Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাচিত দেবদূত


২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৪৯

রুপালী ট্রাঙ্কের শীতল ধাতব শরীরে প্রতিফলিত সূর্যের আলো আছড়ে পড়ে প্রতিফলিত হয় একটি কোমল মুখে। আশেপাশে উপস্থিত উৎসুক দর্শকদের সবাই দেখতে পায়, প্রবল অস্বস্তির মাঝেও দাঁতে দাঁত চেপে তার চোখ বুজে থাকার লড়াই। এ দৃশ্যমান লড়াইয়ের ফাঁকে উপস্থিত দর্শকদের চোখে পড়ে না কোমল মুখের শিশুটির অন্তর্দ্বন্দ্ব।

রুপালী ট্রাঙ্কের গাঁয়ে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মাশুক নামের শিশুটিকে চেতনায় ফিরিয়ে আনতে চায়, যদিও সে তার এই প্রিয়তম ট্রাঙ্কের স্মৃতিচারণার মাধ্যমেই চেষ্টা করছিল অবচেতনে ডুবে যাবার। সে অনুভব করে, মনে মনে, ট্রাঙ্কটির শরীরের মসৃণতা, যা বেতের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত তার পাছার পূর্বকালীন মসৃণতার সমানুপাতিক ছিল। সে ট্রাঙ্কের শরীর ছিল এমনি শীতল যে, তীব্র ক্ষুধার প্রহরেও তা অভুক্ত অর্ধভুক্ত পেটের সাথে ঠেসে ধরলে জাদুকরি উপায়ে সে শীতলতা সঞ্চারিত হত মাশুকের পেটে। ঠাণ্ডা হয়ে যেত তার অর্ধভুক্ত উদর। এই মুহূর্তে মাশুকের পিছমোড়া করে বাঁধা হাতজোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে অবশ হয়ে কাঁধ থেকে খুলে পড়বার উপক্রম। এখন তার জ্ঞান ফিরে না এলেই বরং ভাল। তাই সে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে আবারও অজ্ঞান হয়ে যাবার।

বিজ্ঞাপন

বাস্তবতায় ফিরে আসবার প্রবল অনীহা তাকে প্রলুব্ধ করে আরও কিছুক্ষণ জোর করে চোখ বুজে থাকতে। কিন্তু বাস্তবতা যখন কেবল চার অক্ষরের একটি শব্দের বদলে ঠাণ্ডা পানির প্রবল ঝাপটা হয়ে তার দশবছর বয়েসি শ্মশ্রুহীন শিশুপানা মুখে আছড়ে পড়ে, মাশুকের পক্ষে আর চোখ বন্ধ করে রাখা সম্ভব হয় না। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে মাশুক চোখ খোলে।

চোখ খুলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে তার পরিচিত লিল্লাহ বোর্ডিং এর গনরুমে। এখানেই সে গোটা ত্রিশেক ছাত্রের সাথে কাটিয়েছে তার জীবনের বিগত দুটি বছর। অন্যান্য দিনের সাথে আজকের তফাৎ এইখানে যে, আজ তার সামনে কোনও টেবিল নেই, হেফজ করার জন্যে খোলা নেই কোরআন শরীফ। রুমের একদম শেষ মাথায়, হেফজখানার ওস্তাদের খাটিয়ার পায়ার সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা তার হাত। জ্ঞান হারাবার আগে সে শ্রেণী শিক্ষকের তীব্র বেত্রাঘাতে কাতরাচ্ছিল। জ্ঞান হারিয়ে সে এক হিসেবে বেঁচে যায়। যে ঘটনার অভিঘাতে মাশুকের বেত্রাঘাত প্রাপ্তি, সে ঘটনা সামাজিক ভাবে এবং তাদের ক্ষুদ্র এই লিল্লাহ বোর্ডিং এর প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুতর। যে ঘটনার অভিঘাতে সে খাটের পায়ার সাথে এই মুহূর্তে পিছমোড়া হয়ে বাঁধা অবস্থায় বেত্রাঘাত পাওয়ার মত শাস্তি লাভ করে, তা তার ক্ষুদ্র জীবনের প্রেক্ষিতেও অনেক বড়।

বিজ্ঞাপন

পরিপক্বতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নয়, বরং আসে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। আজ থেকে দু বছর আগে যখন ছোট্ট মাশুক তার মামার হাত ধরে এই লিল্লাহ বোর্ডিং এর প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়ায়, তার জীবনের পরিক্রমা তাকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, স্রেফ অর্থাভাবের জন্যেই সে আজ এখানে। তার ট্রাক ড্রাইভার বাবা মাসছয়েক আগে হাইওয়েতে একসিডেন্ট করে মারা যাওয়ার পর তার চেনা শৈশবের জগত দ্রুতগতিতে বদলাতে থাকে। ইতোপূর্বে যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে সে বড় হচ্ছিল এমনটা মোটেই নয়, তবুও, তার জীবনে বাবা নামে ভরসার একটি কেন্দ্রস্থলের উপস্থিতি ছিল। বাবার মৃত্যুর পর বিচ্ছিন্ন পরমাণুর মত তারা ছিটকে যেতে থাকে একেক দিকে। তার মায়ের বিয়ে হয়ে যায় ইদ্দতকাল সমাপ্ত হবার পরপরই। কিন্তু মায়ের নতুন স্বামী সাফ জানিয়ে দেন, আগের ঘরের কোনও বোঝা তিনি টানতে রাজি নন।

মাশুক আর তার বড়বোনকে আশ্রয় নিতে হয় তার নানীর কাছে, যিনি তার আপন ঘরেই অনেকটা আশ্রিতের মত থাকতেন। কারণ, ঘরের উপার্জনসক্ষম একমাত্র পুরুষ ছিল তার ছেলে, মাশুক, মাশুকের বোনের মামা। স্ত্রী – বাচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে তারও সংসার ছিল। ফলে মাশুক, আর মাশুকের বোনকে প্রাকৃতিকভাবেই তারা নিজেদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া উটকো ঝামেলা হিসেবে দেখা শুরু করলেন। মাশুকের বোনকে পারলে তাদের মামা, মাশুকের মায়ের সাথেই এক আসরে বিয়ে দিয়ে দিতো। সেটা সম্ভব না হলেও খুব বেশি দেরী হয় না শুভকাজে। ছয়মাসের মধ্যেই দশবছরেরও কম বয়সী মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বাকি থাকে মাশুক, যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আরও সহজে এবং দ্রুততার সাথে। আট বছর বয়সী বাপহারা, পরিবারবিহীন একটি ছেলের জন্যে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত সমাজের সবচে উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে এতিমখানার লিল্লাহ বোর্ডিং, যেখানে মূলত ধনী লোকদের দানের অর্থে এতিম ছেলেপেলেরা থাকে, খায়, কোরআন হেফজ করে, মাসালা মাসায়েল, ধর্মতত্ত্ব শেখে।

মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং এ মাশুকের আগমন অন্যসব তালেবুল এলেমের মত হলেও কেবল এক জায়গায় ছোট একটা পার্থক্য থেকে যায়, যা তাকে তার সমস্যাশঙ্কুল জীবনে আলোর পথ দেখায়।

মামার হাত ধরে যখন মাশুক প্রথমবারের মত এই লিল্লাহ বোর্ডিং এর দরোজায় এসে দাঁড়ায়, তার শঙ্কিত মনকে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেই হয়তো মামা বলেন- মাদ্রাসায় পরতেছ বইলা দুঃখ করবা না। মনে রাখবা, এইটা হইল আল্লাহর রাস্তা, এলমে দ্বীনের পথ। বড়ই উঁচা এই রাস্তা। বড়ই সম্মানের। যে কেউ চাইলেই এই পথে আসতে পারে না। যারে আল্লাহ চান, সে ই কেবল এই রাস্তায় আসতে পারে। তোমার অনেক বড় ভাগ্য যে তুমি এই পথে আইবার পারছো। নিজের ভাগ্যবান জাইনো, আর আল্লাহর রাস্তার মান রাইখো!

মামার এই নাতিদীর্ঘ ভাষণ ধর্মাধর্মের হিসেবের বাইরের একটা অবস্থান থেকে মাশুকের উপর প্রভাব বিস্তার করে। বছরের চাকা আটবার ঘুরতে না ঘুরতেই সে জীবনকে যে নির্মম রূপে আবিষ্কার করেছে, প্রথমে বাবাকে হারিয়ে, পরে মা এবং বোনের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে, এবং সবশেষে পরিবার নামক ভালবাসা- আশ্রয়- ফিরে আসার জায়গা থেকে বঞ্চিত হয়ে, তাতে করে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে আলাদা কোনও সম্পর্ক তৈরির সুযোগ তার হয়ে ওঠে নি। তবে সে আল্লাহ নামে এক বন্ধুর সন্ধান লাভ করে, যাকে সে দেখতে পারে না, ছুঁতে পারে না, কিন্তু কল্পনা করে নিতে পারে। মনে মনে সব সুখ দুঃখের কথা ভাগ করে নিতে পারে। তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি সংক্রান্ত দাপ্তরিক কাজ শেষে যখন হেফজখানার গনরুমে আনা হয়, সে বোঝে যে সে আল্লাহর দপ্তরে এসেছে বটে, কিন্তু আল্লাহর বন্ধুদের জন্যে খুব একটা আরাম আয়েসে আপ্যায়নের ব্যবস্থা এখানে নেই। তবে যেহেতু মাশুক তার পূর্বের জীবনেও আরাম আয়েসে তেমন অভ্যস্ত ছিল না, তাই পার্থক্যটা ঘটা করে চোখে পড়ে না, মনেও বেজে ওঠে না।

দিন যায়, মাস যায়, বছরের চাকা ঘোরে, মাশুকের হেফজের পরিমাণ বাড়তে থাকে। কোরআনের পাতায় পাতায় সে দেখে আল্লাহর নাম। দেখে সে উৎসাহিত হয়। তার হেফজখানার ওস্তাদকে প্রশ্ন করে- ওস্তাদজী আল্লা এখানে কি বলছে? ওস্তাদ তাকে বেত উঁচিয়ে শাসায়- বেআদব! আল্লায় কি বলছে মানে কি রে! তুই কি তোর কোনও ইয়ার দোস্তের নাম নিতেছস? বল যে, হুজুর, আল্লাহতালা এখানে কি ফরমাইয়াছেন…।

মাশুক ভয়ে ভয়ে ঢোঁক গিলে প্রশ্ন করে- হুজুর, আল্লাহতালা এখানে কি ফরমাইয়াছেন?

ওস্তাদজী এবার বেশ কায়দা করে উত্তর দেন- অতো বুইঝা কাম নাই। অখন মুখস্ত করণের কাম, মুখস্ত কর। বোঝনের জইন্যে আরও উঁচু কিলাসে উঠতে হইব।

আল্লাহ আসলে কি বলেছেন কোরআনের পাতায় পাতায়, তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনও বোঝাপড়া না হওয়াটাকে মাসুক তার স্বাধীনতা বলেই বিবেচনা করে। সে নিজের মনের মত এক বন্ধু বানিয়ে নেয় আল্লাহ নামে। শেষ রাতে চোখ খুলে গেলে সে উঠে বসে মনে মনে বলে- আল্লা, আমি ঘুম থেকে উঠছি, তুমিও উঠছ? ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত দুলে দুলে কোরআন হেফজ করবার সময় ঘুমে চোখ লেগে এলে সে বলে- আল্লা, আর তো পারি না, আমার চোখ থেকে ঘুম সরায়া দেও। তারপর নিজেই দু হাত দিয়ে চোখ কচলে দ্বিগুণ জোরে ঢুলে ঢুলে কোরআন পড়া শুরু করে। দুপুর বেলা খেতে বসে পেটে ক্ষুধা থেকে গেলেও যখন চাইবার পর আর খাবার পাওয়া যায় না, তখন সে বলে- আল্লা, পেটতো ভরল না, রাইতের বেলা আরও খাওন পাঠাইয়ো। বিকেলবেলা মাদ্রাসাপ্রাঙ্গনে হাঁটাহাঁটির সময় উঁচুক্লাসের কয়েকটা ছেলে যখন মাশুকের দিকে তাকিয়ে বাজেভাবে হাসে, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি বলাবলি করে, মাশুকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ওর পশ্চাৎদেশে খুব জোরে চড় কষায়, মাশুক তখন বলে- আল্লা, ওরা এমন কেন করে আমার সাথে? ওদের আমারে কষ্ট দিতে মানা করো! একবার যখন মাশুকের খুব জ্বর, ঠিকমত দেখভাল করবার কেউই নেই, মাশুক চোখ বুজে একমনে বিড়বিড় করা শুরু করল- আল্লা, আমারে আমার আম্মার কাছে নিয়া যাও, আল্লা, ও আল্লা …। মাদ্রাসায় যারাই পড়ে, তারা সব আল্লাহর বেছে নেওয়া মানবসন্তান- এই চিন্তা মাথায় ঢুকে যাওয়ায় মাশুকের লাভ হয়েছিল, লাভ হয়েছিল খুব গভীরভাবেই, কেননা সে এক বন্ধু তৈরি করে নিতে পেরেছিল এমন সময়ে, যখন তার কথা বলার বা শোনার কেউই ছিল না।

মাশুকের ঝাপসা, ধূসর দিনগুলোকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে মাশুকের মামা বছরদেড়েক পর যখন মাসুকের সাথে দেখা করতে এলেন, তাও উপহার হিসেবে মাশুকের জন্যে এক ঝকঝকে ষ্টীলের ট্রাঙ্ক নিয়ে, মাশুকের আনন্দের সীমা রইল না! সে মনে মনে অসংখ্যবার আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল। নানারকম কাজে তার ছোট একটা আয়নার বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নিজের কাছে একটা ফুটো পয়সাও না থাকায়, আর তার সহপাঠীদের সাথেও খুব একটা ভাল সম্পর্ক না থাকায় সে না পেরেছে একটা আয়না কিনতে, না পেরেছে কারও থেকে ধার নিতে। এখন সে এমন এক ট্রাঙ্কের মালিক, যেটার উপরিতল এতটাই স্পষ্ট যে, সে চাইলেই এটাকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, তদুপরি, এর ভেতরে সে নিজের কাপড় চোপড় তো রাখতে পারবেই! ফলে ট্রাঙ্কটাকে সে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখে, যতভাবে এর সদ্ব্যাবহার করা সম্ভব – করে, এবং তার মনে হয়, প্রবল অভাবের মধ্যেও এই ট্রাঙ্কটি তাকে বিশেষত্ব দেয়। তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে।

সমস্যার সূত্রপাত হয় এ সবকিছুর মাসছয়েক পর, আজ, জুমাবার, জুমার নামাজের পূর্বে।

জুমার আজান পড়েছে। লিল্লাহ বোর্ডিং এর মসজিদে মুসুল্লি এখনও আসি-আসছি অবস্থা। একতলার অর্ধেকটা খালি, দ্বিতীয়তলায়, হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের আবাস যেখানে, মহল্লার বাচ্চারা আগেই গিয়ে সে দ্বিতীয়তলার দখল নিয়ে ছোটাছুটি, হুটোপুটি শুরু করে দেয়। তারা মাশুকের সমবয়সী, কিন্তু প্রত্যেকেই অবস্থাসম্পন্ন ঘরের সন্তান। দারিদ্র্যের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য এমন এক বস্তু, যা বুঝতে বয়স লাগে না। সমাজ চোখে আঙ্গুল দিয়েই শৈশব থেকে বুঝিয়ে দেয় কার অবস্থান কোনখানে। তাই হেফজখানার শিশুরা, এই অতিথি শিশুদের সমবয়সী হলেও তাদের সঙ্গে খেলায় অংশ নেয় না। একটা উল্লেখযোগ্য দূরত্ব বজায় রাখে।

মাশুকও তাই করে এসেছে বরাবর। তাদের ওপর শ্রেণীশিক্ষকের স্পষ্ট নির্দেশ আছে জুমার দিন নামাজের আজান পড়ার আগেই গোসল করে পোশাক পরিধান করে আজানের সঙ্গে সঙ্গে নীচতলার একদম পেছনের সারিতে বসে খতীবের ওয়াজ এবং খুতবা শোনার। মাশুকের আজ গোসলে একটু দেরী হয়ে যাওয়ায় গোসল করে এসে পাঞ্জাবী বের করবার জন্যে দোতালার হেফজখানায় সে নিজের ট্রাঙ্কের খোঁজে এসেছিল। সে উঠে যা দেখে, তার জন্যে সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। তার সমবয়সী একদল ছেলে তার ট্রাঙ্কটাকে টেনে রুমের মাঝামাঝি এনে রেখেছে। একজন উপর্যুপরি ট্রাঙ্কের তালায় পাথর দিয়ে আঘাত করছে, আর একজন থেকে থেকে ট্রাঙ্কের মাঝ বরাবর লাথি মেরে ট্রাঙ্কটাকে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে প্রায়।

মাশুক প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে তার জীবনের একমাত্র মূল্যবান বস্তুটির এই করুণ পরিণতি দেখে। কিছু পরেই, জীবনে প্রথমবারের মত ছোট্ট মাশুকের মনে এমন প্রবল এক ক্রোধের সঞ্চার হয়, যার সাথে চিরদিন ভয়কে উপজীব্য করে জীবনধারন করা মাশুকের কোনও পরিচিতিই ছিল না। সে প্রথমেই ছুটে গিয়ে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দেয় যে ছেলেটি তার ট্রাঙ্ককে ওপর থেকে লাথি মারছিল, তাকে। সে এমনি ভয়ানক ধাক্কা ছিল যে, ছেলেটা টাল সামলাতে না পেরে পিছাতে পিছাতে দোতালার খাটো জানালা গলে নীচে পড়ে গেল একদম। মাশুকের সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নেই। সে ঝুঁকে পড়ে তার আধ-ভাঙ্গা ট্রাঙ্কের শরীরে এমনভাবে হাত বুলাতে লাগল, যেন ট্রাঙ্কটা কোনও জড়বস্তু না, বরং আহত এক মানুষ। আশেপাশের ছেলেগুলো এই ফাঁকে নিজেদের সামলে নিয়ে মাশুককে পেড়ে ফেলে এবং উপর্যুপরি চিৎকার, কিল ঘুষি লাথি এমনভাবেই আরম্ভ করে যে মাশুকদের হেফজ বিভাগের শ্রেণীশিক্ষকসহ বাকি ছাত্ররাও ছুটে আসতে বাধ্য হয় দোতলায়। নীচে, দোতলার জানালা গলে পড়ে যাওয়া ছেলেটিকে উদ্ধার করা হয় পা ভাঙ্গা অবস্থায়। সব মিলিয়ে ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে শ্রেণীশিক্ষক অর্ধচৈতন্য থেকে মাশুককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে নিজের খাটের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধে, এবং সেই অবস্থাতেই বেত্রাঘাত করতে করতে চেতনাহীন করে ফেলার দায়িত্ব সম্পন্ন করে। মাশুককে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও শব্দ উচ্চারণের সুযোগও দেওয়া হয় না। মাশুকের দুর্ভাগ্য এই যে, মাশুক যাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, সে স্থানীয় কাউন্সিলরের ছেলে, উক্ত কাউন্সিলর এই লিল্লাহ বোর্ডিং এর ফান্ডের অন্যতম দাতাদের একজন।

চেতনা ফিরে আসার পর মাশুকের চোখ প্রথমে ঝকমকিয়ে ওঠা তার ট্রাঙ্কের ওপরেই পড়ে। শরীর চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাওয়ার কারণে তাতে প্রতিবিম্বিত সূর্যের আলোর যথাযথা প্রতিফলন আর হচ্ছে না। জানালা দিয়ে তির্যকভাবে প্রবেশ করা সূর্যের আলো দেখে বোঝা যায়, বিকেল হয়ে এসেছে। চোখ দু চারবার পিটপিট করবার পর পুরো রুমটা স্পষ্ট হয় মাশুকের সম্মুখে। অসামঞ্জস্যতায় পরিপূর্ণ একটি কক্ষ। যে কোনও সাধারণ দিনে এই সময় ছেলেরা হয় আসরের নামাজের প্রস্তুতি নিত, বা নামাজ যদি শেষ হয়ে থাকে, তবে সামনের উঠোনে চলে যেত খেলাধুলার জন্যে। কিন্তু আজকের বিকেলটি অবশ্যই অন্যরকম। আর এ ভিন্নতার কুশীলব মাশুক নিজেই। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বরাবরই প্রবল সংকটের মধ্যে থাকা মাশুক কখনওই এভাবে অস্তিত্ববান হয়ে উঠতে চায়নি, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সৃষ্টির ইতিহাসের এক অতি বড় সংকট কী এটা নয় যে, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে আগমন ঘটা এক একটি মানুষকে, জন্মাবার পর, বিপদের মুখে ঠেলে দেবার আগে তার কাছে কেউ এটা জানতে চায় না যে সে কীভাবে পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল হতে চায়, বা কীভাবে অস্তিত্বশীল হতে চায় না, অথবা তারও পূর্বে- সে আদৌ অস্তিত্বশীল হতে চেয়েছিল কি না কখনও?

এভাবে, নিজের অসহায় অস্তিত্বের ব্যাপারে পুনরায় সচেতন হয়ে উঠে মাশুক চোখের সম্মুখে দেখতে পায় রুমের বিবিধ প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার সহপাঠীদের। কয়েকটা ডাঁশা পিঁপড়া তার শরীর জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে- এমনটা সে অনুভব করে। তার আন্দাজ সত্যি হয়, যখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাশুককে পরীক্ষামূলকভাবে কামড়ানো শুরু করে। মাশুকের তখন অসহায়ের মত ছটফট করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। তবে তার শরীর সঞ্চালন উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে চাঞ্চল্য উৎপাদন করে। তাদের কানাকানি করতে দেখা যায়, এবং দ্রুত একজন ছাত্র নীচে দৌড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগমন ঘটে লিল্লাহ বোর্ডিং এর সিনিয়র ক্লাসের কিছু ছাত্র, হেফজ বিভাগের শিক্ষক, বোর্ডিং এর প্রিন্সিপল, লিল্লাহ বোর্ডিং এর পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর, তার আহত ছেলের বন্ধুবান্ধবদের।

রুমের ঠিক মাঝ বরাবর দুটো চেয়ার এনে রাখা হয়। তার একটায় বসেন কাউন্সিলর সাহেব। অপরটায় তিনি প্রিন্সিপলকে বসতে ইশারা করেন। প্রিন্সিপল কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পরে জড়সড় হয়ে বসেন তার পাশে। বাকিরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।

-বোর্ডিং এ পয়সা দেই এই রকম হারামির বাচ্চারে মাগনা খাওয়ানোর লাইগা? কাউন্সিলরের চিৎকার রুমের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়। এই দেওয়াল সেই দেওয়ালই, যাতে সকাল বিকাল প্রতিধ্বনিত হয় স্রষ্টার কালাম। প্রিন্সিপলকে আরও জড়সড় মনে হয়। তার আপ্রাণ কামনা একটাই, অন্তত ছাত্রদের সামনে যাতে তাকে সরাসরি অপমান না করা হয়।

-আমার একমাত্র পোলাডারে ঠ্যালা দিয়া জানালা দিয়া ফেলাইয়া দিলি যে, ও তোর কি ক্ষতি করছিল, ক এহন!

কাউন্সিলরের ক্রুদ্ধ গর্জনের সামনে উপস্থিত সবাইকে প্রাণভয়ে ভীত ভেড়ার পালের মত লাগে।

-ঐ হারামির বাচ্চা! কই থেকে আইছে তোর এতবড় কলিজা? মুখ খুল নইলে টাইনা তোর জিব্বা ছিড়া ফেলামু! মুখ খুল!

কাউন্সিলর আগুন চোখে মাশুকের দিকে তাকালে, সবাই ভীত চোখে দেখে, মাশুকের মধ্যে এই হুমকি ধামকির পরেও কোনও ভাবান্তর নেই। অবসন্ন শরীরে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে ও পুনরায় এলিয়ে থাকে খাটিয়ার পায়ায় ঠেস দিয়ে।

-কথা ক, হারামজাদা! চেয়ারের হাতলে কাউন্সিলরের মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রচণ্ড জোরে আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়। মাশুক অতি মৃদুভাবে চোখ খোলে। আবারও সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে। অল্প কিছু শব্দ, একটা বাক্য। অস্পষ্ট শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর এবার আর সে চোখ বোজে না। স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে কাউন্সিলরের চোখে চোখ রেখে। মাশুকের পৌনঃপুনিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা প্রিন্সিপলকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়।

-চক্ষু নিচা কর বেআদব!

ধমকের সুরে কথাটা বলার চেষ্টা করলেও প্রিন্সিপলের গলা খোনা এবং ভাঙ্গা শোনায়, যেন কথা বলাটাও এসময় অপরাধ। তবুও, ছাত্রের বেআদবির ভার যেন তার কাঁধে এসে না পড়ে, সেই ভীতি থেকেই তার মুখ খোলা। কিন্তু তার বিপদে এতে কমে না, বরং বাড়ে। তার কথার সূত্র ধরেই মাশুক এবার স্পষ্ট, খোলা চোখে দৃষ্টিস্থাপন করে কাউন্সিলরের চোখে এবং আবারও কিছু একটা বলে। কিন্তু তার কথা জড়িয়ে যায় বলে আবারও কেউ কিছু শুনতে পায় না।

– কি কয় এই বেজাত? কাউন্সিলর প্রশ্ন করে প্রিন্সিপলকে।

– আমারে আল্লা বাইছা আনছে এই পথে। মাশুকের মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ এবার সবাই শুনতে পায়।

– তোরে আল্লায় বাইছা আনছে এই আকাম করণের লাইগা? হতভম্ব ভাব কাটিয়ে কণ্ঠে যথাসম্ভব শ্লেষ ঢেলে দেয় কাউন্সিলর।

– আমারে আল্লা বাইছা আনছে তার কালাম পড়ার লাইগা। মাশুক এবার কিছুটা বর্ধিত করে তার উত্তর।

– তাইলে এইরকম বেজাতের মত কাম করলি কেন নাটকির পোলা! কাউন্সিলর তার হাতের মুঠোয় দলা পাকানো টিস্যু মাশুকের দিকে ছুঁড়ে মেরে উঠে দাঁড়ায়। টেনে সামনে আনে মাশুকের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ট্রাঙ্কটি।

– এই ট্রাঙ্কের লাইগা তুই আমার পোলারে দোতলা থাইকা ফেলাইয়া মারার চেষ্টা করছস, তাই না?

ট্রাঙ্কটা এক হাতে উঁচু করে ধরা মাত্রই মাশুকের জুমার নামাজের জন্যে ধুয়ে রাখা একসেট জামা, দু একটা খাতা কলম ছিটকে পড়ে ভেতর থেকে। আর একটুকরো শক্ত কাগজ ঘুরপাক খেতে খেতে মাশুকের সামনে গিয়ে পড়ে। মাশুক অস্পষ্ট চোখে তাকিয়ে দেখে, তার মায়ের ছবি সেটা। ছবিতে তার মায়ের মুখ, তার স্বপ্নের মত এক নিশ্চিন্ত অতীত জীবন আর বর্তমান দুঃস্বপ্নের মধ্যবর্তি সংযোগ স্থাপনকারী একমাত্র সেতু। তবে হেফজখানার পরিবেশে মাশুকের মায়ের ছবি কেবল এক বেগানা আওরতের মুখচ্ছবি ভিন্ন আর কোনও দ্যোতনা তৈরি করে না। এমন একটা জায়গায় এক বেগানা নারীর ছবি জনসম্মুখে উদাম হয়ে যাওয়ায় সবাই একসঙ্গে শিউরে ওঠে। হেফজখানার দায়িত্বে থাকা শ্রেণীশিক্ষক নিজ দায়িত্বে দৌড়ে গিয়ে ছবিটা তুলে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে নীচে।

মাশুকের চোখ দিয়ে প্রথমবারের মত একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

– একশো বেতের বাড়ি, এইটাই শাস্তি! গর্জন করে ওঠে কাউন্সিলর, প্রিন্সিপাল, এখনই শুরু করেন!

প্রিন্সিপাল মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই ফাঁকে কেউ একজন খাপ খোলা তলোয়ারের মতো একটি চিকন জালিবেত তার হাতে তুলে দেয়।

প্রিন্সিপাল ধীরে ধীরে তাকান ছেলেটির দিকে। হাত বাঁধা। বহু আঘাতে শরীর জর্জরিত। এলিয়ে পড়ে আছে খাটিয়ার পায়ায় হেলান দিয়ে। গরীবের ছেলে। এতীম। কোরআন শিক্ষা পরের বিষয়। মূল বিষয় ছিল নামমাত্র খরচায় থাকা খাওয়া। ভুল করেছে। মারাত্মক ভুল। জলে থেকে কুমিরের সাথে কেউ লড়াই করে না। জঙ্গলে থেকে যেচে কেউ বাঘের লেজে পা দেয় না। কিন্তু এগুলো বোঝার বয়স কি ওর হয়েছে? ওর না হলেও, প্রিন্সিপল বোঝেন, জলে থেকে কুমিরের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা, বা জঙ্গলে থেকে বাঘের লেজে পাড়া দেওয়া – কোনওটার সাহসই তার নেই।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যান তিনি, বিষণ্ণ চিত্তে, মাশুকের দিকে।

কাছে গিয়ে, বেত উঁচু করতে করতে তিনি তাকান মাশুকের দিকে। মাশুকের চোখ তার চোখে। সে মৃদু স্বরে পড়ে চলছে – হাসবি আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু, আলাইহে তাওয়াক্কালতু ওয়াহুয়া রব্বুল আরশিল আজিম… হাসবি আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু, আলাইহে তাওয়াক্কালতু ওয়াহুয়া রব্বুল আরশিল আজিম…।

আমার জন্যে বন্ধু হিসেবে কেবল আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনও মালিক নাই। আমি তাকেই ডাকি বারংবার। তিনি মহান আরশের অধিপতি…।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প নির্বাচিত দেবদূত সাজিদ উল হক আবির সাজিদ উল হক আবিরের গল্প 'নির্বাচিত দেবদূত' সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর