে কল্লোলকে একটা চেয়ারে বসালেন। তারপর নিজেও হাঁটু গেড়ে বসে আলতো করে তার জুতো দুটিকে আস্তে করে খুলে আনলেন। জুতো দুটি আলগোছে বৃদ্ধের হাতে মোমের মত গলে একেক করে এমনভাবে চলে এলো যে, কল্লোল কিছু টেরই পেলো না। অথচ এই জুতোজোড়া নিয়ে রাস্তায় কী ধস্তাধস্তিই না চলছিলো এতক্ষণ। জুতো খোলার সাথে সাথে কল্লোলের সব কষ্ট এক মুহূর্তে উড়ে গেল। কল্লোল তার প্রিয় জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখল, কী বিভৎস লাগছে দেখতে। ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে, কাদা ময়লায় একাকার। মনে হচ্ছে নর্দমা থেকে তুলে আনা হয়েছে।
কল্লোল এই দোকান থেকে একজোড়া নতুন জুতো নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বৃদ্ধ খুশি হয়ে তাকে জুতো পছন্দ করতে বললেন। কল্লোল একটার পর একটা জুতো দেখতে গিয়ে কল্লোল আরেক বিস্ময়ের মুখোমুখি হলো। কল্লোলের পায়ে দোকানের কোনো জুতাই ফিট হচ্ছে না। বৃদ্ধ নিজেও চেষ্টা করলো কিন্তু কোনো জুতোই কল্লোলের পায়ে ঠিকভাবে লাগছে না। কোনোটা ঢিলা, কোনোটা আঁটোসাটো, কোনোটায় পায়ে ঢুকছেই না। কল্লোল চিন্তায় পড়ে গেল, জুতো ছাড়া খালি পায়ে সে ঘরে ফিরবে কী করে?
কল্লোলের করুণ অবস্থা দেখে বৃদ্ধ আশ্বস্ত করে বললেন- আপনার হাতে সময় আছে তো?
কল্লোল হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে বৃদ্ধ বললেন- তাহলে অপেক্ষা করুন, দোকান খালি ফেলে কোথাও যাবেন না, দেখি করা যায়, বলেই কাউন্টারের ঠিক পিছনের দরজা দিয়ে তিনি ভিতরে চলে গেলেন।
বৃদ্ধ ওপারে চলে গেলে দরজাটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে দরাম করে বজ্রপাতের শব্দ হলো। দরজা বন্ধ এবং একইসাথে বজ্রপাতের শব্দে কল্লোল ভয় পেলো। কল্লোল টের পেলো বাইরে শব্দ করে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। বৃদ্ধের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে কল্লোলের মনে হলো বৃদ্ধ লোকটা বুঝি আর ফিরবে না। তার কিছুটা ভয় ভয়ও করছিলো। কিন্তু ক্লান্ত কল্লোলকে ভয়ের চেয়ে ক্লান্তিকেই গুরুত্ব দিতে হলো। অজান্তে দুচোখের পাতা বন্ধ হওয়ায় ঘুমের কাছে সমর্পিত হলো কল্লোল। কল্লোল কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো তা সে জানে না। হঠাৎ হাতের স্পর্শে হুড়মুড় করে জেগে ওঠে দেখে একজোড়া জুতো নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধ।
কল্লোল ঘুমের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেই বৃদ্ধ বললেন- ঠিক আছে, এই জুতোজোড়া আপনার পায়ে ফিট হবে। তবে জুতোজোড়া পুরনো, তাই পরিষ্কার করতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। তারপর কিছু একটা বলতে যেয়ে বৃদ্ধ থেমে গিয়ে কল্লোলের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
কল্লোল জুতোজোড়া পরতেই দেখল, সত্যিই তাই। খুব সুন্দরভাবে জুতোজোড়া তার পায়ে ফিট হয়েছে। এতো আরামের জুতো সে জীবনেও পরে নি। জুতোজোড়া পরার পর মনে হলো সে এখন অন্য মানুষ। তার চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বোধগুলো যেন এক এক করে জুতোর সংস্পর্শে জেগে উঠছে। সারাশরীরে একধরনের ভালোলাগার অনুভুতি, উদ্দীপনা এবং স্পৃহার আলোড়ন সে অনুভব করলো।
যদিও জুতোজোড়া পুরনো তবু কল্লোল অনেক খুশি। তাই সে বৃদ্ধকে জুতোর দাম মিটাতে চাইলে বৃদ্ধ দাম নিতে চাইলেন না।
তিনি বললেন- এটি একজন বিখ্যাত লোকের জুতো। উনি আমার কাছে রিপেয়ার করতে দিয়ে আর ফিরে আসেন নি। আমি জানি উনি আর ফিরে আসবেন না। এই জুতো থেকে আপনি অনেক উপকার পাবেন।
মাথায় একরাশ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে কল্লোল জিজ্ঞাসা করলো- এই জুতোজোড়া কার?
বৃদ্ধ বলল- আমি তাকে চিনি, নামও জানি না। তবে আমি তাকে ডাকতাম আলেকজান্ডার।
– মানে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট? প্রশ্ন করলো কল্লোল।
-শান্ত, ভারী কন্ঠে বৃদ্ধ এক শব্দে উত্তর দিলো- হ্যাঁ। কল্লোল অবাক হয়ে লক্ষ করলো ‘হ্যাঁ’ শব্দটি তার মাথায় কেমন যেন একটা প্রতিধ্বনির ঢেউ তুলে থেমে গেল।
বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিতে উদ্যত হতেই বৃদ্ধ বললেন- আজ রাতটা চাইলে আপনি থেকে যেতে পারেন। বাইরে অনেক বৃষ্টি। সাথে বাতাসও বইছে, অনেক জায়গায় পানি উঠতে পারে, এম্বার এলার্ট দেখেননি ফোনে?
কল্লোল এতক্ষণে বুঝতে পারে ফোনটা সে নাইটবারে ফেলে এসেছে। আজ একটু বেশিই পান করে ফেলেছে সে। মুখ দিয়ে তার প্রমাণ, গন্ধ হয়ে বৃদ্ধের নাকে অনেক আগেই পৌঁছে গেছে।
তাই বৃদ্ধ আবারও সসম্মানে বললেন- আপনি এখনও যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই, খানিকটা ভারসাম্যহীন, এই ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করার মত অবস্থায় আপনি নেই। কোনো বাস এদিকে নেই, উবার, লিফটও আসবে না। আপনি পথ ভুলে সঠিক পথে এসেছেন।
কল্লোলের মনে পড়ল, তাই তো! বার থেকে বেরিয়ে সবসময় সে বাস নেয় কিংবা ট্যাক্সি ডাকে। বারের সামনেই বাস স্টপেজ। আজই নেশার ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে অন্যকোথাও চলে এসেছে। বাস-ট্যাক্সি কিছুই ধরে নি। ‘আপনি পথ ভুলে সঠিক পথে এসেছেন’ বৃদ্ধের এই কথায় কল্লোলের একটু রাগ হলো। সে কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বাসার উদ্দেশে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন বৃষ্টির ফোঁটা নয়, জলের ধারা। মনে হচ্ছিল মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছে। নেশার ঘোর না কাটায় বৃষ্টি-বাতাস কল্লোলকে আরও টালমাটাল করে দিলো। রাস্তা পার হতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল কল্লোল।
চার.
সকালে ঘুম ভাঙতেই কল্লোল বুঝতে পারে সে একটা খুব আরামের বিছানায় শুয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে জায়গাটা হাসপাতাল। বামদিকে তাকিয়ে দেখে মা বসে আছে। আতিকা খাতুন কল্লোলের কপালে হাত রেখে বললেন- কেমন আছিস, বাবা?
– ভালো, আমি এখানে কীভাবে? জানতে চাইলো কল্লোল।
আতিকা খাতুন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লানমুখে পুলিশ যা বলেছে তার সারাংশ তুলে ধরে তিনি যা বললেন তা হলো-
রাত প্রায় দুইটার দিকে টহল দেওয়ার সময় পুলিশ তাকে রাস্তার মাঝ থেকে অর্ধচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ইমারজেন্সিতে নিয়ে এসেছে। তারপর কিছুক্ষণ থেমে আতিকা বললেন- ওরা তোর এলকোহল টেস্ট পজিটিভ পেয়েছে। তারপর হাসপাতালের ওরা তোকে ভর্তি করে নেয়। আমাকে খবর দেয়। কপাল ভালো, রাস্তায় গাড়ি ছিল না, তা না হলে গাড়িচাপা দিতে পারত।
আতিকা খাতুন ছেলেকে খুঁজে পেয়েই খুশি। তাই তিনি কল্লোলকে বললেন- যা হওয়ার হয়েছে, তুই ওসব ছেড়ে দে, বাবা। কথাগুলো বলেই কল্লোলের মাথার চুলে বিলি কেটে আদর করতে থাকলেন।
কল্লোল এখন সব মনে করতে পারছে। গতরাতে যা ঘটেছে সব, সব। কিন্তু মাকে সেইসব ঘটনা বলতেই হবে।
– মা, গতরাতের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু গতরাতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটা আমি না বলে পারছি না। কল্লোল কিছুটা বিমর্ষ, এবং চিন্তিত।
– কী অদ্ভুত ঘটনা, বল। আগ্রহভরে জানতে চাইলেন আতিকা।
ছেলের কাছ থেকে গতরাতের সব ঘটনা শুনে আতিকা খাতুন বললেন- সেই জুতোজোড়া কই?
উত্তরে কল্লোল বলল- আমি কী করে জানবো? নার্সকে জিজ্ঞাসা করো।
আতিকা খাতুন নার্সের কাছ থেকে আনা ব্যাগে কল্লোলের ভেজা কাপড়ের সাথে একজোড়া জুতোও পেলেন।
জুতোজোড়া হাতে নিয়ে বিস্ময়ে আতিকার চোখ কোটর থেকে ঝুলে পড়ার অবস্থা।
তিনি শুধু বললেন- এতো তো তোর বাবার জুতো!
– তুমি কীভাবে নিশ্চিতভাবে বলছো, এটা বাবার জুতো?
– এটা তোর বাবার প্রিয় জুতো। একবার ঈদে তোর বাবাকে ঠিক এমন একজোড়া আমি কিনে দিয়েছিলাম। কথাগুলো বলতে গিয়ে আতিকার কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
– আচ্ছা মা, এটা তো তোমার ভুলও হতে পারে, একইরকম জুতো তো অনেকেরই থাকতে পারে।
– পারে কিন্তু এটাকে অনেক আপন মনে হচ্ছে।
তাছাড়া এই জুতোজোড়া মারা যাওয়ার আগে তোর বাবা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সে নিয়ে আমার সাথে কী রাগারাগি। তারপর নিজেই কী মনে করে চুপ মেরে যান।
– মা বাবা কি নিজেকে আলেকজান্ডার মনে করতেন?
কল্লোলের এই প্রশ্নে আতিকা খাতুন একটু ভড়কে গিয়ে বললেন- কেন, বল তো?
– যেই লোকটা আমাকে এই জুতোজোড়া দিয়েছেন উনি এই জুতার মালিককে আলেকজান্ডার বলে ডাকতেন।
অকস্মাৎ একটা ক্ষীণকায় অতীত যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠির মাথায় দপ করে জ্বলা স্ফুলিঙ্গের মত আতিকার সামনে জ্বলে উঠলো।
– তোর দাদা তোর বাবাকে আলেকজান্ডার নামে ডাকতেন! ঐ লোকটা তা জানলো কীভাবে?
উত্তরে কল্লোল শুধু বলল- জানি না। মায়ের কথা শুনে কল্লোলের সারা শরীর যেন ঝিমঝিম করছে। কল্লোলের কানে বারবার দৃঢ় কণ্ঠে বৃদ্ধের আরেকটি কথা মস্তিষ্কের বাইরে সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে- ‘আমি তাকে ডাকতাম আলেকজান্ডার’।
কল্লোল ভাবছে লোকটা কে?
যা হোক আলেকজান্ডার নিয়ে মা-ছেলের কথা আর খুব একটা এগুলো না। কিন্তু কল্লোল বুঝতে পারছে না গতরাতে সে উডসাইডের একটা নাইটবারে গিয়েছিল কিন্তু তাকে পাওয়া গেল লিবার্টি এভিনিউতে। উডসাইড থেকে লিবার্টি এভিনিউ অনেক দূরের পথ। এতটা পথ সে হেঁটে কীভাবে এলো! জুতোর স্টোরটা কোথায় ছিলো তাও সে বুঝতে পারছে না। জুতোর মধ্যে পা আটকে যাওয়া, নতুন করে পুরনো জুতো পাওয়া। জুতোর মধ্যে পা রাখতে উদ্দীপনা, সবকিছুতে তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।
কল্লোলের এই বখে যাওয়া বন্ধ করতে নানান উপায় খুঁজছিলেন আতিকা। সেইসাথে অনেকদিন থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ঢাকার ফ্ল্যাট আর ময়মনসিংহের বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার। শুধু কল্লোলের দাদার বাড়ির অংশটা রেখে দেবেন স্মৃতি হিসাবে। নিজে বেঁচে থাকতে থাকতে কাজগুলো করে ফেলতে চান। উনি না থাকলে সব বেহাত হয়ে যাবে। তার স্বামী মোহাম্মদ আলী বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মারা যাওয়ার পর আত্মীয়পরিজনরা ওর পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার নানা চালাকি চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তিনি ভাবছিলেন সম্পতিগুলো বিক্রির ব্যবস্থা হলে কল্লোলকে নিয়ে বাংলাদেশে যেয়ে কিছুদিন থেকে কাটিয়ে আসবেন। তাতে কল্লোলের কিছুটা হাওয়াবদল হবে, সাথে মনের অবস্থার বদল হতে পারে। তারই অংশ হিসাবে ঢাকা ও ময়মনসিংহের বাড়ি দুটো বিক্রির ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছেন। তিনি ভাবলেন, এই বিষয়ে কল্লোলের সাথে কথা বলার এটাই উপযুক্ত সময়।
– কল্লোল, সুস্থ হলে চল তুই আর আমি বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের দুটো বাড়ি আছে বিক্রি করে দেবো, তা না হলে বেহাত হয়ে যেতে পারে। কে কখন দখল করে নেবে, কে জানে।
মায়ের বাংলাদেশ যাওয়ার কথায় কল্লোলের আবার গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মল জুতো কেনার কথা।
-আচ্ছা মা, আমি কখনো ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মলে গিয়েছি?
– গিয়েছিস তো, একবার আমরা বাংলাদেশে ঈদ করলাম না। তোর বাবাও ছিলো। তোর বয়স ১৩/১৪ হবে। তুই একজোড়া লাল পুমার কেডস কিনেছিলি। অনেক বায়না ধরেছিলি কেনার, জন্য। হঠাৎ বসুন্ধরা শপিং মলের কথা কেন বলছিস?
কল্লোল মায়ের কথার সদুত্তর না দিয়ে, উদ্ভ্রান্তের মতো পাশ কাটিয়ে বলল- হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে হলো, তাই বললাম।
কল্লোলের মাথাটা এখন ফুলস্পিডের ফ্যানের মত ঘুরছে। এই বুঝি সে জ্ঞান হারাবে।
শেষ কথা:
এই ঘটনার পর কল্লোলকে সায়াকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো। তার রক্তে এলএসডি পাওয়া গেছে। এলকোহলের সাথে এলএসডি নিতো সে। এলএসডি একটি হ্যালুসিনোজেন অর্থাৎ এটি হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রম সৃষ্টি করে। বুঝলাম, এলএসডি নানারকম বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেই বিভ্রমের মধ্যে কল্লোলের বাবার ডাকনাম ‘আলেকজান্ডার’, এবং তার জুতো, কিশোরবেলার বসুন্ধরা সিটি শপিংমল কীভাবে ঢুকলো? জুতোর দোকানের বৃদ্ধ আসলে কে? নাকি উনি গড়পড়তা কোনো মানুষ? এইসব বিষয়গুলোর রহস্য আমার কাছে এখনও রহস্যই রয়ে গেছে।
সায়কিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলে জানলাম, চিকিৎসার পর কল্লোল এখন সুস্থ আছে। আলেকজান্ডারের জুতো তার বোধদয় ঘটিয়েছে, চিকিৎসায় এই প্রেরণা সহায়তা করেছে। মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত আতিকা খাতুনেরও চিকিৎসা হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর মা-ছেলে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেছে। বাংলাদেশের একটা মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছে। আমার কাছে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কল্লোলের সেই রাতে কী হয়েছিল সেটা। এ নিয়ে সায়কিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, উনি পুরো ব্যাপারটিকে ওনার মতো করে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু ওনার জ্ঞানের যুক্তি ভেদ করা আমার কম্মো নয়। তাই আমি এখনও সেই আলেজান্ডারের জুতা নিয়েই পড়ে আছি। ভাবছি কল্লোলের কাছ থেকে একদিন জুতাটা ধার চাইবো।
সারাবাংলা/এসবিডিই
আলেকজান্ডারের জুতো ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ রহস্য গল্প সজল আশফাক সজল আশফাকের রহস্য গল্প 'আলেকজান্ডারের জুতো' সাহিত্য