রাজু খিয়াঙের দূর যাত্রা
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:২০
পাড়া থেকে বেরুতে বেরুতে রাজুর মনটা বিষাদে ভরে উঠলো। এখন প্রায় এগারো ঘণ্টা হাঁটতে হবে। এ রাস্তা কত যে দুর্গম তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। দায়িত্ব যখন নিয়েছে তখন তো যেতেই হবেÑ এই ভেবে মনে সান্ত¦না খোঁজে রাজু খিয়াঙ। রাজু খিয়াঙ ছেলে। পর্বতের উপরে থুইছা পাড়ায় তার বসবাস। তার ইচ্ছা ছিল এ কষ্টকর পাহাড়ি জীবন থেকে মুক্তির। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো কী। সে এখন গাইডের কাজ করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আমিয়াখুম-নাফাখুম কিংবা পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা দেখতে আসলে রাজু তাদের গাইড হিসেবে কাজ করে। বিজিএফের শর্ত অনুযায়ী পাবর্ত্য অঞ্চলে কোনো পর্যটককে প্রবেশ করতে হলে বাধ্যতামূলক পাহাড়ি গাইড নিতে হবে। রাজু খিয়াঙ সে কাজই করে। যখন পর্যটক পায় তখন তাদের পাহাড়ি অঞ্চলে কয়েকদিন ধরে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন স্থান দেখায়। তারপর তাদের থানচি বাজারে এসে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। এবারের অতিথিরা ছিল ঢাকা থেকে আগত। তিনদিনই তাদের বাড়িতে অবস্থান করেছে। রাজু তাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। আজ তাদের পৌঁছে দিতে যাচ্ছে।
খিয়াঙ পাড়াটি মস্ত এক টিলার মাথায়। সবাই খিয়াঙ পাড়াটিতে থুইছা পাড়া হিসেবে চিনে থাকে। রাজু ততক্ষণে সেই টিলার উপর পাড়া থেকে নামতে শুরু করেছে। থুইছা পাড়া থেকে নামার পথে পড়ে জিন্নাহ পাড়া। জিন্না পাড়ার উচুঁ পাহাড় থেকে সরু চিকন পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে হয় নিচুতে। এঁকে বেঁকে উঁচু থেকে নিচু পেরিয়ে আবার একটু উঁচুতে উঠে আবার নিচুতে নামতে হয়। ডানে বামের উঁচু নিচু পেরিয়ে নামতে গিয়ে চোখে পড়ে পাহাড়ের গায়ে মেঘ যেন লেগে আছে। এ মেঘ কী রাজুদের জীবনের কালো মেঘ। সহসা পর্যটকদের বিস্ময় জাগালেও রাজুর কোনো বিস্ময় জাগে না। কারণ জন্ম-জন্মান্তর থেকে রাজুদের বেঁচে থাকার বাস্তবতা ঠিক যেন এমনই। নামতে নামতে ততক্ষণে তারা পাহাড় থেকে নেমে পড়ে। নামতেই নদীর মতো বয়ে চলা ঝরণা। রাজুর সাথে ৫জন পর্যটক। যাদেরকে পৌঁছে দিতে হবে থানচিতে। রাজু সহসা ঝরণার পানিতে এসে দাঁড়ায়। আর সবাইকে সচেতন করে দেয়। সাবধানে পানি পার হতে হতে। কারণ পানিতে জোঁক থাকতে পারে। যদি জোঁক গায়ে কামড়ে বসে তাহলে আর ছাড়ানোর কোনো উপায় নাই।
এমন পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ে পাহাড়ে কখন কবে মানুষ বসবাস শুরু করেছে তা কেউ জানে না। রাজু শুধু জানে পাহাড়ে কীভাবে চলতে হয়। যেসব পাহাড়ের পাদদেশে ঝরণা আছে সেসব পাহাড়েই মানুষের বসবাস। এরা কেউ জানে না সমতল ভূমি বলে পৃথিবীতে কিছু আছে। এরা কেউ জানে সমুদ্র বলে কিছু আছে। এরা কেউ জানে না সোপানভূমি বলে কিছু আছে। এরা শুধু জানে পৃথিবী মানেই টিলা আর টিলা। এ টিলাকে ডিঙিয়ে বসবাস করাই তাদের ধর্ম। রাজু থানচি শহরে গাইডের কাজের জন্য ইদানিং বেশি যাতায়াত করে। সে শহরে পড়াশোনারও করেছে। সে দেখেছে সেখানকার মানুষের জীবন। কিন্তু পর্বতের অন্যান্য পাহাড়িরা শহরের জীবন কখনো দেখেনি। পর্বতের মানুষরা পৃথিবী আসলে কেমন তা কখনোই বুঝেনি। এমনকি কল্পনাও করতে পারে না।
রাজুকে যেতে হবে অনেক দূর। দুটো পা তার ভরসা ও সম্বল। গত তিনদিন ধরে এ অতিথি পর্যটককের ঘুরিয়েছে আমিয়াখুম, ভেলাখুম, সাতভাইখুম, বিন্দু ফলস, নেইশামুঙ, নকরাঙ, চিঙথাঙ পাড়া, রেমাক্রি খাল, নাফাফুম ফলস, নাফাখুম পাড়া, শিঙগংমুখ, রেমাক্রিমুখ, সাঙ্গু নদী, বাঘের মুখ, বড়পাথর কত কী। আজ এখন পৌঁছে দিতে হচ্ছে। পদ্মঝিরি হয়ে আপাতত গন্তব্য থানচি বাজার।
রাজু অতিথিদের নিয়ে হাঁটতে থাকে। দুপাশে উচুঁ উচুঁ পর্বত। সকালের সূর্য পর্যন্ত দেখা যায় না। ঝরণার পানি পার হয়ে এপাশের পাহাড়ের ঢাল ঘেষে এগিয়ে যেতে হয়। রাজু খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে পারলেও অতিথিরা দ্রুত যেতে পারে না। চিকন সরু রাস্তা অবরুদ্ধ। বড় বড় পাথরের টুকরো। পাথরের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়। কখনো পাথরের উপর, কখনো পাশের নিচে, কখনো পাথরের চিপা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। কী যে কষ্টকর চলা তা ভাষায় বর্ণনা করা খুব কঠিন। রাজু যেতে যেতে মনে মনে ভাবে খিয়াঙদের মুখ উজ্জ্বল করবে ভেবেছিল একদিন। এ কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে! নিজেরই মেরুদ-ই আজ বাঁকা হয়ে গেছে। খিয়াঙদের জন্য কী করবে। নিজের জন্যই কিছু করতে পারলো না আবার জাতি। অনেক কষ্ট করে সে কিছুদূর পড়াশুনা করেছে। রাজুর পড়াশনার কথা শুনে খিয়াঙদের আনন্দের সীমা ছিল না। আশপাশের অন্য পাহাড়িদের মধ্যেও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। কিন্তু তাতে কী লাভ হলো। ভেবেছিল পাহাড়ি কষ্টকর জীবনের পরিত্রাণ ঘটবে। তা কী কিছু হলো। আজ রাজু খিয়াঙদের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। পড়াশোনা তাদের কী উপকারে আসবে! উল্টো রাজু পড়াশোনা করছে বলে এখন পাহাড় থেকে ফলমূল খাদ্য সংগ্রহ করে আনতে পারে না। পাহাড়ে পাহাড়ে উঠানামা করতে কষ্ট হয়। পড়াশুনা করতে গিয়ে আলসে হয়ে গেছে। পাহাড়ি জীবন মানেই পর্বতে পর্বতে দৌঁড়ে একমুঠু খাবার পেটে দেওয়ার সংগ্র্রামের জন্য সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জীবন। জীবনের উঁচু কোনো আশা তাদের নেই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যারিস্টার হওয়া যে কী তা খিয়াঙরা জানে না। বস্তুত বাইরের যে বিশাল পৃথিবী আছে সে সম্পর্কেই তাদের কোনো ধারণা নেই।
পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একসময় পাথর শেষ হলো বলে মনে হয়। আসলে পাথর শেষ হয়নি। চলার চিকর সরু রাস্তাটি শেষ হয়ে গেছে। তখন আবার ধীরে ধীরে উুঁচ পাহাড়ে উঠতে হয়। ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠতে উঠতে যেন প্রায় নিঃশ্বাস শেষ হয়ে আসে। তবুও উঠতে হবে। কারণ যেতে যে হবেই। পাহাড় থেকে নিচে কী গভীর খাদ। যদি কেউ কোনোভাবে পিছলে নিচে পড়ে যায় আর আস্ত থাকবে না সে। ভয়ে ভয়ে এগুতে হয়। সূর্য উঠা ও সূর্য ডোবার সঙ্গে খিয়াঙদের দিনকাটে। এ পর্বতের টিলায় টিলায় তো তাদের বসতি। অতিথিরা ভয় পেলেও রাজু নির্ভীক। খিয়াঙ শিশু জন্মের পর বাবার লক্ষ্য থাকে সন্তানটি কীভাবে পর্বতের টিলা থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকবে তার জন্য প্রস্তুত হওয়া। পৃথিবীতে যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন তারা জেগে উঠে। সারাদিন দৈনন্দিন কাজ সেরে দিনের আলো থাকতে থাকতে খেয়ে নেয়্। অন্ধকার হবার সাথে সাথে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। বাতি জ্বালানোর দায় তাদের নেই। সূর্যের আলোর আগমন ও সূর্য ডোবার মধ্য দিয়ে চলে তাদের দিনের আবর্তন।
এগিয়ে যেতে যেতে আবার পাহাড় থেকে কিছুটা নিচুতে নামতে হয় তাদের। নিচুতে নামাই সব কিছুর সমাধান নয়। শুরু হয় আরেক চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ের পাশের গিরিখাত বেয়ে বেয়ে প্রায় ঝুলার মতো করেই এক পা করে ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। কী ভয়ংকর সেই রাস্তা। কী ভয়ংকর সেই বাস্তবতা। এ ভয়ংকর পথ পেরিয়েই রাজুদের থানচি যেতে হয়। রাজু বাল্যকালে তার এক দাদার সঙ্গে একবার হেঁটে হেঁটে থানচি এসেছিল। থানচি এসে আনন্দে ভরে উঠেছিল তারমন। পাকা বাড়ি, বিদ্যুতের আলো, মাথার উপর বাতাস করা ফ্যান, টিউবওয়েলের পানি দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। কী চমৎকার থানচির জীবন। তারপর যখন দু চাকার উপর চালিত মোটর সাইকেল রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন আনন্দে লাফিয়ে উঠছিল রাজু। এও কী সম্ভব। দু চাকার গাড়ি। মানুষ উপরে বসে মুঠ নাড়াচ্ছে আর গাড়িটি তাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন রাজুর মনে স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠে আমাকে বড় হতে হবে। আমাকে শিক্ষিত হতে হবে।
গিরিখাত পেরিয়ে যেতে না যেতেই আবার অন্ধকার জনশূন্য জঙ্গল। জঙ্গলে ঢাকা পথ পেরিয়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে হয়। যেতে যেতে আবার ঝরণার আইল পড়ে। সে ঝরণার পানির মধ্যে দীর্ঘক্ষণ হেঁটে যেতে হয়। রাজুর ভাবে প্রতিদিন বাঁশের পাতা খেতে ভালো লাগতো না। কোনো দিন বাঁশের শাঁশ, কোনোদিন কলাগাছের ভেতরের নরম কু-লী খেতে হতো। যেদিন ঝিরি বা ঝরণার পাশ থেকে শামুক সংগ্রহ করতে পারতো সেদিন তো বেশ আনন্দেই কাটতো। আর বনের কাঠবিড়ালী ধরতে পারলে তো কথাই নেই। যেন খাদ্য উৎসব জমে উঠতো পরিবারে। খিয়াঙ পাহাড়িরা এসব খেতো পছন্দের খাবার হিসেবে নয় বরং এগুলো ছাড়া তাদের আর কোনো খাবার ছিল না। জুম চাষে যে পরিমাণ ধান ও সবজি পেতো তা কয়েক মাস বা কাটে। এসব ছাড়া পৃথিবীতে যে আর কোনো খাবার আছে তা তারা জানে না। খিয়াঙদের পৃথিবীই চারদিকের পর্বতে ঘেরা পর্বতের উপরে পর্বতময় জীবন।
তারপর দুপাশের পাহাড় আর ঝরণার পাশ দিয়ে হাঁটু পানিতে এগিয়ে যেতে হয়। যেতে যেতে একসময় কোমর পানির মধ্যে এসে পড়ে। তখন দুপাশে আকাশ ছোঁয়া পর্বত। দু পবর্তের মাঝখানে পানি। এখন কী করবে রাজু। অগত্য অতিথিদের বলে আপনারা যার যার ব্যাগ উপরে উচুঁ করে ধরে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলুন। এ ছাড়া যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। খিয়াঙপাড়ার কেউ কখনো পড়াশুনা করেনি। শুনেছিল অনেকদিন আগে কোনো এক সংস্থা নাম দস্তখত দেবার জন্য প্রাথমিক স্কুল খুলে ছিল। কিন্তু তা বেশিদিন টেকে নি। রাজুও সেখানে পড়তে পারেনি। আর পড়াশুনা জানা প্রয়োজন বলেও কখনো মনে হয়নি। আজ দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে মনে এমন পানি মতো অন্ধকারেই তো পড়ে আছে তাদের জীবন। থুইছা পাড়া খিয়াঙদের বাস। থুইছা পাড়ায় দেড়শ পরিবারের বসতির বেশি হবে না। বছরের পর বছর তারা এখানে বসবাস করছে। কবে কোন কালে তারা বসবাস শুরু করেছিল তা কেউ জানে না। তারা শুধু জানে পেটে দানাপানি দিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে। অতীতে তাদের ধর্মবিশ্বাস ছিল খিয়াঙদের রক্ষাকর্তা দেবতার উপর। কিন্তু কয়েক বছর হলো তারা খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। ধর্মান্তরিত হবার সময় তারা বেশ অর্থ ও খাবার কিংবা সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু এখন আর তারা তা পায় না। রাজুর বাপ মা এখনো খিয়াঙদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মে বিশ্বাসী। প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে সূর্যের আরো পড়ার আগেই জোড় প্রার্থনা করে খিয়াঙ দেবতার।
বাঁচার জন্য যা যা প্রয়োজন তা খিয়াঙরা নিজেরাই উৎপন্ন করে। যথা- জুম চাষ, ফলমূল সংগ্রহ, পরিধানের জন্য কাপড় থেকে শুরু করে সবকিছু। পর্বতের নিচের ঝিরি থেকে অনেক কষ্ট করে উপরে পানি তুলতে হয়। পর্বতের টিলায় টিরায় ঘুরে বেড়াতে হয় কাঠ সংগ্রহের জন্য। ফল মূল আহরণের জন্য। তবে ইদানিং রাজু থানচি যাতায়াত করার ফলে কিছু রেডিমেট কাপড় কিনে নেয়।
থানচি ছাড়া তাদের আর কোনো বাজার নেই। দুর্গম পথ থানচির। থুইছা পাড়া থেকে পর্বতের মাঝখান দিয়ে রেমাক্রি খালের ধার বেয়ে কিংবা পর্বতের উচুঁ-নিচু-পাশ বেয়ে প্রায় দীর্ঘ পথ পেরিয়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় রেমাক্রিমুখে। এই পথ কখনো পিচ্ছিল, কখনো পাথর, কখনো ঝিরি ফাঁক, কখনো পানি পেরিয়ে তখন নিচের পড়ার থেকে বাঁচার ঝুকি নিয়ে উঁচু নিচু পথ মাড়িয়ে যেতে হয়। রেমাক্রিমুখ দিয়ে না গেলে যেতে হয় পদ্মঝিরি দিয়ে। জীবনের এ কষ্টকর বাস্তবতা সেখানে। কিন্তু উপায় কী। বংশ পরম্পরায় যে জীবনের সূত্রপাত। জীবনের ধারাবাহিকতা তা থেকে মুক্তির উপায় কী।
রাজু বাল্যকালে বাবার কাছে জেদ ধরে বলেছিল ‘আমি জুমে কাজ করবো না। পড়াশুনা করবো।’ ছেলের এই বেয়াদবি প্রথম দিকে সহ্য করতে না পারলেও শেষে কষ্ট থেকে মুক্তির অনিমেষ আশায় বাবা বুক বেধে ছিল। কিন্তু তাদের পাড়ায় তো স্কুল নেই। থানচিতে গিয়ে পড়বে কীভাবে। থুইছা পাড়া থেকে পর্বত বেয়ে বেয়ে দুর্গম পথ মাড়িয়ে থানছি পৌঁছাতে লাগে প্রায় এগারো ঘণ্টা। যদিও ইদানিং থানচি থেকে সাঙ্গু নদী দিয়ে রেমাক্রি মুখ পর্যন্ত নৌকা চলা শুরু করেছে। শুনেছিল থানচিতে নাকি স্কুল আছে। যেখানে স্কুলে থেকেই পড়াশুনা করা যায়। কিন্তু খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে। এটাও শোনা যায় সরকারি, দেশি বিদেশি সংস্থার অধীনে কিছু স্কুল রয়েছে যেগুলোতে বিনা খরচে পড়াশুনা করা যায়। কিন্তু রাজু তো সে ঠিকানা জানে না। আবার পড়াশুনা করলেই যে এ কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে তারও তো কোনো নিশ্চিয়তা নেই। রাজু শুনেছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবনের পাহাড়িরা পড়াশুনা করে চাকুরিও পাচ্ছে।
এলাকা এত দুর্গম যে সার্কুলারের খবর যেমন পায় না তেমনি ব্যাংক ড্রাফটের টাকা কোথায়। আর ব্যাংক ড্রাফটই কোথায় করবে। তাই রাজুকে শেষ পর্যন্ত গাইডের কাজ করতে হয়। খিয়াঙরা সরকার কী তা জানে না। কোন সরকার এলে গেলো সে বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। গত কয়েক বছর ধরে পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শনে সরকার অনুমতি দিয়েছে। সেখানে টুরিস্টদের জন্য গাইড বাধ্যতামূলক করেছে। রাজু গাইড হিসেবে কাজ করার অনুমতি সহজেই পায়।
এখনো অনেক পথ বাকি। হাঁটতে হাঁটতে রাজু ভাবে খিয়াঙরা আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। দুর্গম অঞ্চল দুর্গমই আছে। লতাপাতা শামুক খেয়ে বাঁচা জীবন তেমনই রয়েছে। পানির অভাব, জুমচাষের কষ্ট তেমনই আছে। রাজু শুনেছে কোনো কোনো পাহাড়ে সোলার বিদ্যুৎ এসে গেছে। পড়াশুনা করে রাজু শুধু পেয়েছে গাইড হিসেবে কাজ এবং হোস্টেলে থাকাকালীন পালিয়ে পাওয়া একখানা পাহাড়ি বউ। যে তার সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে থানচি থেকে থুইছা পাড়া আবার থুইছা পাড়া থেকে থানচি। রাজু ভাবে তাদের দুঃখকষ্ট সভ্য সমাজের কেউ বুঝে না। জীবনের অতলে কত যে জীবন পড়ে আছে তা কেউ জানে না। জীবন ওখানে নির্মম। সূর্য ওখানে মাথার উপরে। পর্বত ওখানে পায়ের নিচে। সে জীবন নাগরিক সুখ বঞ্চিত জীবন। পৃথিবীর আবিষ্কার ওখানে যায় না। কষ্টই সেখানে জন্মের উপহার। চারপাশে যা পায় তাই খেয়ে বাঁচতে থাকা।
রাজু হাঁটতে থাকে। পৌঁছাতে হবে থানচি বাজার। হ্যাঁ প্রকৃতই থানচি বাজার। রাজু কী তাই চেয়েছিল। রাজু বান্দরবান শহরে যে জীবন দেখছিল। যে জীবনের স্বপ্নে পড়াশুনা করেছে। রাজু মাথার উপর ঘুরবে বাতাসকাঠি। পা শক্ত নয়। শরীরকে টেনে নিয়ে যাবে কোনো ইঞ্জিনগাড়ি। নিচু থেকে পানি উপরে টেনে তোলা নয়। হাতে প্যাচ দিলেই ঝমঝম করে গড়িয়ে পড়বে পানি। গাছের পাতা নয়, বাঁশের করোল নয়। একটু ভালো খাবার জুটবে সামনে। এতো পরিশ্রম নয় আরামে দিন কাটবে। তা কী সম্ভব হয়েছে। আজও সভ্য সমাজ থেকে দূর দূরান্তে তাদের আর্তধ্বনি। যে ধ্বনি হাজারো পর্বত ভেদ করে শহরের মানুষের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না। যে ধ্বনি মানবতাহীন আদিম রোগ-শোক জরা ব্যাধিতে মরে। সে গন্তব্য রাজুর ছিল না। রাজু জানে না তার অনাগত সন্তানও সে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কি না। রাজু খিয়াঙ শুধু জানে তার গন্তব্য দূর বহুদূর।
সারাবাংলা/এসবিডিই
আবু সাঈদ তুলু আবু সাঈদ তুলুর গল্প 'রাজু খিয়াঙের দূর যাত্রা' ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প রাজু খিয়াঙের দূর যাত্রা সাহিত্য