‘পূর্ববাঙলা’য় রবীন্দ্র সত্তা
৮ মে ২০১৮ ১৫:১২
মেহেদী উল্লাহ ।।
পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই ধরনের। এক- লেখালেখির মাধ্যমে তিনি পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার নানা প্রান্তকে এক সুতোয় গেঁথে ভারতবর্ষ এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থিত করেছেন। পূর্ববাংলার দৃষ্টিকোণ থেকে তার এই প্রচেষ্টাকে আমরা বলছি ‘কাগজে-কলমে’ পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ।
দুই- লেখালেখির বাইরে সমাজ সংস্কার, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ক নানা চিন্তায়ও শরিক আছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ভাষণগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হতে পারে। সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে তিনি যতটুকু দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রত্যক্ষ সংস্কারে। বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালির জন্য সেই সুখবরগুলো ভাষণ ঘেঁটে চিহ্নিত করেছি। বাঙালির সংস্কৃতিতে ব্যবহারিকভাবে পড়া রবীন্দ্রনাথের এই প্রভাবকে বলবো ‘হাতে-কলমে’ পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ।
‘কাগজে-কলমে’ পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ
‘কাগজে-কলমে’ ভাবনায় থাকছে লেখালেখির মধ্য দিয়ে দেড়শ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতটা আমাদের? এবং আমরাই বা সেই অধিকারকে কতটা এবং কিভাবে কাজে লাগাাচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পে পদ্মাপাড়ের মানুষের কথা বলেছেন, বাঙালি নর-নারীর হ্রদয়ের কি কুটিরের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গান তার অপরিসীম দান। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের সব ভুলতে পারে, প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে হেলায় তুলে রাখতে পারে; কিন্তু তার গান গাইতেই হবে বাঙালিকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন একথা এবং বর্তমান নতুন প্রজন্মের একটা শ্রেণি গোপনে হাত মিলিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে-সুরের সঙ্গে। এটাই বা কম কীসে! আমাদের লোকউৎসব (যেমন পয়লা বৈশাখ) তার গান ছাড়া জমে না। প্রবন্ধে ভিন্নমাত্রায় যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাচ্ছি, যে সাহস উদ্দীপনা প্রত্যক্ষভাবে পাঠককে তিনি দেন সে প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরোয়নি।
বিশেষত, প্রমথ চৌধুরী তার ‘বর্তমান বঙ্গসাহিত্য’ এ সাহিত্যের যে ‘আবিষ্কার’ ও ‘নির্মাণ’র প্রসঙ্গ নির্দেশ করেছেন সেই আবিস্কারের জন্য তো অবশ্যই, নির্মাণের জন্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এখনো বিরাট ঋণ।
তবে এসব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ভুরিভুরি আলোচনা হয়েছে। লেখালেখিতে রবীন্দ্রনাথ কতটা আমাদের তারও বহু সমালোচনা বেরিয়েছে। সেসব নিয়ে নতুন করে বলার ভান করে এ আলোচনাকে ‘চর্বিতচর্বণ’ করার মানে হয় না।
‘কাগজে-কলমে’র পঠনকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্য কিছু সহজ, স্বাভাবিক এবং সত্য বিষয়কে হাজির করছি এবং তা এখনো ‘পূর্ববাঙলা’র।
১. রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপন চৈতন্যের সচেতনতার ভিত্তিতেই। যেমন করে তিনি আইনজীবী বা জমিদার না হয়ে সাহিত্য রচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বর্তমান বাংলাভাষার ভেতরে যদি প্রাণ থাকে এবং সে প্রাণের স্পর্শ আমরা পাই তবে তা অনেকাংশে রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্ট।
২. ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘বিরাট’! এসব আমরা পরিবারে কিংবা সমাজেই প্রথম শুনি, এবং রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করবার আগেই তার প্রতি আমাদের এক ধরনের বিশ্বস্ততা ও শ্রদ্ধাবোধ জন্মায়। ফলে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটি আমাদের মনোজগতে বাল্যকালেই যে আধিপত্য বিস্তার করে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বা জীবনের যে কোনো পর্যায়ে রবীন্দ্র-সাহিত্য পড়তে গিয়ে তার প্রভাব থেকেই যায়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমাদের ইতিবাচক চৈতন্যই তিনি দখল করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
৩. বর্তমান সময়ে সাহিত্যে ‘নতুন’ কিছু করার বা নিরীক্ষা চালানোর যে মূলমন্ত্র তা হচ্ছে রবীন্দ্রবলয় ভাঙ্গা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যেভাবে গল্প লিখেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক বা শহীদুল জহির লেখেননি এর মানে রবীন্দ্রনাথের স্বাপেক্ষে তারা নতুন। ৩০’ এর দশকে বাংলা সাহিত্যে যখন বুদ্ধদেব বসুদের আগমন ঘটলো, তখন বলা হচ্ছিল রবীন্দ্রবলয় ভাঙার কাল। এভাবেই ‘বর্তমান’ চিন্তাকে প্রভাবিত করছেন রবীন্দ্রনাথ।
৪. হুমায়ুন আজাদ তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে রবীন্দ্রনাথকে রাখেন নি। এর অর্থ তার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নন। এভাবে আধুনিক কবিতার একটি বোঝাপড়া দাঁড়িয়েছে বিপরীত রবীন্দ্রচিন্তার মধ্য দিয়ে।
৫. রবীন্দ্রনাথের লেখা-পত্র থেকে নানা বিষয় খুঁজে বের করে নিত্য নতুন গবেষণা হচ্ছে। এমন একটা প্রবণতা দাঁড়িয়েছে রবীন্দ্রনাথের কোট ব্যতীত গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফলে, যার যেমন প্রয়োজন তিনি রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে নিচ্ছেন। এতে চিন্তা সমৃদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ রবীন্দ্র ভিত্তির উপর দাঁড়াচ্ছে আমাদের চিন্তা-চেতনা। আর রবীন্দ্রনাথের বিকেন্দ্রীকরণও কেবল স্বাধীনতা পাবে।
৬. রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্য কর্ম ও জীবনকে আমরা বয়স অনুযায়ী গড়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। যেমন, ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ’, এটি রবীন্দ্রনাথকে ছোটদের কাছে উপস্থাপনের কৌশল মাত্র। এতে অযৌন বিভায় আলোকিত রবীন্দ্রনাথ। আবার রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংকলন কিশোরদের জন্য আলাদা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।
৭. রবীন্দ্রনাথ নিজের সাহিত্য কর্মকে ছাড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ ‘গীতাঞ্জলি’, ‘চোখের বালি’ ‘ডাকঘর’ এর নাম না জানলেও অনেক প্রান্তিক মানুষ শুধু রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে পরিচিত।
৮. অল্পশিক্ষিত বাঙালী মুসলমানের মনে অযথাই কে যেন এই কথাটি পৌঁছে দিয়েছেন ‘রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর কবি’ এবং ‘নজরুল বড় না রবীন্দ্রনাথ’ অথবা ‘নজরুলকে নোবেল না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়েছে’। ভিত্তি না থাকলেও বর্তমানে এধরনের মানসিকতা পোষণকারী মুসলমানের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
৯. বাঙালি শিক্ষিত সমাজে, এমন একটা প্রবণতা দাঁড়িয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন কিছু লিখতেই হবে। তাই এই সময়ে আলোচনার কোনো বিষয় না থাকলেও জোর জবরদস্তি করে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের শরীর থেকে ‘বিষয়’ অলংকার খুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে নির্মাণের পরিবর্তে আবিষ্কারের দিকে ঝুকছি আমরা। অথচ সাহিত্যে নির্মাণই শ্রেয়।
১০. একটি বিষয় বেশ খেয়াল করবার মতো, বর্তমান সময়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের যুগের সঙ্গে মিলিয়ে ‘পাঠ’ করছে নতুন প্রজন্ম। তারা রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি না পড়ে বরং সেটির অবলম্বনে যে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে তা দেখতেই বেশি আগ্রহী। একই রকম ঘটছে বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে। যেমন, ‘শাস্তি’ গল্পটি নিয়ে ফিল্ম এবং ‘হৈমন্তি’ গল্পটি নিয়ে নাটক তৈরি হয়েছে। ফলে পড়ার চেয়ে ফিল্ম ও নাটক দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করছে নতুন প্রজন্ম।
‘কাগজে-কলমে’ পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এবার একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
প্রসঙ্গত আগেই বলে নিই, আমাদের সাহিত্য দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এই শতকের ‘শূন্যের দশক’র যে কবিতা, তার সঙ্গে একেবারেই পরিচয় নেই আমজনতার। প্রশ্ন উঠতে পারে কবিতা কি আমজনতার বিষয়? এখানেই আরেকবারের জন্য ‘আমাদের’ হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ পরবর্তী কাব্যধারা এক নতুন যুগের সূচনা করল। তৈরি হল নতুন কবির পাঠক সমাজ। সংখ্যায় অল্প হলেও তারাই সেদিন রবীন্দ্রকবিতার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা নিয়েছিল। ‘মানসী’, ‘সোনারতরী’, ‘চিত্রা’,‘কল্পনা’, ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থগুলো পাঠক মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে- সেই সঙ্গে রবীন্দ্রকবিতার একটি সংকলন ‘চয়নিকা’ পাঠক মহলে সমাদৃত হওয়ার কারণে পঞ্চমবারেও বইটি ১ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল।
ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ (১৯২৩)। রবীন্দ্র সাহিত্য প্রকাশনার ভার তখন থেকে তাদের। এরই মধ্যে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ের পুরস্কার’ শিরোনামে একটা সংবাদ বেরুল। এর বিষয় রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থাবলী হতে দুই’শ শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচন করে দিলে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় পাঁচটি পুরস্কার দেবেন। যারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েন বা সব কবিতাই পড়েছেন তাদের উপরই নির্বাচনের ভার পড়ল। কোন কোন কবিতা ভালো লাগে তা পাঠককে জানাতে হবে। পুরস্কারের পাশাপাশি বিজয়ীরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ লাভ করতে পারবেন।
এই সংবাদ ও বিজ্ঞাপনে আশাতীত সাড়া মিলল। পাঠকদের নির্বাচিত কবিতা নিয়ে বেরুল ‘চয়নিকা’র নতুন সংস্করণ। এবং বইটির বিক্রি দেড়গুণ বেড়ে গেল। জনপ্রিয়তা অনুযায়ী সংকলনের পাশাপাশি কবির প্রত্যেক কবিতার পাশে প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা উল্লেখ করা হল। উল্লেখ্য, সেদিন পাঠকের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৩০০ ভোট পেয়েছিল ‘সোনার তরী’ কবিতাটি। ২৯৭ ভোট পেয়েছে ‘চিত্রা’র ‘উর্বশী’। আর কাহিনী প্রধান কবিতা ‘পুরাতন ভৃত্য’ ও ‘দুই’ বিঘা জমি’ যথাক্রমে ২৭৬ ও ২৭৩ ভোট পেয়েছিল। (সন্দ্বীপ দত্ত ১৪১৭ : ২৩) দেখুন, পাঠকের শক্তি কতখানি! পাঠকমত সত্য। সেই কত বছর আগের সাধারণ পাঠকের নির্বাচিত কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে আজো কত জনপ্রিয়! সোনারতরী নিয়ে কত উপায়ে শত ভাবনায় গবেষণা-সমালোচনা হচ্ছে। জনরুচির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংযোগ ঘটেছে বলেই তিনি আজো জনগণের বিশ্বকবি।
বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের নানাভাবে উপস্থিতি আরেকটি জনপ্রিয় ডিসকোর্সের অধিভুক্ত। পণ্যের প্রচারের জন্যই বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোম্পানি জনগণের কাছে পৌঁছাতে চায়। বিষয়টি এভাবে মাথায় গেঁথে নিলে সুবিধে হয়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ খুব ভালোভাবেই বিচিত্র প্রকাশে আমাদের (জনগণ) কাছে পৌঁছেছেন। তাই বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলো জনগণের কাছে পৌঁছাবার জন্য বেছে নিলেন রবীন্দ্রনাথকে। স্বভাবত, রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয়। লোকে তাকে মানেন এবং চেনেন। রবীন্দ্রনাথকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন ভাবনাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন সন্দীপ দত্ত। (ক) রবীন্দ্রগ্রন্থ বা রেকর্ডের বিজ্ঞাপন (খ) পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাপত্র বা হস্তাক্ষর ও আলোকচিত্র প্রতিকৃতি (স্কেচ) (গ) বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের বাণী (কবিতা) বা মুখাকৃতি ব্যবহার।
রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রিক সবচেয়ে প্রাচীন বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল সঞ্জীবনী পত্রিকার ১২৯২ বঙ্গাব্দ ১৪ অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। ‘ডেয়ার্কিন এ্যান্ড সন্স’ কোম্পানীর বিজ্ঞাপনটি। মূলত স্বদেশী আন্দোলনের যুগে স্বদেশী পণ্য বস্তুর প্রচারে রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপনী ভাবনার এই চিন্তা বিশ্বের কোনো লেখককে কেন্দ্র করে হয়নি। জীবিতকালে তিনি যেমন বিজ্ঞাপনী মডেল হিসেবে আদৃত হয়েছিলেন, আজও তেমনি সমানভাবেই।
‘কাগজে-কলমে’ আমাদের রবীন্দ্রনাথের আরেক অবস্থা, রবীন্দ্রমূর্তি বিনির্মাণ। সম্রাট মুখোপাধ্যায় ‘বটঠাকুর: বটতলার পুনর্নির্মাণ’ প্রবন্ধে বলছেন, ‘কখনও তা টুকরো কাহিনীর পরিসরে, কখনও তা গীতিবিতানের অখণ্ডতার ধ্বংসে, কখনও তা রবীন্দ্রজীবনকে ঘিরে তৈরি করা নানা তথ্যসন্নিবেশের ক্রমকে ওলট-পালট করে দিয়ে; আবার কখনও বা এসবের বাইরে এসে রবীন্দ্রকাহিনির প্রচ্ছদে সমকালীন কোনো মডেলের মুখ বসিয়ে, তাকে শরীরি নাগালে এনে ফেলে (বিনির্মান চলছে)। এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ধ্বংস হয় রবীন্দ্রনাথকে বেদীতে বসিয়ে নির্মাণ করা আমাদের গত একশো বছরের ঔপনিবেশিক আর উত্তর ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বোঝাপড়াটি, সমঝোতাটি। যে দুটি পর্বেই অপ্রতিহত ‘গ্র্যান্ড-ন্যারেশান’ এর অখন্ড আখ্যান রীতির প্রতাপটি। অপ্রতিহত সাহিত্যক্ষেত্রেও এক ‘ম্যাসকুলিন-দেবত্ব’ নির্মাণের বৃত্তান্তটিও। যে দুয়ের দাপটে প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রত্ব আজও, এই সন-তারিখের হিসাবে উত্তর ঔপনিবেশিক কালেও, সাহিত্যে আমাদের, সবচাইতে প্রভাবশালী ফোর্স।’
কলকাতায় ও ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের এই বিনির্মানের প্রবনতা সমানভাবে সাম্প্রতিক কালে বেড়েই চলেছে। কয়েকটি বইয়ের নাম শুনলেই এর বিষয়সম্পর্কে ধারণা জন্মে ‘রবীন্দ্র-রসিকতা’, ‘ক্যুইজে রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্য’, ‘সুনির্বাচিত ৩৬০টি রবীন্দ্রসংগীত’ প্রভৃতি।
রঙ্গরসিকতা ধাঁচের বইগুলো চুটকির আকরে সাজানো এবং তা অনেকটা গোপাল ভাঁড় পর্যায়ের। এর ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়ে একটা শ্রেণী রবীন্দ্রনাথকে আসলে কিভাবে মূল্যায়ন করছে, কোন রুচির সঙ্গে মেলাচ্ছে তারই পরিচয় ফুটে ওঠে।
আবার ‘ক্যুইজে রবীন্দ্র জীবনী’ বা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি বইতে স্থান পাওয়া রবীন্দ্র বিষয়ক ‘এমসিকিউ’ পদ্ধতির প্রশ্ন রবীন্দ্রজীবনীর ধারাবাহিকতা বা অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত পরিসর থেকে সরে তথ্যাকারে নতুন প্রজন্মের মনে নয় কেবল মগজে জায়গা করে নিচ্ছেন। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ‘কমন’ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে যেটুকু প্রয়োজন জীবনী থেকে নিয়ে ‘কুইজ-জীবনী’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। ফলে ‘কুইজ’ বা ‘এমসিকিউ’কে উপলক্ষ করে এরকম বইগুলো হয়ে উঠেছে এক বিনির্মিত ‘অবজেকটিভ’ রবীন্দ্র জীবনী। এছাড়া শিল্প প্রকরণহীন প্রচ্ছদ, ভুল বানানও নিজেদের পছন্দমতো সংকলনে প্রকাশিত বইগুলো ‘বটতলা’র বইয়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তাহলে এটা কি আমাদের রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের ‘বটতলা’র প্রতিশোধ? এছাড়া এক শ্রেণীর অসাধু প্রকাশক সম্পাদনা বাদেই নিজের বাণিজ্য ভাবনায় ইচ্ছেমতো দু’তিনটি গল্পের সমন্বয়ে বই করছে, এতে বিকৃতি ঘটছে ‘গল্পগুচ্ছে’র।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকটি সাধারণ পাঠকের কাছে যতটুকু বিবেচ্য তার চেয়ে বেশি পরিমানে স্বীকৃত ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন। এখনো বিভিন্ন নাট্য সম্প্রদায় ‘রক্তকরবী’র সফল মঞ্চায়ন করে চলেছে। আর শুধুমাত্র এর নায়িকা ‘নন্দিনী’র ভূমিকায় অভিনয় করেই রীতিমতো মঞ্চের তারকা বনে গেছেন এমন অভিনেত্রীর সংখ্যা ঢাকার নাটকের জগতে দশ-বারো জন হবেন। আধুনিক ধনতন্ত্রের সমস্যাকে দর্শক প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে মঞ্চে এ নাটকের গুরুত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন। এখনও আছে, এবং প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি ফুরাবে না।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি জন্ম কিংবা মৃত্যু বার্ষিকীতে পোশাক আনে ঢাকাই ফ্যাশন হাউসগুলো। এবারও তার সার্ধজন্মশত বর্ষ উপলক্ষে পোশাক এনেছে ফ্যাশন হাউজ রঙ। রঙ এ পোশাকের ডিজাইন করেছে রবীন্দ্র ও রাবীন্দ্রিক চিন্তা থেকে। এখন দরকারি বিষয়টি হচ্ছে, কী তাদের রবীন্দ্র ও রাবীন্দ্রিক ‘চিন্তা’। মূলত, ফ্যাশন হাউজ রঙ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতার পংক্তি, ঠাকুর বাড়ির পোশাকের ধরণ মাত্রকে বুঝেছেন ‘রবীন্দ্র চিন্তা’ হিসেবে। ফলে যারা পোশাক পরছেন তারাও এর ‘চিন্তা’ কাঠামো দ্বারাই প্রভাবিত বলা চলে, নিয়ন্ত্রিতও। কারণ, এই পহেলা বৈশাখেই বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে রাবীন্দ্রিক পোশাকটি পরছেন তারা, এ নিশ্চিত।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ এখন সুশীল সমাজের ক্ষমতা কাঠামো নির্মাণের সেবায়ও নিয়োজিত। নাম উল্লেখ না করেই বলা যায়, বর্তমান সময়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন অনেকের পৈতা ‘রবীন্দ্রগবেষক’। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বের ভেতর দিয়েই ওই মানুষদের অস্তিত্বের নির্মাণ। এসব রবীন্দ্রগবেষক ওই পৈতাখানার জোরে বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন। আমরাও অধিকার দিচ্ছি। আবার, আরেক শ্রেণীর গবেষক ও সমালোচক আছেন তারা ঠিক এর উল্টোটি করে ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছেন। নানা তত্ত্বের জোরে ও কৌশলে তারা রবীন্দ্রনাথকে চোখ রাঙিয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছেন।
এখনো দেখছি, দৈনিক পত্রিকার সমায়িকীগুলো রবীন্দ্র জন্ম-মৃত্যু দিবসে রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রিক নতুন কিছু করে তাক লাগিয়ে পাঠক ধরার নিরন্তর চেষ্টায় রত।
প্রতিযোগিতা চলছে কার আগে কে কতটা দিতে পারল। এতে পত্রিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদক মহাশয়েরও একটা আসন তৈরি হয় সাহিত্যসমাজে- সাহিত্যিক মহলে। এসবের ভেতর দিয়েই ‘কাগজে- কলমে’র রবীন্দ্রনাথ চর্চা।
‘হাতে-কলমে’ পূর্ববাঙলার রবীন্দ্রনাথ
‘হাতে-কলমে’ বলতে স্পষ্টভাবেই আমি ব্যবহারিক এবং লেখালেখির বাইরের জগতকে বোঝাচ্ছি। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজসংস্কার ও পল্লী উন্নয়নে সরাসরি পূর্ববাঙলার কৃষক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছেন সেই ভাবনা এতে প্রকাশ করবো। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী চিহ্নিত করবো। লেখালেখির বাইরে থেকে ব্যবহারিকভাবে ‘হাতে- কলমে’ রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে এখনো কতটা বৈধ, কতটা প্রাসঙ্গিক তার বিচার হবে এই পর্বে।
পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর (ফেব্রুয়ারি ১৯০৮) সভাপতির অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ পল্লী কৃষির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় কৃষির নানা প্রকার মিতশ্রমিক যন্ত্র বাহির হইয়াছে। নিতান্ত দারিদ্র্যবশত সে সমস্ত আমাদের কোনো কাজেই লাগিতেছে না। অল্প জমি ও শক্তি লইয়া সে সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব নহে। যদি এক একটি মণ্ডলী অথবা এক একটি গ্রামের সকলে সমবেত হইয়া নিজেদের সমস্ত জমি একত্র মিলাইয়া দিয়া কৃষিকার্যে প্রবৃত্ত হয় তবে আধুনিক যন্ত্রাদির সাহায্যে অনেক খরচ বাঁচিয়া ও কাজের সুবিধা হইয়া তাহারা লাভবান হইতে পারে। (বিশ্বভারতী গ্রন্থমালা: রবীন্দ্র শতবর্ষপূর্তি গ্রন্থমালা-রবীন্দ্র সাহিত্য)। রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তা ফলপ্রসু হয়েছে। গ্রামের জমিতে সমন্বিত সেচ প্রকল্প তার নমুনা।
মানসিক দিক থেকে বাঙালি কৃষক ঢাকায় চলে, কলে যোগ দিয়ে শ্রমিক হতে না পারলেও পেশায় তারা হচ্ছেন। এতে কমে যাচ্ছে দেশের কৃষি উন্নয়ন ও উৎপাদন। রবীন্দ্রনাথ এই প্রবণতাকে বলছেন, ‘কলের দ্বারা কেবল জিনিসপত্রের উপচয় করিতে গিয়া মানুষের অপচয় করিয়া বসিলে সমাজের অধিক দিন তাহা সহিবে না।’
ভারতবর্ষের ঐক্যের কথা বললেও, এই ঐক্য যে হুমকিতে ছিল তাও রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন সেই সময়ই। একই ভাষণে তিনি বলছেন ‘পৃথিবীতে সকলেই আজ ঐক্যবদ্ধ হইতেছে, আমরাই কেবল সকল দিকে বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িতেছি- আমরা টিকিতে পারিব কেমন করিয়া?’ ঠিকই টিকলো না ‘ভারতবর্ষের ঐক্য’।
পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা কতটা সুগভীর ছিল, পরিষ্কার বোঝাপড়া ছিল তা নিচের উদ্বৃতিটি দেখলেই ধারণা করা সম্ভব। খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অনেকখানি শোনাচ্ছি, ‘তোমরা যে পারো এবং যেখানে আরো এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো, গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো। এ কর্মে খ্যাতির আশা করিয়ো না। এমনকি, গ্রামবাসীদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে বাধা ও অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। ইহাতে কোনো উত্তেজনা নাই, কোনো বিরোধ নাই, কোনো ঘোষণা নাই, কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃতে তপস্বা- মনের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র পণ, দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুখী তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত সমর্পণ করিব। (বিশ্বভারতী গ্রন্থমালা: রবীন্দ্র শতবর্ষপূর্তি গ্রন্থমালা-রবীন্দ্র সাহিত্য)
রবীন্দ্রনাথের এইসব কথাবার্তা আজকের এনজিওগুলোর গ্রাম উন্নয়ন কিংবা শোষণের ‘গাইডবুক’। রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন, বাঙালির চেতনা জাতীয় কলেবরের সর্বত্র গিয়ে না পৌছানোর কারনে, বাঙালির সব চেষ্টা এক জায়গায় পুষ্ট ও অন্য জায়গায় ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। জনসমাজের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের বিচ্ছেদকে জাতির ঐক্যবোধের ভাঙনের জন্য তিনি দায়ী করছেন।
হিতসাধন মণ্ডলীর প্রথম সভাধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি বলছেন, ‘আমাদের অন্তরের রাজাকে আমরা শ্রদ্ধা করি না বলেই তিনি রাজত্ব করতে পারছেন না। ফলে আমাদের আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে।’
বর্তমান নাগরিক জীবনের ফ্ল্যাট সংস্কৃতির প্রবণতাগুলো রবীন্দ্রনাথ তখনি ধরতে পেরেছিলেন। তাই মানব সম্পর্ক উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমরা পাশের লোককেও আত্মীয় বলে অনুভব করি না, পরিবার পরিজনের মধ্যেই প্রধানত আমাদের আনন্দ ও সহযোগিতা, সেই পরিধির বাইরে আমাদের চেতনা অস্পষ্ট। এজন্যই আমাদের দেশে দুঃখ, মৃত্যু, অজ্ঞান, দারিদ্র্য।’
রবীন্দ্রনাথ অন্তত পরিবারে যে সম্পর্কের চর্চা দেখতে পেয়েছিলেন, আজ তো তাও নেই, নাগরিক সম্পর্কগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।
হিতসাধন মণ্ডলীর সভায় রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আমদানীতে তত্ত্বের ক্ষতির দিক নিয়ে বলে রেখেছেন। তিনি বলছেন, ‘যৌবনের আরম্ভে যখন বিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা অল্প অথচ আমাদের শক্তি উদ্যত, তখন আমরা নানা বৃথা অনুকরণ করি, নানা বাড়াবাড়িতে প্রবৃত্ত হই। তখন আমরা পথও চিনিনে, ক্ষেত্রও চিনিনে, অথচ ছুটে চলবার তেজ সামলাতে পারিনে।’
আবার একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করে তিনি মত প্রকাশ করেছেন,‘আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিষয় শিক্ষা। আমরা নোট নিয়েছি, মুখস্ত করেছি, পাস করেছি, বসন্তের দক্ষিণ হাওয়ার মতো আমাদের শিক্ষা মনুষ্যত্বের কুঞ্জে কুঞ্জে নতুন পাতা ধরিয়া ফুল ফুটিয়ে তুলছে না। অর্থাৎ এ শিক্ষায় আত্মপ্রকাশের আনন্দময় উপায় উপকরণ নেই।’
আবার রবীন্দ্রনাথ নিজের আত্মসমালোচনায় বলছেন, ‘তিনি তো গ্রামের নয়, শহরের পোষ্যপুত্র।’ কিন্তু এ কথা ঠিক কোনো উদ্দেশ্যের মধ্য দিয়ে জ্ঞানকে উত্তীর্ণ করে নিয়ে গেলে তবেই সে জ্ঞান যথার্থ অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। গ্রামে বেড়ে না উঠলেও রবীন্দ্রনাথের ওইরকম অভিজ্ঞতা ছিল।
আমাদের শহরে যাওয়ার প্রবণতাকে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘কৃতী শহরে যায় কাজ করতে, ধনী শহরে যায় ভোগ করতে, জ্ঞানী শহরে যায় জ্ঞানের চর্চা করতে, রোগী শহরে যায় চিকিৎসা করাতে, এটা ভালো কি মন্দ সে তর্ক করা মিথ্যা এতে ক্ষতিই হোক আর যাই হোক এ অনিবার্য।’
পল্লী ছেড়ে শুধু মাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক ভাবনারই যেন প্রতিফলন দেখাচ্ছেন তিনি। শ্রীনিকেতনের উৎসবের একটি বক্তৃতায় তিনি বাংলা ভাষার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, ‘আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষাবিধি বলে একটা পদার্থের আবির্ভাব হয়েছে। তারই নামে স্কুল কলেজ ব্যাঙের ছাতার মতো ইতস্তত মাথা তুলে উঠেছে। এমনভাবে এটা তৈরি যে, এর আলো কলেজি মণ্ডলের বাইরে অতি অল্পই পৌঁছায়। বিদেশী ভাষার স্থুল বেড়া তার চারদিকে। মাতৃভাষার যোগে শিক্ষাবিস্তার সমন্ধে যখন চিন্তা করি সে চিন্তার সাহস অতি অল্প।’ (বিশ্বভারতী গ্রন্থমালা: রবীন্দ্র শতবর্ষপূর্তি গ্রন্থমালা-রবীন্দ্র সাহিত্য)। আমাদের রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ আমরা রাখিনি।
শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসবের অভিভাষণের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আজ ইউরোপ থেকে রিপু বাহিনী ভেদ শক্তি এসে আমাদের দেশে মানুষকে শহরে ও গ্রামে বিচ্ছিন্নভাবে বিভক্ত করছে। আমাদের পল্লী মগ্ন হয়েছে চির দুঃখের অন্ধকারে।’
বস্তুত ঘটেছে তাই, পল্লীতে আজ অভাব কৃষিকারবারে সফলতা নেই। সবাই ছুটছে শহরে। আর পরিকল্পনাহীন ঢাকা শহর পরিতাপের ভারে ন্যুব্জ।
রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ করেই পল্লীর বেদনা বুঝে যাননি এবং পল্লীভাবনা মূলত জাগ্রত করেছে শিলাইদহ ও পতিসর। তিনি শ্রীনিকেতনের কর্মীদের সভায় স্বীকার করছেন, ‘শান্তিনিকেতনের কাজের মধ্যে আমার মনে আর একটি ধারা বইছিল। শিলাইদহ পতিসর এই সব পল্লীতে যখন বাস করতুম তখন আমি প্রথম পল্লী জীবন প্রত্যক্ষ করি। তখন আমার ব্যবসায় ছিল জমিদারি। প্রজারা আমার কাছে তাদের সুখ-দুঃখ নালিশ আবদার নিয়ে আসত। তার ভিতর থেকে পল্লীর ছবি আমি দেখেছি। এক দিকে বাইরের ছবি প্রান্তর, ধানক্ষেত, ছায়াতরুতলে তাদের কুটীর- আর একদিকে তাদের অন্তরের কথা। তাদের বেদনাও আমার কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পৌঁছত।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোটো গ্রাম।’
আর এই দুখানা গ্রামকেই তার ‘ভারতবর্ষ’ মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। এটিই বাঙালির ভাগ্য রবীন্দ্রনাথ বাঙলাকে দিয়েই ভারতবর্ষকে বুঝতে চেয়েছেন।
পল্লীর উন্নয়ন ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ‘অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া’ সোসাইটির হয়ে ম্যালেরিয়ার উপরও ভাষণ দিয়েছিলেন। রোগ নিবারণের পরামর্শ দিয়েছেন। মহামারীর হাত থেকে পল্লীবাসীকে রক্ষার্থে কাজ করেছেন।
মূলত রবীন্দ্রনাথের পল্লী ভাবনার উদ্দেশ্যে ছিল-
১. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য ও সদভাব সংবর্ধন।
২. বিবাদ-বিসংবাদ মীমাংসা।
৩. পল্লীতে চিকিৎসক ও ঔষধালয় স্থাপন করা।
৪. কৃষি খামার স্থাপন ও তাতে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান।
৫. গৃহিনীরাও যেন আপন আপন সংসারের আয় বৃদ্ধি করতে পারেন সেজন্য তাদের শিল্পকর্ম বানানোর প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সংগ্রহ করে দেওয়া।
৬. মাদকদ্রব্য ব্যবহার থেকে নিবৃত্ত করা।
৭. গ্রামে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের এই প্রকারের পল্লী চিন্তা অতীতেও কাজে লেগেছে আর বর্তমান সময়ে এই চিন্তার ভেতর দিয়েই এগোচ্ছে নির্বাচিত সরকারগুলো। ফলে রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়ন সমাজ সংস্কার ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে চিন্তা বাঙালিকে দিয়েছেন আজো সে অনুসারে গ্রামোন্নয়ন হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রাম রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী।
ভাষণগুলোর গুরুত্ব মূলত এইখানে, বিভিন্ন সময়ে এই ভাষণগুলো দেওয়ার পরই তা সাময়িক পত্রে প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করতে দিতেন রবীন্দ্রনাথ। এজন্যই শহরের শিক্ষিত মানুষ পড়বার আগেই রবীন্দ্রনাথ সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে তার চিন্তা পৌঁছে দিয়েছেন গ্রামের মানুষের কাছে। ফলে গ্রামের মানুষ সহজেই ‘হাতে-কলমে’ ব্যবহারিক এক রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছে। এইখানেই ‘হাতে-কলমে’ আমাদের রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা। একুশ শতকে দেড়শ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পল্লীর মানুষের কাছে এভাবেই গ্রাহ্য হচ্ছেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে হচ্ছেন। কারণ চিন্তাই প্রধান, আর সেই চিন্তা পল্লীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব সরকার বা এনজিওগুলো পালন করতে সচেষ্ট। গ্রামের মানুষ রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ না পড়লেও ক্ষতি নেই। তার চিন্তা তাদের সঙ্গে আছে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায় গ্রামে গ্রামে ভাষণ দিয়ে বেড়িয়েছেন। মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করেছেন। যা ব্যবহারিক এবং ‘হাতে-কলমে’, কাগজে-কলমে’র সম্পর্ক নয়।
রবীন্দ্রনাথ ‘দাতা’ হিসেবে উদার, দানে তার অতটুকু কৃপণতা নেই। সারাজীবন এতবেশি লিখেছেন, সব মানুষের ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যে, ভালোর বিপরীত যেমন মন্দ, কমের বিপরীত যেমন বেশি, আস্তিকের বিপরীত যেমন নাস্তিক উভয়পক্ষই চাইলেই তার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারছেন। একজন প্রগতিশীল যেমন তার কাছ থেকে নিজস্ব চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহন করছেন, তেমনি একজন রক্ষনশীলও দান পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের বড় সফলতা বা বড় দূর্বলতা তিনি কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।
সমগ্র সাহিত্যকর্মের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ একজন নন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা। প্রথমত, তিনি পৃথিবীকে দিয়েছেন; দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষকে দিয়েছেন; তৃতীয়ত, বাঙালীকে দিয়েছেন। এভাবেই তিনি সার্বজনীন। এক একটা বছর যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে রবীন্দ্রনাথের; আর প্রতিটি জন্মদিনেই নিজের সাহিত্যকর্মের জটিল দার্শনিক, সামাজিক, নৈতিক ও নীতিশাস্ত্রীয় সমস্যাদির ব্যাপারে নবদিগন্তের সূচনা স্মারক উপহার পাচ্ছেন তিনি। আমাদের রবীন্দ্রনাথকে আমরাই ভাঙছি-গড়ছি, প্রতিনিয়ত যুগের সঙ্গে মিলিয়ে নবায়ন করছি। কারণ, এই ভাঙা-গড়ায় নদী টিকে রয়লেখক টিকে রয়; এমনকি আমাদের এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কও।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
সারাবাংলা/ এসবি