Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ম্যাগ


২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:৫৮

ক.

কী নেবেন— চা না সরবত?
একজন সাহিত্যিক আমার কাছে জানতে চাইছেন, কী পান করব— চা নাকি সরবত। বেশ মজা লাগল। আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। এরকমটা যে হয় তা জানা ছিল না।
আমি যেমন সংকোচ করে থাকি, ঠিক সেইভাবে বললাম, না না কিছু লাগবে না।
তিনি বললেন, তা কি হয়?
এই বলে বেশ জোরে আওয়াজ দিলেন, সোফি! চা দিয়ে যাও আমাদের।
সোফি নিশ্চয়ই এ বাড়ির কাজের লোক। নাম শুনে মেয়েই মনে হচ্ছে। সোফি কি সুন্দরী?
ভদ্রলোকের নাম নির্বাণ চক্রবর্তী। মূলত উপন্যাস লেখেন। সেই সঙ্গে ছোটগল্পের বই আছে চারখানা। কবিতা লেখেন কম। তবে দৈনিক কাগজে উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন নিয়মিত।
সোফি কাচের কাপে টকটকে লাল চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। এইভাবে সে বহুবার যে চা নিয়ে প্রবেশ করেছে এই ঘরে তার চলন দেখে বোঝা যায়। সোফি কিশোরি। গায়ে ওড়না নেই। চুল প্লাস্টিক গার্ডার দিয়ে বাঁধা।
তাহলে আমাদের কথোপকথন এবার শুরু করা যাক? নির্বাণবাবু বললেন।
তিনি পরে আছেন ঢোলা পায়জামার সঙ্গে ঢিলে পাঞ্জাবি। পায়জামা সাদা, পাঞ্জাবি সবুজ। চোখে চশমা। বামপায়ের উপর ডান পা তুলে বসেছেন সোফায়। হাতে একটু পুরোনো দিনের ঘড়ি।
আমি বললাম, আমাদের এবারের রবিবাসরীয় সংখ্যায় শুধুমাত্র আপনার সাক্ষাৎকার থাকবে।
জানি। আপনার সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়েছে।
আচ্ছা।
আমার লেখা আপনি পড়েছেন তো?
সাংবাদিকদের কাজই হল পরচর্চা করা, আমি হাসলাম।
ভদ্রলোকও হাসলেন।
আপনার লেখাই শুধুই পড়িনি, আপনার অনেক ব্যক্তিগত তথ্যই এখন আমার মুখস্থ।
বেশ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বারান্দায় কেউ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। সোফি নিশ্চয়ই। একটা বড় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে সিলিং থেকে। সকলেরই চোখে পড়বে। এমন ঝাড়লণ্ঠন এখন আর কোনো বাড়িতে থাকে না।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন শুরু করতে যাব, এমন সময় বাড়ির সদর দরজা ঠেলে একটি মেয়ে প্রবেশ করল। জিনসের সঙ্গে কুর্তি পরে আছে সে। বয়স একুশ বাইশ। কলেজ থেকে ফিরছে বোঝা যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ। বেশ সুন্দরী। চোখে গাঢ় করে কাজল লাগানো।
আমার মেয়ে, সঞ্চারী। ও প্রেসিডেন্সিতে সোশিওলজি নিয়ে পড়ে। থার্ড ইয়ার, বললেন ভদ্রলোক।
আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। নির্বাণ চক্রবর্তীর মেয়ের তথ্য আমার কাছে আছে। দেখলাম প্রথম।
চোখ নামিয়ে বললাম, এই মফস্বল থেকে রোজ কলেজ স্ট্রিট যেতে ওর অসুবিধা হয় না?
ভদ্রলোক বললেন, আমি শহরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। ও-ই যেতে চাইল না। ওর তো মা নেই। এখানে নাকি মায়ের ছায়া আছে। সেই ছায়া ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না।
আপনার বাড়িটা সুন্দর, প্রশংসা করলাম। মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।
তিনি বেশ আনন্দ পেলেন বোঝা গেল।
আরেক কাপ চা বলি?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি চিৎকার করলেন, সোফি!
সোফি যেন এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। মলিন মুখ।
আরো দু কাপ চা দিয়ে যা। আদেশ দিলেন নির্বাণবাবু।
আমি বললাম, আর চা খাব না। আজ একটু তাড়া আছে। কয়েকটা কপি লিখতে হবে অফিসে ফিরেই। আরেকদিন আসব। আপনাকে শুধু বলি, সাক্ষাৎকারটি যেহেতু বেশ বড়, তাই আমি এটা কয়েকদিন ধরেই নিতে চাই। একদিনে সবটা নয়।
তিনি সোৎসাহে বললেন, ভালোই তো। কোনও আপত্তি নেই।
বেরনোর আগে দেখি, সঞ্চারী সুন্দর একটি ঢিলেঢালা পোশাক পরে পাশের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ফোন বাজছে। মেয়েটিকে সত্যিই ভারি মিষ্টি দেখতে। ও কি ওর মায়ের মতো হয়েছে?
বাড়িতে নির্বাণবাবুর স্ত্রীর কোনও ফটো দেখতে পেলাম না ।
সোফি শুধু দরজার পর্দা ধরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

বিজ্ঞাপন

খ.

রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে নির্বাণ চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস নিয়ে বিছানায় গেলাম। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী গনেশ পাইন। স্যাফ্রন, হলুদ আর আধিদৈবিক সব মুখের ছবি।
একটি অনুচ্ছেদে লেখক লিখছেন— রতন চায়নি তার মেয়ে হোক। সে দাবাড়ু হতে চেয়েছিল। তার ছেলে বড় হয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। রতন সন্তানের জন্মের আগেই হলুদ জামা আর নীল প্যান্ট কিনে এনেছিল। কিন্তু রতনের স্ত্রী জন্ম দিল একটা কন্যাসন্তান। রতন ভদ্রলোক, জ্যোতিষে বিশ্বাসী। সে মেনে নেয়। শুধু প্ল্যান করে, এই স্ত্রীলোকটিকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে বইটার কোথায় পড়ছিলাম সেটা আর খুঁজে পাই না। তা নিয়ে কোনো উদ্বিগ্নতাও নেই আমার।
রোদের সঙ্গে সঙ্গে চা চলে এসেছে আমার পড়ার ঘরে। মা এখনও সকালের চা-টা দেয়।
মাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা তোমাকে কী ফুল দিত মা?
মায়ের মেজাজ আজ ভালো। বলল, ফুল নয় রে, কাচের চুড়ি কিনে দিত।
কী সস্তায় প্রেম হয়ে যেত তোমাদের মা!
কিন্তু প্রেমটা সস্তা হত না, এখনকার মতো।
মা চলে গেল হাসতে হাসতে। শুধু বলল, কেউ জুটেছে নাকি বেড়ালের কপালে?
মা জানে তার বেড়ালটা অকর্মণ্য, ইঁদুর ধরে আজও খেতে শেখেনি বলে নিরামিষ ভোজনের প্রচারক হয়েছে। মাকে আজ খুব ফুটফুটে লাগল। মা কিন্তু স্নো পাউডার কখনো মাখে না। হাতে এখনও কাচের চুড়িই পরে।
মুশকিল হল অন্য জায়গায়।
নির্বাণ চক্রবর্তী সম্বন্ধে আরও পড়াশোনা করে জানলাম, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। কারণ অজ্ঞাত। খ্যাতনামা লেখক বলে সব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কেস হয়নি।
এমন কি পোস্টমর্টেমও না।
আরও নানা তথ্য জানতে পারছি কিন্তু সম্পাদক বলেছে, নির্বাণবাবুর লেখক সত্তাকে তুলে আনতে হবে সাক্ষাৎকারে। ব্যক্তি নির্বাণ চক্রবর্তী নিয়ে তার কোনো আগ্রহ চোখে পড়ল না। ষাটের দশকের এই লেখক আর কোন কোন লেখকদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তা জানতে হবে। মানে গল্প বের করে আনতে হবে।
আজ এক জায়গায় যেতে হবে আগে। তারপর নির্বাণ চক্রবর্তীর বাড়ি।
আমি স্নানে ঢুকে পড়লাম।
ট্যাঙ্কে জল নেই।

গ.

কলেজ স্ট্রিটের গাছের পাতা গরমে শুকিয়ে উঠছে। সরবতের বরফ ক্রমাগত ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। ভিড় খুব। মেয়েরা লাল হলুদ গোলা খাচ্ছে। কিন্তু যে মেয়েটিকে আমার দরকার সে কলেজ থেকে এখনও বের হচ্ছে না।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে বেরিয়ে এলো সঞ্চারী। আজ তার পরনে জিন্স টপ। মাথায় ছাতা।
এগিয়ে গেলাম।
চিনতে পারছেন? গতকাল আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।
সে চিনতে পেরেছে। একবার চোখাচোখি হয়েছিল, তাতেই সে চিনতে পারছে। স্মৃতি ভালো।
খুব শান্ত গলায় বলল, বলুন।
এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। চলুন কোথাও বসি।
প্রায় অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি তো বসি না। সে বলল।
কোনো ক্ষতি করব না আপনার। আসলে আপনার বাবার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে আমাদের কাগজে। তাই আপনার সাহায্য দরকার।
বাবার ইন্টারভিউয়ে আমি কী সাহায্য করতে পারি?
পারেন, অনেক সাহায্য করতে পারেন।

একটি কফি শপে আমরা মুখোমুখি বসলাম। ওকে ভারি সুন্দর লাগছে।
বললাম, আপনাকে ভারি সুন্দর লাগছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করতে চান? তাহলে বলি, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
না না, তা নয়। বলতে ইচ্ছে হল তাই বললাম। ভাবলাম, আপনি খুশি হবেন।
এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। যাই হোক, বলুন।
সরি।
সরি বলার প্রয়োজন নেই। বলুন কী জানতে চান।
আচ্ছা, আপনার মা কীভাবে মারা গেলেন?
প্রশ্ন শুনেই সঞ্চারীর মুখ গোমড়া হয়ে গেল।
আমি কিন্তু আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।
সে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, জল খাবেন?
আমার কাছে জল আছে।
পুরো বোতল নিঃশেষ না করেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। কিন্তু আপনি এত কুণ্ঠিত কেন?
কেউ যাতে শুনতে না পায় সেভাবে মুখ ঝুঁকিয়ে সে বলল, মায়ের মৃত্যু নিয়ে…
বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। বলল, আজ উঠি, অন্য একদিন বলা যাবে।
কফি পান না করেই সে উঠে চলে গেল।
মেয়েটিকে বিষন্ন করে দিয়ে আমার বেশ হালকা লাগছে।

ঘ.

পত্রিকার সম্পাদক ডেকে জানতে চাইলেন সাক্ষাৎকার কতদূর। সম্পাদক ভদ্র সভ্য মানুষ। লম্বা সাদাটে জুলফি, ব্লেজার পরেন। সেই একই নীল ব্লেজারটাই। রোজ। হাতে সব সময় সিগারেট জ্বলে।
শিগগিরই হাতে পাবেন।
তাকে আশ্বস্ত করলাম।
তিনি আবারও জোর দিলেন, আমার কিন্তু ষাটের দশকের সাহিত্যিক মহলের গল্প চাই, মনে আছে তো?
হ্যাঁ, মনে আছে।
কী বললেন এ পর্যন্ত?
তার প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উপন্যাসকার বিজলি দেবীর বাড়ি ফেলে এসেছিলেন। কত ভালো উপন্যাস তা আপনি জানেন। বিজলি দেবীর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। তিনি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক রফিকউদ্দিন সাহেবের কাছে যান। উৎসব সংখ্যায় ছাপার জন্য নির্বাচিতও হয়ে যায় সেটা। নির্বাণবাবুর তখন পাগল হবার দশা। প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা যে বাজারে হিট করত সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। পরে হিটও করেছিল, আপনি জানেন। প্রথম উপন্যাসেই খ্যাতির চূড়ায়। তো যাই হোক, রফিক সাহেব একদিন নির্বাণবাবুকে জানান যে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন বিজলি দেবী। তিনি নির্বাণবাবুকে পড়তে দিতে চান। তারপর সব জানাজানি হয়ে গেল।

এ গল্পটা তো আমি জানতাম না। কতটা জানাজানি হল তাহলে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন সম্পাদক মশাই।

আসলে এই গল্পটি আমার বানানো। এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তাছাড়া, আমাদের সাক্ষাৎকার পর্ব তো এখনও শুরুই হয়নি। সেটা বলতে না পেরে এই গল্প ফাঁদতে হল।

সম্পাদক মশাই সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে ইন্টারভিউটা হিট করে যাবে।

জোর দিয়ে আমি বললাম, নিশ্চয়ই হিট করে যাবে।

গল্প গল্প। পাঠকের গপ্পো চাই।

দারুণ আর চমকপ্রদ গল্প এনে দেবো আপনাকে। নিশ্চিন্ত থাকুন।

এটা বাজার খেয়ে গেলে আপনার পরের অ্যাসাইনমেন্ট হবে কবি সুবিনয় ঘোষ।

দারুণ। আমার কাছে সাক্ষাৎকার একটা ইনভেস্টিগেশনের মতো।

আপনি ফিকশনটাও ট্রাই করতে পারেন।

চিন্তা করবেন না, আমি একটা ফিকশনের মধ্যে দিয়ে এখন যাচ্ছি।

সম্পাদক মশাই মৃদু হেসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। এখন আমাকে একটা সুরভি দেওয়া পান খেতে হবে।

ঙ.

নির্বাণবাবুর বাড়ির একটু দূরে যে বাজার সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। নটা বাজে। জানি এই সময় সোফি আসবে বাজার করতে।
আমাকে দেখে সোফি একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর স্বভাবসুলভ মিষ্টি করে হাসল।
স্টেশনারি দোকানের পাশে সোফিকে ডেকে ওর হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে বললাম, খাও।
প্রথমে নিতে সংকোচ করলেও তারপর সহজ হয়ে নিল প্যাকেটটা। কিন্তু খেল না, ধরে রইল হাতে।
আমি বললাম, সোফি, তুমি কতদিন ওই বাড়িতে কাজ করছো?
৩ বছর।
তার আগে?
আমার বাড়ি গ্রামে। আমরা তিন বোন। স্যার আমাকে এখানে এনে রেখেছেন। আমার বিয়ে দেবে। সব খরচ করবে।

তুমি বাবুকে স্যার বলে ডাকো?

উনি আমাকে স্যার বলতে বলেছেন।

তোমাকে কি পড়ান অবসর সময়ে?

অবসর মানে?

অবসর মানে যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না।

না, পড়ায় না।

দিদিমণি কেমন?

ভালো।

তোমাকে ভালোবাসে?

হ্যাঁ।

স্যার তোমাকে ভালোবাসে?

এই প্রশ্নে সোফি বেশ হকচকিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকালো। তারপর কেঁদে ফেললো।

আমি খুব নরম ভাবে বললাম, কী হয়েছে সোফি?

সে কিছু না বলে, কিছু না কিনে বাড়ির দিকে দৌড় মারল।

আমি তার মলিন ফ্রকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দৌড়ে যাওয়া লক্ষ করলাম।

দাদা, একটা চা দিন তো।

চ.

আজ বুধবার। লু বইছে সকাল দশটা থেকেই। রাস্তায় সবাই নাকমুখ ঢেকে চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে, সৌদি আরবে এসে পড়েছি। পাসপোর্ট আছে তো? একবার পকেটে হাত গেল তারপর মনে মনে হেসে ফেললাম।

নির্বাণবাবুকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি আর তিনি প্রসন্ন মুখে তার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
কীভাবে লিখতে শুরু করলেন, তার বাল্যকাল কেমন কেটেছে, কাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছেন, একই সঙ্গে সাহিত্যের এতগুলো সংরূপ কীভাবে সামলান, উপন্যাস কীভাবে শুরু করেন —কীভাবে শেষ করেন, সমাজ নিয়ে তার কী ভাবনা, তার লেখায় নারীরা কেন এত অবহেলিত, ইত্যাদি সব প্রশ্ন।
তবে নারীদের প্রসঙ্গে এসে তিনি এক অদ্ভুত গল্প শোনালেন।
গল্পটি সংক্ষেপে এরকম—
তিনি মায়ের স্নেহ পাননি। তার জন্মের কয়েক মাস পরে তার মা অন্য এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যান। মায়ের মুখ ভালো করে তার মনে পড়ে না। সেই ছোট থেকেই তার বাবা তাকে মাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। শেখাতেও হয়নি, মায়ের প্রতি ঘৃণাটা সহজভাবেই এসে গিয়েছিল তার মধ্যে। বাবা আর বিয়ে করেননি। অনেক পরে, যখন তিনি কলেজে পড়েন তখন খবর পান যে, তার মা অন্য আরেকটি পুরুষের সঙ্গে তখন ঘর করছে।
বাবা তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনিও একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ে জিনিসটাকে ঘৃণাই করতেন।
তারপর সঞ্চারীর মায়ের সঙ্গে হঠাৎ প্রেম হয়ে যায়। তার বাবাও প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন।
তার খালি মনে হত সঞ্চারীর মা তার মায়ের মতো কারো সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের অদ্ভুত লীলা। সঞ্চারীর জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করে বসেন।
নারীদের তিনি তাই সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন বলে আর ভালোবাসতে পারেননি।
যাই হোক, আরও নানা প্রশ্নের পর আমি বিদায় জানিয়ে অফিসে ফিরে এলাম।
সম্পাদক মশাইকে বললাম শনিবার রাতে কপি জমা দেবো।
তিনি আরেকটি হিট সাক্ষাৎকারের আশায় নারাজ ভাবে শুধু বললেন, বেশ।

ছ.

সোমবার। পত্রিকার দপ্তরের ফোনগুলো ক্রমাগত বেজে চলেছে। অসংখ্য প্রশ্ন পাঠকদের। এ কীভাবে সম্ভব। এতদিন পর এসব আবার কী! যা ছাপা হয়েছে রবিবাসরীয় সাক্ষাৎকারের জায়গায় তা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার। একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের এখনই জেল হয়ে যাবে। লেখকের স্ত্রীর ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতার ছবিও ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি লেখক সম্পর্কে নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সম্পাদক মশাই বিচলিত। আমাকে ডেকেছেন তার ঘরে। বেশ গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার উপর ভরসা করে সাক্ষাৎকারের কপি না দেখে ছাপতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এসব আপনি কী লিখেছেন?

একবর্ণ মিথ্যে লিখিনি স্যার।

এখন যদি নির্বাণবাবু পত্রিকার বিরুদ্ধে কেস করেন তাহলে কী হবে?

আমার কাছে যথেষ্ট এভিডেন্স আছে। অযথা চিন্তা করছেন।

কিসের এভিডেন্স যে তিনিই তার স্ত্রীকে খুন করেছেন? আর কাজের মেয়েকে রেপ করেছেন দিনের পর দিন?

হ্যাঁ। তিনি একজন খুনি এবং রেপিস্ট।

কী সব বলছেন আপনি? কোথায় আপনার এভিডেন্স?

শুনুন তাহলে—
প্রথম দিন নির্বাণবাবুর কাজের মেয়ে সোফি, তার নিজের মেয়ে সঞ্চারী মুখ খুলতে চায়নি। তারপর আমি আবারও তাদের আলাদা আলাদা ভাবে মিট করি। সঞ্চারী আমার প্রেমে পড়েছে। সে তার বাবার সব কথা আমাকে বলে দেয়। এমনকি তার মায়ের যে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা নির্বাণবাবু তার দেরাজে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন সেটাও সে আমাকে দিয়েছে। সেই ডায়েরিতে সঞ্চারীর মা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তাকে তার স্বামী খুন করে ফেলবে। যেদিন তিনি ওই ডায়েরি লিখেছেন তার দু দিন পরে তার ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটে। শুধু তাই নয়, খুনের হুমকির কথাও ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন লেখকের স্ত্রী।

সঞ্চারী নিজেও জানত না যে তার বাবা সোফিকে নির্যাতন করে।
সোফির জবানবন্দি টেপ করে যখন তাকে শোনাই সে আকাশ থেকে পড়ে এবং শুধু তাই নয়, তার বাবার কুকর্ম এক রাতে সে দেখেছেও তারপর।
মায়ের শোক সে ভুলেই ছিল কিন্তু সোফির যন্ত্রণা তাকে আবার তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে এখন তার বাবার শাস্তি চায়। কোর্টে বয়ান দিতেও তার আপত্তি নেই।

সম্পাদক মশাই ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। চোখ এসি মেশিনটার দিকে বোধ হয়। কী বলবেন, কী করবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না।

আপনি গল্প চেয়েছিলেন না?

কিন্তু…

এই হল গল্প। ষাটের দশকের একটি খুনের গল্প যার এই একুশ শতকের প্রথম দশকে নিষ্পত্তি হল।
পরের সাক্ষাৎকারের কাজটা কি শুরু করব?

সম্পাদক স্যার প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে বললেন, আগে একটা রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে যান।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প জিয়া হক জিয়া হকের গল্প 'ম্যাগ' ম্যাগ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর