সাইবেরিয়ার ডাইনি
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:২৩
আইতার মা পা দুইটা জড়ো করে মেঝেতে বসা। হাতের রুটিটা গোলকরে মুড়িয়ে চায়ের মগে ভিজিয়ে বেশ তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছে। থালায় রাখাআলুভাজি আর অর্ধেকটা ডিমভাজি আগেই পলিথিন ব্যাগে উঠিয়েফেলেছে। রুটির সাথে চা পেলেই তার চলে। সন্ধ্যার দিকে কোনোরকমেভাতের একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই আজকের মতো চিন্তা নাই।
স্নো পর্দার আড়াল থেকে খুশি খুশি চোখে আইতার মায়ের খাওয়াদেখছে। ওর বেশ মজা লাগছে আবার একটু ভয় ভয়ও করছে। কাছেযেতে পারছে না, মা বকা দেবে বলে। আইতার মায়ের বয়স হবে সত্তর, তামাটে কুঁচকে থাকা চামড়ার ভেতর দিয়ে কপালের সবুজ শিরাগুলোদিব্যি দেখা যায়। বৃদ্ধার দাঁতগুলো ক্ষয়ে গিয়ে ছুঁচলো হয়ে গিয়েছে, মাথারচুলগুলো সবই প্রায় সাদা আর হাতের রগগুলো চামড়া ফুঁড়ে যেন বেরহয়ে আসবে যেকোনো সময়। লতাপাতা প্রিন্টের শাড়ি আর মলিন, জরাজীর্ণ ভিক্ষার ঝোলা। হাতের তালি দেয়া কালো ছাতাটা দেখে স্নোরমনে হচ্ছে, এইটাই সেই ম্যাজিক ব্রুম।
স্নো আস্তে করে হাতের বইটা খুলে বইয়ের ডাইনির ছবির সাথেআরেকবার আইতার মায়ের চেহারাটা মিলিয়ে নিল। পর্দার ফাঁক গলেস্নোর বাদামী কোঁকড়া চুলগুলো বের হয়ে যাচ্ছে বারবার। বাজপাখিরঠোঁটের মতো বাঁকানো নাকের উপর দিয়ে আইতার মা ঘোলাটে চোখেসেদিকেই তাকিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হেসে ফেললো।
‘ওখানে কে গো? সোনো নাকি? রাজকন্যা সোনো দাঁড়িয়্যা আছ নাকি?’
স্নো খুব সাবধানে ধীর পায়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বড় বড় চোখেআইতার মাকেই দেখছে, মুখে আদুরে হাসি।
‘অ্যাজক্যাও বোয়ের সাথে চ্যাহেরা মিলিয়্যা দেখ্যাছো? কি একদমডাইনিডার মুতু ল্যাগছে? কি নাম যানি ডাইনিডার?’
স্নো ফিসফিস করে বলল-
‘সাইবেরিয়ার ডাইনি।’
এই নামেই আইতার মাকে ডাকে স্নো। ওর ভাবতেই খুব ভালো লাগেসত্যি সত্যি সাইবেরিয়ার ডাইনির সাথে ওর ভাব। স্কুলে সবাইকে বলেছেকথাটা, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতেই চায় না। স্নোর খুব শখ আইতার মাকেতার বন্ধুদের সাথে দেখা করানোর। কিন্তু, মা জানতে পারলে ভীষণক্ষেপে যাবে বলে কথাটা মাকে বলতে পারছে না।
স্নোর বাদামি চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে আইতার মা বলে-
‘তুমাখে আমার এইজন্যেই খুব ভালো লাগে। সবাই আমাখে ডাইনি মুনেকোর্যা কত ঘিন্ন্যা করে, কতযে গালাগাল করে, তুমি কিন্তু আলাদা।তুমি আমাখে যে ডাইনিডার নামে ডাক, সেড্যা আমার খুব ভালো লাগে।বিদেশি ডাইনি, হেহেহে…’ আইতার মা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
হাসিটা বেশ জোরেই হয়েছে বোঝা গেল, মুহূর্তেই রোকেয়া প্রায় দৌড়েবসার ঘরে এসে দাঁড়ালো। রাগী রাগী মুখে স্নোর দিকে তাকিয়ে কড়া করেধমক লাগিয়ে দিলো-
‘তুমি ফের এঘরে কেন এলে? যাও নিজের কাজ করো।’
স্নোকে বিদায় দিয়ে এবার রোকেয়া ফিরে তাকালো আইতার মায়ের দিকে-
‘তোমাকে কতবার বলেছি বিকেলে এ বাসায় আসবে না। এটা স্নোর খেলাকরার সময়, আর সে তোমাকে দেখলে ভয় পায়।’
‘তুমি যত যাই বুলো, সোনো আমাখে কিন্তুক ভয় পায় না। অর আরআমার মিলও আছে। উই বিদেশি রাজকন্যা আর আমি বিদেশি ডাইনি, হেহে…। তুমার বিটি একদম রাজকন্যা, কিন্তুক সোনো নামডা রাখা ঠিকহয়নি। এই রাজকন্যাকে নাকি সৎ মা বিষ দিয়্যা মারে। আর তুমারবিটির চোখেমুখে সাহুস, অখে কে ম্যারবে, উলট্যা উই হাজার মানুষখেএকদিন বাঁচাপে দেখ।’
রোকেয়া বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আইতার মায়ের দিকে। দাঁত চিপেবলল-
‘এবার যাও। আর স্নো স্কুলে যখন থাকে তখন আসবা, ও তোমাকে ভয়পায় কথাটা মনে থাকে যেন।’
রোকেয়া ভালো করেই জানে স্নো আইতার মাকে ভয় পায় না, বরং কিছুটাপছন্দ করে। বুড়িটাও মেয়েটার পিছ ছাড়ছেই না। এলাকায় আইতারমায়ের খুব বদনাম, সবাই ডাইনি ডাকে। ক`দিন আগেই বাড়ির কাজেরখালা রোকেয়াকে সাবধান করে গেছে। আইতার মায়ের সামনে পড়লেইনাকি বাচ্চাদের শরীর শুকিয়ে যায়।
ডাইনিডা চোখ দিয়্যা বাচ্চাদের রক্ত চুষে। বাড়িঘরের ঠিক ঠিকানা নাই, কোথায় থ্যাকা অ্যাস্যাছে তাও কেউ জানে না। সোনোকে অর সামনেএকদম বাইর হোতে দেবেন না খালা।
তবে রোকেয়া সেসব তেমন গুরুত্ব দেয় না। সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়।আইতার মা সুযোগ পেলেই স্নোকে ওর নোংরা ঝুলি থেকে ভিক্ষার এটাসেটা দিয়ে যায়। মেয়েটাও সেরকম বদ। কয়েকদিন আগে আইতারমায়ের কোলে বসে দিব্যি কয়েকদিনের বাসি নাড়ু খেতে শুরু করেছিল।
তারচেয়েও বড় অপরাধ, গত মঙ্গলবার সে চুপ করে স্নোর হাতে দশটাকাদিয়ে গেছে। মঙ্গলবার করে পাড়ায় হরেকমাল নিয়ে ফেরিওয়ালাটাআসে। স্নো তার নাম দিয়েছে মঙ্গলবারওয়ালা মামা। ওর শখ অন্যবাচ্চাদের মতো সেও তার কাছ থেকে চুড়ি ফিতা এসব কিনবে। কিন্তুরোকেয়ার কড়া নিষেধ। স্নোর একা বাড়ির বাইরে বের হওয়া তো যাবেইনা, তারপরে এসব সস্তা শখের বিষয়টা কল্পনাই করতে পারে নারোকেয়া।
মঙ্গলবার এলেই মেয়েটা মনমরা হয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ফেরিওয়ালারবিকিকিনি দেখে। আইতার মায়ের টাকাটা পেয়ে এক মঙ্গলবার স্নো চুরিকরে বাইরে গিয়ে সবুজ ডুরেপাড় দেয়া লাল একটা সিল্কের ফিতা কিনেবাড়ি ফিরেছে। কথাটা মনে আসতেই রোকেয়ার মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে।মেয়েকে ডেকে ভালোভাবে আরেকবার বকা দিবে মনে করে। বাড়িরভেতরে পা বাড়াতেই রাস্তা থেকে হট্টগোলে শব্দটা কানে আসে।
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মানুষের ভিড়ে কিছুই দেখতে পায় নারোকেয়া। দ্রুতপায়ে ছাদে উঠে যায়। রাস্তায় জনা পঞ্চাশেক মানুষেরজটলা। মাঝখানে কাউকে পিটানো হচ্ছে। ফ্যাসফ্যাসে শ্লেষা জড়ানোগলায় কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠছে বারবার। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝতেপারলো সেটা আইতার মায়ের গলা। ব্যথায় কাতর স্বরে চিৎকার করছেবৃদ্ধা।
হতবিহ্বল রোকেয়া বেশ কিছুক্ষণ চিৎকার করে করে শেষে জানতেপারলো- আইতার মা পাশের মুদি দোকানির ছেলেটাকে প্রায় জোর করেইডিমভাজি খাওয়াতে যাচ্ছিল, একবার মুখে নিয়েই বাচ্চাটা বমি শুরুকরেছে, রক্ত বমি। মুহূর্তেই চারদিক থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়েগেছে। ল্যাম্পপোস্টের সাথে আইতার মাকে বেঁধে ফেলেছে অতি উৎসাহীকিছু তরুণ।
ভিড়ের মধ্যে থেকে ক্ষণে ক্ষণে দাবি উঠছে-
‘বুড়িডাখে পিটিয়েই ম্যার্যা ফ্যাল। ডাইনিডা অনেক রক্ত খ্যায়াছেছেল্যাপিল্যার। ওখে বাঁচিয়্যা র্যাখলেই বিপদ।’
রোকেয়া ওপর থেকে চিৎকার করে অনেকবার নিষেধ করেছে। কিন্তুমানুষের চেঁচামেচি গলে সেই কথাগুলো কারো কানেই যাচ্ছে না।আইতার মায়ের চিৎকার কমে আসছে ক্রমশ, এখন কেমন গোঙানিরমতো আওয়াজ আসছে। রোকেয়ার শরীর উত্তেজনায় থরথর করেকাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে কেবল।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যের হট্টগোলটা থেমে গেল, যেন মুহূর্তেই ধাক্কা খেয়েসময়টা থমকে গেছে। ফিসফিসানি শুরু হয়েই আবার তুমুল চেঁচামেচিশুরু হয়ে গেল।
বাড়ির কাজের খালা ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে সোজা দৌড়ে এসেপাগলের মতো গেটে বাড়ি দিয়ে শুরু করেছে। রোকেয়া কিছু না বুঝেইকিছুক্ষণ ইতস্তত করে গেটের সামনে দাঁড়াতেই খালা ওর হাতটা ধরেহ্যাঁচকা টান দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে আনলো।
‘খালাগো, তুমার পাগল বিটিখে বাঁচাও। য্যায়া দ্যাখো ওই পাগলিডাইনিডাকে জড়িয়্যা ধোর্যা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ওখে বাড়িতেঢুকাও।’
ফাঁকা দৃষ্টিতে রোকেয়া একবার চারদিকে তাকায়, তারপরে ভিড় ঠেলেসামনে এগুতে থাকে। আইতার মায়ের শ্লেষা জড়ানো কণ্ঠ চাবুকের মতো ওর মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে-
‘উই একদিন দেখো অনেক মানুষখে বাঁচাবে…’
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প মারিয়া সালাম মারিয়া সালামের গল্প 'সাইবেরিয়ার ডাইনি' সাইবেরিয়ার ডাইনি সাহিত্য