বন্ধুত্ব না প্রেম
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৫৩
অধরা বসে ছিল ক্যাফেটেরিয়ায়। তাদের ইউনিভর্সিটির এই জায়গাটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। কেমন ঠাণ্ডা একটা ওয়েদার এখানে। বেশ খোলামেলা। অত মানুষ তবু কখনও ভিড় মনে হয় না। সে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এখানে এসে বসে। তাদের শেষ সেমিস্টার চলছে। কদিন পরেই সে এমএ ডিগ্রিটা পেয়ে যাবে। এমনিতে প্রতিদিন ক্লাসের খুব বিজি সিডিউল থাকে। কিন্তু আজ পরপর দুটো ক্লাসই হবে না। লাস্ট ক্লাস হবে সেই দুইটায়। অতক্ষণ অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। এজন্য সে রাতুলকে ফোন দিয়েছে। রাতুল এখন ফ্রি আছে। ওদের ইউনিভর্সিটা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মাঝে মাঝে সে দীর্ঘক্ষণ রাতুলের সঙ্গে এখানে বসে থাকে। অন্য ইউনিভার্সিটি থেকে কেউ এসে এখানে তেমন বসে না। কিন্তু রাতুলের ব্যাপারটা আলাদা। রাতুলকে সবাই চেনে। ওর ক্লাসের অনেকের রাতুলের সাথে ভালো সম্পর্ক। অধরা ডাকলেই সে আসে। রাতুল অধরার বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই ক্লাস এইট নাইন থেকে তারা বন্ধু। তখন থেকেই ওরা মানিকজোড়। যতটা সময় সম্ভব একসাথে থাকে। কোথাও ঘুরতে গেলে একসাথে যায়। মার্কেট করার দরকার হলে একসাথে যায়।
অনেক্ষণ বসে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছে অধরা। নীলা আর মিলি এসে বসল পাশের টেবিলে। মিলি বলল, ‘কী রে, তোর রাতুলের জন্য বসে আছিস?’ ওরা জানে অধরার একা বসে থাকা মানে রাতুল আসবে। নয়তো সে অন্যদের টেবিলে বসত। অধরা বলল, ‘হ্যা রে। এক্ষুণি চলে আসবে।’ মিলি আর নীলা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসল। নীলা বলল, ‘তোরা কি প্রেম করছিস?’ অধরা বলল, ‘কী যে বলিস না! প্রেম করব কেন? বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে কেউ প্রেম করে?’ মিলি বলল, ‘করে না আবার? কত দেখলাম! মুখে বলে ফ্রেন্ড, তারপর দেখা যায় ডেট করছে।’ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। অধরা বলল, ‘বন্ধুত্বটা প্রেমের চেয়ে বড়। জানিস তো, সব বন্ধুত্বেই প্রেম থাকে কিন্তু সব প্রেমে বন্ধুত্ব থাকে না। বন্ধুত্বটা বাঁচিয়ে রাখতে হয়।’ ওদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল তখন।
অধরার মনে রাতুলের জন্য প্রবল প্রেম আছে। বয়সন্ধিকাল থেকেই সে রাতুলের সাথে মেশে। রাতুলের বাইরে কোনো ছেলের সঙ্গে সে তেমনভাবে মেশেনি। নানা সময়ে অনেক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকেই তার মনে ধরেনি। অধরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কিন্তু রাতুলের সাথে মনে মনে সে সেসব ছেলের তুলনা করেছে। কখনওই তাদের রাতুলের মতো ভালো মনে হয়নি’। রাতুলের মনে কোনো কলুষতা নেই। তার ভেতর বাহির এক। রাতুলের সব কথা অধরা জানে। অধরার জীবনেও এমন কোনো কথা নেই যেটা রাতুল জানে না। কলেজে উঠার পর থেকে অধরার অনেকবার মনে হয়েছে সে রাতুলকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কথাটা রাতুলকে বলা দরকার। কিন্তু তারপর সে নিজের ভেতরে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। রাতুল যদি বিষয়টা ভালোভাবে না নেয়? তারপর বন্ধুত্বটাই যদি শেষ হয়ে যায়? প্রেমের কথা বলার পর বন্ধুত্বটা কি আর আগের মতো থাকবে? সেই ভয়ে কখনও কিছু বলতে পারেনি অধরা। গলার কাছে এসেও সবসময় আটকে গেছে কথাটা। তার কাছে এই বন্ধুত্বের মূল্য অনেক বেশি। প্রেম করতে গিয়ে সে সেটা হারাতে পারবে না।
অনেকদিন আগেই রাতুলও প্রেমে পড়েছে অধরার। তার জীবনেও অধরা ছাড়া কোনো নারী নেই। রাতুল অনেকবার গেছে অধরাদের বাসায়। অধরার আম্মা তাকে খুব স্নেহ করে। অধরাকেও রাতুলের বাসায় খুব পছন্দ করে। যখন ওরা কলেজে পড়ত অধরা হুটহাট এসে ঢুকে পড়ত রাতুলদের বাসায়। হয়তো অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু রাতুল ফোন ধরছে না। অধরা বুঝে ফেলত রাতভর ভিডিও গেম খেলে শয়তানটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। সে এসে সোজা রাতুলের রুমে ঢুকে তাকে টেনে তুলত। রাতুল হয়তো খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ওসব দেখার বালাই নেই অধরার। তখন ছেলে মেয়ের ব্যাপারটা অধরার মাথায় কাজ করতে না। বন্ধু তো বন্ধুই, তার আবার ছেলে মেয়ে কী! কিন্তু যখন মেয়েলি অনুভবগুলো প্রবল হয়ে উঠল অধরার ভেতর, তখন থেকে কী যে একটা সংকোচ কাজ করে। অধরার এইসব কাণ্ডকীর্তি দেখে রাতুল আরও বেশি প্রেমে পড়ে যায় অধরার। কিন্তু কখনও সে বলতে পারেনি সে কথা। যদি এই বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়। একবার অধরাদের পাড়ার কয়েকটা ছেলে রাতুলের সাথে বেয়াদবি করেছিল। অধরা সে কথা জানতে পেরে রাস্তার ওপর খুব শাসিয়েছিল ছেলেগুলোকে।
রাতুল বললে যেমন অধরা যেকোনো সময় ছুটে আসতে পারে, অধরা বললেও রাতুল যে কোনো প্রান্ত থেকে অধরার জন্য ছুটে আসতে পারে। ওরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু বন্ধুত্বের একটা দেয়াল ওদের ভালোবাসার কথাটা বলতে দেয় না। অধরা যদি কোনো কারণে দুদিন ঢাকায় না থাকে, রাতুলের কিছুই ভালো লাগে না। আবার অধরার ব্যাপারটাও তাই। রাতুল দূরে কোথাও গেলে কেমন অস্থির লাগে তার ভেতরটায়।
রাতুল এসে চেয়ার টেনে অধরার পাশে বসল। অধরা বলল, ‘কী রে, দেরি করলি কেন?’ রাতুল বলল, ‘দেরি করলাম কোথায়? তোর ফোন পেয়েই তো রিকশায় উঠলাম। সিগনালে বসে থাকতে হলো পনের মিনিট। এত জ্যাম। নেমে হাটব তার কোনো উপায় নেই। ঢাকার ফুটপাত দিয়ে এখন হাঁটাও যায় না। একেকজন এসে গায়ের ওপর পড়ে।’ অধরা বলল, ‘তোর খালি অজুহাত।’ রাতুল বলল, ‘কখন যাবি?’ অধরা বলল, ‘কোথায়?’ ‘সব ভুলে বসে আছিস? কেন তোর মনে নেই আজ তোর টেস্টের রিপোর্টগুলো দেওয়ার কথা?’ ‘ওহহ একদম ভুলে গেছি রে। সন্ধ্যায় দেবে। তুই সন্ধ্যার সময় আমাকে ফোন দিবি। বাসার সামনে থেকে তুলি নিবি আমাকে?’ ‘ইশশ্, কত শখ! কাজ তোর আর তুই মহারাণীর মতো পড়ে পড়ে ঘুমাবি। আমাকেই তুলে নিতে হবে বাসার সামনে থেকে।’ ‘নিবি না? তুই আমার দোস্ত না? আমার আর কে আছে বল তুই ছাড়া।’ ‘হইছে, এত তেল মারতে হবে না। আমি চলে আসবে। ফোন দিলে রেডি হয়ে থাকবি।’
আজ দুপুরেও কি অধরা ভেবেছিল এই সন্ধ্যার সময়ে তার জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে? রাতুলও তো ভাবতে পারেনি। অধরা প্রায়ই বলত তার মাথা ব্যথা করে। সামান্য মাথা ধরার ওষুধ খেয়ে খেয়ে অনেক দিন কেটেছে। কিন্তু ব্যাপারটা ফিরে ফিরে আসতো। তখন যদি অবহেলা না করে টেস্ট করাতো তাহলে হয়তো আজকের দিনটা আসত না। রাতুল যদি ডাক্তারের কাছে জোর করে নিয়ে যেত অধরাকে, তাহলে হয়তো তাকে বাচানো যেত। কিন্তু ডাক্তার বললেন এখন অধরার হাতে সময় খুব কম। ব্রেনের সমস্ত জায়গায় ক্যানসার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে এখন অপারেশনেও কোনো কাজ হবে না।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অধরা। তার কাছে পরিবারের লোকজন। রাতুল সেখানে বেমানান। সে বাইরে একটা সোফার ওপর বসে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটা আর পৃথিবীতে থাকবে না। সেই মানুষটা জানতেও পারবে না রাতুল তাকে কত ভালোবেসেছিল। বুক ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছে রাতুলের। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে সে তার চোখের জল দেখাতে চায় না। অধরা বড়জোর আর মাসখানেক বাঁচবে। এই পৃথিবী তখন শূন্য হয়ে যাবে রাতুলের কাছে।
অধরার ঘুম ভাঙ্গল মাঝ রাতে। পাশের বেডে তার মা ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গেই তার মনে হলো রাতুলের কথা। সে তো এসেছিল সন্ধ্যায়। তাহলে তাকে না বলে চলে গেল? কিন্তু রাতুল এমন করে না কখনও। সে বেড থেকে উঠে বাইরে মুখ বের করে দেখল রাতুল লবিতে একটা সোফায় বসে আছে এক ধ্যানে। সে বাসায় যায়নি? এখানে এই রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে আছে? অধরার খুব কষ্ট হলো রাতুলের জন্য। ইশ, মরে গেলে সে আর রাতুলকে দেখতে পাবে না। সে কি আজ এই নীরব হাসপাতালে রাতুলকে বলবে তার মনের কথা? সে তো মরেই যাবে, মৃত্যুর আগে প্রেমের কথাটা কি জানাবে তাকে? কিন্তু রাতুল যদি খুব হাসি ঠাট্টা করে এটা নিয়ে? যদি বলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছে! না, থাক। এই বন্ধুত্ব বেঁচে থাক। এই বন্ধুত্ব প্রেমের চেয়ে বড়। সে পাশে গিয়ে বসল রাতুলের। রাতুল চমকে উঠল। বলল, ‘কী রে, খারাপ লাগছে? নার্সকে ডাকব?’ অধরা বলল, ‘না না, খারাপ লাগছে না। তোর পাশে একটু বসে থাকি। বন্ধুর কাছে বসে থাকার মতো সুখ আর কী আছে বল?’ রাতুলের ওর মাথায় হাত রাখল। অধরা রাতুলের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে লগাল। রাতুল বলল, ‘তুই ঠিক হয়ে যাবি দেখিস?’ অধরা বলল, ‘আমি জানি রে আমি আর ঠিক হব না। আচ্ছা রাতুল, মরে গেলেও আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড থাকব তো?’
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প বন্ধুত্ব না প্রেম রাহিতুল ইসলাম রুয়েল রাহিতুল ইসলাম রুয়েলের গল্প 'বন্ধুত্ব না প্রেম' সাহিত্য