Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একজন আমানত গাজীর শেষ দৃশ্যপট


২৬ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৫৭

ভোরে ঘুম ভাঙার পর আমানত গাজী টের পায় তার শরীর থেকে একটা দুর্গন্ধ আসছে। তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে সে তার বসার ঘরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নাটা অন্য দিনের মতো ঝকঝকে-তকতকে মনে হচ্ছে না। তাই সে পাশের ব্যাসিনে যেয়ে কয়েক আজলা পানি চোখে-মুখে ছিটিয়ে আবার আয়নার সামনে আসে। এটা চোখের ঝাপসা না আয়নায় ঝাপসা তা বুঝে না উঠলেও নিজেকে সে আয়নার ভিতরে দেখতে পায়। প্রথমে সে মুখটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ভালোভাবে দেখে। কিছু পরিবর্তন দেখতে পায় না। ঘার গলা মাথা হাতিয়ে গায়ের গেঞ্জিা খুলে ফেলে। তখন শরীরে ঘামের বিন্দুগুলো ফুটে ওঠে। দুর্গন্ধটা আরও ঝাঝালোভাবে ভাসতে থাকলে সে তার নিজের নাককে বিশ্বাস করতে পারে কি পারে-না তা আমরা বুঝে উঠি না। কিন্তু দেখতে পাই তার ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে এবং এরপর তাকে আরও ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

২.
আমানত গাজী তার চোখজোড়া বড় বড় করে। আয়নার সামনে আসে, এত সামনে যে সে তার নিজের চোখ নিজেই দেখতে পায় না। একবার ডানে, একবার বাঁমে ঘুরিয়ে চোখ দুটি দেখতে থাকে। ঘুম থেকে উঠে আসা চোখ এমনিতেই লাল থাকে বিধায় সে তার কানের ভিতর বার বার তর্জুনী আঙুল প্রবেশ করায়, কানে দেয়া আঙুল নাকের কাছে এনে শুঁকতে থাকে। এই শুঁকার ধরনটি অবিকল কুকুরের মতো। অনেক সময় ক্ষুধার্ত কুকুর কিংবা সন্দেহপূর্ণ কুকুর যেমন কোনো কিছুর উপর নাক রেখে শোঁ শোঁ শব্দে নিশ্বাস টেনে গন্ধ অনুসন্ধান করে ঠিক তেমন। এবং তার চাহনি বলে দেয় সে তার নিজের চোখের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এবার সে আঙুল একবার নাকের কাছে ধরে, একবার চোখের সামনে ধরে। কয়েকবার এরকম করার পর আয়নার ভিতরের আঙুলের দিতে তীক্ষèভাবে তাকায়। আঙুলটা অন্য আঙুলে নেড়েচেড়ে দেখে। দুর্গন্ধটা তাকে স্থির থাকতে যে দিচ্ছে না তা বাহির থেকে যে-কারো চোখে পড়বে। আমাদের চোখেও পড়ে। সে এক হাতের দুই আঙুল দিয়ে কানের ছিদ্রটা আরও একটু বড় করার চেষ্টা করে এবং আয়নার সামনে এসে আড় চোখে তাকায়। তার ধারণা কোনো কারণে কানের ভিতর পানি গিয়েছে এবং তাতে পচন ধরে দুর্গন্ধটা বের হচ্ছে। দুর্গন্ধটার উৎস না পেয়ে সে আরও অস্থির হয়ে ওঠে। হাত, কনুই, কব্জি, বুক, পিঠ, পেট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নার সামনে এমনভাবে ধরতে থাকে যে, তাকে তখন আর স্বাভাবিক মানুষ মনে হয় না। এবার তার মনে হতে থাকে, ঊরুর গোড়ালিতে কিছু দিন আগে গরমের যে ঘা হয়েছিল- তা হয়ত বেড়েছে, যার জন্য এমন গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে পেছনে তাকিয়ে এবার সে তার পরনের ট্রাউজারটা একটানে খুলে সটান হয়ে দেখতে থাকে স্থূল দেহটার নিচের অংশ। ঊরু, শিশ্ন, অ-কোষজোড়া নাড়িয়ে সে তার পুরনো ঘা’টা দেখতে চায়। লোমের আড়ালে ও আয়নার অস্পষ্টটায় পরিস্কার দেখা না গেলে দেহটা সামনের দিকে আধাআধি বাঁকা করে আয়নাটা বাদ দিয়েই নিজেকে দেখতে চায় কিন্তু চেষ্টা ব্যর্থ হলে সে ফিরে আসে আয়নার সাহায্যে। আরও কাছে। দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তাকে পুরো আতঙ্কিত একজন মানুষ মনে হয়, যেন সে অনেকদিন থেকেই জানতো যে তার শরীর থেকে এমন একটা দুর্গন্ধ বের হবে, যেন সে জানত যে তার শরীরে কোনো না কোনো সময় গূঢ় পচন ধরবে তার জীবদ্দশাতেই। বলে রাখা ভালো, এখানে আমরা শুধুই প্রত্যক্ষদর্শী। মাটি যেমন প্রত্যক্ষদর্শী, বায়ু যেমন প্রত্যক্ষদর্শী-আমরাও তেমন আমানত গাজীর প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করতে পারি, অনুমান করতে পারি কিন্তু কোথাও কোনো মতামত বা সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। আমরা তাই দেখতে থাকি আমানত গাজীর কার্যকলাপের পরের দৃশ্য।

বিজ্ঞাপন

৩.
দুর্গন্ধটা আরও তীব্রতর হয়ে তার নাকে প্রবেশ করতে থাকলে তা শরীরের কোন অংশো তা চিহ্নিত করতে না পেরে সে ভাবে আসলে গন্ধটা তার নাকের ভিতর থেকেই আসতে পারে। অনেক আগে নাকের ভিতর মাংস ফুললে সে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল তখন তার স্ত্রী তাকে বলেছিল, তুমি কি কোনো গন্ধ পাও? উত্তরে সে বলেছিল, না। কিন্তু পাশের লোকেরা বলেছিল তারা একটা ছুঁচোর গন্ধ পাচ্ছে অথচ আশেপাশে কোনো ছুঁচো ছিল না। তার কয়েকদিন পরেই তার নাকের ভিতরে পচনের কারণে অপারেশন করতে হয়েছিল শুধু ওই গন্ধটা দূর করার জন্য। ফলে নাকটা টেনেটুনে দেখতে লাগল সে। কয়েকটি আঙুল নাকের ছিদ্রে চালিয়ে দিয়েও যখন কিছুই পাওয়া গেল না তখন পূর্ণ-উলঙ্গ একটি মানুষ তার ঘরের ড্রেসিংটেবিলের সামনে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে। যেন কতদিন গোসল না করা, না খাওয়া, না ঘুমানো দীর্ঘ মেয়াদী একজন রোগী। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তার মধ্যে ছিল না কোনো অস্থিরতা। রাতে খেয়েদেয়ে কয়েকটি জরুরি ফোনালাপ সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিল অন্য অনেক দিনের মতো।

অফিসে আজ জরুরি মিটিং। সাথে নতুন কয়েকটি প্রজেক্ট চালু হবে। এদিকে আমানত গাজী নিজেকে স্থির করতে পারছে না। গন্ধটা তার নাকের কাছে লেগেই আছে। এত সকালে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে ডাকা ঠিক হবে! ভাবনা নিয়ে এগুতে পারে না আমানত গাজী। যদি সবাইকে জাগিয়ে তোলেও তবে সে কী করে বলবে যে, তার শরীর থেকে অমন একটা দুর্গন্ধ আসছে! মরা মাছের আঁশটে গন্ধ কখনো কখনো নাকি মানুষের শরীর থেকে আসে, সে শুনেছে। তারও মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তার গা থেকে আঁশটে গন্ধ বের হচ্ছে। কিন্তু বাসায় এসে ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করার পর তা আর অনুভব করেনি। সে দ্রুত ওই উলঙ্গ অবস্থায়’ই গোসলখানায় ঢোকে। সারা শরীরে ইচ্ছে মতো পানি ঢালতে থাকে। এভাবে কতক্ষণ সে গায়ে পানি ঢালে তা সে অনুমান করতে পারে না। একসময় পানি ফুরিয়ে আসলে তার মনে পড়ে, বাড়ির কেয়ারটেকার গতরাত ন’টায় পানির মটর ছেড়ে ট্যাংকি পূর্ণ করেছিল এবং সে কী পরিমাণ পানি খরচ করেছে! এবং এও মনে পড়ে যে, সে গোসলখানায় ঢুকার সময় বিকল্প ট্রাউজার, টাওয়াল সাথে নেয়নি। নিরুপায় হয়ে সে তার স্ত্রীকে ডাকতে থাকে। সে ডাক কোনো বিপদগ্রস্ত পশুর মতো। তার স্ত্রী যখন ট্রাউজার নিয়ে সামনে হাজির হয় তখন আমানত গাজী তার স্ত্রীকে সমস্ত খুলে বলে। তার স্ত্রী তার শরীরের কাছে নাক নিয়ে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলে আমানত গাজী লাফিয়ে কয়েক হাত দূওে সরে যায়। কেননা, তখনও সে তার শরীর থেকে আগের গন্ধটা স্পষ্ট টের পাচ্ছিল। তার স্ত্রী যতই তাকে আস্বস্ত করে যে কোনো গন্ধ সে পাচ্ছে না, ততই সে তাকে ধিক্কার দেয় যে, স্ত্রীর শর্দিজাতীয় সমস্যা আছে। শেষ পর্যন্ত আমানত গাজী সিদ্ধান্ত নেয়, কয়েকদিন সে গৃহবন্দি থাকবে।
৪.
অফিসে জানিয়ে দেওয়া হলো তার শরীর খুব খারাপ। তার দ্বারা অফিসে উপস্থিত থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সে-মতে কয়েকদিন বাসাতেই তার সময় কাটে। তবে তা ভালো সময় না। এরই মধ্যে জানানাজি হয়ে যায়, আমানত গাজীর শরীর থেকে অজানা এক দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। বাড়িতে লোকের ভিড় বাড়ে। আমানত গাজী সে ভিড় পছন্দ করে না । যতটা পারে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক থাকার মৌলিক বা যৌগিক চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয় না। বন্ধুরা, স্বজনরা, সঙ্গীরা, প্রতিবেশিরা পরামর্শ দেয়, যেহেতু দুর্গন্ধটা সে ব্যতীত অন্য কেউ তার শরীর থেকে পায় না যেহেতু সে তার দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে পারে। মেনে নেয় না আমানত গাজী। দিন দিন তার চেহারা তার নিজের কাছেই ভগ্ন দেখায়। শরীর পতনের দিকে যেতে থাকে। কয়েকজন আত্মীয় তার জন্য উচ্চমানের সুগন্ধী পাঠিয়েছে। সে নিজেও সুপার-শপিংমল থেকে কিছু আনিয়েছে তবে কোনোটিতেই পরিত্রাণ আসে না। তার কাছে তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকা দুর্গন্ধটা তার যাপন নরক করে তুলছে। সে ভাবে, সে কি পাগল হয়ে যাবে? উন্মাদ হয়ে পাগলাগারদে চলে যাবে? তার ঔরসজাত সন্তানেরা আর তার প্রিয়তমা স্ত্রী কি তাকে কোনো এক একলা প্রকোষ্ঠে ফেলে আসবে অচিরেই?

ডাক্তার বলেছে, এটা মানসিক অসুখ। কোনো দীর্ঘ দুশ্চিন্তার ফসল। আমানত গাজী বিশ্বাস করে না। এদেশের কোনো ডাক্তারের প্রতি আগেও যে তার বিশ্বাস ছিল এমন না। এখন আরও না। সে বিশ্বাস করে, কোনো ডাক্তার তার অসুখটা ধরতে পারছে না। তার কথা ঠিক মতো শুনছে না। তাকে প্রশ্ন করে কিছু বের করে নিচ্ছে না। কথা না শুনেই হরহর করে এক পাতা ওষুধ আর একগাদা টেস্টের ফর্দ ধরিয়ে দিচ্ছে দায় সারার মতো। আবার ভাবে, এদেশের ডাক্তাররাও অপরাজনীতির সঙ্গে এমন প্রকাশ্য জড়িয়ে পড়েছে যে, তারা আর রোগীর সুস্থতা-অসুস্থতার কথা ভাবে না। তারা ভাবে টাকার কথা। তারা ভাবে রাজনীতির কথা। তারা ভাবে জনকল্যাণের নামে আত্মপ্রচার আর প্রচারণার কথা। বিত্তবান হওয়ার কথা। ডাক্তারি পেশা যে একটি সেবা- সেটা তারা ভুলেই গেছে। বরং উল্টো ভাবে যে, তারা রোগীর সাত-জন্ম উদ্ধার করছে। আমানত গাজীর গা ঘিনঘিন করে। সে এটাও বিশ্বাস করে না যে, কেউ তার শরীর থেকে ওই গন্ধটা পায় না। সে মনে করে সবাই তাকে মিথ্যা বলছে- হয় ভয়ে, না হয় অন্য কোনো কারণে।

৫.
আমানত গাজী মনোস্থির করে সে আর চাকরিটা করছে না। অবসর গ্রহনের যে কয়েক বছর বাকি তাতে যেন তাকে নমনীয় দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং তার চাকরিপরবর্তী সুবিধাধিতে তার প্রভাব না পড়ে। অফিস থেকে ফিরতি উত্তরে তাকে আস্বস্ত করা হয়, তার সুস্থতাই সকলের কাম্য। কিছুটা নিশ্চিন্ত হলে আমানত গাজী তার শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। আমরা দেখি আমানত গাজী অল্প সময়ের মধ্যে তার ওজন হারিয়ে ফেলেছে প্রায় বিশ কেজি। তার চোখ কয়েক কড়ের মতো নিচে চলে গেছে। তার গায়ের বর্ণ মাঝ বসন্তে প্রাণহীন কাশফুলের মতো ধূসর, চুল উষ্কু-খুষ্কু, ঠোঁট ভেদে করে উঁচু দাঁত বেরিয়ে এসেছে, দৃষ্টি ঘোলা, হতভম্ব। চামড়া ঝুলা। নাকের ডগা শুকনো খরখরে- মাঘের শীতে রুগ্ন ত্বকের সদৃশ। পা বলহীন। বয়স পঞ্চাশ হলেও সত্তর পার হওয়া নগর লোকের মতো তাকে দেখাচ্ছে। বিছানায় শোবার পর আমানত গাজী কখন নির্মেদ ঘুমি তলিয়ে যায় তা বুঝা যায় না। অনেকদিনের ঘুমের ক্ষুধাই হয়ত তাকে এক গভীর ঘুমের ভিতর আচ্ছাদিত করেছে। সে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আমরা লক্ষ্য করি আমানত গাজী ঘুমের ভিতরে একটা স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করে। সেখানে সে তার মৃত পিতাকে দেখতে পায় এবং তার পিতা আমান গাজী তার সামনে এসে একটা কাঠের চেয়ার টেনে পা তুলে বসে। আমানত গাজী একটা ছোট্ট টুলের উপর বসা। তারা দুজন নিকটবর্তী ও মুখোমুখী। আমান গাজীর চেহারা ক্লান্ত, ভার ও প্রদীপ্ত। আমানত গাজীর চেহারা ভঙ্গুর, দ্বিধাগ্রস্থ, থতমত। আমান গাজী প্রথমে আমানত গাজীর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়-

‘তোমার গায়ে এত চর্বি জমেছে কী করে! তুমি তো আমার হালের চিটটিচে বলদের মতো চিটচিটে ছিলে। এ হাল কী করে হলো?’
-জানি না। (আমানত গাজী বিরক্ত)
‘জানো না নাকি বলতে চাও না। যতি বলতে না চাও তবে আর প্রশ্ন করব না। যদি চাও তবে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল।’
-জি করেন।
‘তোমাকে যখন ঢাকায় পাঠাই তখন তোমার হাতে মাত্র তিন হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম। তোমার চাকরি প্রোজেক্ট সুপারভাইজর। পানি মন্ত্রণালয়। গত ঊনত্রিশ বছরে তুমি কয়টা প্রমোশন পেয়েছ?’
-দ্ইুটা। এখনই প্রোজেক্ট সুপারভাইজর। যখন জয়েক করেছি তখন ছিলাম জুনিয়র সহকারী প্রোজেক্ট সুভারভাইজর।
‘তুমি যে মেধাহীন তা তোমার পদোন্নতি দেখেই বুঝা যায়। সকলকে মেধাবী হতে হবে এমন কথা নেই। কিন্তু সকলকে সৎ হতে হবে এমন কথা আছে। হাদিসে, কোরআনে, আইনেও। তোমার মনে নেই, ছোট বেলা তোমায় আম্মা তোমারে কী শিক্ষা দিয়েনে মক্তবে পাঠিয়ে?’
-আপনি কি আমাকে আজীবন বকেই যাবেন, যখন যেখানে যেভাবে পান! আমি এক বিপদে নিমজ্জিত, আপনি কি জানেন?
‘আমি তোমার পিতা। আমি তোমার সঙ্গে-সঙ্গেই আছি। তুমি ভাবো আমার মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কোনো পিতা-মাতা তার সন্তানদের কাছ থেকে মৃত হয় না। তারা তাদের সন্তানদের চারপাশেই থাকে। আমিও। আমি তোমার সব দেখছি।’
-তা জানি। আপনি স্বপ্নের মধ্যে প্রায় আসেন। এটা সেটা বলেন। উপদেশ দেন।
‘তুমি কি আমার উপদেশ কোনোটা মানো আমানত গাজী?’
-মানি তো।
‘কী করে মানো! আমি তোমারে সেই চাকরির প্রথম থেকেই বলে আসছি উপরি একটি হারাম বস্তু। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো। অনৈতিক স্বভাব ছাড়ো। তুমি তার কোনটি পালন করেছ? যদি করেই থাক তবে পরিবাগ, সেনবাগ, নিকেতনের মতো অভিজাত পাড়ায় তোমার অমন প্রাসাদসম ইমারতগুলো কী করে ওঠে! তোমার মাইনে কত? তোমার জন্য তো আমি কিছুই রেখে যেতে পারি নাই ভিটেবাড়ি ছাড়া। কোথায় পেলে এত টাকা! তোমার ছেলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তোমার মেয়ে তদ্রুপ কলেজে! তাদের খরচ কে যেগায়?
-হয়ে যায়। বাড়ি ভাড়া, গাড়ির জমা, হাতিরপুলের দোকানের টাকায়। ওসব গ্রহণ করি না এখন। গত বছর ওমরাহ্ পালন করে এসেছি, তার পূর্বের বছর হজ-ব্রত হয়েছি। আপনার বৌমাকে, নাতি নাতনিকেও তা পালন করিয়ে এনেছি। ওই পথে আর যাব না।
‘বৌমাকে, নাতি নাতনিকে হজ পালন করিয়ে এনেছ ভালো। কিন্তু এতদিন তুমি যা করেছ তা কি তুমি ফিরিয়ে নিতে পারবে। তা’কি তুমি কেটে ছেটে ফেলতে পারবে। প্রতি বছর প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রোজেক্টে তুমি যত অবৈধ কাজ করেছ, তার ফলে যতটা অশুভ দেখা দিয়েছে প্রতিটি কাজে, যতটা অনিষ্ঠ করেছ রাষ্ট্রের অর্থের তা’কি তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে। নানান কৌশলে নানান দিকে যে কূটকৌশল করে রাষ্ট্রের মালিক- মানুষের পানি ব্যবহারে অনিয়ম করেছ তার কি শোধ দিতে পারবে! রাষ্ট্রীয় অপচয়ের দায় মিটাতে পারবে! তুমি কি পারবে এক এক করে প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে, তোমার দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?’
-সে কী করে সম্ভব!
‘সম্ভব, অসম্ভব বলে কিছু নেই আমানত গাজী। তোমার তো সব মিলিয়ে আধাপাকা একটি ছোট্ট বাড়ি থাকার কথা ছিল আশুলিয়া বা সাভারের মফস্বল মহল্লার ভিতর। যদি কৃচ্ছপনা করে থাক তবে একটা সামান্য ফ্ল্যাট হতে পারত অনেক আগের বাজার দামে। কিন্তু এই শহরে তোমার অট্টালিকা কয়টা? তোমার নামে কয়টা প্লট সাবকবলা করা আছে? ফ্ল্যাট? কত টাকা আছে তোমার নামে, নামে বেনামে? তোমার স্ত্রীর নামে কী কী আছে আমি জানি।’
-আমি সব ছেড়ে দেব। বিলিয়ে দেব। আমার গায়ের দুর্গন্ধটা কী করে যাবে তা বলেন আপনি। দুর্গন্ধ তো যা-তা দুর্গন্ধ না। বিশ্রী দুর্গন্ধ আব্বা। গা গুলিয়ে ওঠে। বমি আটকে রাখতে পারি না। নিজেই নিজের গায়ের দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। মানুষ কী করে সহ্য করছে জানি না। আপনি তো কবিরাজী চিকিংসা জানতেন। এখনও কি মনে আছে ওইসব চিকিৎসা? আমার জন্য কি কিছু করার নেই আব্বা?
‘আছে। দাওয়াই দিতে পারি, তবে তোমার কাজে আসবে কিনা জানি না। জানো তো সকলের শরীরে সকল দাওয়াই সকল সময় কাজে আসে না। তোমার আসবে কিনা বলতে পারছি না।’
-আমি সুস্থ হতে চাই আব্বা। আব্বা আমি দুর্গন্ধহীন হতে চাই।
‘সত্যি তুমি দুর্গন্ধহীন হতে চাও? তোমার তো কথা না রাখার অভ্যাস সেই ছোট বেলা থেকেই দেখছি। এই বলো, এই ভুলে যাও। বড় বেলায় তো আরও বেড়েছে সে বদভ্যাস। আর এখন তো তুমি নিজেও প্রায় বৃদ্ধ। তোমার মৃত্যু সময় আসছে।’
-তাই বলে এইভাবে মৃত্যু, পচা দুর্গন্ধ গায়ে নিয়ে! আমার তো দাফন হবে না, গোসল হবে না, আমার সন্তান, আমার স্ত্রী আমার কাছে আসবে না, কী ভয়ানক বিষয়। আমি আর চিন্তা করতে পারি না আব্বা। একটা বিহিত দেন।
‘এই বয়সে চিন্তাটা ভোতা হয়ে যায়! যা করার কম বয়সেই করতে হয়। সব ধর্মের কলে তা’ই বলা আছে। তুমি অন্ধ। তুমি চক্ষুহীন। তুমি পাষাণ। তোমার বিবেক চুরি হয়ে গেছে। তোমার বোধ নির্বোধের চেয়েও নীচ। তোমার কারণে কত মানুষ চোখের জল ফেলেছে। কত মানুষ তাদের শেষ পাওনাটা শান্তি মতো নিতে পারেনি। টেবিলে টেবিলে ঘুরেছে, তুমি পাত্তা দাওনি। ঘুরিয়েছ। তাদের চোখের জল দেখে হেসেছ। কৃতকর্মের ফল কাউকেই ছেড়ে যায় না।’
-আপনিও আমাকে অভিশাপ দেবেন!
‘আবুল হাশেম নামে এক নিঃসহায় কৃষিজমির মালিক তোমার কাছে এসেছিল তার জমিতেই যেন সেচের ডিপটিউবলটি না বসানো হয়। যেন একটু পাশ দিয়ে নিলে তার সর্বশেষ আয়ের জমিটা বাঁচে, যেন আহারে লাখি না দেওয়া হয়। তুমি তাকে কী বলেছিলে মনে আছে আমানত গাজী? তুমি তাকে শুয়োর বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলে ষাট হাজার টাকা ঘোষ দিতে না পারায়। তুমি যাকে-তাকে শুয়োর বলে গালি দেওয়া তোমার নিত্যঘটনা ছিল, মনে আছে? কী যোগ্যতা আছে তোমার গাড়ি চড়নের। তোমার তিনটা চকচকে গাড়ি আছে। তোমার ড্রাইভার আছে। তোমার গ্যারেজ আছে। একবার তোমার গাড়িতে একটা অটোভ্যানের আচড় লেগেছিল বলে তুমি সেই অটোভ্যানের বৃদ্ধকে কী প্রহারটাই না করেছিলে! আর কতবার শুয়োরের বাচ্চা বলে খিস্তি দিতে দিতে বাড়ি পৌঁছেছিলে, মনে নেই? অথচ দেখ, কী নিয়তি। তোমর গায়েই এখন মরা শুয়োরের কঠিন দুর্গন্ধ।
-মরা শুয়োরের দুর্গন্ধ!
‘হ্যাঁ আমানত গাজী, তোমার শরীরে ওই গন্ধটা মরা শুয়োরের দুর্গন্ধ। প্রয়োজনে তুমি কোনো শুয়োরের খামারে যেয়ে কয়েকদিনের মরা একটা শুয়োরের সমনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে আসতে পারো।
-হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা আমানত গাজীর মাথায় ভনভন করে ঘুরতে থাকে বাক্যটা- মরা শুয়োরের দুর্গন্ধ! এক হাজার বার, এক লক্ষ বার, এক কোটি বার। চিৎকার করে ওঠে আমানত গাজী। আমি কি কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নই আব্বা। আমি কি আর ফিরে পাব না ওই দুর্গন্ধহীন স্বাভাবিকতা। এই মরা শুয়োরের দুর্গন্ধ নিয়ে আমি কী করে বাঁচব! একটা দাওয়াই দিন আব্বা। আব্বা আমি নিস্তার চাই এ দুর্গন্ধ থেকে।
‘দিতে পারি, তবে নিরাময়ের মালিক আরেকজন। আমি উছিলা। চেষ্টা তোমার।’

৬.
আমানত গাজী আর আমান গাজীর এই আলাপ কখন শেষ হয় তা অসমাপ্তই রাখছি তবে অনেকদিন পর আমানত গাজীর একমাত্র পুত্র রউফ গাজী তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো এক রাতের নির্জন প্রহরে তার পিতার অবশিষ্ট আয়ুর কথা যখন বলে তখন আমরা পাশ থেকে শুনতে চাই সে কথোপকথন এবং আমাদের সামনে অবতার হয় পরবর্তী আরও কিছু দৃশ্য। আমরা দেখতে পাই, প্রায় দু’দিন পর আমানত গাজী তার বিছানে ছেড়ে ওঠে একটা শিশুর মতো। সাত আট মাসের একটা শিশু যেমন দীর্ঘ ঘুমের পর আড়মোড়া ভেঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে, চার দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জেগে ওঠে, ঠিক তেমন; কিন্তু তার অবয়বে গেলে থাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা এক বিভ্রম মানুষের আবরণ। আমানত গাজী জাগে, না নিজেকে জাগ্রত করে তা ঠিক ধরা পড়ে না। অল্প সময়ের ব্যবধানে সে আবার ফিরে যায় সেই আয়নাটা সামনে। আয়নার সমনে সে তার নিজেকে হাজির করেই তার গায়ের জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেলে। বুকের মাঝখানে দশ আঙুলের নখগুলো বসিয়ে চিড়ে ফেলতে চায় তার বুকের চামড়া; যেন আমানত গাজী অনুভব করছেÑ দুর্গন্ধটা আসছে তার আত্মার ভিতর থেকে। সে তার মাথায়ও দুইহাতে স্বজোরে আঘাত করে; যেন সে অনুভব করছেÑ দুর্গন্ধটা আসছে তার মগজের কোষগুলো থেকে। চুলগুলো টেনে টেনে তুলে ফেলতে চায় সে। তবে আমাদের ধারণার সাথে তার চিন্তার মিল আছে কিনা আমরা জানি না। আগেই বলেছি, আমরা শুধুই প্রত্যক্ষদর্শী কিন্তু কোথাও কোনো মতামত বা সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। আমরা তাই দেখতে থাকি আমানত গাজীর শেষ দৃশ্যপট।

৭.
একটা এতিমখানার বিরাট মাঠ। ময়দানের মতো বড়। একজন মধ্যবয়স উত্তীর্ণ লোক একা রৌদ্রস্নান করছে উঠানের মাঝখানে বসে। কারো সঙ্গে সে দেখা করে না, কথা বলে না। তার চারপাশে অনেক শিশু। তারা নানান খেলায় কল্লোলিত। প্রত্যেকের স্বরে শামুকখোল পাখির স্বরের মতো কিচিরমিচির স্বর। স¦রটা তার কানে সুধানগরের তরুণ বাঁশি বাঁধক নৃপেন দত্তের অবিরাম বাজিয়ে যাওয়া বাঁশির স্বরের মতো মনে হয়। সে দেখতে পায় অদূরে তার শ্মশ্রুমণ্ডিত পিতা একটি সাদা পাঞ্জাবী গায়ে হাঁটছে, গজল গাইছে এক ঝাঁক বেলে-হাঁসের বাচ্চার সাথে, নৃপেন দত্ত বাঁশিটা বাজিয়েই যাচ্ছে, বাজিয়েই যাচ্ছে। লোকটি হঠাৎ নৃপেন দত্তকে বাঁশি বাজানো থামিয়ে কাছে ডাকে। বলে, ‘নৃপেন, দেখ তো আমার গা থেকে কোনো দুর্গন্ধ আসছে কিনা!’ নৃপেন লোকটির গায়ের কাছে এসে লম্বা একটা নিশ্বাস টান দিয়ে বলে, ‘জ্যেষ্ঠ, এরূপ সুগন্ধী আপনি কোথায় পেলেন?’
একইভাবে আমরা দেখতে পাই, শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কাচপুর ব্রিজের পূর্ব-পাড়ে নোংরা নদীর কোল ঘেঁষে জলে-কাদায় পাওয়া একটি বিগলিত লাশ ঘিরে উৎসুক অনেক লোকের হৈচৈ ভিড়; যে লাশের সুরতহালের সঙ্গে আমানত গাজীর সুরতহালের হুবহু মিল পাওয়া যায়। উপস্থিত পুলিশকে নাম জিজ্ঞাসা করা হলে পুলিশ বলে, ‘এই মুহূর্তে তা বলতে পারছি না।’

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ একজন আমানত গাজীর শেষ দৃশ্যপট গল্প জোবায়ের মিলন জোবায়ের মিলনের গল্প 'একজন আমানত গাজীর শেষ দৃশ্যপট' সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর