Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বস্ত্রবালিকার জোনাকি রাত

মাহবুব আলী
২৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:০১

বাস যখন মহাখালি এসে দাঁড়ায়, তখন সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। প্রায় চোদ্দো ঘণ্টার যাত্রা। আলিমা অপলক চোখে ঢাকা দেখে নিতে থাকে। এই প্রথম আসা। কত মানুষ! প্রচণ্ড ব্যস্ত মহানগর! বিশাল উঁচু উঁচু বিল্ডিং। প্রশস্ত কাঁচের জানালা। তার দৃষ্টিতে যাত্রাপথের ক্লান্তি ছাপিয়ে ঘোরলাগা বিস্ময় জেগে ওঠে। এখানে মানুষেরা কীভাবে থাকে? এত হইচই শব্দ-কোলাহল! সাবিনা সে-সময় ব্যাগ তুলে সামনে এগিয়ে গেছে। এবার ইশারায় তাকে নামতে বলে।
‘এ্যালা আলাদা বাসোত্ গাজীপুর।’
‘আলদা বাস? স্যাঠে যাইতে ফির কতক্ষণ?’
‘কতক্ষণ নহায়, ক ক-ঘণ্টা?’
‘রাত হয়া যাবি তাইলে।’
‘ঢাকাত রাইত হয় না ছইল। ঢাকা শহর দিনরাত জাগি থাকে।’
আলিমা চুপচাপ তার পেছন পেছন হেঁটে একপাশে দাঁড়ায়। দিনাজপুর শহরের রাস্তার দৈর্ঘ পাশাপাশি চারবার সাজিয়ে রাখলে তবেই রাজধানীর সড়কের এপার-ওপার। আলিমা বাড়ি থেকে বেরোবার আগে একদিন কী ভেবে দিনাজপুর গিয়েছিল। সারাদিন টইটই ঘোরাই সার। কোনো লাভ হয় না। আত্মীয়স্বজন বন্ধু, দু-একজন যাদের কাছে বলা যায়, তারা সব শুনে তেমন করে কথা বলে না। সাবিনাই শুধু দুঃখ করে। একসময় একসঙ্গে পড়াশুনা করেছে। রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু মনের টান; আত্মার যোগাযোগ। তার আফশোস কৃত্রিম মনে হয় না। আলিমার দৃষ্টি টলমল। মনের মধ্যে হাজারও ভাবনা-দুর্ভাবনা-উৎকণ্ঠার মিছিল। অবশেষে সাবিনার পরামর্শ। দিনাজপুর ছোট জায়গা। এখানে কাজ কোথায়? ঢাকা যেতে হবে। গাজীপুরে কতগুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। সে যেমন চাকরি করে, আলিমারও সেখানের কোনো একটিতে কাজ জুটে যাবে। তখন ভাই আর ভাবীর গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে না। আলিমার বুকে স্বস্তি আর প্রত্যাশার স্বপ্নদোলা। সেদিন শেষবিকেলে তার ওখানে দুপুরের ভাত খায়। চোখের জল গাল বেয়ে ঠোঁটের কোণে এসে পড়ে। তার ভাই। আপনজন! কত সম্মান আর আদরের বড়ভাই। এমন করেই কি নিজের মানুষেরা পর হয়ে যায়?

বিজ্ঞাপন

কাচিনিয়া বাজার পেরিয়ে সরু রাস্তা। তারা ভাইবোন হেঁটে যায়। কত বছর শেষ হয়ে এলো বাবা চলে গেছে। দিঘিরপাড় উত্তরে বাঁশবাগান জঙ্গলে ঘুমিয়ে থাকে। সেখানে সন্ধে হলে জোনাকির আলোয় সব ভেসে যায়। ঘরের টুকরো জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে ভোর। বাবা কেন চলে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একদিন বাবার মতো ভরসা হয়ে ওঠে বড়ভাই। তার হাত ধরে থাকে। আলিমা তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রি। নতুন ভূষিরবন্দর উচ্চ বিদ্যালয়। এই দেড়-দুই কিলো রাস্তা পরম নিশ্চিন্তে ভাইয়ের হাত ধরে থাকে সেও। টিফিন পিরিয়ডে একটি-দুটি করে জমানো কয়েন দিয়ে বাদাম-বুট কেনা হয়। কোনোদিন স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে ওঠে। ছাতিম গাছতলার রেস্তোরাঁ থেকে দুটো শিঙাড়া কেনে। ভাই খায়। সে খায়। আহা ভাইয়ের মুখ কত শুকনো লাগে! টাকা থাকলে আরও একটি কিনে দিতে পারত। সেই ভাই এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে একদিন চাকরি পেল। কত আনন্দে কেটে গেল এক-দেড় বছর। মাকে মিল চাতালের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হলো। আলিমার চোখে রামদিঘির শত শত পদ্মর মতো স্বপ্নসুখ ঝিরিঝিরি বাতাসে খেলা করে। তারা তিনজন রাতে খেতে বসে। অনেকদিন পর মুরগির মাংস গরম ভাতে বড় স্বাদু লাগে। ভাই বলে, –
‘মাও এ্যালা আলিমার বেহা লাগামো। তোর মত কী?’
‘বেহা তো দিবা হবি বাপ। মেয়া বড় হইছে।’
আলিমার চোখ-মুখ লাল। ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে। সেই আলোর সঙ্গে বাইরের জোনাকিরা লাজ লাজ ঝিলমিল করে। অনেক দূরে কেউ বাঁশি বাজায়। তার সুর বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে বুকে ধাক্কা মারে। আলিমা রাতে ঘুমোতে পারে না। আকাশের চাঁদও বড় বেশি বেহায়া হয়ে কথার প্রতিধ্বনি তুলতে থাকে।
‘তোর কোনো পছন্দ আছে নাকি রে আলিমা?’
‘মা…দেখেক তো ভাই কী কছে!’
‘তুই ওক শরম দিস না তো রফিজুল। ভাত খাবা দি।’
‘হা হা হা! সামনের আঘনে বেহা দিম তোর।’
‘আগোত ভাবী আনমো।’
আলিমা হাসতে হাসতে বললেও একদিন সত্যি সত্যি ভাবী এলো। মা জানল না, আলিমারও ধারণা নেই; অথচ কত সাধ ছিল ধুমধাম করার। ভাইয়ের বিয়েতে কোমরে ওড়না জড়িয়ে উঠোনে নাচবে। একটু আবীর ছড়িয়ে সখীদের সঙ্গে ছুটোছুটি করবার কি গোপন সাধ! সে অবাক হয়। মায়ের মুখে রা নেই। রফিজুল একটু জানাল না? কেমন ছেলে? তবু নতুন মানুষকে বরণ করতে হয়। ঘরের দুয়ারে একমুঠো চাল-দুর্বা রেখে স্বাগতম। ভাবী আলিমার থুতনি তুলে জিজ্ঞেস করে, –
‘তোমার নাম কী?’
‘আলিমা। এসএসসি দেব।’
‘ও আচ্ছা। বাব্বা তুমি কি সুন্দর!’
একই অফিসে ভাইয়ের সঙ্গে চাকরি করে রূদাবা। গোলগাল চেহারা। চোখে চশমা। মাথা ভরতি কোঁকড়ানো লালচে চুল। একদিন সেই চুলের গোড়ায় গোড়ায় জেগে উঠল বিষ। আলিমা কী করে? মায়ের সঙ্গে সহনশীলতার পরীক্ষা দেয়। একটি লন্ড্রি সাবান নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ। তারপর এক সন্ধেয় খাবারের খোটা। ভাতের অনেক দাম। আলিমার গলা দিয়ে আর নামতে চায় না। তারপরও খায়। তখন চোখের স্বপ্ন যে বুকের কষ্টের মতো মিলিয়ে গেছে। এক সকালে মাকে নিয়ে মিলচাতাল ঘুরে আসে। মা কাজ করতে পারে না। যে ভাতের জন্য এত কষ্ট সেই ভাতও কপাল থেকে উঠে গেছে প্রায়। বায়ুচড়া দিনরাত। শরীর চলে না। হাত-পায়ে টান। এতসব কষ্ট নিয়েও কখনো কলতলায় থালাবাসন মাজতে বসে। কাজ করে হালাল হয় দুটো ভাত। আলিমা চাতালের রোদে ধান শুকোয়। নিড়ানি দিয়ে ধান টানে। চালুনি দিয়ে কাঁকর বাছে। জীবনের ছোট ছোট ক্ষতগুলো কাঁকর-পাথরের মতো ভাবনার চালুনিতে জমা হতে থাকে। এই কি জীবন? এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? ওদিকে মিল মালিকের মেজছেলে যখন তখন কত ফরমায়েশ হাঁকে। কারণে-অকারণে মুখে-গালে হাত দিতে আসে। ইশারায় কী বলে সবই বোঝে আলিমা।
‘আলিমা, মোড়ের দোকান থেকে শাহজাদি জরদা দিয়ে দুটো পান নিয়ে আয়।’
‘জি ভাই।’
‘আর এক প্যাকেট সিগারেট।…আর শোন্, না বলে চাতাল ছেড়ে যাবি না বুঝলি?’
এদিকে সন্ধে রাত হয়। আলিমা বোঝে। অনেককিছুই সন্দেহ করে। তাই একদিন চোখের জল শুকোতে শুকোতে কাজ ছেড়ে দিতে হয়। ভাইয়ের সম্মানেও লাগে। সমাজ কী বলে? আলিমার বুকের ব্যথা আর কষ্টের কথা তো জিজ্ঞেস করে না কেউ। ততদিনে আত্রাই নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আশপাশের ক্ষেতে কতবার রসুন ফলিয়েছে মানুষজন। আলিমার কিছু হলো না। অবশেষে বেরিয়ে পড়তে হয়। পথে বেরোবার সময় যার কারণে পথে নেমে আসতে হলো, তাকে বলে আসে মাকে যেন একটু দেখে। রূদাবা ভাবী কি কথা রাখবে? হায় জীবন!

বিজ্ঞাপন

সারা রাস্তা মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাত খেতে পেরেছে? কোনোদিন ঢাকার পথে যাওয়া হয়নি, তার উপর একা; কীভাবে যাবে? একটু তো ভয় ভয় লাগে তার। কাঁচিনিয়ার চিকন পথে তখন ভ্যান চলতে শুরু করেছে। একটি ব্যাগ। তার মধ্যে টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। লাল রঙের এক নোটবুক। তার পাতায় পাতায় হাজারও ভাবনা কবিতার মতো লিখে রাখে আলিমা। এই তার গোপন সম্পদ। ভ্যানের অপর পাশে সাবিনা। শেষবিকেলের আলোয় চোখ-মুখ দুর্বোধ্য। আলিমার ফরসা গাল আর নাকের ডগায় হালকা স্বেদবিন্দু। শ্রাবণের শেষ দিনকালে মেঘে মেঘে ঢাকা সকালের গুমোট তাপ ঝিরিঝিরি বাতাসে হালকা হতে শুরু করে।
‘কাজ পাওয়া যাইবে তো সাবিনা?’
‘চল ক্যানে, তুই তো সেলাই শিখিছি। টেনিং আছে।’
‘হয় মহিলা সমিতি থাকি তিন মাস ট্রেনিং।’
‘আলিমা তুই কাপড় কাটিবা পারিস তো? নাইলে কোয়ালিটি সেকশনে কাজ করিবু।’
‘স্যাঠে ফির ক্যাংকা কাজ?’
‘সেইটা আরও সোজা। সেলাই করা কাপড় তুলি ধরি দেখিবু, মাপজোক-সেলাই-বোতাম-জিপার এ্যাইলা ঠিক আছে কি না।’
‘বেতন কত পাওয়া যাবা পারে?’
‘আট থাকি দশ হাজার, আরও বেশি হবা পারে।’
‘দশ হাজার হলে চলিবে। মুই আর মা-ও। দু-খান মানুষ।’
‘চাকরি পাকা হইলে মাওক নিয়া যাবু। বিয়া করিবু। নাদিম না কী কয়, ওঁয় বিয়া করিছে নাকি ফির?’
‘করে নাই কছি! একনা ছইলও হইচে।’
‘তোরও ছইল হবি।’
আলিমা বড় রহস্যময় বিষাদ হেসে নেয়। অন্ধকারে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন সে এসব আর ভাবে না। তারপরও মনের অন্তরালে ছবির পর ছবি ভেসে আসে। যেভাবে শরতের আকাশে সাদা মেঘ ভেসে যায়, তার মনের সবটুকুতে আবছায়া কালো মেঘ; সে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। আলিমা কোনোদিন স্কুলে যেতে একই ভ্যানে উঠে বসে। ভাবকি হতে এগিয়ে আসা সেই ভ্যানে বসে থাকে নাদিম। অনেক দূরে বালিয়াড়িতে কাশবন। সকালের হালকা বাতাস কাশফুলের মতো নরম স্পর্শ দিয়ে যায়। চোখে চোখ হতে হতে একদিন কথা, সেই কথা কখন যে মনের কথা হয়ে ঘুমহীন রাতের স্বপ্নে জেগে ওঠে আলিমা টের পায়…পায় না। আলিমা স্কুলে যায়। ভাই কাছের এনজিওয় কাজ করে। হিসাব রক্ষক। বর্ষায় দিঘিপাড়ের কদম গাছে যখন শত শত কমলা রং ফুল ফুটে উঠে, আকাশে মেঘের দল আনমনা ভেসে যায়, থই থই জলে সাঁতার কাটে সাত-আটটি হাঁস; আলিমার মনে ফুর্তির ঢেউদোলা। নাদিমের কথা মনে তড়পায়। সে কলেজে পড়ে। এখানের পড়া শেষ হলে রাজশাহি যাবে। সেখানে পড়বে। কলেজের অধ্যাপক নয়তো অ্যাডভোকেট হওয়ার সাধ। আলিমা যদি তার বউ হয়। আলিমার চোখে-মুখে গোধূলির আভা। নাদিম সেই কথা একদিন বলে ফেলে। তার হাতে বাঁশি। কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বাজায়। চারিদিকে হাততালি। আলিমার স্কুলের পাশেই তো কলেজ। তখন তার বুকজুড়ে মুগ্ধ আবেশ। সেদিন ফেরার পথেও কি জানি কীভাবে একই ভ্যানে উঠতে হয়। নাদিম ফিসফিস জিজ্ঞেস করে, –
‘তুমি আমাকে বিয়ে করবে? তোমাকে খুব পছন্দ হয়।’
আলিমা জবাব দিতে পারে না। কোত্থেকে হাত-পা স্থবির হয়ে আসে। মুখে কথা সরে না। আশপাশে কীভাবে যেন নতুন আলোয় সবকিছু অতিউজ্জ্বল হয়ে যায়। সে কিছু দেখে না, দেখতে পারে না; সেদিন সেই আলো সারারাত জাগিয়ে রাখে। সেই নাদিম শহরে বিয়ে করেছে। আলিমার বুকের আবেগ কোথায় কোন্ গহ্বরে পড়ে গেল যেভাবে রাতের সুখস্বপ্ন মিলিয়ে যায়; তার নোটবুকের পাতা মুড়োল। আলিমার মনে তবু খেদ নেই। গরিব মানুষের স্বপ্ন রাতের সুখ ছাড়া কী? আজ একমুঠো ভাতের কাঙাল হয়ে পথে নেমেছে। বাবা যদি বেঁচে থাকত, তার কোলে শুয়ে বসে কত স্বপ্ন দেখত সে। মা গরম গরম ভাত আর মৃগেল মাছের ঝাল ঝাল ঝোলে তরকারি রান্না করে খেতে দিত। হায় একজন মানুষ সংসারে না থাকলে কতকিছু নাই হয়ে যায়! আলিমার চোখে কি বাতাসের ঝাপটা লাগে? সে যে রাতের দেয়ালে শুধু ঝাপসা দেখে যায়।
‘কত্থন লাগিবে সাবিনা? রাত হয়া আসিল্।’
‘এ্যাঠে রাত হয় না আলিমা, তয় চোউখ-কান খোলা রাখিবু; জারুয়া মানষে ভরতি।’

তিনজন মানুষ বিশাল টেবিলের ওপাশে। তারা দেখতে জ্বিনের মতো ধবধবে ফরসা। আচ্ছা জ্বিন কি সত্যিই ফরসা, যেমন গল্পে পড়েছে, আর তারা কি এত বাহারি পোশাক পরে? এই মানুষগুলোর মুখ-চোখ-চেহারা কত সুন্দর করে সাজানো-গোছানো! কি মিষ্টি কথা বলে! কি মধুর কণ্ঠস্বর! রুমের মধ্যে হালকা ঠান্ডায় আকাশ থেকে নেমে আসা স্তব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। পৃথিবীতে এরাই আসলে স্বর্গের মানুষ। দেবতা। তখন সোনারং চশমা পরে থাকা মানুষ জিজ্ঞেস করে।
‘এর আগে কোথাও কাজ করেছ?’
‘না স্যার। এখানেই প্রথম আবেদন করেছি।’
‘অভিজ্ঞতা নেই।’
‘আমি শিখে নেব স্যার। সেলাই ট্রেনিং করেছি।’
‘বেশ।’
তারা তিনজন টেবিলের এপাশের চেয়ারে জ্বিনদের মুখোমুখি বসে আছে। চেয়ারগুলো সাধারণ নয়, অদ্ভুত সুন্দর নরম আর দামি; একনজর দেখেই বোঝা যায়। আলিমা তাই জড়সড় আড়ষ্ট, চোখে-মুখে অস্থিরতা লুকোবার হাজার চেষ্টা; সে এমন একটি চেয়ারেরও যোগ্য না। তার পাশে অন্য এক মেয়ে, একটু আগে কথায় কথায় জানা হয়, সে অন্যকোথাও কাজ করে, বেতন ঠিকমতো পাওয়া যায় না; আচ্ছা এখানে নিয়মিত বেতন পাবে তো? ওপাশে এক তরুণ, সপ্রতিভ, দুশ্চিন্তায় অস্থির চেহারা। এমন ভাবনার মধ্যে কেউ ওই প্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করে, –
‘রাকিব তুমি তো কাজ ছেড়ে চলে গেছ। আমরা কেউ জানি না, কোনো আবেদন নেই কোনো কথা নেই, এভাবে তো হয় না; তাই না? এখানে তোমার আর সুযোগ নেই। তুমি বরং অন্য জায়গায় চেষ্টা করো।’
‘স্যার হঠাৎ করে মা স্ট্রোক করল, বগুড়া যেতে এত অস্থির ছিলাম, মাথা ঠিক ছিল না…আর স্যার মোবাইল করেছিলাম সেকশন ইনচার্জকে, তিনি ফোন ধরেন নাই। সিদ্দিকি ভাই কিছু বলেননি স্যার?’
‘ডিরেক্টরস কমিটিতে তোমার আবেদন আর পারফরমেন্স রিভিউ হয়েছে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে কমিটি পজিটিভ রিমার্ক করেনি। সরি। তুমি অন্যকোথাও চেষ্টা করো। আমাদের রিকমান্ডেশন লাগলে দেয়া যাবে।’
‘স্যার আমার মা চলে গেল। কাজটা খুব দরকার। বাবা বৃদ্ধ মানুষ। সংসারে ছোট ছোট দুটো ভাইবোন, ইনকাম করার কেউ নেই স্যার। স্যার?’
টেবিলের ওপাশে আর কেউ কথা বলে না। আলিমার বুকের মধ্যে ইতোমধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। সে কাজ পাবে তো? মানুষগুলো এত সুন্দর অথচ কত কঠিন! কি শক্ত নিয়মকানুন! সে সব নিয়ম অনুসরণ করবে। যেভাবে কাজ করতে বলবে মেনে নিতে অসুবিধা নেই। তার চাকরি দরকার। মা খাবে কী? অনেক আশা নিয়ে এত দুরের পথ পাড়ি দিয়ে আসা। সাবিনার ওখানে উঠেছে। একটি ছোট্ট রুম। চারজন শুয়ে বসে থাকে। বোঁচকা-পোটলার মধ্যে নিজেকে বড় জড়বস্তু মনে হয়। তার কোনো প্রাণ নেই। তার আলো-বাতাস লাগে না। তারপরও একরাশ ধোঁয়া চোখে-মুখে এসে চেপে ধরে, তখন মনে হয়, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না; সে হাতড়ে হাতড়ে মুক্ত বাতাসের জন্য ব্যাকুল হয়। প্রায় বদ্ধ ঘরের এককোণায় কেরোসিন স্টোভে রান্না হতে থাকে। কেরোসিনের গন্ধ-ধোঁয়া চারকোণায় জমে ওঠে। আলিমা একমুঠো ভাতের গ্রাস তুলতে তুলতে প্রতিবারই ভাবে, মা খেতে পাচ্ছে তো? এভাবে আর কত দিন? টেবিলের ওপাশের মানুষজন এই বিষাদ চেহারাছবি দেখে কি একটুও দয়ালু হবে না? তার যে কাজ চাই। মাকে কাছে না আনা পর্যন্ত স্বস্তি আর শান্তি কোথায়? মা কেমন আছে?
‘তোমার নাম তবে আলিমা আকতার। তুমি কবে জয়েন করতে পারবে?’
‘যখন বলবেন স্যার। আজকেও পারব।’
‘বেশ তুমি এই টোকেন নিয়ে নুর জামালের সঙ্গে দেখা করো। ফোর্থ ফ্লোর। অ কে?’
‘জি স্যার, অনেক ধন্যবাদ স্যার। আসসালামু আলায়কুম।’
‘ওয়েলকাম।’
সোনালি ফ্রেম চশমা পরা মানুষের চকচকে দৃষ্টির মধ্যে আন্তরিকতা ঝরে পড়ে। এ হলো মানবিকতা। মানুষ অহেতুক ধনী মানুষের নিন্দা করে। আড়ালে গালমন্দ। সবাই কি খারাপ? পৃথিবীতে ভালো মানুষও আছে। আলিমা নিজেকে খুব শান্ত রেখে বুকের অস্থির আনন্দ চেপে আস্তে করে রুম থেকে বের হয়। পরম করুণাময় তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আজ ঘরে ফিরে দু-রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে। মাকে জানাবে আনন্দ সংবাদ। ভাই আর ভাবীকে বলবে। সবার আগে…সে কি ভেবে মোবাইল বের করে। সাবিনাকে খবর দেওয়া দরকার। চিকন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে পুনরায় সব আবেগ থেমে যায়। বিশাল এক রুম। অনেক মহিলা টুকটুক করে কাজ করছে। কারও দিকে কারও তাকাবার ফুরসত বুঝি নেই। মানুষের কত কাজ! আজ থেকে কাজ করবে সেও।

সন্ধে শেষ হতে হতে বের হয় আলিমা। কোনোদিন কাজ চলে রাত সাড়ে নয় বা দশ পর্যন্ত। অতিরিক্ত এই সময়ের জন্য বাড়তি কিছু আয়। তারপর রাস্তায় বস্ত্রবালিকাদের ভিড়। সারাদিন কাজশেষে পরিশ্রম অবসন্ন চেহারায় তবু কোনো ক্লান্তি নেই, বোধকরি খটখট শব্দের মধ্যদিয়ে একটি দিনের অবসান আর আর্থিক সংযোজনের প্রশান্তি। আলিমার আজ প্রথম দিন। নতুন অভিজ্ঞতা। মন বড়ই আশাবাদী। সাবিনা এরমধ্যে মোবাইলে কল করে। খোঁজখবর নেয়। আলিমা খুশির খবর দিতে দিতে আবেগ ভারাক্রান্ত। সাবিনার কথা ঠিক। তার নিয়োগ কোয়ালিটি সেকশনে। নূর জামাল কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে। সেলাই হয়ে যাওয়া প্রতিটি কাপড় চেক করে দেখতে হবে। সেটির সেলাই-জিপার-বোতাম-মান ইত্যাদি ঠিক আছে কি না, কোনো দাগ কোনো অসঙ্গতি এইসব পরখ করার কাজ। আলিমার সামনে দুটো বড় কার্টন, সেগুলোর গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, একটি ‘অকে’ অন্যটি ‘রিজেক্টেড’। পৃথিবীতে যেন এমনই দুটো দিক ধরে রাখে ঈশ্বর, একদিকে ভাগ্যবান অন্যদিকে হতভাগা; কি আজব নিয়মকানুন! আলিমা তেমনই এক ভূমিকায় কাজ পেয়ে গেছে। চাকরির নিয়োগ-বেতন-সুযোগ-সুবিধা কাজের ধরন আর দায়িত্ব তথ্য কাগজ আগামিকাল অথবা পরশু পাওয়া যাবে। তখন জানা যাবে কত টাকা বেতন। আলিমার দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে গিয়ে মনের গহিনে ফুরফুরে সুর। এবার হয়তো দু-বেলা ঠিকমতো খেতে পারবে। একদিন সময় আর সুযোগ বুঝে মা-কে নিয়ে আসার সাধ আছে। তার ভালো চিকিৎসা দরকার। এইসব কথা আর অনেক অনেক গল্প-পরামর্শ ঘরে ফিরে করবে আজ। সাবিনা অনেক উপকার করল।

এভাবেই দিন গড়াতে গড়াতে তিন মাস পেরিয়ে গেলে সকল জড়তা ঘুঁচে গেল আলিমার। অফিসের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম তলা যেমন চেনা হয়ে যায়, কতগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় শেষ সীমানায়, তেমন করে জানাশোনা হয় অনেকের সঙ্গে। পৃথিবীর সকল মানুষের নিজস্বতার মধ্যে যার যেখানে যেমন অবস্থান, তাদের মধ্যে তৈরি হয় আন্তরিকতা আর সম্পর্কের সেতুবন্ধন, সেখানে একটু বোধকরি আত্মার সংযোগও সৌরভ তুলে যায়। সারাদিন ব্যস্ত কাজের ফাঁকে কথা হয়, সুখ-দুঃখের গল্প, কে কোথা থেকে এসেছে, কেমন সেই আবাস আর আশপাশ, কেমন ছিল শৈশব আর আনন্দময় দিনকাল কিংবা বিষাদ গল্প, আর এভাবেই একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসে; সে হলো অন্য এক জীবন। আলিমা কাহিনি শোনে, সুতোয় বোনা নকশি কাঁথার মতো মনে গেঁথে যায় মানুষের জীবনযাপন। প্রত্যেক মানুষ একেকটি গল্প, তাদের সকলের কাহিনিতে হাসিকান্না আশা-প্রত্যাশা আর আনন্দ-সংঘাত জীবন্ত হয়ে ওঠে…জ্বলজ্বল করে। তার নিজের গল্পও যেমন বদলে যেতে শুরু করে, সেই কথা তার লাল রং নোটবুকের পাতায় পাতায় লেখা হয়, নতুন নতুন কথা আর স্বপ্নসাধ; সে-সবের কিছু ভালো কিছু তার ক্লেশ। মায়ের কথা মনে পড়ে, এখনো নিয়ে আসতে পারে নাই, মা রাজী নয়; আর এসবের মধ্যে সংযোগ আসে নতুন নাম নতুন জীবনের হাতছানি, ভালবাসা-বিশ্বাস। কখনো সেই স্বপ্নের মায়ায় কেটে যায় কোনো কোনো রাত আর উদাসী বিকেল। সোনারং মানুষ সামনে এসে দাঁড়ায়। এই গার্মেন্টেসের অন্যতম অংশীদার রাজ আনসারি। আলিমা ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে লাজে মরে। তার মন না জানুক কিংবা বুঝুক, আশপাশে সকলেই বুঝি জেনে গেছে। কারও মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে কেমন শিরশির লাগে তার।
‘আলিমা কী করো? এদিকে একটু আসবে?’
‘জি স্যার আসছি।’
এভাবেই মানুষটি কাছে আসে। আলিমাও কি স্বপ্ন দেখে না? একদিন যে স্বপ্ন ফুল হয়ে বিকশিত হতে হতে বাসন্তিক হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছিল। তখন কখনো নাদিমের কথা মনে পড়ে। বিকেলের বাতাস অকারণ উদাস হয়ে আসে। সেই সে বেলার কথা, কত আবেগ কত আনন্দ আর স্বপ্নের সুতোয় বোনা রুমালের কোণায় এক নাম। সব জলের ধোয়ায় মুছে গেল। আলিমা আর সেই কথা ভাবতে চায় না, মনে করবে না, সে যে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া রূপকথা গল্প; তাকে স্পর্শ করা যায় না। সেদিন আলিমা ভয়ে ভয়ে তিনতলায় নামে। একটি হিমশীতল প্রশস্ত ঘর, পশ্চিমে কাঁচের বিশাল জানালা নাকি পরদা, সূর্য ডোবার কমলা আকাশ দেখা যায়। রাজ আনসারি সেদিকে তাকিয়ে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কোনো ভাবনায় কোন্ সুদূরে বিভোর। আলিমা আস্তে করে পা রেখে বলে, –
‘স্যার?’
‘আলিমা! এসো এসো বোসো…তুমি আমাকে স্যার বলবে না কেমন?’
‘জি স্যার।’
‘স্যার? তুমি আমাকে রাজ ডাকবে। কেন জানো? সেই গল্প একদিন শোনাব।’
‘জি স্যার।’
‘হা হা হা!’
তারপর সেই গল্প। প্রত্যেক মানুষের বুকে যেমন কিছু বিষাদ গল্প থাকে, তার রূপ-অরূপ আর স্বরূপ; আলিমা সেই গল্প শোনে। আলিমার নিজেরও কি এমন গল্প নেই, সেই গল্প ভুলে যেতে চাইলেও কি ভোলা যায়…নাকি ভুলতে পেরেছে কেউ? আলিমা ভোলেনি। কখনো সেই দিনকাল ঘুরে ঘুরে এসে বিবর্ণ করে দেয় মনের আকাশ। জীবন আর অস্তিত্ব শরতের মেঘের মতো ভেঙে ভেঙে পেঁজা তুলো হয়ে যায়। রাজের গল্পও তেমন এক খেই হারিয়ে ফেলা পথক্লান্ত অসমাপ্ত কাহিনি।
শহরের এখানে-ওখানে তখন সন্ধেবাতি জ্বলতে শুরু করেছে, বিশাল কাঁচ জানালা দিয়ে দূরের সেই আলোকবিন্দু বোধকরি কাচিনিয়া বাজারের ওপাশে গ্রামের কোনো ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলো; আলিমা সেই প্রভায় পথ চিনে চিনে ঘরে ফেরে। নাদিম কথা রাখেনি। আর সেদিন কেউ একজন কথা রেখেও কথার মূল্য পায়নি; ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে সেই প্রিয় একজন। আলিমার কষ্ট লাগে, সে-সময় নিজের জন্য হয়তো নয় কিংবা কে জানে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘাকায় মানুষটির ছায়া দেখে দেখে অচেনা কষ্ট আলিমার বুকেও প্রতিধ্বনিত হয়। সে হতবিহ্বল উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
‘আলিমা তুমি আমায় বিয়ে করবে?’
‘জি স্যার?’
‘আবার স্যার?…শোনো তুমি যেদিন প্রথম এখানে এলে, আশ্চর্য আমার চোখের সামনে যেন ফারিন বসে আছে। ওকে খুব ভালবেসে ছিলাম জানো, একটি বছর; তারপর কাউকে না জানিয়ে কোনো কথা না বলে কানাডা চলে গেল। আমাদের জীবনের ছোট ছোট সুখ-আনন্দ-ভালবাসা কত ঠুনকো হয়ে যায়। সে আমার কথা রাখল না।’
আলিমা কী বলে? তার অবরুদ্ধ ভাবনার মধ্যে সবকিছুই বোধকরি সিনেমায় দেখা কোনো কাহিনি, সেলুলয়েড ফিলমের উপর আলোকরশ্মি পড়ে মনের পরদায় ছবি তুলে যায়। তারপর একদিন মন না চাইলেও, মন বড় অবুঝ, কোনো কথা শোনে না; আলিমা কী জবাব দেয়? সে কেমন করে কোনো নিষেধ শোনে না, মানুষটির দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আনমনা হয়। এই বুঝি আরও একবার ডাক পড়ে। কোনোদিন শ্রুতিতে শোনা হয়নি এমন এক জিজ্ঞাসা ‘আলিমা তুমি আমায় বিয়ে করবে?’ বেজে ওঠে। কখনো শুধু ভাবতে ভালো লাগে। জীবনে কোনো সুখ পেল না সে। আজ লটারির মতো অনেক উঁচুতে থাকা মানুষের সুখ-ঐশ্বর্য-বিত্ত-বৈভব হাতছানি দেয়। মনের জানালায় ভীরু ভালবাসা উঁকি দিতে থাকে। আলিমা কী করে? সে মনের সকল দোলাচল আর সহস্র আলোড়ন নিজের মধ্যে রেখে দেয় আর এভাবেই কখন অজান্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
একদিন আলিমা শেষদুপুরে বেরিয়ে আসে বুড়িগঙ্গার বুকে অনেক অনেক দূর। গোধূলির সূর্য চারপাশে ছড়িয়ে রাখে সলাজ রক্তিমা, জলের দর্পনে বিম্বিত হয়ে লেপটে থাকে চেহারায়। তার একটি হাত বুঝি কারও হাতের মধ্যে ঘেমে ঘেমে উত্তাপ হারিয়ে ফেলে অথবা তার সকল জীবনীশক্তি শুষে নেয়।
‘আলিমা ওহ্ আলিমা, তুমি আমার বিয়ে করবে তো? একবার বলো।’
‘বলব না।’
‘আচ্ছা।’
তখন সকল সীমারেখা বোধ আর লজ্জার কে জানে প্রজাপতি ভিতু মনের জড়তা ঘুঁচে গেছে। আলিমা তার বুকে ছোট্ট পাখি হয়ে নির্ভরতার নিশ্বাস নেয়। আকাশে ছড়িয়ে রাখে দুটো পাখা। নীল আকাশের গায়ে ঘেঁষে থাকা মেঘের উপর ভাসতে ভাসতে নিজেকে বড় হালকা আর নির্ভার লাগে। জীবন কত সুন্দর! প্রকৃতি কাউকেই প্রতারিত করে না, কোনো না কোনো দিক দিয়ে পূর্ণ করে দেয়; এই হলো বিশ্বাস। সে তখন সত্যি সত্যি দৃষ্টি ওপরে তোলে।
‘আমার তো কোনো পরিচয় নেই স্যার, গরিব ঘরের মেয়ে, মা আছে, অসুস্থ, ভাই আর ভাবী। আমি আপনার যোগ্য না।’
‘তুমি আমার যোগ্য কি না, সে ভাবনা আমার। আর শোনো তুমি কক্খনো স্যার বলে ডাকবে না। অনলি রাজ।’
‘সে আমি ডাকতে পারব না। আপনি কত উঁচুতলার মানুষ। আমি কোথায় পায়ের নিচে পড়ে থাকা হতভাগি একজন।’
‘তুমি আর হতভাগি নও আলিমা। আমি তোমার সাথে আছি। আমি তোমার রাজ। এই পরিচয়ই এখন আমাদের।’
তখন রাত নেমে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ বড্ড বেহায়ার মতো জলের বুকে ঢেউ হয়ে হেসে কুটিকুটি। আলিমা কারও বুকের সঙ্গে নিজেকে গেঁথে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে বসে। সেই গাড়ির মধ্যে হিমহিম শীতলতায় বেজে চলে প্রেমের কোনো গান। আলিমা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে; নিশ্চয়ই কোনো পুণ্যবলে জীবনের মোড় ঘুরে গেছে তার। তখন মায়ের কথা মনে পড়ে। আজ মা দু-বেলা খেতে পায়। মাস শেষে বেতন তুলে ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। রূদাবা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে। মোবাইলে আরও শোনে মায়ের কথা। কখনো বিষাদ বাতাসে আকাশ ভারী হতে থাকে। মা বলে, –
‘মা একবার বাড়িত্ আসি ঘুরি যা…তোক খুব দেখিবার মন চায়।’
‘আসিম মাও। সামনের মাসে যাইম অ্যালা। তুই ভাত খাইছি? কী সালুন খালু? কোমরের বিষব্যথা? ভাবী ডাক্তরের গোড়ত নিয়া গেছিল?’
‘হয় মা, বউ ভালোই খেয়াল রাখোচে। পিত্যিক দিন এক গেলাস দুধ খাছি। আইজ তোর ভাই রুই মাছ আনিছিল।’
‘আল্লাহর রহম। ভাল থাকিস মায়ও।’
‘তুই ক্যাংকা খাছি মা? আহা রে মোর জাদু! …আর কত্দিন চাকরি করবু মা? বিয়াত বসিবার হবি না? তোর বড়বাপের ব্যাটা রমিত তোর কথা সদায় সদায় কয়। ওঁয় তো ভালো ছুঁয়া, মোরও পছন্দ; এইবার আসি হেনে বিয়া করি যাইস। রমিতও সাথে যাইবে।’
‘দাদা কি আর বউ পাছে না? আগের বউ তো তালাক দিছে। তুই ওক ক্যান পছন্দ করি থুইছি মা?’
কোথায় রমিত আর কোথায় সঙ্গে থাকা ভালবাসার মানুষ রাজ। অনেক ধনী মানুষ। কয়েকটি দোকানের মালিক। একটি জুয়েলারি। আলিমার জোরকপাল। এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে হলে আর কী চাই? মা খুব খুশি হবে। তার মুখে হয়তো কথা সরবে না।

ওইদিন সাভারের স্মৃতিসৌধে বিজয় দিবস উদযাপনের উৎসব। আলিমা দলবেঁধে কুচকাওয়াজ আর বিবিধ আয়োজন দেখতে যায়। সাবিনা আগের রাতে রান্না করতে করতে যাওয়ার কথা বলে রাখে…আরও অনেক গল্প-আলাপ বিবিধ বিষয়আশয়। রাত ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যভাগ। বাজারের সবচেয়ে সস্তা সবজি বাধাকপি বঁটিতে ফেলে কুচি কুচি করে আলিমা। কয়েকদিন ধরেই এই সবজি আর নেপালি মসুর ডাল। ঘরের মধ্যে ধোঁয়া আটকে মেঘ থমথম। একটিমাত্র জানালা, খোলা যায় না; ওপাশে পুকুরের পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। গোসলখানা আর টয়লেটও ওদিকে। দক্ষিণ দিকে দরজা, সেটিও বন্ধ। দিনরাত মশার উৎপাত। তিন সাড়ে তিনফুট ফাঁকা জায়গা মধ্যখানে রেখে উত্তর-দক্ষিণে ছয়টি রুম। এই রুমে চারজন মানুষের বসবাস। এখানেই মেঝের এককোণায় কাপড়ের ব্যাগ, ডেকচি-পাতিল, বঁটি-চাকু, থালা-বাসন, কয়েল স্ট্যান্ড আর হাজারও জিনিসপত্তর। সিলিং-এ একটি ফ্যান, কোন্ আমলের কে জানে, সারারাত ঘটর-ঘট শব্দ তুলে বাতাস ছড়ায়। এখনও চালাতে হয়। ডিসেম্বরের এই সময়ে দিনাজপুরে তীব্র শীত জেঁকে বসে। ঢাকায় তেমন ঠান্ডা নেই বরং গরম। ওইদিন আকাশ মেঘলা, বিকেলে কিছু বৃষ্টি হয়েছে; তাই আচমকা দমকা হিম বাতাস ভেসে আসে। সাবিনা স্টোভ থেকে ভাতের ডেকচি নামাতে নামাতে কথা বলে, –
‘ওই ছইল, কাল সাভার যামো…ঢাকাত দেখার কত জায়গা, কিছু তো দেখলু না।’
‘ক্যাংকরি দেখিবু ক? সকালে কামোত্ যাও…আসিতে আসিতে রাইত। সাভার কী তনে যাবু?’
‘চলেক ক্যানে।’
‘ওটি রানা প্লাজা নহায়? ওই যে ভাঙি পড়িছিল?’
‘হয় হয়। দেড় হাজার মানুষ মরিছিল।’
তারপর নিশ্চুপ সময়। আলিমা সবজি কাটে। সেই খবর পড়া আছে। দু হাজার তেরো সালের ঘটনা। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ। একদিন সকালে ভেঙে-দেবে একাকার নয়তলা বিল্ডিং। মাটি আর ইট-পাথরের নিচে চলে গেল দেড় হাজার মানুষ। আহত দু হাজার। এসবের মধ্যে সতেরো দিন পর রেশমা নামে কেউ একজন জীবিত উদ্ধার হয়। অবিশ্বাস্য…আশ্চর্য! কেউ বলে নাটক। আলিমা সেই ছবি টেলিভিশনে দেখেছে। মানুষের জীবন কত হালকা আর মূল্যহীন! নয়তলা ভবনের তৃতীয় থেকে সপ্তমতলা পর্যন্ত ছিল গার্মেন্টস কারখানা। সেখানে পাঁচ হাজারের উপর মানুষ কাজ করত। তার মধ্যে কতজন বস্ত্রবালিকা? আলিমা যখন ঢাকায় এই কাজের খোঁজে আসতে চায়, মা কী করে জেনে রাখা এসব খবরাখবর তুলে ধরে; বাধা দেয়। আলিমা শোনে না। ভুষিরবন্দর কাচিনিয়ায় কতটুকু ভালো আছে তারা? এত ভয় করলে জীবন চলে? সে চলে এলো। এখন কাজ। এরই মধ্যে দেখা হলো আগুনের আকাশ ঊর্ধ্ব হলকা। কোথাও আগুন লাগে, মানুষ পুড়ে মরে, কেউ প্রাণ বাঁচাতে পাঁচ-ছয়তলা থেকে শূন্যে লাফ দেয়; সেই চোখে দেখা তাপে বুঝি দমবন্ধ হয়ে আসে আলিমার। মানুষ এত ঝুঁকি নিয়েও কাজ করে, জীবনযাপনের বিবিধ উপাচার সংগ্রহ চলে, সংসারের বিবিধ গল্প আর স্মৃতিচারণ; কখনো এরমধ্যে ভারী নিশ্বাসও বাতাসে ভেসে যায়। তারপর আবার দিন, সকালে তড়িঘড়ি বাস ধরা, বড় গেট দিয়ে কারখানায় প্রবেশ, সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চমতলায় নিজের কাজ; এসবের মধ্যে অচেনা পুলকে এসে যায় নতুন জীবনের হাতছানি। মন স্বপ্নে বিভোর হতে ভালবাসে। সেই কথা অতিধীর উঠে আসে রাতে।
‘তোক একখান কথা কও আলিমা? রাগ করিবু না?’
‘ক।’
‘ওই যে মানুষটা রাজ আনসারি স্যার, তোক বারবার খালি ডাকে পাঠায়, সাবধান থাকিবু; এ্যাঠে কাহোক বিশ্বাস করিবু না।’
‘ক্যান্? মানুষটা তো ভালো। বউ ছাড়ি চলি গেইছে নাকি।’
‘তোক গল্প শোনাছে বুঝিলু। মানুষ যেইংকা ভালো তেইংকা বদ। কাঁয় কখন হাউস মিটাবি, তুই টেরও পাবু না। ঢাকা জারুয়া মানষে ভরতি।’
‘তুই এইলা ক্যান কছি ওই?’
‘এমনিই কছো। পাছোত ফির বিপদোত না পড়িস। মুই কানা নহায়। এ্যালা এক-দুদিন ছুটি নিয়া তোর মাওক নিয়া আয়। সামনের মাসোত উত্তর পাখের ঘরটা পামো। তিনজন থাকমো।’
‘মাও আসিবার চায় না।’
‘সেটা কইলে তো হবি না। তুই বুঝসুজ দিবু। আর তোর বড়বাপের ব্যাটা বলে বিয়া করিবার চায়, তুই কী কলু?’
‘ধুর্…ওঁয় মানষের স্বভাব ভাল্ না। নেশা-ভাঙ খায়।’
‘তোর মাও যি ফির কছে…অ্যালায় মনে হয় ভালো হইছে।’
‘গু খাওয়া গরু ফির গু খাওয়া ছাড়ি দেয় সাবিনা?’
রাতের সময় স্থবির এগোতে থাকে। আলিমার গলা দিয়ে ভাত নামে না। কী করবে সে? বেঁচে থাকা দিনকালে এক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আরেক ঝামেলায় নেমে আসতে হয়। মানুষের জীবন কি এই? কেন এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভাবায় তাকে? এই তো কয়েকদিন আগে আনন্দের কত কথা শুনেছে। তখনো মনের মধ্যে হাজারও দোলাচল, জটিল প্রশ্নের উথালপাতাল অস্থির তরঙ্গ, এসব কি ঠিক হচ্ছে নাকি কোনো পাপ; আলিমা ভাবনার খেই পায় না। সে সুযোগও বোধকরি নেই। বিশাল হোটেলের হিম হিম প্রশস্ত কক্ষে সে আর রাজ। মানুষটি এত সুন্দর কথা বলে! একাকী এক মানুষ, কত কষ্ট বুকে বয়ে বেড়ায়; আলিমারও অনেক কষ্ট। কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় না? রাজের কথা ভালো লাগে। আলিমা বুঝি সিনেমা হলে বসে কোনো ছবি দেখতে থাকে। রাজ্জাক-শাবানার গল্প…‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’। আলো-আঁধারির আবছায়া দেয়ালে রংধনু প্রতিচ্ছায়া। রাজ জড়িয়ে ধরে থাকে। অচেনা আবেশের সৌরভ চারপাশে ছড়িয়ে যায়। আলিমার বোঝা না বোঝা দিগভ্রান্ত বিহ্বল প্রহর। রাজের সঙ্গে পরিচয় কেমন করে হলো তার? এই তো সেদিন তিনজন মানুষের সামনে বসে ছিল। তার বুক থরো-থরো কেঁপে যায়। চাকরি হবে তো? একটি কাজ খুব দরকার। তখন কয়েকটি জিজ্ঞাসার পর অন্য কেউ কথা বলার আগেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় রাজ আনসারি। আলিমার দিকে একটি টোকেন এগিয়ে উপরে যেতে বলে। সোনালি রং চশমার নীল-নীল কাচ ভেঙে মুগ্ধ দৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ে। আলিমা কি তখন বোঝেনি? তারও ভালো লাগে। তারপর ওপরে ওঠে। এখন মাটির নিচতলা থেকে উঁচুতে উঠে গেছে, আরও অনেক উঁচুতে উঠবে, আরও…আরও। আলিমা এসব ভাবনার মধ্যে গলে গলে যেতে থাকে। রাজ তখন বুকের নরমে হাত রেখে কানে কানে ফিসফিস স্বরে ভালবাসার কথা বলে যায়। অচেনা হাজারও শিহরন ছড়িয়ে পড়ে সঘন পরিসরে। আলিমা বুঝি একদিন কাশফুলে ঢাকা রুপোলি বালুতে বসে এমনই ভালোলাগা খুঁজে পেয়েছিল। সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে। নাদিম। অভাগা মানুষ। আজ আলিমা কত উপরে উঠে গেছে! কি ভাগ্য তার! কত আনন্দ! রাজ জড়িয়ে ধরে বলে, –
‘আ-লি-মা…মাই লাভ…আই লাভ ইউ সো মাচ।’
‘মি টু।’
আলিমা বোঝে অথবা বোঝে না, কি যায় আসে; তাই সকল বোঝাপড়া হয়ে যায়। তারপর দিন গড়াতে গড়াতে যখন সন্ধে নামে, সেই ভালবাসার মানুষকে আর দেখা যায় না। আলিমা তার লাল রং নোটবুকে কী লিখে রাখে, কষ্ট নাকি অপেক্ষা অথবা আকস্মিক জেগে ওঠা অবিশ্বাস আর সন্দেহের দু-একটি ভিতু ভিতু দুর্বল লাইন? আজ দুই সপ্তাহ হয়ে গেল রাজ আসে না। তার দেখা নেই। তেমন করে আর ডাকবে কে? আলিমার মন থেকে থেকে বিষাদে কু ডেকে ওঠে। তার ডানে-বাঁয়ে দুটো কার্টন, একটি ‘অকে’ অন্যটি ‘রিজেক্ট’। সে নিজেকে কোথায় ফেলে রাখে? তার চোখ ক্ষণে ক্ষণে আনমনা খুঁজে চলে কাউকে। পরম বিশ্বাস। ওইদিন সকলে যখন কারখানা থেকে বের হতে শুরু করে, শীতের সন্ধে অদ্ভুত ঠান্ডা-কোমল আর নিস্তব্ধ গহিন, শোনা যায়, রাজ আনসারি কানাডা চলে গেছে; তার বউয়ের কাছে। রাজ আর এই গার্মেন্ট্সের অংশীদার মালিক নয়। আলিমা থমকে দাঁড়ায়, বুকের বাঁ-পাশে বুঝি পরাজিত কোনো হাহাকার উদভ্রান্ত দিশাহীন, কী যেন ছিল, কী আর নেই; সেই শূন্যতা নিশ্চুপ কান্নায় গুমরে উঠে। কাচিনিয়ার ঘরদোর আর দিঘিপাড়ের বাঁশবাগান জেগে জেগে উজ্জ্বল হয়। সেখানে সন্ধেরাত বড় নিবিড়। হাজার জোনাকি মাতাল হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। বাবা কোনোদিন হাতের মুঠোয় জোনাকির আলো ধরে নিয়ে আসে, এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আলিমা ধরি থাক মা…এই আলো তোক পথের দিশা দেখাবি।’ আজ বাবা নেই, বাঁশবাগানের অন্ধকারে শুয়ে থাকে; আর সেই জোনাকিরা জেগে জেগে রাত পাহারা দেয়। আলিমা সব ছেড়ে পথের খোঁজে চলতে চলতে দিশা হারিয়ে ফেলেছে। আজ কার বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদে? কেউ কি বুকে টেনে পরম সান্ত্বনায় মাথায় হাত রাখবে? কেউ নেই। আলিমার অবোধ দু-চোখ ঝাপসা হয়ে পড়ে।

তখন বাসের জানালা দিয়ে দূরের ঝোপঝাড় দেখা যায় আর সেখানে শত শত জোনাকি দূর নক্ষত্রের মতো জ্বলে আর নেভে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

গল্প বস্ত্রবালিকার জোনাকি রাত মাহবুব আলী সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস
২১ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৬

আরো

সম্পর্কিত খবর