খোঁড়ল
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪১
সকাল সাতটার দিকে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে সাজেদিন ভাইয়ের ফোন, টরন্টো থেকে। বলেন, বিনু ভাই মারা গেছেন, শুনেছিস?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে উঠে দাঁড়াই। ইন্নালিল্লাহ… মানে? কখন? কীভাবে?
কী আশ্চর্য! বিনু ভাইয়ের বলা কয়েকটা কথাই ভাবছিলাম গত কয়েকদিন। কারণ আমি নিজেও বিষয়গুলি উপলব্ধি থেকে বিশ্বাসের জায়গা নিয়ে এসেছি। বিনু ভাইয়ের কথা ভাবছি, তিনি ‘গর্ত’ ও ‘খোঁড়ল’ শব্দ দুটো খুব ব্যবহার করতেন, তার একটা কথা তো আপ্তবাক্যের মতো প্রায় মনে পড়ে: ‘‘গর্তে পড়া কি গর্তের দোষ?’’ আর আজ শুনতে হলো বিনু ভাইয়ের চলে যাওয়ার খবর। তাও সাজেদিন ভাইয়ের কাছে!
সকালবেলাটাই একদম তব্দা খেয়ে গেলাম। বিস্ময়ে ঘোর কাটছিলই না। কী কাকতালীয় ব্যাপার। ভাবা যায় না!
বিনু ভাইয়ের সঙ্গে বা অধীনে সে অর্থে আমার কোনো কাজ করা হয়নি। কয়েকবার দেখা হয়েছে সাজেদিন ভাইয়ের কল্যাণে, কিন্তু সাজেদিন ভাইয়ের কাছে তার কথা এত শুনেছি যে তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বিনু ভাই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাজগতের দ্রোণাচার্য আর হতভাগা একলব্য যেন আমি। যদিও আমি আর সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু সংবাদপত্রে লেখা ও ঘাঁটাঘাঁটির নেশা আমাকে ছাড়েনি।
ছুটির দিন। মোবাইল ছাড়া জগতের সব কিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন। বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে টাঙ্গাইলের একটা রিসোর্টে এসেছি। দুদিন থাকব। মধুপুরের কয়েকটা জায়গায় যাবো। রাবার শিল্পের নতুন কিছু বিষয় নিয়ে একটা গবেষণার কাজ করছি। রাবার বাগান দেখব। মান্দি মানে গারোদের তৈরি কিছু জিনিসপত্র কিনব। এই আর কী।
সকাল বেলা হাত নিশপিশ করছিল। টেবিলে বসে যাই কাগজ কলম নিয়ে। নেতা ও রাজনীতিবিদের পার্থক্য, আর কেন আমাদের সর্বনাশ হলো: পরের লোকদের আমরা তৈরি করতে পারিনি, কোনো সেক্টরেই, সেসব চিন্তা থেকেই লিখতে বসেছি। কোথায় ছাপা হবে, না হবে চিন্তা করি না। স্রেফ নিজের জন্য লিখব। সবচেয়ে বড় কথা, এগুলো আমার নিজের কোনো মৌলিক চিন্তা নয়, কারওই নয়। কিছু বোধ মাত্র, যে বোধগুলি গণবোধ হয়ে ওঠা ভারী দরকার।
ল্যাপটপ আনাব আনব করেও আনিনি। যাচ্ছি বেড়াতে, সেখানে আবার কীসের লেখালেখি! কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, আমাদের এই বিশেষ মানসিক বদ্ধতা নিয়ে লিখি। কথাটা বহু আগে সাজেদিন ভাই বলেছিলেন, ওকে বলেছিলেন বিনু ভাই। বলেছিলেন, নেতা হলো আগামী প্রজন্ম নিয়ে ভাবেন, আর রাজনীতিবিদ ভাবেন আগামী নির্বচানের বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার কথা; নেতাকে হতে হয় বিশাল হৃদয়ের মানুষ, আর রাজনীতিবিদ সংকীর্ণ মনের হলেও সমস্যা হয় না। নেতা দেশের সমস্যা সংকট সম্ভাবনা নিয়ে ভাবেন, অগ্রগতি নিয়ে ভাবেন; রাজনীতিবিদ দলের ও নিজের পদ অবস্থান নিয়েই চিন্তিত। আরও আছে। বুঝতে পারছেন তো আমাদের দশা? আপনি হো চি মিন বা মাও সে তুংয়ের কথা ভাবতে পারেন? হো বলেছিলেন, ‘কেউ ভাববেন না আমি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রেমে পড়েছি। দেশগড়ার জন্য এরচেয়ে ভালো কিছু পেলে, এটা অবলীলায় ছেড়ে তিয়ে সেটা গ্রহণ করব।’
আমি সাহিত্যিক ধাঁতের লেখক নই। টুকটাক ফিচার লিখি। মাঝে মাঝে কলাম। তাও বিশেষ বিষয় নিয়ে। রাজনীতি সমাজনীতি নয়, কিছু সামাজিক সমস্যা, লিঙ্গবৈষম্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুস্থ বিনোদন নিয়ে পড়ালেখা ও গবেষণা কাজ করি। রসায়নের ছাত্র ছিলাম। এই নিয়ে মাস্টারি করছি। কিছু বিজ্ঞান ও দর্শনের বইয়ের অনুবাদ করেছি। না করতে করতেও বইও হয়ে গেছে কয়েকটা। এই করে করেই পঁয়তাল্লিশ বছর পার করে দিলাম।
আমাকে এ পথে এনেছিলেন সাজেদিন ভাই। সাজেদিন ভাই বিনু ভাইয়ের কথা এত বলতেন যেন তার ওপর জ্বিনের মতো আসর করেছেন বিনু ভাই। মুখে না বললেও বুঝতে কষ্ট হয়নি যে, বিনু ভাই-ই হলেন তার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। ক্যারিয়ারের এত ভালো সময়ে শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্য তিনি দেশ ছেড়ে দিলেন, এটা বিনু ভাই একদম পছন্দ করেননি। তার কথা হলো, কত রকমের হুমকি ধমকি ভয়ভীতির ভেতর দিয়েই সাংবাদিকতা করতে হয়। ভয়ের গর্তে থাকা আর যাই হোক সাংবাদিকের কাজ নয়। প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি, আর ঝুঁকি-পার। সাংবাদিকতা মানে প্রতিদিন অ্যাডভেঞ্চার, প্রতিদিন এক্সারশান, প্রতিদিন ফিল্ডওয়ার্ক, প্রতিদিন শিক্ষাসফর। তবে সাংবাদিকতা যতটা না এডুকেশন, তারচেলে বেশি লেসন-সবক। হাওয়া থেকে এখানে কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু সারাক্ষণ হাওয়ার কী ভাসে ভেসে যায়- খেয়াল করা লাগে। চোখ ও কান খেলা রাখা লাগে আর হাত খুলে নির্ভয়ে সত্য লেখার সাহস থাকতে হয়। পরে সেটা কতটা বাদ হয়ে গেল কি রইল, সেসব সম্পাদকদের বিষয়, সাংবাদিকদের নয়।
বিনু ভাই বলতেন, আচ্ছা বলেন তো: পাথরই কি ঠিক করতে পারে যে, তাকে কোথায় ব্যবহার করা হবে? সেটিকে কি বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হবে, নাকি রাস্তা তৈরি তে নর্দমা তৈরিতে ব্যবহার করা হবে, নাকি ভাস্কর্য তৈরিতে ব্যবহার করা হবে? বেশিরভাগ মানুষই হলো এই পাথরের মতো, ফলে যারা প্রতিভাবান ও দক্ষ মানুষ তাদের উচিত যেচে যেচে কিছু লোক তৈরি করা। যারা তাদের জায়গা নিতে পারবে। আমাদের দেশে তাল থাকে: আমার জায়গা যেন আর কেউ নিতে না পারে। আমাদের দেশের হাজারো সমস্যা ভেতরে সবচেয়ে বড় একটা সমস্যা আমরা কেউ গভীরভাবে ভেবে দেখি না: কেউই পরের লোকটা আর তৈরি করতে চাই না। প্রতিটি সেক্টর খেয়াল করেন, প্রতিষ্ঠান খেয়াল করেন: একটা প্রেসে দারুণ এক ব্যবস্থাপক ছিলেন, তার সময়ে বইয়ের ছাপা বাঁধাই মুদ্রণ এত অসাধারণ ছিল, তিনি চলে যাওয়ার পর পরই সেই ধারা বন্ধ হয়ে গেল। কেন বন্ধ হলো? তিনি তার পরে এই কাজ যে যে করতে পারে, তেমন কিছু লোক তৈরি করতে পারেননি, বা করতে চাইলেও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সব জায়গায়ই এ-ই হয়েছে একটা দারুণ দক্ষ লোক পরের লোকটাকে আর তৈরি করে যায়নি। এটাই হলো আমাদের আসল খোঁড়ল। বিনু ভাই চেষ্টা করেছিলেন কিছু দক্ষ সংবাদকর্মী তৈরি করতে। কিন্তু তাদের কেউ এদেশে টিকতে পারল না। কেউ সব কিছু ছেড়ে গ্রামে ভাগল, কেউ একদম দেশ ছেড়ে বিদেশে।
বিনু ভাই মানে বদরুল আনোয়ার চৌধুরী বিনু। দৈনিক বিশ্ববার্তার সম্পাদক। এক সময়ের অনেকেরই স্বপ্নকন্যা/ড্রিমগার্ল আরিয়া তাসমিনা ওরফে দুনিয়া আপার প্রথম স্বামী বিনু ভাই।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ধারা বদলে দেওয়া গাজী ইব্রাহিম তার সংবাদিকবাহিনীর ভেতরে যে কজন সিপাহসালার পেয়েছিলেন বিনু ভাই ছিলেন তাদের মধ্যে সেরাদের সেরা। ‘আজকের বার্তা’ থেকে ‘ভোরের বার্তা’ হয়ে বর্তমানে যে ‘দৈনিক পরিপ্রেক্ষিত’, যার সার্কুলেশনে একদম মার মার কাট কাট দশায়, আর গাজী ইব্রাহিম পত্রিকা জগতে সবাইকে ছাড়িয়ে একক হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে একটি দৈনিকের প্রচারসংখ্যা ৫ লক্ষ, ভাবা যায়! কেউ কেউ বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছিলেন, আই উইল মেক দি পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান; গাজী ইব্রাহিম নাকি পলিটিক্সের জায়গায় জার্নালিজম বসিয়ে ভেবেছেন। জার্নালিস্টদের জন্য তিনি জার্নালিজমকে কঠিন করে দিয়েছেন।
নিউজ এডিটর হিসেবে বিনু ভাইয়ের তুলনা মেলা ভার, কিন্তু ইব্রাহিম ভাই তাকে ধরে রাখতে পারলেন না। কী সব মান-অভিমানে, তাকে ছেড়ে চলে এলেন বিনু ভাই। একটার পর একটা নতুন নতুন পত্রিকায় নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেলেন।
বিনু ভাইয়ের কথা মনে পড়লেই সাজেদিন ভাইয়ের একটা কথা নাকি খুব মনে পড়ত, যেদিন সার্কুলেশনে ‘দৈনিক পরিপ্রেক্ষিতে’র চেয়ে মাত্র এক বেশি হতে পারব, সেদিন ইব্রাহিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। এর আগে নয়। এর আগে ওই সভাসমিতি প্রেসক্লাবে দেখা হতে পারে, সালাম হাই হ্যালো অব্দি। কিন্তু দেখা করা বলতে যা বোঝায় সেটা হবে না। এটাই আমার অঙ্গীকার।
গাজী ইব্রাহিমের সঙ্গে বিনু ভাইয়ের দেখা করা আদৌ সম্ভব হয়েছিল কি? কারণ ‘দৈনিক পরিপ্রেক্ষিত’ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের দুনিয়ায় একাই সত্তর ভাগ, আর বাকি সবাই মিলে ত্রিশ ভাগ। ফলে এর ধারেকাছে যাওয়া কঠিন। সমস্ত পত্রপত্রিকার টার্গেট হলো ‘দৈনিক পরিপ্রেক্ষিতে’র মতো হওয়া। তাতে সে না বাড়ে নিজের মতো, না হয় সে ‘পরিপ্রেক্ষিতে’র মতো কিছু।
বিনু ভাইয়ের সঙ্গের যারা ছিলেন, বা যাদের সঙ্গে বিনু ভাই কাগজের কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের একটা সাধারণ মিল হলো: প্রত্যেকেই দুর্দান্ত সুন্দরী স্মার্ট মেয়েদের বিয়ে করেছেন। প্রায় প্রত্যেকেই ছিল সে সময়ের সব নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেয়ে। বিনু ভাইয়ের মতে, এমন বিয়ের কারণ নিজের ব্যক্তিত্বকে আরও উন্নত করা। বনলে বনল, না বনলে সংঘাতে সংঘাতে ফুলকি। সুখ হলো একটা গর্ত, একটা খোঁড়ল। সেখান থেকে বেরুতে না পারলে কেউ বেড়ে ওঠে না, বড়ও হতে পারে না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর সঙ্গে থাকলে কোনো ব্যক্তিসম্পন্ন লোকের সত্যিকারের উন্নতি হওয়ার কথা, কারণ এতে দুজনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নিত্য সেই ঠোকাঠুকির ভেতর আগুনের তেজ আরও বাড়তে থাকে। তাতে কারও কারও বা বেশিরভাগেরই সংসার ভেঙে যায়, কিন্তু লাভও হয় বিপুল। বিয়ে করলে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুন্দর ও দুদান্ত স্মার্ট মেয়ে বিয়ে করবে। বিয়ে দাম্পত্য ও সংসারও তখন সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে উঠবে। হা হা হা। সাজেদিন বলেছিলেন, বিনু ভাইয়ের এই একটা কথা আমি মানি না।
সাজেদিন ভাই ও আমি জীবন শুরু করেছিলাম ‘দৈনিক সবুজদিন’ থেকে, পরে সাজেদিন ‘আজকের বার্তা’য় কাজ শুরু করে। আমিও পরে ‘আজকের বার্তা’য় কিছুদিন ছিলাম। এরপর একটা গণছাটাইয়ে সে বাদ পড়ি। সাজেদিন মালিকপক্ষে ঘনিষ্ট লোক ছিল বলে টিকে যান। সাজেদিন ভাই বলেছিলেন, এক মাসের মধ্যে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আমি রাজি হয়নি। আমি ‘দৈনিক দর্পন’ ও পরে যে-পত্রিকা ভেঙে ‘পরিপ্রেক্ষিত’ হলো, সেই ‘দৈনিক ভোরের বার্তা’য় গিয়েছিলাম। সেখানে মাত্র চারমাস কাজ করেছিল। কোনোভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। পরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি এনজিওর একটি ত্রৈমাসিকের কাজ নিয়ে বলতে গেলে চিরতরে সংবাদপত্রের মূলধারা থেকে বিদায় নিই। তারপর তো বিসিএস। তবে আদনান ফারুক নামে প্রায় সব পত্রিকায় ফিচার, ভ্রমণকাহিনি লিখে চলেছি। বিসিএসে পাস ফল হলো কেন্দ্র থেকে প্রান্তে চলে আসা। মফস্বলের কলেজে শিক্ষকতা করি। নিরাপদ স্বাস্থ্যকর সুস্থির জীবন। সাজেদিন ভাই পত্রিকার জগতেই ছিলেন। পরে সেই সময়ের সরকারের রোষে পড়ে দেশ ছাড়েন। বর্তমানে বৌবাচ্চাসহ কানাডায় থিতু হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সাজেদিন ভাই বিপ্লবী রাজনীতি করতেন, পরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বেশ কিছুদিনের জন্য অজ্ঞাতবাসে চলে গিয়েছিলেন। এরশাদ পতনের কয়েক বছর পর, বিনু ভাই বলতে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনেন। বিনু ভাইও বলে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছিলেন। গ্রামে বিশাল বিষয়সম্পত্তিওয়ালা লোকের ছেলে, রাজনীতি করে সর্বহারা- এই ছিল এক সময়ের আজব ধারা।
সাজেদিন ভাই কোনোমতে এম.এ পাস করেই পত্রিকায় যোগদান করেন। সঙ্গে আমি ছিলাম। সাজেদিন ভাই ‘দৈনিক আজকের বার্তা’ থেকে ‘দৈনিক পরিপ্রেক্ষিতে’ যান।
সাজেদিন ভাই সবসময় বলেন, বিনু ভাইয়ের মতো কারিশমা আর কারও ভেতরে তারা দেখেনি। বাংলাদেশে আধুনিক সংবাদপত্রজগতের কিংবদন্তি বলতে ওনারা বিনু ভাইকেই বুঝতেন।
বিনু ভাইয়ের অদ্ভুত কিছু স্বভাব ছিল, পিয়ন থেকে শুরু করে কাউকে ‘আপনি’ ছাড়া সম্বোধন করতেন না। এক মিনিট দেরি করে অফিসে আসতেন না। অফিসে এলে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যেতেন। গভীর রাত অব্দি পড়ে থাকতেন। মাথার ভেতরে পত্রিকার পাতা কতবার সাজাতেন আর ভাঙতেন ঠিক ছিল না। লোকে বলত, ঘুমের ভেতরে তিনি পাতা তৈরি করতেন। তখন মোবাইল ছিল না, কিছু মনে হলেই বাসা থেকে ফোন করতেন। কোনো কোনো সময় তার নির্দেশ ঠিকমতো মানা হয়েছে কি-না দেখতে সোজা হাজির হয়ে যেতেন।
করোনার শুরু হওয়ারও তিন কি চার বছর আগে, সাজেদিন ভাই এখন অব্দি শেষ যেবার দেশে এসেছিলেন, ওর সঙ্গে বিনু ভাইয়ের দপ্তরে গিয়েছিলাম। আগের সেই এক মাথা ঝাঁকড়া চুল নেই। কপাল অনেক চওড়া হয়ে গেছে। জুলফি থেকে ওপরের দিকের চুলে পাক ধরেছে। চুলও ছোট ছোট করে ছাঁটা।
সেই বিনু ভাই, লোকে তাকে বলত ‘কার্পেট নিউজম্যান’। খবরের কাগজে তিনি খবরের ‘কার্পেট বোম্বিং’ করতেন। ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। ইতিহাস যেমন নগ্ন সত্য বলে, সেই সত্য কার পক্ষে গেল, কার বিপক্ষে গেল- সেসবের ধার ধারে না, তিনি সংবাদপত্রে ইতিহাসের সেই শর্ত ফলাতে চাইছিলেন। কিন্তু বুঝলেন, এটা ব্যবসা, এখানে ইতিহাস চলে না।
বিপুল পরিমাণ বইপত্র পড়তেন। নামকরা কবিতা, ছোটগল্পের বা উপন্যাস কি প্রবন্ধের কোনো বই তার পড়ার বাইরে ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সুবিমল মিশ্র বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ থেকে সদ্য নতুন বা উঠতি তরুণ লেখকদের বইও যত্ন করে নিজে কিনে পড়তেন। সাহিত্যকে বলতেন, মহাকালের দৈনিক। এরিস্কিন কল্ডওয়েল ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় লেখক। সাজেদিন ভাই বলতেন, লরেন্স ডারেল, জেমস বল্ডুইন থেকে পিটার হ্যান্ডকের নাম তার কাছেই প্রথম শুনি। অল্প কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া তেমন মেলামেশা করতেন না, কিন্তু সবার সঙ্গে খুবই প্রাণবন্ত আন্তরিক ব্যবহার করতেন।
বিনু ভাই সাব এডিটর, সিনিয়র সাব এডিটর, শিফট ইনচার্জ, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক থেকে বার্তা সম্পাদক। তারপর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হয়ে নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন এক একটি পত্রিকার। এখন পুরো সম্পাদক। বিশাল সুসজ্জিত কক্ষ। বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপারে বিশাল একটা চেয়ারে তিনি বসা। আমাকে নিয়ে সাজেদিন তার কক্ষে ঢুকতেই, আসুন আসুন। তাসরিফ রাখুন।
সাজেদিন ভাই ও আমি হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলান। সাজেদিন বলে, মান্যবরের দেখা পেয়ে ধন্য হলাম।
দুরো! কীসের মান্যবর। আমি সামান্য এডিটর। মনে আছে ওই কবিতার লাইনটা, কে যেন লিখেছিল, কবি মরে জন্ম নেয় সাব এডিটর?
তার মুখে মান্যবর আর এডিটর, শব্দ দুটো ছন্দমেলানোর মতো মনে হলো।
সাজেদিন ভাই বলেন, আরে না, না, আপনি সামান্য নন, অসামান্য।
বিনু ভাই ঠোঁটের কোণে একটু হাসির নৌকা ভাসিয়ে বেল টেপেন। দরজা খুলে সাফারি পরা বেঁটেমতো, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙের একটা লোক ঢুকতেই সাজেদিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী সেবা করতে পারি? তার আগে বলেন, কী খাবেন, কী কী আনাব?
কিছু না বিনু ভাই। একদম কিছু না। আনলে, নিপাট রং চা।
চিনি?
হবে। অল্প।
বাহ! চিনি চালাচ্ছেন তাহলে?
ওই আর কী!
সাফারি পরা লোকটির দিকে মাথা নেড়ে চোখের মণি একটু ঘুরিয়ে ইশারা করলে লোকটা চলে যায়।
সাজেদিন ভাই বলেন, সেবা-টেবা কিছু না। স্রেফ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। আপনি ছিলেন আমাদের প্রথম রুটিরুজির মালিক।
ছিঃ এসব বলবেন না। রুটি রুজির রিজিকের মালিক রাজ্জাক। বলে, তিনি ডান হাতের তর্জনী ছাদের দিকে দেখান, সঙ্গে বলেন, মুখ দিয়েছেন যিনি/ আহার দেবেন তিনি। তবে তিনি এসে মুখে পুুরো তো খাইয়ে দেবেন না, মাঝখানে নিজেকে একটু চেষ্টাচরিত্র করতে হবে- এই যা। কেউ কেউ উছিলাটুছিলা হয় -এই আর কী!
তা কেমন আছেন বলেন?
বুঝতেই পারছেন কেমন আছি? এককালের খতমের লাইনের লোক, তথাকথিত বিপ্লবী, এখন আল্লাহখোদার নাম ছাড়া কিছু বলছি না। বুঝতেই পারছেন কেমন আছি! তবে হ্যাঁ একদিক থেকে পাক্কা ভালো আছি। একদম আক্ষরিক অর্থে ভালো আছি।
তা-ই তো থাকবার কথা।
না তা থাকবার কথা নয়, কিন্তু আমি আছি। আছি বলতে, একসময় ভাবতাম: দুনিয়া উল্টে দেওয়ার মতো কাজ করব। সারা পৃথিবীর মানুষ এক নামে চিনবে। মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো, মাদার তেরেসা বা বব মার্লের মতো। একটু থেমে বলেন, শিক্ষিত বাঙালির কাছে নিদেনপক্ষে রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিতের মতো, নিদেন পক্ষে নায়করাজ রাজ্জাকের মতো। এখন এসব চাপ থেকে একদম নিজেকে তুলে এনেছি। আসলে তো কেউ কারও মতো হয় না। এখন কোনো চাপ নিয়ে ঘুরি না। কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি, আমি একবারে একজন সাধারণ মানুষ। অনেকদিন সংবাদপত্রে শ্রম দিয়েছি, তা-ই এখানে। বাড়তি কোনো গুণগম্ম্যি কোনো কিছু নেই, কোনো কালেই ছিল না। স্রেফ একজন চাকুরিজীবী। পত্রিকায় কাজ করা, শ্রম দেওয়ার মতো একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হয়ত আছে। তাছাড়া বৌ-ছেলেমেয়ের জন্য সংসারের জন্য আর দশটা লোকে যা করে, করতে চায়, তার বেশি কোনো সাধ ও সাধ্য কিছু আমার নেই। আমি যা, আমি তা-ই। এর বেশি কিছু না। আমার দ্বারা যা হতে পারত, এর বেশি কিছু হতে পারত না। কোনো অসম্ভবের সাধনা করার সাধক আমি নই। এটা যেদিন স্পষ্ট করে বুঝে গেলা; একদম কী যে ভারমুক্ত লেগেছিল, মনে হয়েছিল নবজন্ম হলো। বিশাল বিরাট ফাটিয়ে দেওয়ার সব রকমের খায়েস থেকে বের হতে…
এতক্ষণ রুমে সাজেদিন ভাই আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিলাম না। চা নাস্তা নিয়ে ওই সাফারিওয়ালা ঢুকতেই বিনু ভাই বলেন, নিন। সামান্য নাস্তা। শুধু চা তো চালাতে চাই না। নিন।
চায়ের সঙ্গে দুটো পিরিচে স্যান্ডুইচ। ঠিক তক্ষুনি দরজাটা একটু ফাঁক হলো সঙ্গে টোকা, বিনু ভাই বলেন , কাম ইন। ঢুকল শিবলি মোহাইমিন, ঢুকেই সাজেদিন ভাইকে দেখে, আরে সাজু ভাই! তৈয়ব ভাই! শুনেছিলাম আজ আসবেন।
কিছু বলবেন শিবু?
ওই রামপালেও ওই স্টোরি তৈরি করেছি। বলেছিলেন, দেখবেন। পাঠাবো?
পাঠান, পাঠান।
পরে সাজেদিন ভাই বলেছিল, ভাবছিলেন, জানতে চাইবেন, রামপাল নিয়ে তাদের অবস্থান কী? কিন্তু লাগাম টানেন। রামপাল-রূপপুর এসব নিয়ে সে আর ঘাঁটতে চান না। যাকে বলে পুরো ঠান্ডা মেরে যাওয়া। আমাকে আগেও বলেছেন, বুঝেছিস, একদম ঠান্ডা মেরে গেছি। মনে আছে মিহির কথা? মিহির কথা ভাবলে আগের মতো অস্থির লাগে না।
সত্যি, মিহির জন্য সাজেদিনের কী পাগলামিটাই না ছিল! শত শত চিঠি লিখেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে মিহির বিয়ে হওয়ার পর চিঠি লেখা বাদ দিলেও নানান সময় মিহির কথা না বলে থাকতে পারতেন না। মিহির জন্য মধ্য রাতে উঠে রওনা দিয়েছেন চাঁদপুরের সকালের লঞ্চ ধরবার জন্য। একবার তো যে লঞ্চে যাচ্ছিলেন সেটা ডুবে যায়। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমি হলে আর কস্মিনকালে আর লঞ্চের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতাম না।
অল্প কিছুক্ষণই ছিলাম। স্যান্ডুইচ আর চা শেষ হতে যতক্ষণ।
সাজেদিন গাড়িতে উঠে বললেন, একটা বয়সে সবাই ঠান্ডা মেরে যায়। বিনু ভাইয়ের একটু দেরি হলো আর কী! তবে বয়স এখন প্রায় ষাট, আমারই তো তেপান্ন চলছে, তাই না!
আমি বলি, ষাট বছরেই কি চূড়ান্ত হয়ে যায় জগতে কার কী অবস্থান? শুনতাম, পঞ্চাশ মাচ্যুরিটি অর্জনের শেষ প্রান্ত। এরপর আর যা হয় তা হলো যোগ-বিয়োগ। আচ্ছা, দুনিয়া আপা তো এখন একাই থাকেন। বিনু ভাইয়ের পর বলে, আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। কোনোটায় বনিবনা হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ওমন সুন্দর দেখতে, তারওপর এত গুণী। আর কী ব্যক্তিত্ব। ফিচারগুলি মনে আছে! ফাটাফাটি সব কনটেন্ট, তেমন তার কনটেক্সট।
হ্যাঁ, রীতিমতো বিদূষী। আমরা বলতাম, রূপেগুণে দ্বিতীয় নভেরা আহমেদ। অনেকগুলি ভালো ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন। ওই নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। মানুষকে কিছু এটা পেয়ে বসলে, আর অন্যদিকে নজর দেওয়ার সময় থাকে না। এটা একদিকে ভালো অন্যদিকে তো সমস্যারও। বিনু ভাই আর দুনিয়া আপার একসঙ্গে সংসার করাটা হতোই না আসলে। শুধু শুধু একসঙ্গে থাকার কোনো মানে তো নেই।
একটু ইচ্ছা করছিল জিজ্ঞাসা করি, কারণ সাজেদিন বলতে পারে, অনেক খবর তার কাছে পৌঁছায়। আমি হালকাপাতলা শুনেছিলাম, যে দুনিয়া আপা বলে মুক্তসম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন এজন্য বলে বিনু ভাইয়ের সঙ্গে বনেনি? আর বিনু ভাইও কঠিন প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন, কিন্তু তার মতে, তিনি টাকা ও মেয়েমানুষ পুরুষ মানুষের এই দুটো প্রধান বিপদ থেকে দূরে। সম্পাদক হয়ে অনেক বেতন পান, সব গ্রামের বাড়িতে নিজেদের করা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনেই খরচ করে ফেলেন। অতিরিক্ত বাড়তি টাকা মানেই চরিত্রে খোঁড়ল তৈরি করবে।
একটাই মাত্র ছেলে। দুনিয়া আপার কাছেই মানুষ। ঢাকায় দুনিয়া আপাদের বিরাট পরিবার। বিরাট বাসায় রাজ্যের মানুষ। ফলে অপূর্ব তাসমিন চৌধুরীর কোনো সমস্যা হয়নি। বিনু ভাইয়ের সঙ্গে নিত্যই যোগাযোগ ছিল। তিনি অবশ্য দুনিয়াদের বাসায় যেতেন না। এমনিতে ওপরে কিছু মনে না হলেও ভেতরে নিশ্চয়ই জ্বালাপোড়া চলত, অবশ্য কে বলতে পারে। আজকে তো দেখলাম কী সুন্দর করে বললেন, এখন বুঝে গেছি, আমাকে দিয়ে যা হওয়ার ছিল তার বেশি কিছু হওয়ার ছিল না। ওই ফ্যান্টাসিগুলি হলো যার যার মিথ্যা খোঁড়ল।
আমি ভাবছিলাম, মানুষ কি তার প্রকৃত স্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পায়? একদিন কিছু একটা করবে, কিন্তু কবে জানে না। স্বপ্নে হাত সে ছেড়ে দিতে পারে না। ছেড়ে দিলে সে ভেতরে ভেতরে মরে যাবে, কিন্তু ছেড়ে না দিলে কী হবে না হবে- সে কীভাবে বুঝবে। তবু ছেড়ে দিতে পারে না, নাকি ভয় হয় তাও নিশ্চিত বুঝতে পারে না।
টাঙ্গাইলে না এলে বিনু ভাইয়ের জানাজায় যেতাম। খবর রাখতে হবে, শোকসভাটা বা স্মরণসভাটা কবে হবে। সঙ্গে মনে হলো: বিনু ভাইয়ের মতো সাংবাদিক নিয়ে স্মারকগ্রন্থও নিশ্চয়ই বের হবে। সেখানের তার লেখা কেউ চাইতেও পারে, নাও চাইতে পারে। সে তো আর তেমন কোনো লেখক নয়। তাছাড়া বিনু ভাইয়ের সঙ্গে তার তেমন কোনো ঘনিষ্টতাও ছিল না।
বিনু ভাইয়ের শেষ দেখার সময় বলা ফিরে ফিরে এসেছে, ভালো আছি, শাব্দিক অর্থে ভালো আছি, কারণ একসময় জানতাম বিরাট কিছু করব, দুনিয়ায় সবাই এক নামে চিনবে। এখন বুঝি আমি অতি সাধারণ চাকুরিজীবী মাত্র। যা করেছি, তার বেশি কিছু করার সাধ্য আমার নেই। এটা বুঝতে পারা শান্তির নিশ্চয়ই। কিন্তু কজন এমন শান্তি পেতে পারে, যদি সে বিনু ভাইয়ের মতো মানুষ হয়?
বিনু ভাই অতি সাধারণ; এটা মেনে নেওয়া নিজের কাছেই একটা পরাজয় পরাজয় লাগে। অনেক দিনের লালন করা কিছু ধারণা ঝুপঝাপ ভেঙে পড়ে। আর এমন পতনের শব্দ শোনাটা কোনো আনন্দের ঘটনা হতে পারে না; যদিও যেকোনো মানুষের পতনে আমরা প্রায় সবাই গোপন আর ‘কোনো দিন কাউকে বলা যায় না’ এমন অব্যাখ্যনীয় পুলকই তো বোধ করি।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ খোঁড়ল গল্প সাহিত্য হামীম কামরুল হক হামীম কামরুল হকের গল্প 'খোঁড়ল'