Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিপ্লব


২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:১৪

ঊর্মি রহমানকে যে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা কয়েকদিন আগেও সে ভাবতে পারেনি। আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতো ওর ধারণা ছিল, মেয়েদের জীবনে বিয়ে একাধিকবার হয় না। হতে পারে না। এই শিক্ষা ওর ভেতর প্রোথিত করেছিলেন মা। ওর ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ নির্মাণে বাবার ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। বাবা-মা ওর কাছে বরাবরই দেবতূল্য।

গুণী বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ঊর্মি কেবল একটি গুণ পেয়েছে, যার নিচে চাপা পড়ে গেছে ওর অন্যান্য গুণাবলী। তা হলো নাচ করা। তিন বছর বয়সী ছোট মেয়েটিকে নৃত্য শেখার জন্য ওর বাবা বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য নৃত্যগুরুর কাছে পাঠিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বছরের পর বছর ঊর্মি মণিপুরি নৃত্য শিখেছে ছায়ানটে। নাচে বেশি সময় দেওয়ার কারণে ও একাডেমিক পরীক্ষায় কখনো তেমন ভালো করতে পারেনি। এজন্য বাবা-মা ওকে সামান্যও বকাঝকা করত না; বরং নাচের ব্যাপারে আরও উৎসাহ দিত। বাবা বলতেন, যে কাজই তুমি করো না কেন, সেখানে সেরা স্থানটি দখল করতে হবে; তবেই জীবন সার্থক।

পেছনে ফিরে তাকালে ঊর্মির অবাক লাগে। উনিশ বছরের একরত্তি মেয়ে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত পরিবেশ—সব ছেড়ে কেবল নাচের জন্য চলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। প্রেরণা মা-বাবাই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নাচ ছাড়া ঊর্মির কাছে পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন মনে হতো। গান, অভিনয়, ফরাসি ভাষা শেখা, বেহালা বাজানো, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় ছিল না যেখানে ওর বাবা নিয়ে যায়নি; কেন জানি কিছুদিন পর ওর আগ্রহ মিইয়ে যেত। তবু বাবা-মা ওর ওপর কোনো ধরনের চাপাচাপি বা রাগ করেনি; বরং তারা বলতেন তোমার যা ভালো লাগবে, সারা জীবন সেই কাজে ব্যস্ত থেকো; ওটাই জীবনের কাজ।
ঊর্মির ধারণা, যদি মন-প্রাণ দিয়ে নাচ করতে না পারত, ওর জীবন বৃথা হয়ে যেত। নৃত্য ছাড়া ওর জীবনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই; তেমন উল্লেখযোগ্য চাহিদাও নেই। চলমান ঘটনাগুলো কেবলই জীবনের অনুষঙ্গ; এমনকি প্রেম-ভালোবাসা ও বিয়ের মতো বিষয়ও। শৌনকের সঙ্গে প্রেম ও সম্পর্কচ্ছেদ এবং পিয়ালের সঙ্গে বিয়ে আর বিচ্ছেদও নিছক ঘটনা ছাড়া কিছু মনে হয় না। জীবন যতক্ষণ থাকবে, ঘটনাও সমান্তরালে ঘটতে থাকবে— জীবনকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মা-বাবার কাছেই পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পিয়ালের সঙ্গে বিয়েটা কাকতালীয় ছাড়া আর কী বলা যায়। অতশত হিসাব করে ঊর্মি বিয়ে করেনি; বিয়ে করেছিল অনেকটা জেদের বশে। তখন ওর মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না। শৌনক মুখার্জির ভূত মাথা থেকে নামানোর জন্য তড়িঘড়ি করে ঊর্মি নিয়েছিল এত বড় সিদ্ধান্ত। এ জন্য পস্তাতেও হয়েছে। এমনকি এখনো ওই চক্র থেকে বের হতে পারছে না।
শৌনকের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর পিয়াল ওর পাশে দাঁড়ায়; ধরতে গেলে ওকে নতুন জীবন দেয়। নতুন জীবন যে চক্রান্তের ফল, তা বুঝতে ঊর্মির অনেক সময় লেগে যায়। ততদিনে ও পিয়ালের স্ত্রী। বুঝতে পারলেও তখন আর কিছু করার ছিল না। পিয়ালের সঙ্গে বিয়ে হলেও ঊর্মি নিশ্চিত ও কখনো ভালোবাসতে পারেনি। ওর কাছে ভালোবাসা এত সহজ ও সুলভ বিষয় নয়।
ঊর্মির জীবনে একবারই প্রেম এসেছিল; সেই প্রেম শৌনক মুখার্জিকে ঘিরে। মুগ্ধতা, ভালো লাগা, ভালোবাসা সেখানে একাকার হয়েছিল; অথচ পিয়ালের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই ও টের পায়নি। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ঊর্মি বুঝতে পারছে শৌনক ছাড়া আর কোনো পুরুষকে ও ভালোবাসেনি। পিয়ালের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোকে শ্লেটের ওপরকার লেখার মতো মুছে দিতে পারলেই যেন ঊর্মি স্বস্তি ও মুক্তি পায়।
শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে একই বিভাগে পড়ার সুবাদে ঊর্মি শৌনকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ছোটবেলায় ওরা একই সঙ্গে ছায়ানটে নাচ শিখত; সেই হিসেবে পূর্বপরিচিত, তবে ওরা বন্ধু ছিল না। কিছুদিন না যেতেই ক্যাম্পাসের সবার মুখে মুখে রটতে থাকে ওদের প্রেমকাহিনি। প্রচলিত ছিল আদিরসাত্মক গল্পও। ওসব নিয়ে ওরা ভাবত না।

ঘুমানোর সময় ছাড়া ওরা সারাদিন একসঙ্গে কাটাত। ক্লাসে, আড্ডায়, পড়াশোনায়, বেহালা শেখায়, ঘুরে বেড়ানোয়, গুরুর কাছে তালিম নেয়ায় কখন যে সময় পার হয়ে যেত ঊর্মি টেরই পেত না। ওই দিনগুলো ওর কাছে স্বপ্নের দিন বলে মনে হয়।
বিশ্বভারতীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওরা দুজন পাখা মেলে উড়েছিল। কোন ফাঁকে যে বছরগুলো কেটে গিয়েছিল, ঊর্মি টের পায়নি। মনে হয় এই তো সেদিন ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ওরা শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল। ঢাকার ছেলেমেয়ে হলেও অনেকের মাথাব্যথার কারণ ছিল দুজনের ধর্ম। অথচ ওদের কারওরই এ নিয়ে বোধ ছিল না; বিষয়টি মাথায়ও আসেনি কখনো।
ঊর্মি তখন শৌনককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনানুষ্ঠানিক চুক্তিবদ্ধ ছিল ওরা। বিয়ে যার সঙ্গে হবে তাকে দেহ-মন উজাড় করে দিতে ও দোষের কিছুই দেখেনি। ওরা জানত ওদের মা-বাবা বিয়েতে আপত্তি করবে না। এজন্য কারও কথায় কর্ণপাত করত না ওরা।
শৌনকের বাবা বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিবিদ অর্পণ মুখার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে অর্পণ মুখার্জির নামডাক আছে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তার অন্য ভাইয়েরা বিভিন্ন সময় দেশ ছাড়লেও তিনি দেশত্যাগের ঘোরবিরোধী। বিয়ের আগে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে গিয়ে তিনি চাইলে থেকে যেতে পারতেন। অনেকে থেকে যাওয়ার কথা বলেও ছিল, তিনি কান দেননি; বরং তিনি বলতেন, দেশ ছাড়ার জন্যই কি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। তা ছাড়া পুঁজিবাদের প্রতি বিতৃষ্ণা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থনও তাকে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করেছিল।

শৌনককে তিনি গড়েছেন নিজ আদর্শে; শিখিয়েছেন মানুষের একমাত্র পরিচয়— সে মানুষ। মানুষ হতে হলে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সেখানে কোনো ভেদাভেদ রাখা যাবে না। এমন মনোভাবের কারণে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব অনেকেই তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। অবশ্য এই নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। তিনি বরাবর অটল থেকেছেন একলা চলো নীতিতে।
ঊর্মির মা-বাবা দুজনই সংস্কৃতিকর্মী; সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের নাট্যজগতের পরিচিত মুখ তারা। ঊর্মির মা রেহনুমা আফরোজ ও বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হকের ভাবশিষ্য। গুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা নিজেদের মরণোত্তর দেহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুদিন আগে উইল করেছেন।
মুক্তবুদ্ধিচর্চার দিক থেকে বিবেচনা করলে উভয় পরিবার মানবধর্মতত্ত্বে বিশ্বাসী; গতানুগতিক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের পদে পদে বিরোধ। পারিবারিক অনাপত্তি সত্ত্বেও ঊর্মির বিয়ে শৌনকের সঙ্গে হলো না; পড়াশোনা শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে ওদের বিচ্ছেদ ঘটে।
তখন কিছু বিষয়ে মতবিরোধের কারণে শৌনকের ওপর থেকে ধীরে ধীরে ঊর্মির মন উঠে যাচ্ছিল। সেই সুযোগ জায়গামতো কাজে লাগায় শৌনকের বন্ধু পিয়াল। পিয়াল ঊর্মির কাছে এমনভাবে শৌনকের বদনাম করে যে ঊর্মি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। যেমন শৌনক গাঁজা খায়, মদ খায়, অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন আরও কত কি। পিয়ালের প্ররোচণা ছাড়াও শৌনকের কিছু পরিবর্তন ঊর্মিকে সরে আসতে বাধ্য করে।

পিয়াল অর্থনীতির ছাত্র। তার হিসাব বেশ পাকা। যা সে চায় তা তাকে যেভাবে হোক পেতেই হবে। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর থেকেই ঊর্মির প্রতি পিয়াল দুর্বলতা টের পায়; শৌনকের কারণে তা প্রকাশের সুযোগ পায়নি। অবদমনের ভেতর দিয়ে পার করেছিল দিনরাত। ঈর্ষাকাতর প্রেমিক এমন কৌশলে অস্ত্র প্রয়োগ করে যে ঊর্মি শৌনকের কথা ভুলতে বাধ্য হয়; এমনভাবে বশে নিয়ে আসে যে পিয়াল বলতে ঊর্মি দিশাহারা। ঊর্মির মাঝে মাঝে মনে হতো পিয়াল ওকে হিপনোটাইজড করেছিল।
দেশে ফিরে ঊর্মি সিদ্ধান্ত নেয় যে পিয়ালকে বিয়ে করবে। বিয়ের ব্যাপারে মা-বাবার কাছ থেকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। ওর কোনো বিষয়ে তাদের অমত ছিল না; তাদের ধারণা, ও যেটা ভালো বুঝবে, সেটাই করবে। ওকে খুশি রাখা যেন মা-বাবার একমাত্র উদ্দেশ্য। কখনো ঊর্মির রাগ হতো এ জন্য যে বয়সের কারণে ও কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও মা-বাবা কেন তা শুধরে দেয় না।
একই ধর্মানুসারী হলেও দুই পরিবারের মতাদর্শ ভিন্ন। বিয়েতে কোনো সমস্যা না হলেও বিয়ের পর দুজনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক আদর্শ। মেয়ে নাচ করে বলে পিয়ালের মা-বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না। পিয়ালের জেদের কারণে মেনে নিতে বাধ্য হন। তারা ভালো করে জানেন পিয়াল যা বলে, তা-ই করে। শান্তিনিকেতনেও পড়তে গিয়েছিল মা-বাবার অবাধ্য হয়ে। ছোটবেলা থেকে ওর মধ্যে গোঁয়ার্তুমির ভাব প্রকট। সে জন্য মা-বাবা ওর সঙ্গে দ্বিমত করতে চান না; মেনে নেন তার সব ধরনের আবদার।

বিয়ের আগে ঊর্মি পিয়ালকে জানিয়েছিল, প্রোগ্রামের জন্য মাঝে মাঝে ওকে ঢাকার বাইরে, কখনো দেশের বাইরে যেতে হতে পারে। পিয়ালের তাতে আপত্তি ছিল না; তখন পিয়াল ছিল ঊর্মির প্রেমে অন্ধ। কিন্তু বাস্তবতা তো আর প্রেম মানে না; সংসার-সমাজের নিয়ম বলে তো কিছু আছে। বিয়ের পর কেবল পিয়ালের মা-বাবা নয়, পিয়ালও ঊর্মির বাইরে যাওয়া ও থাকার বিষয়টি মানতে পারে না। মধুচন্দ্রিমা কেটে যাওয়ার পর দুজনের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব; সেখানে অগ্নিতে ঘি ঢালে পিয়ালের মা-বাবা।
দিনে দিনে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। দূরত্ব যেন কিছুতে ঘোচে না। দুজন সহজভাবে আর কথা বলতে পারে না। প্রথমে একদিন। তারপর দুদিন। এমন করতে করতে একবার একটানা এক মাস ওরা একটাও বাক্য বিনিময় করেনি। ঊর্মি ইচ্ছেমতো বাসায় আসা-যাওয়া করত। পিয়ালের মা-বাবাও আর কিছু বলত না। এমন দমবন্ধ অবস্থায় ঊর্মি চিরতরে মা-বাবার কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রায় এক মাস পিয়াল কোনো খোঁজখবর না নেওয়ায় ঊর্মির জেদ আরও বাড়তে থাকে। এভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানে হয় না। ঊর্মি একপর্যায়ে পিয়ালদের বাসায় আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয় মা-বাবার পরামর্শে।

দুই.

ডিভোর্সের পর ক্যারিয়ারের কথা ভেবে ঊর্মি একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ও বুঝে গেছে ক্যারিয়ার গড়তে হলে সংসার নামক জেলখানায় আর প্রবেশ করা যাবে না। ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হবে ক্যারিয়ার। এজন্য থাকতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটাও ঊর্মি বুঝতে পেরেছে যে সামাজিকতার কারণে কারও মন জুগিয়ে চলা বা কারও কাছে নতজানু হওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রোগ্রাম আর প্রোগ্রামে ঊর্মির দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। প্রোগ্রামের জন্য সব সময় অনুশীলন করতে হয়। দেশে-বিদেশে প্রোগ্রাম লেগেই আছে। একটা শেষ হলে আরেকটা। উপার্জনও বাড়তে থাকে সমানুপাতিক হারে। সময়ের অভাবে অনেক আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানও করতে হয়। সেই সঙ্গে ঊর্মি চালাচ্ছে নাচের স্কুল নৃত্যধারা আনন্দনিকেতন। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। শান্তিনিকেতনে গুরুর কাছেও যেতে হয় প্রতি বছর। সব মিলিয়ে ব্যস্ততার মোড়কে ঢাকা ওর প্রতিটি ক্ষণ।
এর মধ্যে ঊর্মি আর শৌনক বাংলাদেশের পক্ষে এক প্রোগ্রামে দলীয় নৃত্যে অংশগ্রহণের জন্য দিল্লিতে আমন্ত্রণ পায়। এই খবর বেশ ফলাও করে ছাপা হয় সব কটি উল্লেখযোগ্য জাতীয় দৈনিকে। দিল্লি যাওয়ার কিছুদিন আগে ওর সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে শৌনক। একসঙ্গে যাওয়ার খবর শুনে ও প্রথমে অংশগ্রহণ না করার কথা ভাবলেও পরক্ষণে ব্যাপারটিকে ছেলেমানুষি ভেবে হেসে উড়িয়ে দেয়। আরো ভাবে, জীবনে চলার পথে অনভিপ্রেত ঘটনা মনে রাখা উচিৎ নয়; জীবনকে জীবনের নিয়মেই চলতে দিতে হয়। সময়ই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এত বড় আয়োজনে আমন্ত্রণ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলে ওর মা যেতে উৎসাহিত করে। সবদিক চিন্তা করে যথাসময়ে আয়োজক কর্তৃপক্ষকে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় ঊর্মি।

ঊর্মি না রাখলেও শৌনক ওর সব খবর রাখত। ঊর্মির বিচ্ছেদ ওকে দগ্ধ করে তিলে তিলে। ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে শুধরে নিয়েছে শৌনক। বেশ কয়েকবার ঊর্মির সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চাওয়ার কথাও ভাবে শৌনক। দিল্লির প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ শৌনকের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করে; সে ভাবে ঊর্মির ভুল ভাঙানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ। প্রথমে ঊর্মি এড়িয়ে চললেও শেষ পর্যন্ত শৌনককে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। ওর মনের অন্দরমহলে শৌনক ঠিক ঘাপটি মেরে বসেছিল।
দিল্লিতে প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার সময় ঊর্মির মধ্যে পুরোনো প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দলের সবাই মিলে যখন আগ্রার তাজমহল দেখতে যায়, সেখানে শৌনকের পুনর্বার প্রেম নিবেদনে ঊর্মি সাড়া না দিয়ে পারে না। নিজেকে প্রশ্ন করে ঊর্মি বুঝতে পারে ও আর ঠকার পক্ষপাতী নয়; মনের কথাই শুনতে হবে। আগামীতে আর কোনো ভুল করা চলবে না।
দিল্লি থেকে দেশে ফিরে দুজন দেখা করে। একবার নয়। একাধিকবার। অবসর সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায় ওরা। বাইরে দেখা হলেই মনে পড়ে শান্তিনিকেতনের আনন্দময় দিনগুলোর কথা। বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ওরা। কত মধুর ছিল সেসব দিন, ভাবলেই রোমাঞ্চ জাগে মনে। শরীরেও। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ভাবনাহীন সেইসব দিনগুলোতে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরেফিরে দিন কাটালেও বিয়ের কথা ঊর্মি ভাবে না। শৌনকের কথার জবাবে ও জানায়, বিয়ে জীবনে একবারই হয়। তবু শৌনক আশা ছাড়ে না। সে বলল, আমি বাকি জীবন তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই; তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে ঊর্মি হাসে, কাটুক না দিন হাসি-আনন্দ আর নাচে-গানে। জীবন তো একটাই।

তিন.

পিয়ালের সঙ্গে ডিভোর্সের পর বিয়ে নামক প্রথাটিকে ঊর্মি ঘৃণা করতে শুরু করে। মনে মনে ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, কখনো যদি বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তবে এমন কিছু করবে যাতে সমাজ একটা ধাক্কা খায়। এই নষ্ট সমাজের প্রতি ওর ন্যূনতম সহানুভূতি নেই। যে সমাজে মানুষের ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও মানবিক অনুভূতির মূল্য নেই, সেই সমাজের তোয়াক্কা করার কোনো মানে হয় না। সমাজের প্রতি ঊর্মির ঘৃণা এ জন্য যে, ও যখন ডিভোর্সের পর বাবার বাড়িতে ফিরে যায়, তখন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব আকারে-ইঙ্গিতে ওকে কটু কথা শোনায়। ও কাউকে বোঝাতে পারেনি যে জোর করে এক ছাদের নিচে বাস করার নাম সংসার নয়।
শৌনকের বিয়ের প্রস্তাব ঊর্মি অগ্রাহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয় শৌনকের বাবার কারণে। ঊর্মি স্বধর্মী নয়, তার ওপর ডিভোর্সি—এসবের কারণে শৌনকের বাবার বিয়েতে আপত্তি নেই; শৌনকের আগ্রহকে তিনি আরও উৎসাহিত করেন। তিনি চান, ওদের বিয়ে হোক।

অর্পণ মুখার্জি সারা জীবন যে সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন, শৌনক-ঊর্মির বিয়ে হবে তার সফল পরিণতি। ঊর্মিকে ডেকে বোঝান, দেখো মা, জীবন একটাই। মানুষের উচিত সে জীবনের সদ্ব্যবহার করা। একে নষ্ট হতে দিওনা। আমি যতদূর জানি, তুমি একজন পুরুষকেই ভালোবাসো। সে শৌনক। শুধু শুধু নিজেকে কেন বঞ্চিত করছো? নিজের মনের কথা শোনো।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঊর্মি প্রতিবাদ করে, আমি ডিভোর্সি। আবার আপনাদের ধর্মেরও নই। আমার জন্য আপনাদের সমাজচ্যুত হতে হবে। এটা আমি মেনে নিতে পারব না। শৌনক আমার বন্ধুই থাকুক। বন্ধুত্বের মাঝখানে ধর্ম দেওয়াল হতে পারে না।
ঊর্মির কথায় শৌনকের বাবা প্রথমে দমে গেলেও পরক্ষণে বললেন, আমি যে সমাজবিপ্লবের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম, তোমাদের বিয়ের মাধ্যমে তার বাস্তব রূপায়ণ করতে চাই। আমার অনুরোধটুকু রাখো।
ঊর্মি আর কিছু বলার জন্য ভাষা খুঁজে পায় না।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প পলাশ মজুমদার পলাশ মজুমদারের গল্প 'বিপ্লব' বিপ্লব সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর