কাওরান বাজারের বিকেল
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:১৬
কাওরান বাজারে বসে আছি। তখনও দুপুর পার হয়নি। তবে হব হব করছে। বিকেল নামার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রস্তুতিটা শুধু আকাশে না, জমিনেও। শান্তাও হয়তো আসছে আমার দিকে। ওর জন্য বসে আছি। শান্তার সঙ্গে আমার দেখা ও পরিচয় শ্যামলীতে। দিনকয় আগে আমি একটা কাজে গিয়েছিলাম শ্যামলী সিনেমা হলের পেছনের পার্কের পাশের এক বাসায়। শ্যামলী সিনেমা হলের সামনের জায়গাটায় কিছু ছেলেমেয়ে একটা পথসভা করছিল। পথসভাটা ছিল সরকারবিরোধী। জিনিসপত্রের দাম-টাম নিয়ে। সেই পথসভায় ইলিয়াস ভাই ছিলেন আমার পরিচিত। শ্যামলী সিনেমা হলের ওই এলাকায় এত ভিড় আর গাড়ির চাপ যে একটা পথসভা হচ্ছে বোঝার উপায় নাই। আমি গাড়ির ফাঁক আর মানুষের শরীর গলে বের হতে গিয়ে পথসভার কর্মীদের মাঝখানে ঢুকে গেলাম। তখন ঘাড়ের ওপর একটা চওড়া হাত এসে পড়ল। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইলিয়াস ভাই। শাহবাগের নেতা শ্যামলীতে। ওনার সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা হয় হাতিরপুলে। সেখানে আমার বাসা। বাসা বলতে ব্যাচেলর বাসা। আমি আর কানন থাকি। কানন আবার এক্স-বাম। ইলিয়াস ভাই সচল বাম। তারপরও তাদের ভেতর কী নিয়ে যেন কথা হয়। এসব কথা বলাবলি করতে ইলিয়াস ভাই আমাদের বাসায় আসেন, কখনও থাকেন। তাদের কথাবার্তা আমি কিছু বুঝি না। বুঝতেও চাই না। বামের এক বড় নেতা একবার ফেসবুকে পাকা কলার ছবি দিয়ে লিখেছিলেন–এসব কলা যদি ঝুলিয়ে রাখা হয়, তাহলে কলারা ভাবে যে তারা গাছেই আছে; আর তখন পচে না। আমার মনে হয় দুই বামের এই আলাপ বিপ্লবটাকে ঝুলিয়ে রাখার। তাতে বিপ্লব আর পচবে না। সে তাদের ব্যাপার। আমি যেহেতু কাননের সঙ্গে একই বাসায় থাকি ফলে ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গেও খাতির হয়ে যায়।
কানন আবার আমার সরাসরি পরিচিত না। পৃথিবীতে মানুষ মা ছাড়া আর কারও সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হয় কি না সেটা জানতে হলে গবেষণা লাগবে। যেমন আমার সঙ্গে ইলিয়াস ভাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় কানন, কাননের সেঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মারুফ ভাই। ওনার পরিচয় আমার সঙ্গে কীভাবে হলো মনে নাই। তিনি এখন কোথায়-কীভাবে আছেন জানি না। ক্যাম্পাসের বড় ভাই ছিলেন, আমাকে পছন্দ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকায় ওঠার আগে ওনাকে ফোন দিই। তিনি আমাকে কাননের কাছে পাঠান। কাননের সঙ্গে ওঠার কয়েকদিন পর দেখি ইলিয়াস ভাইকে। সেই ইলিয়াস ভাইয়ের হাত হঠাৎ আমার ঘাড়ে এসে পড়ায় থেমে যেতে হলো।
আমি গিয়ে ছিলাম ওই এলাকায় একটা কাজে। একটা খেপ পাওয়ার কথা ছিল। খেপ বলতে ট্রান্সক্রিপ্ট। একজন প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা তার পেশাজীবন নিয়ে একটা বই করবেন। আত্মজীবনীর মতো বই। আমার কাজ তার কথা রেকর্ড করে সেগুলো কাগজে ফুটিয়ে তোলা। বেশ ভালো টাকার কাজ। বই ছাপা, কভার, প্রুফ মিলিয়ে লাখখানেক তো হবেই। তিনি আমাকে তার বাসায় ডেকে ছিলেন। সনি সিনেমা হলের পেছনে বাসা। সে বাসায় গিয়ে কাজটা জোগাড় করার টেনশন ছিল আমার ভেতর। ফলে ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েই হাঁটা দিই। আগেও খুব একটা কথা যে তার সঙ্গে আমার ছিল তা না। আমাকে দাঁড় করিয়ে নিজেদের পথসভার কথা শোনানো আর লোক বাড়ানোর ধান্দা থাকতে পারে ইলিয়াস ভাইয়ের–চকিতে মনে হলো এমন। বরাবরই এসব করে পলিটিশিয়ানরা। ক্যাম্পাসেও দেখেছি, নিজেদের টেন্টের কাছে পেলে ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন আর চা ধরিয়ে দিতেন বড় ভাইরা। তাতে মনে হতো আমি তাদের লোক। লজ্জায় কিছু বলতেও পারতাম না। এখন সেসব দিন নাই। আমারও অত ভদ্র সাজার অবকাশ নাই।
কিন্তু ওই সাবেক পুলিশ অফিসার আমাকে তার বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনি আরেকদিন আসেন। বসতেও বললেন না। আমার শালা মেজজাটাই খারাপ হয়ে গেল। সেই শাহবাগ থেকে এত কষ্ট করে শ্যামলী আসলাম। ভাড়া লাগল, পরিশ্রম করলাম, এখন আবার ফিরে যাব–মেজাজ খারাপ না হয়ে উপায় আছে? তারচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো আমার মনে হলো তিনি বইটা করবেন না। কোনো একটা ঘাপলা ঢুকেছে তার মনে। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন রীনা আপা। এই রীনা আপা আবার আরেক কেস। এখানে একসঙ্গে অনেকগুলো কেস আছে। সব কেসই আমি ডিল করতে রাজি ছিলাম টাকার জন্য।
কারণ আমার টিকে থাকার উপায় হলো এসব খেপ মারা বা কনট্রিবিউট করা। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সাহিত্য বা এডিটোরিয়ালের সম্পাদকদের ডেস্কে ডেস্কে ঘুরে বেড়ানো আমার কাজ। তাদের কাছ থেকে কোনো একটা টপিক নিয়ে এসে লেখা দিই বা অনুবাদ করে দিই। আশায় আছি কোথাও একটা চাকরিতে ঢুকে যাব। তখন আর কাউকে পুছব না। চাকরি করব, মাস শেষে বেতন নেব। আমার টার্গেট হলো প্রথম আলোতে ঢুকব। ওদের অফিসটা ভালো, চাকরির নিশ্চয়তা আছে। প্রথম আলোতে চাকরি করি শুনলে ভাব-সাব কিছু বেড়ে যায়। কনট্রিবিউট করি, তাতেই তো আমার একটা পার্ট তৈরি হয়েছে। তবে এখানেও নানা কেস আছে। যেমন একটা অনুবাদ হয়তো আমি নিজে নিজে ঠিক করে রাখলাম, তখন আমার অটোমেটিক চিন্তা প্রথম আলোতে দেব। কারণ ওরা টাকাটা অন্যদের তুলনায় তাড়াতাড়ি দেয়, কিছু বেশিই দেয়। আর তাদের লেখা পড়েও বেশি লোকে। এখানে কেসটা হলো, আমি দেখা গেল কথায় কথায় অন্য পত্রিকার কোনো এক পাতার সম্পাদককে বললাম এটা অনুবাদ করছি। নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তো এসব বলতেই হয়। সেই সম্পাদক ভাবলেন যেহেতু তাকে বলেছি অনুবাদের কথা, তাহলে তার পত্রিকাতেই দেব অনুবাদটা। কিন্তু আমি দিয়ে দিলাম অন্য পত্রিকায়। তখন আবার মনোমালিন্য। একই পলিটিকস সব পত্রিকায়। এসব ম্যানেজ করে চলতে হয়। মাঝে মাঝে পত্রিকার বিলের পরিমাণ কমে যায়। যে কারণে বাইরের কাজ খুঁজি। এই সাবেক পুলিশ অফিসারেরটাও সেই বাইরের কাজ। আর এর সঙ্গে যুক্ত রীনা আপা।
পত্রিকায় কাজ করতে করতে কিছু প্রকাশকের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। দেখা গেল তাদের কোনো একটা বই বের হলো, পত্রিকায় সেটার পাবলিসিটি আমাকে করতে হয়। সাহিত্য সম্পাদকের অনুরোধক্রমে প্রকাশকের কাছ থেকে বই এনে কিছু লিখে দিতে হয়। এতে বইয়ের মালিকানাও আমার হয়ে যায় আবার টাকাও পাই। এ সূত্রেই রীনা আপার সঙ্গে পরিচয়। আমাকে ওনার কাছে পাঠান তরিকুল ভাই। গিয়ে দেখি কাঁটাবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে এক মহিলা ঘামাচ্ছেন। ভরাট শরীর নিয়ে বসে আছেন তিনি। ফরসা গায়ের রঙ গরমে লালচে হয়ে আছে। গোলগাল মুখ, যাকে বলে পউটি লিপস বা উন্মুখ ঠোঁট ওনার। দুটো সেকেন্ড ব্র্যাকেট আমাকে দেখামাত্র হেসে উঠল। তবে ওনাকে দেখে আমার মনে হলো, ভেতরের অনেক অপ্রস্তুতি ঢাকতে কেউ কেউ বাইরেটা বেশ চকচকে করে রাখেন। যাকে বলে ডোনট জাজ অ্যা বুক বাই ইটস কভার। রীনা আপাও তেমন। নিজে বেশ গোলাপী সুতির শাড়ি, পাতলা ব্লাউজ, চোখে কাজল দিয়ে রাখলেও ওনার অফিস ঘরটা এলোমেলো, ছোট। এসি চলে না ঠিকমতো। খুব গরম হয়ে থাকে ভেতরটা। তিনিও অল্প সময়ের জন্য কোনোরকম অফিসে আসেন। আসার জন্যই আসা। লোক দেখানো কাজ তার। বাপের গাড়িতে এসে কিছুক্ষণ বাপের বানানো অফিসে বসে বাসায় চলে যান। ওনার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনেই বুঝে গেলাম ব্যাপারগুলো।
তরিকুল ভাই বলেছিলেন, ইয়ং ছেলেদের রীনা আপা পছন্দ করেন। বিয়ে করেন নাই। একাই থাকেন বাবার বাসায়। বাবার ব্যবসা দেখেন। আমি বললাম, পছন্দ করেন মানে কী? তরিকুল ভাই বললেন, গিয়াই দেখেন না, গেলে বুঝবেন। মেয়েদের বুঝার ব্যাপারটা আপনার ভেতর আছে।
আমি বুঝলাম ধীরে ধীরে। রীনা আপার কম বয়সের ছেলে দেখলে পছন্দ হয়ে যায়। আমাকেও পছন্দ করে ফেলেছেন। অন্য ছেলেদের সঙ্গেও ফোনে-ফেসবুকে ওনার যোগাযোগ হয়। সেসব একটু চোখ-কান খাড়া রাখলেই দেখে ফেলা যায়। আমি ওনাকে দেখেছি ইনবক্সে এক ছেলেকে ছবি দিতে। তরিকুল ভাই বলেন, ‘সাপিও’।
রীনা আপা কথা বলতে আর গল্প করতেই থাকেন করতেই থাকেন। আর খুব খাওয়াতে চান। একটু পর পর বলবেন, ‘এই কী খাবা?’, ‘খাবা কিছু?’। আমার অবশ্য তাকে পছন্দ হচ্ছিল না। কিছুটা বয়স্ক তিনি, কিন্তু আচরণ করেন যেন খুব কম তার বয়স। কিছুদিন আলাপের পর আমাকে বললেন, তুমি করে ডাকতে। আমি বোধহয় কিছুটা গ্রাম্য। আমি ওনাকে তুমি ডাকতে পারি না। বাসায়ও যেতে বলেছিল, আমি যাই নাই। ওনার এই যে এত সহজে আপন করে নেয়ার ইচ্ছা– কেমন যেন আমি এটা পছন্দ করতে পারি নাই। নিজেকে সেই টান থেকে সরিয়ে রাখার বহু চেষ্টা করে যাচ্ছি। আবার তাকে ছেড়েও যাচ্ছি না। কারণ কাজ করে টাকা পাচ্ছি। তরিকুল ভাই ওনার সঙ্গে দেখা করে আসার পরই মুচকি মুচিক হাসেন। কেন হাসেন, আমি জানতে চাইলে তারপর হো হো করে হাসেন। তারপর বলেন, কেমন ভালো না?
আমি বুঝি ওনার ইঙ্গিত। উনি দুষ্টু আছেন। আমি বলি, রীনা আপার কেমন যেন একটা পেঁচিয়ে ধরার টেনডেনসি। ফেঁসে যাব। তরিকুল ভাই বলেন, কীসের পুরুষ হইলেন তাইলে, হবে না আপনারে দিয়ে। আমি অবশ্য কিছু হওয়াতে চাই না এখন। আমার চাকরি দরকার। চাকরির পর দুনিয়াটা বদলে যাবে আমার জন্য।
সেই রীনা আপা আমাকে এ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করায়ে দেন। তিনি আগের কোন এক আমলের পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তার অবসর চলে আসে। তারপর দীর্ঘ সময় চুপ ছিলেন। এখন তার ইচ্ছা হচ্ছে কর্মজীবন লিখে রাখবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছায় ছাই পড়েছে হয়তো। কে দিল! জানি না। বিরক্তি নিয়ে বের হলাম তার বাসা থেকে। আবার সেই শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে ইলিয়াস ভাইলের চওড়া থাবা। আমাকে দাঁড় করিয়ে হাতে চা ধরিয়ে দিলেন। তখন দেখা শান্তার সঙ্গে। ছোটখাট গড়নের একটা মেয়ে। মুখে ক্লান্তি। চোখে অবশ্য সতেজ ভাবটা রয়েছে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো তার। আমিও সামান্য হাসলাম। চা খেলাম, কথা বললাম। শান্তার আবার তলপেটে চাপ পড়েছে। ইলিয়াস ভাই আমাকে বললেন বিষয়টা। আমি শ্যামলী সিনেমা হলের সেই মার্কেটে একটা ব্যবস্থা করে দিলাম। ইলিয়াস ভাই নিজে কেন গেলেন না শান্তাকে এ কাজে হেল্প করতে? হয়তো ওনার সঙ্গে ওনার দলের আরো যারা আছেন, তাদের সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। আমার মনে এ রকম নানা প্রশ্ন তৈরি হলো। এসব প্রশ্ন আমি শান্তাকে করলাম ফেসবুকে। ওই ঘটনার পর শান্তা আমাকে ফেসবুকে নক করে। তখন আমি জানতে চাইলাম। কারণ দলের একটা মেয়ে পেশাব করবে এটার জন্য আমাকে ইউজ করা হলো কেন? ঢাকায় থাকা একটা মেয়ে মার্কেটের টয়লেট খুঁজে পাবে না সেটাও তো কেমন কথা। পরে শান্তা জানালেন, তিনি ব্যানার ধরে দাঁড়ায়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখেন। পরে পথসভা শেষে যখন চা খাওয়ার আলাপ চলছিল, তখন ইলিয়াস ভাইকে না জানিয়ে মার্কেটের ভেতর ঢুকতেও চাইলেন। কিন্তু ইলিয়াস ভাই জানতে চাইলেন, ‘কই যাও’। তখনই আমি এসে হাজির আর আমাকে তিনি ট্যাগ করে দিলেন। আমি বললাম, ‘এটা তিনি কেন করলেন?’ শান্তার বক্তব্য, ম্যাসকুলিনিটি। মেয়েদের পুরুষের নিরাপত্তা ছাড়া কোথাও যেতে দেন না বামের নেতারা।
আমি বুঝলাম না এর মাথামুণ্ডু কিছু। আমাকে বুঝানোর জন্য পরে শান্তা বলল দেখা করবে। ওর অপেক্ষায় যে কারণে বসে আছি। নির্দিষ্ট সময় পার হলেও সে আসছে না দেখে বিরক্ত হচ্ছি। অযথা সিগারেট টানছি। এ সময় পত্রিকা অফিসের লোকজন ব্যস্ত হতে শুরু করে। তারা কেউ কেউ সন্ধ্যার পর একবার হয়তো নামে চা খাওয়ার জন্য। বা যাদের অফিস শেষ হয়ে যায় তারা নামে। এখন কেউ নাই, ফলে আমি একা। বসে বসে জ্যাম দেখছি। তখন সালাম দিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন লম্বা এক লোক। তাকে আমি প্রথমে চিনতে পারি নাই। তিনি জানালেন তার নাম মুকিম। আমার সঙ্গে শ্যামলী সিনেমা হলের ওখানে সেদিন পরিচয় হয়েছিল। ইলিয়াস ভাই আর শান্তার সঙ্গে তিনিও ছিলেন। আমি মেনে নিলাম তার কথা। মনে হলো আমি তাকে আসলেই দেখেছি।
জানতে চাইলাম, ‘আপনি এখানে?’
‘হে হে, আসলাম ব্যবসার কাজে। ’
‘ব্যবসা মানে?’
‘এই যে সবজির ব্যবসা, লাউয়ের সিজনে লাউ, পটলের সিজনে পটল, পেঁয়াজ–এসব। ’
‘এখন কি তাইলে জিনিস বেচতে আসলেন?’
‘বেচতে না, এখন সবজির সিজন নাই আর ওইভাবে, সামনে বর্ষা চলে আসবে। এমনি আসলাম পাইকারদের সঙ্গে দেখা করতে?’
‘ওহ, ঢাকায় আসছিলেন কেন তাইলে?’
‘আসছি, পার্টি অফিসে আসি মাঝে মাঝে। ’
‘ওহ, তা সবজির ব্যবসা কেমন?’
‘সবজির ব্যবসা ভালোই। ’
‘ব্যবসা ভালো, কই আমরা তো ভালো সবজি পাই না। ’
‘ভালো সবজি আপনেরা পাবেন না। শোনেন আপনি তো পার্টির লোক, ভালো সবজি সব চলে যায় জায়গামতো। ’
‘আপনি কোথায় থাকেন?’
‘যশোর। ’
‘সেখানে কি নিজের জমি চাষ করেন?’
‘নিজের জমি, অন্যের জমি মিলায়ে করি। ’
‘কতটুকু জায়গা?’
‘আছে ভালোই?’
‘তারপর নিজে নিয়ে আসেন সেসব সবজি?’
‘আমি আনি না, লোক আছে, তারা নিয়া আসে?’
‘তাইলে বললেন যে সবজি চলে যায় জায়গামতো?’
‘হু যায়। ধরেন আমি যখন লাউয়ের চাষ করি, তখন সবচেয়ে ভালো লাউটা চলি যাবি মিন্টো রোডে। ’
‘কীভাবে?’
‘চলে যাবে, হিসাব আছে। পাইকাররা নিয়ে যায়। জমি থেকে সোজা মন্ত্রী-মিনিস্টারের বাসায়। ব্যবসায়ী গো বাসায়। অরা বেশি দাম পায়, আমরাও পাই। দেখেন না ভিআইপি গেলে রাস্তা ছাইড়ে দিতে অয়, সবজিও ছাইড়ে দিতে অয়। ’
‘ভালো মানে কী, আপনারা কেমিকেল দেন না সেগুলায়?’
‘ভালো মানে ধরেন যে, মিষ্টি, নরম। কেমিকেল তো লাউয়ে দিতি অয় না। তয় ধরেন যে কেমিকেল বিষয় না, বিষয় হইল ফ্রেশ। প্রতিদিন এত সবজি লাগে, কেমিকেল ছাড়া কি আর সব হয়। বিষয়ডা এমন যে আপনি দশদিন লাউ কিনলে একদিন ভালো পড়ে। আর তাগের লাউ সবই ভালো। ’
‘সবই ভালো?’
‘আপনি পার্টির লোক, বিষয়ডা বুজতি পারেন না? আমাগের বাড়ি রূপদিয়া। সেখানে জমাজমি যা আছে, আমরা যে চাষ করি তা তো সব জানে। এলাকার নেতারাও জানে। তাগো তদবির থাকে। সে করে কী সবচেয়ে কচি লাউডা আগেই বন্ধক দিয়ে রাখে। ঢাকায় আসার সময় নিয়ে আসে। আমাগের ওদিকে বুড়ি ভৈরবে যদি মাছ-টাছ ধরা পড়ে তাইলেও ওই নেতারা সব নিয়ে আসে। আপনেরা জীবনেও এসব মাছ চোখে দেখবেন না।’
‘আচ্ছা।’
‘হ মজাডা এহানে। আমরাই দিয়া আসি। সবচেয়ে ভালো পেঁপেটা, ভালো জাতের চালটা, খালের মাছটা–ডিসি-এসপিদের দিয়া আসি। আগের জমিদারদের দিয়ে আসত না? এহন এসবেরে দিয়ে আসি। জমি-জমা, ব্যবসায় এদের কাছে যাতি অয়।’
‘আচ্ছা।’
‘শোনেন ডেঙ্গি চিনেন ডেঙ্গি? ডেঙ্গি এ রকম বিলের বা নদীর কিনারে হয়। শুকায়ে গেলে পরে বড় বড় গর্তে মাছ জমা হয়। সেসব মাছের কেমন যে টেস্ট, খাবেন তো মনে হবে পরের ঘরে বউরে চুমা খাচ্ছেন। দামও অনেক। এসব মাছ আপনি জীবনেও পাবেন না বাজারে। সেগুলো সব চলে যায় জায়গামতো।’
আমি এবার লোকটাকে আরো ভালো করে দেখতে থাকলাম। যে দল আমি করি না বা কখনও করি নাই, ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় সুবাদে সে দলের এক লোক কতকিছু আমাকে বলে ফেললেন। হয়তো তেমন কোনো কথা না এটা। কিন্তু আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। মনে হলো এই লোক এমন তথ্য জানেন যা সবাই জানে না, ভাবতেও পারে না। সমাজটাকে তিনি অন্যভাবে দেখতে পান। যা আমার চিন্তাতেই আসে নাই কখনও। লাউয়ের বণ্টন নীতি যে এমন হতে পারে সেটা আমাদের কখনও কেউ পড়ায় না। পত্রিকায়ও খবর হয় না। অথচ এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা খবর হতে পারে।
লোকটার যাওয়ার সময় হলো বোধহয়। আমি তাকে চা খাওয়ার অফার দিলেও নিলেন না। বললেন খুব গরম। এখন বাসায় চলে যাবেন। উঠেছেন আত্মীয়ের বাসায়। কাল ভোরে যশোর চলে যাবেন। আমার নামটাও জানতে চাইলেন যাওয়ার সময়। এটা আমাকে আরো অবাক করল। নামটাও ভুলে গেছেন, শুধু চেহারা মনে রেখে আর পার্টির লোক ভেবে অনেক গোপন কথা আমাকে বেলে গেলেন।
কিন্তু কথাগুলো কি আসলে গোপন! এই বণ্টন ব্যবস্থায় তো অনেকে যুক্ত। প্রতিদিন, প্রতি বছর এটা একটা সিস্টেম তৈরি হয়েছে। তাহলে এটা গোপন থাকে কীভাবে! যার যার জানার সে সে ঠিকই জানে। আসলে যা স্বাভাবিক, সাধারণ, নৈমিত্তিক ঘটনা তার ভেতর থেকে জানার কী আছে! তাহলে আমি অবাক হলাম কেন? তরিকুল ভাই ঠিকই বলেন, গ্রামের মানুষের একটা স্বভাব হলো অযথা জ্ঞান দেওয়া। এই লোকও আমাকে জ্ঞান দিয়ে গেল। প্রথমে বুঝতে পারি নাই। পরে নিজেকে বোকাচোদা মনে হলো। আমার যেহেতু মাছ-সবজি এসব নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন কখনও হয় নাই, ফলে তার কথাগুলা নতুন লাগল। নইলে এই কাওরান বাজারের মূর্খগুলা এগুলা সব জানে। আমি জানি না দেখে কিছুটা অবাক হলাম– এ ঘটনার গুরুত্ব এটুকুই। অযথা উত্তেজনায় মুখের ভেতর থু থু জমল।
শান্তাও এল না। ফোন নাম্বার দেওয়া-নেওয়া হয় নাই আমাদের। শুধু ফেসবুকে কথা হয়েছে। ফোন নাম্বার যে নিয়ে রাখব সেই বুদ্ধিও আমার নাই। এখন কলও করতে পারছি না। বসে থাকব না চলে যাব ডিসিশনও নিতে পারছি না। হয়তো ফেসবুকে মেসেজ দিয়েছে সে। কিন্তু ফোনটা স্মার্ট না আমার। কোনো অফিসে সুযোগ পেলে ফেসবুক চালাই। বিরক্তি ধরে গেল নিজের ওপর। সেটা কাটাতে রীনা আপাকে কল করব ভাবছিলাম। তখনই ওনার ফোন এল।
‘হ্যালো সৌরভ, তুমি কই?’
‘আমি কই মানে? আপনি আজ আমাকে এত কষ্ট দিলেন?’
‘আচ্ছা শোনো না, ওই লোকটার না সমস্যা হয়েছে। ওনাকে কেউ বলেছে এখন এসব কথা লিখে বই বের করবেন না। ঝামেলা হতে পারে।
‘এসব কথা মানে?’
‘মানে অনেক ঘটনা আছে। তোমাকে বলব পরে। আসো না বাসায় আসো। ’
‘না, বাসায় যাব না কাজ আছে। উনি তাইলে কাজটা করবেন না?’
‘করবেন পরে, এখন না। ’
‘ওনাকে বলেন না, ওনার কথা শুনে লেখা রেডি করতে করতেও তো অনেক দিন লেগে যাবে। কাজটা রেডি হয়ে যাক, পরে না হয় বই করবেন। ’
‘না না, উনি এখন কোনো কথা ডিসক্লোজ করতে চান না। ’
‘তাইলে এখন কী করব?’
‘আচ্ছা তুমি টেনশন নিও না। আমি আরেকটা কাজ ম্যানেজ করে দেব তোমাকে। ’
‘তাইলে আরকি, আমি রাখি কাজ আছে। ’
‘ইয়ে মানে, তুমি এমন করো না প্লিজ, রাগ করো না। তোমার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি। বাসায় চলে আস তোমাকে খাওয়াব। ’
‘খাওয়াব মানে?’
‘খাবা, ক্ষুধা পায় না তোমাদের ছেলেদের?’
‘কী খাব?’
‘কী খেতে চাও তুমি বলো, তুমি যা রেগে আছ, কী খেতে চাইবা কে জানে?’
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কাওরান বাজারের বিকেল গল্প সালাহ উদ্দিন শুভ্র সালাহ উদ্দিন শুভ্রর গল্প 'কাওরান বাজারের বিকেল' সাহিত্য