Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পিতৃঘাতী


২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:০৪

হঠাৎ গর্তে ঢুকে যায় মোকাররমের সাইকেলের চাকা।
প্রচণ্ড জোরে একটা ঝাঁকুনি খায় সে।
তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে যায় ডানদিকে।
রাস্তার পাশের জমিতে সার দিচ্ছিল আবুল কালাম। কারও পড়ার শব্দ শুনে সে কাজ থামিয়ে পেছনে তাকায়। মোকাররম তখন মাটি থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে হাঁটুতে প্রচণ্ড চোট লাগায় দাঁড়াতে পারছে না। আবুল কালাম সারের বোলটা ক্ষেতের আইলে রেখে এক দৌড়ে ছুটে আসে মোকাররমের কাছে। মোকাররম তাকে দেখে লজ্জা পেয়ে যায় এবং উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হলেও মোচড় মেরে উঠে যায়। আর মুখমণ্ডলে এমন একটা ভাব আনে, যেন সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া ধরাধামের সর্বাপেক্ষা অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
: এইটা কোনও কথা? তোর মতো মানুষ আবার সাইকেল থেইকা পইড়া যায় গা ক্যামনে?
: চালাই সাইকেল, সাইকেল থেইকা পড়মু না তো বিমান থেইকা পড়মু?
: সেইটা তো বুঝলাম। কিন্তু তোর মতো মানুষ ক্যামনে পড়ে?
: সবাই যেমনে পড়ে, আমিও তেমনেই পড়ছি। নতুন কোনও তরিকায় পড়ি নাই।
: যারা পড়ে, তারা বাচ্চা পোলাপাইন। নতুন নতুন চালায় বইলা পড়ে। তুই তো চালাইতে চালাইতে বুইড়া হইয়া গেছস গা। তুই পড়বি ক্যান?
: ক্যান পড়মু, সেইটা গবেষণা কইরা পরে জানাইতাছি। তুই যোগাযোগ রাখিস। এখন যা, যেই কাজ করতেছিলি, সেই কাজে যা।
: তুই যাস না ক্যারে?
: আমার এইখানে কাজ আছে।
: কাজ আছে? নাকি পইড়া হাঁটুর বাটিবুটি ছুটায়া লাইছস! যেই কারণে এখন আর হাঁটতে পারতাছস না? হাঁটতে না পারলে ক, আমি তোরে বাড়িতে পৌঁছায়া দিয়া আসতাছি।
: ফাউল কথা কওয়ার খাসলত তোর জীবনে দূর হইবো না। বই-পুস্তকে কি আর এমনে এমনেই লেখছে কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না! যা ভাই তুই, ডিস্টাব করিস না। যা।
মোকাররমের ইচ্ছে ছিল আবুল কালাম চলে যাওয়ার পর সে বিদ্যুতের খুঁটিতে সাঁটানো লিফলেটটা মনোযোগ দিয়ে পড়বে। কিন্তু তাকে কোনওভাবেই ভাগাতে না পেরে সে তার উপস্থিতিতেই পড়তে থাকে লিফলেটটা। আসলে এই লিফলেটটা পড়তে গিয়েই তাকে পড়তে হয়েছে সাইকেল থেকে। রাস্তার দিকে না তাকিয়ে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বিদ্যুতের খুঁটির দিকে। এই সুযোগে সাইকেলের চাকা ঢুকে যায় গর্তে। তারপর যা হওয়ার তাই হয়। মোকাররম দূর থেকে লিফলেটের ছোট লেখাগুলো ভালভাবে পড়তে না পেরে সামনে এগিয়ে গিয়ে পড়ে।
: এই ব্যাডা, তুই এইসব বিজ্ঞপ্তি খুঁজস ক্যান? এইগুলা তো খুঁজবো বেকাররা।
: কথা কম ক।
: একলগে দুই চাকরি করবি নাকি?
: কম কথা হইতে কইছি।
: এক বিজ্ঞপ্তি পড়তে কতক্ষণ লাগে? বানান কইরা কইরা পড়তাছস মনে অয়!
আবুল কালামের কথা পুরোপুরি সত্য না হলেও অনেকটাই সত্য। মোকাররম বিজ্ঞপ্তিটা বলতে গেলে বানান করে করেই পড়ে। কারণ, সে একটা দাঁড়ি-কমাও বাদ দিতে চায় না। দৈনিক কয় ঘণ্টা ডিউটি, সব মিলিয়ে মাসে বেতন কত পড়বে, সপ্তাহে কয়দিন নাইট ডিউটি থাকবে ইত্যাদি বিষয় সে বারবার পড়ে একেবারে মুখস্থ করতে থাকে। তার পড়ার ধরন দেখে আবুল কালাম এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে মনে হইতাছে চাকরিডা লাগবোই? কার লাইগা? যার লাইগাই হোক, যদি মনে করছ লাগবোই, তাইলে আমারে জানাইস।
: তুই মানুষেরে চাকরি দিয়া বেড়াইতাছস নাকি? বিজ্ঞপ্তিটার দিকে শেষবারের মতো চোখ বুলাতে বুলাতে বলে মোকাররম।
: টিকটারি মারিস না। মানুষরে চাকরি দিয়া না বেড়াইলেও এই চাকরিডা দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। কারণ, এই মসজিদের ইমাম সাব আমার মার আপন চাচাত ভাই।
এবার আবুল কালামের দিকে ঘুরে তাকায় মোকাররম। জানতে চায় সত্য বলছে নাকি গুল মারছে। আবুল কালাম বলে সইত্য না গুল, এইটা পরে বুঝিস। এখন ক চাকরিডা কার দরকার। তোর কোনও আত্মীয়-স্বজনের? আবুল কালামের গলার স্বর বলছে সে সিরিয়াস। তাই মোকাররম তার আসল উদ্দেশ্যটা প্রকাশ করে নির্দ্বিধায় চাকরিডা আসলে আমারই দরকার। রোজ রোজ উপজেলা সদরে সাইকেল চালায়া গিয়া চাকরি করতে মনে লয় না। তাও বেতন মাত্র তিন হাজার টাকা। রোজ দশ দশ বিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়া যদি তিন হাজার টাকার চাকরি করতে হয়, তাইলে ক্যামনে জান বাঁচে, ক!
: এইখানে যে বেতন খুব বেশি, তা তো না। মাত্র চাইর হাজার।
: চাইর হাজার ক্যান, দুই হাজার হইলেও ঐটার চেয়ে ভাল। কারণ, মসজিদটা এইখান থেকে আড়াই মাইলের বেশি হইবো না। কই দশ মাইল আর কই আড়াই মাইল।
: তাইলে মনে কর চাকরি তোর হইয়া গেছে। ইমাম সাব মার চাচাত ভাই বইলাই না, চাকরি তোর নিজের যোগ্যতার গুণেই হইবো। তুই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছস, তাও এক ক্লাস দুই ক্লাস না, নাইন পর্যন্ত পড়ছস, নামায কালাম পড়স, একটা মসজিদের খাদেম হওয়ার লাইগা আর কত যোইগ্যতা লাগবো?
পরদিন সেই মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যায় মোকাররম। নিজের নাম ঠিকানা বলতেই তিনি বলেন আবুল কালাম তোমার কথা বলেছে। তার কথা শুনে আমার মনে হয়েছে তুমি এই চাকরির যোগ্য। যোগ্যলোকের জন্য সুপারিশ করতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি তোমার জন্য অবশ্যই মসজিদ কমিটিকে সুপারিশ করব। তারা যদি মনে করেন এখন পর্যন্ত যারা যারা যোগাযোগ করেছে, তুমি সবার থেকে বেশি যোগ্য, তাহলে সরাসরি নিয়ে নেবেন। আর যদি একইরকম যোগ্যতাসম্পন্ন আরও কেউ যোগাযোগ করে থাকে, তাহলে পরীক্ষা নিতে পারেন।
ইমাম সাহেবের শেষ কথাগুলো খানিকটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় মোকাররমকে। তার কেবল মনে হতে থাকে তার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন আরও অনেকেই এই পদের জন্য যোগাযোগ করেছে। আর সেই ব্যাপারে ইঙ্গিত দিতেই তিনি কথাগুলো বলেছেন। মসজিদ কমিটির সদস্যদের পক্ষ থেকে ডাক পড়ে মোকাররমের। তাদের কথা শুনে সে বুঝতে পারে তার দুশ্চিন্তাটা অকারণ ছিল না। ঠিকই তার সমান যোগ্যতা সম্পন্ন একাধিক প্রার্থী আছে। তাই মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হবে একজনকে।
মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে চমকে ওঠে মোকাররম। কারণ, তার এক জেঠাত বোনের ছেলেও একই পরীক্ষা দিতে এসেছে। তাজুল। তাজুল আর মোকাররম সমবয়সী। লেখাপড়ার দৌড়ও প্রায় সমান। স্বামীর সংসারে অভাব-অনটন থাকায় তাজুলের মা জুবাইদা বেগম আগে বেশিরভাগ সময়ই বাপের বাড়িতে থাকতেন। তার সঙ্গে তাজুলও থাকত। তাই মোকাররম আর তাজুলের মধ্যে পাড়ার ছেলেদের মতোই সম্পর্ক। জুবাইদা বেগমের স্বামীর সংসারের অভাব-অনটন এখনও আগের মতোই আছে। তবু বাপের বাড়িতে ততটা আসতে পারেন না; কারণ, তাজুলের মামারা বিরক্ত হন।
: কী মনে হইতাছে, হইবো চাকরিটা? মৌখিক পরীক্ষা শেষে রাস্তায় এসে তাজুলকে জিজ্ঞেস করে মোকাররম।
: আমার তো মনে হয় হইবো। তোর কী অবস্থা?
: আমারও তোর মতোই অবস্থা।
: কিন্তু পদ তো মাত্র একটা। ক্যামনে কী হইবো?
: শেষ পর্যন্ত কি তাইলে আমার আর তোর মধ্যেই কম্পিটিশন হইবো?
: হইবো মানে কী! কম্পিটিশন তো শুরুই হইয়া গেছে। কারণ, আরও যেই দুইজন পরীক্ষা দিতে আইছিল, আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কইরা দেখছি, তারা নাকি বেশি উত্তর টুত্তর দিতে পারে নাই। এইজন্য তাদের সম্ভাবনা নাই। সম্ভাবনা থাকলে আমার আর তোরই আছে।
আধমাইলের মতো একসঙ্গে হেঁটে তাজুল আর মোকাররম নিজ নিজ পথ ধরে। একদিন পর আবুল কালাম আসে মোকাররমদের বাড়িতে। বলে তুইও আমার আপন, তাজুলও আপন। কারে রাইখা কার লাইগা চেষ্টা করমু ক। তবে মসজিদ কমিটি তোদের মধ্য থেইকা একজনরে বাছাই করার জন্য ভাল একটা উপায় বাইর করছে। তারা এলাকার মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করব তোদের মধ্যে কেডা বেশি পরহেজগার। যার পক্ষে বেশি ভোট পড়বো, তারা তারেই নিবো। আমি তোর ব্যাপারে আশাবাদী। নো টেনশন।
মসজিদ কমিটির সদস্যরা বেশি সময় নেন না। দুদিনের মধ্যেই মোকাররম আর তাজুলের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে নিয়োগের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে আসেন। মোকাররমকে ফোন করা হয়। সে গেলে সভাপতি বলেন তোমার ব্যাপারে যা যা রিপোর্ট পেয়েছি, আমরা খুবই খুশি। আসলে মসজিদের একজন খাদেমের জন্য পরহেজগার হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু তোমার রিপোর্ট ভাল, অতএব তুমি আগামী মাস থেকে জয়েন তো করবেই, তোমাকে আমরা বেতনও বাড়িয়ে দেবো। চার দেওয়ার কথা ছিল না? পাঁচ পাবে।
শাহ আলমের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে মোকাররম। মার মুখে মিষ্টি তুলে দেয় নিজ হাতে। মা নিজে খান, মোকাররমকেও খাওয়ান। আবুল কালামকে ফোন করে আনা হয়। সে মজা করে মিষ্টি খেতে খেতে বলে পাঁচ হাজার কইছে দেইখা মনে করছস খালি পাঁচ হাজারই দিবো? জি না। এই মসজিদ কমিটির লোকজনের আত্মা খুব বড়। তুই মনোযোগ দিয়া ডিউটি করতে থাক, দেখিস কত সুযোগ-সুবিধা দেয়। কমিটির মধ্যে বড় বড় শিল্পপতিরা আছে, বোঝস না? তারা টাকা দেওয়ার লাইগা লোক খোঁজে।
নির্দিষ্ট দিনে মার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে যায় মোকাররম। ইমাম সাহেব নিজের রুমে বসে তসবিহ জপছিলেন। জানালা দিয়ে মোকাররমকে দেখতে পেয়ে তিনি তাকে ডেকে রুমে আনেন। বসতে দেন। জিজ্ঞেস করেন কিছু খাবে কি না। কিন্তু মোকাররম লজ্জায় কিছু খেতে না চাইলেও তিনি তার বৈয়াম থেকে চিড়া আর গুড় বের করে প্লেটে পরিবেশন করেন। তবে তাকে খুব মনমরা দেখায়। মোকাররম এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলে।
: জি, মন তো অবশ্যই খারাপ। আর সেটা তোমার জন্যই।
: আমার জন্য! বুঝলাম না হুজুর। চিড়া-গুড় খাওয়ার কথা ভুলে ইমাম সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মোকাররম।
: শুনলে তুমি কষ্ট পাবে। তবু সত্যটা তো শুনতেই হবে। মসজিদ কমিটি তোমার নিয়োগ বাতিল করেছে।
: কী!
: জি। শেষ পর্যন্ত তারা তোমাকে নিয়োগ দিয়েছিল পরহেজগারির বিবেচনায়। কিন্তু এখন তোমার বিরুদ্ধে এমন এক অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিয়োগ দেবে কী, তাদের সিদ্ধান্ত ছিল তোমাকে ধরে পুলিশে দিয়ে দেবে।
: কী অভিযোগ হুজুর? আমি কী করছি?
: তোমার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
: কিসের অভিযোগ?
: খুনের।
: কিসের?
: খুনের। একজন খুনিকে তো মানুষ সাধারণ কাজেই নিয়োগ দেয় না। মসজিদের খাদেমের মতো পবিত্র একটা পদে কীভাবে নিয়োগ দেবে বলো! মসজিদ কমিটি বলেছিল তুমি এখানে আসলেই যাতে তোমাকে পাকড়াও করা হয়। কিন্তু আমি বলেছি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগে যেন তোমার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া না হয়। আর এই যে নিয়োগ বাতিলের কথা বললাম, এটাও সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। যদি তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারো, তাহলে অবশ্যই জয়েন করতে পারবে।
বিস্ময়ে হতভম্ব মোকাররম ইমাম সাহেবকে কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারে না। তার জিহ্বা যেন অবশ হয়ে গেছে, ওজনদার পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। নড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। নড়াতে পারছে না ঠোঁটও। ইমাম সাহেব বলেন খাওয়া শেষ করে তুমি একটু চটজলদি চলে যাও। কারণ মসজিদ কমিটি আমার কথা মানলেও এলাকার ছেলেপুলেদের সঙ্গে বিশ্বাস নেই। তারা যদি তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু করে ফেলে, আমি খুব কষ্ট পাবো। তুমি যাও।
: আমি কারে খুন করছি? মোকাররমকে রুম থেকে বের করে দরজা দিয়ে দিতে চাইলে সে প্রশ্নটা করে ইমাম সাহেবকে।
: তোমার বাবাকে।
: কারে?
ইমাম সাহেব এবার আর উত্তর দেন না। মোকাররমের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবারও বসে যান তসবিহ নিয়ে। আর মোকাররম দাঁড়িয়ে থাকে দরজায় ঠেস দিয়ে। ভেতর থেকে এখন দরজা খুললে যে সে ধড়াম করে পড়ে যাবে আর পড়ে গিয়ে পাকা ফ্লোরে বাড়ি খেলে মাথা আস্ত থাকবে না এদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। মিনিট পাঁচেক সে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে শক্ত করে নিজেকে। সাইকেলের কাছে যায়। রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশে।
মোকাররমকে মরার মতো উঠানে প্রবেশ করতে দেখে ছুটে আসেন মা। জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে। মোকাররমের মুখ দিয়ে কোনও কথা সরে না। কিন্তু মা প্রশ্ন করতেই থাকেন। মোকাররম ঘরে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। মার উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। জিজ্ঞেস করতে থাকেন শরীর খারাপ লাগছে কি না। মোকাররম তাকে অনুরোধ করে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ সে একা থাকতে চায়। মা তার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে ঘর থেকে বের হলেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার প্রবেশ করেন।
: আল্লার দোহাই লাগে বাজান, আমার কাছে ক তোর কী হইছে।
: বসেন। শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বলে মোকাররম।
: ক বাজান, কোনও সমস্যা যদি হইয়াও থাকে, আমার কাছে ক। আল্লার রহমে আমি একটা ব্যবস্থা কইরা ফালামু।
: আমারে চাকরি দিবো না। কারণ আমি নাকি আমার আব্বারে খুন করছি।
মোকাররম ভেবেছিল কথাটা শুনে মা চিৎকার করে সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে তুলবেন। কিন্তু না, তিনি কোনও শব্দই করেন না। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকেন মোকাররমের মুখের দিকে। মার এই চাহনি দেখে তার সন্দেহ হতে থাকে। সে বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে মার কাছে এসে বলে কী হইছে মা, আপনে এইভাবে তাকায়া রইছেন ক্যারে? আমি কি হাচা হাচাই আব্বারে খুন করছি? আরে টাশকি লাইগা রইলেন ক্যারে? কথা কন। আমি কি খুন করছি আব্বারে?
: তোরে এইসব কেডা কইছে? বড় বড় চোখ খানিকটা স্বাভাবিক বানিয়ে জিজ্ঞেস করেন মা।
: কেডা কইছে, সেইটা জিগান ক্যান? ঘটনা সত্য কিনা কন।
: হুনি না কেডা কইছে।
: এতো কিছু হুনতে হইবো না। যেইটা জিগাইছি সেইটা কন।
: আর কারও কাছে না জিগায়া আমার কাছে জিগাইলে উত্তর পাইবি, এইটা তোর ক্যান মনে হইল?
: বেক্কলের মতো কথা কইয়েন না তো! আব্বায় মরছে আমি বেবুঝ থাকতে। মাইরা থাকলে তো তাইলে তখনই মারছি। আর তখনের খবর আপনে জানবেন না তো কেডা জানবো?
: এতো পুরানা কথা লইয়া টানাটানি করার কিছু নাই।
: কিছু নাই নাকি কিছু আছে, সেইটা আমি বুঝমু। আপনেরে যেইটা জিগাইছি সেইটা কন।
: খাদেমের চাকরি হইবো না বইলা এতো উতলা হওয়ার কী আছে? আগের চাকরিটা তো আছে! বেতন কম হইলেও ঐটায়ই চলবো। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
: কথা কিন্তু আপনে ঘোরাইতাছেন মা। আমি আব্বারে খুন করছি কিনা কন।
: অ্যাই, এতো প্যানপ্যানাইস না তো! কইত্তে কী হুইন্যা আইছে, এখন এইটা লইয়া শুরু করছে প্যাঁংসা। আমি যাই, আমার কাম আছে।
মা ঘর থেকে বের হয়ে যান। মোকাররম আর কিছু বলে না। তবে তার ভেতরে ঘূর্ণিঝড় বইতে থাকে। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণ মার রহস্যজনক আচরণ। তিনি যদি সরাসরি বলে দিতেন তার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল, তাহলে সে এতোক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারত। মা তাকে নির্দোষ বললে সারা এলাকার মানুষের কথায়ও তার কিছু যেত আসত না। মোকাররম নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ঠান্ডা মাথায় উপায় খুঁজতে থাকে মার মুখ থেকে সত্য বের করার। সে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।
একদিন পর। মোকাররম বাজার থেকে এসে দেখে মা বাড়িতে নেই। সে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজে, জোরে জোরে ডাকে। কিন্তু কোনও সাড়া-শব্দ পায় না। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে জিজ্ঞেস করেও কোনও হদিস পায় না। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মোকাররম। সে বারান্দায় বসে থাকে ঝিম মেরে। সন্ধ্যার ঠিক আগে বোরখা খুলতে খুলতে উঠানে ঢোকেন মা। মোকাররম কিছুটা রাগ আর কিছুটা অভিমান মিশিয়ে জিজ্ঞেস করে কই গেছিলেন? যেইখানেই যান, একটু বইলা যাইবেন না? হুদাহুদি টেনশনে ফালান ক্যারে?
: যা মনে করছিলাম তাই হইছে।
: কী মনে করছিলেন? কী হইছে?
: আকামডা তাজুলেই করছে।
: কিসের আকাম?
: তোর চাকরি খাইছে। সে-ই মসজিদ কমিটিরে জানাইছে তুই তোর বাপেরে খুন করছস। তোরে না ভাগাইলে তার চাকরি হয় না, এই জন্য সে এই আকাম করছে।
: কিন্তু তাজুলে তো আমার চেয়ে ছয় মাসের ছোট। সে ক্যামনে খুনের খবর জানবো?
: তার মার কাছ থেইকা জানছে।
: তার মায় ক্যামনে জানে? আমি তাইলে আসলেই খুন করছি?
অস্থিরতা চেপে অনেকটা কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে মোকাররম। কারণ, ইতোমধ্যে সে এটা বুঝে গেছে, জোর করে বা রাগারাগি করে মার কাছ থেকে কোনও তথ্য আদায় করা যাবে না। সে গলার স্বর কোমলের চেয়েও কোমল করে বলে আপনে জানেন না মা, এলাকায় কী শুরু হইছে। সবার মুখে শুধু একটাই কথা, আমি আমার আব্বার খুনি। আমি বাইরে বাইর হইতে পারি না। সবাই আমার দিকে তাকায়া থাকে। আমারে দেখলেই একজন আরেকজনের লগে কানাঘুষা করে। আমি এই যন্ত্রণা থেইকা মুক্তি চাই মা।
: কয়দিন একটু বাইরে কম বাইর হ।
: বাইরে কম বাইর হইলেই কানাঘুষা বন্ধ হইয়া যাইবো মনে করছেন?
: হ। মানুষে এক কথা লইয়া বেশিদিন মাতামাতি করে না। কয়দিন পরে ভুইলা যায়।
: আপনে এইটা কী কন মা! এই বিষয়টা কি ভুইলা যাওয়ার মতো? গেরামে আমাদের শত্রুর অভাব আছে মনে করছেন?
: শত্রুরা কী করব?
: কী করব আবার! পুলিশ নিয়া আইসা আমারে ধরায়া দিবো। খুনি হিসাবে আমারে ফাঁসিতে ঝোলাইবো।
: যখন ঝোলায় তখন দেখমুনে। আমি এখনও জীবিত আছি।
: আপনে জীবিত থাকলেই আমার লাভটা কী! আপনে তো একটা হাচা কথাও কইতাছেন না। মোকাররম আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
: যখন দরকার হয় তখন কমু।
: এখন দরকার। এখন কন।
: কী কমু?
: কী কইবেন এইটা একশোবার কইয়া দিতে হইবো? আমি আব্বারে খুন করছি কিনা কন। খুন করলে ক্যামনে করছি, কবে করছি!
: কোনও সন্তানই তার বাবা-মারে খুন করতে পারে না।
: এইসব জ্ঞানের কথা কইয়েন না তো! ছেলে-মেয়েরা বাপ মারে খুন করছে, এইরকম বহু ঘটনা আছে।
: তারা তো অমানুষ। পশু। তুই তাগো মতন না। আমি কোনও অমানুষরে, কোনও পশুরে পেটে ধরি নাই।
: তাইলে আমার নামে যে অভিযোগ উঠল, এইটা ভুয়া। ঠিক না?
মা কোনও জবাব দেন না। কয়েক সেকেন্ড নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকে বোরখাটা আলনায় রেখে লেগে যান ঘরের কাজে। মোকাররমের সন্দেহে যোগ হয় নতুন মাত্রা। তার এখন ইচ্ছে করছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করতে। সে কিছুক্ষণ পাগলের মতো পায়চারি করে ঘরজুড়ে। তারপর চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়। হঠাৎ বাইরে মানুষের আগাগোনা শুনে উঠে বসে সে। দেখে শফি চাচা এসেছেন। সঙ্গে পাড়ার আরও কয়েকজন। মোকাররমের ভেতরে ধড়ফড়ানি শুরু হয়। তবু সে তাদের কাছে যায়।
: চাচা, আপনে?
: খালি আমি না। আরও লোকজন আছে।
: তা তো দেখতাছিই।
: যাদেরকে দেখতেছো তারা ছাড়াও আরও লোক আছে। উঠানের বাইরে খাড়ায়া রইছে।
: কী ব্যাপার চাচা?
: কী ব্যাপার তুমি জানো না? তোমার মায় কই? তারে আসতে কও।
মা শফি চাচাদের আগমন টের পেয়েও সামনে আসতে চাচ্ছিলেন না। মোরগের খোপের মুখ বন্ধ করার নাম করে হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন খোপের সামনে। আশা করছিলেন, তারা মোকাররমের সঙ্গে কথা বলেই চলে যাবে। কিন্তু শফি চাচা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকে খুঁজতে থাকলে তিনি আর লুকিয়ে থাকতে পারেন না। সামনে এসে আগমনের কারণ জানতে চান। চাচা বলেন ক্যান আইছি, বোঝার ক্ষমতা আপনের আছে। আমি জানতে চাই, মানুষের মুখে মুখে যেইটা রটছে, আপনে সেইটা বন্ধ করবেন নাকি বিপদ ডাইকা আনবেন?
: কিসের বিপদ?
: না, বিপদ আর কিসের। আজকা তো আমরা আইছি। দুইদিন পর যখন পুলিশে বাড়ি ভরবো, তখন বুঝবেন কিসের বিপদ।
: আপনেরা বিষয়ডা নিয়া এতো বাড়াবাড়ি করতাছেন ক্যারে?
: এই চাচি, বাড়াবাড়ি আমরা করতাছি নাকি আপনে করতাছেন? এইটারেই কইছে, চোরের মার বড় গলা। দুলাল বলে।
: সাবধানে কথা ক দুলাল। মার লগে বেয়াদ্দবি করলে বেশি ভাল হইবো না কইয়া দিলাম।
: গলা নামায়া কথা ক। খুনির গলায় এতো জোর কইত্তে আসে?
: চাচা, আপনে দুলালরে মুখ সামলায়া কথা কইতে কন। নইলে কিন্তু বাড়ি মাইরা মাথা চৌচির বানায়া ফালামু।
: শুনলেন চাচা, শুনলেন! খুনির কথা শুনলেন! নিজের বাপেরে খুন কইরা হাউশ মিটে নাই। আমারেও খুন করতে চায়।
চাচা ধমক দিয়ে সবাইকে থামান। মাকে বলেন যাহা রটে, তার কিছু না কিছু বটে। আপনের পোলায় আপনের জামাইরে ক্যামনে খুন করছে, আমার বুঝে আসতাছে না। তবে বিনা কারণে যে মানুষ তার উপরে এই কথা তোলে নাই, এইটা বুঝি। আপনে যদি মনে করেন পোলারে পুলিশের হাত থেইকা বাঁচাইতে চান, তাইলে আপনেরই প্রমাণ করতে হইবো সে নির্দোষ। এখন ভাইবা-চিন্তা দেখেন কী করবেন। থানায় এই খবর পাঠানির মানুষের কিন্তু অভাব নাই। হয়তো এর মধ্যে চইলাও গেছে। খারাপ খবর বাতাসের আগে আগে চলে শুনছেন না?
শফি চাচা তার লোকজন নিয়ে চলে যান। মা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মোকাররম তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলে না। ঘরে ঢোকে। তারপর আলমারির উপর থেকে একটা বোতল এনে মার সামনে দাঁড়িয়ে বলে বেগুন ক্ষেতে দেওয়ার লাইগা এই বিষের বোতলটা আনছিলাম। আপনে যদি সত্যটা প্রকাশ না করেন, তাইলে এখন ঢকঢক কইরা পুরা বোতল খাইয়া ফেলমু।
মা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন মোকাররমের দিকে। মোকাররম আবার হুমকি দেয় কইবেন? নাকি খামু? খাইয়া ফেললাম কিন্তু!
: আমি কিছু কইতে পারমু না। তাজুলের মায় সব জানে।
অন্ধকারের মধ্যেই তাজুলদের বাড়ির দিকে ছোটে মোকাররম। সে যখন গন্তব্যে পৌঁছে তখন রাত সাড়ে নটা। তাকে দেখে ভয় পেয়ে যান তাজুলের মা। কিন্তু মোকাররম অভয় দেয়। বলে আমি খাদেমের চাকরি পাই নাই, এইটা নিয়া আমার কোনও দুঃখ নাই, রাগ নাই। আপনে খালি কন আমি আমার বাপেরে ক্যামনে মারছি, কবে মারছি। আমার বয়স যখন তিন বছর, তখন নাকি আব্বায় মারা গেছে। তিন বছর বয়সের একটা বেবুঝ শিশুর পক্ষে বয়স্ক একটা মানুষরে ক্যামনে মারা সম্ভব! কন আপা, কন। আল্লার ওয়াস্তে কন।
: এখন কইতে পারমু না। পরে একসময় আয়িস।
: এখন কন। না শুইনা আমি যামু না।
: সবার সামনে আমি কিছু কইতে পারমু না।
: সবার সামনে কইলে সমস্যা কী? এইটা নিয়া লুকোচুরির তো আর কিছু নাই। পুরা এলাকার লোকজন জাইনা গেছে।
: তবু আমি সবার সামনে কইতে পারমু না। শরমের বিষয়।
মোকাররম এবার তাজুলের মার হাত ধরে হেঁচকা একটা টান দেয় আর বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। বলে এইবার কন। এইখানে কেউ নাই, শরম পাওয়ার কিছু নাই। কন আপা, কন।
তাজুলের মা ডানে-বামে দেখে নেন কেউ শুনছে বা দেখছে কি না। তারপর গলার স্বর প্রায় শূন্যে নামিয়ে বলেন তোর আব্বায় ঠ্যাং বিছায়া রাখছিল, তুই তার ঠ্যাঙের উপর শুইয়া হাত-পা ছুইড়া খেলতেছিলি। আৎকা তোর পায়ের একটা লাত্থি গিয়া লাগে তার অণ্ডকোষে। সে অণ্ডকোষ ফাইট্টা মারা যায়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইকবাল খন্দকার ইকবাল খন্দকার-এর গল্প 'পিতৃঘাতী' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প পিতৃঘাতী সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর