পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
৮ মে ২০২৩ ১৮:১৭
রবীন্দ্রনাথ কবি। শুধুই কবি রবীন্দ্রনাথ! বাংলার কাব্য আকাশে যেভাবে তিনি তাঁর কাব্যের বর্ণছটা ছড়িয়েছেন, তাতে করে সাধারনের কাছে তো তিনি কবি রবীন্দ্রনাথই। শুধুই কবি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিতা ছাপিয়েও তো বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় সমান ভাবে ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের আলোক মালা। ছরিয়ে আছে জীবনবোধের নানান অনুসঙ্গ। দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথের মানবিক দর্শনের সুভাষ বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে সমগ্র পৃথিবীময়। কাব্যের ছন্দে, সুরের ঝংকারে, গল্পের জাদুতের মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন পৃথিবীর সকল প্রেমময় হৃদয়কে। এসব ছপিয়ে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথের আরো একটি বড় পরিচয় হল ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথ’। আদতে কবি রবীন্দ্রনাথ, ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ, গল্পকার রবীন্দ্রনাথ, সুরকার রবীন্দ্রনাথ, চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ সব একই স্রোতে বহমান। সবই রবীন্দ্র দর্শনের বাহ্যিক রূপ।
যার হৃদয় কোমল, মানবিক, প্রেমময়, সেই তো কবি। রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ছিল প্রেমে পূর্ণ , মনবিক। এ জন্যই তিনি জমিদার হয়েও আর দশজন জমিদারের মতো প্রজাপীড়ক অত্যাচারী জমিদার ছিলেন না। যার প্রকাশ তিনি তাঁর পুণ্যাহ অনুষ্ঠানেই দেখিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথের আমল থেকে সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ অনুযায়ী পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে থাকে বিভিন্ন আসনের বন্দোবস্ত। হিন্দুরা চাদর ঢাকা শতরঞ্জির উপর একধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মনের স্থান আলাদা এবং চাদর ছাড়া শতরঞ্জির উপর মুসলমান প্রজারা অন্যধারে। সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদমর্যাদা মতো বসেন পৃথক আসনে। আর বাবুমশায়ের জন্য ভেলভেটে মোড়া সিংহাসন।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ প্রথা ভেঙ্গে দিলেন। প্রভাববিস্তারকারী সকলের প্রবল আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, ‘হিন্দু মুসলমান, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল, সবাইকে একই ভাবে একই আসনে বসতে হবে। সবার একাসন করতে হবে। জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে বললেন – ‘তোমরা পৃথক আসন সব সরিয়ে দাও। একসাথে বস। আমিও বসব। আমি তোমাদেরই লোক’।
হ্যাঁ! রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক। বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, পূর্ব বঙ্গের রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ।
কবিকে কখনোই ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। কবির ভালোবাসা সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে পূর্ববঙ্গের যে সম্পর্ক তাঁর তাৎপর্য আলাদা । পূর্ব বঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে যেমন দিয়েছে দুই হাত ভরে, তেমনই রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে নির্যাস তুলে নিয়ে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। যে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে ‘রাইটার্স ব্লক’-এর কবলে পড়ে নতুন কিছু লেখার না পেয়ে বসে বসে ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথই কিন্তু শিলাইদহে বসে রচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের অনেক রত্ন। এখানেই পূর্ব বাংলার প্রকৃতির তাৎপর্য। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ঘুরে এমনকি ভারতবর্ষের কোথাও এমন উদাস করা পৃথিবীর সন্ধান পাননি, যা পেয়েছিলেন এই বাংলার বরেন্দ্রভূমিতে।
রবীন্দ্রনাথের পূর্ব বঙ্গে আসার কারন ছিল মূলত জমিদারী দেখাশোনা করা। পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, শাহাজাদপুর আর পতিসর। তিনটি স্থানেই ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি৷ নীলকর সাহেব শেলীর নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠিত শিলাইদহ কাছারি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৈত্রিক জমিদারি দেখাশোনার কাজে প্রথম আসেন ১৮৯১ সালে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে। নওগাঁয় নাগর নদীর তীরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কালিগ্রাম পরগনায় ১৮৯১ সালে প্রথম এলেও সিরাজগঞ্জে করতোয়া নদীর সংযোগ খালের পাড়ে দাদা প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুরের ১৩ টাকা ১০ আনায় কেনা শাহাজাহাদপুর কাছারি বাড়িতে যান ১৮৯০ সালে। পতিসরে রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মত যান ১৯৩৭ সালে। প্রজারা সদর কাছারিতে একত্রিত হয়ে “মহামান্য দেশবরেণ্য দেবতুল্য জমিদার শ্রীযুক্ত কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়ের পরগণায় শুভাগমন” উপলক্ষে সংবর্ধনা দেন।
জমিদারির জন্য পূর্ব বঙ্গে এলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য কর্ম আর জমিদারী সমানতালে চলিয়ে যান। সাধারন মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি বহুবিদ কর্মসূচী হাতে নেন। তিনি ছিলেন প্রজাদের প্রকৃত বন্ধু ও অভিভাবক। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন। খাজনা আদায় মানেই যে জমিদারী নয়, সেটা তিনি প্রমাণ করলেন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের পত্তন তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়। তিনি মহাজনদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কাছারিতে সালিশি ব্যাবস্থার মাধ্যমে তিনি সাধারন জনগন কে মামলার ঝামেলা থেকে মুক্ত করেন। এছাড়া পল্লী উন্নয়নে তাঁর বহুবিদ কর্মসূচীর মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের মানুষদের কাছে তিনি প্রজা প্রিয় জমিদার হয়ে উঠেন।
শুধু জমিদারী দেখাশোনাই না, তিনি সমান তালে চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর সাহিত্য কর্ম। শস্য শ্যামলা বাংলার আকাশ, সুজলা সুফলা মাঠ, বহতা নদীর স্রোতধারা কবিকে মুগ্ধ করেছিল । তিনি তাঁর অনেক বিখ্যাত লেখাই লিখেছেন এই পূর্ব বঙ্গে বসে। শিলাইদহ বসেই কবি লিখেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, ক্ষণিকার অসংখ্য কবিতা। লিখেছেন অর্ধশতাধিক ছোটগল্প আর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীকে অনন্য পত্রগুচ্ছ।
মোদ্দা কথা পূর্ব বঙ্গের সাথে কবির সম্পর্ক অবিনাশী। পদ্মা বক্ষে নৌকায় ভেসে ভেসে কবি অবগাহন করেছেন পূর্ববঙ্গের অপার সৌন্দর্য । শ্বেত শুভ্র কাশ বন, অবারিত নীল আকাশ, সবুজ সোনালী ফসলের মাঠেই কবি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর বিশাল কর্ম যজ্যের অনুপ্রেরণা। কবি আর পূর্ব বঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে এক আত্মিক মেলবন্ধন। যা আজো কবির গল্পে, কাব্যে, ছন্দে বিদ্যমান।
সারাবাংলা/এসবিডিই