বাংলা সাহিত্যের ‘মানিক’
১৯ মে ২০২৩ ১৭:১২
সমাজ ও মনোবাস্তবতার রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য সাধনায় তিনি ছিলেন সৎ পথের সন্ধানী। স্বপ্ন-বিলাসী মন তার ছিল না, বরং সবরকম শোষণ, উৎপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্বে মধ্যবিত্তের উপরিস্তরের আবরণকে তিনি উন্মোচন করেছেন অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে। শ্রেণিগত স্বরূপ উন্মোচনের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত জীবনের মেকি আবরণটি উদ্ঘাটন সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দর্শন গ্রহণের পর তিনি কল্পনার অসারতা অনুভব করেন। মধ্যবিত্তের ভাবালুতা অথবা শ্রমজীবী মানুষের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবনার অহংবোধ বিসর্জন এবং সেই সঙ্গে জাতীয় জীবনের মূলধারার সঙ্গে সংযোগ ছাড়া এ সমাজের যে মুক্তি অসম্ভব, তা তিনি বুঝেছিলেন। তার নিজের জীবনেও ছিল এই দর্শনের প্রতিফলন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে যে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকট মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে ক’জন লেখকের হাত ধরে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত তাদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি।
মানিক সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তারই একটি মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা একদমই অসম্ভব, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে।’ শুধু এই সময় না শতাব্দী ধরে কথাটি একধরনের অসহায়ত্ব আর দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঘুরছে আমাদের পরিচিত জগতে। বাংলা সাহিত্যের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ানো একজন সাহিত্যবোদ্ধাও এই কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ তিনি বাংলা সাহিত্যকে উচ্চাসনে নিয়ে গেলেও শেষ জীবনে কাটিয়েছেন দারুণ অর্থকষ্টে।
তাই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে উত্তর পর্বের সাহিত্যে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের রূপায়ণে এই শ্রেণির প্রতি মানিকের সহানুভূতি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নিজ মর্যাদাবোধ ও ভদ্রতাজনিত অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে অস্তিত্ববিনাশী মধ্যবিত্তের উপলব্ধিজাত অনুভূতিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ পর্বের সৃষ্টিকে ঔজ্জ্বল্য দান করেছে, যা ছিল লেখকের অভিজ্ঞতাজাত চেতনার ফসল। জীবনের নানামাত্রিক শোষণের উন্মোচন মানিক সাহিত্যে সর্বদাই উজ্জ্বল।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের আজকের দিনে (১৯ মে) বিহারের সাঁওতাল পরগনার বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। জন্মপত্রিকায় তার নাম রাখা হয়েছিল অর্ধচন্দ্র। তার পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাবরেজিস্ট্রার।
পিতার বদলি চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।
মানিকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। মানিকের গণিতের অনার্সের তখন আরও এক বছরের মতো বাকি। কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে প্রতি সন্ধ্যায় তুমুল আড্ডা হয় রাষ্ট্রনীতি, সমাজ, মার্ক্স, লেনিন, ফ্রয়েড নিয়ে। এরপরই আসে সাহিত্য। ফ্রয়েড আর মার্ক্স পছন্দ করা ছেলেটি সাহিত্য আসতেই চুপ হয়ে যায়।
একদিন তো কথায় কথায় বন্ধুদের তুমুল আড্ডায় ভেসে আসে ‘গণিতের ছাত্ররা আবার সাহিত্যের কী বুঝে রে’ ঠাট্টাচ্ছলে বলা কথাটা কানে ভেসে আসতেই ঝাঁঝালো গলায় ও পাশ থেকে জবাব আসে, ‘কেন সাহিত্য কি বাঘ ভাল্লুক নাকি?’
‘আচ্ছা বাপু তা লিখে দেখাও না দেখি?’ তাচ্ছিল্যভরা সুরে বলা কথাটি সেদিন মানিক যে কতটা আক্রোশে নিয়েছিলেন তা পরবর্তী সময়ের দিকে তাকালেই জলের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাহিত্যের মায়ায় মানুষটির আর গণিত নিয়ে পড়া হয়ে ওঠেনি। অসমাপ্ত ডিগ্রি নিয়ে ছেড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আর সেদিন থেকে বাঙলা সাহিত্যের কোলজুড়ে এসেছিল ‘মানিক বন্দ্যোপ্যাধায়’ নামক গল্প বলার এক ধ্রুপদী।
মানিক বন্দ্যোপ্যাধায় নিয়ে একটি ঘটনা না বললেই নয়, পরীক্ষায় বরাবর ভালো রেজাল্ট করা মানিক যখন রাজনীতি আর সাহিত্য নিয়ে মেতে উঠলেন সে সময় পরপর দুবার বিএসসিতে ফেল করলেন। তখন পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালাতেন তার বড়দা। ভাইয়ের রাজনীতি করার খবর পেয়ে চিঠিতে লিখলেন, ‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে, ফেল কেন করেছ, তার কৈফিয়ত দাও।’
উত্তরে তিনি লিখলেন, ‘গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দাদা বলেছিলেন, ‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন দাদা।
উত্তরে তিনি লিখেছিলেন, ‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’
নিজের লেখার প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এই মানুষটি তার কথা রেখেছিলেন। এখন তার রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে উচ্চারিত হয়। শিক্ষা জীবনের ডিগ্রি অর্জন করতে না পারা মানিক বন্দোপাধ্যায় কিছুদিন নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তী কালে বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে মানিক কয়েকমাস একটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখক জীবনের প্রথম পর্বে মধ্যবিত্তের রক্তক্ষয়ী জীবন-যন্ত্রণার স্তরকে ছাপিয়ে ভদ্রতার আবরণ উন্মোচনেই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে লেখক নিজেই বলেছেন- ‘ভদ্র জীবনের সীমা পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মাচ্ছিল নিচের স্তরের জীবনের সঙ্গে। উভয়স্তরের জীবনের অসাম্যঞ্জস্য, উভয়স্তরের জীবন সম্পর্কে নানা জিজ্ঞাসাকে স্পষ্ট ও জোরালো করে তুলতো। ভদ্র জীবনের অনেক বাস্তবতা কৃত্রিমতার আড়ালে ঢাকা থাকে, গরিব, অশিক্ষিত খাটুয়ে মানুষের সংস্পর্শে এসে এই বাস্তবতার উলঙ্গ রূপ দেখতে পেতাম, কৃত্রিমতার আবরণটা আমার কাছে ধরা পড়ে যেতো।… সেই সঙ্গে সাহিত্যে আবার জাগতো নতুন নতুন জিজ্ঞাসা। জীবনকে বুঝবার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম গল্প-উপন্যাস। গল্প-উপন্যাস পড়ে নাড়া খেতাম গভীরভাবে গল্প-উপন্যাসের জীবনকে বুঝবার জন্য ব্যাকুল হয়ে তলল্গাশ করতাম বাস্তব জীবন।’
শোষিত মানুষের অনুসন্ধান থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠা- এই ধারাবাহিকতাই আমরা মানিক সাহিত্যে লক্ষ্য করেছি। নিঃস্ব জীবন যাপন ও সাহিত্য রচনাকে তিনি একে অপরের পরিপূরক করে তুলেছিলেন। তার প্রথম ও শেষ জীবনের রচনাবলিতে জীবন-যন্ত্রণার উপলব্ধিজাত অনুভূতিই আমরা লক্ষ্য করেছি। মানব মনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যই হলো আত্মলড়াইয়ের মধ্যে ক্রমে বিশুদ্ধচারীর অভিযাত্রী হওয়া। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে মধ্যবিত্ত জীবন-চেতনার বিরুদ্ধে আত্মসংগ্রামের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। লেখনীর সাহায্যেই তিনি মধ্যবিত্তের আত্মপ্রতারণাকে আঘাত করেছেন নিমর্মভাবে। সমাজকে মধ্যবিত্তের জীবন চিনিয়ে দিয়ে তা থেকে মুক্তিদানে তিনি হয়ে ওঠেন একনিষ্ঠ। সমাজবাদী তত্ত্বজিজ্ঞাসাই তাকে আরও বেশি সতর্ক ও বিশ্লেষণ-উন্মুখ করে তুলেছিল। জীবনযুদ্ধের ক্ষত নতুন জীবন দর্শনের আলোকে তিনি এভাবেই অবলোকন করেছেন- ‘….প্রথম বয়সে লেখা আরম্ভ করি দুটি স্পষ্ট তাগিদে, একদিনে চেনা চাষি মাঝি, কুলি মজুরদের কাহিনী রচনা করার, অন্যদিকে নিজের অসংখ্য বিকারের মোহে মূর্ছাহত সমাজকে নিজের স্বরূপ চিনিয়ে দিয়ে সচেতন করার। মিথ্যার শূন্যকে মনেরাম করে উপভোগ করার নেশায় মরমর এই সমাজের করতালি গভীরভাবে মনকে নাড়া দিয়েছিল। ভেবেছিলাম, ক্ষতে ভরা নিজের মুখখানাকে অতি সুন্দর মনে করার ভ্রান্তিটা যদি নিষ্ঠুরের মত মুখের সামনে আয়না ধরে ভেঙ্গে দিতে পারি, সমাজ চমকে উঠে মলমের ব্যবস্থা করবে।’
১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৪৪ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তার লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া মার্ক্সবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তার অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তরাধিকারী। তার প্রথম গল্পগুচ্ছ ‘অতসী মামী’ ও অন্যান্য সংকলনে সবকয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবনচিত্রও তার বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তার সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণ-বঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত তার লেখনীতে বিশাল বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় সাধারণ মানুষের কথা যেমন বস্তুনিষ্ঠ জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমনি মানুষের কর্মে পিপাসায় জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আদিমতার অন্ধকারে ফিরে গেছেন বার বার। অদ্ভুত নিরাসক্তভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধি ও লেখনীতে। নর-নারীর জৈবসত্তা বিকাশের নানাদিক তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার লেখায় জৈবসত্তা ও দৈহিক বর্ণনায় ছিলেন কিছুটা বেপরোয়া প্রকৃতির।
দৈহিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বলিষ্ঠতা রক্তের উষ্ণ-স্রোত উত্তাপ টের পাওয়া যায় তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনায়, পেশায়, কাজে-কর্মে। মানিকের সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশটা একটা চমক এবং চমক ‘অতসী মামী’ রচনার ইতিহাস, চমক ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘অহিংসা’ (১৯৪৮) ও ‘চতুষ্কোণ’ (১৯৪৩) প্রভৃতি। পাঠকের চেতনাকে নাড়া দিতে পেরেছেন বলেই এগুলো পাঠকের কাছে আদরণীয়।
‘অতসী মামী’ গল্পের মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা। পরবর্তীকালে তিনি ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ‘সরীসৃপ’ ‘হারাধনের নাতজামাই’ ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ ‘ফেরিওয়ালা’ ‘বৌ’ ‘সমুদ্রের স্বাদ’-এর মতো জীবন-সমৃদ্ধ শিল্পসার্থক গল্প লিখলেন। তার এই সফলতা ও সার্থকতার কারণ রয়েছে। তার অভিজ্ঞতার পসরা ছিল বিচিত্র ও বিস্তীর্ণ। মধ্যবিত্ত অভিযাত্রিক সচেতনতার মধ্যে জন্ম বর্জিত হলেও বিত্তের অসচ্ছলতার চাপ শিল্পীকে ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতেই হয়েছে প্রায় আগাগোড়া। এককথায় মানবিক বিশ্বাসের মূলে চিড় ধরেছিল। আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মানব সত্যের প্রাণ ও স্বপ্নপুরুষ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। ফলে তিনি জীবনের দিকটি দেখতেন তার সমগ্রতায়, খণ্ড খণ্ড করে নয়, অখণ্ডতায়। এটি তার প্রধান গুণ এবং লেখক মাত্রেই শ্রেষ্ঠ গুণ। তিনি যেমন ফ্রয়েডীয় মতবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি জীবনের, মনুষ্য জীবনের মুক্তি দেখেছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদই তাকে দীক্ষা দেয়। এই মতবাদেই তিনি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে বিশ্বাস পোষণ করেন, তাই তার সাহিত্য জীবনের পাথেয়।
মনে রাখতে হয়, ব্যক্তিগতভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতারই উত্তরাধিকারী। তার প্রথম গল্পগুচ্ছ ‘অতসী মামী ও অন্যান্য’ সংকলনে সবকয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের মুখে এসেছিলেন, তখন থেকেই বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবনে সার্বিক অবক্ষয়ের চেতনা চারপাশ হতে ঘিরে চেপে বসতে চাইছিল। বিশ্বজোড়া মধ্যবিত্ত বৈমানসিকতা বোধের তাড়নায় বাংলা সাহিত্য তখন পীড়িত। পাঠকের অভিজ্ঞতাতেও এ নিয়ে তারতম্য ছিল না। তবু তার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্ধকারের নিরবচ্ছিন্নতাকে উতরিয়ে উত্তরণের পথ খোঁজার। সে জন্যই তিনি চিরস্মরণীয় ও বরণীয়।
১৯৫৬ সালের এক সাক্ষাৎকারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ছোটগল্প রচনায় রোমাঞ্চ আছে। এতে গভীর মনঃসংযোগ করতে হয়। এত দ্রুত তালের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে হয় বলেই মন কখনও বিশ্রাম পায় না। ছোটগল্প লেখার সময়ে প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চ বোধ করি।’
১৯৫৪ সালে ‘কেন লিখি’ নামে একটি সংকলন বেরিয়েছিল ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের পক্ষে। সংকলনটির সম্পাদক ছিলেন হিরণকুমার সান্যাল ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাশিল্পীদের জবানবন্দি’-এই ঘোষণা থাকলেও সংকলনটিতে কথাশিল্পীদের সঙ্গে কবিরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওই সংকলনটিতে অন্যদের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একটি লেখা লিখেছিলেন। নিতান্তই ফরমাশি রচনা। কিন্তু বাস্তবিকই সেটি ছিল তার অসাধারণ রচনা। তার মধ্যে প্রতিভাসিত হয়েছে শিল্পীমাত্রেই, কিন্তু বিশেষভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। সে রচনার প্রথম চরণ ছিল, ‘লেখা ছাড়া অন্য কোনও উপায়েই যে সব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি।’
‘আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুটি জেনেছি।’- এই উক্তিটির মধ্যেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত শিল্পকর্মের যে সচেতন বুদ্ধির প্রকাশ পায় তাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘কেন লিখি’র তিন বছর পরে ১৯৪৭ সালে, শারদীয় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রতিভা’ নামে আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন। ওই প্রবন্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝাতে চেয়েছেন প্রতিভা কোনও ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত রহস্যময় জিনিস’ নয়। বুঝালেন, ‘প্রতিভা আসলে এক। বৈজ্ঞানিক আর কবির প্রতিভায় মৌলিক পার্থক্য কিছু নেই- পার্থক্য শুধু বিকাশ আর প্রকাশে।’ এখানে ‘কবি’ বলতে লেখক শিল্পী মাত্রকেই বুঝিয়েছেন মানিক। আর প্রতিভা জিনিসটা কী?- না, ‘দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা।’ এছাড়া আর কিছুই নয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন; কিন্তু আসলে তিনি কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। যা তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।
১৯২৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘দিবা-রাত্রির কাব্য’ প্রকাশিত হয়। তার লেখা বিষয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে ঔপন্যাসিক হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য কিছু নন, তিনি ঔপন্যাসিক।’ অপরদিকে সুকুমার সেন মনে করতেন, ‘ছোটগল্পগুলিতেই শিল্পী মানিকবাবুর শ্রেষ্ঠ পরিচয় নিহিত। কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক হিসাবে সফল নন, বরঞ্চ গল্পকার হিসাবে সফলতা অর্জন করেছেন।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০টি উপন্যাস এবং ৩০০টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত ৪৮ বছরের জীবনকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছিলেন সাহিত্যে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত মানিককে বলেছেন, ‘কল্লোলের কুলবধন।’
দিনেশরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘কল্লোল’ পত্রিকা চলছিল বছর সাতেক। রবীন্দ্রোত্তর তরুণ লেখকদের মুখ্যতম মাধ্যম ছিল এই পত্রিকা। ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি আরও অনেক পত্রিকা ছিল তরুণ সাহিত্যের বাহন। কিন্তু ‘কল্লোল’ এর নামেই আধুনিক উত্তর জৈবিক আধুনিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘কল্লোল’ সম্পর্কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন শ্রদ্ধাশীল।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবদ্দশায় ১৬টি গল্পগ্রন্থের পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল দুটি গল্পসমগ্র। গল্পগ্রনন্থ ছিল, অতসী মামী (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮), সরীসৃপ (১৯৩৯), বৌ (১৯৪০/দ্বিতীয় সং ১৯৪৬), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), ভেজাল (১৯৪৪), হলুদপোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬/দ্বিতীয় সং ১৯৫০), পরিস্থিতি (১৯৪৬), খতিয়ান (১৯৪৭), মাটির মাশুল (১৯৪৮), ছোট বড় (১৯৪৮), ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯), ফেরিওলা (১৯৫৩/দ্বি-সং ১৯৫৫), লাজুকতা (১৯৫৪)। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০) ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৫৬) এই দুটি ছিলো প্রকাশিত গল্পসমগ্র।
বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্রের সমগ্রজীবন কেটেছে ভীষণ কষ্টে। শেষ জীবনে ওষুধের পয়সা জোগাড় করতে পারেননি। মানিকের স্ত্রী প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। মেলেনি যথার্থ সাহায্য। ১৯৩৫ সাল থেকে মানিক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তীকালে জটিল অবস্থায় গমন করে। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন বাংলা কথাসাহিত্যের এই ধ্রুপদী।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এজেডএস