Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা

সুভাষ সিংহ রায়
৮ মে ২০২৩ ১৪:৪৮

কবিগুরু বলেছিলেন, ‘পেশা আমার জমিদারি, নেশা আমার আসমানদারি’। সত্তর দশকে নোবেল বিজয়ী নরম্যান আরনেস্ট বোরলগ সারা পৃথিবীর কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তিনি এই মহৎ কাজ না করলে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেত।

এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, ভারতের নকশাল বাড়ির আন্দোলনকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের সাথে বোরলগের সবুজ বিপ্লব অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। যে কারণে কৃষি বিপ্লবের জনক নরম্যান বোরলগ অন্নদাতা পরিচিতি পান। কারন উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার, কীটনাশক, পাম্পের সাহায্যে সেচ ইত্যাদি সহযোগে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার যে বিপ্লব দেখা দেখা গিয়েছিল, তা কৃষকদের অন্দোলন ছেড়ে আরও বেশী কৃষি অভিমুখী করে তুলেছিল।

বিজ্ঞাপন

মূলত বাংলাদেশে এই কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের জমিদারিতে পল্লীপুনর্গঠনের কাজকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-

প্রথম পর্ব (১৮৯৯-১৯০৬)

শুরু হয় ১৮৯৯ সালে তার একক প্রয়াসে। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে নতুন ধরনের ধান চাষ, আমেরিকান ভুট্টা, নৈনিতাল ও আমরাগাছি আলুর চাষ, পাটনাই মটর, আখ, কপি, রাজশাহীতে রেশমচাষের চেষ্টা করেন এবং কিছুটা সফল হন। কৃষি নিয়ে এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন নিজের অর্থ ব্যয় করে। উদ্দেশ্য ছিল নতুন চাষের প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামের আর্থিক অবস্থার উন্নতিসাধন।

এই কৃষিকাজের পরীক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ পরে ‘কুইক্সটিক’ ও ‘বহুব্যয়সাধ্য প্রহসন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার নিজের কথায় ‘শিলাইদহে কুঠিবাড়ির চারিদিকে যে জমি ছিল, প্রজাদের মধ্যে নতুন ফসলের পরীক্ষায় লেগেছিলেম। এই পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারি কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা অত্যধিক পরিমাণেই মিলেছিল। তাদের আদিষ্ট উপাদানের তালিকা দেখে চিচেসটারে যারা এগ্রিকালচার কলেজে পাশ করেনি এমন সব চাষিরা হেসেছিল; তাদেরই হাসিটা টিকেছিল শেষ পর্যন্ত।… কিন্তু একথা যেন মানেন শিক্ষার অঙ্গরূপে এই ব্যর্থতারও ব্যর্থ নয়।’

বিজ্ঞাপন

১৯০৫ সালে শিলাইদহে ও পতিসরে চাষিদের ঋণ পাওয়া যাতে সহজসাধ্য হয় সেজন্য কৃষিব্যাংক ও তাত শিক্ষার কেন্দ্র গঠন করা হয়। কৃষিকাজকে আরও সংহত রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ও গো-পালন শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তার এক বছর পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও ওই একই বিষয় শিক্ষালাভ করার জন্য আমেরিকায় পাঠান। রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন ৮০ বিঘা জমিতে কৃষি খামার ও সঙ্গে কৃষি বিষয়ক নানা ব্যাপারে পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষাগার গড়ে তোলেন। লক্ষ্যনীয় যে, কবিগুরু সব সময় গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

দ্বিতীয় পর্ব (১৯০৮-১৯০৯)

শুরু হয় ১৯০৮ (১৩১৮, চৈত্র মাস) সাল থেকে বিরাহিমপুর পরগনায় শিলাইদহে ভগ্নদশা গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের কাজের মাধ্যমে গ্রামের লোকেদের নিয়ে তাদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। এই পর্বের কাজে রবীন্দ্রনাথের সহযোগী হিসেবে যোগদান করেন কালীমোহন ঘোষ, শচীন্দ্রনাথ অধিকারী ও অন্যান্যরা। কালীমোহন ১৯০৭ সালে পাবনা সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের গঠনমূলক কাজের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার জমিদারি এলাকায় গ্রাম পুনর্গঠনের কাজে ব্রতী হন। তাদের এই সম্পর্ক আজীবন বজায় ছিল। শান্তিনিকেতনেও তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রথমে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরে (১৯২২ সালে) শ্রীনিকেতন কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।

শিলাইদহের কাজে তার সঙ্গে আরও জনা চল্লিশ কর্মী নানা সময়ে গ্রামোন্নয়নের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কালীমোহন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই কাজ স্থগিত করে দিতে হয়।

তৃতীয় পর্ব (১৯১৫-১৯৪০)

এই পর্বে পতিসরকে কেন্দ্র করে কালিগ্রামে পরগণায় গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ আবার নতুন করে শুরু হয়। সহযোগী হিসেবে যোগ দেন বাগনান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অতুল সেন, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বিশ্বেশর বসু, উপেন্দ্রনাথ ভদ্র, নলিনী বসু, ভুপেশচন্দ্র রায়, রতিকান্ত দাস, সতীশচন্দ্র ঘোষ ইত্যাদি কর্মীরা।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের কাজে বিস্তৃতির দিকে থেকে তফাত থাকলেও ভাবনার দিক থেকে পৃথক ছিল না। দুটি জায়গাতেই মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের দ্বারা গ্রামোন্নয়ন করা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পতিসরে মন্ডলী প্রথা দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয় এবং একে ভিত্তি করেই গ্রাম উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয়। এলাকার শক্ত এঁটেল মাটি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ দেওয়ার ব্যবস্থাসহ গ্রামের কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন, বয়ন ও মৃৎশিল্পের উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জলের জন্য কুয়া নির্মাণ, পুকুর সংস্কার, ধর্মগোলা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণদান, সালিশি বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন, দু’শটি প্রাথমিক স্কুল, পতিসরে হাইস্কুল, তিনটি হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি স্থাপন ইত্যাদি নানা গ্রামোন্নয়নের কাজ করা হয়।

বিশ্ব ভারতীর কাজ শুরু হবার পর ও বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে সেখানকার গ্রামের কাজে ভাঁটা পড়ে।

বাংলাদেশের গ্রামের চাষিদের ঋণ জর্জরিত অবস্থা বরাবর গ্রামবাংলার সমাজজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে মেনে নেওয়া ছিল রীতি। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথার বাইরে গিয়ে বাংলার চাষিদের ঋণ কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করেন। নিজে চাষিদের অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিজনিত ফসলের ক্ষতি হলে তাদের দেয় খাজনা মওকুফ করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেন। কিন্তু সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। ১৯০৫ সালেই তিনি পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। এই ব্যাংকের মূলধন বরীন্দ্রনাথ তার বন্ধুদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার করে জোগাড় করেন। এ ছাড়া বিশ্বভারতী হাসপাতাল ফান্ড ও টিউবওয়েল ফান্ডের টাকা সেখানে জমা রেখে আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চাষিদের কাছে অধিক পরিমাণে টাকা জোগান দেওয়ার মতো প্রচেষ্টা করা হয়। পরে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ৮২,০০০ টাকা পতিসরের ব্যাংকে রেখে মূলধনের সমস্যার সমাধান করা হয়। সেসব থেকে যে বার্ষিক আট হাজার টাকা সুদ পাওয়া যেত তা থেকে শান্তিনিকেতনের অর্থের চাহিদার কিছুটা মেটানোও সম্ভব হতো।

রবীন্দ্রনাথের চাষিদের অল্প সুদে মূলধন জোগান দেবার এই প্রয়াসে সজোরে কুঠারঘাত করা হয় ১৯৩০ সালে। তখন “Rural Indebtedness” আইন প্রবর্তনের ফলে ঋণগ্রস্ত চাষিদের সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকে গচ্ছিত নোবেল পুরস্কারের অনেকটা অর্থ এই আইন প্রবর্তনের ফলে রবীন্দ্রনাথকে ও শান্তিনিকেতনকে হারাতে হয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

নিবন্ধ রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা সাহিত্য সুভাষ সিংহ রায়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর