‘প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো’
৮ মে ২০২৩ ১৫:২৩
‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু,হে প্রিয়মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো’ সপ্তাহখানেক আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি সারা মন-প্রাণ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বেশ খানিকটা লম্বা সময় ধরে। প্রায় এমনটা হয় আমার। অনেকেরই হয় বলে জেনেছি। সঙ্গীতসংক্রান্ত এক ধরণের সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতা।
একটা কর্মময় দিনের শুরুতে তেমন কোন কারণ ছাড়াই, অথবা বেশিরভাগ সময় কর্মব্যস্ত দিনের শেষে, অপরাহ্নের অস্পষ্ট আলো-ছায়ায়, ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীর-মন যখন আর কিছুতেই শান্তি খুঁজে পায়না; যখন টেনে নেওয়া জীবনের গুরুভার খুব বেশি বলে অনুভূত হয়, তখন হঠাৎ করে একটা প্রিয় গান, একটা ভালো লাগার গান আমার টিমটিম করে জেগে থাকা অস্তিত্বের পুরোটা দখল করে ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই প্রিয় গানটা হয় কবিগুরুর কোন একটি সঙ্গীত। কখনও কোন একটি কবিতার বারবার পড়া কিছু লাইন।
সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তে নিজের জীবনের সাথে, জীবনের কোন এক বা একাধিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ওই গানটির বিশেষ বিশেষ চরণের চমকে ওঠা সাদৃশ্য অথবা অভাবিত সংযোগ, আমাকে একই সাথে হতবিহবল করে ফেলে; নির্মল আনন্দে ভাসিয়ে দেয়; আর গভীর বিষাদে ডুবিয়ে রাখে। আমি বারবার গানটির অন্তহীন অতলে অবগাহন করতে থাকি। আমার ঘোর কাটেনা। মন্ত্রমুগ্ধতার মায়াজালে বারবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
‘সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা/ কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা’ বা ‘হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়’ শোনার সাথে সাথে গলা পর্যন্ত উঠে আসা আবেগে আপ্লুত হই; মনে হয় এ আমারই হৃদয়-উদ্ভূত ক্ষরণের অব্যক্ত উচ্চারণ। অথবা, ‘একলা পথের চলা আমার করব রমণীয়’ বলবার আগে যে বাসনা পোষণ করেন কবিগুরু, মনে হয় আমার মনটাই উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন তিনি বহু বহুদিন আগে। শুধু কি আমার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়? তা তো নয়। তার অলৌকিক কাব্যসম্ভারের, অপার্থিব সুরের সংযোজনে সঙ্গীত যার অন্যতম অংশ, অনির্বচনীয় আকুলতা আর বিশ্বজনীন আবেদন ও প্রাসঙ্গিকতার গুণে তিনিই জগতের একমাত্র বিশ্বকবি, মহাকবি। এই উপাধিটি কেবল তারই জন্য।
যদি আইরিশ কবি W.B.Yeats এর বহুল-উচ্চারিত বিখ্যাত সেই উদ্ধৃতিটির পুনরাবৃত্তি করি, তাহলে সংক্ষেপে কবিগুরু সম্পর্কে আমাদের সকলের অনুভুতির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। “Tagore was the product of a whole people, a whole civilization, immeasurably strange to us, and seems to have been taken up into this imagination; and yet we are not moved because of its strangeness, but because we have met our own image, as though we had walked in or heard perhaps for the first time in literature, our voice as in a dream.” আর তার বিশাল সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ভেতরে যে অপূর্ব যোগসূত্রের সন্ধান দিয়ে গেছেন ও স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের যে সহজ উপায় বাতলে দিয়ে গেছেন; বিশ্ব মানবতার কল্যাণে যে অপার শান্তি, আশা ও বিশ্বাসের বাণী তিনি বারবার তুলে ধরেছেন, তা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ খুঁজে নিতে দিশা দেখিয়ে যাবে।
আবারো যদি কবিগুরুর সঙ্গীতেই ফিরে আসি, সেই স্বর্গীয় মূর্ছনার মাঝেই যেন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা/ তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা’। আর কিছু বলবার সুযোগ কোথায় থাকে, যখন, ‘যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো’, কারণ, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/ এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।’
অথবা, যখন আমি কেবল আওড়াতে থাকি, ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা/ শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা/শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া, শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া’, তখন মনে হতে থাকে আর অন্য কোন শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে আমাদের ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনের চিরন্তন অসহায়তাকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো না। ‘শুধু যাওয়া আসা’ আর ‘শুধু কাঁদা-হাসা’ দিয়েই যেন গোটা জীবনের ব্যাপ্তিটাকে তুলে ধরা যায়; সংজ্ঞায়িত করে ফেলা যায় এর সামগ্রিক পরিধিটাকে। আর কিছু না বললেও চলে; সত্যিকার অর্থে আর কিছুই বলার অবকাশ থাকে না।
তারপর, হঠাৎ কখনও, এই সঙ্গীতের মাঝেই ‘অনাদি কাল হতে’ চলে আসা সেই নিরবচ্ছিন্ন হাহাকারের এক অসাধারণ কাব্যময় আকুতি- ‘এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে/সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে/ গভীর ক্রন্দন—‘যেতে নাহি দিব’। হায়,/ তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।”
এ তালিকা কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। বিস্ময়ের পারদ ক্রমশ চড়ে যেতে থাকে। অভিজ্ঞতার কোন রকমফের হয়না। প্রতিবার একইরকম বোধের উন্মেষ; প্রতিবার একই মাত্রার এপিফ্যানি। প্রতিটি অভিজ্ঞানের সমাপ্তিতে অনুরূপ আত্মানুসন্ধানের দুয়ার খুলে যাওয়া যেন ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিলো দ্বার’ অথবা যেন আরও একবার গেয়ে ওঠা যায়, ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।’
এভাবে আরেকটি সকাল আসে। আরেকটি নতুন দিনের শুরুতে মনের কোনে জেগে ওঠে সেই পুরাতন প্রার্থনা নতুনতর শক্তিতে, আবেগে; ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে/…যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো/ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে।’
এভাবে কবিগুরু পাশে থাকেন সবসময়; ঘুরে ফিরে দিনের শুরুতে অথবা শেষে তিনি জুড়ে থাকেন মননের সবটুকু বিস্তার। কোন কোন দিন সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিতে দিতে মনের কোনে গুণগুণ করে ওঠেন সাগর সেন। সেই আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে পিত্রসূত্রে পাওয়া এই ভালো লাগাটুকু আজও অনেক বিষন্ন মুহূর্তে চটজলদি মন ভালো করে দেওয়ার টোটকার কাজ করে। ফ্রেঞ্চ জানালার বাইরে দূরে ভারত সাগরের সাথে শুভসকাল বিনিময় করে মন গেয়ে ওঠে, ‘আমি যে গান গাই জানিনে সে কার উদ্দেশে/যবে জাগে মনে/অকারণে চঞ্চল হাওয়ায়, প্রবাসী পাখি উড়ে যায়/সুর যায় ভেসে কার উদ্দেশে।’
কবিগুরুর ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে ‘Revisiting Rabindranath Tagore’s Legacy’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য হয়েছিল। কলম্বো ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর কনটেম্পরারি ইন্ডিয়ান স্টাডিস ছিল এই অনুষ্ঠানের উদ্যেক্তা। নিয়মমাফিক অনুষ্ঠান শুরু হলো শ্রীলঙ্কা ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। একটি শিহরিত মুহূর্ত। দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতেই কবিগুরুর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপস্থিতি। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কথা স্মরণ করে বলতে হয়, পৃথিবীর আর কোন কবিই এই দুর্লভ সৌভাগ্য ও সম্মানের অধিকারী হতে পারেননি। একারণেই তিনি জগতের একমাত্র বিশ্বকবি, মহাকবি। এই অভিধাটি কেবল তারই জন্য। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’এবং এর রচয়িতা বিখ্যাত সিনহালা গীতিকার-সুরকার আনান্দা সামারাকুনের ব্যাপারে বেশকিছু ঘটনা শোনা যায়। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণাটি হলো, সামারাকুন কবিগুরুর সঙ্গীতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ বা প্রভাবিত হয়ে উক্ত গানটির বাণী রচনা এবং সুর সংযোজন করেছিলেন। সামারাকুন ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে সামান্য সময়ের জন্য শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর সরাসরি সংস্পর্শে থেকে শিল্প ও সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়ন করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। আরেকটি দল অবশ্য দাবি করেন, যদিও তারা সংখ্যায় নগন্য, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের পুরোটিই কবিগুরুর রচনা। ঘটনা যাই হোক, এটি অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব বা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। গানটির বর্তমানে গীত প্রথম চরণ ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’র জায়গায় আসল বাণী অনুসারে ছিল ‘নমো নমো মাতা’। কিন্তু সংস্কারজনিত বা অন্য যেকোন কারণে হোক, সমালোচকরা ‘নমো নমো মাতা’ দিয়ে গানটি শুরু করবার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী গানটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়। কিন্ত্ত এই সংশোধনী আনার বিষয়ে রচয়িতা সামারাকুনকে কিছুই জানানো হয়নি বলে অভিযোগ আছে। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তীতে ক্ষোভে, অভিমানে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সামারাকুন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন! শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতে কবিগুরুর প্রভাব বিষয়ে যা বলছিলাম, সঙ্গীত যেহেতু একটি অনুভবের বিষয়, তাই যতবারই এই সঙ্গীতটি শোনার সুযোগ হয়েছে, সবসময়ই একটি রাবিন্দ্রিক দ্যোতনা নিজের ভেতরে অনুরণন তুলেছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ইচ্ছা আছে, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে একটি আলাদা রচনা লিখবার। কেননা,আরও অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মতো এরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি আছে। আমাদের চিন্তার খোরাক যোগায় এই বিষয়টি যে, বিশেষ প্রক্রিয়ায় সাধারণভাবে জনপ্রিয় একটি সঙ্গীত নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে একটি স্বাধীন দেশের অন্যতম পরিচয়বাহক হিসেবে তার জাতীয় সঙ্গীতের অনন্য মর্যাদা লাভ করে।
আবার, যখন কলম্বোস্থ রিজিওনাল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ কর্তৃক আয়োজিত ১৯তম সার্ক সম্মেলন-পূর্ব এক সেমিনারে উপস্থিত থাকবার সুযোগ ঘটেছিল, সেখানেও ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথ আসেন। উচ্চারিত হয় তার সার্বজনীন মানব-প্রেমের বাণী, বিশ্ব-দর্শনের কথা। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনার সবটুকু পরিধি জুড়েই তিনি কেবল একজন গুরুদেব, গুরুজী। তার গানের সুরেই তাই গাইতে হয়-
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।
…আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী
হল না সারা,কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব।’
লেখক: সাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই