পৌনঃপুনিক
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৬
খবরটা শোনার পর থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করলেন তারানা নিজের মনে। শোনা অবধি কেমন যেন একটা দায়বদ্ধতা চেপে বসে তারানার কাঁধে। নিজের অবস্থানটাকে মাঝ পথে কল্পনা করে প্রথমেই ভেবে নেন শুরুটা করবেন কোত্থেকে? ব্যাপারটা যখন মিজান সাহেবের, নিশ্চয়তাটা নিতে হবে সেখান থেকেই আগে। আবার খুব বেশি নিশ্চিত হবার পর মীনা ভাবি যদি মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলেতো পন্ডশ্রম সবটুকুই। সাত পাঁচ ভেবে মীনা ভাবির জন্যই মনটা উচাটন হল তারানার।
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পেশায় নিয়োজিত তারানা আগাগোড়া। বর্তমানে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছেন। এক মাত্র মেয়ে নাফিসার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়িটাই কেমন ধু ধু করে। ব্যবসায়ী স্বামী আজ দেশে তো কাল বিদেশে। আজ এ শহর তো কাল ও শহর। মিটিং সেমিনার কনফারেন্স নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। তারানা বেগম কখনো কখনো সঙ্গী হন সাগর পাহাড় কিংবা অভয়ারন্যের হাতছানিতে। তবে ইদানিং ডায়াবেটিস ভর করায় নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে নিয়ম মাফিক চলা ফেরাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ল্যাপটপে বসে নাফিসার সঙ্গে মন চাইলে যে একটু গাল পল্প করবেন তা হয় না। একে তো দুই দেশের সময়ের অমিল তারপর আবার মাস তিনেক হল জবে ঢুকেছে নাফিসা। খবরের কাগজে হেডিং এ চোখ বুলিয়ে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে টেলিফোনে নাম্বার ঘুরালেন তারানা। ওপ্রান্তে মিনার কন্ঠ…
– হ্যালো।
– মীনা ভাবি কেমন আছ?
– তারানা ভাবি যে, দেশে আছ তুমি?
কৃত্রিম অভিমানে বলে মিনা।
– আছি ভাবি, দেশেই আছি। সেদিন কি আর আছে, শরীরটা একটু অনিয়ম হলেই বিদ্রোহ করে বসে। আমার কথা থাক আজ। তোমার কথাই বলি।
এরপর তারানা ভুমিকা ছাড়াই যা বললেন মীনার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিরশিরে একটা ঢেউ বয়ে গেল। সারা চেতনা যেন মুহুর্তের মধ্যে অবশ হয়ে গেল। কি জবাব দেয়া উচিৎ কিংবা উচিৎ নয় কিছুই জোগালো না মাথায়। তারানা ফোনের ওপ্রান্তে ব্যাপারটা ঠিক আঁচ করলো। দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব। দুজনে এক সময় পাশাপাশি ফ্লাটে বিশটি বছর পার করেছে পারিবারিক ঘনিষ্টতায়। ওপ্রান্তে মীনার অনড় মুর্তি কল্পনা করে আবার কথা বলে তারানাই…
– হ্যালো ভাবি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। এখুনি কিছু বলতে হবেনা। তুমি ফোন রাখ। আমি সন্ধ্যে নাগাদ আসছি, কথা হবে।
নীরবে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন মীনা।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ছোট্ট টুলটায় বসলেন আয়নার মুখোমুখি। একটু কি চমকে উঠলেন? নাকি দীর্ঘ দশটি বছর পর নিজেকে নুতন করে আবিস্কার করলেন। এক সময়ের সবার নজর কাড়া সুন্দরি মীনার টান টান চেহারায় আজ বয়স অতিক্রান্তের ছাপ স্পষ্ট। তিন তিনটি কচি মুখের বড় হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আর এ বড় করবার পেছনে সংগ্রাম রত মীনা রাত দিনের ফারাক না রেখেই পার করছেন বহু দিন মাস বছর। আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে সেই মুখ তিনটির জন্যই জীবনের হিসাব মিলাতে বসেছেন। নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবার কিই বা আছে আর। তবে কি সন্তানদের তিনি বঞ্চিত করছেন পিতৃস্পর্শ থেকে। তার মতামতের কি আজ সত্যিই প্রয়োজন?
ত্রিশ বছর আগের সেই দিনটাকে মনে পড়লো হঠাৎ। এতো অস্থিরতার মাঝেও হাসি পেলো মীনার। হায়রে সময়, সেদিন আর এদিন। স্কুল ডিঙিয়ে সবে কলেজের গন্ডিতে প্রবেশ করেছে তখন মীনা। রাতের খাবার দিতে দিতে মা-ই প্রথম তুললেন কথাটা। ভুমিকা ছাড়াই বাবা বললেন – আমার বন্ধুর ছেলে মিজান ভাল চাকুরিতে প্রতিষ্ঠিত। তোমাকে কলেজে দেখে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমি আগাতে চাই। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমার মাকে জানিয়ো।
ব্যস এটুকুই। অথচ মীনার অনেক কিছু ঘটে গেল অন্তরে বাহিরে। শত চেষ্টাতেও একটি ভাতও আর গলা দিয়ে নামলো না। ঘামতে থাকলো অনর্গল। শেষ মেষ খাওয়ায় ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো আপাতত। নিজ ঘরে দরজা ভেজিয়ে আয়নার সামনে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো নিজেকে। লজ্জায় লাল হয়ে অদেখা অচেনা বাবার বন্ধুর ছেলেটির মুখটি কল্পনায় আঁকতে বৃথা চেষ্টাও করলো। সিদ্ধান্ত জানাবার আর কোনো প্রশ্নই উঠলোনা।
যথারীতি ছেলের বাবা মা আংটি পরিয়ে দিয়ে তারিখ নির্দ্ধারণ করে গেলেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা চুড়ান্ত দিনটিতে লাল বেনারসি ঘোমটা মুড়ি দিয়ে বাবার বন্ধুর বাড়িতে বধু সাজে পদার্পন করলো মীনা । দিন কয়েক পরে মিজানের কর্মস্থল ঢাকা শহরে মিজানের কোয়াটারের একচ্ছত্র গিন্নি পদে যোগদান করে ঘরকন্নায় ব্রতী হল। বদলির চাকরির সুবাদে দুচার বছর পর পর এ শহর ও শহর ঘুরা ঘুরিও হল অনেক। একে একে সংসার ও মুখরিত হয়ে উঠতে লাগলো পর পর তিনটি সন্তানের কলকাকলিতে। প্রাইমারি পর্যন্ত তেমন অসুবিধে মনে হয়নি। কিন্তু বড় ছেলেটা যখন উপরের ক্লাস গুলোয় স্কুল পরিবর্তনে বিব্রত হতে লাগলো মীনার পরামর্শে মিজান সংসারটাকে ঢাকাতেই থিতু করে ফেললেন। অফিস লোন আর নিজের পৈতৃক সম্পত্তির যোগসাজসে ছোট একটা এপার্টমেন্টের মালিকানাও দিয়ে ফেললেন মীনাকে।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। মিজান সপ্তাহান্তে মাসান্তে আসা যাওয়া করতেন বদলির চাকরির দুরত্বভেদে। শহর থেকে শহরের দুরত্ব বাড়ে, মিজানের ও দুরত্ব বাড়ে মনের। একটু একটু করে অনেকটাই বেড়ে যায় এক সময়। সন্তানদের পড়ালেখা স্কুল কলেজ কোচিং প্রাইভেট ইত্যাদির বেড়াজালের অচ্ছন্নতায় বড় দেরিতেই টের পান মীনা ব্যাপারটা। ততদিনে মিজান কলিগ সোনিয়ার মোহে আবিষ্ট হয়ে পড়েছেন পুরোপুরি। অভিমানি মীনা অভিমান আর অপমানে মিজানের কাছ থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নেন মনের দিক থেকে। একই ছাদের নিচে বাস করলেও দুরত্ব তৈরি হয় যোজন যোজন। অনেক শুভাকাংখীরা মীনাকে অনমনীয় মনোভাবের জন্য দায়ী করেন। কিন্তু মীনার সব সময় মনে হয়েছে জোর করে কিছু ঠেলে গিলিয়ে উগলানোর চাইতে সেটাকে উপেক্ষা করাই ভাল। করেছেও তাই। দিনের পর দিন দুজন দুজনের প্রতি উদাসীন থেকেছে। কেউ কারে সঙ্গে কথা বলেনি, কেউ কারো চোখের দিকে তাকিয়ে দুরত্বটা কমানোর প্রয়োজন মনে করেনি। দিন তো আর এভাবে গড়াতে থাকবেনা, এক সময় স্থির হবে। বিশটি বছরের দাম্পত্য জীবনের ভালবাসাগুলো মিজানের অনুভবে অনুরণন তুলবে একদিন না একদিন। সন্তান তিনটির মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের মায়ের প্রয়োজনীয়তা টুকু মনের কোনে উঁকি তো দেবেই। বড়টা স্কুল ডিঙিয়ে সবে কলেজে বাকি দুজনও প্রাইমারী পার করেছে। বাবা মায়ের শীতল সম্পর্কটা টের পায় ওরা। ভাবে বড়রা এতো কিছু বোঝে, ছোটদের মনটা বোঝেনা কেন। বাবা মা না হাসলে যে বাচ্চাদের কান্না পায়, বাবা মা শাসন না করলে যে পড়াতে মন বসেনা। মায়ের হাতের প্রিয় রান্নাগুলিও যে বিস্বাদ লাগে। পেটে ক্ষিধে রেখেও খাবার ঠেলে উঠে যেতে হয়। বড় ছেলে শিমুল এদের মত করে ভাবে কিনা কে জানে। তবে একদিন কলেজ থেকে ফিরে মার চোখের দিকে তাকিয়ে সারাসরি জিজ্ঞেস করে – মা, বাবার খবর কিছু রাখো?
– না।
– এক কথায় জবাব দিয়ে আর শেষ করোনা মা।
মীনা যথা সম্ভব স্বাভাবিক থকার চেষ্টা করে বললেন
– কেন, কী হয়েছে?
– বাবাকেই জিজ্ঞেস করো।
না আর জিজ্ঞেস করতে হয় নি। ডোর বেলের আওয়াজে নিজে এগিয়ে যান দরজা খুলতে। খুলেই দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে মিজান। পাশে দাঁড়ানো সোনিয়া হাতে ছোট একটা সুটকেস। ধৈর্য্যরে সীমা ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন মীনা
– বাইরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এখন ঘরে মেহমানকে আনা হয়েছে?
মিজান কিছু বলে ওঠার আগেই সোনিয়া বলে ওঠে ধীর কন্ঠে
– সংযত হয়ে কথা বলেন, সরে দাঁড়ান। ঘরের মেহমান নই, আপনার মতই সমান অধিকার নিয়ে এসেছি।
তারানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিমুল একছুটে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সোনিয়ার হাতে ধরা সুটকেসটি ছিনিয়ে সামনে রাস্তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে অংগুলি নির্দেশ করে চেঁচাতে থাকে সারা শরীর কাঁপিয়ে
– চলে যান এখুনি, এই মূহুর্তে। আমার মায়ের বাড়িতে প্রবেশের কোনো অধিকার আপনার নেই।
তারপর মা’কে এক ঝটকায় ঘরের ভেতরে নিয়ে সশব্দে দরজা এঁটে দিয়ে মাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিমুল।
– এ কাজটা না করলে তোমার অবশিষ্ট সম্মানটুকুও ধুলায় মিশে যেতো। ছেলে হয়ে পুরোটাই দেখতে পারলামনা মা।
কঠিন অথচ ধীর কন্ঠে বললো মীনা
– কিন্তু তার আশ্রয়ে আমি থাকবোনা আর।
– কিসের আশ্রয়, কার আশ্রয়? ঐ লোকটাকে তুমি আশ্রয়দাতা ভাবছো এখনো ? তার ঠাঁই তো আর এখানে হতে পারেনা। এতটা বছরতো তুমি এবাড়িতে শুধু স্ত্রীর পরিচয়েই ছিলেনা, মায়ের পরিচয়েও ছিলে। যে স্ত্রীর পরিচয় তার মর্যাদাতো লেস মাত্র নেই আর। তুমি এখন এবাড়ির সন্তানদের মা। তোমার আশ্রয়ে আমরা। এই কঠিন সত্যটাকে না মানলে আমাদের মাথার ছায়াযে সরে যাবে। তুমি বাস্তবের মুখোমুখি হও মা প্লিজ।
মীনা এবার ছেলের চোখে চোখ রাখলেন, বড্ড অচেনা কেউ যেন। এই অগোছালো নির্লিপ্ত ছেলেটা এতো কথা কবে শিখলো, এতো ব্যথা শেয়ার করতে কে শেখালো ওকে। অদুরে দাঁড়ানো ছোট ছেলে দুটো অসহায় বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কাছে ডাকলেন ওদের। পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়ে বললেন
– যাদের মাথার ওপর এমন বড় ভাইয়ের ছায়া, তাদের এমন সামান্য ব্যাপারে ভয় পাবার কি আছে? শিমুল হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে তাকায় মার দিকে, বলে
– এই ছায়ার শক্তির উৎস যে তুমিই মা। আমাদের দিকে তাকাও, শুধু ভেঙ্গে পড়োনা।
তারপর যেন কিছুই হয়নি, কন্ঠে এমন স্বাভাবিকতা এনে তাড়া দেয় মাকে
-সেই কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চা দিবেনা মা?
বাইরের সমাধান এভাবে হলেও মীনার অন্তর পুড়তে থাকে নিভৃতে নীরবে।
স্বজনদের কেউ কেউ সমবেদনা জানালো, কেউবা এমন অনড় সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালো, কেউবা আবার মিজানকে নারী নির্যাতন আইনে ফাঁসিয়ে দেবার পরামর্শ দিল। উল্লেখ করার মত ব্যাপার হল মিজান সেই যে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে চলে গেল আর কখনোই এলোনা। মীনা ছেলেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন কঠিন সংগ্রামে। এই দশ বছরে অনেকটাই সামলে উঠেছেন চাপা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে কর্তব্যে কর্মে সচেতনতায় অভ্যস্থ হতে।
কিন্তু আজ সকালে তারানা ভাবির ফোন পাবার পর থেকে মনের মাঝে এ ঝড়কে বস করা যাচ্ছেনা কিছেুতেই। ঝড়ের দমকা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনকে ত্রিশ বছর আগে সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে।
– মা তুমি এখানে?
আয়নায় ছেলের প্রতিবিম্ব আর কর্নকুহরের চিরন্তন ডাকে চিন্তাচ্ছেদ ঘটে মীনার।
– আয় শিমুল বোস, কথা আছে।
শিমুল মার সামনে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে
– তুমি কি কিছু নিয়ে খুব ভাবছো মা?
– হ্যাঁ
– আমি অনুমান করতে পারছি। তারানা চাচী আমাকেও ফোন করেছিলেন। সেই মহিলা মারা গেছেন। উনার ধারনা বাবা এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হবেন। আমরা রাজি থাকলে তারানা চাচী বাবাকে ফিরিয়ে আনতে চান, আমাদের আবার আগের মত করে দিতে চান।
মীনা তাকালেন শিমুলের দিকে।
– চাইলেই কি আগের মত হওয়া যায়? হতে পারে কখনো? তোর বাবা ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার ধুলায় মেশা সম্মান? ফিরে পাবো আমি আমার সন্তানদের জীবন থেকে হারানো শৈশবের দশটি বছর? আমার সন্তানদের কষ্টে ভেজা দুহাতে ঠেলে পার করা দিনগুলির যন্ত্রনা?
– মা তোমার সন্তানদের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তুমি একাই তা এতোদিন চিনে এসেছো। আমরা শুধু তোমার দেখানো পাথ চলেছি, চলবো। তোমার বাড়িতে ঢোকার অধিকার সর্ম্পূণ তোমার সিদ্ধান্ত। তারানা চাচীকে এই কথাগুলোই আমি ফোনে বলেছি।
এরপরে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে হয়নি মীনাকে। সন্ধ্যে নাগাদ তারানা ভাবি এসেছেন, চা নাস্তা সেরে প্রতিবারের মত চলেও গেছেন। ছেলেরা শুধু চেয়ে দেখেছে তাদের মা যে একটা সিদ্ধান্তহীনতায় বেসামাল হচ্ছিলেন, চাচী যাবার পরে সে ভাবটা একেবারেই নেই আর। নিত্যকার মতই রান্নাঘর আর ছেলেদের ঘরে তদারকিতে ব্যস্ত হয়েছেন। টিভির খবর দেখেছেন। টালি খাতার হিসেবে ভ্রুকুচকে চোখও বুলিয়েছেন।
রাতে ছেলেরা যে যার ঘরে ঘুমিয়ে গেলে নিজ ঘরের লাগোয়া এক চিলতে ব্যালকনিতে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন মীনা। সারা দিনের বুকের জমাট বাঁধা বরফগুলো কষ্টের উত্তাপে গলিয়ে নিজেকে হালকা করতে। তারানা ভাবির কথাগুলো আবার বিছিয়ে দেখেন মীনা। মিজান সোনিয়ার দাম্পত্য জীবন ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে মনের মত করে সেজেছিল ঠিকই। ক’বছর বাদে সংসারে নতুন মুখও এসেছে কিন্তু তার পর থেকেই সোনিয়ার অসুস্থতা বেড়ে যেতে লাগলো। ধরা পড়লো কিডনি সমস্যা একেবারে শেষ ধাপে। প্রথমটায় ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় সোনিয়া একমাত্র কন্যা শিশুটির দায়ীত্ব মিজানের হাতে সপে দিয়ে অদ্ভুত একটা অবদার করে বসে – শত্রুপুরিতে যেন কখনই তার সন্তানকে নিয়ে মিজান না যায়। তারই নির্বাচিত পাত্রীর সাথে মিজানের বিয়েটা সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়ে মরতে চায়।
ফলাফল যা হবার তাই হল। সোনিয়ার মৃত্যু সংবাদে যারাই মিজানের ভেঙ্গেপড়া দেখবে বলে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিল, তারাই অকল্পনীয় আর একটি নতুন সংসারের ভিত্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে ফিরে এলো।
সারাবাংলা/এসবিডিই