মণ্টির ফটোগ্রাফ
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:৫৭
নান্নু সাহেব বসেন।
নান্নু টেবিল ঘিরে থাকা চারটি চেয়ারের একটিতে বসল। প্রভা এনজিওর ডিরেক্টর আতাউর রহমান রিভলবিং চেয়ারে পেছনের দিক হেলান দিয়ে অর্ধশায়িত হয়ে বললেন, আপনি এত চুপচাপ থাকেন কেন? একেবারেই কথাবার্তা বলেন না। বর্তমান মানুষের প্রধান কাজ হল বকবক করা। এর মধ্যে আপনি তো বেমানান হয়ে যাচ্ছেন।
নান্নু সামান্য হাসল। কিছু বলল না।
শোনেন নান্নু সাহেব, এ মাস থেকে আপনার বেতন বাড়ল পাঁচ হাজার। জানেন তো?
জ্বী জানি।
আপনি খুশি হননি?
হয়েছি স্যার, ধন্যবাদ।
আসলে আপনাকে খুশি করার জন্য বেতন বাড়ানো হয়নি। বেতন বাড়িয়েছি আপনার যোগ্যতায়। আপনি খাতাপত্রে যেমন পরিষ্কার, তেমনি অফিসের পরিবেশের ব্যাপারেও পরিষ্কার। কোন কথাকথির মধ্যে নেই।
ধন্যবাদ স্যার।
এই যে দ্যাখেন কয়েকদিন আগে সুইডেন থেকে চল্লিশ লাখ টাকা আসলো। আপনিইতো টাকাটা রিসিভ করেছিলেন, নাকি?
জ্বি স্যার।
টাকাটা এসেছে সেনিটেশন প্রোগ্রামের জন্য। হিসাব করা টাকা। অথচ নাকি কানাঘুষা চলছে টাকাটা আমি মেরে দিয়েছি। এদেশে মানুষের জন্য কিছু করতে নাই। ছয়টি গ্রামে আমি সেনিটেশনের ব্যবস্থা করেছি না?
জ্বি করেছেন।
আর কত? যা হোক, ওসব কথা থাক। আপনি তো বিয়ে থা করেননি?
জ্বি না।
সংসারে আছে কে?
আমি আর মণ্টি।
মণ্টি কে? আপনার ভাইবোন কেউ?
জ্বি না। তবে খুবই কাছের…।
ডিরেক্টর সন্দেহের চোখে তাকালেন। বললেন, আপনার তো মা-বাবা নেই?
জ্বি না।
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, আপনার কথা কিছু কিছু জানি। আপনি একা। একটু বুঝে শুনে চলবেন। ঠিক আছে নান্নু সাহেব, কাল দেখা হবে।
নান্নুও চেয়ার ছেড়ে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল অফিস আওয়ার শেষ। পাঁচটা বেজে গেছে।
মাঝেমাঝেই নান্নুর মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি নিঃসঙ্গ? মানুষ আসলে নিঃসঙ্গ হয় না। শুধু মনে করে সে নিঃসঙ্গ। একা থাকলেও তার চিন্তার জগতে কেউ না কেউ থাকে। নিজের হৃদয় মানুষকে সঙ্গ দেয়। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি বুঝছিলেন। হয়তো তাই লিখতে পেরেছেন, তুমি রবে নিরবে-হৃদয়ে মম। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে না পারলে সে বেঁচে থাকবে কী করে? যে নিজের সঙ্গে কথা বলতে জানে না তার তো নির্জীব জীবন। হাঁটতে হাঁটতে নান্নু একটা বিশেষ দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। দোকানে পোষা প্রাণীর খাবার, অষুধ ইত্যাদি বিক্রি করে। সে এক কৌটা বিদেশী খাবার কিনলো। দেশের মানুষ বিদেশী খাবার, বিদেশী পোষাক এমনকি কালচারের প্রতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কুকুররাও কি তাই? কুকুরের কি বিদেশপ্রীতি সৃষ্টি হতে পারে? কুকুরের কি দৃষ্টিভঙ্গী চেইঞ্জ হয়? দুশ বছরের আগের কুকুর আর এখনকার কুকুরের চিন্তা কি একরকম? বুদ্ধি কি একরকম? মানব সমাজের ভেতর বাস করে ওদের চিন্তায় কি পরিবর্তন আসেনি? ধরা যাক এক কুকুর আরেক কুকুরের ভাষা বোঝে। ধরা যাক মণ্টি এই টিনজাত খাবার খেয়ে রাস্তায় বের হল। দেখা হয়ে গেল রাস্তার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়া ঠিকানাহীন কুকুরের সাথে। মণ্টি বলল, কিরে নেড়ি কুত্তা, কোথায় যাস?
মণ্টি ভাই নাকি! আসসালামু আলাইকুম। আইলাম তুমাগো এলাকায়। দেখি কোনো বাড়ি গিয়া ফ্যান ট্যান, আইটা খাবার কিছু পাই কি না।
তোরা যে কি করে ওসব খাস ভেবেই পাই না। আমি তো আজকাল দেশি টেবিলে রাখা খাবারই খেতে পারি না।
তুমার কি মণ্টি ভাই, তুমার তো যত্ন নেওয়ার মত একজন প্রভু আছে। আমা গো কি সেই ভাগ্য!
তা ঠিকই বলেছিস। এই যেমন আজ মেইড ইন ইংল্যান্ড খাবার খেলাম। স্বাদই আলাদা। এসব খাবার তো বাংলাদেশের অনেক মানুষই চোখে দেখে না।
লেডি কুত্তা অনেকখানি জিহব্বা বের করে শুনল। বলল, ঠিকই কইছো মণ্টি ভাই। লাখ লাখ মানুষের অবস্থা আমাগো চে’ খারাপ। খাওয়া পড়া নাই, সম্মান নাই। দ্যাখো ভাই, আমাগো তো কারও কারও নাম আছে। যেমুন তোমার নাম মণ্টি। গরিব মানুষের পোলাপানের কোনো নামও নাই। ওরা সবাই টোকাই।
তুই থাকিস কোথায় লেড়ি?
কাওরান বাজারের ফুটপাতে থাকি মণ্টি ভাই। কয়েকশ’ মানুষ আর আমরা মোট আঠারো উনিশটা কুত্তা-কুত্তী। মানুষগুলো সারা রাইত ছটফট করে। ময়লায় গাও কামড়ায়। আর বেশির ভাগের নানাজাতের রোগ বিরোগ। সারারাইত ওগো মশায় খায়। মায়া লাগে মণ্টি ভাই!
মণ্টি মোটা গলায় ভোক ভোক করে বলল, ঠিকই বলছিস নেড়ি। গরীবের পোলাপানগুলারতো তো অনেকটা কুত্তা জীবন। দেশ তো দূরের কথা, মা বাবাই যত্ন নিতে জানে না!
নান্নু নিজে নিজে হাসল। মানুষের কল্পনার কোন সীমা নেই। এতক্ষণ সে কী চিন্তা করল!
বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল দূর থেকে দৌড়ে আসছে মণ্টি। কাছে এসেই পায়ের সাথে মাথা ঘষতে থাকল। মণ্টি রীতিমত হাপাচ্ছে। সামনের দুই পা দিয়ে সোহাগ করে পা জড়িয়ে ধরছে। নান্নু বলল, কীরে ব্যাটা, কোথায় ছিলি? একেবারে হাপিয়ে উঠেছিস! খাবার টাবার কিছু খেয়েছিস? চল খাবার দিচ্ছি। আজ স্পেশাল খাবার।
নান্নু ঘরের ভেতর ঢুকল। মণ্টির নির্দিষ্ট প্লেটে করে কিছু খাবার কৌটা থেকে ঢেলে বারান্দায় ফিরে এল। বলল, দ্যাখতো ব্যাটা, খেয়ে দ্যাখ। আমি তো এসব কীভাবে খাওয়াতে হয় জানিও না। বুঝলিরে, ইংল্যান্ড থেকে আমদানী করা খাবার। অফিসে বেতন বাড়ছে। খুশির খবরটা কাকে দেব? কেউ তো নাই। যার পরিবার আত্মীয় নেই তারও কাছের কিছু মানুষ থাকে। আমার তো আছিস তুই-ই। তাই তোর জন্য স্পেশাল খাবার নিয়ে এলাম।
মণ্টি লেজ নাড়া বাড়িয়ে দিল।
বুঝলি, সবাই বলে আমি নাকি কম কথা বলি। দ্যাখতো আমি তোর সাথে কত বকবক করি! মানুষের সাথে বলবোই বা কী! কেরানির চাকরি করে বা প্রফেসর, সেও যদি শোনে কারো ডায়বেটিস বা হৃদরোগ, সেও এক ঘন্টা লেকচার দিয়ে অষুধ প্রেসক্রাইব করে! অবস্থা বুঝলি কিছু?
মণ্টির এক বিশেষ বৈশিষ্ট হল রাতে ডাক দিলে সে দরজার বাইরে বসে কু-কু শব্দ করে। দরজায় মুখ দিয়ে টোকা দেয়। প্রবল চেষ্টা করে জানাতে চায় আমি দরজার সামনেই আছি।
রাতে ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। বেশ খানিক সময় প্রচণ্ড বাতাস ওলোটপালট করে ফেলতে চাইল। তখন বিদ্যুৎ চলে গেল। ঝড় বৃষ্টি থাকল না। কিন্তু বিদ্যুৎ আর ফিরে এল না। রাত যেন অন্ধকার সাগরে ডুবতে থাকল।
চারদিকের বাড়িঘরগুলো অন্ধকারের কোলে ঢলে পড়েছে। শুধু আকাশের বিদ্যুৎ চমকে চমকে প্রমাণ করছে, এখানে পৃথিবী আছে।
নান্নু বিছানায় শুয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই নান্নুর? নিশ্চিয়ই আছে! হয়তো কেউ না কেউ তাকে ফিল করে। শিলাও তো এখন তিন সন্তানের মা। শিলার কি কখনও মনে হয় না যে নান্নু একা?
হঠাৎ মণ্টি ভোকভোক করে চিৎকার করতে থাকল। মণ্টির চিৎকারে চারদিকের নিরবতা খান হয়ে গেল। নান্নু খানিকক্ষণ কান সজাগ করে রাখল। কিন্তু মণ্টির চিৎকার আরও বাড়ছে। এবার নান্নু বিছানা ছেড়ে উঠে আসল। দরজা খুলে মণ্টিকে ধমক দেওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকাল। আর তখনই চোখে পড়ল পাশের দোতলার সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো পাঁচিলের উপর পা রেখে নেমে যাচ্ছে এক যুবক। তার মাথার কাছে ছোট বারান্দায় অর্ধ উলঙ্গ একটি মেয়ে মেয়েটি দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরছে। এক সেকেন্ডের দৃশ্য! নান্নুর গলায় শব্দ বের হতে চাইল না। তারপরও বলল, মণ্টি থাম!
মণ্টি অবাক করে দিয়ে থেমে গেল। নান্নু সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। নিজেই নিজের কাছে বিব্রত বোধ করল। কেন এ দৃশ্যে তার চোখ পড়ল? দৃশ্যটি কি স্বাভাবিক? একবার মনে হল অবশ্যই স্বাভাবিক। হয়তো দুজন তরুণ তরুণী জন্ম জন্মান্তর থেকে পাওয়া ক্ষুধা নিবৃত করল। সমস্যা কী? এই ক্ষুধাকে অস্বীকার করে কার সাধ্য! অনেক মহাপুরুষও তো এই ক্ষুধার কাছে নতি স্বীকার করেছেন! এক সেকেন্ডে দেখা যুবক যুবতীর জন্য তার মায়া হলো। কত কষ্ট করে ওরা এই ঝড় বৃষ্টির রাতে তৃষ্ণা মেটাতে এক হয়েছে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, সমাজের ভয় সব উপেক্ষা করেছে। বিছানায় শুয়ে নান্নু বারবার বালিশ এপিঠ ওপিঠ করল। ওদের জন্য মায়া হলেও দৃশ্যটা নান্নুর কাছে অস্বাভাবিক। কোন ক্রমেই ঘুম আসে না ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা ভাব এসেছিল। ওই পর্যন্তই সকালে সে লাল চোখ নিয়ে অফিসে গেল। অফিসে বসেও বারবার রাতে দেখা সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। নান্নু জোর করে তা ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল।
ক্যাশ সেকশনের হুসাইন আনসারী এসে নান্নুর সামনে বসল। আনসারীরর মুখে কালো দাড়ি। মৌমাছির চাক যেমন ঝুলে নীচের দিকটায় চোখা হয়ে যায়, তেমনি আনসারির লম্বা দাড়িও চোখা হয়ে বুকের কাছে শেষ হয়েছে। মাথায় সাদা টুপি। চোখে সুরমা। এখনও সুরমা কোথায় পাওয়া যায় কে জানে! আনসারী বলল, নান্নু সাহেব, নামাজ পড়েছেন?
নান্নু বিব্রত হল। আনসারী মাঝে মাঝে নামাজ পড়েছে কিনা জানতে চায়। শুধু নান্নুর কাছে না, অফিসের সবাইকেই সে সুযোগ পেলে এই প্রশ্নটা করে। তিনি সবাইকেই আখেরাতের ব্যাপারে সতর্ক করেন।
নান্নু বলল, না ভাই, পড়ি নাই।
আনসারী যেন তৃপ্তি পেল। এই উত্তরই যেন আশা করছিল। বলল, নামাজ পড়বেন ভাই, নামাজ পড়াটা খুব জরুরী। পরকালে হিসাব দিবেন কি একটু ভাবছেন?
পড়ব আনসারী ভাই। শুরু করব।
আলহামদুলিল্লাহ! শুনেও ভালো লাগলো। নান্নুভাই, শুনলাম আপনি একটা কুকুর পোষেন?
নান্নু বিব্রত হয়ে বলল, হ্যাঁ, পুষি আর কী।
আনসারী বলল, খুবই খারাপ কথা নান্নু ভাই। শিগগির ওইটাকে বাড়ি থেকে তাড়ান। একটা নাপাক প্রাণী, রোজা নামাজ করবেন কেমনে!
নান্নু একটু অবাক দৃষ্টিতে বলল, নামাজ রোজার সাথে ভাই কুকুরের সম্পর্ক কী?
আনসারী টেনে টেনে বলল, আছে ভাই, আছে। এইটা আপনি বুঝবেন না। দ্যাখেন, নাছাড়া-জালিম আমেরিকানরা বোঝে! গুয়ান্তানামোতে, আবু গারিবে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কী ব্যবহার করছে জানেন?
কী?
ইহুদি সৈন্য আর কুকুর। দুইটাই মুসলমানের শত্রু। আমি তো কুকুর দেখলেই পিটাই। সেদিন একটারে পাউরুটির মধ্যে বড়শি দিয়েছিলাম। আর দ্যাখে কে! তিনচারদিন ভুইগা মরল। আল্লাহর ইশারায় একটা ইহুদি যদি বড়শিতে গাঁথতে পারতাম! দিলটা একটু ঠাল্ডা হইতো নান্নু সাহেব!
নান্নু প্রতিদিন দুপুর দুটো বাজতেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খেতে বসে। মনে পড়ে মণ্টির কথা। মণ্টি কী করছে? সকালে খাবার দিয়ে আসা হয়। কিন্তু দুপুরে? মন খারাপ হয়ে যায়। এটাই কি মায়া-ভালোবাসা? এমন কী কোন কথা আছে যে মানুষকেই শুধু ভালোবাসতে হবে? মণ্টি যখন ছিল না তখন ঘরের দেওয়ালে একটা বড় ছবি টাঙানো ছিল। সাবানের বিজ্ঞপ্তির ছবি। ছবিতে একটি মেয়ে। মুক্তার মত দাঁত বের করে হাসছে। শিলার সাথে চেহারার মিল পাওয়া যায়। বেশ বড় সাইজের ওই ছবির মেয়েটি সরাসরি নান্নুর দিকে তাকিয়ে থাকতো। সে ডানে গেলে দেখতো মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে। নান্নু এক সময় লক্ষ করেছে সে ওই ছবিটির প্রতি টান অনুভব করছে। খিটমিটে মেজাজ নিয়ে ঘরে ঢুকে ছবিটার দিকে তাকালেই মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। শেষ দিকে এমন হয়েছিল হঠাৎ করে নান্নু ছবির মিষ্টি মেয়েটির সাথে কথা বলে উঠত। তারপর নিজেই লজ্জা পেত।
একদিন হঠাৎ করেই কী মনে হলো, নান্নু সেই ছবিটা দেওয়ার থেকে টেনে ছিড়ে ফেলল। বড় নিঃসঙ্গ লাগছিল তার। এর কয়েকদিন পরেই এল মন্টি।
মাঝে মাঝে মানুষের জন্য মানুষের মনে খচ করে কামড় দিয়ে উঠে। কেন এমন হয়? সে উত্তর মানুষের কাছে নেই বলে তারা অনেক কিছু ধরে নেয়। ভাবে কোনো দুঃসংবাদ নয়তো?
অফিস থেকে বের হয়ে নান্নু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একফোঁটা মেঘ পর্যন্ত দেখা যায় না। সব মেঘ কি তাহলে আকাশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে? নান্নু ধীর পায়ে বাসার দিকে চলল। ভাবল, ঘরে গিয়ে রান্না করতে হবে। সময় পাওয়া গেলে আজ মণ্টিকে গোসল করাবে। বেটা ভারী বেয়াড়া। গোসল করতেই চায় না। গোসলের সময় খালি ছুটাছুটি করে। স্থির থাকে না। তবে ও বুঝতে পারে এটা কোন শাস্তি নয়। গায়ে পানি ঢালার সময়ও দ্রুত লেজ নাড়তে থাকে। একটা অদ্ভুত বিষয়ও নান্নু লক্ষ করেছে। গোসলের পর মণ্টি মানুষের মতই খাবারের অপেক্ষা করে। খাবার না খেয়ে আর বাইরে বের হয় না। নান্নু ঘরের বারান্দা পর্যন্ত এসেও মণ্টির কোন সাড়া শব্দ পেল না। সাধারণত নান্নু অফিস থেকে ফেরার সময় লক্ষ করে মণ্টি বাড়িতে থাকলে দৌড়ে রাস্তায় আসে। এগিয়ে নিয়ে যায়। কী করে বুঝতে পারে যে নান্নু এসেছে কে জানে! দীর্ঘক্ষণ পর দেখা হওয়ায় আহ্লাদ করে পায়ের সাথে মুখ ঘষতে চায়। রাগ করলেও শোনে না।
পা বাড়িয়ে বারান্দায় উঠতেই নান্নু থমকে গেল। স্থির হয়ে গেল। বারান্দার এক কোনে মণ্টি নিথর পড়ে আছে। মাথার ঠিক মাঝখান থেকে রক্ত আর মগজ বের হয়ে বেশ খানিকটা জায়গায় দাগ হয়ে আছে। নান্নুর মাথার ভেতরে ঘুরে উঠল। সাথে সাথে সে ঘুরে দাঁড়াল। তখনই চোখ পড়ল দোতলা বারান্দায়। সেই প্রেমিকা মেয়েটি অপরাধীর মত চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে। নান্নুর চোখে চোখ পড়তেই সে ঘুরে চলে গেল ঘরে। নান্নু ধপাস করে বারান্দায় বসে পড়ল।
কাছাকাছি প্রায় বারান্দার সাথে লাগোয়া বেলায়েত সাহেবের বাগান। বাগানের জন্য বাগান করেননি। তিনি চাকরি করেন হর্টিকালচার বিভাগে। নিজের একটা ফাউ বাগান না থাকলে চলে না। অবশ্য বাগান না বলে শাক সবজির ক্ষেতও বলা যায়। বেলায়েত অলস ভঙ্গিতে ওই বাগানের মধ্যে হাঁটছিলেন। তিনি নান্নুকে লক্ষ করলেন। কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার নান্নু ভাই, অসুস্থ লাগছে?
নান্নু কথা বলল না।
বেলায়েত সাহেবের চোখ বারান্দায় গিয়ে পড়ল। তিনি অতি স্বাভাবিক স্বরে বললেন, আহা কুত্তাটা মরে গেছে। মারল কে? দ্যাখেন নান্নু ভাই, মাথার ঠিক মাঝখানে কোপ দিছে।
নান্নু দেখল না।
বেলায়েত সাহেব বললেন, কুত্তাটা বেশ ভালো ছিল। মানুষের মত বুঝতো। এখন তো ভাই মানুষেরই জীবনের কোন লাইসেন্স নাই! একদিকে সন্ত্রাসী, আরেকদিকে বিচারছাড়া মৃত্যু রাস্তায় গন্ডায় গন্ডায় লোক প্রত্যেকদিন মরতেছে। কার হাতে যে খতম হয়ে যাবেন কেউ জানে না। আর কুত্তার জন্য মায়া কইরা লাভ কী! মরা কুত্তাটা ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
মানুষ মরে গেলে তার দেহকে বলে লাশ। কুকুর মরলে, এমনকী অত বড় যে হাতি সেই হাতি মরলেও তার দেহাবশেষকে কেউ লাশ বলে না। মানুষ মরলে তার জন্য মাগফেরাত কামনা আছে, অন্য কোন প্রাণীর জন্য নেই? নান্নুর ভেতর এসব প্রশ্ন ঢুকে গেছে। মণ্টির কথা ভাবতে পারছে না। মণ্টি নেই মনে হলেই ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। সন্ধার পর নান্নু থানায় ঢুকল। থানা এক আলাদা জগত। থানার লোকেরা যাদেরকে সালাম দিয়ে চলে তাদেরও থানায় ঢুকলে বুকের ভেতর ধুকধুক করে। নান্নু ডিউটি অফিসারের সামনে দাঁড়াল। দারোগা কী বুঝল কে জানে, বলল, বসেন ভাই। কী খবর বলুন। সমস্যা কী?
নান্নুর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবুও শান্ত কণ্ঠে বলল, আমি একটা মামলা করতে চাই। দারোগা সাহেব আমাকে সাহায্য করেন প্লিজ!
দারোগা যেন এমন উত্তরই আশা করছিল। সে অটোমেটিক মেশিনের মত উত্তর দিল, অবশ্যই করবেন। আপনার উপর কেউ অত্যাচার-অনাচার চালাবে, আর আপনি বসে থাকবেন? আর থানার কাজই তো মামলা নেওয়া।
নান্নু বলল, দারোগা সাহেব, মানুষ হত্যার বিচার আছে, প্রাণীহত্যার নাই?
কী ব্যাপার খুলে বলেন তো?
আমার একটা কুকুর ছিল। নাম মণ্টি। কখনও কারও ক্ষতি করেনি। বরং উপকার করেছে। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। সেটা কি সম্ভব?
দারোগা পাকা হাসি দিল। বলল, সম্ভব। আমরা দুমাসের শিশু বাচ্চাকেও ডাকাতির মামলায়, ধর্ষণ মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারি। পত্রপত্রিকায় দেখেন না? একটা না, কয়েকটা বালবাচ্চা ফাঁসিয়েছি। আর কুকুর মেরে ফেলেছে তার বিচার হবে না?
ভাই, আমি চাই, যে মণ্টিকে মারল তার সাজা হোক।
অবশ্যই হবে! মামলা আমরাই সাজিয়ে দেব।
দেন ভাই, একটু লিখে দেন।
ইয়ে…মানে মামলার খরচপাতি আনছেন তো?
খরচ কত?
আপাতত হাজার দশেক দিয়ে যান।
দশ হাজার টাকা খরচ!
দারোগা হাসল, খুবই কম ধরা হয়েছে। পশু মারা কেইস! মানুষ মারা কেইস হলে আরেকটু বেশি লাগতো।
নান্নু মনে মনে রাগল। কিন্তু সে রাগ দারোগাকে দেখানো যায় না। বলল, না ভাইজান, আমি একটা অন্যায়ের বিচার চাচ্ছিলাম। টাকা দিয়ে বিচার পেতে চাই না।
দারোগার হাসির কালার পরিবর্তন হয়ে গেল। আগের হাসিটা ছিল শুভ্র। সেই হাসি কেমন যেন কালচে লাল আকার ধারণ করল। বলল, কী করেন আপনি?
একটা এনজিওতে কাজ করি।
নাউজুবিল্লাহ! ভুতের মুখে রাম নাম! চাকরি করেন এনজিওতে! ডলার মারিং ব্যবসা।
নান্নু রাগের সাথে বলল, আমি কাজ করে পয়সা নিই!
দারোগা এবার অন্য কাজে মন দিয়ে বলল, আচ্ছা যান, কাজ করেন গিয়া।
আমার মামলা নেবেন না?
আরে যানতো ভাই! অনেক পাগলামি করছেন, এখন কাজ করতে দেন!
একটু থেমে দারোগা পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ মরতেছে গন্ডায় গন্ডায় তার কোন বিচার হয় না, আর উনি আসছেন কুত্তা মারার মামলা করতে!
এবার যেন দারোগা আরও আক্রমনাত্মক হয়ে উঠল। নান্নুর দিকে চোখ রাঙিয়ে, ঠোঁট চোখা করে বলল, কুকুর মার্ডার! ৩০২/৩০৪ ধারা! সাথে ৩৩৪ ধারাও! আসামীর ফাঁসি! আরে মিয়া, দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার গরু ছাগল মারা হয়! জবাই করে হত্যা। তাহলে সেগুলোরও মামলা করি, নাকি!
নান্নু মাথা নিচু করে থানা থেকে বের হয়ে এল। কেউ বোঝে না মণ্টি শুধু একটা কুকুরই না। মণ্টি হল মণ্টি। মণ্টি ওর পরিবারের একমাত্র সদস্য। মণ্টি মিষ্টি, দুষ্ট সন্তানের মত।
থানার পাশেই একটি মসজিদ। সব থানার কাছাকাছি একটা মসজিদ দেখা যায়। থানা আর মসজিদ হল সমাজের অপরিহার্য দুটি অঙ্গ। তাছাড়া থানাওয়ালাদেরতো নামাজ রোজাওতো করতে হয়! নান্নু মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতর থেকে মসজিদের ইমাম সাহেব বের হয়ে এসে আরবি কায়দায় সালাম জানালেন। বললেন, কী বাপার ভাই?
শান্ত কণ্ঠে নান্নু বলল, হুজুর আমি একটা মিলাদ দিতে চাই।
আলহামদুল্লিাহ! মিলাদের উপলক্ষ?
কিছুক্ষণ থেমে থেকে নান্নু বলল, মৃতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা। হুজুর, মিলাদটা শুক্রবার বাদ জুমা পড়াবেন।
ইনশাআল্লাহ!
আমি টাকা দিয়ে যাই। আপনার সাধ্যমত করবেন। শুক্রবার কত লোক হয় মসজিদে হুজুর?
আপনাদের দোয়ায় লোক হয় ভাই! প্রায় সব লোকই নামাজে আসে। আমাদের থানার থেকেও মাশাল্লা প্রায় সবাই আসেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। এই নিন টাকা। আপনি নামাজিদের বিরিয়ানী খাওয়াবেন হুজুর।
আপনি থাকবেন না?
না হুজুর। আমি হয়তো আসতে পারব না।
তাহলে ক্যামনে হবে ভাইজান? আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি মৃতের নাম, তার পিতার নাম দিয়ে যান, কোন অসুবিধা নাই।
নান্নু অবাক হয়ে বলল, আমি তো আর থানায় মামলা করছি না যে আসামীর পিতার নাম ঠিকানা লাগবে!
হুজুর এমনভাবে নান্নুর দিকে তাকালেন মনে হল তার চোখমুখ বলছে, এত মস্ত বোকা লোক! মুখে বললেন, কার সন্তানের জন্য আল্লাপাকের দরবারে দোয়া মাঙছি এইটা লাগবে না? একই নামে তো অনেক লোক থাকতে পারে!
হুজুর, আল্লার দরবারে নাম ঠিকানা নাই?
হুজুর বিব্রত হলেন। যখন তখন মিলাদের অর্ডারটা ছুটে যেতে পারে। তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নাই। তিনি অ্যাডভান্স দোয়া শুরু করলেন পকেটে টাকা রাখতে রাখতে। আল্লাহ মৃতকে বেহেস্ত নসীব করুন।
চারদিন পর রাতে বিছানায় শুয়ে আছে নান্নু। আগামীকাল জোহর বাদ নান্নুর বিরুদ্ধে সালিশ। সে নাকি কুকুরের নামে মিলাদ পড়িয়েছে। শুধু তাই না, কুকুরের নাকি জানাজাও পড়িয়েছে! বিচারে উপস্থিত থাকবেন বহু লোক। নান্নুর চোখ পড়ল তাকের উপর রাখা কুকুরের খাবার কৌটার দিকে। কৌটার গায়ে একটা কুকুরের ছবি। নান্নুর মনে হল ছবিটা মণ্টির ফটোগ্রাফ।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প মণ্টির ফটোগ্রাফ মহসীন হাবিব মহসীন হাবিবের গল্প 'মণ্টির ফটোগ্রাফ' সাহিত্য